আয়না দেখে আঁতকে উঠলুম। এ তো আমার সেই চিরকেলে চেহারা নয়! সেই যাকে ছোটবেলা দেখেছিলুম ন্যাড়া মাথা, নাকে সদি, চোখ ফুলো! তার পর দেখেছিলুম চুল খোঁচা, নাক খাঁদা, গালে-টালে কাজল! এই সেদিনও দেখলুম খাকি পেন্টেলুন, ময়লা শার্ট, মুখে কালি। এমন-কি, আজ সকালেও দেখেছি কালো কোট, ঝাঁকড়া চুল রাগী রাগী ভাব।
এ সেই চিরকেলে আমি নয়। দেখলুম বয়েস তের, মুখ ভরা নোংরা ঘেমো কাঁচাপাকা দাড়ি, ঝুলোঝুলো গোঁফ, চোখে নীল চশমা, গলায় হলদে লাল ডোরা কাটা কম্ফর্টার, গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কালো কোট, বুকের কাছে বোতাম নেই, মরচে ধরা সেফ্টিপিন আঁটা। -অবাক হয়ে গেলুম!
আয়নার পিছনে হাতড়ে দেখলুম কেউ যদি লুকিয়ে বসে থাকে । দেখলুম কেউ নেই, খালি কাঠের উপর আঙুলগুলো খমচ্ করে উঠল, নখের মধ্যে খানিকটা বানিশ না ময়লা কি যেন ঢুকে গেল।
বিরক্ত লাগল।
গলা হম্ করে সাফ করে বললুম, "কে?"
সেই লোকটা দাড়ি চুলকে মুচকি হেসে বলল, "ন্যাকা! চেন না যেন!” বলে এক হাতে গোঁফ আঁচড়ে উপরে তুলে দিল, অন্য হাতে দাড়ি খামচে নীচে ঝুলিয়ে দিল। দেখলুম নীচে আমারই নাকমুখ ঢাকাচাপা রয়েছে!
বললুম, "য়্যা !"
লোকটা সিঁড়ি না কি যেন বেয়ে তরতর করে খানিকটা উপরে উঠে গেল, চাপা গলায় বলল, "বাকিটাও পছন্দ হল কি?"
দেখলুম তার মুণ্ডু দ্যাখা যাচ্ছে না। তার জায়গায় নোংরা ধুতি হাঁটু অবধি, গোড়ালি ছেঁড়া লাল মোজা গুটিয়ে নেমেছে, পাস্যু'র ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে, নখগুলো আঁকাবাঁকা, ময়লা ঢোকা।
ব্যাপারটার কোনো দিক দিয়ে সুবিধে বুঝলুম না। মুণ্ডু ফিরিয়ে চলে গেলুম। যাবার আগে বাতি নিবিয়ে ছায়াটাকে নিকেশ করে দিলুম। তবু মনে হল আয়নার ভিতর বুনো অন্ধকার থেকে কে যেন বুড়ো মানুষ হ্যাঃ হ্যাঃ করে বিশ্রী হাসি হেসে আনন্দ করছে। কি আর বলব। রাগলুম, ভয়ও পেলুম। থেতে গিয়ে মনে হল সবাই যেন একটু অন্যরকম করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হল যেন সুবিধে পেলেই সব-কটা গোঁফের ফাঁকে ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে হেসে নিচ্ছে। যেন সেই বুড়ো লোকটার কথা আর গোপন নেই, সবাই জেনে ফেলে আমোদ করছে।
খাবারগুলো বদ লাগল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম। তবু রক্ষে নেই। যেখানে যাই, কে যেন নীল চশমা পরে সঙ্গে সঙ্গে চলে। ভালো করে লক্ষ্য করলুম কানে তার পাকা লোম, শোনবার সময়ে খাড়া হয়ে ওঠে। একবার জোর করে বললুম, "এইয়ো। আমি অন্য লোক। তুই কে রে?" বলতেই সে কোথায় মিশিয়ে গেল। শার্টের গলার চার পাশে আঙুল চালিয়ে তাগড়া হয়ে নিলুম।
এমন সময় গঙ্গুদা বলল, "এদিকে আয়।”
গেলুম-বাগ্ রে, না গিয়ে উপায় আছে? ও বাপু ভীষণ লোক। মুখে দাড়ি, রোগা শরীর, বাবাজিদের সঙ্গে ভাব। সাদা শিমুলের শেকড় খাইয়ে নাকি পড়া দাঁত গজিয়ে দিতে পারে।
দেখলুম সে চোখ পাকিয়ে, পায়ের পাতা উলটে, সটাং হয়ে খাটে বসে দুই হাঁটুতে হাত বুলুচ্ছে, মুখে একটা খিদে খিদে ভাব। বলল, "ঘাড়ে সুড়সুড়ি দে।" ভাবলুম বলি, 'এখন পারব না।' কিন্তু সে এমন কট্সট্ করে চেয়ে বললে-
ও পারে যেয়ো না ভাই, ফটিংটিংয়ের ভয়, তিন মিন্সের মাথা কাটা, পায়ে কথা কয়। তাদের সঙ্গেতে মোর চেনাশোনা আছে রে, সুড়সুড়ি না দিস যদি বিপদ ঘটতে পারে রে।
দেড়টি ঘণ্টা সে গুনগুন করে গাইতে লাগল-
কেরোসিন। কেরোসিন!
কেরোসিনের সুবাতাসে
মহাপ্রাণী খইসে আসে,
খাও, খাও, ভইরে টিন, কেরোসিন। কেরোসিন।
রেগে ভাবলুম দিই ব্যাটার ঘাড়ে চিষ্টি। সে আরো গাইল-- অনুতাপে দগ্ধ হবি, ড্যাও দুদু চেটে খাবি।
জিগেস করলুম, "ড্যাও দুদু কি ?" বললে, "ভ্যাঁও পিঁপড়ের দুধ। দে, সুড়সুড়ি দে, অত খবরে কাজ কি?"
খানিক পরে আয়নার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখলুম আবার সেই লোকটা। এবার আবার মাথায় মাল্কি ক্যাপ্। বড় কান্না পেল। বললুম, "এমনিই তো যথেষ্ট ছিল, আবার ওটা কেন?"
সে বললে, "হ্যাঃ। গঙ্গুদাকে ভয় পাও, আবার কথা! দু কানে যে তুলো গুঁজি নি সে তোমার ভাগ্যি আর আমি দয়ালু বলে। ছ্যাঃ, এত প্রাণের ভয়।"
আবার বললুম, "একটু আগে তো অমন ছিল না। ওটা খুলে
ফেলুন বড় বদ, বড় বদ।"
সে বললে, "তাপর অনেক জল বয়ে গেছে, অনেক জিনিস অদল- বদল হয়ে গেছে। আর চল্লিশটা বছর সবুর কর, এই এমনটিই হবে। ছ্যাঃ। গঙ্গুটাকে মানুষ হতে দেখলুম, তাকে ভয় পায়! আরে তার দাঁত পড়তে ক্যায়সা চেঁচিয়েছিল আজও মনে আছে।" চোখ পিট্ পিট্ করে বললুম, "আপনি বুড়ো মানুষ, আর কি বেশি বাঁচবেন!"
লোকটা চকাত্ চকাত্ করে হেসে বলল, "ফ্যাচর। ফ্যাচর। সেই আনন্দেই থাকো! বুঝলে না হে? আমিই হচ্ছি তুমি। তুমি যেমন ভীতু, কাপুরুষ, হাঁদা, বুড়ো হলে আমার মতন সাবধান-সাবধান গোছের হবে। তাই তো আমার রাগ ধরে। ইচ্ছে করলেই লক্ষ্মী- ডাক্তারের মতন হতে পারো। হাফপ্যান্ট আর মাদ্রাজি চটি পরে ফলমূল খেয়ে তেজী-তেজী ভাবে ঘুরে বেড়াতে পারো। তা নয়। আরে ছোঁড়া, ঐ তো টিকটিকির মতন শরীর, ছারপোকার মতন মন! অত ভয় কিসের? এতে অসুখ করবে, ওতে বকুনি খাব, অত ভাবনা কেন? কর আরো, আর এইরকম চেহারা হবে। আজ মাল্কি ক্যাপ্, কাল মাথায় কম্বল মুড়ি। আরে হতভাগা তোর মতো একটা অপদার্থ মলেই-বা কি?"
এই অবধি শুনে এমন রাগ হল যে ঠাস্ করে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম।
তাতে এক আশ্চর্য কান্ড হল।
চড়ের চোটে গাল ঘুরে গেল! দেখি ওমা! সে লক্ষ্মীডাক্তার হয়ে
গেছে! একগাল হেসে সেলাম ঠুকে বললে, "সাবাস্ বেটা। এই তো চাই।" বলেই কোথায় মিলিয়ে গেল। তার পর থেকেই লোকে আমায় বলে: আর তাকে দেখি নি। কিন্তু "তেজী বুড়ো।"