ঠিক যেই নিতাইদের বাড়ির পেছনের সেই ঝাঁকড়ান্ডুলো ঝোপটার কাছে এসেছি, পকেট হাতড়ে দেখি যে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! সেই কোনা-মোড়া আধ-ময়লা নোটটা কে যেন বুক-পকেট থেকে তুলে নিয়েছে!
ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ের চোটে কোট খুলে, শার্ট-প্যান্ট ঝেড়ে-ঝুড়ে ভালো করে খুঁজে দেখলাম। জুতো-মোজা খুলে তার ভেতরে হাতড়ে দেখলাম। কোথাও কিছু নেই।
গলা শুকিয়ে গেল। বাবা যে রোজ বলেন আমার আলজিবটা আর টনসিল-দুটো বেড়ে-বেড়ে গলার ফুটো একেবারে বন্ধ করে ফেলেছে, এ কথা যে সত্যি তা টের পেলাম। চুলগুলো শির-শির্ করে একে-একে সব উঠে দাঁড়াল, আর তার ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা মতন কিসের হাওয়া বইতে লাগল। আজকে ঐ নোট হারানো মানে একেবারে আমার সর্বনাশ হওয়া। পিসিমা বার বার বলে দিয়েছেন-তাঁর সেমিজের ছিট হ-গঞ্জ, তাঁর নাতির হাতওয়ালা গেঞ্জি দুটো, হলদে জুতো একজোড়া- আমার মাপের হলেই চলবে, এই-সব কিনে যদি কিছু বাকি থাকে, সেই দিয়ে আমার সেই রঙিন খড়ির বাক্স কিনতে পারি। আর, সে বাক্স আজ না কিনলে, কাল ইস্কুলে আমার যে কি অবস্থা হবে, তা জানবে শুধু গোবিন্দবাবু আর আমি, আর ক্লাসের বাকি উনত্রিশটা ছেলে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবধি কি কি করেছিলাম, ভালো করে ভেবে দেখলাম। গেটের বাইরের সেই আশ্চর্য লোকটার কথা টপ্ করে মনে পড়ে গেল। এখন মনে হল, তার মুখটা কেমন চোর-চোর মতন। তখন বুঝতে পারি নি। ভেবেছিলাম-চেনা-চেনা লাগছে কেন? মনে পড়ল যে শুনেছি, কানের লতিটা ঝলঝুল না করে মাথার সঙ্গে জোড়া থাকলে বুঝতে হবে লোকটা সুবিধের নয়। তায় আবার চোখদুটো সরু-সরু লম্বা-লম্বা, নাকের দু-পাশে খুব কাছাকাছি পিট্-পিট্ করছে। ঝাঁটার মতো গোঁফ, তিনদিনের দাড়ি। ও-ই চোর না হয়ে যায় না। ওরু সারা মুখে যেন তাই লেখা আছে।
আমি কেন তখন টের পাই নি? সে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে বলেছিল, "দেশলাই আছে?" আমি রেগে বলেছিলাম-"আমি বিড়ি খাই না।" সে বলেছিল, "বিড়ির জন্য নয়। আমারও গুরুদেবের বারণ আছে। হুঁকো?-হ্যাঁ। চুরুট-হ্যাঁ; পাইপ?-হ্যাঁ। কিন্তু বিড়ি কখনো না। আমার একটা দরকারি কাগজ পড়ে গেছে কিনা, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না, তাই ?"
তখন দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা খুঁজলাম। নিশ্চয় সেই সময়ে কখন টুপ্ করে আমার সেই কোনা-মোড়া আধ-ময়লা দশ- টাকার নোটখানি সে তুলে নিয়েছে। মনে হল 'পেয়েছি' বলে সে এমনি হঠাৎ ঘুরেছিল যে, আমি তার পেছনের ধাক্কা খেয়ে ধপ্ করে মার্টিতে বসে পড়েছিলাম। সে-ই যে চোর-এর কোনো সন্দেহ নেই।
তখুনি ফিরে তার সন্ধানে চললাম। অন্ধকারে তাকে চিনতে না পেরে একেবারে তার উপর দিয়ে আরেকটু হলেই হেঁটে যাচ্ছিলাম। সে জামা-টামা ঝেড়ে বলল, "কিছুতে তাড়া করেছে নাকি?" আমি বললাম, "না, তোমার সঙ্গে সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করল।"
সে কিছু না-বলে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার এগুতে লাগল।
পথে তার সঙ্গে অনেক কথা হল, কিন্তু আমার মনটা তার বুক- পকেটের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগল। একটু দূরে বাস-স্টপের কাছে এসে বলল, "আর হাঁটা যায় না।
চল, বাসে যাই।"
দুজনে বাসে উঠলাম, পাশাপাশি বসলাম। কন্ডাক্টর পয়সা চাইলে, সে-ই দুজনের হয়ে টিকিট কাটল। ভাবলাম-হঠাৎ বড়লোক হয়েছে, তা আর কাটবে না?
দুজনেরই ঘুম পাচ্ছিল। এক দিক দিয়ে ভালোই। আমি চাই সে ঘুমোয়, আবার আমি সুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবে না। সে চাই কি আমার জুতোজোড়াটা হয়তো পা থেকে খুলে নিয়ে নেমে পড়বে। কন্ডাক্টরের তো উপর দিকে এত বড় পাগড়ি আর নীচের দিকে এত বড় দাড়ি যে, কিছু দেখতে পায় কিনা সন্দেহ।
তাই আমি তাকে মামাবাড়িতে ডাকাত পড়ার একটা গল্প বানিয়ে বানিয়ে আস্তে আস্তে একটানা সুরে বলতে লাগলাম, আর সে একটু অন্য দিকে তাকালেই আস্তে আস্তে তার পিঠ চাপড়াতে লাগলাম, যাতে সে শিগ্ গির ঘুমিয়ে পড়ে। সেই একঘেয়ে গল্পের চোটে আমার সুদ্ধ ঘুম পেতে লাগল।
হঠাৎ চমকে দেখি, সে তার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে ঘুমোচ্ছে, মাথাটা বাসের ঝাঁকুনিতে একটু করে নড়ছে, আর বুক-পকেটটা একটু হাঁ হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে ভাঁজ-করা একটা কোনা-মোড়া আধ- ময়লা দশ-টাকার নোট!
আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আমি এদিক-ওদিক দেখে হঠাৎ টুপ করে সেটি তুলে নিলাম।
প্যান্টের পকেটে সবে পুরেছি, বাসটা একটা ঝাঁকুনি দিল আর সেও সোজা হয়ে বসে চোখ রগড়াতে লাগল। আমি যত জোর করে আমার চোখদুটোকে অন্য দিকে ঘুরোতে চাই, সে-দুটো তবু ফিরে-ফিরে ওর ঐ হাঁ করা পকেটের দিকে তাকায়।
বাস থেকে নেমে বাঁচলাম। সে এক দিকে চলে গেল, আমি আরেক দিকে চলে গেলাম। ছিট কিনলাম, গেঞ্জি কিনলাম, জুতো কিনলাম, খড়ি কিনলাম। যতক্ষণে বাড়ি ফিরলাম, সেই লোকটার কথা ভুলেই গেছি।
বাড়ি এসে পিসিমাকে জিনিসপত্র দিয়ে ঘরে গিয়ে পড়ার টেবিলে গুড়ি রাখতে যাব, যা দেখলাম তাতে আমার একেবারে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! পেটের ভিতর কিরকম করতে লাগল্প, টনসিল দুটো আবার বড় হয়ে গলাটাকে ঠুসে ধরল!
দেখলাম-দোয়াত চাপা দেওয়া কোনা-মোড়া আধ-ময়লা দশ-টাকার নোটটা-সেই যে বাড়ি থেকে বেরোবার আগে জুতো পরবার সময় যেমন রেখেছিলাম, ঠিক তেমনটি রয়েছে!
সেই লোকটার পকেট থেকে নেওয়া ও খরচ-করা সেই নোটটার কথা মনে করে আমার হাত-পা যেন পেটের ভিতর সেঁদিয়ে গেল।
কাকে কি বলব?