জন্তু জানোয়ারদের বিষয়ে কতরকম অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায় তার আরু ঠিক নেই। একবার নাকি একটি ব্যাঙ কেমন করে পাথরের ফোকরের মধ্যে বদ্ধ হয়ে গিয়ে, ঐভাবে কতকাল যে ছিল তার ঠিক নেই। বোধ হয় অনেক শো বছর। তার পর যেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হল, অমনি সে চাঙা হয়ে উঠে বার দুই চোখ মিট্সিট্ করে, থন্থপ্ করে কোথায় চলে গেল, যেন কিছুই হয় নি।
তার পর আরেকটা অদ্ভুত গল্প শুনেছিলাম, গোবি মরুভূমিতে কয়েকজন ভূপর্যটক নাকি বিরাট বিরাট গোল গোল পাথরের মতো কি পেয়েছিলেন, সেগুলি ভেঙে দ্যাখেন কোনো অতিকায় জানোয়ারের ডিম। বালির মধ্যে থেকে ভিতরটা একটুও নষ্ট হয় নি।
এ-সব গল্পের সত্যিমিথ্যা সম্বন্ধে অবশ্য আমি কিছুই বলতে চাই না, তবে চেনা-জানা জানোয়ারদের মধ্যে, একবার একজন বাঘ-শিকারীর কাছে একটি মজার বাঁদরের গল্প শুনেছিলাম। তাঁর নাম মুকুন্দবাবু তিনি তো বলেছিলেন গল্পটা সত্যি।
একবার নাকি তাঁরা লোকজন নিয়ে মধ্য ভারতের কালাহান্দীর ঘোর জঙ্গলে বাঘ শিকারে গেছেন। গভীর বনের মধ্যে তাঁবু গেড়েছেন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে অবধি কানে আসছে একটা অনর্গল গুনগুন্ শব্দ। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখেন, বিরাট এক বোলতার চাক, লম্বা হয়ে নিচু একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে। হাজার হাজার বোলতা যাওয়া আসা করছে, আর গুনগুন্ শব্দ হচ্ছে।
তাঁবুর সামনে বসে মুকুন্দবাবু মজা দেখছেন। চাক থেকে নীচে মাটির উপর টুপ্ টুপ্ করে মধু পড়ছে, প্রজাপতিরা উড়ছে, পাখিরা কিচির- মিচির করছে। এমনি সময় চোখ পিটির্-পিটির্ করতে করতে এক বাঁদর-ছানা এসে হাজির। ছোঁক্-ছোঁক্ করতে করতে একেবারে চাকের তলায় গিয়ে উপস্থিত।
চাকটা খুব নিচু ডালে ঝুলছে, বাঁদর-ছানা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাই দেখল। তার পর আঙুল দিয়ে মাটি থেকে একটু মধু তুলে নিয়ে চেটে খেল।
ইস্! কি ভালো রে! আরেকটু পেলে হয়।
এই ভেবে বাঁদর-ছানা চাকটাকে একটু ঠেলে ঠুলে দেখতে লাগল। হয়তো-বা একটা বোলতাকে চিপে দিয়ে থাকবে, কি যে কারণেই হোক, কোথেকে এক বোলতা এসে দিয়েছে হুল ফুটিয়ে। আরে বাপ্! আর যায় কোথা! ঐ ছোট বাঁদর-ছানা মানুষের মতো হাত ঝেড়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, সাংঘাতিক ক্যাও-ম্যাও করে, জঙ্গলটাকে একেবারে মাতিয়ে তুলল। তার পর চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে দৌড়তে দৌড়তে সে তো সেখান থেকে ভাগল।
কিন্তু একটু বাদেই, ওমা, কোত্থেকে এক ধাড়ী বাঁদরকে সঙ্গে এনে হাজির! চাকের কাছে এসে কিচির-মিচির হুকুহুকু করে কি যে না বলল তার ঠিক নেই ।
তার পর ছানা বাঁদর তফাতে দাঁড়িয়ে রইল, ধাড়ী বাঁদর খুব সাবধানে গুঁড়ি মেরে চাকের কাছে এসে উপস্থিত হল। ততক্ষণে বেলা একটু বেড়েছে, বোলতারা বেশির ভাগই চাকের মধ্যে ঢুকেছে, মাঝে মাঝে একটা- একটা বেরুচ্ছে, আর উড়ে চলে যাচ্ছে।
বুড়ো বাঁদর খানিকক্ষণ ধরে চাকটাকে খুব নজর করে দেখল। তার পর গম্ভীর মুখ করে বাঁ হাতের তেলো দিয়ে বেরুবার গর্তটাকে চেপে ধরল। হানা বাঁদর দূর থেকে হাঁটুর উপর হাতের ভর দিয়ে কান্ড দেখতে লাগল যেই-না ভিতর থেকে একটা বোলতা বেরুতে চায়, বুড়োর হাতে সুড়সুড়ি লাগে বোধ হয়, আর অমনি সে হাতটা একটুখানি ফাঁক করে ডান হাত দিয়ে খপ্ করে বোলতাটাকে ধরে, দাঁত দিয়ে কামড়ে মুণ্ড ছিড়ে নিয়ে, বোলতাটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। হাতের তেলোর চামড়া এমনি পুরু যে তাই বোধ হয় বোলতারা আর হুল ফুটোতে পারে না!
তাঁবু থেকে মুকুন্দবাবু অবাক হয়ে দেখলেন যে দেখতে দেখতে বাঁদরের পায়ের কাছে, ছোটখাটো একটা বোলতার ঢিপি জমে গেল। ছোট বাঁদরটা তখনো মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তার পর মুকুন্দবাবুরা কাপড় চোপড় পরে, দলবল নিয়ে, শিকারের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
ফিরলেন সেই সূর্য ডোবার সময়, ক্লান্ত শরীরে। তাঁবুতে ফিরে, স্নান সেরে, বাইরে এসে ডেক-চেয়ারে পা মেলে বসলেন। চারি দিকে ফুফুট্ করছে জ্যোৎস্না। হঠাৎ মুকুন্দবাবু দারুণ চমকে উঠলেন। কি সর্বনাশ, ঐ না ছানা বাঁদরটা এখনো সেইখানে দাঁড়িয়ে উত্তেজনার চোটে একবার এ পায়ে, একবার ও পায়ে, লাফাচ্ছে।
বুড়ো বাঁদরও বোলতার চাকের তলায় বসে আছে আর তার পাশে দেড়হাত উঁচু একটি বোলতার পাহাড়। তখনো সে একমনে একটির পর একটি বোলতা কামড়ে চলেছে। যতক্ষণ মুকুন্দবাবু জেগে রইলেন বাঁদর দুটোও নড়ল না।
তার পর ওরা তো খেয়েদেয়ে শুতে গেলেন। পরদিন সকালে উঠে দ্যাখেন, বাঁদর দুটো কখন চলে গেছে। বোলতার চাকের তলায় একটা বোলতার পাহাড়। আর সকালবেলার রোদে প্রজাপতিরা উড়ছে, পাখিরা কিচির-মিচির করছে, কিন্তু বোলতাদের কোনো সাড়া-শব্দ নেই।