পঁয়ষট্টি বছর আগে আমার মামাবাড়ির দেশে এক দিকে যেমন সাধু- সজ্জনের ভিড় ছিল এবং তার ফলে পুজোপার্বণ, তিথিপালন, হরির লুট, ব্রাহ্মণ-ভোজন, কাঙালী-বিদায় লেগেই থাকত, আবার তেমনি অন্য দিক দিয়ে ঠগ-ঠ্যাঙাড়ে, জোচ্চোর-বাটপাড়েরও এমনি উপদ্রব ছিল যে, দিনের বেলাতেও কেউ একা নির্জন পথে বেরুতে সাহস পেত না!
তখন লোকের অবস্থাও ছিল ভালো। খাওয়া-দাওয়ার কারো অভাব ছিল না, পুকুরে প্রচুর মাছ, গোয়াল-ঘরে বড়-বড় দুধী গাই বাগানে অপর্যাপ্ত শাকসবজি, ফলপাকুড়, কোনো ভিখিরি কখনো গৃহস্থের বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরে যেত না।
কিন্তু তা হলে হবে কি? দুষ্টুলোকদের ঠেকানো কারো সাধ্য নয়। উপরন্ত দু-একজন ছিচকে চোর ছাড়া কেউ বড়-একটা ধরাই পড়ত না, তা তাদের সাজা দেওয়া হবে কি করে? সে সময়ে ঐ অঞ্চলের জেলখানাগুলো বারোমাস খালি পড়ে থাকাতে গ্রামের পঞ্চায়েতের পরামর্শে নাকি সে-সব ঘরগুলি গরিবদের কাছে অল্প দামে ভাড়া দেওয়া হত, আর ঐ ভাড়ার টাকা থেকে শীতকালে ঐ গরিবদেরই লাল কম্বল কিনে দেওয়া হত। কিন্তু সৎকাজের সব সময় ভালো ফল হয় না। চুরি-ডাকাতি উত্তরোত্তর বেড়েই যেতে লাগল।
শেষকালে এমন হল যে, সরকারি খাজাঞ্চিখানার এক দিকের দেয়াল রাতারাতি কারা কেটে নিয়ে যথাসর্বস্ব তো নিয়ে গেলই, উপরন্ত দেয়ালের ইটগুলি খুব মজবুত হওয়াতে সেগুলিকে সুদ্ধ যে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল, ঢাকার সব দাগ থেকেই তা বোঝা গেল। সমস্ত অস্ত্রধারী পাহারাওয়ালা, চৌকিদার, জমাদারদের মুখে কাপড় বেঁধে একটা ছোট কুঠরিতে তালাচাবি বন্ধ করে এই কাজটি সারা হল, বাইরের কাকপক্ষীটি কিছু টেরই পেল না। পাহারাওয়ালারা শুধু এইটুকু বলতে পারল যে, লোকগুলো দারুন মণ্ডা আর বীভৎস সব মুখোশ দিয়ে সারা মুখটা ঢাকা।
এত-সব উপদ্রবের মধ্যে যে আমার মামাবাড়ির লোকরা নিশ্চিন্ত আরামে বসবাস করতে লাগলেন, ছেলেমেয়েদের পৈতে ও বিয়ে উপলক্ষে তাল তাল সোনার গয়না গড়িয়ে, পাড়াসুদ্ধ সকলকে দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন, তার একমাত্র কারণ হল নাকি ওদের গুরুদেবের আশীর্বাদ।
আমার ছোটমামার কাছে শুনেছি যে গুরুদেবটি যে-সে লোক ছিলেন না। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা দুই হাত, মানুষটি। আর শরীরে সে কি শক্তি! মোষের শিং চেপে ধরে তাকে এমনি ফরসা রঙ, তাল-ঢ্যাঙা একবার বাঁ হাতে একটা পাগলা বশ করে ফেলেছিলেন যে সেই অবধি সে কুকুর-বাচ্চার মতো তাঁর পিছনে-পিছনে ঘুরত, কেউ কাছে এলেই ল্যাজ নাড়ত।
গুরুদেবের অবিশ্যি খুবই নামডাক, খুবই চাহিদা, তাই বারোমাস গাঁয়ে থাকা তাঁর ঘটে উঠত না। দুটি শিষ্য নিয়ে আসতেন যেতেন, দুদিন এর বাড়ি দুদিন ওর বাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করে সকলকে আশীর্বাদ করে চলে যেতেন। ঠিক আতিথ্যও বলা যায় না, কারণ সাধুসজ্জন মানুষ, কারো বাড়ির মধ্যে পদার্পণ করতেন না, উঠোনে তাঁদের জন্য কানাৎ ফেলা হত। নিজেরা রান্না করে নিরামিষ খেতেন, তার জন্য কাঁচা ফল, তরকারি, দুধ, ছানা শিষ্যরা জোগান দিত। টাকাকড়ি যে যা পারত প্রণামীও দিত, কিন্তু গুরুদেব কখনো কিছু চাইতেন না। লোকে খুশি হয়ে চ্যালাদের হাতে যা-খুশি দিত। তারাও সেটাকে খুশি হয়ে মাথায় ঠেকিয়ে ছোট একটা কালো সিন্দুকে তুলে রাখত। যাবার সময় সিন্দুকটি কাঁধে করে নিয়ে যেত, আবার দরকার হলে গরিব-দুঃখীকে সিন্দুক খুলে টাকা-পয়সা দানও করত।
গুরুদেবের ক্ষমতাও ছিল অনেক। ফোঁটা দিয়ে, বড়ি দিয়ে, মাদুলি দিয়ে সাধারণ রোগ তো সারিয়েই দিতেন, আবার তেমন কঠিন ব্যামো হলে অনেক সময়, চাই-কি, শহরের হাসপাতালে যাবার খরচটাও দিয়ে দিতেন! কাজেই লোকে যে তাঁদের দেবতার মতো ভক্তি করবে এতে আর আশ্চর্য কি?
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, গাঁয়ের বুড়োরা গুরুদেব সম্বন্ধে যতটা উৎসাহী ছিলেন, ছেলে-ছোকরারা ততটা ছিল না। বিশেষ করে আমার ছোটমামা ও তাঁর বন্ধুরা! তার একমাত্র কারণ অবিশ্যি হিংসে ছাড়া আর কিছু নয়।
গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা ছাড়া তাদের মনে আর কিছুই থাকা উচিত ছিল না। কারণ ধর্মের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু গুরুদেব যাদের বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দিয়েছেন, তাদের বাড়ির লোকদের আর কখনো যে কিছু খোয়া যেত না এটা তো কম কথা নয়!
সমস্ত শীতটা গুরুদেব গাঁয়ে থেকে ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে চলে যেতেন। আবার পৌষ পড়লে এসে হাজির হতেন। মাঝের কটা মাস গাঁয়ের লোকেরা তাঁর আগমনের আশাতেই কাটিয়ে দিত। আর এমনি ছিল তাঁর তেজের মহিমা যে কেউ যদি তাঁর অনিষ্ট বা নিন্দামান্দা করেছে তো তার একটা বড় ক্ষতি হবেই হবে। ফিরে এসে তাই শুনে অবিশ্যি গুরুদেব খুবই দুঃখ করতেন।
একবার ছোটমামা পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। পাড়ার কতকগুলি আড্ডাবাজ ছেলে মিলে একটা ক্লাব খুলেছিল। সেখানে তাস পেটা, জুয়ো খেলা, লুকিয়ে লুকিয়ে সবই চলত। ছোটমামা তাঁর একটি গুণধর বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ওর মধ্যে জড়িয়ে পড়েন, মেলা টাকা হেরে শেষটা আর উপায় না দেখে গাঁয়ের মহাজনের কাছে ধারধোর করে, সে-সব শোধ না করেই, আবার ছুটির শেষে কলকাতার কলেজের মেসে পালিয়ে গেলেন।
এদিকে মহাজন মহা চটে গিয়ে চিঠি লেখালেখি শুরু করেছে, বাড়িতে বলে দেব বলে ভয় দেখাচ্ছে। ছোটমামার বয়স তখন আঠারো কি উনিশ হবে, সেরকম বুদ্ধিও পাকে নি। বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। তখন হঠাৎ গুরুদেবকে মনে পড়ল। কতবার ঐ গুরুদেবকে নিয়েই বন্ধুমহলে হাসি-তামাশা করেছেন। এবার বিপদের সময় কিন্তু মনে-মনে দিনরাত গুরুদেবকে ডাকতে লাগলেন। আর কেবলই মনে হতে লাগল যে গুরুদেব নিশ্চয় একটা হিল্লে করে দেবেন।
হলও তাই। পুজোর ছুটিতে দারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে আবার দেশে যাচ্ছেন। পথে সন্ধ্যা নেমে গেছে, চার দিক অন্ধকার করে দারুণ মেঘও করেছে। মাঝপথে ছোট একটা জংশনে গাড়ি বদল করতে হয়। স্টেশন মানে একটা শেডের মতো, তারই পাশে একটা কুঠরিতে স্টেশন- মাস্টারের আপিস, আর শেড বোঝাই গুড়ের নাগরি ও দিশি খেজুরের তাল। সবটা থেকে একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ বেরুচ্ছে। সেই আধো- অন্ধকারে মিনিট-পনেরো অপেক্ষা করতে হবে।
ছোটমামার তো বুক টিপি করছে। খালি মনে হচ্ছে গুড়ের ভাঁড়ের ওপাশে যেন দুটো লোক গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে! তার পর যেই-না দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছোটমামা দু-পা এগিয়েছেন, অমনি অন্ধকারের মধ্যে থেকে দুটো কালো মুস্কো লোক এসে তাঁর দু-ঘাড়ে বিরাশি সিক্কা ওজনের দুই হাত রেখেছে। ছোটমামা তো পাথর হয়ে গেছেন!
কানের কাছে মুখ এনে একজন বললে-"ইস্, ভারি ভালোমানুষ বনে গেছিস দেখছি! খ্যাদা নাকের উপর আঁচিলটা না দেখলে তো চিনতেই পারতাম না। নে ধর, ভণ্ড কোথাকার! তোর আশায় বসে- বসে হাত-পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে।" ততক্ষণে ট্রেনটাও এসে লেগেছে, আর দু-চারজন লোকও স্টেশন-মাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে! লোক দুটো ছোটমামার মুঠোর মধ্যে একটা ছোট কালো থলি একরকম জোর করে গুঁজে দিয়ে নিমেষের মধ্যে পিটান দিল। এক হাতে নিজের প্ল্যান্ড স্টোন ব্যাগ, অন্য হাতে থলিটা নিয়ে ছোটমামা গুটিগুটি সামনেই যে গাড়ি পেলেন তাতে উঠে পড়লেন। গাড়িও ছেড়ে দিল।
এতক্ষণে ছোটমামার জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে এসেছে, নেড়ে দেখেন, ব্যাগটা দারুণ ভারী। চার দিকে চেয়ে দেখেন গাড়িতে আর দ্বিতীয় মানুষ নেই, ভুল করে ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে পড়েছেন। তখনকার দিনে গাড়ির আলো এত উজ্জ্বল ছিল না, সেই টিফ্লিমে আলোতেই থলির মুখের দড়ি খুলে, একবার তাকিয়েই ছোটমামা আরেকটু হলেই মূর্ছা খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন! থলিটার গলা অবধি হীরে, জহরৎ, সোনার গিনি ঠাসা! সব চেয়ে উপরে একটা লাল পাথরের আংটি জ্বল্-জ্বল্ করছে, তার গায়ে মকরের মুখ খোদাই করা।
"জয় গুরুদেব" বলে এক মুঠো গিনি যেই-না ছোটমামা হাতে করে তুলেছেন, অমনি জানলা দিয়ে একটা যমদূতের মতো লোক গলে এসে- তখন জানলায় শিক লাগানো থাকত না-ঝুপ্ করে সীটের উপর পড়ল। ছোটমামা অবাক হয়ে দেখলেন, তার কুকুচে কালো হাতে একটা বেঁটে মোটা মুগুরের মতো কি, আর মুখে একটা বিকট মুখোশ, তার নাকের কাছটা ফাঁকা। সেইখান দিয়ে খ্যাদা একটা কালো নাক বেরিয়ে রয়েছে, তার উপরে বিরাট একটা আঁচিল!
লোকটি হাত বাড়িয়ে বলল-"বা-ব্বা! দিব্যি তো গুছিয়ে নিয়েছ চাঁদ! এবার দাও দিকিনি থলিটা! খুব লোক বাবা তুমি!" ছোট- মামা কোনো আপত্তি না করে থলিটা তার হাতে দিয়ে দিলেন। গিনি- গুলিও দিয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু লোকটা ফিক্ করে হেসে থলির মুখ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। "আহা, অত ভালোমানুষি নাই-বা দ্যাখালে! উটি তোমার টিপিন খাবার পয়সা বলেই নয়তো রেখে দাও।" বলে এক লাফে যেরকম ভাবে এসেছিল, তেমনি ভাবে জানলা গলে চলে গেল! ছোটমামা বার বার গুরুদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে গিনি কটি পকেটস্থ করলেন।
তার পর যথাসময়ে দেনা শোধ করে ছোটমামা কুসঙ্গ ত্যাগ করে, আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেবের আগমনের অপেক্ষায় থাকলেন। পৌষ মাসের আরম্ভেই শ্যামলবাবুদের বাগানে গুরুদেবের তাঁবু পড়েছে শুনে ছোটমামা আগে-বাগে ছুটে গিয়ে গুরুদেবের দুই পা জড়িয়ে ধরলেন। গুরুদেবও উদ্ধত ছেলেটার সুমতি হয়েছে দেখে মহা প্রসন্ন হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন, আর পাশের ফুলের সাজি থেকে একটা আশীর্বাদী স্থল-পদ্ম তুলে তার হাতে দিলেন।
ছোটমামা হাত জোড় করে ফুল নিতে যাবেন, হঠাৎ চোখে পড়ল গুরুদেবের ডান হাতের বকবার আঙুলে একটা লাল পাথর-দেওয়া আংটি স্বন্দ্বল্ করছে, তার গায়ে মকরের মুখ খোদাই করা। ভীষণ চমকে গিয়ে ছোটমামা গুরুদেবের মুখের দিকে চাইলেন। গুরুদেব দু-চোখ বুজে মুচকি মুচকি হাসছিলেন।