আজকাল সবই অন্যরকম লাগে। দরজার কড়া নাড়বামাত্র ভিতর থেকে একটা ভারী জিনিস দরজার উপর আর আছড়েও পড়ে না। নখ দিয়ে কেউ দরজায় আঁচড়িয়ে, পালিশ উঠিয়ে, বকুনিও খায় না; ঘরে ঢুকবামাত্র নেচেকঁদে গায়ের উপর চড়ে একাকারও করে না। মিনু শংকর কেউ কারো দিকে তাকায় না।
শোবার ঘরের মেজেটা অদ্ভুতরকম খালি-খালি লাগে; অদ্ভুত চুপচাপও, খচ্ করে কেউ চলে বেড়ায় না, থপ্নপ করে কানের উপর ল্যাজ আছড়ায় না।
শুধু পিসিমা একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, "আঃ, আপদটা বিদায় হয়ে ঘরদোরগুলো যেন কেমন হালকা হয়ে গেল। এবার একটু নিশ্চিন্দি হয়ে হাত-পা মেলে বসা যাবে। সদাই ভয়ে- ভয়ে থাকতাম ঐ বুঝি ক'ন্ থেকে কিসে মুখ দিয়ে আমায় এসে চাটল! আর তোদেরও বাবু বলিহারি! ঠাকুরদা ত্রিসন্দে জপতপ না সেরে জলস্পর্শ করত না, আর তোদের কিনা ঐ কুত্তোটার সতে একপাতে না খেলেই নয়। অস্বীকার করিস নে, স্বচক্ষে দেখেছি টেবিল থেকে সব চুপি চুপি প্লেট নামানো হচ্ছে!"
মিনু শংকর কেউ অস্বীকার করল না। কোনো কথাই বলল না। নিঃশব্দে যে যার বই বের করে নিয়ে পড়তে বসে গেল। সাবধানে ঘুরে বসল যাতে আলমারির ঐ কোণটাতে যেখানে পুরনো সবুজ কম্বল- খানি পাতা থাকত সেদিকে চোখ না পড়ে!
পিসিমার কথা শুনে বাবা দোরগোড়ায় একবার দাঁড়িয়েছিলেন, এবার তিনিও নিঃশব্দে পাশের ঘরে চলে গেলেন। শুধু মা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, "হ্যাঁ, আর তার জন্য কোনো হাঙ্গামা নেই।"
পিসিমা একটু অবাক হয়ে মার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, "হাঙ্গামাও নেই, বউ, খরচাও নেই। ওর পেছনে তোমরা এ ক-বছরে যা খরচ করেছ, তাতে এক-আধটা গরিব ছেলের স্বচ্ছন্দে খাওয়া-পরা চলে যেত। সেজদিদিরাও বলছিল, তোমাদের সব-তাতেই বাড়াবাড়ি। কুকুরের জন্য রোজ রোজ দুধ রে, পাঁউরুটি রে, মাংস রে-এ-সমস্ত বাড়াবাড়ি।"
মিনু শংকর আস্তে আস্তে বই হাতে করে উঠে গেল! মা বললেন, "তা হলে জন্তু-জানোয়ার না পোষাই উচিত, ঠাকুরঝি!"
"হ্যাঁ, পুষতে হয়, গোরু মোষ পোষ, দুধটা পাবি। নিদেন একটা ছাগলই পোষ, তার দুধেরও ভারি গুণ, মহাত্মাজি খেতেন। নয়তো বেড়াল পোষ, ইঁদুর মারবে। তা নয়, এ কোথাকার লাট রে বাবা, ইঁদুর-বাঁদরের দিকে ফিরেও তাকায় না, খালি ঐ মিনু শংকরের পিছন পিছন ঘুর-ঘুর করবে!"
মা বললেন, “ওরা বাড়ি পৌছবার অনেক আগে থাকতেই কেমন করে জানি টের পেত। অমনি উঠে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।"
পিসিমা বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন, "যাই বাবা, আমারও তো পুজো- "আচ্ছা আছে!”
সবার পাতে মোটা-মোটা হাড়গুলো সব পড়ে থাকে, ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়! সবাই লক্ষ্য করে, কেউ কোনো কথা বলে না। সন্ধেবেলা বাবা একবার বলে বসলেন, "আর কুকুর পুষব না। বাঁচেও না বেশিদিন, শুধু হাঙ্গামা বাধায় আর মায়ায় জড়ায়।"
মা বললেন, "আমিও সেই অবধি মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করে বসে 'আছি, আর কখনো নয়।" এতক্ষণ পরে মিনু শংকরের কথা ফুটল। দুজনে জোর গলায় বলে উঠল, "সত্যি মা, আর কখনো নয়।" শংকর আরো বলল, "জানো, রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, কিরকম নিঃশ্বাস ফেলা শুনতে পাই, ভুলে যাই, উঠে পড়ে দেখতে যাই ও ঘুমুচ্ছে কি না।"
পিসিমা ঘরে এসে শেষ কটি কথা শুনে বললেন, "হয়েছে! বলি, তোদের পিসেমশাই স্বর্গে গেলেন, কই তাঁর নিঃশ্বাস তো একদিনও শুনলাম না, আর তোরা তোদের কুকুরের শোকেই যে হেদিয়ে গেলি! এবার আবার একটিকে এনে দুঃখ ভোলা হবে নাকি?" বাকি চারজনে সমস্বরে বলে উঠল, "না, না, না, আর কখনো নয়।"
"যাক, তবু যে সুবুদ্ধি হল সেই রক্ষে। পই-পই করে বলি নি ও-সব জন্তু-জানোয়ার ঘরে এনে ঢোকাস নি রে বাবা! যত সব রোগের ডিপো। এই কোলে এসে মাথা রাখছে, এই গায়ের উপর থাবা রাখছে, উঃ, দেখে দেখে আমার গা ঘিন্-ঘিন করে উঠত। তা বাপু কিছু বলবার কি জো ছিল ?"
মিনু শংকর একটু অস্বাভাবিকরকম জোরে বলল, "যাক, এখন তো আর সে নেই, এখন খুশি হয়েছ তো?"
• এমনি করে দিন কাটে। পিসিমা ঝিকে জিজ্ঞাসা করেন, "হ্যালা, ওটার বাসনকোসনগুলো ফেলে দিয়েছিস তো? নইলে আবার অন্য বাসনের সঙ্গে তুলে রাখলে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাবে। কোনোই তফাত তো নেই। যত সব আদিখ্যেতা এদের।" ঝিও একগাল হেসে বলল, "কে জানে, পিসিমা, দিয়েছে হয়তো ফেলে। উঃ, কি বলব পিসিমা, হিদুর মেয়ে আমি, আমাকে পর্যন্ত ঐ কুত্তোর সেবায় লাগিয়ে দিয়েছিল! হ্যাঁ সায়েবরাও কুকুর পোষে বটে, কিন্তু তার কাজ করে জমাদার! আর হেথা ঘাটেও আমি, গঙ্গাতেও আমি। তা মন্ম দিয়েছেনও এটা-সেটা আমাকে, মিথ্যে বলব নি। আর আমিও বাসনটা মেজে দিয়েছি, কম্বলটা কেচে দিয়েছি। ও-সব আর এখন করতে হচ্ছে না, বেঁচিছি।"
এক মাস বাদে ঐ ঝিই একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "কি জানেন পিসিমা, মনটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। ঐ যে ছাদের কোণে লাঠিগাছটি দেখছেন ঐটে টেনে টেনে নিয়ে বেড়াত। আর সক্কাল- বেলায় উঠোনের দুয়োর খুলে ভিতরে যেই-না ঢুকেছি, সে কি ন্যাজ নাড়ার ধুম! সত্যি বলছি মা, আমায় দেখে আর কেউ অমনটি খুশি হয় নি কোনো জন্মে, অথচ কিছু তো পেত না আমার কাছটিতে। হ্যাঁ, পিসিমা মারা কি আর-একটা আনবে-টানবে না?"
পিসিমা এমন একটি চেলা হারিয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, "না রে বাবা, আর দরকার নেই। ওরা চারজনেই প্রতিজ্ঞা করেছে আর কক্ষনো নয়।" ঝি আর-একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, "কি জানি, ডাক্তারবাবু একদিন বলেছিলেন, "যাঁরা কুকুর নিয়ে একবার বাস করেছেন, তাঁরা কুকুর ছাড়া আর থাকতে পারেন না। বড় আদুরে ছিল, পিসিমা, আমাকে দেখলেই এত খুশি হত, ধপাধপ্ শব্দ করে ন্যাজটা নাড়ত।"
পিসিমা রবিবার সকালে কথাটা একবার নিজেই পেড়ে, সবাইকে যাচিয়ে নিলেন।
হ্যাঁরে নতুন খবর শুনছিস? ঐ পাতির-মা কুকুরের সঙ্গে এ্যাদ্দিন শুম্ভ-নিশুন্তের লড়াই চালিয়ে এসেছে, এখন ওর নাকি ভারি মন কেমন করে। তা আমিও বলে দিয়েছি, বাপু, সে মনই কেমন করুক কি যাই করুক আর নয়।"
কেউ কোনো কথা বললে না। আরো কদিন কাটল। একদিন ডাক্তারবাবু এসে বললেন, "কি, কুকুরের শোক কমল? ভালো ভালো কুকুরের ছানা বিক্রি হচ্ছে যে।" মার জন্মদিন আজ, সবাই বড় ব্যস্ত। মা সমানে কিসমিস বেছে যেতে লাগলেন, অম্বলে পায়েসে ঘিভাতে লাগবে। শংকর মিনু পরস্পরের দিকে তাকাল আর বাবা একবার খবরের কাগজটা নামিয়ে সকলের মুখ ভালো করে দেখে নিয়ে, আবার খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে গেলেন। শেষে মা বললেন, "আবার
কুকুর!"
সন্ধের মধ্যে রাঁধাবাড়া সেরে, ছেলেমেয়ে ও তাদের বাবার হুকুম মতো মা স্নান করে, নতুন কাপড়খানি পরে বসেছেন। পিসিমা খুশি হয়ে বললেন, "বাঃ এই বেশ হয়েছে, বউ! আচ্ছা এদের কাউকে দেখছি না যে, সব গেল কোথায়?"
"কি জানি, সব একে একে তো বেরুল। ঐ যে ঠাকুরঝি, এক- আধজন এল বোধ হয়।"
প্রথমে এল মিনু আর শংকর কাপড়ে করে কি ঢাকা দিয়ে। মার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, "এই নাও মা, তোমার জন্মদিনের উপহার।" প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবাও এলেন, "এই নাও গো একটা জিনিস 'আনলাম তোমার জন্যে, ধরো।" বলে আরেকটা কাপড়ে 'ঢাকা কি
কোলে ফেলে দিলেন।
পিসিমা অবাক হয়ে দেখলেন, মার কোলে দু-দুটো মিশকালো কুকুর- বাচ্চা এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে, মাড়িয়ে দিচ্ছে, ক্ষুদে-ক্ষুদে ল্যাজ নাড়ছে। লাল লাল জিব ঝুলছে।
সবাই হেসে ফেলল, "এ্যাঁ, বাবা! তুমিই বুঝি অন্যটি কিনেছিলে? • ঐ মেম বলল, একজন খুব মোটা ভদ্রলোক কিনে নিয়ে গেছেন।"
বাবা বললেন, "আমিই তো। এই, তোরা অত পয়সা পেলি কোথায় রে?" "বা-বা! আমাদের বুঝি জন্মদিনের জমানো টাকা ছিল না?
আর বাকিটুকু তো পিসিমাই দিলেন।"
পিসিমা হঠাৎ উঠে পড়ে বললেন, "যাই, চট্ করে সন্ধেটা সেরে 'আসি! বা-ব্বাঃ এদ্দিন তো বাড়ি ছিল না, হয়েছিল একটা গোরস্থান! ঐ দ্যাখ, পাতির-মার সব-তাতেই বাড়াবাড়ি, দু-দুটো বাটি কোত্থেকে • আনল বল দিকিনি। ওরে, আমার দুধ থেকেই নিস আজ, কাল থেকে "আনালেই হবে।" +