পালা শুরু
জুড়ির সুর করে আবৃত্তি, মৃদু মুনু তবলা ইত্যাদি সহযোগে পোড়া জতুগৃহ থেকে বাহিরিয়া যবে, পাণ্ডব বঝিলা মনে এ বিশাল ভবে গৃহ বন্ধু কিছু নেই, নিলা বনবাস। দুঃখে কষ্টে বৃক্ষতলে কাটে দিনমাস। কত যে বিপদ ঘটে, কেবা তাহা কবে, বাহুবলে ভীমসেন রক্ষা করে সবে। ঘোর অরণ্যে মারি হিড়িম্ব দুরাচারে, বাঁচাইলা ভীম চারি ভাই আর মা'রে। তার বোন হিড়িম্বারে বিয়া করি তবে, কিছুদিন থাকে ভীম ছাড়ি আর সবে; হিড়িম্বারে ছাড়ি পরে অতি সুখী মনে, পাণ্ডবের সনে ভীম ঘোরে বনে বন্তে। দীর্ঘকাল গেল কাটি, ঘোরে দেশে দেশে। পত্ত মারে, ভিখ মাগে, ঘোরে দীনবেশে। হেনকালে পিতামহ ব্যাসদেব আসি, দেখা দিলা সুমধুর বচনে সন্তাষি। পাঠাইয়া দিলা সবে একচক্রা গ্রামে আশ্রয় লইল সেথা ব্রাহ্মণের ধামে। তার পরে ঘটে যাহা শুন শান্ত মনে, বক-বধ কথা এবে কহি সর্বজনে।
প্রথম দৃশ্য
ব্রাহ্মণের বাড়ির প্রাঙ্গণ
গীতকণ্ঠে নারদের প্রবেশ
নারদের গান
তোরা ঝগড়াঝাঁটি কর
আহার নিদ্রা মাটি কর। সুখশান্তি লণ্ডভণ্ড
ওরে নারদ নারদ বল্।
বন্দোবস্ত হচ্ছে পন্ড।
ওরে নারদ নারদ বল্। আমরা খেটে মরি ঘুরে, তোমরা খাসা পেটটি পুরে, ঘুম লাগাও হে দিন-দুপুরে।
ওরে নারদ নারদ বল্।
বের কচ্ছি মজা মারা, কুঁড়ের বাদশার দল।
দিবানিদ্রা কচ্ছি সারা,
ওরে নারদ নারদ বল।
[ নারদের প্রস্থান
পরস্পরের কাঁধে ভর দিতে দিতে ভীম ও কুন্তীর প্রবেশ, মাঝে মাঝে পড়ে যাওয়া, 'কালে নিতে চেষ্টা...ইত্যাদি
কুস্তী। বড্ড লেগেছে বুঝি বাবা? তাই আর আজ ওদের সঙ্গে 'ভিক্ষে করতে বেরুতে পারলি না? তা বুনো ছাগলের সঙ্গে কেন লড়াই করতে গিয়েছিলি বল্ দিকিনি? আহা মরে যাই! দেখি বাপধন কোথায় কোথায় ব্যথা, সেখানে বেশ করে ঘষে ঘষে এই অস্থি-ভস্ম- টুকুন লাগিয়ে দিলেই সব সেরে যাবে। দেখি তো। আর কোনো ভয় থাকবে না।
ভীম। (লাফিয়ে উঠে) অ্যা! ওষুধ লাগাবে? বল কি!
ও বাঁবা! এ মনিতেই আমি ব্যথার চোঁটে টিকতে পারছি না তাঁরু উপর আবার ওষুধ দিলে আমার নিশ্চয় ভীষণ জ্বালা করবে। তাঁ হলে তাঁর পর আমি নিশ্চয় মরে যাঁব। ও বাঁবা!
কুন্তী। কি জ্বালা। এর যে দেখি দেহটা যেমনি বড়, বুদ্ধিটা ঠিক তেমনি ভোঁতা! আরে না না, কিছু লাগবে না। আর ওষুধ না লাগালে ব্যামো বেড়ে যাবে। করেজমশাইকে ডাকতে হবে। পঞ্চতিজ্ঞ গেলাবেন, এই এত্ত বড় ব্যাণ্ডিস্ বেঁধে দেবেন। তিনদিন খাওয়া বন্ধ করে দেবেন-
ভীম। অ্যাঁ বল কি! খাওয়া বন্ধ? তা হলে আমি কেমন করে বাঁচব? আচ্ছা দাও, ওষুধটাই বরং দাও। (শরীরের নানাস্থান দেখিয়ে) এই যে এখেনে ব্যথা, এখেনে ব্যথা, এখেনে ব্যথা। উহু-হু-হু, ওকি করছ, ওখেনে যে ভীষণ ব্যথা। আরি বাবারে! ঐ জায়গাটা ধরো না, ধরো না বলছি। উঃ আর কিছু রাখলে না রে। আরি বাব্বা! অত চিঙ্কোচ্ছ কেন বল তো? আই মাই গড়! জ্বলে গেলুম রে! ওরে তোরা কে কোথায় আছিস রে, আমি যে আর নেই রে!
বাইরে করাঘাত ও হেঁড়ে গলায় ডাক
হিড়িম্বা। (বাইরে থেকে) বলি, কেউ বেঁচে আছে নাকি গা? আমি যে একটা মেয়েমানুষ, কখন থেকে দোরগোড়ায় দেড়িয়ে দেঁড়িয়ে হেঁকে মরছি, বলি, তোমরা কি সব কানের মাথা খেয়েছ নাকি বাছা? কুস্তী। ও মা! এ আবার কেমনধারা মেয়ে গো? হাঁকের চোটে গাছ থেকে কাগরা উড়ে মায়, চাল থেকে খড়কুটো ভেঙে পড়ে। কে বাছা তুমি অমন ধারা বে-আক্কেলের মতো চেল্লাচিল্পি লাগিয়েছ?
কোমরে কাপড় জড়াতে-জড়াতে হিড়িম্বার প্রবেশ
হিড়িম্বা। তারি তেজ দেখছি যে। মুখ দিয়ে বুঝি মিষ্টি কথা বেরোয় না? জানিস তোকে আমি এক- (ভীমকে দেখে জিন্ড কেটে, ঘোমটা দিয়ে) ওমা, কি লজ্জা!
ভীম। হিড়িম্বে, এদিকে আয়। নাকে খৎ দে, প্রতিজ্ঞা কর আমার মার সঙ্গে আর কক্ষনো অমন ভাবে কথা বলবি নে।
হিড়িম্বা। (কুন্তীর পায়ে ধরে) দোষ নিয়ো না মা। এই দ্যাখ নাকে হেই মা, তোমার পায়ে পড়ি, খৎ দিচ্ছি। উঃ, মেঝেটা কি শক্ত রে বাবা, একটু গোবরজল-ছড়াও কি কেউ কক্ষনো দেয় না? দ্যাখ দিকিনি আমার এমন ভালো নাকটার কি অবস্থা হল!
কুন্তী। কের্যা ভীমু, চিনতে পারছি না তো?
ভীম। হিড়িম্বা, হিড়িম্বা! আঃ তোমার বউমা গো! কুন্তী। অমা! এই আমাদের সেই হিড়িম্বা-বউমা নাকি? তা বাছা তোমার চেহারার এ কি হাল হয়েছে বল দিকিনি? তখন তো দিব্যি ফুটফুটেটি ছিলে, এমনধারা পোড়াহাঁড়ি চেহারা কেমন করে হল গা?
হিড়িম্বা। তাই বটে! যাও তো ঠাকরুন পুকুরপাড়ে একবারটি গিয়ে জলের মধ্যে নিজের চেহারার প্রতিবিম্বিটি দ্যাখ গিয়ে! মাছ- কচ্ছপরা সব আঁৎকে উঠবে। ইস্! আমায় কিনা বলে পোড়াহাঁড়ি। আজ যদি আমার দাঁদা বেচারীকে যমের বড়ি না পাঠাতুন তবে সে তোঁমাকে দেখে নিত ঠাকরুন, হ্যাঁ! আর আমি নিজেও কি কিছু কম-
ভীম। কি আপদ! বল্লি তুমি থামবে কি না? দেখ তো কানের কাছে কি ঘ্যান ঘ্যান লাগিয়েছে?
হিড়িম্বা। বেশ, আমি নাহয় খারাপ, পোড়াহাঁড়ি, কিন্তু তাই বলে কি আমার পরানে একটু দয়ামায়াও থাকতে নেই? তোমরা কেমন আছ তাই দেখতে এলুম। আর সে সঙ্গে আমার ঘটুবাবার সংবাদটাও দিতে এলুম। কোথায় খুশি হবে, তা, না। আসামাত্র সব মারমূর্তি ধরেছে।
কুন্তী। (সহাস্যে) আহা, ঘটু আমাদের বেঁচে থাক্। তাসে
কত বড়টি হয়েছে এখন?
হিড়িম্বা। (সগর্বে হাত তুলে দেখিয়ে) তা এই তালগাছটি পরমাণ হবে বৈকি। আর দেখতে যেন সাক্ষাৎ কাতিক ঠাকুরটি! ইয়া ছাতি, যেন একটা বিরাট কালো পাহাড়। ইয়া মুখখানিতে কেমন সুন্দর তামাটে রঙের নৌকোর মতো ঠোঁট দুখানি। আর প্যাখনা-পানা কান দুটি মাথার দুটি পাশে এমনি করে উচিয়ে রয়েছে। আর মাথাটিও কি সুন্দর মোলায়েম চিক্ চিক্ করছে, চুলটুলের বালাই নেই। আহা বেঁচে থাক্ বাছা, লক্ষ বছর পরমাই হোক।
কুন্তী। (গালে হাত দিয়ে) ওমা, সে কি গা, মাথায় চুল নেই
কেন গা?
ভীম। তা বেশ, তা বেশ। আচ্ছা, এসেছই যখন, দ্যাখ আমার শরীরটাতে বড় কাহিল-কাহিল বোধ করছি। তুমি আমার পায়ের আঙুলগুলি আস্তে আস্তে টেনে দাও দিকি, বেশ মুমুট্ করে উঠলে ভারি আরাম লাগে। উহুহু, ও কি করছ? আরে বাবারে! একেবারে ছিড়ে যাবে যে!-আচ্ছা, ও থাক্। তার চেয়ে বরং আমার পিঠটাতে আস্তে আস্তে কিলিয়ে দাও। ওরে বাস্ রে! এ যে গুম্ গুম্ করে মুগুর পিটতে লেগেছে! হয়েছে, হয়েছে, তুমি সরে গিয়ে, ঐখানে আমার মায়ের পাশটিতে চুপটি করে বস দিকিনি। আমার শরীর খারাপ, আমি ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিই। ইচ্ছে কর তো ঐখান থেকে আমাকে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে পার। উড়িয়ে দিয়ো না আবার। কিন্তু দেখো যেন এক্কেবারে
ভীমের নিদ্রা। নাক ডাকার গান ভর দুপুরে ঘঁফিস্ ঘঁফিস্। ইব্ধি কাণ্ড! হোয়াট ইজ্ দিস্! ভোঁ-ঘড় ঘড়! ভোঁ-ঘড় ঘড়। রক্ষ মড়, মড়, ঘরদোর পড় পড়। এই ভয় লাগানো, চোর ভাগানো, লোক জাগানো লক্ষ্মীছাড়া। এই কাগ, তাড়ানো, ভূত ঝাড়ানো, নাক ডাকানো কেমন ধারা!
অন্তরালে নানান সুরে বিলাপ
ওরে বাবা রে, আমরা কোথায় যাব রে!
হায় রে কি হবে রে!
ওরে কি সর্বনাশ রে! তার চেয়ে না জন্মালেই তো ভালো ছিল রে।
হু-হু-হু। হায় হায় হায় ইত্যাদি।
ভীম। (উঠে বসে হাই তুলে) এই দ্যাখ! একটুখানি বিশ্রাম করবার কি জো আছে? যেমনটি দুই চোখের পাতি এক করেছি, অমনি কি না ওরে বাবা রে, গেলুম রে, মলম রে, খেয়ে ফেল্লে রে! যাও, যাও, দেখে এসো গিয়ে কার ছাল ছাড়ানো হচ্ছে। আরে, রক্ষা-টক্ষা করবার দরকার থাকলে তো সেই আমাকেই যেতে হবে। মনে হচ্ছে যেন সেই বামুন-বাম্নীর গলাই বটে। যাও, যাও,
কুস্তীর প্রস্থান ও ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী ও তাঁদের পুত্র-কন্যার সঙ্গে পুনঃপ্রবেশ
ব্রাহ্মণ। দেখুন মা, আপনারা হলেন গিয়ে অতিথি, দ্যাবু তার
স্বরূপ। আপনারা মরে গেলে আমাদের পাপ লাগবে, তাই বলি কি না-(হিড়িম্বাকে দেখে) আরি বাবা রে। এখানে আবার এ কোত্থেকে
এল রে?
হিড়িম্বা। (সরোষে) দ্যাখ বাপু, তুমি কেমনধারা ভদ্রলোক তা তো বুঝলাম না। আমি বউ মানুষ, লজ্জায় মুখটি খুলি নে, তাই বলে আঙ্কারা পেয়ে পেয়ে যা মুখে আসে তাই বলে যাবে নাকি? দাঁড়াও ঠাকুর, একবার যখন ঠ্যাং দুটো ধরব, এক্কেবারে ফালা-ফালা করে ছিড়ে ফেল্ম বলে রাখলাম। চির্ চির্ করে কেটে সরু চাকলি বানিয়ে ফেল্ম!
ভীম। হিড়িয়ে, চোপ্! দেখুন, আপনার ভীতির কোনো যথাথ কারণ নেই। উনি আসলে আমার ভার্যা। অতিশয় স্নেহশীলা, তবে কিনা একটু কোপন-স্বভাবা। কিছু মনে করবেন না, ওঁর দ্বার' আপনাদের কোনোরকম অনিষ্ট হবে না।
হিড়িম্বা। হবে না মানে? যথেষ্ট হবে। দ্যাখই-না, হয় কি না।
ভীম। চোপ্।
ব্রাহ্মণ। তুমি তো বাছা ধমক দিয়েই খালাস। ভাঁটা-পানা চক্ষ করে তাকাচ্ছে দ্যাখ না। এমনিতেই ভয়ে আমাদের প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়, তার উপর এ আবার কি নতুন গেরো! যাক গে. আমার কপালে যা আছে তাই হবে।
পুত্র-কন্যা। অ্যাঁ, কপালে যাঁ আছে তাঁই হবে? ও বাঁবা, ভয়ে যে আমাদের হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকাঠক হয়ে যাচ্ছে। চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, পেটের মধ্যে প্রজাপতি ফরফ্ফর্ করছে। যদি সত্যি কাঁমড়ায়? ওরে বাঁবা রে, কোথায় যাঁব রে।
ভীম। ন্যাকা। বলছি ও কাউকে কিচ্ছু করবে না। আর সামান্য একটু এখানে ওখানে কামড়ালেই-বা, কী এমন ক্ষতিটা হবে শুনি? যত রাজ্যের ঢং! নাও, এখন ব্যাপারটা কি তাই খুলে বল- কিসের জন্য অত হাঁউমাউ হচ্ছিল?
ব্রাহ্মণ। আরে কি মুশকিল! সেই কথা বলবার জন্যই তো এসেছি। বককে চেনেন? আরে, এ অঞ্চলের বক-নিশাচরের নামই শোনেন নি? তবে শুনেছেন কি? এই ঢাকাই জালার মতো পেট, বিরাট-বিরাট শালগাছের মতো হাত-পা, আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, মুলোর মতো দাঁত। আরি বাবারে! বলতে বলতেই যে গা শিউরে উঠছে। তার গর্জনেতে বড়-বড় কাঁঠাল গাছ ভেঙে পড়ে। আর কি দারুণ ক্ষিদেই যে অষ্টপ্রহর লেগে আছে সে আর কি বলব! পেটে যেন সদাই আগুন জ্বলছে। দিনরাত শুধু খাই-খাই।
ভীম। সে কি! বেশি খাওয়া যে বড় খারাপ। ওতে ব্যামো হয়। মন তামসিক হয়ে ওঠে। বড় খারাপ।
হিড়িম্বা। আহা, ন্যাকামো করবার আর জায়গা পাও নি। নিজের খাওয়ার বহরটি তো কিছু কম যায় না। বাড়িতে যা রান্না হবে, তার অর্ধেকটি ভাগ উনি একলা খাবেন, আর বাকি অর্ধেকটি বাড়িসুদ্ধু সবাই মিলে খাবে। বক বেচারির বেলাতেই যত দোষ!
ভীম। হিড়িয়ে! ফের মুখ খুলেছিস কি দেখবি মজা! এক্কেবারে হিড়ি-মিড়ি-কিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব। চারটি খাই বলে অমনি খোঁটা দিচ্ছিস যে বড়, তোর খাই নাকি?
ব্রাহ্মণ। আহা, এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ বাধাল। আপনারাই যদি সর্বক্ষণ খ্যাঁচাখেঁচি করবেন তো আমাদের উদ্ধার করবেন কখন? কোথায় আমাদের দুঃখের কথা শুনবেন, না নিজেদের তালেই আছেন।
ভীম। আচ্ছা, আচ্ছা, বলুন, বলুন।
ব্রাহ্মণ। তা সেই ব্যাটা বক এমনি উৎপাত লাগিয়ে দিল যে দেশে তিষ্ঠনো দায় হয়ে উঠল। মানুষ, গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি-ইঃ! থুড়ি! ধান চাল কলা মুলো, সব তন্ন করে দিতে লাগল। আমাদের রাজাটি তো আর মনিষ্যি নয়, দিবারাত্র শহরে গিয়ে আমোদ-আহ্লাদে মেতে আছে। রাক্ষস তাড়ানো তার কম্ম নয়। শেষটা তার সঙ্গে বক রাক্ষসের এইরকম রফা হল যে, ও কাউকে কিচ্ছু বলবে না, কিন্তু প্রজাদের পালা করে প্রতিদিন ওর খোরাক জুটোতে হবে। সে এক- একটা এলাহি ব্যাপার! এই পাহাড় পাহাড় খাবার, আর একটা করে মানুষ। আজ আমাদের পাঁলা। (কুন্দন)
ভীম। এই দ্যাখ, গল্প শেষ না হতেই আবার ক্যাওম্যাও লাগিয়ে দিল।
ব্রাহ্মণ। ক্যাওম্যাও আবার কি? আমার ব্রাহ্মণীকে বক খেয়ে ফেললে বুঝি আমাদের কষ্ট হবে না? কে আমাদের ভাত রেঁধে দেবে, কে ঘর-দোর নিকিয়ে দেবে? ও হো হো! রাতে কে আমার বাতের * তেল মালিশ করে দেবে শুনি?
ব্রাহ্মণী। ওগো, তুমি অমনটি কোরো না, তা হলে আমার বুক ফেটে যাবে। কিন্তু হায়! হায়! কি সর্বনাশ। আমার বামুন বকের পেটে গেলে কে আমার ছেলেমেয়ে মানুষ করে দেবে? ও আমার একার কস্ম নয়, এক-একটা যা হয়েছে, এক-একটা আস্ত বাঁদর! আর-আর আমার এই নতুন বালা জোড়া কে পরবে?
কন্যা। হাউ হাউ হাউ! আমি পরব মা, আমি পরব। তোমার
এত কষ্ট করে আদায় করা বালাজোড়া কি আর আমি অমনি ছেড়ে দেব? কিন্তু-কিন্তু তা হলে বাবাকে যদি বক খায়, আর তুমি যদি বুক ফেটে মরে যাও, তা হলে আমার বিয়ে দেবে কে? উহুহুহুহু! পুত্র। অ্যা! অ্যা! তাই তো! ঐ বুড়োধাড়ি মেয়েটাকে আমি কি করে পার করব। ঐ তো চেহারা, ঐ তো গুণের হাঁড়ি! শেষটা কি আজীবন আমার ঘাড়ে চেপে থাকবে নাকি রে! ও মাগো, ও বাবাগো, ও পিসিমা!
ভীম। (উঠে দাঁড়িয়ে) কি মুশকিল! এরা যে একটা গোটা কন্সার্ট পার্টি খুলে বসল! আরে না না, কাউকে বকের পেটে যেতে হবে না। দ্যাখ-না, আমি এক্ষুনি গিয়ে তার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে আসছি। কই গো, কোথায় তোমাদের হাঁড়ি হাঁড়ি পোলাও কালিয়া ক্ষীর সন্দেশ। দাও, দাও, সব গুছিয়ে দাও। বককে ভালোভাবেই যমের বাড়ির দিকে রওনা করে দিয়ে আসি! কি আপদ! ও আবার কিসের গন্ডগোল! (নেপথ্যে কোলাহল)
আঁটলো-বঁাটলোর প্রবেশ
আঁটলো। এই সেরেছে। এখানে আবার কিসের কাঁদাকাটি নেগেছে গো? এয়ারা সব মরে যাচ্ছেন নাকি বাবা?
বাঁটলো। সেটি হচ্ছে না কত্তা, এই বলে রাখলুম। লবাবী করে সব দুটো দুটো চাকর রাখবেন। তাপর মাইনে দেবার নামটি করবেন না। আর টপাটপ সব মরে যাবেন! আছেন বেশ! বড় যে সব সারি সারি মরতে লেগেছেন, বলি, আমাদের মাইনেটা কে দেবে? এই সবার সামনে বলে দিলুম বাপু, ও-সব মরা-টরা চল্কে না। কান অবধি দেনায় ডুবে রয়েছেন, আবার সখ দ্যাখ-না!
আঁটলো। যা বলেছিস। ইদিকে ট্যাক সব গড়ের মাঠ উদিকে বড়-মানুষির বহরটি আছে খাসা! ও-সব হবে-টবে না। আগে টাকা ফেলুন, তাপর দ্যাখা যাবে।
বাঁটলো। ইস্, কি সাঁপের মতো মানুষ গো! তখন কত্ত কত্ত মিষ্টি কথা।-দু বেলা পেট পুরে খাওয়া, দু টাকা করে মাইনে, পুজোর সময় কাপড় গামচা, হেনা তেনা কত কি-যেন আমার বাপের ঠাকুরদাদা এয়েছেন!
আঁটলো। তার পর মাস না ঘুরতেই অন্য সুর।
আঁটলো-বাঁটলোর গান
এই আঁটলো, কাপড় কাচ্।
টিকে আন তামাক সাজ।
ঘরটা মোছ, খড়ম খোঁজ।
ও বাঁটলো, বাসন মাজ । উনুন ধরা, ছাগল চরা। বিছানা কর্, পোলাটা ধর্। শিল্পির ওঠ, বাজারে ছোট্। মাছটা কাট্, মসলা বাট্। চছে সদাই এমনি ধারা, কাজের বহর হয় না সারা। রাত্রি দিবা, হুকুম কিবা।
আঁটলো। এবার ইয়াকি ছেড়ে মাইনে দিন। বাঁটলো। ভালো চান তো মাইনে দিন।
ব্রাহ্মণী। একি গেরো রে বাবা। বার বার বছি তোদের, এখন: আমরা ভয় পাচ্ছি, এখন বিরক্ত করিস্ নি, কেবল কানের কাছে টাকা দেন, টাকা দিন। তা কে কার কথা শোনে! আরে ব্যাটারা, টাকা হল গিয়ে ছাই। এক কানাকড়িও ওর দাম নয়। তার চেয়ে আত্মার সম্পতি কর দিকি বাপ্।
ব্রাহ্মণ। আর তোরা হলি গিয়ে কাজের মুনিষ! তোদের মুখে
কি অত বড়-বড় কথা শোভা পায়? ভীম। বেশ, তা হলে আপনারা ঝগড়া করতে থাকুন, আমি ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিই।
শয়ন। নেপথ্যে যুধিষ্ঠির অর্জন প্রভৃতি চারি পাণ্ডবের ভীমের পাশ ফিরে শয়ন সমবেত সংগীত। ভীমের উত্থান ভীম। কি জ্বালা। ও আবার কি হল?-এই যে বাবুরা সব
ফিরে এলেন।
মাছ ধরার গান গাইতে গাইতে চারি পান্ডবের প্রবেশ
মাছ ধরার গান
মাছ মারি, মাছ মারি, মাছ মারি।
চক্চকে কালো মাছ,
সাদা সাদা ছোট মাছ, আঁশ-ঢাকা, শিং-ওলা, বড়-বড় ভালো মাছ। ধরা দেয় হাঁদা মাছ।
মাছ মারি ।...
ভ্যাদা মাছ, চাঁদা মাছ,
মাঙ্গ মারি ।...
জালে পড়ে বোকা মাছ,
টোপ্ গেলে খোকা যাছ।
মাছ মারি ।...
শোল শিণ্ডি ভাঙড় মাছ,
চিতল মাছ, মাগুর মাছ, চিংড়ি মাছ, তাজা মাছ। বাটা মাছ, বাচা মাছ, ইলিশ হল রাজা মাছ। ঘাই মারে ভাই মাছ, খ্যাংরা গোঁফ ট্যাংরা মাছ।
ডাগর ডোগর হাওর মাছ।
মাছ মারি ۱۰۰۰
গান শেষ করে ছিপ, মাছের থলে ইত্যাদি মাটিতে ফেলে
যুধিষ্ঠির। উঃ! কী ক্ষিদে রে বাবা! পেটের ইদিকটার সঙ্গে উদিকটা এক্কেবারে কিনা সেঁটে গেছে মনে হচ্ছে। অর্জুন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি একটা আস্ত উট পেলে, তাকে সুদ্ধ গিলে ফেলি।
নকুল। হ্যাঁ রে, মনে হচ্ছে একটু লেবু আর নুন দিয়ে উগ্ করে গিলে ফেলি।
সহদেব। আর সামান্য একটু কাঁচালঙ্কাবাটা দিয়ে।
অর্জুন। এই, ফের তোরা আমি যা বলছি তাই বলছিস?
কুন্তী। (দুই বাহু প্রসারিয়ে) এসো, এসো বৎসগণ, বক্ষে এসো। ইস্! তোদের গায়ে কি ঘামের গন্ধ রে বাবা। যা, যা, নেয়ে আয়, নেয়ে আয়। ততক্ষণ আমাদের হিড়িম্বা-বউমা মাছগুলোকে কেটেকুটে দিব্যি নুন হলুদ আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে ভেজে ফেলুক।
হিড়িম্বা। যা বলেছ ঠাকরুন!
ভীম। (সকলকে ঠেলেঠুলে সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে) বাবাবাবা! আছ বেশ! ভিক্ষে করবার নাম করে সব বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবুরা তোফা মাছ ধরে এলেন। ওহে জ্যেষ্ঠ, যদি তুমি আমার উপাস্য দেবতা না হতে, তা হলে আজ তোমায় একবার দেখে নিতাম! ইয়াকি করবার জায়গা পাও নি, না? গুরুজন হয়ে নেহাত বেঁচে গেলে, নইলে একটি প্রচণ্ড চপেটাঘাতে তোমার মুণ্ডুর খুলিটা যদি আজ উড়িয়ে না দিতাম, তা হলে-
অর্জুন। আরে সে কি পুকুর রে ভাই। স্বর্গের সঙ্গে কোনো তফাত নেই। সেইখানেতে গাছের ছায়ায় পা মেলে দিয়ে সারাটা সকাল পড়ে থাকতে সে যে কী আরাম, সে আর তোকে কি বলব! থেকে থেকে এই বড়-বড় মাছ ঘাঁই মেরে ওঠে-
নকুল। হ্যাঁ, এমনি করে এত্ত বড় মাথা উঁচিয়ে ওঠে।
সহদেব। আর টুপ্ করে ফের ডুবে যায়। অর্জুন। ফের! দিন, রাত কেবল আমি যা বলব তোরা তাই বলবি? যা, পালা এখান থেকে।
যুধিষ্ঠির। ওরে ভীমু, চটছিস কেন বল তো? মাছ ধরব বলে কি আর বেরিয়ে ছিলাম রে? তা হলে তো তোকে সঙ্গেই নিয়ে যেতাম। মাছ ধরার নাম করলেই তোর সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়িয়ে যেত, সে কি আর জানি না। ভিক্ষের বুলি নিয়েই বেরিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি পথের ধারে কালো জলে ভরা পুকুরটা টলমল করছে। আর সে কি বিরাট বিরাট মাছ ঘাঁই মারছে-
নকুল-সহদেব। ঐ শুনলে অর্জুনদা? তুমি যা বল জ্যেষ্ঠও তাই বলছে। আমাদের বেলাতেই যত দোষ।.
অর্জুন। তোরা থাম দিকিনি।-বুঝলি, তখুনি গাছতলায় সব বসে পড়ল, আর আমি এক দৌড়ে বাড়ি এসে লুকিয়ে লুকিয়ে ছিপটিপ নিয়ে গেলাম।
নকুল-সহদেব। হ্যাঁ, পাঁই-পাঁই করে বাতাসের বেগে এল আর গেল। কাক-পক্ষীটি টের পেল না।
অর্জুন। আবার। আবার যা বলছি তাই বলছিস? এ তো মহাজ্বালা!
যুধিষ্ঠির। (শুয়ে পড়ে) উঃ! ঠায় বসে থেকে থেকে পিঠ ধরে গেল। কী বড় একটা মাছ টোপ্ গিলেছিল রে! কম-সে-কম তার ওজন হবে পঁচিশ সের। যেই-না ফাৎনা নড়েছে, অমনি বুঝেছি বাছাধন টোপ্ গিলেছেন। তার পর আধটি ঘণ্টা তাকে খেলিয়ে খেলিয়ে যেই-না ড্যাঙার কাছে এনে ফেলেছি-
অর্জুন। অমনি ব্যাটা সুতো ছিঁড়ে একদম ভাগলুয়া!
নকুল। হ্যাঁ, এক্কেবারে চোঁ-চাঁ হাওয়া!
সহদেব। স্রেফ কপুর!
অর্জুন। কি মুশকিল! এ দুটো কি এক্কেবারে তোতাপাখি বনে গেল নাকি! হ্যাঁ গা মেজদা, তুমি যে চুপ?
ভীম। আমি থাকলে ঐ মাছটাকে-যাকগে, এখন আমার বাজে বক- বার সময় নেই।-কই গো, বকের জন্য কি খাবার-দাবার দেবে, দাও। ব্রাহ্মণ। সবই প্রস্তুত আছে। আঁটলো-বাঁটলোর মাথায় চাপিয়ে নিয়ে গেলেই হল।
আঁটলো। অ্যা! ঐটেই বাকি ছিল রে বাবা! এবার দে আঁটলো- বাঁটলোকে বকের পেটে ঠুসে! না বাবু, আমরা দেশে চললুম।
বাটলো। 'তার' এয়েছে, ঠাকুমার কঠিন ব্যামো, বাঁচে কি না সন্দেহ। তা হলে এবার মাইনেটা দিয়ে দিন। ওষুধপথ্যি কিনতে হবে, গামছা লাগবে, খাটিয়া লাগবে, কাঠ লাগবে-
ভীম। (ধমক দিয়ে) যা, যা, মেলা কথা না বলে কি সব পোলাও, কালিয়া, চিংড়িমাছের আফগানী কাটলেট, পাঁঠার দোপেঁয়াজা, ক্ষীর, নতুন গুড়ের সন্দেশ আর কি কি সবের গন্ধ পাচ্ছিলাম-যা, নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। ক্ষিদেয় যে পেট জ্বলে গেল। বক বেচারিকে কতক্ষণ অপেক্ষা করান যায় বল! অর্জুন। বলি, ও মেজদাদা, বকের খাওয়ার জন্য যে ভারি উদ্বেগ ! তা বক কিছু পাবে-টাবে তো?
হিড়িম্বা। (সহসা হাত-পা ছুঁড়ে কেঁদে উঠে) তুমি কি তা হলে একাই ঐ-সব খাবে? কাউকে কিছু দেবে না? আর বকের সঙ্গে যদি তোমার মারামারি হয়, আর যদি ভীষণ যুদ্ধ হয়, আর যদি দুজনেই দুজনকে মেরে পাট করে দেয়, তা হলে কি ঐ খাবার-দাবারগুলো সব নষ্ট হবে? অ্যা! এই মাগ্ গি-গন্ডার বাজারে ঐ তাল তাল পোলাও কালিয়া দোপেঁয়াজী আর চিংড়িমাছের কি যেন আর ক্ষীর- সন্দেশগুলো সব কি তবে বিড়ালে খাবে?
কুন্তী। দ্যাখ বউমা, ভাশুরের সামনে ওরকম চ্যাঁচামেচি শোভা পায় না, বাছা। আর গলাখানিও যা বানিয়েছ, যেন খুপ্তি দিয়ে কড়াই চাঁচা। তুমি একটু ইদিকে এসো তো? ঘটুর জন্য কয়েকটা জিনিস রেখেছি, তা এখন গায়ে উঠলে হয়! আর তার পর, দ্যাখ বাছা, বেলাও হয়ে এল, যাবেও অনেক দূর, দিন থাকতে থাকতে হাঁটা দাও। আমার ছেলেরা স্নানাহার করবে, এখন কি আর মেলা খ্যাঁচ্ খ্যাঁচ্ ভালো লাগে? জিনিসগুলি নিয়ে কেটে পড় দিকিনি। মাছ-টাছ যে তুমি ভেজে দেবে না সে আমি আগে থাকতেই জানি।
যুধিষ্ঠির। কিন্তু কি যে ব্যাপার সে তো আমার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না। খাবার-দাবার নিয়ে সব যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
ভীম। যাও, যাও, তোমার সে জেনে দরকার নেই। মাছ মারার সময় যেমন আমি কিছু বলি নি, আমার রাক্ষস মারার সময় তুমিও তেমনি নাক ঢোকাতে এসো না। কই রে আঁটলো-বাঁটলো!
যুধিষ্ঠির। রাক্ষস মারা? বলি, কার পারমিশন নিয়ে তুমি রাক্ষস মারার তোড়জোড় করছ চাঁদ?
ভীম। কেন, স্বয়ং মাতৃদেবীর। জিগেস করতে পার।
কুন্তী। আরে, এর জন্য আবার পারমিশন কি বাবা? ও যাবে আর আসবে। তোমাদের মাছগুলো আমি খোলা থেকে ভেজে তুলতে না তুলতে দেখো, হাঁই হাঁই করতে করতে এসে হাজির হবে।
মুধিষ্ঠির। না, মা। কিঞ্চিৎ বিকৃতি ঘটে থাকবে। কাজটা ভালো কর নি। তোষার মস্তিষ্কের নইলে তুমি তো ভালো করেই জানো যে যদিও ওর বুদ্ধিশুদ্ধির বালাই নেই, তবু বিপদে-আপদে ওর ঐ ষাঁড়ের মতো শক্তিই আমাদের একমাত্র সহায়। ও-ই আমাদের রাজ্যোদ্ধার করে দেবে বলে আমরা আশা করে বসে আছি। দুর্যোধন তো আমাদের থোড়াই কেয়ার করে। একমাত্র ওরই ভয়ে রাতে তার ভালো করে ঘুম হয় না। নাঃ, এই অবস্থায় ওকে বকের কাছে পাঠিয়ে কাজটা ভালো করছ নামা।
ভীম। কেন, তাতে হয়েছে কি? কী বলতে চাইছ খুলেই বল- না। বকের সঙ্গে আমি পারব না, এই তো? ওঃ! নিজেদের শক্তি তো কাঁচকলা। বারোমাস আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাও আর আমারই উপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই? বাঃ বাঃ খুব ভালো।
কুন্তী। রাগ করছিস কেন? ও তোর গুরুজন না? আর তোমাকেও বলি বাবা যুধিষ্ঠির, বাস্তবিকই তুমি নিজে কিছু কম্পের নও, এক বক্তিমে করা ছাড়া। ওকে বাধা দিয়ো না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ও বহু মহাবল পরাক্রান্ত মহাকায় সব রাক্ষসদের এক- একটি গদার ঘায়ে মাটিতে সব ফ্ল্যাট করে দিয়েছে! তুমি কিছুমাত্র
ভীত হয়ো না। ও এখনই বকরাক্ষসকে সাবাড় করে ফিরে আসবে। যুধিষ্ঠির। হ্যাঁ, শুধু কি আর বককে সাবাড় করবে? উপরন্ত ঐ-সব উপাদেয় সামগ্রীগুলিকেও সাবাড় করবে!
হিড়িম্বা। সত্যি কাউকে কিছু দেবে না? সব একা খাবে? ভীম। তা হলে তোমরা এখন ঐ-সবই কর, আমি চলি। ও আঁটলো-বাঁটলো, গেলি কোথায়?
নেপথ্যে আঁটলো-বাঁটলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়- এই যে স্যার-সব রেডি
কুত্তী ও হিড়িম্বা। তা হলে এসো। দুগ্গা দুগ্গা। অর্জুন। দুগ্গা দুগ্গা। নকুল ও সহদেব। দুগ্গা দুর্গা। অর্জুন। ফের।
দ্বিতীয় দৃশ্য
বকের আবাসের সম্মুখভাগ
ঘটি গামছা সাবান ইত্যাদি সহ বক ও তার দুই অনুচরের 'রান নৃত্য' ও প্রস্থান ভীমসেন ও খাদ্যাদি-সহ আঁটলো-বাঁউলোর প্রবেশ
আঁটলো। আর কত এগুবে দাদা? আর তো পারিনে। ভীম। অ্যা? আচ্ছা, এইখেনেতেই রাখ, দিকিনি।-আহা-হা, ও কী করছিস? পোলাওটার পাশেই কালিয়া রাখ। তার পর ওধারটাতে মণ্ডা-মেঠাইগুলো থুয়ে দে। নইলে বকের যে ভারি অসুবিধে হবে। জল এনেছিস? আ সর্বনাশ, জল আনতে ভুলেছিস তো? ইস্, এমন ভালো খাওয়াটা এক্কেবারে মাটি। বক বেচারির যদি গলা শুকিয়ে যায়?
বাঁটলো। না গো না, সব এনেছি। খাবে তো ঐ বক হতভাগা, তা আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন কত্তা?
ভীম। উতলা হব না, বলিস কি রে? সে অতিথি মানুষ, তার খাওয়া নিয়ে উতলা হব না তো কার খাওয়া নিয়ে উতলা হব? তোদের যে একেবারেই কোনো জ্ঞানগম্মি হয় নি দেখছি। নে, এখন দে তো আমার হাতে একটু জল। বকের খাবার-দাবারগুলো একটু গুছিয়ে দিই।
হাত ধুয়ে খাবারের সামনে ভীমের আসন-পিড়ি হয়ে উপবেশন
আঁটলো। বক এলেই কিন্তু আমরা সরে পড়ব স্যার, বলে রাখলুম।
ঠাকুমার ব্যামো; সেবা করবার, কাঁধ দেবার লোকের দরকার। ভীম। যা না, এখুনি যা। ঠাকুমার ব্যামোতে দেরি করতে নেই। পালা, পালা।
বাঁটলো। উঁহু! 'সেটি হচ্ছে না কত্তা। মা-ঠাকরুনকে কথা দিয়ে এসিচি, খাবার-দাবারগুলো যাতে যথাস্থানে পৌঁছয় সেটি দেখে যাব। আমরাও যাই, আর আপনিও সুবিধে বুঝে সব সাঁটাবেন, সেটি হবার জো নেই।
ভীম। বটে? বটে? তবে বককেই ডাকা যাক। (উচ্চৈঃস্বরে) বক, ও বক, বক রে, তোর খাবার এনেছি রে, গেলি কোথা? হেই বকু, হোই বক, বকরে।
আঁটলো। ওরে বাবা রে, এবারে বুঝি এল রে। চল, আর দেরি নয়। পৈতৃক প্রাণটি নিয়ে সময় থাকতে চম্পট দিই।
[ আঁটলো ও বাঁটলোর পলায়ন
ভীম। আঃ, এবার একটু আরাম করা যাক। আচ্ছা-নুন-টুন যদি ঠিক না হয়ে থাকে? তাহলে তো বক বেচারির বড়ই কষ্ট হবে। তা হলে তো একটু চেখে দেখাই কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। (একটার পর একটা হাঁড়ির ঢাকনা খুলে একটু-একটু চাখন) বাঃ। বেড়ে রেঁধেছে ভাই এটা!- ও ব্বাওয়া? এটা যে আরো সরেস!- আহাহাহা! এর সঙ্গে যে মধুর কোনো তফাত নেই।-(আর একটা) কি খাওয়ালি রে বাপ্! জন্ম জন্ম ধরে যে খালি জিভ চুলকুব আর কেঁদে কেঁদে বলব 'কি খেলুম রে কি খেলুম!' (থাবা থাবা ভোজন) আঃ! নরজন্ম কি সাধে বলে! বহু পুণ্যে নরজন্ম হয়। দেওতা হয়ে কি সুখ রে বাবা তোরাই বল্? শুধু অমৃত খেয়ে কি আমাদের শানায় রে? হ্যাঁরে? আহাহাহা! সায়েবরা যে চিংড়িমাছের মুণ্ডু খায় না, কি পাপিষ্ঠ বল দিকিনি? আর যাই হোস রে বাবা, কখনো সায়েব হোস নি।- কি রেঁধেছে বাবা সত্যি!
দূরে গর্জন
আহা, এমনি একটা ভালো দিনে কে গোল কচ্ছিস বল্ তো? নারে বাবা, জন্ম জন্ম এইখেনেই পড়ে থাকতে চাই। সঙ্গেও যেতে চাই না, কোথাও যেতে চাই না।
আরো কাছে গর্জন
উঃ! কি মানুষ রে বাবা। এই সময়ও চ্যাঁচায়?-আঃ, এগুলি যে রেঁধেছে সে সাক্ষাৎ পিতামহ ব্রহ্মা! হিড়িম্বাটা কোনো কম্মের নয়। একটা ওয়ার্থলেসের একশেষ!
একজন রাক্ষসের প্রবেশ
আরে আরে বক নাকি! তা এসো ভাই বক, ওদিকটাতে বসো। আমি আর এখন নড়তে পাচ্ছি নে।
রাক্ষস। ওরে ও লক্ষ্মীছাড়া। তোর পরানে ভয়ডর নেই? বড় যে খাবারগুলো খেয়ে ফেলছিস?
ভীম। ওমা কী বলে। খেলুম কোথায়? কেমন হল না-হল, একটু শুধু চেখে দেখছিলুম। তোরই সুবিধে করে দিচ্ছিলুম। সাধে কি শাস্ত্রে বলে কারুর উপকার করতে নেই।
রাক্ষস। প্রথম কথা হল শাস্ত্রে মোটেই ও-সব বলে না। দ্বিতীয় কথা হল, আমার সুবিধে কচ্ছু মানে।-ও, তুমি বুঝি আমাকেই বক ঠাউরেছ? আর আমাকেই দেখে বুঝি ভয়ে ঠকাঠক হয়ে যাচ্ছ? হাসালে বন্ধু। আমি হলাম গিয়ে বকের ভাই ঠক। আমার দাদাকে যদি দ্যাখ তো তোমার দুই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে বলে রাখলুম। হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। চুরি করে খাওয়া তখন তোমার বেরুবে। দাদা চান করতে গেছে, এখুনি হালুম হালুম করতে করতে এই এল বলে। ভালো চাও তো আগে ভাগেই কেটে পড়ো। সরো, সরো, উঠে পড়ো। আমিই বরং ঐখানটাতে বসে জিনিসপত্র আগলাই।
ভীম। ইল্লি? দেখি দেখি, চাঁদমুখখানি দেখি একবার। আমি উঠি, আর উনি আমার জায়গাটিতে বসে এত কষ্টের সব খাবার চেঁচে- পুঁচে সাবাড় করুন আর কি! ও-সব হবে-টবে না। ভারি আমার বকের জন্য সহানুভূতি দেখাতে এয়েছেন। এখন এখান থেকে মানে মানে পালাও। নইলে একটি প্রচণ্ড ঘুষিতে তোমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব। যাও, পালাও। [ ঘুষি প্রদর্শন
রাক্ষস। (কাঁদো-কাঁদো সুরে) বাঃ। আমি কি করলুম? উনি দিব্যি বসে বসে আমার দাদা বেচারির খাবার গিলছেন, আর আমি একটু কিছু বললেই যত দোষ। বেশ, তবে তাই হোক। দাঁড়াও-না, আমিও এখুনি গিয়ে দাদাকে ডেকে আনছি। দেখো তোমাকে কেমন পিটিয়ে ছাতু বানায়।
ভীম। কি আপদ। যা না, তাকে ডেকে নিয়ে আয়। আরে, তার জন্যেই তো পথ চেয়ে বসে রয়েছি। নইলে আমার আর কী বল?
রাক্ষস। (চীৎকার করে) ও দাদা, ও বক দাদা, বলি চান করতেই যদি দিন কাবার হল তো খাবে কখন? ও দাদা, ও বক দাদা, এদিকে যে একটা বদমাইস লোক সব খেয়ে ফেলল! ও বক দাদা, বক দাদা গো-
[ ডাকতে ডাকতে রাক্ষসের প্রস্থান
ভীম। গেল চলে? আঃ! বাঁচা গেল। কোথাও যে একটু নিরি- "বিলি হাত-পা মেলে আরাম করে বসব, তার উপায় নেই। তাও বাবা, ঐ হিড়িম্বাটার, ক্যাঁচক্যাঁচানি থেকে খানিকক্ষণের মতন রেহাই পাওয়া গেছে।- অ্যা! ও কি! ওটা আবার কে?
ঘোমটা দিয়ে হিড়িম্বার প্রবেশ
কি জ্বালা! আবার এসে জুটেছ? পালাও, পালাও এখান থেকে। নইলে এক্ষুনি বক এসে তোমাকে খেয়ে ফেলবে! হিড়িম্বা। আচ্ছা, আসুক তো সে। তার পর কে কাকে খায় দেখা যাবে'খন! ঐ বড় হাঁড়িতে কী আছে?
ভীম। ও হিড়িয়ে, ঐ ব্রাহ্মণী বুড়ির পা ধুয়ে চারটিখানি জল খেতে পারিস না রে? কি রেঁধেছে, বা বা! মুখে দিলে চোখ আপনা থেকে বুজে আসে। দেখবি চেখে? তোকে একটু একটু দেব। অন্ কণ্ডিশন যে তোকে ঐরকম রাঁধতে হবে। পারবি তো?
হিড়িম্বা। কি যে বল। তা আবার পারব না? একবার সেই বনের মধ্যে গাছের তলায় দাদার জন্য এমনি তোফা দু-ঠ্যাং রেঁধেছিলুম, দাদা তো গলে জল! নিজের গলা থেকে গজমোতির মালা খুলে আমাকে দিয়ে বললে-'ওরে হিড়িম্বে, তোর মতো কেউ রাঁধতে পারে না। ব্রাহ্মণীদের ঠাকুরমারাও না!' আর আজ কি না তুমি আমাকে ব্রাহ্মণী দেখাচ্ছ। (খেতে খেতে) কই, দাও তো আরো চাট্টি, সত্যিই বেড়ে রেঁধেছে। বুঝলে গো, খাওয়া হল গিয়ে আমাদের জেতের পেশা। যেমনি রাঁধতেও পারি, তেমনি খেতেও পারি। আর তার ফলে শরীরেও যেমনি শক্তি, মনেও তেমনি সাহস। আমাদের বুকের ভিতর দিবারাত্র হাঁই হাঁই করে সিংহ ঘুরে বেড়ায়। ভয়-ডর কাকে বলে আমাদের জানা নেই। (সহসা দূরে গর্জন শুনে) ও বাবাগো। ওটা আবার কি?
ভীম। অ্যাঁ, ভয় পেলে নাকি? এই যে বললে ভয়-ডর কাকে
বলে জানো না, বুকের মধ্যিখানে সিংহ চরে বেড়াচ্ছে? কই সে? হিড়িম্বা। আরে দুৎ, ভয় পাব কেন? হাত-পাগুলো কেমন- ধারা এলিয়ে যাচ্ছে কিনা, তাই। (পুনরায় গর্জন) বাঁধাঁরে! ঐ গাঁছগুলোর পিছনে বরং একটু লুকোই। [ পলায়ন
ভীম। দেখলে, মেয়েদের কান্ড দেখলে? লম্বাচৌড়া বক্তিমে, আর কাজের বেলা অষ্টরম্ভা! নাঃ, বক্তিমে শুনে শুনে ক্ষিদেষ্টা আবার চাগিয়ে উঠেছে। সেই কখন ঘুম থেকে উঠে অষ্টগণ্ডা লুচি সন্দেশ দিয়ে জলযোগ করেছিলুম, তার পর থেকে এই এত্তটা বেলা পর্যন্ত গুটি পাঁচেক কাঁটাল, আর বিশ-পঁচিশষ্টে ন্যাংড়া আম, আর তার পর চাট্টিখানিক দই-ভাত আর এই দুই হাঁড়ি দই আর সের পাঁচেক ছানা ছাড়া দাঁতে কিছু কাটি নি! মাগো, কেমন যেন দুব্বল-দুব্বল লাগছে গো! এখন কি করা যায়? অ্যাঁ! কি করা যায়, কি করা যায়-ঠিক হয়েছে! একটু টিপিন খাওয়া যাক্। একা একা এত খেলে বকটার নির্ঘাৎ পেটের ব্যামো হবে।
গর্জন করতে করতে বকের প্রবেশ
বক। (দুচোখ কপালে তুলে) কে রে হতভাগা তুই? প্রাণের উপর বুঝি ঘেন্না ধরে গেছে, তাই আত্মহত্যে কত্তে এইছিস? (ভীমের একমনে ভোজন। ভীমের ঘাড়ে টোকা দিয়ে) শুনতে পাচ্ছিস না? কালা নাকি? আমার খাদ্য যে বড় খেয়ে ফেলছিস, পরানে তোর ভয় নেই? ওঠ বলছি।
ভীমের হাস্য ও ইঙ্গিতে বককে প্রস্থান করবার নির্দেশ
বক। (রেগে ভীমের পিঠে কীল-চড় মারতে মারতে) লক্ষ্মীছাড়া, বাঁদর, পেটুক দামু কোথাকার! (ভীমের অল্প একটু কনুইয়ের গুতো খেয়ে) যাও, ভালো লাগে না, অসভ্য কোথাকার। পেটে আমার লাগে না বুঝি? (প্রাণপণে প্রহার করতে করতে) ইডিয়ট্ কাঁহিকা, ঠ্যাং ভেঙে তালগোল পাকিয়ে দেব, মুণ্ডু ছিড়ে ফেলে দেব, গলা টেনে ইয়া লম্বা করে দেব।- ই কি! পাথর দিয়ে তৈরি নাকি রে বাবা? লাগে-টাগেও না? হ্যাঁরে, তুই কী রে বাবা!
বক কিছু দূরে গিয়ে ছুটে এসে ভীমের পিঠে লাফিয়ে পড়ল, আর তখুনি কাঁধ- ঝাঁকানি দিয়ে ভীম বককে ফেলে দিল
বক। উঃ, গেলাম গো! হাঁটুটা আমার উলটোবাগে হয়ে গেছে নিশ্চয়। কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা! (হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে) কি সব্বনাশ। অন্ধেকের বেশি শেষ করে দিয়েছে! ব্যাটা তোর পেটে কি দাবানল জ্বলছে নাকিরে? আরে ওঠ না। ওই বলছি। ও-সব আমার খাবার। এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। নড়েও না, চড়েও না, - সমানে খেয়ে যাচ্ছে। কি জ্বালা। এর একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে তো চলছে না। (কিঞ্চিৎ চিন্তা করে) হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে! একটা গাছ আনছি। এবার বাছাধনকে টের পাওয়াচ্ছি!
বকের গ্রন্থান ও বিশাল এক গাছ কাঁধে নিয়ে পুনঃপ্রবেশ। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ভয়ে গোটা তিন রাক্ষস ও সেই প্রথম গানের দুই-এক পদ গাইতে গাইতে নারদের প্রবেশ
রাক্ষসত্রয়। হ্যাঁ, এইবার ঠিক জমবে। লেগে যা। নারদ। নারদ! বক। এইবার মজাখানা টের পাবে বাছাধন। গাছ এনেছি। ধাঁই ধাঁই করে গাছ দিয়ে প্রহার। ভীমের বাঁ হাতে গাছ কেড়ে নিয়ে নারদের দিকে নিক্ষেপ ও নিবিষ্টভাবে ভোজন
বক। ইঞ্চিরে বাবা! একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। তখন থেকে অ্যায়সা পিটছি, তবু কিছু হয় না! দাঁড়া, আরো অনেক বড় আর অনেক শক্ত একটাকে নিয়ে আসি। [বকের প্রস্থান
ওদিকে গাছের ডালের খোঁচা লেগেছে নারদের গায়ে
নারদ। এই, তোদের কাছে আইডিন-টাইডিন আছে? রাক্ষসত্রয়। যান মশাই। মরছি নিজেদের জ্বালায়, আর উনি এসেছেন 'আইডিন আছে? ব্যাণ্ডিস্ আছে?' বলি আমরা কি দাতব্য চিকিৎসালয় নাকি?
বড় গাছ নিয়ে বকের পুনঃপ্রবেশ
বক। সর্, সর্, পথ ছাড়।
নারদ। ঐ গাছ-ফাছ দিয়ে কিছু হবে না দাদা। মাথায় একটা সুপুরি বসিয়ে বরং লাগাও খড়ম। বক। আমার ব্যাপারে তুমি নাক ঢোকাতে এসো না ঠাকুর। সরো; পথ আটকো না।
ভীমকে প্রহার। ভীম খাওয়া শেষ করে, মুখ ধুয়ে, বকের কাপড়ে মুখ মুছে
নারদকে বলল-
ভীম। আঃ! বেড়ে খাওয়াটা হল। ও ঠাকুর, তোমার বটুয়াতে পান কি মসলা কি হরতুকি বা কোনোরকম মুখশুদ্ধি আছে নাকি?
নারদের কাছে ভীমের হরতুকি গ্রহণ। বকের ক্রমাগত প্রহার। ভীমেরু হরতুকি মুখে ফেলে গা ঝেড়েঝুড়ে জুতো পায়ে দিয়ে আস্তিন গুটিয়ে সহসা বকেরু চুলের মুঠি ধারণ
ভীম। আচ্ছা এবার চলে আয়।
নেপথ্যে যুদ্ধের বাদ্য। রাক্ষসদের আস্ফালন।
তৃতীয় দৃশ্য
যুদ্ধস্থল
ভীম ও বক তাল ঠুকে পাঁয়তাড়া কষছে। তাদের ঘিরে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নারদ ও রাক্ষসরা
বক। বলি পিঁপড়ে, বকরাক্ষসের সঙ্গে যে বড় যুদ্ধ করতে এইছিস, বলি লাইফ ইন্সিয়োর করেছিস তো? জানিস তোকে আমি এক্ষুনি চিকিয়ে মেরে ফেলব? বাড়ির লোকদের কাছ থেকে ভালো করে ফেয়ারওয়েল নিয়েছিস? যাকে যা যা বলবার শেষবারের মতো বলেছিস? যা যা দেবার-থোবার, সব দিয়েছিস?
ভীম। ওরে ও বক! আমার জন্য তোর অত ভাবতে হবে না। বরং তোর ভাবনাতেই আমি গেলাম। এক্ষুনি প্রচণ্ড এক ঘুষিতে তোকে একটা তালগোল পাকিয়ে দেব, তা জানিস? কোথায় তোর হাত-পা নাক মুখ চোখ কান ভুঁড়ি, তোর বাপ-ঠাকুরদাদারাও চিনতে পারবে না রে! তখন তোর অবস্থাটা কেমন হবে বল দিকি?
বক। বটে। বটে! ছোটবেলা থেকে আজ অবধি তোর মতো যত অপোগণ্ড নরাধম মেরেছি, সবগুলোকে টান টান করে লম্বালম্বি শুইয়ে দিলে পৃথিবীর চার দিকে তিন বার ঘুরে আসবে, তা জানিস? ভীম। বলিস কি রে বক? অতগুলো মানুষ তোর সামনে এসে একবারটি দাঁড়ালেই যে তুই ভয়ের চোটে পেলিয়ে যাবি।
বক। বটে। বটে। দাঁড়া-
নেপথ্যে যুদ্ধের বাদ্য। বকের যুদ্ধনৃত্য এক মিনিট
ভীম। আরে বাবা রে! এ যে দেখি বেজায় তড়পায়! আয় তুবে আয়।
এবার ভীমেরও নৃত্য। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে দুজনের বসে পড়া
১ম রাক্ষস। ইক্কিরে বাবা! এরা যে দেখি পরান ভরে খালি নেত্য করে। যুদ্ধ-টুদ্ধ হবে না?
নারদ। ওমা, সে কি কথা! আমি বলি বুঝি এর পর লড়াই না হয়ে যায় না। তাই কাজ ফেলে ছুটে এনু। আমার ভাই মারামারি ব-ড্ড ভালো লাগে। কিন্তু কিছুই দেখছি না যে?
২য় রাক্ষস। ধেৎ। সব যেন যাত্রাদলের সপ্ত! আজকের দিনটাই মাটি! (নারদের দিকে চেয়ে) হেই ঠাকুর, তুমিই-বা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কি দেখতেছ? একটা কিছু লাগিয়ে দাও-না
নারদ। আরে দুর্-দুর্। ওরা আবার যুদ্ধ করবে। তবেই হয়েছে। তার চেয়ে দুজনায় মিলে একটা সখের থিয়েটার পার্টি খুলে বঙ্গলেই পারে। আমরা টিকিট কেটে মজা দেখে আসি।
৩য় রাক্ষস। আমারও ভাই থিয়েটার দেখতে ভা-বি মজা লাগে। কিন্তু টিকিট কাটার জন্য আমার একটাও পয়সা নেই কিনা, তাই আমার কিচ্ছু দেখা হয় না।
নারদ। কিচ্ছু দেখা হয় না কিরে? আয়নায় গিয়ে নিজের মুখটা দেখলেই পারিস, তা হলে তোর সঙ দেখা হয়ে যাবে। ১ম রাক্ষস। আচ্ছা ঠাকুর, তা হলে কি সত্যই আজকের
মারামারিটা হবে না? নারদ। হবে না মানে? আলবাৎ হবে।
২য় রাক্ষস। আমাদের এতজনাকে এতক্ষণ ধরে এত আশা দিয়ে এনে এখন বললেই হল মারামারি করবে না? ইয়ার্কি নাকি, মারামারি করতেই হবে।
নারদ। করতেই হবে। করতেই হবে।
বক। (উঠে দাঁড়িয়ে বুক চাপড়ে) আমার নাম বক।
আমার ভয়ে কুরুপাণ্ডব কাঁপে ঠক্ ঠক্। ভীম। (উঠে দাঁড়িয়ে) আমার নাম ভীম।
আমার নামে রক্ষোকুলের হাত-পা ঝিম্ ঝিম্।
বক। থামা থামা বক্সকানি। দেমাক দেখে অবাক মানি!
চাল নেই,
চুলো নেই।
রাজ্য থেকে তাড়া খেয়ে,
ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে গিয়ে, হেথায় এসে দাদাপানি!
থামা থামা বন্ধকানি।
ভীম। বলি ওহে গুণধর। আজ এসেছে ভীমসেন, একটিমাত্র গদার ঘায়ে, যেথা থেকে এসেছিলে, শেষ কটি কথা বলে, আবার সেথায় যাবে চলে। কাঁদবে নাকো কেউ।
সামনে থেকে এবার সর্। নিরীহ সব গ্রামবাসী
তাদের সুখশান্তি নাশি,
সবার উপর অত্যাচারি,
খাসা আছ, বলিহারি!
ঘুচবে তোমার লেনদেন।
১ম রাক্ষস। ও ঠাকুর, মারবে বলছে। এবার একটা কিছু হবেই হবে বলে মনে হচ্ছে যে। কেয়াবাৎ। কেয়াবাৎ। ২য় রাক্ষস। হ্যাঁ, এবার একটা কিছু না হয়ে যায় না! নারদ। (সুর করে) ওরে নারদ নারদ বল্। বক। উঃ, তোরা যে বড্ড গোল কচ্ছিস! তোদের এখানে কে ডেকেছে বল্ তো? তোদের কি কোনো কাজকম্ম নেই?
ভীম। হ্যাঁরে, তোর তাতে কি রে বক? ওদের যদি কাজকম্ম নাই থাকে, ওরা যদি বেকারই হয়, তোর তাতে কোন্ অসুবিধাটা হচ্ছে তাই বল্? না হে, এই আহাম্মকটার কথায় তোমাদের কান দিতে হবে না। তোমরা আমার দলের লোক। বরং তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্যাখ আমি রাস্কেলটাকে ক্যায়সা একটা ডবল্ রদ্দা কষিয়ে দিই। তার পর একটা ডান-পটকান লাগিয়ে ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়াকে একেবারে 'ভূমির উপর পার্টির মতো বিছিয়ে দেব। যাকে বলে একেবারে 'মাটিং চকার' করে দিই কেমন, একবার শুধু চেয়ে দেখ।
বক। তাই বটে! তাই বটে। নেহাত তোকে একটা উচিত শিক্ষা না দিলেই নয় 'দেখছি। (হাতের বাইসেপ্ চাপড়ে) উঃ। তোকে ফালাফালা করে ছিড়ে ফেলবার জন্য, হাত দুটো চিডুবি করছে। (বুক চাপড়িয়ে) একবার এমনি জাপটিয়ে ধরব যে এক্কেবারে আলুভাতে বানিয়ে দেব। (ট্যাক থেকে বটুয়া বের করে নারদের হাতে দিয়ে) ধরো তো ঠাকুর আমার মনিব্যাগটা। নইলে ভীমভবানী প্যাঁচটা কষবার সময় আমার ভারি অসুবিধা হবে। তা ছাড়া, ঐ ব্যাটাকেই-বা বিশ্বাস কি? গোলমালের মধ্যে কখন আমার পকেট মারে তারই-বা ঠিক কি? নিজের ট্যাক তো গড়ের মাঠ।
ভীম। (বকের পিঠে প্রচণ্ড এক কীল মেরে) চোপ্। যতই কিছু বলি না, ততই তোর বাড় বেড়ে যায় দেখছি।
কোলাহল। কুত্তী, হিড়িম্বা, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি সকলের প্রবেশ
হিড়িম্বা। এই রে, এইবার একটা মারপিট না হয়ে যায় না। কেমন চোখ রাঙাচ্ছে দেখেছ?
যুধিষ্ঠির। বৎস ভীম, তোর আর কোনো ভয় নেই রে ভাই। এই যে আমরা চারজনা এসে পড়েছি। কে তোকে মারে দেখব। আয়, এই সুযোগে তুই উপ্ করে আমাদের কাছে পালিয়ে আয় তো। তোর সব বেয়াদপি ক্ষমা করে, আমরা তোকে সাহায্য করতে এসেছি। কুন্তী। (বককে) আর তোমারই-বা কি আক্কেল বাপু? তিন
কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, তবু ঐ ছেলেমানুষের সঙ্গে লাগতে যাও? যুধিষ্ঠির। ভীম, ভীম, তোকে উদ্ধার করবার জন্যই আমরা এইচি। এই বেলা পালিয়ে আয়।
অর্জুন। ইস্! বকটাও আবার সব স্যাঙাৎ-সাগরেদ জুটিয়ে এনেছে দেখছি। দুষ্টু লোকদের কি আর সঙ্গীর অভাব হয়? সহদেব। হ্যাঁ, সক্কলের সঙ্গে এক্কেবারে গলায় গলায় ভাব। অর্জুন। আচ্ছা, তোরা কি এখানে এসেও টিয়েপাখির মতো বুলি আওড়াবি না কি? তখন থেকে বারণ করছি না।
নকুল। মোটেই না, মোটেই না, দুনিয়াসুদ্ধ সবাই তাদের বন্ধু।
যুদ্ধের বাদ্য। নারদ প্রভৃতির ব্যস্তভাব
নারদ। আহা, আপনারা এসে সব মাটি করে দিচ্ছেন। সরুন, সরুন, ওদের জায়গা দিন।
৩য় রাক্ষস। ভীষণ যুদ্ধ হবে, তাও জানেন না? ২য় রাক্ষস। এক্ষুনি সাংঘাতিক মারামারি হবে। দুজন দুজনকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
১ম রাক্ষস। দু-তিন ঘণ্টা ধরে দারুণ যুদ্ধ হবে। এও ছাড়ে না, ও-ও ছাড়ে না। চারি দিক অন্ধকার করে আসবে। চাঁদ সুয্যি ভয়ের চোটে মুখ ঢাকবে। আকাশ থেকে তারারা সব খসে পড়বে। বাজ পড়বে। ভূমিকম্প হবে। রক্তগঙ্গা বইবে। সবাই মরে কুচিকুচি হয়ে যাবে। ইস্।
হিড়িম্বা। কী মজা! নারে?
২য় রাক্ষস। কিন্তু তা হলে দুজনেই মরে কুচিকুচি হয়ে গেলে যুদ্ধে কে জিতবে? আমি যে আটআনা পয়সা বাজি ধরেছি। ৩য় রাক্ষস। অ্যাঁ। তাই তো! আমিও তো তাই। তা হলে কী হবে?
হিড়িম্বা। হ্যাঁগা, মাঝখানে একবার টিপিনের ছুটি হবে না? নারদ। টিপিন কি কিছু বাকি রেখেছে যে টিপিনের ছুটি হবে মাঠাকরুন?- এদিকে তোরা সবাই মিলে তো আচ্ছা মজা লাগিয়েছিস। এইবার থাম্ দিকিনি, ঐ দ্যাখ্ শুরু হল বলে।
সকলের ইদিক-উদিক বসে পড়া, ভালো জায়গা নিয়ে ঠেলাঠেলি... ইত্যাদি। মাঝখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধের জায়গা। ভীম ও বকের পরস্পরকে অবলোকন। তার পর ভীষণ যুদ্ধ! একবার ভীম সরে যায়, একবার বক। অবশেষে ভীম বককে বগলদাবা করে। রণবাদ্য। পাণ্ডবদের উৎসাহ। রাক্ষসদের হতাশা। খানিক পরে বককে দূরে নিক্ষেপ করে ভীম রক্তচোখে তাকায়
নারদ। ইস্! দেখলি। বকটাকে তুলে কোথায় ছুড়ে ফেলে দিল। ভীম। আর কারো মরবার সখ হয়ে থাকলে এগিয়ে এসো। (রাক্ষসদের প্রতি) কি? তোমাদের কিছু বলবার আছে? রাক্ষসগণ। (হাঁটু গেড়ে) না স্যার। না স্যার! ভীম। (পাণ্ডবদের প্রতি) তোমাদের কিছু বলবার আছে? যুধিষ্ঠির। আরে না না। আমরা আবার কী বলব? অর্জুন। শুধু তোমাকে অভিনন্দন করা ছাড়া আমাদের আরু কোনো কর্তব্য নেই।
নকুল। ঠিক, ঠিক, কিছু করব না, শুধু তোমার প্রশংসা করব।
সহদেব। হ্যাঁ, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, আর থেকে থেকে তোমার জয়গান করব।
কুন্তী। বাছা, বক্ষে এসো। আর কক্ষনো ওরকম মারামারি কোরো না।
হিড়িম্বা। আর অত খেয়ো না। ওতে চিত্ত তামসিক হয়ে যায়। অন্যরা কিছু পায় না।
ভীম। এই রাক্ষসরা, যা তোদের ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মনে রাখিস, এখন থেকে নিরামিষ খাবি, হরিনাম করবি আর কক্ষনো যুদ্ধের সময় ওরকম হট্টগোল করবি না। যা, পালা।
[রাক্ষসদের পলায়ন
কুন্তী। (নারদকে প্রণাম করে) ভগবন, এবার তোমায় চিনেছি। তুমিই যে এই-সমস্ত ব্যাপারটার মূলে, সেটা এতক্ষণে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি ঠাকুর। এবার তা হলে আমাদের সকলকে আশীর্বাদ করে বিদায় দাও।
নারদ। বেশ, তাই হোক। এই বর দিলাম যে, যখনই তোমার পুত্ররা ঝগড়াঝাঁটি করবে, তখনই তারা জয়যুক্ত হবে। এখন যদিও ঐ বক-নিশাচরকে বধ করে তোমাদের কোনো পাপই হয় নি, তথাপি বাড়ি ফিরে গিয়ে সবাই মিলে কিঞ্চিৎ বেদগান কোরো। বলা তো যায় না।