লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তাদ এসেছে। দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়িতে গান শুনতে গেছেন, ফিরতে রাত হবে।
ঝগড় বলল, "তা তোমরা যদি সব-কিছুই বিশ্বাস না করে আনন্দ পাও, তা হলে আমার আর কিছু বলবার নেই। তবে সর্বদা মনে রেখো, বোগিদাদা, যা বিশ্বাস করবার মতো নয়, তা যে সত্যি করে হয় না, এরকম কোনো কথা নেই।"
ঝগড় রাগ করে উঠে দাঁড়াল। ওর পেছনে কুচি কুচি ঘাস লেগে- ছিল, তার কতকগুলো ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। তাই দেখে বোগি নরম গলায় বললে, "তাই বলে ঘুটঘুটে অন্ধকারেও মানুষ চোখে দেখতে পায়, সে কথা কি করে বিশ্বাস করি? অসম্ভব জিনিস যে হয় না, ঝগড়।"
ঝগড় আরো রেগে গেল। "অসম্ভব বলেই সে-জিনিস হবে না? এ কি একটা কাজের-কথা হল, বোগিদাদা?"
বাগান যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা মর্চে-ধরা কাঁটা- তারের বেড়া। তার পরেই রেলের লাইনের বাঁধ আকাশ পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে। দুপুরে দুখু ঘাস কেটেছে, যেখানে-সেখানে কুচি-কুচি ঘাস পড়ে আছে; পাখিরা সব বাসায় ফিরে আসছে। শ্যামলবাবুদের গোয়ালে এখন গোরু দোয়া হচ্ছে। বাঁধের ওপারে কিছু দ্যাখা যায় না। বাঁধের উপরে একটা ন্যাড়া মনসার ঝোপ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে;পিছন দিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
কারো মুখে কথা নেই। কানে এল একটা শব্দ, উংলিং টংলিং টংলিং। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চেন-শেকল ঝোলাতে ঝোলাতে একটা মালগাড়ি বাঁধের উপর দিয়ে চলে যেতে থাকে।
যেই সূর্যের সামনে আসে, অমনি সেই গাড়িটা কুকুচে কালো হয়ে ফুটে ওঠে। শেষ গাড়িটার দু দিককারই বড় টানা দরজা খোলা। সেই খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে ওপারের সূর্যটাকে এই মস্ত হয়ে দ্যাখা গেল। আর দ্যাখা গেল, সূর্যের সামনে গাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, কালো পাতলা ছিছিপে একটা মানুষ। তার মাথার উপর খাড়া দুটো শিং।
বোগি, রুমু, ঝগড়, কেউ আর কথা বলে না। ঠিক সেই সময় বাঁধের পিছনে সূর্যও টুপ করে ডুবে গেল। আর অমনি চার দিক ধোঁয়া ধোঁয়া আবছায়া হয়ে উঠল। শীত-শীত মনে হতে লাগল। বকের মতো একটা সাদা পাখি কোঁ-ও-ও-ও, কোঁ-ও-ও-ও বলে ডাকতে ডাকতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ঝগড় উঠে পড়ে গা ঝাড়া দিয়ে নিল, "আর নয়, এখন ভিতরে চল।"
রুম বললে, "ঝগড়, লুচি ভাজতে বল-না, আমার খিদে পেয়েছে।" ঝগড় রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই বোগি বললে, "স্-স্-স্, দ্যাখ।"
বাঁধের ধার বেয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে নেমে, এক লাফে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, শিংওয়ালা লোকটা একেবারে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। ওর পিঠে একটা লম্বা ঝোলা।
"এই, শোন! আমাকে লুকিয়ে রাখবে?" বোগি রুমু ওর মুখের দিকে তাকাল, এ ওর মুখের দিকে তাকাল।
লোকটা বলল, "আমার পা ব্যথা করছে, তেষ্টা পাচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে। রাখবে লুকিয়ে? তা হলে তোমাদের জাদু-পড়া, গুণ-করা, ভেল্কি- বাজি সব শিখিয়ে দেব। দেখবে?” বলেই লোকটা দিদিমার মার হাতে লাগানো সাদা গোলাপ ফুলের ঝোপের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকে ডেকে বলল, বসেই আবার উঠে দাঁড়াল। কালো পোশাক, কোথায় শিং। মাথায় মুকুট। লোকটা একটু "এই দ্যাখ।" বলে টুপ করে একবার বোগি রুমু অবাক হয়ে দেখলে-কোথায় সাদা চুল, সাদা দাড়ি, সাদা পোশাক, হেসে আবার টুপ্ করে একবার বসেই উঠে পড়ল! আবার কালো পোশাক, মাথায় শিং যে-কে সেই।
বোগি রুমু উঠে একবার গোলাপগাছের পিছনটা ভালো করে দেখে এল। কোথাও কিছু নেই।
"কি দেখছ, দিদি? ভেল্কি লাগিয়ে দিতে পারি, কিন্তু ঠকাই না।" বোগি বললে, "এসো, তোমাকে লুকিয়ে রেখে দেব, শোবার জন্য দড়ির খাট দেব, জল খেতে দেব, কিন্তু আমাদের অন্ধকারে দেখতে শিখিয়ে দিতে হবে, মাটিতে কান পেতে এক মাইল দূরে বনের মধ্যে হরিণ-চলা শুনতে শিখিয়ে দিতে হবে।"
রুম বললে, "আর সেই ?"
লোকটা অবাক হয়ে বলল, "কি সেই, দিদি?"
"সেই যে, বাঁশি বাজালে জন্তু-জানোয়ার বশ হয়?"
"হ্যাঁ, তা-ও শিখিয়ে দেব, চোখের সামনে আমের আঁঠি থেকে আম গাছ করে তাতে ফল ধরাতে শেখাব, দড়ি বেয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে শেখাব-" বোগি বলল, "ধ্যেৎ !"
লোকটা বললে, "ধ্যেৎ? এই নাও ধর।” বলেই পাশের পেয়ারা
গাছ থেকে একটা প্রকান্ড নীল রঙের কাকাতুয়া ধরে দিল।
বোগি ঢোক গিলে বলল, "চলো।” লোকটা তক্ষুনি নীল পাখিটাকে অন্ধকারে উড়িয়ে দিল। বলল, "হরিণ-চল্লার শব্দ আর এমন কি। আমাদের মণিপুরে তুঁতফলের গাছে রেশমী-গুটির গুঁয়োপোকারা থাকে। রাত্রে যদি গাছতলায় দাঁড়াও, ওদের পাতা চিবুনোর শব্দ শুনতে পাবে।"
দূরে রান্নাঘরের আলো দ্যাখা যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, "আমার মা দুধ দিয়ে কমলালেবু দিয়ে মেখে শীতের রাত্রে বাইরে রেখে • দিত, আর পাহাড় দেশের বেঁটে মানুষরা এসে সে-সব খেয়ে যেত। তাই
আমাদের কোনো অভাব থাকত না।"
রুমু বলল, "তুমি তাদের দেখেছ?" বোগি বলল, "রুমু, বোকার মতো কথা বোলো না।"
দুষ্টু ভূতের ভয় পায়, মালীর ঘরে থাকে না। ঘরের পাশে জলের কল আছে। তাই শিংওয়ালাকে ওরা সেখানে থাকতে দিল। "যাও,
ঢুকে পড়। ঝগড় দেখলে আবার মুশকিল হবে।"
লোকটা একটু ইতস্তত করে বলল, "একটা মোমবাতি হলে হত- না? যদি ইয়ে-মাকড়সা-টাকড়সা থাকে?"
বোগি বললে, "তবে-না বললে, অন্ধকারে দেখতে জানো ?"
সে বললে, "আহা, আমি দেখতে পারি কখন বললাম? বলেছি, তোমাদের শিখিয়ে দেব। আমার অন্ধকারে ভয় করে।" রুমু বললে, "দাদা, দাও-না তোমার নতুন টর্চটা ওকে।" রান্নাঘরের বারান্দা থেকে ঝগড় ডাকল, "বোগিদাদা-আ-আ, রুমুদিদি-ই-ই।" আর অমনি ওরাও লোকটার হাতে টর্চ গুজে দিয়ে ধুপধাপ্ দৌড় লাগল।
সব শেষের পেটফোলা গরম লুচিটা লাল কাশীর হয়। রান্নাঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওরা মুখ ধুল। জল পড়ে, সেখানে একটা মস্ত লঙ্কা গাছ হয়েছে। চিনি দিয়ে খেতে যেখানে মুখ ধোয়া দুখু বলেছে, ওকে কেউ লাগায় নি, আপনা থেকেই হয়েছে। তাতে ছোট্ট-ছোট্ট তারার মতো সাদা ফুল ফুটেছে আর রাশি রাশি লাল টুকটুকে লঙ্কা ঝুলে রয়েছে। মাথার উপর আকাশটার ঘন বেনী রঙ, কিন্তু দূরের আকাশ আলো হয়ে রয়েছে। কালো বাঁধের উপর দিয়ে কালো গুঁয়োপোকার মতো একটা মালগাড়ি যাচ্ছে, টংলিং, টংলিং, টংলিং করে চেন-শেকল ঝোলাতে ঝোলাতে।
শুনে শুনে ঘুম পায়। রুমু বায়না ধরে, আজ কিছুতেই একলা শোবে না। ঝগড় বিড় বিড় করে কি সব বলতে বলতে বোগির খাটে ওর বালিশটা দিয়ে দেয়। বোগির কানে কানে রুমু বলে, "দাদা!"
"কি, রুম্?"
"ওর যদি ভয় করে?"
বোগি কোনো উত্তর দেয় না। তার পর বিরক্ত হয়ে বলে, "ও কি রুম, আবার কান্নার কি হল ?"
"ও-ঘরে মাকড়সা আছে দাদা, আমি দেখেছি।"
বোগি বললে, "ওকে টর্চ দিয়েছি তো, রুম।" "ঝগড়র ঘরে অনেক জায়গা।"
ঝগড়ু বলল, "কি কানাকানি হচ্ছে। ও-সব ভালো নয় বলে দিচ্ছি। কি, লুকোচ্ছ কি! আজ গল্প শুনবে না ?"
বোগি বললে, "তুমি যাও-না, তোমার কত কাজ বাকি আছে। যাও- না রান্নাঘরে।"
কিন্তু ঝগড় কিছুতেই যাবে না। চৌকাঠের উপর বসে পড়ল। "অসম্ভব জিনিস হয় না বলে?"
বোগি পাশ ফিরে শুল। "হয়, ঝগড় হয়, আমি ভুল বলেছিলাম।" ঝগড় রাগ করে আলো নিবিয়ে সত্যি করেই চলে যাচ্ছে দেখে রুমু
হাত বাড়িয়ে ওর ফতুয়ার পকেটে গুঁজে দিল।
"কি কর দিদি, তামাকের গন্ধ হবে হাতে। কি, চাও, কি?"
"অসম্ভবের গল্প বল ঝগড় ।"
ঝগড় খাটের পায়ের দিকের রেলিং ধরে দাঁড়াল। "তোমরা হয়তো বলবে পরশপাথরও অসম্ভব।"
বোগি গায়ের ঢাকা খুলে ফেলে উঠে বসল। "পরশপাথর অসম্ভব
জিনিস নয়? পরশপাথর থাকলে এত গরিব লোক হবে কেন?"
রুমু বলল, "তুমিই তো বলেছ, এত গরিব যে, বীচিসুদ্ধু কুল ছেঁচে 'খায়।" ঝগড় বলল, “বেশ, তা হলে পৌষ মাসের সন্ধ্যাবেলায় কম্বল গায়ে
দিয়ে বুড়ো লোকটা আমার ঠাকুরদার কাছে আসে নি।" ঝগড় আবার
উঠে দাঁড়াল।
"না, ঝগড় না, দাদা কিছু জানে না, তুমি বল!"
ঝগড় শুরু করলে-"চার দিক চাঁদের আলোয় ঝিঝিম্ করছে এমন সময় সে লোকটা এল। বলল, 'খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।' ঠাকুরদা বললেন, 'কোত্থেকে দেব, এ বছর অজন্মা, আমাদেরই খাবার কুলোয় না, মুরগি সব মরে গেছে, শালকাঠ ভালো দরে বিকোয় নি, দেব কোত্থেকে বল?' লোকটা বলল, 'তোমাদের এ বেলাকার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে?' 'না'। 'বেশ, তবে তোমার ভাগটাই নাহয় দাও আমাকে।' বাড়িতে যা ছিল চেঁচেপুঁছে ঠাকুরদা সব তার সামনে ধরে দিলেন। বলেছি তো, দুমকার ব্যাপারই আলাদা। লোকটা দাওয়ায় বসে বাড়ি- সুদ্ধ সবাকার ভুট্টা দিয়ে ভাত দিয়ে সেদ্ধ সবটুকু খেল, তার পর আমাদের পাহাড়তলির কুয়োর মিষ্টি জলও এক ঘটি খেল। তার পর আঁচিয়ে উঠে ট্যাক থেকে একটা হরতুকি আর একটা ছোট্ট কালো পাথর বের করে হরতুকিটা মুখে ফেলে বলল, 'বড্ড অভাব তোমাদের, তাই-না?' বলে পাথরটা দিয়ে পাথরের বড় থালাটাকে ছুয়ে দিল, অমনি থালাসুদ্ধু সোনা হয়ে গেল।
"সকলে তো থ! বুড়ো লোকটিও কালো পাথরটাকে ট্যাঁকে গুঁজে জঙ্গলের দিকের পথ ধরল। তখন সকলের চোখ চক্চক্ করে উঠল, সোনা থাকলে দুর্ভিক্ষেরও কোনো ভয় থাকবে না। চার দিক থেকে একটা 'ধর, ধর', 'গেল, গেল', রব উঠল। বুড়ো লোকটি একবার ওদের মুখের দিকে তাকাল তার পর একটা লাফ দিয়ে হরিণ হয়ে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।"
বোগি রুমু কিছু বলল না।
ঝগড় বলল, "বল, এ-ও অসম্ভব।"
বোগি বালিশে মুখ গুঁজে বলল, "অসম্ভব হবে কেন?"
ঝগড় তো অবাক। এমনি সময় দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। "সে এক কান্ড শুনে এলাম রে। রামহাটি স্টেশনে কে একটা জাদুকর নানারকম খেলা দ্যাখাচ্ছিল, দেখতে দেখতে দারুণ ভিড় জমে গেল, তার পর কি নতুন খেলা দ্যাখাবে বলে সে এর ঘড়ি, ওর আংটি, তার উর্চ সব নিয়ে দে লম্বা! ঐ ভিড় স্টেশনের মধ্যে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল, সবাই মিলে আঁতিপাঁতি খুঁজেও তার টিকিটি পেল না। কিন্তু তোদের ঘুমুবার সময় হয়ে গেছে, তোরা এখন ঘুমো।"
অনেকক্ষণ পরে রুমু বললে, "দাদা!"
"কি ?"
"টর্চ তো ছিল না ওর কাছে।"
বোগি চুপ করে রইল। রুমু আবার ডাকল, "দাদা!"
"কি বল?"
"ওর কপাল কেটে গিয়েছিল।"
বোগি বললে, "আঃ, রুমু, ফের কাঁদছ কেন?"
"রক্ত বেরুচ্ছিল যে দাদা, টর্চের আলোতে দেখলাম।"
বোগি রুমুর পিঠে মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়ে রইল।
ঘড়ির শব্দ দূরে সরে যেতে লাগল। আরো দূরে বাঁধের উপর
মালগাড়ি যাচ্ছিল উংলিং টংলিং টংলিং। পরদিন সকালে মালীর ঘরে গিয়ে বোগি রুমু দেখল, দড়ির খাটে
উর্চটা রয়েছে, আর-একটা ছোট বাঁশি। লোকটা নেই।