শিবু, শিবুর মা আর শিবুর বউ তিন নম্বর হোগলাপট্টি লেনের দোতলার তিনখানি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত।
একটা ঘরে শিবুর মা শুত, সেটা সব থেকে বড় ও ভালো, কারণ বুড়ি ভারি খিটখিটে। আরেকটাতে শিবু আর শিবুর বউ, শুত, সেটা মাঝারি সাইজের। আর সব থেকে ছোটটাতে শিবু, শিবুর মা আর শিবুর বউ তিনটে কাঁঠালকাঠের পিঁড়িতে বসে কানা-তোলা বড়-বড় কাঁসার থালায় ভাত খেত, বড়-বড় কাঁসার বাটিতে ঝোল খেত, আর বড়- বড় কাঁসার গেলাসে জল খেত। কিন্তু নুন আর লঙ্কা রাখত থালার পাশে সান-বাঁধানো মেঝের উপর।
আগে খেত শিবু আর শিবুর মা, দরজার দিকে পিঠ করে পাশাপাশি বসে। তারা উঠে গেলে খেত শিবুর বউ দরজার দিকে মুখ করে। কিন্তু শিবুর বউ সব থেকে বড় মাছটা নিজের জন্য তুলে রাখত। শিবু জানত না বলে রাগ করত না।
শিবু রোজ রাত্রে খেয়ে-দেয়ে, মুখে একটা পান পুরে, একটা শাবল, একটা শেড-লাগানো লণ্ঠন আর এক থলে হাতিয়ার হাতে নিয়ে চুরি করতে বেরুত। কারণ শিবু ছিল অসাধারণ সাহসী। পুলিশ-টুলিশ দেখে কেয়ার করত না। তা ছাড়া শিবু অসম্ভবরকম দৌড়তে পারত, আর টিকটিকির মতন জলের পাইপ বেয়ে নিমেষের মধ্যে তিনতলায় উঠে যেতে পারত!
যাই হোক, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর শিবু নিজের ঘরে যেত রেডি হবার জন্য, আর শিবুর বউ অমনি রান্নাঘরের দরজার দিকে মুখ করে খেতে বসত।
শিবুর মা নিজের ঘর থেকে ডেকে বলত, "হ্যাঁরে শিবে! জামা ছেড়ে উঁচু করে ধুতি মালকোচা মেরে পরেছিস তো?"
শিবু বলত, "সে আর তোমায় বলে দিতে হবে না!"
শিবুর' মা বলত, "গায়ে আচ্ছা করে তেল মেখে নিতে ভুলিস না।"
শিবু বলত, "আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ ।"
শিবুর মা তবু বলত, “শাবল, লণ্ঠন, থলে সব নিয়েছিস?"
শিবু বলত, "কী মুশকিল!"
তখন রান্নাঘর থেকে শিবুর বউ ভাত-খাওয়া গলায় বলত, "দেখে- শুনে আনবে, ছেঁড়া-ফাটা না হয় যেন।"
শিবু বলত, "জ্বালালে দেখছি!"
আর শিবুর মা আর শিবুর বউ একসঙ্গে বলত, "দুগ্গ্গা! দুগ্গা। হরিনারায়ণ !"
শিবুও অমনি চট্ করে অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত।
শিবুর মা তখন নিজের ঘরে আবার ফিরে খাটের নীচে ট্রাঙ্কের পিছনে, আনাচে-কানাচে দেখত সব জিনিস ঠিক আছে কি না। তার ঘরভরা কত জিনিস: রুপো-বাঁধানো গড়গড়া, দাঁড়ানো ঘড়ি, গ্রামো- ফোনের চোঙ, মেমদের হ্যান্ডব্যাগ, পাউডারের কৌটো-এই-সব। এদিকে চোর-ছ্যাঁচড়ের যা উপদ্রব।
বুড়ির ছিল সজাগ ঘুম। শিবু বাড়ি ফিরতেই যেই সিঁড়ির আলগা রেলিঙটা ক্যাচ্কোঁচ্ করত, তার ঘুম যেত ছুটে, আর যা-কিছু ভালো জিনিস বুড়ি আগেই গাপ্ করত।
বউয়ের এদিকে অ্যায়সা ঘুম যে সকালে চা তেষ্টা না পেলে ঠেলা না দিলে ওঠে না। সেও উঠেই কতক জিনিস বাক্সে তোলে-মালা, আংটি, রুমাল, সিগারেট কেস। আর বাদবাকি যা থাকে শিবু তাই বিক্রি করে সংসার চালায়।
তবে দিনে-দিনে শিবুও চালাক হয়ে গেছে। সেও অর্ধেক জিনিস আগেই গছিয়ে আসে!
এমনি করে পুজোর সময় এসে গেল!
মহালয়ার দিন! শিবু রাতে খেতে বসে ভাবছে যে একটা • মোটারকমের দাঁও মারতে না পারলে তো আর এই মা-টিকে আর গিন্নিটিকে ঠেকানো যাবে না!
এমন সময় একজন লোক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রান্নাঘরের দরজায় ঠেস্ দিয়ে দাঁড়াল। শিবুর বউ অমনি জিব কেটে ঘোমটা দিল।
লোকটার একটা চোখ আছে, আরেকটার উপর সবুজ একটা তাপি মারা। নাকটা কার ঘুষি খেয়ে থ্যাবড়া-পানা হয়ে গেছে, থুতনিটা বুলডগের মতন, মাথার চুলে কদমছাট, গায়ে একটা কালো হাফপ্যান্ট আর সাদা হাতওয়ালা গেঞ্জি। শিবুর তখন খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে জল খেয়ে, গেলাসটা থালার ঠিক মধ্যিখানে রেখে, লোকটিকে বলল, "ভপি! কী মনে করে?" গুপি কোনো কথা না বলে ডান হাতের বকবার আঙুল বেঁকিয়ে শিবুকে ডাকল। শিবু উঠে বাইরে গেল। এতক্ষণ শিবুর মা ও শিবুর বউ একহাত করে ঘোমটা দিয়ে, দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে ছিল। এবার তারা আবার এদিকে ফিরল। শিবুর মা মস্ত একগ্রাস ভাত মুখে পুরল আর শিবুর বউ নখ খুঁটতে লাগল।
এদিকে গুপি শিবুর কানের কাছে মুখ দিয়ে জোরে-জোরে ফিস্- ফিস্ করে বলল, "শিবে, তুই রাজা হবি! আজ তোর কপাল খুলে যাবে রে শা-! চিংড়িহাটার জমিদারের বাড়ি চিনিস তো? সেই যেখানে আমার মামাতো ভাই চাকরি করে, সেই যে দোতলার লোহার সিন্দুকে ইয়া ইয়া পায়রার ডিমের মতন মণিমুক্তো আছে! আজ কেউ বাড়ি থাকবে না। গিন্নি রেগে-মেগে ছেলেপুলে, সেপাই, ডালকুত্তা আর বাপের বাড়ির গয়না নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। জমিদারবাবুও রেগে- মেগে মাছ ধরতে চলে গেছেন। কাল সব ফিরে আসবে যে যার রাগ
পড়লে। আজ রাতে বুঝলি কি না-" শিবু বলল, "গয়না-না নিয়েই চলে গেছে ?"
গুপি বলল, "সে তো শুধু বাপের বাড়ির গয়না। আসলগুলো এখানে !"
শিবু-"তোর তাতে কী?"
গুপি-"তুই কাজ বাগাবি, তিন ভাগ তোর। আমি খবর এনেছি, এক ভাগ আমার। রাজি?"
শিবু বলল, "রাজি।" গুপি চলে গেল। মায়ের আর বউয়ের উৎসাহ দ্যাখে কে! "ওরে শিবে, দেরি করিস
নি! পায়রার ডিমের মতন দুটো-একটা আমরা নেব।" শেষপর্যন্ত তোড়জোড় করে শিবু বেরুল।
গভীর রাত্রে চিংড়িহাটার চেহারা বদলে গেছে। বাড়িগুলো আরো কাছাকাছি ঘেঁষে এসেছে, মাঝের গলিগুলো আরো সরু, আরো লম্বা হয়ে গেছে। থেকে-থেকে বিরাট বিরাট ষাঁড় দিব্যি নিশ্চিন্তে পথ জুড়ে শুয়ে আছে। অন্ধকারে তাদের ফোঁস্-ফোস্ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। রাস্তায় জনমানুষের সাড়া নেই, খালি পথের ধারে ডাস্টবিনের পাশে মড়াখেকো খেঁকিকুকুর পিছনের ঠ্যাঙের ফাঁকে ল্যাজ গুঁজে আকাশের দিকে মুখ করে বিশ্রী করে ডাকছে। আকাশে একটু-একটু মেঘ, আর চারি দিকে অন্ধকার।
এমন সময় শিবু এসে সেখানে পৌছল।
মস্ত বাড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু শিবুর নাড়ি-নক্ষত্র সব জানা ছিল। পিছন দিক দিয়ে গিয়ে উঠোনের পাঁচিল টপকে শিবু একগাদা ঘুঁটের উপর পড়ল। সামনে একটা কাচের জানলা, তাতে শিক দেওয়া নেই। অন্যদিন এখানে ডালকুত্তা বাঁধা থাকে।
শিবু তখন পায়ের বুড়ো আঙুলে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করল। বাঁ হাতে একটা আঠা-লাগানো কাগজের একটা দিক জানলার কাচে সেঁটে দিল, তার পর ডান হাতে একটা ন্যাকড়া-জড়ানো হাতুড়ি দিয়ে এক-ঘা দিতেই কাচটা ভেঙে গেল। কোনো আওয়াজ হল না। ভাঙা কাচটা কাগজে আটকে ঝুলে রইল। শিবু তখন সেই ফুটো দিয়ে হাত গলিয়ে ছিটকিনি তুলে জানলা খুলে ফেলল আর এক নিমেষে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
একেবারে নিঝুম ঘু্যুটে অন্ধকার, শিবু খুব সাবধানে এগুতে লাগল। আলোর ঢাকনিটা একটু তুলে দেখল চওড়া শ্বেতপাথরের ছক- কাটা বারান্দা, তার এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। তার আবার ধাপে-ধাপে খোঁচা-খোঁচা কি সব গাছপালা পেতলের হাঁড়িতে বসানো। জনমানুষের সাড়া নেই।
শিবু উপরে ওঠবার জন্য সবে এক পা তুলেছে, এমন সময় নাকে এল কিসের একটা কেমন চেনা-চেনা সোঁদা-সোঁদা আঁশটে গন্ধ ।
শিবু ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখচোখের চেহারা অবধি বদলে গেল। শিকার দেখলে বেড়ালের যেমন হয়।
নাক উঁচু করে শুঁকতে শুঁকতে সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে একেবারে ভাঁড়ারঘরের সামনে হাজির। দরজায় মস্ত তালা মারা, কিন্তু শিকলির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা চোখ-ভোলানো একটা আটসেরি কাতলা মাছ ঝুলে রয়েছে।
শিবুর মন থেকে আর সব-কিছু মুছে গেল। এ যে সাত রাজার ধনের বাড়া কাতলা মাছ! শিবু কাতলা মাছের দড়ি কেটে নামিয়ে নিয়ে পিঠে ফেলে সোজা সদর দরজা খুলে, আবার সেটা সযত্নে ভেজিয়ে রেখে, একেবারে সটান তিন নম্বর হোগলাপট্টি।
সিঁড়ির ক্যাচ্কোঁচ্ শুনে শিবুর মা দৌড়ে এসে বলল, "কই পায়রার ডিমের মতন?" তার পর মাছ দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললে, "অ শিবে! এমনটি যে পনেরো বছর দেখি নি। সের-দশেক হবে, না রে?"
বউও জেগে ছিল, ধুপধাপ্ করে দৌড়ে এসে বলল, "পায়রার ডিমের মতন সত্যি?" তার পর মাছ দেখে গালে হাত দিয়ে বলল, "আরে বাবা রে! এমনটি যে জন্মে দেখি নি। বড় বঁটিটা বের করতে হবে দেখছি।"
শিবু মাছটা তার হাতে দিয়ে বলল, "তিন ভাগ আমার, একভাগ গুপির। ও খবর এনেছে!"