বুঝলে, আমার মামাবাড়িতে ফান্ড বলে একটা চাকর ছিল। বাঙালি নয়। ঐ গারো পাহাড়ে অঞ্চলে ওর বাড়ি। আশা করি গারো পাহাড় কোথায় সে কথা আর তোমাদের বলে দিতে হবে না। ফান্ড যে বাঙালি নয় সে ওকে দেখলেই বোঝা যেত। বেঁটে, মোটা, এক মাথা কাঁটা কাঁটা চুল, দারুণ ফরসা আর খেত যে, আরে বাপ্, দেখলে তোমাদের তাক্ লেগে যেত। রোজ দুটি বেলা এক গন্ধমাদন পর্বত ভাত আর এক গঙ্গা জল তার চাই। তাই দেখে আমরা হাসাহাসি করলে আবার সে কি রাগ!
"অত হাসবার কি আছে, দিদি? জানো, আমরা হলাম গিয়ে পরীদের বংশ। আমরা নানারকম তুক্তাক্ ভেল্কি-মন্তর জানি, একটু না খেলে আমাদের চলবে কেন?"
একদিন আমার মামাতো ভাই নগা বলল, "দ্যুৎ? পরী আবার হয় নাকি? যত-সব বানানো গল্প। চালাকি করবার আর জায়গা পাও নি।” তাই শুনে ফান্ড এমনি চটে গেল যে আরেকটু হলেই থালায় এক পাহাড় ভাত ফেলেই উঠে যাচ্ছিল। নেহাত অত ভাত খেলে বেড়ালটার অসুখ করতে পারে বলেই গেল না। পাহাড়টিকে শেষ করে, এক কলসি জল গিলে, "তোমরা জানোই-বা কি আর বোঝই-বা কি? কোনো কথা না বলে তার পর আবার বলল, ইস্কুলে গিয়ে কয়েকটা বই মুখস্থ করে নিজেদের সব মস্ত পণ্ডিত মনে কর। বলি, একটা তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পারো ?"
নগা বললে, "হ্যাঁ, তুমি পারো না তো আরো কিছু! একটা থালা মাজতে পারো না, পিসিমার কাছে তাড়া খাও, তুমি আবার বাঘ বানাবে!" ফাণ্ড ব্যস্ত হয়ে বলল, "আস্তে, খোকাবাবু, আস্তে। বড়রা শুনতে পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না।" নগা বললে, "কেন, আস্ত রাখবে না কেন?"
"আরে আমার ঠাকুরদা শুধু যে তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পারত তা নয়, তার উপর সুতো বেঁধে মানুষকে ছুচো বানিয়ে দিতে পারত।" "মানুষকে ছুচো বানাত বললেই হল। কক্ষনো মানুষকে ছুচো বানাত না।"
ফাগু বলল, "আহা, ছুঁচো বানাত তো আর বলি নি, বানাতে পারত। খুব দয়ালু ছিল তাই বড়-একটা বানাত না। তবে মানুষকে ইঁদুর ব্যাঙ কাঁচপোকা বানিয়ে দিতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।"
শুনে আমরা সবাই একেবারে থ মেরে গেলাম। ফান্ড আরো বলল, "আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পাহাড়ের নীচেকার গাঁয়ের চমক মোড়ল ঠাকুরদার কাছে টাকা ধার করে শোধ দিচ্ছিল না বলে, ঠাকুরদা প্রথমে সরষে পুড়িয়ে তাকে আমাদের বাড়িতে এনে, তার পর তার চার দিকে সুতো বেঁধে মন্ত্র পড়ে একটা ব্যাঙ বানিয়ে, একটা মাটির হাঁড়িতে সরা চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তার পর চমরুর বউ হাঁউমাউ করে কেঁদেকেটে এসে টাকা শোধ করে দিয়ে গেলে, তবে ঠাকুরদা আবার চমরুর মাথায় ঘুঁটের ছাই মাখিয়ে ওকে মানুষ করে দিলেন। ঐজন্যেই বার বার বলি, খোকাবাবু, আমার পিছনে লেগো না।"
নগা মাঝে মাঝে ফাণ্ডর মাথার টিকি ধরে টানত কিনা, তাই ফাণ্ড ওরকম বলল। নগা যদিও মুখে বলল-"হ্যাঁঃ। উনি সব-কিছু করতে পারেন, অথচ দশ-টাকা মাইনেতে বাড়িঘর ছেড়ে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছেন!"-মুখে একটু চাল দিল বটে কিন্তু টিকিতে হাত দিল না।
ফাগু আস্তে আস্তে উঠে থালা-ঘটি নিয়ে আঁচাতে গেল। যাবার সময় শুধু বলল, "টাকাপয়সা তৈরি করতে পারি এ কথা তো বলি নি, খোকাবাবু। সে আমার ঠাকুরদাদাও পারত না। আর সে যা পারত, আমার বাবা অতটা পারত না। আবার আমি পারি আরো কম। তবে একেবারে যে কিছুই পারি না তাও নয়। দেখাব এখন একদিন। এখন তোমরা কেটে পড় দিকিনি। চাকর-বাকরদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম মোটেই ভালো নয়।"
বুঝতেই তো পারছ এ-সব কথা বড়দের কাছে মোটেই বলবার মতো নয়। তার পরদিন সন্ধেবেলা ফাণ্ড মুঠোর মধ্যে করে কি একটা ছোট্ট লাল বীচি আর একটা তামার আংটি দ্যাখাল। "কি রে ফান্ড, ও দিয়ে কি হবে?" ফান্ড বলল, "আংটি পরে ওটা খেলে, তার পর যদি আমার জানা একটা মন্তর মনে মনে বলা যায় তা হলে যখনই ইচ্ছা হবে তখুনি আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারব। এর অনেক বিপদও আছে, কাজেই তোমরা যেন আবার খেতে-টেতে চেয়ো না।" এই-না বলে আমাদের সামনেই টপ্ করে সেটাকে গিলে ফেলল। আরেকদিন, দেখি পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা তামার মাদুলি বাঁধা। বলে কিনা, "ওটা যতক্ষণ আমার পায়ে পরা থাকবে, ততক্ষণ সব জন্তু-জানোয়ারদের কথা আমি বুঝতে পারি, দিদি।" নগা বিরক্ত হয়ে বলল, "হ্যাঁ, তাই বৈকি, এদিকে ক খ পড়তে পারেন না, বাড়িতে চিঠি লিখতে হলে আমাকে এসে খোসামুদি করেন, উনি বুঝবেন জন্তু-জানোয়ারদের ভাষা!"
আমার ছোট মামাতো বোন টিনা বলল, "সস্প্যানকে বলেন ন্যাজ্- পানা, রেফ্রিজারেটরকে বলেন ক্যাবেন্ডিস্, ইলেকট্রিককে বলেন লিক্টিস্, উনি বাঘা পুষিদের কথা বুঝবেন।" ফান্ড একটু কাষ্ঠ হেসে বলল, "দ্যাখ দিদি, পরীদের ইংজিরি শিখবার দরকার হয় না, ঐ যে কাল মাস্টারবাবু তোমাদের বকতেছিলেন বাঁশ বেয়ে বাঁদর ওঠে বুঝতে পারছিলে না বলে, ও-সবও আমাদের শিখতে হয় না। আমাদের দেশে 'আমি নিজের চোখে দেখেছি বাঁদররা বাঁশ বেয়ে বেয়ে ওঠা-নামা করতেছে। একটুখানি ওঠে আবার একটুখানি করে পিছলে পড়ে যায়, আর রেগেমেগে সে যা বলাবলি করতেছে, সে আর তোমাদেরকে না বলাই ভালো, কোন ফাঁকে কি শিখে নেবে। হ্যাঁ কি বলছিলাম, জন্তুদের কথা বুঝি বৈকি। এই তো একটু আগে পুষি বলছিল, খোকাবাবু হাত না ধুয়েই পিসিমার বাটি থেকে দুধ চুরি করে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। অত হাসছ কি দিদি? কাল বাঘাকে কে ঐ পুজোর সময় ছেড়ে দিয়েছিল সে কথাও বাঘার কাছে শুনেছি।"
এর পর ফাগুকে আমরা খুব বেশি ঘাঁটাতাম না। কিন্তু সত্যি ব্যাটার খাওয়ার আর ঘুমের বহর দেখে অবাক না হয়ে পারতাম না। মাঝে মাঝে আমাদের বলত, "দ্যাখ, দাদা দিদি, তোমরা যদি আমাকে খুশি করতে পার তোমাদের আমি ঐ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মন্তরটা শিখিয়ে দেব। আমরা তখুনি ওকে আমাদের পয়সাকড়ি, যার যা হাতে ছিল দান করে বসলাম। "এবার খুশি হয়েছ তো ফাণ্ড, এবার শিখিয়ে দাও।” ফাগু বলত, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, শিখিয়ে দেব বৈকি। তবে একটা কালো প্যাঁচার চোখের মণি লাগবে। সেটা আনতে পারবে তো?" আমরা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে এ ওর দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম! শেষে নগা বলল, "কি যে বল ফান্ড, প্যাঁচার চোখ কোথায় পাব? আচ্ছা এই কালো মার্বেলটাতে হবে না?" ফান্ড একটু ভেবে বলল, "তা হতে পারে, পরীদের ছেলে আমি, ওটা শক্ত হলেও আমার পক্ষে অসম্ভব নয়, কিন্তু তা হলে যে, আবার জ্যাঠামশাইয়ের ঐ ভালো তামাকটার এক দলা লাগবে। আর দেখ, খোকাবাবু, কাউকে যদি এ-সব কথা বল তো মন্তব্ব তো হবেই না, বরং পড়া-টড়া যা একটু-আধটু জানো তাও সব ভুলে যাবে।" নগা বলল, "পাগল, পাগল, এ-সব কথা কাউকে বলি কখনো।"
তামাক পেয়ে ফাণ্ড বলল, "আজ তো হবে না খোকাবাবু, আজ সকালে পশ্চিম দিকে ছাগল ডেকেছিল, আজ হবার নয়। কাল বিষ্যুৎবার, বাদ দিতে হবে, পরশু একাদশী পরন্ড মস্তর-তন্তর করলে ম্যালেরিয়া হয়, সেই গিয়ে একেবারে শনিবার করতে হবে। তা এক দিক দিয়ে ভালো হল, সেদিন ছোটকাকিমাও বাপের বাড়ি থেকে আসবেন, ওনার সঙ্গে সেই দুষ্টু বিজুও আসবে, ওকেও তা হলে শিখিয়ে দিতে পারব। আচার-টাচার চুরি করতে ভারি সুবিধে হবে।"
তাই হল। কোনোরকমে বিষ্যুৎ শুক্কুরটা পার করে শনিবারু সকালে যেই ছোটকাকিমার সঙ্গে বিজু এসে উপস্থিত হয়েছে, ধরলাম। গিয়ে ফান্ডকে। নগা বলল, "আর চালাকি চলবে না, ফান্ড, বলে রাখলাম। যা, যা, বলেছিলে সব হয়েছে। এবার না শিখিয়ে দিলে কিন্তু বাবাকে বলে-টলে একাকার করব, সে পড়াই ভুলি আর যাই করি!" আমি বললাম, "হ্যাঁরে, সত্যিই তাই। তা ছাড়া এমনিতেই তো প্রায় সবই ভুলে গেছিস, মাস্টারমশাই বলছিলেন না?" খুশি হওয়া দূরে থাকুক নগা আমাকে এক ধমক দিল, "চুপ। আমি তোর চেয়ে বড় না।” বিজু বললে-"আহা, তোরা থাম্ না। দ্যাখ্ ফান্ড, পড়া-টড়ার জন্য আমি কেয়ারই করি না। জানিই না কিছু, ভুলব কি ছাই। তবে এটুকু বলে রাখি চালাকি করবি তো পিটিয়ে ছাতু করে দেব। তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো লোকদের একেবারে আমচুর বানিয়েছি তা জানিস? যখন শেষটা ছেড়ে দিয়েছি পানের মসলার সঙ্গে তাদের কোনো তফাত থাকে নি। কাঁদতে কাঁদতে সব বাছাধনরা বাড়ি গেছে।"
ফান্ড বলল, "আরে না, না। অত অবিশ্বাস করলে কি চলে, দাদা? আজ সন্ধ্যাবেলায় সুয্যি ডুববার একঘণ্টা পরে খুব ভালো সময়। তোমরা চারজনে একটা নতুন কাঁসার ঘড়ায় পঞ্চাশটা সন্দেশ, একটা নতুন ধুতি, একটা নতুন গামছা, আংটিটা তো আমার পকেটেই আছে"- বলে ফান্ড এ পকেটে সে পকেটে হাতড়াতে লাগল। সব্বনাশ আংটি তো নেই। "তার কি হবে। এমনি আংটিতে তো হবে না, ওটা যে মন্ত্রপূত ছিল।"
এ্যা ফান্ড! শেষ কালটা সব পণ্ড! বিজু ঘুঁষি পাকিয়ে বঙ্গল, “দ্যাখ্, চালাকি রাখ্, আংটি যখন তুই হারিয়েছিস তোকেই ব্যবস্থা করতে হবে। এক মিনিট সময় দিলাম। ফাগু কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলল, "লাল পাথর-বসানো বড় সোনার আংটি একটা হলেও চলে যায়। তা সে আমি কোথায় পাব?" বিজু একটু হেসে বলল, "আচ্ছা, সে আমি দেব 'খন। কিন্তু অদৃশ্য হতে শেখাতে হবে।"
ফাগু বলল, "সে আর বলতে। ঠিক সাড়ে ছটার সময় ঐ জিনিস- গুলো নিয়ে, গোয়াল ঘরের পিছনে ঐ খালি গুদোম ঘরটাতে তোমরা এসো। আগে আমি নিজে অদৃশ্য হয়ে দেখব পারি কি না, আংটিটার জন্যই একটু ভাবছি। তার পর তোমাদের শিখিয়ে দেব। তবে কি জানেন দাদাবাবু, এ-সব বড় শক্ত খেলা, এইটুকু ভুল করেছি তো সর্বনাশ। হয়তো চিরটা কালের মতো বিজু বললে, "ন্যাকামো রাখ্। উবে যাব, হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যাব।" সাড়ে ছটাই ঠিক রইল।"
সন্ধেবেলা বড়রা সিনেমা দেখতে গেলে, বিজু ছোট কাকিমার সঙ্গে এসেছিল ওর বিয়ের যে ঘড়া, তত্ত্বর সন্দেশ, ধুতি, গামছা আর নিজের নতুন লাল পাথরের আংটি, এই-সব নিয়ে আমাদের সঙ্গে গুদোম-ঘরে গেল। সেখানে ফান্ড অপেক্ষা করছিল। "কাউকে বল নি তো তোমরা? তা হলে কিন্তু মন্তর ফলবে না।" "আরে না, না, এবার শুরু কর।" ফান্ড ঘরে ঢুকে বলল, "তোমরা একটু বাইরে দাঁড়াও, গোপনে মস্তরটা সড়গড় করতে হয়।" বলে জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। আধ ঘণ্টা গেল, এক ঘণ্টা গেল, চার দিক দিয়ে এমনি অন্ধকার হয়ে এল যে আর কি বলব। তার পর বড়রা সাড়ে আটটার পর এসে হাজির হবে, তখন কিছু হবার জো নেই। এত দেরি করলে মস্তর শিখব কখন! শেষটা বিজু কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলে খুলে ফেলে দিল। গিয়ে দেখি সব ভোঁ তাঁ। ফাগু ও জিনিসপত্র সব ডিস্যাপিয়ার্ড!
ভেবেই পেলাম না কি হল। ব্যাটা মস্তরই ভুল করে চিরকালের মতো হাওয়াই হয়ে গেল, না কি-আমরা সবাই গুদোম ঘরের দেয়ালের *ছোট জানলাটার দিকে একবার তাকালাম। খালি বিজু একটু মাথা চুলকে বলল-"আমি আবার আমার বন্ধু জগাইয়ের কাছে খানিকটা খানিকটা বলেছিলাম, সেইজন্যই কি বেচারা শেষটা হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল নাকি?"
পরে গোলমাল হয়েছিল বৈকি, আংটির কথা কেউ না জানলেও, ঘড়া নেই, সন্দেশ নেই, কাপড় নেই, ফান্ড নেই। গোলমাল হবে না? তবে ফাণ্ডকে পাওয়া যায় নি।