গোরুদের ঘরের পিছনের ছোট ফটকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। গোয়ালের কোনায় একটা মাটির ঢিবির উপর ঝোপের আড়ালে বসে-বসে একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছে আর একটু-একটু পা দোলাচ্ছে। সারা গায়ে ধুলো মাখা, কাপড়-চোপড় ছেঁড়া-খোঁড়া, খালি পা, এখানে-ওখানে কেটে গেছে।
আমাকে দেখেই বলল, "আঃ, তোকে দেখে ধড়ে প্রাণ পেলুম রে। এখন বড় একঘটি জল দিয়ে প্রাণটাকে বাঁচা দিকিনি বাপ্।"
কেউ কোথাও নেই, গুটিগুটি গোরুর ঘরে গিয়ে শ্যামলী-কপলীদের দুধ দোয়াবার বালতি ভরে ঠান্ডা জল নিলাম, ওদের মস্ত পিতলের ঘটির নীচে অনেকখানি দুধ পড়েছিল, তাও নিলাম।
• লোকটা জল দিয়ে হাত-পা মাথা সব ধুয়ে ফেলল, পকেট থেকে একটা জঘন্য নোংরা রুমাল বের করে ঘাড়টা মুছে নিয়ে চক্চক্ করে সব দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলল।
তার পর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলা নেই কওয়া নেই আমার পায়ের উপর সটাং এক প্রণাম ঠুকে বসল। আমি তো মহা অপ্রস্তুত।
তার পর আমার মুখের দিকে পিপিট্ করে তাকিয়ে বলল, "তা শাহেন-শার নাকে-চোখে জলের দাগ কেন? কাঁদা-টাঁদা হয়েছে নাকি? আজ্ঞা করেন তো এখুনি সব ব্যাটার মুণ্ডু কেটে নিয়ে আসি।" বলেই খপ্ করে শূন্য থেকে এই মস্ত এক তলোয়ার ধরে নিয়ে, মাথার চার দিকে সেটাকে পাঁই-পাঁই করে বার-দশেক ঘুরিয়ে, আবার সেটাকে শূন্যে 'ছুড়ে দিল আর সেটাও তখুনি কোথায় মিলিয়ে গেল।
লোকটা আমার দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে বলল, "কি সার্, অবাক হলেন নাকি? চোখ যে গোল-গোল হয়ে গেল, ঠোঁট যে ঝুলে পড়ল। তা, কাঁদাকাটির কি হল তা তো বান্দাকে বললেন না?"
আমি নাকটা একটু মুছে নিয়ে বললাম, "বাড়িসুদ্ধ সব্বাই স্কুলের মাঠে ম্যাজিক দেখতে গেছে। আমার কাল জ্বর হয়েছিল বলে মেজো- মামা আমাকে নিয়ে গেলেন না।"
লোকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, "ও কি জাঁহাপনা! আবার চোখে জল কেন? আরে, আপনিও যেমন। কি ম্যাজিক দেখাবে সরু ঠ্যাঙ- ওয়ালা এ গুপো হতভাগা! ও-ব্যাটা জানেই-বা কি, আর পারেই-বা কি! পারে এরকম করতে?" বলেই ঘটিটা তুলে নিয়ে তার ভিতর থেকে একটার পর একটা কুড়ি-পঁচিশটা খরগোশ বের করে চারি দিকে ছেড়ে দিল, তারাও ল্যাজ তুলে যেদিকে পারল ছুটে পালাল ।
"হ্যাঁ। ব্যাটা জোচ্চুরি করে পাঁচজন পার্টনারের টাকা হাতিয়ে মস্ত এক তাঁবু ফেঁদে বসলেই কি ম্যাজিসিয়ান হয়ে গেল! পারে এরকম?" বলেই বালতিটাকে একটা ঠেলা মারতেই সেটা আমার চোখের সামনে একটা কচ্ছপ হয়ে গিয়ে গুড় গুড় করে ঝোপটার দিকে এগিয়ে চলঙ্ক। লোকটাও "আরে! যাও কোথায় চাঁদ!" বলে ছুটে গিয়ে আমাদের বালতিটা এনে আমার হাতে দিল। আমি তো থ!
তার পর পা-দুটোকে সোজা করে পকেট থেকে একটা দাঁতভাঙা চিরুনি বের করে ঝাঁকড়া কটা-রঙের চুলগুলো আঁচড়াতে লাগল আর মাথা থেকে রাশি রাশি হলদে প্রজাপতি উড়ে যেতে লাগল। তার পর চিরুনিটাকে এক ঝাড়া দিয়ে পকেটে পুরল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম চারি দিক ছোট্ট-ছোট্ট সাদা কাগজের ফুলে ছেয়ে গেল।
লোকটা বলল, "ছিঃ! ওটাকে আপনারা ম্যাজিসিয়ান বলবেন না। ব্যাটা শুঁটকি খায়, ঘুমোলেই নাক ডাকে, আর ভারি পাজি, ছোটলোক। তবে আজ একহাত নিয়েছি ব্যাটার উপর। আমার কাছে ম্যাজিক শিখে আমাকেই আজকাল তোয়াক্কা করে না। জানেন, ওটার এমনি আস্পদ্দা বেড়েছে যে দরোয়ানদের বলে দিয়েছে আমাকে যেন তাঁবুতে ঢুকতে না দেয়। হু। পীরের সঙ্গে মামদোবাজি! ওর চোদ্দোপুরুষের ভাগ্যি যে ওকে ধুলো ফুঁকে উড়িয়ে দিই নি। ঠিক দিতাম। নেহাত ওর মার মনে কষ্ট হবে কিনা তাই ছেড়ে দিলাম। তবে এক্কেবারে ছেড়ে দিই নি, সার্। তাঁবুর বাইরে থেকে এমনি করে একটা তুড়ি মারলাম, আর ওর ট্যাকের পয়সা সব এমনি করে আমার ট্যাঁকে চলে এল।" বলেই লোকটা একটা তুড়ি মারল আর অমনি কোত্থেকে সব রাশি রাশি টাকা টুপ্তাপ্ করে ওর পায়ের কাছে জড়ো হল। সেগুলিকে গোছা করে কুড়িয়ে আবার পকেটে রেখে, লম্বা একটা সেলাম ঠুকে আমাকে বলল, "খোদ কর্তা আজ আমাকে দুধে-জলে বাঁচিয়ে দিলেন, নইলে ছুটতে ছুটতে খিদেয় তেষ্টায় প্রাণপাখি এক্ষুনি ভানুমতীর খেল দেখাচ্ছিল আর-কি! ব্যাটাছেলে কি কম বদমাইস! ওর ট্যাকের পয়সা আপনা থেকেই আমার পকেটে চলে এল, আমি মোটে নিই নি, আর হতভাগা আমার পিছনে কিনা পুলিশ লাগিয়ে দিল! উঃ! আরেকটু হলেই বুকটা এক্কেবারে ফেটেই যাচ্ছিল, ভাগ্যিস বাঁচিয়ে দিলেন। এখন আপনাকে কি দেওয়া যায় বলুন দিকি? এগুলোর খানিকটা নিয়ে আমাকে কেতার্থ করবেন কি?" বলেই শূন্য থেকে একমুঠো টাকাপয়সা ধরে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি মাথা নাড়লাম। সে বললে, "নিন-না সার্। লজ্জা কিসের। আমি হলফ করে বলছি ওর একটা পয়সাও আমার নিজের নয়, সব ভেলকি! সত্যি নেবেন না, সার? আমার কিন্তু কোনো ক্ষতি হত না।" আমি বললাম, "না! পয়সাকড়ি চাই না।" তখন সে টাকাপয়সা- গুলোকে আবার শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, "মনে বড় দুঃখ দিলেন, জাঁহাপনা। প্রাণটা বাঁচালেন, এখন আমি যদি উলটে কিছু না করি তবে যে আমি ঋণী থেকে যাব। সেটা কি ভালো হবে? আচ্ছা। নাহয় ফরমাশ করুন শেষ একটা খেল দেখিয়েই যাই। কি হুকুম বলুন।"
আমি বললাম, "ঐ লোকটা নাকি টেবিল-চেয়ার নাচাতে পারে।" সে হো হো করে হেসে বলল, "ওঃ, এই! টেবিল-চেয়ার তো যে- সে নাচাতে পারে, সময় থাকলে আপনাকেও শিখিয়ে দিতাম। ও কিছু নয়। তার চেয়ে ঢের ভালো নাচ দেখাচ্ছি আপনাকে।" বলেই তার ময়লা রুমালটাতে তিনটে-চারটে গিট দিয়ে নিল, অবাক হয়ে দেখলাম দূর থেকে দেখতে অবিকল একটা ছোট্ট মানুষের মতো হল। তার পর সেটাকে ছুড়ে একটু তফাতে ফেলতেই সেটা লাফিয়ে উঠে একটা সেলাম ঠুকে, কোমরে হাত দিয়ে ঠ্যাং তুলে এমনি নাচতে শুরু করে দিল যে আমার চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড়!
তখন লোকটা আমার দিকে ফিরে বলল, "না, একা-একা বেশি জমাতে পারছে না। আপনার রুমালটিও দেবেন সার ?"
আমি বললাম, "না, না, রুমাল যদি নাচে তা হলে আমি নাক মুহব কি দিয়ে?"
সে বললে, "আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে সার।" বলে নিজের রুমালটিকে আবার হাতে তুলে নিল, আর ওটা ওর হাতের উপরেই নাচতে থাকল। তার পর আস্তে ওর মাথায় একটা টোকা দিতেই দেখি যে একটা রুমাল নাচছিল, তার জায়গায় দুটো রুমাল নাচছে। কতক্ষণ যে ঐ নাচ দেখলাম তার ঠিক নেই। শেষে যেন দূরে লোক- জনের সাড়া পেলাম। লোকটা অমনি লাফিয়ে উঠে কুনিশ করে বলল, "চলি, জাহাপনা। বান্দাকে মনে রাখবেন।" অমনি রুমাল-দুটোও হাত তুলে আমাকে সেলাম করে ওর সঙ্গ নিল। যতক্ষণ দেখা যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, ওরা তিনজনে নাচতে নাচতে আমাদের বাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে। তার পর পথটা যেখানে বেঁকে গেছে, সেইখানে পৌছে ওরা একবার ফিরে দাঁড়িয়ে ঘুরে-ফিরে নেচে নিয়ে, হাত নাড়তে নাড়তে মোড় ঘুরে চলে গেল।
দাদারা সন্ধ্যাবেলা কত কি যে বলতে লাগল তার ঠিক নেই। আমার হাসি পাচ্ছিল। একবার শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, "লোকটার মস্ত গোঁফ আছে না, আর পেন্টেলুনের ঠ্যাং সরু না?” “আরে, সত্যিই তোরে তাই। তুই কি করে জানলি? আর জানিস, শেষের খেলাটি অদ্ভুত, স্টেজের উপর টেবিল-চেয়ারগুলো ডুন্ডুগ্ করে নাচতে শুরু করে দিল!” আমি বললাম, "ও আর এমন কি? একটু শিখে নিলেই ওরকম সবাই পারে। কুর্নিশ করেছিল? সেলাম করেছিল? যাবারু সময় হাত নেড়েছিল?" দাদা বলল, "হ্যাঁরে, তুই পাগল হলি নাকি?” আমি শুধু পাশ ফিরে একটু মুচকি হাসলাম।