রাজামশাই ব্যস্ত হয়ে দরদালানে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন, খিদেয় পেটের এ-দেয়াল ও-দেয়াল একসঙ্গে লেপটে যাচ্ছে, টেবিল পাতা, সোনার বাসন-কোসন সাজানো, মুক্তো-বসানো গেলাসে কেয়ার গন্ধ-দেওয়া জল, রানী ওদিকে মখমলের গদির উপর বসে চাকুচুকুম্ আওয়াজ করছেন, অথচ খাবার দেবার নাম নেই।
মন্ত্রীমশাইয়েরও জিব শুকিয়ে ঘুঁটে, বিশেষ কিছু মুখে বলছেন না বটে কিন্তু পেটের মধ্যে কি যে হচ্ছে দেবতারাই জানেন।
অগত্যা আর থাকতে না পেরে রাজামশাই মন্ত্রীকে বললেন, "মন্ত্রী, যাও তো একটু অনুসন্ধান কর!" মন্ত্রী পাশের ঘরে গিয়ে লাল পোশাক- পরা প্রহরীদের বললেন, "খবর নিয়ে আয়।"
* তারা রান্নাবাড়ির সদর দরজায় ভান্ডারীমশাইকে বললে, “খাবার দেয় না কেন খবর নিন।"
তিনি বাবুচিখানার বাইরে দাঁড়িয়ে নাক টিপে দরজার ভিতর মুণ্ডু ঢুকিয়ে বললেন, "খাঁবার দেতা নেই কাঁইকু?"
খাস খানসামা সাজ-পোশাক-পরা মোটাসোটা বাঙালি মানুষ, হাতের উপর রেশমী ঝাড়ন নিয়ে দৌড়ে এসে বললে, "চপ, কাটলেট, স্যুপ, স্যালাড সব তৈরি, ছোকরা বেল্ দেয় না, তাই খাবার দিতে পারছি না!"
"যাও, দ্যাখ, কেন ঘণ্টা দেয় না।"
খাস খানসামা ছোট খানসামাকে বললে, "যাও, দ্যাখ, ছোকরা কোথায় গেল।"
ছোট খানসামা ঘণ্টাতলায় গিয়ে দ্যাখে ছোকরা সেখানে ঘণ্টাগাছে ঠেস দিয়ে কি একখানা বই পড়ছে, তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, চুল খাড়া হয়ে আসছে, মুখ হাঁ হয়ে গেছে। বই কেড়ে, তার দুই কান আচ্ছাসে পেঁচিয়ে, ঘণ্টার দড়িতে কষে টান লাগিয়ে, ছোট খানসামা রান্নাবাড়ির দিকে এগুলো। চলতে চলতে বই তুলে দ্যাখে লোমহর্ষণ সিরিজ ২২ নং। মলাটের উপর দ্যাখে গুহা থেকে মুখ বের করছে বিকট ভয়ংকর একটা কি যেন।
খাস খানসামা ছোট খানসামার দেরি দেখে দোর গোড়া পর্যন্ত ছুটে গিয়ে দ্যাখে গোল-গোল চোখ করে কি একখানা বই পড়তে-পড়তে হোঁচট খেতে-খেতে সে আসছে! তার মাথায় দুই গাঁট্টা লাগিয়ে, বই কেড়ে নিয়ে, খাস খানসামা খাবার পরিবেশন করতে ছুটল।
রাজামশাই রানীমা মন্ত্রীমশাই, স্যুপ, চপ, কাটলেট, স্যালাড খেয়ে বসে আছেন, খাস খানসামা আর রাজভোগ আনে না। কোনো বিপদ হল না তো, হঠাৎ কোনো শত্রু এসে রাজভোগ খেয়ে ফেলল না তো? মন্ত্রীমশাই ব্যস্ত হয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দ্যাখেন রাজভোগের থালা জানলার উপর নামিয়ে রেখে খাস খানসামা কি একখানা বই পড়ছে আর তার মাথার প্রত্যেকটা চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। রাগের চোটে মন্ত্রীমশাই ছুটে গিয়ে বই কেড়ে নিয়ে, সেটাকে পকেটে পুরে নিজেই হাতে করে রাজভোগের থালা এ ঘরে আনলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর পশ্চিম দেশ থেকে সাহেবদের দূতেরা এসেছে, তাদের সঙ্গে মেলা কথাবার্তা আছে। রাজামশাইয়ের বসে-বসে পায়ে খিল ধরে গেল, দূতদের হেসে-হেসে মুখ ব্যথা হয়ে গেল, মন্ত্রীমশাই আসেনও না, কাজের কথাও পাড়া হয় না। শেষটা আর থাকতে না পেরে রাজামশাই বেরিয়ে গিয়ে দ্যাখেন, বারান্দার ঝাড়লণ্ঠনের তলায় দাঁড়িয়ে এক হাতে কি একটা বই নিয়ে মন্ত্রীমশাই নিবিষ্ট মনে পড়ছেন, আর উত্তেজনার চোটে অন্য হাত দিয়ে মুঠো-মুঠো দাড়ি ছিঁড়ে চার দিকে ছড়িয়ে ফেলেছেন।
রাজা রেগে-মেগে দৌড়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে, ঘরে গিয়ে সেটার উপর চেপে বসলেন, মন্ত্রীও সুড়সুড় করে নিজের। জায়গায় গিয়ে কাজের কথা পাড়লেন।
কথাবার্তা সেরে দূতরা কখন অতিথিশালায় চলে গেছে, মন্ত্রী বাড়ি গেছেন, কিন্তু রাজামশাই আর অন্দর-মহলে আসেন না! শেষটা সখীরাও সবাই হাই তুলছে দেখে রানী রেগে দুদুম্ করে সভাঘরে গিয়ে দ্যাখেন, সিংহাসনে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে রাজামশাই কি একটা বই পড়ছেন, আর তাঁর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, কান দুটো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠেছে। রানী রেগে অন্ধ হয়ে ছুটে গিয়ে রাজার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে তাঁকে শুতে পাঠিয়ে দিয়ে, নিজে রাগে অভিমানে কেঁদে-কেটে গোঁসাঘরে গিয়ে খিল দিলেন। গোঁসাঘরের খাস দাসী তাঁর চুল বেঁধে দিল, রাত-কামিজ এনে দিল, বালিশটাকে আরেকটু উঁচু করে দিল, গন্ধতেলের প্রদীপটা একটু কাছে টেনে দিল। রানী তখন বালিশের তলা থেকে লোমহর্ষণ সিরিজ ২২ নং খানা বের করে দাসীকে বললেন, "তুই আমার চুলে বিলি কেটে দিস না, পায়ের আঙুলগুলো আস্তে-আস্তে টেনে দিস না, এখান থেকে ভাগ। যেখান থেকে পারিস ২৩ নং খুঁজে রাখিস।" বলে বইখানি খুলে নিবিষ্ট মনে পড়তে লাগলেন, আর আস্তে-আস্তে তাঁর ভুরু কপালে উঠে যেতে লাগল, মুখ হাঁ হয়ে যেতে লাগল।