shabd-logo

হলদে পাখির পালক

1 December 2023

0 Viewed 0

এক

কত দেরি হয়ে গেল ভুলো তবু বাড়ি এল না, সন্ধে হয়ে গেল, রাত হয়ে গেল। দাদু তাস খেলতে যাবার আগে বললেন, "খুঁজতে যাবার কিছু দরকার নেই, কেউ তোদের নেড়িকুত্তো চুরি করবে না, খিদে পেলে সুড়সুড় করে নিজেই বাড়ি ফিরবে দেখিস।"

রুমুর গলার কাছটা কী রকম ব্যথা-ব্যথা করছিল; কখন ভুলোর খাবার সময় হয়ে গেছে, বারান্দার কোনায় ভুলোর থালায় দুধ-রুটি- গুলোকে নীল মতো দেখাচ্ছে, পিপড়েরা এসেছে।

জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেনের আগায় কলারটা আটকানো ছিল। খুব মজার দেখাচ্ছিল। ভারি দুষ্টু ভুলো। কলার আঁটবার সময় কান খাড়া করে গলা ফুলিয়ে রাখে। তার পরে যেই-না সবাই চলে যায়, কান চ্যাপটা করে, গলা সরু করে, কলারের মধ্যে থেকে সুড় ও করে বেরিয়ে পড়ে দে ছুট।

কেন ভুলো পালিয়ে যায়?

দাদা চেন কলার আর একটা বেঁটে লাঠি হাতে নিয়ে গেটের কাছে দূরে রেলের লাইনের ওপারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রুমুকে দেখেই রেগে গেল।

"যা, ঘরে যা, এখানে কেন এসেছিস? যা ভাগ্।"

"দাদা, বোধ হয় সে সাঁওতাল গ্রামে গেছে। ওরা যদি মারে?"

"বেশ হবে, ঠিক হবে, আমি খুব খুশি হব, পালানো বেরুবে,

আসুক-না বাড়ি, পিটিয়ে মজা বের কচ্ছি। যা, পালা, ছিঁচকাঁদুনে।' রুম আবার পিছনের বারান্দায় গেল।

এমনি সময় ভুলো বাড়ি এল। অন্যদিনের মতো সামনের গেট দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে নয়। রান্নাঘরের পিছন দিয়ে, দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে ল্যাজ নামিয়ে, কান ঝুলিয়ে, আড়চোখে তাকাতে তাকাতে, স্রেফ একটা চোরের মতো এসেই রুমুর পায়ে মুখ রেখে ল্যাজ নাড়তে লাগল। রুমুর মুখে কথাটি নেই, গা শিরশির করতে লাগল। জানলা দিয়ে খাবার ঘর থেকে আলো এসে ভুলোর গায়ে পড়েছে, সেই আলোতে রুমু দেখতে পেলে ভুলোর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হলদে পালক গুঁজে রয়েছে। সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে।

রুমুর বুকটা ধড়াস্ করে উঠল, এক দৌড়ে দাদার কাছে গেল। "দাদা, ভুলোর ঠোঁটের কোনায় সেইরকম হলদে পালক।" "যাঃ, দূর, হলদে পাখি ঝগড়ুর বানানো।" "না, দাদা, তুমি দেখবে এসো।"

ভুলো মাটির ভাঁড় থেকে জল খাচ্ছিল। হলদে পালকটা ভাঁড়ের জলে ভাসছিল। ভিজে একটু চুপসে গিয়েছে, কিন্তু তখনো সোনার মতো জ্বল্গল্ করছে। বোগি পালকটা তুলে, মুছে, পকেটে রেখে দিল।

কারো মুখে কথা সরে না। কোথাও একটু আওয়াজ নেই, শুধু মাথার উপর একটা রাতের পাখির ডানা নাড়ার ঝপটি, আর দূরে কুসিদিদিদের পোড়ো জমির ঝাউগাছের পাতার মধ্যে দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে, আর রুমু বোগির বুকের ধুন্ধুকি। এবার তবে তো ঝগড় মিথ্যা কথা বলে নি। দারুণ গাঁজাখুরি গল্প বলে ঝগড়। দুমকায় ওদের গাঁয়ে নাকি হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। সেখানে সীতাহার গাছের পিছনে সূর্য ডুবে গিয়ে যেই তার লাল আলোগুলোকে গুটিয়ে নেয়, অমনি নাকি আকাশ থেকে সোনালী রঙের অবাক পাখিরা বটফল খেতে নেমে আসে। তারা ডাকে না, কারণ তাদের গলায় স্বর নেই। তারা মাটিতে বা গাছের ডালে বসতে পারে না, কারণ তাদের পা নেই। এমনি উড়ে ফল খেয়ে আবার আকাশে চলে যায়। কিন্তু দৈবাৎ যদি একটা পাখার ডানা জখম হয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, আর ঠিক সেই সময় যদি তাকে শেয়ালে কি কুকুরে খেয়ে ফেলে, তা হলে সেই শেয়াল কি কুকুর মানুষ হয়ে যায়। তাই শুনে বোগি বলেছিল,  "যাঃ, ঝগড়, যত রাজ্যের বাজে কথা। জানোয়ার কখনো মানুষ হয়?" "বিশ্বাস না করতে পারো, বোগিদাদা, কিই-বা জানো তুমি? জানলে

কি আর রোজ রোজ মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেতে! কিন্তু আমাদের দুমকাতে ঐরকম অনেক মানুষ আছে। তাদের দেখলেই চিনতে পারা যায়। কারণ সবটা মানুষের মতো হলেও, চোখটা হয় পাটকিলে রঙের, আর কানের উপর দিকটা হয় একটু ছুচলো। নেই ওরকম মানুষ তোমাদের এখানেও? কেউ চোখে দেখে না ও পাখি, কিন্তু ঐ মানুষদের দেখলেই সব বোঝা যায়।"

পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নি রোজ সন্ধেবেলায় দাদুর বাড়ির পাঁচিলের তলা থেকে আমরুল পাতা তুলতে আসেন। মাঝে মাঝে আমরুল' তুলতে তুলতে চোখ উঠিয়ে রুমুকে বলেন, "আয় তুলে দে, আমার গেঁটে বাত, এ- সব তোদের কচি হাড়ের কাজ।" ততক্ষণে সূর্য তালগাছের গুড়ির কাছে নেমে গেছে, ছায়াগুলো লম্বা হয়ে গেছে। পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নির চোখে আলো পড়ে, চক্সকি পাথরের মতো ঝঝক্ করে। পাটকিলে রঙের চোখের মণি, তার মধ্যে সোনালী রঙের সবুজ রঙের ডুরি ডুরি কাটা মনে হয়। মাথার কাপড় খসে যায়, ঝিনুকের মতো পাতলা কান, উপর দিকটা গোল না হয়ে খোঁচা মতন।

ওরকম লোক এখানেও আছে।

দিদিমা এসে বলেন, "ওঃ, চাঁদের তা হলে বাড়ি ফেরার মজি হয়েছে। কে জানে হয়তো এবার এ বাড়ির অন্য লোকদেরও পড়াশুনো খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি হবে। মেজোমামা সরভাজা এনেছে, জানিস তোরা ?"

ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ, সরভাজা। রুমু তখুনি চলে গেল। বোগি অনেকক্ষণ ভুলোর নাক মুখ চোখ পরীক্ষা করে দেখল। কই, কিছু তো হয় নি। তার পর খুব আঁটো করে কলার লাগিয়ে সরভাজা দেখতে গেল।

রাতে শোবার সময় মশারি টানাতে টানাতে ঝগড় বলল, "বোগিদাদা, ভুলো কিছু খেল না, চটের উপর শুয়ে খালি ঘুমুচ্ছে।"

বোগি রুমু একবার ঝগড়র দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু আর বলা হল না। ঝগড়ুটা ভারি বাজে বকে, এখনি দাদু-টাদুকে বলে একাকার করবে।

ঝগড় বলল, "কে জানে, যা পাজি কুকুর, ঘরের ভাত মুখে রোচে না, কোত্থেকে কি খেয়ে এসেছে কে জানে।"

বোগি শুধু বলল, “থাক্ চেনে বাঁধা। আজ রাত্রে ছাড়িস না ওকে।" রুমু বলল, "কিন্তু রাতে যদি ক্যাওম্যাও লাগায়? দাদু যদি রাগ করে?"

ঝগড় মশারির দড়িটাকে দাঁত দিয়ে কামড়ে টান করে ধরে, দু হাতে গিট বাঁধতে বাঁধতে বলল, "কম বদমাশ ঐ কুত্তো! সব বাড়ির কুকুর সারাক্ষণ বাঁধা থাকে, আর এনাকে একটু বাঁধলেই পাড়া মাত করবেন। ইদিকে ছাড়লে আবার একে কামড়ে, ওকে কামড়ে একাকার করবেন।"

রুমু বলল, "আহা, রুটিওলা যে ওর ল্যাজ মাড়িয়ে দিয়েছিল।" "তোমাদের দাদুর বন্ধু অনিমেষবাবুও ল্যাজ মাড়িয়েছিল?" বোগির বিরক্ত লাগছিল। “দ্যাখ, ঝগড়, বাজে বোকো না। অনিমেষবাবু কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। জানোই তো কালো জোব্বা দেখলে ভুলো রেগে যায়।" "বেশ, বোগিদাদা, বেশ! তোমাদের কুকুরের জন্য তোমাদের হাতে হাতকড়া পড়লে আমার আর কি হবে, বল!"

ঝগড় চলে গেলে, বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। তার পর একবার উঠে, টেবিল থেকে টর্চটা নিয়ে, গুটিগুটি গিয়ে ভুলোকে দেখে

এল।

ভুলো নাক ডাকাচ্ছে! আবার এসে শুতেই রুমু চাপা গলায় ডাকল, "দাদা!" "চুপ কর। ঘুমো। ঠিক আছে।"

পরদিন সকালে দাঁত মাজতে মাজতে পিছনের বারান্দায় গিয়ে রুমু • বোগি দেখে, জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেন বাঁধা, তার আগায় কলার আটকানো, কিন্তু ভুলো নেই।

দুই

নেই তো নেই। চা খেতেও এল না। বোগি সে বিষয় কোনো কথা না বলে বাড়ির চার পাশটা একবার পিছনে ঝগড়কে একটু বলতে গিয়েছিল। খুঁজে এল। রুমু রান্নাঘরের ঝগড় চেঁচিয়ে-মেচিয়ে এক কান্ড করে বসল।-“আমি যেতে পারি নেড়িকুত্তো খুঁজতে এই সাত সকালে, যদি তোমরা দুজন কুয়ো থেকে জল তুলে স্নানেয় ঘরের চৌবাচ্চা ভরে, রান্নাঘরের ট্যাঙ্কি ভরে, চারাগাছে জল দিয়ে-" দিদিমাও রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন-"আচ্ছা, নেড়িকুত্তো কখনো পোষ মানে শুনেছিস? হাজার চান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কানা-তোলা থালায় করে খেতে দিস, সেই এর বাড়ি ওর বাড়ি আঁস্তাকুড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে-যা দিকিনি এখন, সকালবেলাটা হল গিয়ে সংসারের চাকায় তেল দেবার সময়।"

রুমু ঘরে ফিরে এল। বোগি কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে। "দাদা, হলদে পালকটা দেখি ।"

অদ্ভুত পালকটা। অন্য পালকদের রোঁয়াগুলো একসঙ্গে সেঁটে মোলায়েম হয়ে থাকে। হলদে পালকটার রোঁয়াগুলো কোঁকড়া, রোদ লেগে ঝক্সক্ করছে, হাওয়ায় ফুরফুর করছে। গোড়াটা সাদা কাচের একটা ফুলের বোঁটার মতো।

রুমুর একটু ভয়-ভূয় করতে লাগল। এমনি সময় ওরা হাসিটা শুনতে পেল। ঝগড়ুর ঘরের ওদিক থেকে খিল্বিল্ করে কে হাসছে। বোগি রুমু তখুনি এক দৌড়ে সেইখানে।

ঝগড় দের দাওয়ায় একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর একটা ছোট্ট কালো ছেলে বসে আছে। এত মোটা যে পেটে ভাঁজ-ভাঁজ পড়ে গেছে, মাথায় কয়েক গাছি কোঁকড়া চুল, খালি গা, এক-গাল হাসি, পাটকিলে রঙের চোখ আর বড়-বড় দুটো কান, মাথা থেকে পাখনার মতো আল্গা হয়ে রয়েছে, উপর দিকটা একটু ছু'চলো।

ঝগড়ুর বউ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটাকে টপ্ করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, "আমার ভাইয়ের ছেলে, এখেনে কয়েকদিন

থাকবে। তোমাদের এখন পড়ার সময় না ?" রুমু জিজ্ঞাসা করল-"কখন এল? কাল তো ছিল না। কোথেকে এল ?"

বউ বললে, "আজ ভোরে এসেছে, দুমকা থেকে। তোমরা যাও, তোমাদের দিদিমা রাগ করবে। চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়।"

বোগি দাওয়ার উপর বসে পড়ল।

"কেন ভালো নয় ?"

বউ একটু রেগে গেল।

"দ্যাখ, বোগিদাদা, এখন আমার রাঁধাবাড়ার সময়। অন্য সময় এসো।"

"ছেলেটাকে দাও, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।"

"অ মা! ছেলে নিয়ে তুমি কি করবে?"

"না দিলে কিছুতেই যাব না।"

ঝগড়ুর বউ রেগেমেগে দুম্ করে ছেলেটাকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল।

বোগিও অমনি তাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়।

বারান্দায় তাকে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে সটান ভুলোর থালার কাছে গেল। তার পর খালি থালা দেখে তার রাগ দ্যাখে কে! রুমু একটু রুটি এনে দিতে তবে থামল। বোগি আস্তে আস্তে ডাকল "ভুলো, ভুলো, ভুলো।" ছেলেটা খিল্কিল্ করে হেসে, হামা দিয়ে কাছে এসে, ভিজে ভিজে জিব দিয়ে বোগিকে চেটে দিল। .

রুম কাঁদতে লাগল। গোলমালের মধ্যে ঝগড় এসে ছেলেটাকে বারান্দা থেকে নামিয়ে মোমলতার তলায় ছেড়ে দিল। "তোমরা এইখেনে খেলা করো দিদি। বারান্দার উপরে দিদিমা

দেখলে রাগ করবে।"

ঝুরঝুর করে মোমলতার ফুল ঝরে পড়ছে, তাই দেখে ছেলেটা আহাদে আটখানা। মুঠো মুঠো তুলে মুখে পুরতে চায়! শিশুগাছে দলে দলে বুনো হাঁস ফুলে গাছ ভরে গেছে। এসে বসেছে, দেখে মনে হয় বুঝি বড়-বড় সাদা তাই দেখে খিলখিল্ করে ছেলেটা হেসে ওঠে।

অমনি যেন নিশানা পেয়ে হাঁসের ঝাঁক একসঙ্গে আকাশে উড়ে পড়ে। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ছেলেটা কাঁদতে থাকে।

রুমু বললে, "দাদা, আগেই তো ভালো ছিল।"

বোগি ছেলেটাকে খুব আস্তে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে, "কেন খেইছিলি হলদে পাখি? কে বলেছিল খেতে ?"

ছেলেটার কান্না থেমে যায়, এই বড়-বড় ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে।

রুমু হঠাৎ উঠে পড়ে, ওকে বুকে জাপটে ধরে একেবারে ঝগড়ুর ঘরে বউয়ের কাছে দিয়ে আসে।

বউয়ের হাঁড়িতে উদ্বগ্ করে ভাত ফুটছে, বুদ্বুদ উঠছে; ফেটে যাচ্ছে, ফুটন্ত জল ছিটুচ্ছে, বউ ভারি খুশি! "কি, এরই মধ্যে সখ মিটে গেল? আগেই জানি।"

ওখানে আর দাঁড়ানো নয়। ঘরে এসে দেখে বোগি পালকটাকে কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলেছে। বোগি বললে, "ধেৎ। নেড়িকুকুর পুষতে হয় না। ওদের জাত খারাপ, পোষ মানে না যা-তা খায়। তার চেয়ে বিলিতি কুকুর ঢের ভালো। সেজোমামা একটা দেবে, চাইলেই দেবে। তার জন্য নতুন লাল কলার কিনব। এটাকে ফেলে দে।"

রুমু অমনি জানলা গলিয়ে কলারটা বাইরে ফেলে দিল। নেড়ি- কুত্তোর কলার আবার কে পরবে?

বোগি উঠে দাঁড়াল।

"দ্যাখ্ রুমু, তার ঢুকতে দিবি না কিন্তু। পর যদি কখনো ভুলোটা ফিরে আসে, খবরদার ঠেলে বের করে দিবি।"

"দাদা, ভুলোকে ঠেলে দিলে যে আবার দৌড়ে দৌড়ে ফিরে আসে!

মনে হয় ঠেলে দিলে বোধ হয় খুশি হয়।" "তা হলে বেঁটে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াবি।"

"ওকে মারলে ও নিশ্চয় আমাকে কামড়ে দেবে। কক্ষনো যাবে না।"

“দ্যাখ্, কলারটা বরং আবার তুলে নিয়ে আয়। ছেলেটার গলায়ও মন্দ দেখাবে না। ওকি, এ সময়ে শুয়ে পড়লি যে? সর, আমিও শোব, আমার শরীর খারাপ লাগছে।"



তিন

ঘিকেলে ঝগড় একটা ভাঙা মাটির ভাঁড়ে করে কি যেন নিয়ে এল। "কি রে ঝগড়? কি এনেছিস?"

"উঠেই দ্যাখ না, এ সেই আমাদের দুমকার জাদুকরী মাঞ্জা, ঘুড়ির সুতোয় লাগিয়েছ কি দেখো কি কান্ড হয়।"

"কোথায় পেলি রে?"

"আরে দুমকা থেকে কত কষ্ট করে আমার শালা এনে দিয়েছে।

আহা, হাত দিয়ো না দিদি, মাঞ্জায় কাচের গুঁড়ো দেয়া থাকে জানো না?" "তুমিই তো বলেছ দুমকায় কাচ পাওয়া যায় না বলে জানলায় তোমরা চাটাই বুনে দাও, কাচ কোথায় পেল তোমার শালা? রোজ রোজ উলটোরকম কথা বল!"

"বেশ, বিশ্বাস না হয় আমি কুসিদিদিদের বাড়িতে দিয়ে আসছি, জগুরাও সুতো লাটাই কিনেছে দেখে এলাম। তা ছাড়া দুমকায় কাচ নেই বলে থাকতে পারি, কাচ হয় না তাতো বলি নি। জাদুকরী মাঙ্গায় দুমকার সেই কাচের গুঁড়ো না দিলে অন্য মাঞ্জা থেকে কোনো তফাতই থাকে না।"

রুমু বোগি বিছানা থেকে উঠে এসে বলল-

"কিরকম কাচ, ঝগড় ?"

"তোমরা তা হলে হাত-মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে, জামাকাপড় পরে আমার সঙ্গে চলো, শালবনে ফুল ফুটেছে দেখবে চলো। তা হলে জাদুকরী মাঞ্জার কথা বলব।"

"সত্যি গল্প তো ঝগড়? তুমি কিন্তু ভীষণ গুল্ মারো।"

"ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস কোরো না, আমি আর কি করতে পারি। তবে এই কথা মনে রেখো, দরকার না হলে আমি কখনো মিছে কথা বলি না।"

শালবন থেকে রেলের লাইন দেখা যায় না, কিন্তু ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কত দূর থেকে আসছে, আবার তার পরেই মনে হয় একেবারে কানের গোড়ায়, কিন্তু যেই-না মুখ ফিরিয়ে দেখতে গেছ, অমনি আবার মনে হবে কত দূরে সরে গেছে।

শালবনে থেকে থেকে দক্ষা দক্কা হাওয়া দেয়, সাদা গুঁড়োর মতো রেণু ওড়ে, শালফুলের সোঁদা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।

"ভুলো এলে বেশ হত, না দাদা?" গাছের গোড়ায় ডিপি ঢিপি ফুল জমেছে, ভুলো থাকলে ওর মধ্যে নাক ঢুকিয়ে নেচে কুঁদে একাকার করত। বোগি বলল, "ঝগড়, আর চালাকি নয়। বলো শিল্পির দুমকার কাচের কথা। না, চুপ করে থাকলে চলবে না ঝগড়।"

"চুপ করি কি সাধে! দুমকার কাচের কথা ভাবলেও আমার মনটা উদাস হয়ে যায়। দুমকা কিরকম জায়গা জানো তোমরা? শুকনো খর্খর্ করে চার দিক, আর যেই শীত পড়ো-পড়ো হয়ে আসে, অমনি শিশির্ করে একরকম বাতাস বইতে থাকে। আর গাছে গাছে পাতাগুলো সব আলাদা আলাদা হয়ে বাতাসে গা মেলে দেয়! রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ঐ বাতাসের শব্দ আর পাতা খসার আর দূরে কাদের বাড়িতে শীতলাগা কুকুরের ডাক শোনা যায়। দুমকার লোকেরা কুকুর ভালোবাসে, বোগিদাদা-"

এই অবধি বলে টুকু করে একবার রুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝগড় তাড়াতাড়ি বলতে লাগল-

"আর শুধু কুকুর কেন-কুকুরদের পেজোমির কথা তো তোমরা 'জানোই-দুমকার লোকরা মুরগি ভালোবাসে, শুয়োর ভালোবাসে- বেড়াল বাদে সব জন্তু-জানোয়ার ভালোবাসে-"

"কেন, বেড়াল বাদে কেন?"

"খোলা শত্রুর ভালে, রুমুদিদি, যাদের নখ ঢাকা থাকে আর আলো লাগলে যাদের চোখ ছোট হয়ে যায়, তাদের ভালোবাসতে নেই। দুমকার লোকেরা তাই বেড়াল ভালোবাসে না।"

বোগি বললে, "আঃ, কি বেড়াল বেড়াল করছ, কাচের কথাটা বলো-না।"

"এই বলি শোনো। চাটাই দিয়ে জানলা বন্ধ করে ঝাঁপিঝুঁপি হয়ে শুয়ে থাকি, শরীরটা গরমের মধ্যে আরামে শুয়ে থাকে কিন্তু মনটা ঐ বাইরে বাইরে শীতের মধ্যে পাতা খসার শুকনো গন্ধের মধ্যে, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে হু হু করে বেড়ায়।"

"কেন ?"

"আরে চারি দিক অন্ধকার হয়ে গেলে শরীরের চোখ তো বন্ধ হবেই, আর শরীরের চোখ বন্ধ হলে মনের চোখ খুলবে না? যাই হোক, আমার বুড়ো ঠাকুরদা ভাবলেন ঘরে আলো আনতে হবে। জানলায় কাচ দিয়ে দিনে আলো আনতে হবে, প্রদীপের চার দিকে কাচ দিয়ে রাতে আলো আনতে হবে। কিন্তু দুমকায় কাচ কোথায়, কাচের বড় দাম। তখন আমার বুড়ো ঠাকুরদা শালগাছ, মহুয়াগাছ আর হাজার হাজার মৌচাকসুদ্ধু একটা গোটা বন বেচে দিয়ে, শহর থেকে এক বাবু ভাড়া করে আনলেন, সাহেবদের লেখা কেতাব দেখে কাচ তৈরি করে দেবে। তাকে নিজের ঘর ছেড়ে দিলেন, বিরাট চুল্লী তৈরি করে দিলেন, মালমসলার পাহাড় বানিয়ে ফেললেন, মুরগি আর গাওয়া ঘি খেয়ে খেয়ে রোগা বাবু মোটা হয়ে গেল, কিন্তু কাচ আর হল না।"

"কেন হল না ঝগড় ?"

"আরে আজ নয় কাল নয় করে করে বছর ঘুরে গেল, শেষটা বুড়ো ঠাকুরদা একদিন রেগেমেগে তাকে যা নয় তাই বলে বকাবকি করলেন। তার পর সে ঘোর রাত্রে পায়ে হেঁটেই দুমকা থেকে চলে গেল। সারাদিন তাকে খোঁজাখুঁজির পর গভীর রাতে ঠাকুরদার বড় চুল্লীটা জ্বেলে, তার মধ্যে ঐ পাহাড় পাহাড় মালমসলা আর রাশি রাশি সাহেবদের বই সব ঢেলে দিয়ে, রাগে দুঃখে সারারাত বনে বনে ঘুরে বেড়ালেন।"

"ওরে বাবা! বাঘে খেল না?"

"আরে তোমরা যে কিছুই জান না দেখছি। রাগী মানুষদের আর পাগলদের কেউ কিছু বলে না, তাও জানো না?"

যাই হোক, সকালে উস্কোখুস্কো চুল আর লাল ভাঁটার মতো চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, চুল্লীর সেই গনগনে আগুনে সব জ্বলে-পুড়ে থাক্ হয়ে গিয়েছে, আর তার জায়গায় চুল্লীতে ঠেসে রয়েছে পরত পরত কাচ, আর সবার নীচে উনুনের ছাঁচে ঢালাই হয়ে আছে এই বিশাল এক দলা সবুজ কাচ। কাচ কাটে যারা তারা এল, জানলা হল, প্রদীপের ঢাকনি হল, সব হল, দুমকার দুঃখ তখনকার মতো ঘুচল, আর ফালতো কাচ গুড়িয়ে জাদুকরী মাজায় দেওয়া হল।"

"দুমকার দুঃখ ঘুচল তো তুমি কেন দুমকা ছেড়ে এখানে এলে চাকরি করতে?"

"বললাম-না তখনকার মতো ঘুচল। দুঃখ কি আর চিরকালের মতো ঘোচে, বোগিদাদা? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারে বারে ফিরে আসে। তবে হ্যাঁ, এই জাদুকরী মাঞ্জাটাও কিছু কম যায় না!"

"কেন কি হয় ওতে?"

"সেই কথাই তো বলছি, তা তোমাদের কিছুতেই তর সয় না।" "আচ্ছা ঝগড়, সব জানলায় কাচ হল, তবে তোমরা চাটাই লাগাও কেন?"

"সেও এক কাহিনী, রুমুদিদি। ষাট বছর আগে যে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে দুমকার একটি বাড়িও দাঁড়িয়ে ছিল না, কাচ-টাচ সব গুঁড়ো। এই মাঞ্জা তো সেই গুঁড়ো দিয়েই তৈরি। আমাদের দুমকায় ঘরে ঘরে কৌটো করে সেই কাচের গুঁড়ো তুলে রাখে। মাঞ্জার সঙ্গে একটু করে দেয়া হয়, ফুরিয়ে গেলে আর তো পাওয়া যাবে না, দিদি। চল, এখন না ফিরলে আঁধার হয়ে যাবে, সূর্য ডোবার পর এ জায়গাটাও অন্যরকম হয়ে যায়, চল এখন ফেরা যাক।"

"তা হলে রাত্রে শোবার সময় মাঞ্জার কথা বলবে তো ঠিক?"

ঝগড় দুজনার কনুই ধরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলল-"হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে হবে 'খন।"

রাত্রে মাংস রান্না হয়েছিল। মোটা হাড়গুলো কে খাবে? তার উপর রুমুর খুব পা কামড়াচ্ছিল। দিদিমা ঝগড়ুকে বকলেন- "কি দরকার ছিল ওদের শালবন অবধি হাঁটাবার, ঝগড়? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার দেখি বুদ্ধি বাড়ছে।"

ঝগড় কিছু বলল না। ঝগড় বোধ হয় খুব বুড়ো, কানের কাছের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, হাতের অনেকগুলো নখ ভাঙা, শিরাগুলো উচু-উঁচু হয়ে রয়েছে। রুমু একটা আঙুল দিয়ে ঝগড়র শিরায় হাত বুলিয়ে দিল। বোগি বলল, "ঝগড়, তুমিও চল, আমরা শোব, তুমিও আমাদের সঙ্গে চল।"

হাত ধুতে গিয়ে রুমু একবার কানাতোলা থালাটার কাছে গেল। বোগির রাগ ধরল, "কি করে আসবে সে? তুই এত বোকা কেন রুম? হাড়গুলো তুলে এনে থালায় ফেললি?" রুমু পা দিয়ে থালাটাকে একটু সরিয়ে বলল, "ঝগড়র বউ সন্ধেবেলা ছেলেটাকে কলা চটকে খাওয়াচ্ছিল। আমার বড্ড পা কামড়াচ্ছে, দাদা।" রুমু মহা কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল।



চার

ঝগড় অনেকক্ষণ ধরে রুমুর পা টিপে দিল। পা টিপতে টিপতে মাঞ্জার কথাটা বলল-

"আমরা যখন ছোট ছিলাম, বোগিদাদা, ঐ মাঞ্জা সুতোয় লাগিয়ে একদিন ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। সারাদিন লেগেছিল সুতোয় মাঞ্জা দিতে। লম্বা করে' দুটো শিশুগাছে বেড় দিয়ে সুতো গুকোনো হল। ঘুড়ি উড়োতে সেই বিকেল হয়ে গেল।

"আমি আর আমার ভাই ঝমরু, না খেয়ে না দেয়ে সুতো তৈরি করে আকাশে তো ঘুড়ি ছেড়ে দিলাম। ছাড়তেই মনে হল জ্যান্ত পাখি ছেড়ে দিলাম। ঘুড়ি কাত হল না, গোত্তা খেল না, শোঁ শোঁ করে একেবারে সটান মাঝ আকাশে উড়ে গেল।

"যতই সুতো ছাড়ি ততই ঘুড়ি উপরে উঠে যায়। বামরু বললে, দাদা ঘুড়ির কেন ওজন নেই, টান নেই? বাস্তবিকই তাই, এদিকে লাটাইয়ের সুতোও প্রায় শেষ! আমি বললুম, সারাদিন মাঞ্জা দিলাম, সব কটি সুতো যাবে শেষে, থাক, তুই টেনে নামা।

"কি বলব, বোগিদাদা, সে ঘুড়ি নামতে চায় না, জোর করে। ততক্ষণে সুয্যি ডুবেছে, গাঁয়ের লোক আর যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সবাই চলে গেছে, তখন ঘুড়ি এসে চোখের সামনে দেখা দিল। দেখা দিল কিন্তু মাটিতে পড়ল না। ঝমরু আর আমি দেখলাম, ঘুড়ির কল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশ্চর্য একটা হলদে পাখি! তার পা নেই, মাটি থেকে এক হাত উপরে খালি খালি ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে। গলায় স্বর নেই, ডাকছে না, কিন্তু লাল চুনীর মতো দুটি চোখ দিয়ে পাগলের মতো ইদিকে-উদিকে তাকাচ্ছে।"

বোগি জিজ্ঞাসা করল, "তবে না বলেছিলে কেউ ও পাখি চোখে দেখে নি?"

"মিথ্যা কথা বলেছিলাম বোগিদাদা। আর কেউ কখনো দেখে নি. শুধু ঝমরু আর আমি দেখেছিলাম। ঝমরু তাকে খপ্ করে ধরে ফেলল, অমনি সে চোখ বুজে নিঝুম হয়ে গেল, খালি ওর বুকটা ধড়াস্ ধড়াস করতে লাগল। কিন্তু যেই-না আমি তাকে ধরেছি আর ঝমরু তার গলা থেকে সুতোর ফাঁস খুলে দিল, অমনি সে ডানা ঝাপটা দিয়ে আমার হাত থেকে ফস্কে গিয়ে, তীরের মতো আকাশে উড়ে দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল।"

"তার পর কি হল ঝগড় ?"

"তার পর আর কি হবে? ঝমরুর আর আমার আর দেশে থাকা হল না। ঐ পাখির ডানার ঝাপটা যার গায়ে লেগেছে সে কি আর ঘরে তিষ্ঠতে পারে, বোগিদাদা? আজ তুমি ঘুমোও বোগিদাদা, দ্যাখ রুমুর চোখ কখন বুজে গেছে।"

তার পরদিনও ভুলো এল না, তার পরদিনও না, তার পর দিনও না।

তার পরদিন রুম বললে, "ঝগড়, যে শেয়ালরা কুকুররা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তারা আর জানোয়ার হয় না?" ঝগড় বললে, "একবার মানুষ হলে তারা কি আর জানোয়ার হতে

চাইবে, দিদি? তবে শুনেছি নিদুলী-মন্ত্র দিয়ে সব হয়।"

"তুমি জানো সেই নিদুলী-মন্ত্র ?"

"জানি আমি সবই। আমাদের দুমকায় ছেলে-ছোকরারাও নিদুলী- মন্ত্রের কথা শুনেছে। কিন্তু করা বড় শক্ত !"

"কেন শক্ত, ঝগড় ?"

"তার জিনিসই পাওয়া যায় না, দিদি। পাচঠেঙো মাকড়সা চাই, সোনা-রুপোর মাদুলি চাই-এখন আমি বাজারে যাচ্ছি, দিদি, পরে সব বলব।"

"বাজারে যাচ্ছ, ভালোই হল, ঝগড়, একটু দেখো তো।"

"কি দেখব, দিদি?" "সেই। সেই সোনা-রুপোর মাদুলি যদি পাও।"

"সে কি অত সহজে মেলে দিদি?"

"তা হলে সেদিন সেই একচোখ লোকটাকে তাড়িয়ে দিলে কেন? ওর কাছে হয়তো ছিল। বলল, রক্ত-বন্ধ-করা মাদুলি আছে, স্বপ্ন- দেখা মাদুলি আছে। দেখলে না কেন, ঝগড় ?"

"আচ্ছা, এবার দেখলে তাকে ডেকে আনব'খন। কিন্তু কি করবে তুমি ঐ মাদুলি দিয়ে?-বিকেলে হীরে খুঁজতে যাবে তো?"

"হ্যাঁ, যাব। হীরে খুঁজব, আর সেই যে তুমি বলেছিলে সাপের মাথার ফুল, যে ফুল কখনো শুকোয় না, সেই খুঁজব। খোয়াইয়ের মধ্যেই সব পাওয়া যাবে তো?"

"পাওয়া যাবে কি না জানি না, দিদি। তবে খোয়াইয়ের মধ্যেই ও-সব খুঁজতে হয়। পেলেই তো মজা ফুরিয়ে গেল।"

বিকেলে যেতে হয় খোয়াইয়ে। বর্ষার জলে মাটি খেয়ে খেয়ে লাল কাঁকরের পাঁজরা বেরিয়ে থাকে। ধারে ধারে মনসাগাছ মাথা উঁচিয়ে কাঁটা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আলো কমে এলেই রুমুর কেমন মনে হয় মনসারা আগের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে নেই, মাথা ঘুরিয়ে ইদিক-উদিক দেখছে। খোয়াইয়ের মধ্যে কতরকম আশ্চর্য সাদা লাল পাথর পড়ে থাকে। ঝগড়ু বলল,

"কিছুই বিশ্বাস করো না, বোগিদাদা, বইয়ে না লেখা থাকলে কিছুই মানতে চাও না। আরে বইয়ে কতটুকুরই-বা জায়গা হয়, বল? আমাদের দুমকাতে একরকম গাছ আছে তারা চলে বেড়ায়।"

"ফের বাজে বকছ, ঝগড় ?"

"আরে না না, নিজের চোখে দ্যাখা। ছোটবেলায় ঝমরু আর আমি পাহাড়ে যেতাম ছাগল চরাতে। আমাদের দেশের জন্তু-জানোয়ারদের বড় কষ্ট, রুমুদিদি, এমনি খরা যে ঘাসগুলো সব জ্বলে পুড়ে যায়। তবে পাহাড়ের উপরে বড়-বড় পাথরের ছায়ায় ছায়ায় লম্বা-লম্বা ঘাস থাকে, ছাগলরা তাই খেতে বড় ভালোবাসে।

"ছাগলরা চরে বেড়ায়, আর ঝমরু আর আমি সারাটা দিনমান এ পাথর থেকে ও পাথরে লাফিয়ে বেড়াই, বাঁশি বাজাই, আর পাথরের আড়ালে ঘুমুই। ঝমরু একটু রাগী ছিল, দিদি, একটুতেই মেরে-ধরে একাকার করত।"

"কোথায় সে এখন ?"

বোগি একটু কাছে এসে বলল, "মরে গেছে নিশ্চয়।" ঝগড় রাগ করল। "মরবে কেন বোগিদাদা, তোমার যেমন কথা! ঝমরু এখন বদ্যিনাথে পুলিশে চাকরি করে, তার পাঁচটা ছেলে পাঁচটা মেয়ে। কেউ মরে নি।"

"আচ্ছা, আচ্ছা, তার পর বল, ঝমরু ভারি রাগী ছিল, তার পর ?"

"একদিন একটা ছাগল কিছুতেই পাহাড়ে উঠবে না। আমি যতই তাকে ফুল্লোই সে উলটে গুতোতে আসে। তখন ঝমরু রেগেমেগে দিয়েছে তাকে এক লাথি কমিয়ে। ছাগলটা অমনি তরতর করে পাহাড়ে উঠে গেল বটে, কিন্তু পাশেই একটা মস্ত-মস্ত শাঁসালো পাতাওয়ালা কাঁটাগাছ ছিল, ঝমরুর পায়ে তার একটা এই বড় কাঁটা গেল বিঁধে। অমনি চুনীর মতো গোল-গোল রক্তের ফোঁটা উল্টপ্ করে পড়তে লাগল, আর ঝমরুর সে কি চ্যাঁচামেচি। রেগে গাছটার গোটা ডালটাই ছিড়ে ফেলে দিলে, আর তার গা থেকেও একরকম সাদা রস পড়তে লাগল।

"তার পর ব্যথা কমলে আমরাও পাহাড়ে চড়লাম। ঝমরু কি করে, পায়ে ব্যথা, সেদিন আর দৌড়-ঝাঁপ করতে পারে না। তখন সে করল কি, মাঝারি পাথরগুলোকে উলটে উলটে ফেলতে লাগল। পাথর উলটেছ, রুমুদিদি?" কখনো

"না তো। কেন, কি হয়?"

"পাথরের তলাকার ছোট-বড় পোকারা ঊর্ধ্বশ্বাসে যে যেদিকে পারে পালায়। সে ভারি মজা লাগে দেখতে কিন্তু ওদের ভারি কষ্ট হয়।" "কেন কষ্ট হয়?"

"আরে, ওরা অন্ধকারের পোকা, আলো সইতে পারে না। তা ছাড়া 'পাথরের তলাটাই ওদের বাড়ি, বাচ্চা-টাচ্চা ডিম-টিম নিয়ে সেখানে ওরা থাকে। পাথর উলটে ফেলে দিলে বাচ্চারা মরে যায়, ডিমরা ভেঙে যায়।"

"ইস্! ঝমরু তো ভারি দুষ্টু ছেলে।"

"না, দুষ্টু মোটেই নয়, রুমুদিদি, আমাদের দুমকার ছেলেরা আর

যাই হোক, কখনো দুষ্টু হয় না। তবে অতটা ভেবে দ্যাখে নি।" "আচ্ছা, তার পর বল।"

"তার পর আট-দশটা পাথর ঐরকম উলটে ফেলবার পর, ঝমরুর সে কি চীৎকার! আমি ভাবলাম নিশ্চয় পোকায় কামড়েছে! ছুটে গিয়ে দেখি, ওর পায়ে আবার সেইরকম একটা কাঁটা ফুটে রয়েছে।

"তাকিয়ে দেখি পাশে ঠিক সেইরকম একটা গাছও রয়েছে। শুধু তাই নয়, গাছটার একটা ডালও ভাঙা, আর সেখানে ফোঁটা ফোঁটা সাদা রস জমে রয়েছে।"

"কি করে হতে পারে ঝগড়? তুমি কি বলতে চাও সেই গাছটাই পাহাড়ে চড়েছিল ?"

“দ্যাখ, বোগিদাদা, তোমাদের সঙ্গে আমাদের এই তফাত যে আমরা যা দেখি তাই মেনে নিই, অত 'কি করে হল' জানতে চাই না। কিছুই মানতে চাও না, এই হল মুশকিল। আমি একবার খোয়াইয়ের মধ্যে ঘোড়ার কঙ্কাল পেয়েছিলাম, তাও বোধ হয় বিশ্বাস করবে না?"

বোগি বলল, "তা কেন বিশ্বাস করব না? একটা সত্যি ঘোড়াই হয়তো বুড়ো হয়ে খোয়াইয়ের মধ্যে মরে গেছিল, কিম্বা হয়তো কিছুতে মেরে ফেলেছিল, কিম্বা পথ হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরে গেছিল-ও কি, ফের কাঁদছিস রুমু?"

রুমু ফ্রকের কোনা তুলে চোখ মুছে বললে, "ঘোড়া মরে গেলেও কাঁদতে পাব না? না খেতে পেয়ে একলা একলা অন্ধকারে খোয়াইয়ের- মধ্যে ঘুরে বেড়ালেও কাঁদতে পাব না?"

বোগি বিরক্ত হয়ে বলল, "ফ্রক নামাও রুমু, তোমার পেট দ্যাখা

যাচ্ছে!"

ঝগড় ব্যস্ত হয়ে উঠল। "আহা, কান্নাটা থামিয়ে আসল কথাটাই শোন-না, দিদি। ঘোড়াটার ওরকম কিছুই হয় নি।"

"কি করে জানলে?"

"শোনোই-না বলি।"



পাঁচ

ঝগড় খোয়াইয়ের মধ্যে একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল। "ওরকম কিছুই হয় নি বুঝলাম, কারণ কঙ্কালটার কাছে গিয়ে দেখলাম মেলা ঈগল পাখির পালক ছড়ানো।"

"ও, তা হলে হয়তো ওকে ঈগল পাখিতে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, পাহাড়ের উপরে ঈগল পাখির বাসাতে বাচ্চারা খাবে বলে। তার পর নখ থেকে কি করে খুলে ঘোড়াটা খোয়াইয়ে পড়ে মরে গেছিল।"

"আচ্ছা, রুমু, আবার কি হল?"

"ঈগল পাখিতে ধরবে কেন? আস্তাবলে রাখে না কেন?"

"কি মুশকিল! আমাকে গল্পটা বলতে দেবে কি না?" "ও, গল্প? তা হলে সত্যি নয়?"

"সত্যি নয় মানে? আমার সব গল্পই সত্যি গল্প।"

"বল, তার পর ঈগল পাখির পালক দেখে কি করলে ?"

"ভালো করে দেখে বুঝলাম ঈগল পাখিরই পালক নয়। ঈগল পাখির পালক অত বড়ও হয় না-ওরকম নীল নীলও হয় না।"

"তবে ?"

"বুঝলাম, তা হলে ওরই পালক।"

"ওরই পালক মানে? ঘোড়ার আবার পালক হয় নাকি?" ঝগড় উঠে পড়ল, "কি যে বল! ঘোড়ার পালক হয় না? এবার হয়তো বলবে ঘোড়ার ডানাও হয় না। কঙ্কালটার কাঁধের কাছে দেখলাম, মুরগিদের ডানার হাড়ের মতো বিরাট দুই হাড়।"

রুমু হাত দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল, "তবে কি-তবে কি ওটা পক্ষীরাজ ছিল, ঝগড়?"

"তা জানি না, তবে শুনেছি পক্ষীরাজরা বুড়ো হলে, পুরনো দেহটাকে

ছেড়ে নতুন দেহ গজিয়ে নেয়।"

বোগি বললে, "না, তুমি ভীষণ গাঁজাখুরি গল্প বল, ঝগড়, নতুন দেহ গজিয়ে নেয় আবার কি?"

"তা তোমাদের এখানে কি হয় না হয়, সে বিষয় আমি তো কিছু বলতে পারি না, কিন্তু দুমকাতে হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। তা ছাড়া টিকটিকির ল্যাজ গজাতে পারে, আর পক্ষীরাজ দেহ গজাতে পারে না বললেই হল!"

. "ঘোড়ার কঙ্কাল তো এখানে পেয়েছিলে বললে।"

"এখানে পেলেই তাকে এখানকার ঘোড়া হতে হবে? আমিও তো এখানে আছি, তা হলে কি আমিও দুমকার ছেলে নই?"

ঠিক এই সময় ওদের কানে এল স্পষ্ট ঘোড়ার খুরের শব্দ! সবাই অবাক। তার পরে পাশের গর্ত-মতন জায়গা থেকে হাঁচড়-পাঁচড় করতে করতে উঠে এল একটা হাড়-গির্গিরে সাদা ঘোড়া।

তার খুর ছাড়া সবটা সাদা। গায়ের লোম, চুল, ল্যাজ, চোখের পাতি সব সাদা। খালি খুর চারটে আর চোখের মণিটা কুকুচে কালো।

ওদের দেখে ঘোড়াটা চারটে পা এক জায়গায় জড়ো করে থমকে দাঁড়াল, তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল, চোখের কালো মণির চার ধারে অনেকখানি করে সাদা দেখা গেল। ঠোঁটের কোনায় একটু সাদা ফেনা লেগে রয়েছে, বুকটা হাপরের মতো উঠছে পড়ছে। বোগি রুমুর মুখে কথা নেই। ঘোড়াটার প্রত্যেকটা পাঁজর গোনা যায়, আর কাঁধের উপর দুটো হাড় অদ্ভুতরকম উঁচু হয়ে রয়েছে। ঝগড় ওদের কানে কানে বলল, "নড়বে না, খবরদার আওয়াজ করবে না।"

তার পর দুহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত পাখি-ডাকার মতো নরম শব্দ করতে করতে ঝগড় ঘোড়াটার দিকে এগুতে লাগল। আস্তে আস্তে ঘোড়াটার কাঁপুনি থেমে গেল, চোখ দুটো কালো মখমলের মতো হয়ে গেল, সেও একটু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে ঝগড়ুর হাতের তেলোয় মুখ গুঁজে দিল। ঝগড় অন্য হাতটা দিয়ে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগল।

"এবার তোমরা কাছে আসতে পার, দিদি, ও আর কিছু বলবে না। কিন্তু সামনে দিয়ে এসো, ঘোড়ার পিছন দিক দিয়ে কখনো আসতে হয় না।"

"তুমি এত কথা কি করে জানলে, ঝগড় ?"

ঝগড় মুখটা তুলে, দূরে যেখানে গাছের পিছনে সূর্য ডুবে যায়, সেই দিকে চেয়ে বলল-

"বলেছি তোমাদের, হলদে পাখির ডানার ঝাপটা লেগেছে আমার গায়ে, দেশে আমি তিচ্ছুতে পারি না। কোথায় কোথায় যে সে আমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে সে আর কি বলব। বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না, তোমাদের কেতাবে সে-সব জায়গার কথা লেখে না। ঘোড়দৌড়ের মাঠে কাজ করেছি আমি পাঁচ বচ্ছর। বোগিদাদা, ভালো ঘোড়া রেসের দিনে কেন দৌড়য় না তাও জানি, খারাপ ঘোড়া কেন হঠাৎ ঝড়ের মুখে খড়ের কুটোর মতো ছুটে চলে তাও জানি। চল, ওঠ, ঘরে যাবার সময় হয়েছে।"

সাদা ঘোড়াটা দুটো কান খাড়া করে ঝগড়র কথা শুনছিল, এবার মুখ তুলে ঝগড়ুর চোখের দিকে চেয়ে রইল, ওর চোখ দেখে মনে হল যেন কালো দীঘির জল, তার তল নেই থৈ নেই।

"বল-না ঝগড়, হলদে পাখির ডানার ঝাপটা লাগলে কেন ঘরে তিচ্ছু নো যায় না ?"

"বুকের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, ফোঁপরা হয়ে যায়, দুনিয়াতে হরেকরকম ভালো জিনিস আছে, কিন্তু কিছু দিয়েই আর সে ফাঁকা ভরানো যায় না, বোগিদাদা ঘর ছেড়ে, ঘরের মানুষ ছেড়ে তাই বেরিয়ে পড়তে হয়। চল, আঁধার নামছে।"

"কিন্তু তা হলে সাদা ঘোড়ার কি হবে? ওকে বাড়ি নিয়ে গেলে হয় না ঝগড় ?"

"থাকবে কোথায়? খাবে কি? তোমাদের দিদিমা কেন থাকতে দেবে ?"

"তোমার ঘরে থাকবে ঝগড়, তরকারির খোসা খাবে, দিদিমা জানতেও পারবে না।"

রুম বলল, "আর জানলেই-বা কি হবে? তোমার ঘরে যে কালো ছেলেটা এসেছে, দিদিমা বলেছে কিছু?" ঝগড় মাথা উঁচু করে বলল, "ও তো দুমকার ছেলে। আর তা ছাড়া

এ হল পক্ষীরাজ, এদের ঘরে বেঁধে রাখা যায় না।"

"পক্ষীরাজ তো ডানা কোথায় ঝগড়ু ?"

ঝগড় অবাক হয়ে গেল। "সব পক্ষীরাজের কি ডানা গজায় ভেবেছ নাকি? দেখছ-না ওর কাঁধের উপরকার হাড় কেমন উঁচু হয়ে রয়েছে? ওর যে ডানার কুড়ি রয়েছে বোগিদাদা। ডানার কুড়ি থাকলেও সকলের ডানা গজায় না, গায়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে, একটুখানি জিরুতে দেয় না, সারাটা জীবন জ্বালিয়ে খায়।"

এই বলে ঝগড় ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিলে। ঘোড়াটাও একবার ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার চিঁহি করে ডাক ছেড়ে, পেছনের দুটো পায়ের উপর একবার দাঁড়িয়ে উঠে, খোয়াইয়ের উপর দিয়ে খটাখট্ শব্দ করে দৌড় দিল। চারটে খুর থেকে আগুনের হল্কা ছুটতে লাগল, চারি দিকে ধুলো উড়তে লাগল, কাশবনের মধ্যে দিয়ে, তীরের বেগে ছুটে, দেখতে দেখতে সাদা ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে গেল।

সারাটা পথ কারো মুখে কথা নেই। ভুলো সেদিনও ফিরল না। ঝগড়ুর ঘরে কালে। ছেলেটা অঘোরে ঘুমুচ্ছে বোগি গিয়ে দেখে এল। রাতে খেতে বসে দাদু বললেন, "কি হে নেড়িকুত্তোর দুঃখ ঘুচল?

আনবে না কি সেজোমামা বিলিতি কুকুরের ছানা ?"

রুম বোগির মুখের দিকে চেয়ে দেখে, বোগি মাথা নাড়ছে। দিদিমা বললেন, "কি জানি পায়ে পায়ে অষ্টপ্রহর ঘুরঘুর করত,

ভারি বিরক্ত লাগত, এখন আবার কেমন যেন খালি-খালি লাগে।" বোগি তবুও কিছু না বলে, একটা পরিষ্কার চুলের কাঁটা দিয়ে নলি হাড়ের ভিতর থেকে রস বের করে খেতে লাগল।

রুমু বলল, "ভুলো ছাড়া আর কাউকে আমরা চাই না, দাদু।"



ছয়

রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়দের ঘর আর রান্নাঘরের পাশে গরমজলেরু ঘর। সেখানে তিনটে বড়-বড় পাথর দিয়ে উনুন করা আছে, তার উপর কেরোসিনের টিনে স্নানের জল গরম করা হয়।

ঐ উনুনে কয়লার বদলে কাঠ জ্বালানো হয়। কতরকম কাঠ, তাদের কতরকম রঙ, কতরকম গন্ধ। মাঝে মাঝে কাঠে আগুন লাগলে কেমন একটা শোঁ শোঁ শব্দ হয় আর সারা ঘর একটা মিষ্ট মিষ্টি গন্ধে ভয়ে যায়।

ঝগড় বলে, "তা হবে না, ও যে কাঠপরীদের চুলের সুবাস।"

"কাঠপরী হয় না, ঝগড় ।"

"কাঠপরী হয় না এটা একটা কথা হল, বোগিদাদা?"

"কোনোরকম পরীই হয় না, ঝগড়ু, কাঠপরীও না।"

"তবে তোমাদের বইতে লেখে কেন? দিদিমা কাল যে বই থেকে পড়ে শোনালেন ?"

"সব বানানো গল্প, ঝগড়, পরী হয় না।"

"না হয় না! বইতেও লিখেছে, তবু হয় না। তা ছাড়া আমি দেখেওছি।"

"তুমি নিজের চোখে দেখেছ?"

"না, ঠিক নিজের চোখে দেখি নি, আমার বাবা দেখেছেন। তবে কি আমার বাবা মিছে কথা বলেছেন?"

"কোথায় দেখেছেন ঝগড়, কবে দেখেছেন?"

"অনেক বছর আগে, রুমুদিদি। দুমকার পাহাড়ে দেখেছেন অবিশ্যি, তোমরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না।"

"না, না, ঝগড়ু, বলই-না তোমার বাবার কাঠপরী দেখার কথা।"

ঝগড় জল গরমের উনুনে একটা ফিকে সবুজ রঙের কাঠ গুঁজে দিয়ে বলল, "এইরকম কাঠে পরী থাকে, শুকনো মরা কাঠে থাকে না।" বলতেই সারা ঘর একটা মিষ্টি ধুনো ধুনো গন্ধে ভরে উঠল।

ঝগড় বলল, "ভালো করে আগুনের মধ্যে চেয়ে দ্যাখ, বোগিদাদা, যেখানে নতুন ধরেছে সেখানে নয়, যেখানে গগন করে জ্বলছে সেখানে দ্যাখ। কিছু দেখতে পাচ্ছ না, ঘরবাড়ি, গাছপালা ?" অমনি রুমু বোগিরও মনে হতে লাগল সত্যি বুঝি আগুনের তৈরি ঘরবাড়ি গাছপালা দেখতে পাচ্ছে, লাল, একটু একটু নীল, দেয়াল ছাদ ডালপালা কেবলই কাঁপছে নড়ছে ভাঙছে আবার গড়ছে। মনে হল আগুনের তৈরি একটা শহরই দেখতে পাচ্ছে।

বোগি চোখ ঢেকে বলল, "শুধু কাঠ জ্বালালে নয়, ঝগড়, আমি কয়লার আগুনেও দেখেছি যুদ্ধ হচ্ছে, শহর পুড়ে যাচ্ছে, বিরাট বিরাট প্রাসাদ ধ্বসে পড়ছে।"

"তা হবে হয়তো, বোগিদাদা, দুমকায় আমরা কাঠ জ্বালাই, কয়লার কথা অত বলতে পারব না।"

"দাদা, তুমি অত কথা বল কেন? বল ঝগড় তোমার বাবার পরী দেখার কথা।"

"বুঝলে, বাবার তখন বয়স হয়েছে, হাড়ের ভিতরে শীত আর কিছুতেই যায় না, সারাটা দিন গোল লোহার চুলার ধারে বসে থাকেন, হাতের কাছে কাঠের গাদা, থেকে থেকে আগুনে একটা কাঠ গুঁজে দেন, ধোঁয়ায় চার দিক ভরে থাকে, যে আসে তার চোখ জ্বালা করে, তারা বাবাকে শুধোয়, তোমার চোখ জ্বলে না, বুড়ো? বাবা বলেন, আরে বুকের জ্বালাই আর টের পাই না, তা আবার চোখের জ্বালা!

"সারাদিন চুলীর ধারে বসে থাকেন বাবা, আর কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা-আলু পুড়িয়ে খান। যে আসে তাকে খাওয়ান। তারা মাঝে মাঝে বলে, রাঙা-আলুতে ইঁদুরের দাঁতের দাগ কেন, বুড়ো? তোমাদের ক্ষেতে বুঝি ইঁদুর হয়েছে? বাবা চোখে ভালো দেখেন না, রাগ করেন, বলেন-ইচ্ছে না হয় খেয়ো না।

"একদিন আগুনের মধ্যে যেই-না কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা-আলু ফেলেছেন অমনি মনে হল যেন আগুনের ভিতরকার ঘরবাড়িতে মানুষ আছে, কে যেন রাঙা-আলুটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পোড়াতে লাগল, লম্বা দাড়ি কে একজন বুড়ো লোক রাঙা-আলুতে কামড় দিল। অমনি বাবা তাড়াতাড়ি কাঠি টেনে আনতেই রাঙা-আলুর সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও বেরিয়ে এল। একটুক্ষণ দেখতে পেলেন, তার পরেই সে ঝুরঝুর করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। বলতে চাও এ-সব বানানো কথা, বোগিদাদা? শুধু বাবা কেন, বনে-জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায়, তারা সবাই জানে জঙ্গলে এমন অনেক জিনিস আছে, যাদের কথা কোনো বইতে লেখে না। গাছ-গাছালির কথা যারা চারটে দেওয়ালের মধ্যে বাস করে তারা জানবে কোত্থেকে?"

"কিন্তু জন্তু-জানোয়ারদের তো মানুষরা ভালোবাসে, তাদের কথা তো জানতে পারে?"

"কে বলেছে মানুষরা জন্তু-জানোয়ার ভালোবাসে? একবার হাতি- ধরার খেদায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সুন্দর সব পোষা হাতি সাজিয়ে রেখে, বুনো হাতি ধরা হচ্ছে। ভালোবাসে বললে? যারা দলে দলে গাছপালা ভেঙে হুড় মুড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে, তাদের পায়ে শেকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলাম।

"হাতির বাচ্ছার ভীষণ কাতুকুতু তা জানো? খরা বুরুস দিয়ে ঘষে ঘষে তাদের কাতুকুতু ছাড়িয়ে, পিঠে হাওদা চাপানো হয় তা জানো? তা নইলে একটুকু ছুলেই তারা হেসে লুটোপুটি। তোমরা কি এগুলোকে ভালোবাসা বল?"

রুমু বলল, "আমরা কুকুর ভালোবাসি, না দাদা? আমরা ভুলোকে ভালোবাসি। তুমিও তো বলেছ দুমকার লোকরা বেড়াল বাদে সব জন্তু- জানোয়ার ভালোবাসে।"

"দুমকার লোকদের কথা আলাদা। একবার দুমকার বনে দাবানল লেগেছিল। দলে দলে জন্তু-জানোয়ার ভয়ের চোটে ছুটে বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকেরাও তাদের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, জানোয়ারদের কেউ কিছু বলল না।

"একটা ভাল্লুক ছিল, সেরকম ভাল্লুক কেউ কখনো দেখে নি। তার গলার লোমগুলো ছিল সাদা, মনে হত ফুলের মালা পরেছে বুঝি। আর যেমনি তার গায়ের জোর তেমনি তার সাহস। ওর জ্বালায় কারো মৌচাকে মধু থাকত না, আর কত লোককে যে খুনজখম করেছিল তার ঠিক নেই। কিন্তু এমনি চালাক যে কেউ তাকে মারতেও পারে নি, ধরতেও পারে নি।

"দাবানলের দিন সেও বন থেকে বেরিয়ে এল, সঙ্গে একটা বাচ্চা, তার পায়ে কি হয়েছে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পড়ে গেল আমাদের সর্দারের একেবারে সুমুখে। আগের বছর সর্দারের ছেলের পায়ের হাড় চিবিয়েছে ঐ ভাল্লুক, সর্দারের হাতে তাঁর-ধনুক।"

"মেরে ফেলল?"

"সর্দার ধনুক তুলতেই ভাল্লুক তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আর সর্দারও ধনুক নামিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল। জণ্ড-জানোয়ারকে ভালোবাসা চারটি খানিক কথা নয়, দিদি। একটা কুকুর কি একটা বেড়াল ঘরে বেঁধে রেখে তাকে আদর করলেই কি আর ভালোবাসা হল!"

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুনু ডাকল, "সাদা"

"কেন, কি হয়েছে?"

"মাঝে মাঝে ভুলো কেন পালিয়ে যায়? হয়তো এখানে ওর ততটা ভালো লাগে না?"

বোগি উঠে বসল, "ভালো লাগে না? এখানে ভুলোর ভালো লাগে না? তুই কি পাগল হয়েছিস ?"

"তবে আসছে না কেন?"

বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, "আসছে না কারণ আসতে পারছে না। আর হয়তো আসবেও না।"

নিশ্চয় আসবে। একটা পাঁচঠোঙা মাকড়সা আর একটা সোনা- রুপোর মাদুলি পেলেই আসবে দেখ।



সাত

ঝগড় বললে, "আমাদের দুমকা একেবারে খরখরে শুকনো হলে হবে কি, আমাদের পাহাড়ে নদীর জলে যখন বান ডাকে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই ভিন গাঁয়ে গেলাম দিব্যি সুন্দর পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে, আর ঘণ্টা তিন বাদে এসে দেখি লাল ঘোলা জলে ভরতি বিরাট নদী, আর তার সে কি আওয়াজ, কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আবার রাত পোয়ালে যে নদী সেই। পায়ে হেঁটে পার হয়ে গাঁয়ে ফেরা যায়।

কোত্থেকে বানের জলে হাজার হাজার মাছ ভেসে আসে। নদীর জল দুই পাড় ছাপিয়ে ওঠে, তার পর যখন আবার নেমে যায়, যেখানে- সেখানে পাথরের ফোকরে ফাটলে জল আটকে থাকে, তার মধ্যে কত- রকম মাছ কিবিল্ করতে থাকে।"

"সে মাছ তোমরা ধর, ঝগড়?"

"ধরি বৈকি। কদিন ধরে গাঁয়ের লোকে মনের সুখে মাছ খায়। দুমকার লোকরা বড় গরিব হয়, দিদি। তাদের বড় কষ্ট। শীতকালে টোপা কুল পাকলে, বিচিসুদ্ধ পাথর দিয়ে ছেঁচে খায় লোকে। তা হলে অনেকক্ষণ পেট ভার হয়ে থাকে, ভাত খেতে ইচ্ছা হয় না।

"তবে শুধু কি আর মাছ ধরে, তার চাইতেও আশ্চর্য সব জিনিস মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।"

"কি জিনিস, ঝগড় ?"

"একবার আমাদের গাঁয়ের নান্দু জল নেমে যাবার পর, সন্ধেবেলায় চাঁদের আলোয় গেছে নদীর ধারে, বর্ণা দিয়ে মাছ গাঁথবে, তীরের কাছ থেকে। দ্যাখে কিনা চাঁদের আলোয় কি একটা লম্বা জিনিস বালিতে বেধে গিয়ে, স্রোতের সঙ্গে একটু একটু দুলছে।

"কাছে গিয়ে দ্যাখে আগাগোড়া আশ্চর্যরকম কারিকুরি করা সাদা রঙের একটা ছোট নৌকো। হাতির দাঁতের কি হাড়ের তৈরি বুঝতে পারল না। নৌকোর সামনের দিকটার গড়ন একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ের মতো কিন্তু তার পায়ের বদলে আঁশে ঢাকা মাছের ল্যাজ। "হাত বাড়িয়ে নৌকোটাকে টেনে ডাঙায় তুলতেই, নান্দুর চক্ষু চড়ক

গাছ!

"নৌকোর মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে আশ্চর্য একটি মেয়ে। তার গায়ের রঙও হাতির দাঁতের মতো, হালকা পালকের মতো গড়নটি, চোখ খুলতেই নান্দু দেখলে তার ঘোর নীল রঙ, পরনে একটা ঘন সবুজ রেশমী কাপড়। চমকে মেয়েটি উঠে বসল, একবার চারি দিকে তাকিয়ে দেখল, তার পরে এক নিমেষে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল।

"নান্দু তার আঁচলখানি চেপে ধরল, এক মুঠি সবুজ রেশম তার হাতে রয়ে গেল, মেয়েটি স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেল আর নৌকোটা বালির উপর পড়ে থাকল। ছোটবেলায় ঐ নৌকো আমিও দেখেছি।"

ঝগড় থামলে বোগি রাগ করতে লাগল। "তোমার সব গল্প হারানোর গল্প, ঝগড়, পাও নি কখনো কিছু?" "তা হলে যাবে কাল দোলতলার মেলায়? সেখানে কিছু পাওয়া

যেতে পারে। রুমুদিদি, যাবে নাকি তোমার সেই একচোখ লোকের

খোঁজে ?"

রুমু বললে, "যাব, যাব, ঝগড়। চিনির মঠ কিনে দেবে তো ?" দিদিমাকে নিয়ে একটু গোল বাধল, "ঝগড়, তোমার সঙ্গে না গিয়ে ওদের দাদুর সঙ্গে গেলেই ভালো হত-না ?"

"না, দিদিমা, দাদু গাছতলায় বসে খালি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে চায়, হাঁটতে চায় না।"

শেষপর্যন্ত ঝগড়ুর সঙ্গেই যাওয়া হল। দিদিমা বললেন, "সারাক্ষণ ঝগড়র সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, তেলেভাজা খাবে না, অচেনা লোকের সঙ্গে 'কথা বলবে না।"

মেলার মাঠের উপরে মেঘের মতো ধুলো উড়ছে, প্যাঁ পোঁ করে বাজনা বাজছে। বোগি বলল, "সার্কাস দেখাবে তো ঝগড়? জানো, বাঁদরে ছাগলটানা গাড়ি চালায়, টেবিল চেয়ারে বসে চা ঢেলে খায়! আছে তোমাদের দুমকাতে অমন বাঁদর?"

ঝগড় বলল, "হাসিয়ো না, বোগিদাদা, দুমকাতে ও-সব ছেঁদো বাঁদরকে ঢুকতে দেয়া হয় না। পয়সা নষ্ট করে সার্কাস না দেখে একবার দুমকার বনের মধ্যে যেয়ো দিকিনি।"

"সে কিরকম বন, ঝগড় ?"

ঝগড়ুর মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, মেলার মাঠের উপরে ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে, হোঁচট খেতে খেতে ঝগড় চলতে লাগল। "সে গভীর বন, রুমুদিদি, শালগাছ, মহুয়াগাছ, সীতাহার গাছ, শিমুলগাছের ভিড় সেখানে। গাছের গা জড়িয়ে লতা ওঠে, শীতের আগে সেই লতায় ঝুরো ঝুরো সাদা ফুল ফোটে। বুনো মুরগি দেখেছ রুমুদিদি? দুমকার বনে বুনো মুরগি চরে, কি তাদের রঙের বাহার। সমস্ত বন জুড়ে জন্তু-জানোয়ারদের খৃট্ট, কিচির-মিচির, কিন্তু হঠাৎ চোখে কাউকে দেখতে পাবে না। নজর করে দেখো, দিদি, গাছের ডালের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ছাই রঙের পাখি বসে থাকে, চোখে পড়ে না। যেই-না একটু বাতাস বইল, লতাপাতা ডালপালা শিরশির্ দুদুল্ করে উঠল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রোদ্দুর এসে পাখির গায়ে লাগল, অমনি সে ডানা মেলে আকাশে ওড়ে। বাইরেটাই শুধু ছাই রঙের, ডানার তলাটা শাঁখের মতো ঝঝকে সাদা। গাছতলায় ঝোঝাপ্ থাকে, দিদি, তাতে ফুল ফোটে, কি তাদের সুবাস, ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতিরা সেখানে ঘোরাফেরা করে।

"কিন্তু ঝোপের মধ্যে না যাওয়াই ভালো, বোগিদাদা, সেখানে সাপের বাস। হঠাৎ যখন চক্কর মেলে ওঠেন তাঁরা, যেমনি তাঁদের রূপের ছটা তেমনি তাঁদের বিষের জ্বালা। রূপের বড় জ্বলুনি, দিদি।"

"তোমরা ঝোপের মধ্যে যাও না, ঝগড় ?"

"আমরা যাব না-কেন? দুমকার ছেলেরা সবাই সাপের মন্ত্র জানে।" "কি মন্ত্র বল।"

ঝগড় জিব কেটে বললে, "সে অন্য কাউকে বলা যায় না, বোগিদাদা, তবে ছোট্ট একটা তামার মাদুলিতে ভরে, তোমার হাতে বেঁধে দিলে, আর ওরা তোমায় কিছু বলবেন না।"

"বল, দুমকার বনের কথা আরো বল।"

“ঐখানে ছোটবেলায় বাবুদের সঙ্গে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম।"

"পাখি তো বিলের ধারে শিকার করতে হয়। আঃ, রুম, খালি খালি কাঁদো কেন?"

"সবুজ পায়রার গলায় বন্দুকের গুলি লাগলে রক্ত বেরয় দেখেছি।" "না, দিদি, না, সে সবুজ পায়রার সময় নয়। আমাদের বনে একরকম লালচে রঙের ল্যাজঝোলা পাখি থাকে, মাথায় তাদের কালো ঝুঁটি, বাবুরা তাদের শিকার করে। সে পাখি বিলের ধারে থাকে না।" "তার পর কি হল ?"

"বাবুরা অন্য পাখি দ্যাখে, ছোট-ছোট জানোয়ার দ্যাখে, কিন্তু সব ছেড়ে দেয়। এমনি সময় এক পাল বাঁদরের সামনে পড়ে গেল। বাঁদর মারতে ওরা যায় নি, শুধু শুধু মজা করে বন্দুক তুলতেই, বিশ্বাস করবে কি না জানি না, বাঁদরগুলো সব হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে বাবুরা হেসে উঠল, কিন্তু একজনার হাতের বন্দুক কি করে জানি ছুটে গিয়ে, একটা বাঁদর মরে গেল। অমনি এক নিমেষে সব বাঁদর হাওয়া! মরা বাঁদরটা পর্যন্ত রইল না।"

"তোমার দুঃখ হয় নি, ঝগড় ?"

"দুঃখ বলে দুঃখু, রুমুদিদি? কিন্তু কি করি, বাবুরাও কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। আর কি আশ্চর্য কথা, বনটার চেহারাও যেন বদলে গেল। হঠাৎ এক সময় সকলের খেয়াল হল, কোথাও একটা টু শব্দ নেই। গহন বনটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কোথাও একটা পাখি নেই, কাঠবেড়ালী নেই, পাতার খস্থ শব্দ নেই, ঝোপের মধ্যে চক্চকে চোখ নেই।"

"তার পর, ঝগড় ?"



আট

ঝগড় বললে, "তার পর? তার পর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল, তারা বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। যার হাতের বন্দুক ছুটে গেছিল, সে যাচ্ছে সবার আগে, এমন সময় তাকে খরিশে ছোবলাল।"

"খরিশ? খরিশ কি ঝগড় ?"

"খরিশ আমাদের সাপ, রুমুদিদি, ভারি তাঁর তেজ। মাথায় তাঁর খড়ম আঁকা থাকে।"

"তার পর লোকটা বোধ হয় মরে গেল?"

"না, বোগিদাদা, আমরা পাঁচজনা দুমকার ছেলে ছিলাম'সাথে, মরকে 'কেন? তাকে আমরা ওষুধ করে বাঁচিয়ে দিলাম, তবে তাকে কথা দিতে হল আর বন্দুক ধরবে না।"

"তা কেন ঝগড়? তোমরাও তো জানোয়ার মারো।" "বোগিদাদা, আমরা মারি পেটের জ্বালায় কিম্বা প্রাণের তরে। তার

পর শোনই-না, এমনি সময় আমার নাকে এল কি মিষ্টি গন্ধ সে আর কি বলব। বাবুরা এগিয়ে গেল, আমি খুঁজে খুঁজে মরি, দেখি গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ফুটে আছে এক গোছা জুঁই-চাঁপা। কি তাদের ররূপ দিদি, মনে হয় সাদা মোমের তৈরি, তার মধ্যে বেগনী রঙের চিত্তির করা। আর তুই-চাঁপার পাশে মাটির উপর পড়ে আছে সাপের মাথার মণি।"

"না, ঝগড়, যা-তা বললে হবে না, আমাদের বইতে আছে, সাপের মাথায় মণি হয় না।"

"সে তো তুমি বললেই হবে না, বোগিদাদা, নিজের চোখে দেখলাম।"

"কোথায় সে ?"

"আরি বাবা! সাপের মাথার মণিতে হাত দেব আমি! তুমি কি 'পাগল হলে? তা হলে উনিই-বা আমাকে ছাড়বেন কেন? যেখানেই লুকোই-না কেন, ঠিক খুঁজে বের করবেন। না, বোগিদাদা, যেখানকার জিনিস সেইখানেই রেখে ঘরে ফিরে এলাম।"

"সাপের মাথার মণি কেউ নেয় না, ঝগড় ?"

"নেবে না কেন, দিদি? যাদের দেখাশুনো শেষ হয়ে গেছে, তারা নেয়। আমার যে এখনো ঢের বাকি আছে। চলই-না মেলায়, সেখানে একটু খুঁজে দেখা যাবে।"

ততক্ষণে মেলার কাছে ওরা পৌঁছে গেছে। কি নেই ঐ মেলায়? বোগি রুমু মাথা উচু করে নাক তুলে বুক ভরে মেলার গন্ধ শুঁকে নিল। সব্বাই তেলেভাজা খাচ্ছে, পাঁপড় খাচ্ছে, আলুকাবলি খাচ্ছে, গোলাপী বাতাসা খাচ্ছে, টানাল্যাবেঞ্চুষ খাচ্ছে।

ঝগড় বললে, "এদিকটা ঢের ভালো, দিদি, দ্যাখ এই-সব ভালো ভালো বাঁশি, আয়না, কাচের পুতুল, দু-আনা করে বিলিয়ে দিচ্ছে। দ্যাখ কেমন কাচের চুড়ি, মোতির মালা, চুলের ফিতে। ছাঁচি পান খাবে? দিদিমা তো পানের কথা কিছু বলেন নি-"

ঝগড় এইরকম বলছে, এমন সময় একটা অদ্ভুত লোক এসে ওদের পাশে দাঁড়াল। বেজায় লম্বা, বেজায় রোগা, হাড়গোড় বের করা, গর্তেরু মধ্যে চোখ ঢোকা, তার ঢাকনি পিপিট্ করছে, ভুরু নেই, ছক-কাটা সরু ঠ্যাং পেন্টেলুন পরা, মাথায় একটা বারান্দাওয়ালা টুপি, বগলে রুপো- বাঁধানো ছড়ি আর একটা থলে, আর দশ আঙুলে দশটা চমৎকার লাল- নীল পাথর বসানো আংটি।

তাকে দেখেই বোগি রুমুকে অন্য পাশে টেনে নিল। তাই দেখে লোকটা সোনা দিয়ে মোড়া, সোনার পেরেক ফোটানো লম্বা-লম্বা দাঁত বের করে খিস্থিক্ করে হাসতে লাগল।

"কোথায় সরাবে ওকে, খোকাবাবু, ইচ্ছে করলেই আমি ওকে এক্ষুনি একটা জোনাকি পোকা বানিয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তা জানো? অমনি আমার কত আছে, এই দ্যাখ।" বলেই লোকটা হাতের মুঠো খুলে দেখাল, আট-দশটা কালো পোকা কিলবিল করছে। রুমু বলল, "যাঃ, বাজে কথা, ওগুলো মোটেই জোনাকি পোকা নয়,

জোনাকি পোকাদের আলো জ্বলে।"

লোকটা খুব হাসল। "রাতে এদের দেখো খুকি, চোখে তাক লেগে যাবে। সুন্দর জিনিস চেনো না? সাদা চোখে কালো কুচ্ছিৎ, নকল আলোয় চমৎকার।"

পোকাগুলোকে লোকটা পকেটে পুরে রাখল। "ওরা মরে যাবে না ?"

"গেলই-বা, এমনি আরো কত পাব।"

বোগি রুমু একটু সরে দাঁড়াল। "ঝগড়, চল।" লোকটাও একটু ঘেঁষে এসে বলল, "ভয় পাচ্ছ?" ঝগড় বলল, "যাদের সঙ্গে সঙ্গে দুমকার ছেলে রয়েছে, তাদের আবার ভয় কিসের?" লোকটা খুব হাসল। "উত্তরমেরুতেও ঘুরে এসেছি, ভয় কোথায় নেই বলতে পার।" ঝগড় বুক ফুলিয়ে বলল, "দুমকায় ভয়ের জায়গা নেই।"

"নেই, যাবে আমার সঙ্গে ঘোর রাত্রে তোমাদের মহা শিরীষগাছের তলায় ?"

ঝগড় বোগি রুমুর হাত ধরে টানতে লাগল, "চল, দিদিমা-না অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে মানা করেছেন?"

তাই শুনে লোকটা হেসেই খুন।

"কে অচেনা? যে মনের কথা জানতে পারে, তাকে দ্যাখে নি বলেই ব্যস্ সে অচেনা হয়ে গেল? তোমার সাহস থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির বহরটি তো বেশ! তা ছাড়া আমার কাছ থেকে একটা কিছু না কিনে যেতে পাবে না।"

"না, না, ওদের কাছে বেশি পয়সা নেই, মেলা কেনবার আছে।"

লোকটা রুমুকে বলল, "ঘুম থেকে উঠে কি খেয়েছিলে দিদি?"

"ডিমসেদ্ধ, রুটি, দুধ, কলা।"

"তার পর দুপুরে?"

"মাছ ভাত।"

"আর আমি কি খেইছি জানো? সেই কাল রাত্রে চাট্টিখানিক বকফুল ভাজা। তাও একজনকে ভাঁড়িয়ে, পাঁচটা মিথ্যে কথা বলে। মিথ্যে বলা ভারি খারাপ জানো তো? কিনবে কিছু? সেই পয়সা দিয়ে আমি আলুকাবলি কিনে খাব।"

ঝগড় তখনো বোগি রুমুর হাত ধরে টানছে। রুম বললে, "কই, দ্যাখাও কি আছে?"

লোকটা বললে, "তিনফলা ছুরি কিনবে?" বলেই একটা আশ্চর্য তিনফলা ঝিনুক দিয়ে বাঁধানো ছুরি বের করল। ঝগড় বলল, "না, ওতে ধার থাকে না।" "তবে কি জাপানী তারের ধাঁধা কিনবে?” বলেই একটা চক্চকে

সোনালী জড়ানোমড়ানো তারের গোছা বের করল।

"না, ও দুদিনে পাকিয়ে যায়।"

"তা হলে এই সাপের মাথার মণিটা কেনো।" বলেই ফস্ করে থলে থেকে একটা লাল ন্যাকড়ার টুকরো বের করল। তার মধ্যে এই এত্ত বড় একটা সাদা পাথর হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে, চার দিকে তার পল কাটা, তাতে রোদ পড়ে রামধনুর রঙ ঠিকরোচ্ছে। ঝগড় চেঁচিয়ে বললে, "দ্যাখ রুমুদিদি, ওতে হাত দিলে, ভালো হবে না বলছি।"

লোকটা হেসে বলল, "কেন, কি হবে?"

"তা হলে আমি-দুমকা চলে যাব।"

"না, ঝগড় না, সাপের মাথার মণি নেব না। আর কি আছে দ্যাখাও।"

লোকটা রুমুর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল, "সাপের মাথার মণি দিতে আমারও একটু আপত্তি ছিল, খুকি, নেহাত তুমি বলেই দিচ্ছিলাম। তা ভালোই হল, কজের জিনিস কি আর অন্য লোকের হাতে তুলে দিতে হয়? তবে তুমি কি বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর আশ্চর্য জিনিস নেবে?"

বলে একটা কাঠের বাক্স বের করল। এতটুকু, রুমুর হাতের মুঠির সমান হবে। "চীনে কারিগররা ছাড়া এ জিনিস বড় একটা কেউ করে না, খুকি। এই দ্যাখ কেমন ডিমের খোলার মতো পাতলা বাক্সের গা।"

একটার ভিতর-একটার ভিতর একটা করে দশটা বাক্স বেরুল। শেষেরটার মুখ এটে রয়েছে, ঝাঁকালে ভিতরে কি নড়ে।

নখের কোনা দিয়ে খুঁটে লোকটা সে বাক্সটাও খুলে ফেলল। ভিতরে একটা লম্বা লাল বিচি, অনেকটা নিমের বিচির মতো, কিন্তু অনেক বড়। পালিশ করা চক্চক করছে, এক কোনায় একটা সাদা চোখের মতো।

"কি ওটা?"

"ঐখান দিয়ে ওর শেকড় গজাবে, দিদি। পৃথিবীতে এরকম গাছ আর একটাও পাবে না খুঁজে। পুঁতবে কিন্তু ছাইয়ের গাদায় কি আঁস্তাকুড়ে। ফুল যখন ধরবে দেখবে কোথায় লাগে পারিজাত। ভালো জায়গায় লাগালে ফুল ধরবে না কিন্তু।" ঝগড়ুর বোধ হয় একটু রাগ হয়েছিল, দূর থেকে টাকাটা ফেলে দিয়ে, ওদের টেনে নিয়ে চলল। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চলল ঝগড়ু।

লোকটা গোড়ালি ঠুকে একটা সেলাম ঠুকল। রুমু বললে, "রাগ করলে, ঝগড় ?"

ঝগড় ওদের হাত ছেড়ে দিয়ে, আস্তে আস্তে চলতে লাগল। "না, দিদি রাগ করি নি। মাঝে মাঝে মনটা কেমন করে ওঠে। রাগ করি নি। ও গাছ হল গিয়ে মানুষের মনের গুণের মতো, কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না। ওর নাম দিয়ো গুণমণি। আমাদের রান্নাঘরের পাশে ছাইগাদার মধ্যে পুঁতো।"



নয়

বাড়ি ফিরেই ছাইগাদার মধ্যে বোগি বিচিটা পুঁতে ফেলল। ঝগড় একটু হেসে বলল, "কই নাচ-গান হল না? গাছ পুঁতলে যে নাচতে হয়, গাইতে হয়?"

রুম বোগি কি করে? অবিশ্যি একটু নাচলে গাইলেও হয়। ঝগড় ছাড়া কেই-বা দেখবে। কিন্তু ঝগড়ুই বলল, "এ গাছের জন্য নাচগান লাগে না, বোগিদাদা, অমনি পুঁতে দাও। এ হল দুঃখীদের গাছ, তোমাদের ঘটা করার জন্য বসে থাকবে না। তিনদিন বাদে দেখো এসে, ওর কল বেরুবে।"

থেকে থেকে কালো ছেলেটার জ্বর হয়। ঝগড়র বউ তখন রাঁধাবাড়া ফেলে তাকে দিনরাত বুকে করে বসে থাকে। রুমু ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে, আগুনের মতো গরম।

"একটু ওষুধ খাইয়ে দাও-না, সেরে যাবে।"

ঝগড়ুর বউ বলে, "দুমকা থেকে মাদুলি আনতে দিয়েছি, দিদি, তা হলে আর জ্বর আসবে না।"

ঝগড়কে বোগি জিজ্ঞাসা করল, "শেয়ালরা কুকুররা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে, তার পর যদি মরে যায়, তা হলে কি আবার শেয়াল কুকুর হয়ে যায়?"

ঝগড় তাই শুনে অবাক। "মরে গেলে আবার শেয়াল কুকুর কি, বোগিদাদা? মরে গেলে মানুষই-বা কি? দ্যাখ গিয়ে ছাইগাদায় গুণমণির কল গজিয়েছে।"

ওমা তাই তো! বিচি পুঁতেছিল বোগি ছাইগাদার ঠিক মাঝখানে, কেমন করে সরে গিয়ে, ছাইগাদার একপাশে মস্ত একটা বাঁকানো বোঁটা দেখা যাচ্ছে।

দিদিমাও দেখতে এলেন। "ওমা, ঐ বুঝি তোদের সেই মেলায় কেনা শিমগাছ? হুস নে, রুমু, ও জায়গাটা বড় নোংরা, ভালো জায়গায় লাগালি না কেন? তবে ওখানে সার পাবে যথেষ্ট, দেখতে দেখতে লক্লকিয়ে উঠবে দেখিস।"

ভালো জায়গায় লাগালে গুণমণির ফুল ধরবে না। মেলার সেই লোকটা কোথায় থাকে কোথায় শোয় কে জানে? ঝগড়কে জিজ্ঞাসা করতে হল।

"ঐ লোকটা? ওকে নিয়ে আবার তোমরা মাথা ঘামাচ্ছ? পাজির পা-ঝাড়া ব্যাটা। কাচের গোলা নিয়ে বলে সাপের মাথার মণি।"

“ওটা সত্যি সাপের মাথার মণি নয়, ঝগড় ?"

বোগিও বিরক্ত হল। "তবে ওটা দেখে ঘাবড়াচ্ছিলে কেন? আমাদের হাত দিতে বারণ করেছিলে কেন? তোমার চালাকি আমরা বুঝি না ভেবেছ? সারাক্ষণ দুমকা দুমকা কর, কতদিন দুমকা যাও নি বল তো?"

ঝগড় জল গরমের কাঠ কাটছিল। কুড়ুল দিয়ে কাঠ লম্বা করে

চিরে, কাঠের গাদায় কাঠটা আর কুড়ুলটা ফেলে দিয়ে, বারান্দার কোনায় ওদের পাশে পা ঝুলিয়ে বসল। "দিনের হিসাব আর রাখি না, বোগিদাদা। দুমকা যাবার আমার

দরকারটাই-বা কি বল? আমার মনের মধ্যে আমি দুমকাকে নিয়ে

ঘুরে বেড়াই। দুমকায় কি করে যাই? সেখানে বড় কষ্ট।"

"কেন, তোমার মনের দুমকায় কষ্ট নেই?"

ঝগড়ু একবার বোগির মুখের দিকে, একবার রুমুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে।

"কষ্ট কাকে বলে জানো?"

রুমু বলে, "ভুলো চলে গেছে বলে আমাদের কষ্ট হয়, ঝগড়। ভুলোকে আমরা ভালোবাসি। তোমার বাড়ির লোকদের তুমি ভালোবাসো না?"

ঝগড় হেসে বললে, "তা আর বাসি না? বুড়ি মাকে মাস মাস

টাকা পাঠাই। সে রুপোর পৈঁচে গড়িয়েছে। ভারি খুশি হয়েছে।

আর বোশেখে আমার সবার ছোটো ভাই নানকুর বিয়ে দেব, যাব তখন।" "নানকুর বিয়েতে আমাদের নিয়ে যাবে, ঝগড়? আমাদের দুমকায় যেতে ইচ্ছে করে।"

"সে তো আমার মনের দুমকায়, বোগিদাদা। পাহাড়ের ধারের ঐ দুমকা হয় তো বদলে গেছে, শুনেছি ভালুকরা আর মহুয়া খেতে আসে না।"

"ঝগড়, তুমি কি ঐ সত্যি দুমকাকে ভালোবাস না ?"

"কি জানি দিদি, আজকাল আমার ভালোবাসাগুলো কেমন গুলিয়ে

গেছে। তবে এটা ঠিক যে দুমকার মতো জায়গা নেই কোথাও।" দিদিমা ভুলোর থালা, ছেঁড়া কম্বল, আর চেনকলার জল গরমের ঘরের তাকে তুলে রাখলেন। কিন্তু দরজায় জানলায় যেখানে সেখানে ভুলোর নখের সব আঁচড়ের দাগ, বারান্দার দেয়ালে ভুলোর পিট ঠেসার দাগ।

ঝগড়র ঘরের কালো ছেলেটা রুমু বোগির কোলে আর আসতে চায় না। ওদের দেখলে বউয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে।

বউ ওদের বুঝিয়ে বলে, "জ্বর হলে ওদের মেজাজ খিছিটে হয়ে যায়, বোগিদাদা। রাতে ভালো ঘুমোয় না।” রুমু জিজ্ঞাসা করল, সেই মাদুলি আনলে না? কিসের তৈরি হয় সে মাদুলি ?"

"তা সে তামার হয়, সীসের হয়, অনেকরকম হয়।"

"সোনা-রুপোর হয় না বউ?"

"আমরা গরিব মানুষ, সোনা-রুপো কোথায় পাব বল? দ্যাখ গিয়ে তোমাদের শিমগাছে পাতা হয়েছে।" "না। আমাদের গাছের উপর কাল ঝগড় ভুলে ছাই ঢেলে

দিয়েছে, গাছ মরে গেছে।"

* "তোমরা দ্যাখই-না গিয়ে।"

গিয়ে দ্যাখে সত্যি সত্যি রাতারাতি গুণমণি আরো খানিকটা লম্বা হয়ে, আবার ছাইগাদার উপর মাথা তুলে আছে, ছোট-ছোট ফিকে সবুজ চারটি পাতা বাতাসে নড়ছে।

ঝগড় শুনে বললে, "তাতে আর দুনিয়াটাই তো আশ্চর্য জিনিসে ঠাসা, কথা না লিখলে আর আমি কি করব?" আশ্চর্যটা কি, বোগিদাদা? তোমার বইওয়ালারা সে-সব

বোগি বলল, "বইতেও অনেক আশ্চর্য জিনিসের কথা থাকে, ঝগড় । তুমি জানো উত্তর মেরুতে ছমাস করে রাত হয় আর ছমাস করে দিন হয়?"

ঝগড়ুকে নিয়ে মহা মুশকিল, কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। "হ্যাঁ! ছমাস ধরে দিন হয় বৈকি। তবে কি বলতে চাও সূর্যটার ছমাস লাগে আকাশটা পেরুতে ?"

"না ঝগড়, আমার বইতে লিখেছে, ওখানকার সূর্য মাঝ আকাশ পর্যন্ত ওঠেই না, চাকার মতো আকাশের চার দিকে ঘোরে। প্রথমে, যেখানে মাঠ গিয়ে আকাশে মিশেছে-তাকে দিগন্ত বলে ঝগড়-সেইখানে চার দিকে বালার মতো ঘুরে আসে। তার পর তিনমাস ধরে একটু করে উঁচুতে উঠে ঘোরে। আবার তিনমাস ধরে একটু করে নীচে নেমে ঘোরে। শেষটা ছমাস হলে, গাছের পিছনে তলিয়ে যায়, তার পর ছমাস আর তার মুখ দেখা যায় না। জানতে এ-সব ?"

ঝগড় হেসে বলল, "এত সব কথা বিশ্বাস কর বোগিদাদা, অথচ আমি যদি আমাদের জাদুকরা ছাগলের গল্প বলি, বিশ্বাস করবে না তো?"

বোগি রুমু ঝগড়ুর কাছে এসে বলল, "বল-না জাদুকরা ছাগলেরু গল্প, ঝগড়ু।"



দশ

ঝগড় বললে, "তোমরা ছাগল ভালোবাসো, দিদি-"

রুমু বললে, "দাদুকে ছাগলে তাড়া করেছিল, জানো ঝগড়ু ?" বোগি বলল, "হ্যাঁ, ভীষণ দুষ্টু হয় ওরা। ছাগলটা অনেকক্ষণ দাদুর পিছনে পিছনে ঘুরেছিল, যাতে দাদুর কোনোরকম সন্দেহ না হয়। তার পর একটি পেয়ারা গাছে শিঙে একটু শান দিয়ে নিয়ে, হঠাৎ তেড়ে এল। দাদু দারুণ ছুটতে পারে, জানো ঝগড়? তবু অমরকাকাদের বারান্দায় উঠে তবে প্রাণ বাচল।"

রুমু আরো বলল, "আর দাদু বলেছে, ছাগলটা যখন দেখল শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন সে রেগে নাক দিয়ে হাওয়া ছাড়তে লাগল, আর মাটিতে খুর ঠুকতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু হয়।

ঝগড় রাগ করে বলল, "বেশ, তা হলে রইল জাদুকরা ছাগলের গল্প। কোথায় কার দাদুকে ছাগলে একটু তাড়া করেছিল, কামড়ায় নি পর্যন্ত আর তাই সব ছাগল দুষ্টু হল, এরকম কথা তো কখনো শুনি, নি। উঠি আমি, কাজ আছে অনেক।" "না ঝগড়, না। দুমকার ছাগলের কথা বলি নি আমরা। বলতেই হবে তোমার গল্প ।"

ঝগড় খুশি হয়ে বলল, "আচ্ছা, তা হলে একটা পান মুখে দিয়ে আসি।"

ঝগড় বলতে লাগল-

"আমার বুড়ো ঠাকুরদার কাচ তৈরির গল্প তো তোমাদের বলেইছি। তাঁর ছেলে, আমার ঠাকুরদা ভারি নেশা করতেন।"

"ইস্, কি খারাপ!"

"কেন, খারাপ কেন?"

"দিদিমা বলেছেন খারাপ লোকরা নেশা করে।"

"তা বলতে পারো তোমাদের ইচ্ছে হলে, তবে কি জানো, খারাপ লোকরা তো ভাতও খায়। আর আমার ঠাকুরদা অন্য কারণে নেশা করতেন।"

"কি কারণে বল, ঝগড় ।"

"কি মুশকিল, এত ভালো লোক ছিলেন সব বিষয়ে, আর নেশা করবার জন্য এক পয়সা খরচাও হত না, বনভরা মহুয়া ছিল, কত খাওয়া যায়। জানো বোগিদাদা, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম চারটে তো মোটে দিক। তা ছাড়া এক যদি কয়লার খনিতে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাও, তা হলে আবার শুনেছি বাইরের চোখ কান আর মনের চোখ কান সবেতে নাকি ধাঁধা লেগে যায়। নয় তো উপরে আকাশের দিকে ডানা- ভাঙা চিলের মতো চেয়ে থাকা যায়। মোট কথা ঠাকুরদার অতটুকু জায়গাতে কুলোত না, তাই নেশা করতে হত। 'নেশা করা খারাপ হতে পারে, কিন্তু ঠাকুরদা খারাপ ছিলেন না।"

"না, না, আমরা জানতাম না। বল তার পর।"

"তার উপর ঠাকুমার ছিল যেমনি রাগী স্বভাব তেমনি গায়ে জোর। ঠাকুরদাকে নানারকম ফন্দি করে বাড়ি থেকে দূরে দূরে গিয়ে থাকতে হত। অথচ বাড়ির মতো আরামটি কোথায় পাবেন?

"তখন ঠাকুরদা বুদ্ধি করে ওখানকার সব চাইতে উঁচু পাহাড়ে ছাগল চরাতে যেতে আরম্ভ করলেন। ছাগলরা খুশিমতো চরে বেড়ায় আর ঠাকুরদা গাছতলায় পড়ে ঘুম লাগান। যেই সূর্য নেমে যায়, পাহাড়ের উপর থেকে রোদ সরে যায়, ঠাকুরদার শীত করে, আর অমনি ঘুম ভেঙে যায়, ছাগল গুণে নিয়ে ঠাকুরদা পাহাড় থেকে নেমে আসেন, ছাগল নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলেন, ছোট্ট কাঁসার বালতিতে দুধ দোয়ান, তবে তাঁর কাজ শেষ হয়।

একদিন কেমন যেন বেশি ঘুমিয়ে পড়েছেন, কখন রোদ নেমে গেছে

টের পান নি। ঘুম ভাঙতে চেয়ে দ্যাখেন গাছের ছায়াগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, হিম পড়ছে, ছাগলরা পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে! ঠাকুরদা তাড়াতাড়ি ওদের নিয়ে নেমে এলেন। জায়গাটার নাম বড় খারাপ-ঠাকুরদা ছাড়া কেউ সেখানে যেতেই চায় না-ছাগল গুণে নেবার আর তর সইল না, সরাসরি বাড়িমুখো চললেন।

দোরগোড়ায় ছাগল গুণে ঠাকুমা দেখেন একটা ছাগল কম! ঠাকুমার রাগ দ্যাখে কে! 'সোনালিয়াকেই ছেড়ে এলে! এত নেশা কর! যাও তাকে খুঁজে নিয়ে এসো।'

ঠাকুরদার নেশার ঘোর তখনো ছোটে নি, রাগ হল বটে, কিন্তু যা কান বোঁ বোঁ করছে, রাগটা আর দেখাতে পারলেন না। ফিরে গেলেন পাহাড়ে।

চাঁদের আলো ফুফুট করছে, পাহাড়ে উঠে দ্যাখেন সেই চাঁদের আলোয় হাজার হাজার ছাগল চরছে। মাঝখান দিয়ে ঝিরঝির্ করে এক ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, তার এপারে ওপারে ছাগল চরছে। কই দিনের বেলায় তো ঝরনা চোখে পড়ে নি!

কয়েকজন দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক ছাগল চরাচ্ছে, ঠাকুরদা তাদের কাছে গিয়ে সোনালিয়াকে চাইলেন। তারা উত্তর না দিয়ে ছাগলের পাল দেখিয়ে দিল।

ঠাকুরদা সোনালিয়াকে চিনতে পারেন না। যে ছাগলের দিকে তাকান তাকেই মনে হয় সোনালিয়া। রগড় দেখে দাড়িওয়ালা বুড়োরা হেসেই কুটোপাটি। সেই হাসি শোনবামাত্র ছাগলরা সব দলে দলে ঝরনা পার হয়ে চলে যেতে লাগল।

তখন ঠাকুরদা সামনে যাকে পেলেন, তাকেই মনে হল সোনালিয়া, তাকেই কোলে তুলে নিয়ে, দৌড়তে দৌড়তে পাহাড় থেকে নেমে একেবারে বাড়িতে।

সোনালিয়াকে দুইতে গিয়ে ঠাকুরদা অবাক হয়ে গেলেন, বালতি ভরে দুধের গঙ্গা বয়ে যেতে লাগল, তবু থামে না। এমন সময় ঘরের দরজায় কে টোকা দিল।

গিয়ে দেখেন একজন দাড়িওয়ালা বুড়ো দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, সঙ্গে তার সোনালিয়া। এতক্ষণে সত্যি সোনালিয়াকে চেনা গেল। ঠাকুরদা অন্য ছাগলটাকে এনে দিলেন। লোকটা যাবার আগে মুচকি হেসে ঠাকুরদার তামাকের দিকে দেখিয়ে দিল। দিলেন তাকে একদলা তামাক, তার বদলে সে তাঁকে এই জিনিসটে দিয়ে গেল।"

এই বলে ঝগড় তার কোঁচড় থেকে ছোট্ট একটা কালো গোল ফল বের করে দেখাল, তার বোঁটার কাছটা রুপো দিয়ে বাঁধানো।

"কি হয় এতে, ঝগড়? কেন দিয়েছিল?"

"কি হয়? এ কাছে থাকলে লোকে স্বপ্ন দ্যাখে বোগিদাদা, আর কোনো দুঃখু তার গায়ে লাগে না। নেশা করবারও দরকার লাগে না। চল, চল, মেঘ করে আসছে, দেখ এবার জোর জল পড়লে গুণমণির কি দশা হয়।"



এগারো

রুমু দেখল কিছুতেই কিছু হয় না গুণমণির। ছাই দিয়ে চাপা পড়ে যায়, বৃষ্টির তোড়ে শুয়ে পড়ে, পরদিন সকালে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, জোড়া জোড়া পাতার কুঁড়ি ফুটে যায়। দিনে দিনে গুণমণি বাড়তে থাকে।

কিন্তু ভুলো আর আসে না।

"দাদা, ভুলো একদিন কাদাপায়ে তোমার খাটে উঠেছিল বলে তুমি ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে কেন?" রুমু খুব কাঁদতে থাকে।

ঝগড় এসে বলে, "ও কি, খালি খালি চোখের জল! তবে আর সুখনের কথা কাকে বলি?" রুম চোখ মুছে বলে, "কে সুখন, বল ঝগড়।"

ঝগড় বলে, "আমার ছোট ঝমরু, তার ছোট সুখন, তার ছোট নানক। সখনও মাটিতে শেকড় গাড়লে না।"

"মাটিতে কেন শেকড় গাড়বে, ঝগড় ?"

"ফেরারী হয়ে রইল, দিদি, ঘর বাঁধল না কোথাও। আগে কিন্তু ভারি সুখের প্রাণ ছিল তার। ভালোটি খাবে, ভালোটি পরবে, এ চাই, ও চাই। সেই লোডে সর্দারের বোবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলল সুখন, কারো মানা শুনল না। এমন সময় ভারি জলের কষ্ট হল সেবার।

আমাদের গাঁয়ের লোকে চাঁদা করে বড় ইঁদারা কাটাবে ঠিক করল। জল-খোঁজারা এল।"

"জল-খোঁজা কারা, ঝগড় ?"

"তারা বেদেনী, বোগিদাদা। হাতে একটা তিন মুখো কাঁচা লাঠি নিয়ে ঘুরতে লাগল, পাহাড়ের কোলের কাছে এসে লাঠির মুখ বেঁকে মাটিতে ঠেকে গেল। বেদেনীরা সর্দারকে বলল, এইখানেই খোঁড়ো, সর্দার, এইখানে জল আছে।

"অমনি আমাদের গাঁসুদ্ধ লোকে, পুরুষ মেয়ে, ছেলে বুড়ো কোদাল নিয়ে লেগে গেল। খুঁড়তে খুঁড়তে এক মানুষ, দুই মানুষ মাপ করে করে যায়। আট মানুষ হয়ে গেল, তবু আর জল বেরয় না।

"বেদেনীদের আবার ধরে আনা হল। তারা তবু বলে, আছেই জল, ঝরনার মুখে কিছু বেধে আছে, বের করে ফেল, জল পাবেই।

"সেদিন বিকেলে খুঁড়তে খুঁড়তে সুখনের কোদালে কি একটা জিনিস লাগল। বের করে দ্যাখে, পাথরের মতো শক্ত একটা বাঁশের চোঙ। কিছুতেই খুলতে পারল না, কোদাল দিয়ে ভেঙে ফেলতে হল। খানিকটা কাঠের গুঁড়োর মতো কি জিনিস ঝুরঝর করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল, আর পড়ল একটা ফিকে হলদে পাথরের মূতি।

"আধ হাত লম্বা হবে দিদি, পাতলা ফিনফিন্ করছে, লতাপাতার মাঝখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ নিচু করে। পড়ন্ত রোদে সুখন তাকে হাতে করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি কাছে যেতেই বলল, দ্যাখ, দাদা, ওর বন্ধ চোখের তারা দিয়ে আমার বুকের ভিতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

"ঘরে নিয়ে গেলাম মূতিটাকে। গাঁসুদ্ধ সবাই দেখতে এল। সর্দার বললে ওর পুজো না দিলে খারাপ হবে সুখন, মাটি থেকে না তুললেই ভালো ছিল। বন্ধ চোখে দৃষ্টি থাকে এমন তো কখনো শুনি নি।

সর্দার বললে, "সুখন, পুজো না দাও, কাল আমাকে সদরে যেতে হবে, ওকে সরকারের কাছে জমা দিয়ে আসি। এ-সব জিনিস ঘরে

রাখতে নেই, সুখন।"

"তার পর কি হল, ঝগড় ?"

"তার পর কি হল? সেই রাত্রেই মূতিটাকে নিয়ে সুখন কোথায় চলে গেল। আর তাকে দেখি নি।"

"মরে গেছে তা হলে।"

"সবাই মরবে কেন, বোগিদাদা? সুখন মোটেই মরে নি, মাঝে

মাঝে দেশে টাকা পাঠায়। তবে ওর শেকড় কেটে গেছে।"

"তা হলে দেশকে ভালোবাসে না বোধ হয়।"

"দেশে না থাকলেই দেশকে ভালোবাসা যায় না? ভালোবাসার জিনিসকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে হবে নাকি?"

"আচ্ছা, আচ্ছা। আর ইঁদারার কি হল?"

"ইঁদারায় সে কি মিষ্টি জল উঠল, দিদি। এখনো আমাদের গাঁয়ের লোক ঐ ইঁদারার জল খায়, ফটিকের মতো পরিষ্কার, মধুর মতো মিষ্টি। জষ্টিমাসে দারুণ খরার সময়ও ঐ কুয়োতে দু-মানুষ জল

থাকে। কিন্তু সুখনকে আর দেখলাম না।" "তোমাদের বাড়ি কিরকম বল-না ঝগড় ।"

"মাটির বাড়ি বোগিদাদা, শীতের ভয়ে ছাদগুলো নিচু করে তৈরি। তবে চার দিকে ঘুরে উঁচু মেটে দাওয়া, গোবর দিয়ে নিকিয়ে আমার মা তক্তকে করে রাখে। জানলার চাটাইয়ে, দোরের দুই পাশে আমার মা নিজের হাতে ফুল লতাপাতা মাছ শাঁক এই-সব এঁকে রাখে। সে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, বোগিদাদা, মনে হয় মনের পাখি ডানা ঝাপটানি বন্ধ করে বাসায় এসে বসুক। আমার মা রাঁধে ভালো, রুমুদিদি, মেয়েমানুষকে রাঁধা-বাড়া শিখতে হবে।"

"দিদিমা আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না।"

"আঃ, রুমু, চুপ কর। বল, ঝগড়, তুমি এতকাল দেশে যাও না, তোমাদের বাড়ি কেমন দেখতে হয়েছে জানলে কি করে?" "বাঃ, তা জানব না, আমার চোখের মণিতে গাঁথা হয়ে থাকে, কেমন

দেখতে জানব না?"

"দিদিমাকে বলে একবার যাও-না কেন ঝগড়? তোমার বুড়ি মা কত খুশি হবে।"

"নানকুর বিয়ে দিতে যাব মনে ঠাউরেছি। কি জানো, দিদি, আমাদের গুষ্টির ছেলেরা যে ধানের চাল খাবে সে হেথা-হোথা কত দূর দূর দেশে বোনা হয়েছে।"

"তা কেন, ঝগড়? তোমার বাবা, ঠাকুরদা তো দেশে থাকত।" "চিরকাল কি আর দেশে থাকত বোগিদাদা? আমার বাবা সে একরকম ছিলেন। আর জন্তু-জানোয়াররা ছিল তাঁদের ঘরের লোক। একবার দুমকার ঘোর জঙ্গলে কাঠের খোঁজে গিয়েছিলেন, দেখেন কিনা গাছের গোড়ায় একটা এতটুকু বনবেড়ালের বাচ্চা মিউ-মিউ করে কাঁদছে। বাবাকে দেখে সে দারুণ খুশি, দু পা তুলে নেচে-টেচে একাকার। বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন। মনে হল তার হলদে চোখের পিছনে আলো জ্বলছে। বুকে করে বাবা তাকে ঘরে নিয়ে এলেন।

সে রাত্রে আমাদের গাঁয়ের কেউ ঘুমুতে পারল না, নেকড়ে বাঘ এসে সারারাত দাপিয়ে বেড়ালো। বাবা বনবেড়ালের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলেন, শেষরাত্রে মনে হল বাঘ বুঝি উঠোনে এসে কেঁদে বেড়াচ্ছে। জানলার ঝাঁপি খুলে বাবা তখন বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলেন, অমনি নেকড়েও তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে একছুটে চলে গেল।"

"তা হলে বনবেড়ালের বাচ্চা নয়, ঝগড়, নেকড়েরই বাচ্চা।"

"কি জানি, রুমুদিদি, ওদের জাতই আলাদা। ওরা মানুষের বাচ্চাও পোষে তা জানো? আমাদের গাঁয়ের একটা ছোট্ট ছ মাসের ছেলে হারিয়ে গেছল তার গলায় মোটা রুপোর কণ্ঠি ছিল। দশ বছর বাদেও নেকড়ের দলে একটা মানুষের ছেলেকে চার হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, তার গলায় রুপোর কণ্ঠি।"

"ওর বাবা মা ওকে ধরে আনলে না কেন?"

"সে কি আর চেষ্টা করে নি, দিদি, মানুষ দেখলেই সে কামড়াতে আসত, ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে যেত। যে মানুষের রক্তে নেকড়ের দুধ মিশেছে সে কি আর অন্য মানুষের মতো হয় কখনো?"

"ঝগড়, তোমার বাবা চিরকাল দেশে থাকেন নি বললে, কোথায় গেছিলেন?"

“বর্মা জানো বোগিদাদা? সমুদ্দুরের ওপারে বর্মা আছে, সেইখানে।"

"বল তোমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প।"

"এখন তার সময় কোথায় দিদি? ঐ দ্যাখ নাথু এল কাপড়ের

গাঁটরি নিয়ে।"



বারো

নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু। ঝগড়র জন্য নাথু ট্যাকে করে গুণ্ডি নিয়ে আসে। ঝগড়ুর বউ নাথুকে দেখতে পারে না, তাই নাথুর কাজ সারা হলে ঝগড় ওর সঙ্গে মোমলতার তলায় বসে গল্প করে।

বোগি বলে, "কেন তোমার বউ নাথুকে দেখতে পারে না ঝগড় ?" নাথু মুচকি হেসে বলে, "আমার পা দুটো ডুবে থাকে এখানকার নদীর জলে কিন্তু মন কোথায় থাকে ঝগড়র বউ জানে না, তাই আমাকে দেখতে পারে না।"

"কেন, নাথু, কোথায় থাকে তোমার মন ?"

"বাতাস দিলে তোমাদের বাঁশবনের শিরশির সর্সর শব্দ শুনেছ, দিদি? বাতাস থামলে কোথায় থাকে সেই শব্দ? অমন বোকার মতো কথা জিগেস কোরো না।"

বোগি বললে, "ভারি বোকা রুমুটা, নাথু। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। আমি মজা করে বলেছিলাম, পুতুল ভেঙেছে কাঁদিস না, পুঁতে রাখ গাছ হবে। ও সত্যি পুঁতে রেখেছিল।"

রুমু বললে, "মোটেই আমি বোকা না। মোটেই আমি যে যা বলে বিশ্বাস করি না। খালি তুমি যা বল বিশ্বাস করি।" রুমুর কান্না পাচ্ছিল।

নাথু তাড়াতাড়ি বলল, "আর বিশ্বাস করবে নাই-বা কেন? কিসের গাছ হয় আর কিসের হয় না, তার তুমিই-বা কি জানো বোগিদাদা? যারই বুকের মধ্যে শেকড়ের কলি আছে তারই গাছ হয়। আমাদের গাঁয়ের কাছে এক সাধু থাকত, তার একটা কানাকড়িও ছিল না। সেবার বান ডাকার পর দুর্ভিক্ষ হল। সে সারা গাঁকে দশদিন খাওয়াল কি করে? খালি রাশি রাশি চক্চকে পয়সা এনে দেয়। তার পর সরকারি সাহায্য এল, সবার দুঃখ ঘুচল, তখন লোকে বললে, সাধু, তুমি পয়সা জাল কর নাকি, অত নতুন পয়সা পেলে কোথায়? তাকে নাস্তানাবুদ করলে গাঁয়ের লোক, মনের দুঃখে সে আস্তানা ছেড়ে চলেই গেল! সে গেলে সবাই বললে-দাও, জালিয়াত সাধুর ঘর পুড়িয়ে, ভন্ডামি করবার জায়গা পায় নি। ঘরে ঢুকে দেখে কয়েকটি মাটির বাসন আর একটা চট আর ঘরের মাঝখানে ছোট একটা শুকনো গাছ। তাকে উপড়ে ফেলতেই বেরুলো একটা পয়সা, তার চার দিকে গাছের শেকড় জড়িয়ে রয়েছে। ও কিসের গাছ?"

বোগি বললে, "তাই বলে তো আর পয়সার বুকে শেকড়ের কলি থাকে না যে গাছ গজিয়ে উঠবে। ওটা আপনিই কেমন করে শেকড়ে জড়িয়ে গেছিল।"

নাথু গাঁটরি তুলে মাথায় নিয়ে বলল, "পয়সার বুকে শেকড়ের কলি না থাকলেও, দয়ার বুকে তো আছে।"

"নাথু, যেয়ো না, তুমি একবার কি মাছ ধরেছিলে সেই কথা বল।" নাথু আবার গাঁটরি নামিয়ে রেখে বলল, "ঝগড় বলেছে বুঝি? ঝগড় তুমি বড্ড বেশি কথা বল! মনের কথা যাকে-তাকে বিলিয়ে দিতে হয় না। হ্যাঁ, তবে বোগিদাদা রুমুদিদিকে বলা যায়, ওদের চোখেও ঘোর আছে কিনা।"

"বল, নাথু, বল। ঝগড়কে বোকো না। ঝগড় খুব ভালো। ঝগড়ুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার পাঁচটা বন ছিল। গাছপালা জন্তু-জানোয়ার মৌচাক সব তাঁর ছিল। দারুণ সাহস ছিল তাঁর। আর এই বুকের • হাতি।"

"একবার কুড়ুল দিয়ে লম্বালম্বি ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বাঘ চিরে ফেলেছিলেন।" LI

"একবার ডাকাতে ধরেছিল তাঁকে, গাঁ থেকে এক কোশ দূরে, এমনি জোরে গাল বাজিয়ে লোক ডেকেছিলেন যে ঝড় উঠেছিল, ডাকাতরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!"

শুনে নাথু খুব হাসল, "কে বলেছে এ-সব? ঝগড়ই তো? ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তাও জানো না? তবে শোনো আমার মাছ- ধরার গল্প।

যারা জলে জলে কাজ করে জানো তো তাদের জলের নেশা লেগে যায়, জল ছেড়ে থাকতে পারে না। আমারও হল তাই। রোজ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সে কি দারুণ শীত সে আর কি বলব, বুকের ভিতরটা পর্যন্ত হিম হয়ে যায়, তার পর বিকেলবেলায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। কাজও করতে পারি না, অথচ ঘরে শুয়েও থাকতে পারি না।"

"কেন, নাথু, শুয়ে থাকতে পারো না কেন?"

"শুলে যে সময় চলে যায়, রুমুদিদি, একটু-একটু করে সময় ফুরিয়ে যায়। শোনোই-না গল্প। আমাদের গাঁ ছেড়ে খানিকটা উত্তরে একটা আমগাছ আছে জলের কিনারায়। সেইটে ঠেস দিয়ে বসে মাছ ধরি। পোকামাকড়ের টোপ্ দিই না, দিদি, পোকামাকড়ে সাধারণ মাছ ওঠে।" "সাধারণ মাছ উঠলে কি হয়, নাথু?"

"কি'জ্বালা! সাধারণ মাছ তো হাটেও কিনতে পাওয়া যায়, ও দিয়ে আমি কি করব?"

"আচ্ছা, আচ্ছা, বল।"

"একদিন আমি বঁড়শিতে একটা লাল টুকটুকে কুঁচফল গেঁথে ছিপ ফেললাম। ভারি জল তখন, আমাদের এখানে রোদ ঝক্কক্ করছে, কিন্তু নদীর গোড়ায় কোথায় বৃষ্টি পড়েছে, ভারি জোর স্রোত। ভাবছি এত স্রোতে মাছ পড়বে না, সারা গা রোদে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বুকের বরফ কিছুতেই গলছে না, এমনি সময় সুতোয় টান লাগল। টেনে তাকে তুলতে পারি না, হাঁপ ধরে গেল, শেষে অনেক কষ্টে তাকে ড্যাঙায় ওঠালাম। ওরকম মাছ তোমরা চোখে দ্যাখ নি, বোগিদাদা, রুমুদিদি। দেখবেও না কখনো।"

"থামলে কেন, নাথু? বল, বল।"

"আঃ! থামলাম সে কথা মনে করেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বলে। শোনো মন দিয়ে। মাছটা দুই হাতের কনুইয়ে ভুর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। রোদের আলোতে পষ্ট দেখলাম তার মাথাভরা কালচে সবুজ চুল ঘাড়ে গলায় লেপটে রয়েছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বড় কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে, মুক্তোর সারির মতো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, কানের কাছে চুলের সঙ্গে বঁড়শি আটকে আছে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। ছোট দুটি কানে দুটি সোনার মাকড়ি পরা। দেখলাম পদ্মফলের মতো হাত দুটি দিয়ে শক্ত করে ঘাস আঁকড়ে রয়েছে, নীল-নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, দীঘির মাঝখানকার মতো ঘন সবুজ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, বুকটা কত যন্ত্রণায় উঠছে পড়ছে। কোমরের তলা থেকে মাছের মতো দেখতে, ল্যাজটার কি রঙের বাহার, ময়ূরের পেখমের মতো মেলে রয়েছে। দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে তার সব রঙ ফিকে হয়ে আসতে লাগল, নিঃশ্বাসের ওজন যেন একশো মণ, দু ফোঁটা চোখের জল আমার হাতে এসে পড়ল। অমনি আমার বুকের ভিতরকার বরফ গলে গেল, আমি তাড়াতাড়ি ট্যাক থেকে আমার ছুরিটা বের করে ছিপের সুতো কেটে দিলাম। ভয় হল এখুনি বুঝি এলিয়ে পড়বে, কোলে তুলে তাকে মাঝ-নদীতে ছুড়ে ফেলে দিলাম। সারা গা আমার ভিজে গেল। তার পর আর মনে নেই।

যখন জ্ঞান হল, দেখি ঘরে শুয়ে আছি, জ্বর-গায়ে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য বাড়ির লোকরা রাগারাগি করল। এখন যাই, বোগিদাদা রুমুদিদি। ঝগড়ুর গল্প সব সত্যি না-ও হতে পারে। ও জেগে জেগে স্বপ্ন দ্যাখে।" যেতে যেতে থেমে বলে, "এই আমার এক কানে সোনার মাকড়ি দেখছ, এটিকে পরদিন ঐ আমগাছের তলায় পেয়েছিলাম।"

নাথু গাঁটরি নিয়ে চলে গেল, আর ঝগড়ু হেসে বললে, "জ্বরও হল গিয়ে স্বপ্নেরই জাতভাই, দাদা। স্বপ্ন দেখতে না পারলে আর পারলে কি? উঠি। গা-টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কাঠ ফেড়ে ঘাম ঝরিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে করে ফেলি। কাল সারারাত ঘুমোই নি, বোগিদাদা, চাঁদনী রাতে কুকুররাও ঘুমোয় না, আমারও চোখে ঘুম থাকে না, আমার শালার ছেলেটা কিন্তু খুব ঘুমিয়েছে।"

"চাঁদনী রাতে ভুলো তো ঘুমোত, ঝগড়।"

"ভুলো? সে তো সুখী কুকুর, সুখীদের ঘুমতে বাধা নেই।"

"সুখী তো পালিয়ে যায় কেন, ঝগড় ?"

"সুখীরা পালায় না কে বলেছে দিদি? সুখীরা পালায় ঐ সুখের কাছ থেকেই। দুঃখ পায় না বলে দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়। বলব একদিন আমার বাবার বর্মা যাওয়ার কথা !"



তেরো

চাঁদনী রাতে দুঃখী কুকুররা সত্যি ঘুমোয় না, সারারাত চাঁদের দিকে মুখ তুলে হু-হু করে কাঁদে। তাই শুনে রুমুরও কান্না পায়, বোগির খাটে উঠে এসে শোয়। ঝগড় এসে বলে-

"শুনবে নাকি আমার বাবার বর্মা যাওয়ার গল্প?"

"হ্যাঁ, ঝগড় শুনব।"

"বুঝলে, আমার ঠাকুরদার তখন খুব ভালো অবস্থা। আমার বাবা আর কাকা রাজার হালে থাকে, কাজকর্ম বিশেষ করতে হয় না, সারাদিন হরিণ শিকার করে, বাঁশি বাজিয়ে, মাছ ধরে ঘরে ফিরে মাংস ভাত খেতে পায়। রাতে বিছানায় নরম তোশক পায়, কম্বল পায়। সোনার আংটিও হল দুজনার, যার যা সখ ছিল মিটে গেল! তখন তারা আর সইতে না পেরে একদিন ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল।"

"কেন, ঝগড়, ভালো ছিল তো, পালাল কেন?"

"সখ মিটে যাওয়া ভালো নয়, দিদি, তখন পালানো ছাড়া আর

উপায় থাকে না।"

"ঝগড় !"

"কি, বোগিদাদা?"

"তোমার কি মনে হয় ভুলোর সব সখ মিটে গেছিল?"

"তা কি করে মিটবে, বোগিদাদা? কয়েকটা সখ তো মেটে নি জানি। যেমন আমার পায়ের গুলি কেটে নেবার সখ। রেবতীবাবুদের বেড়াল খাবার সখ। তোমার দাদুর ইজিচেয়ারে বসবার সখ। না, দাদা, ভুলোর সখ মিটতে দেরি আছে।"

"আচ্ছা, তোমার বাবার কথাই বল। কোথায় গেল তারা?"

"কাঠের আড়তে লোক নিচ্ছিল, বর্মায় কাঠ কাটতে যেতে হবে। বাবা আর কাকা সেইখেনে গিয়ে নাম লিখিয়ে, সেই রাত্রের গাড়িতেই এক দলের সঙ্গে রওনা হয়ে গেল। গাঁয়ের কেউ জানতে পারল না। ঠাকুমা কেঁদে কেঁদে সারা। তার পর বর্মা গেল বাবা আর কাকা। জাহাজে করে সমুদ্দুর পার হয়ে। সমুদ্দুর জানো, দাদা?"

"বাঃ, সমুদ্দুর জানি না? পৃথিবীর তিন ভাগই তো সমুদ্দুর, আর শুধু এক ভাগ ড্যাঙা।" ঝগড় তাই শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করে না। হ্যাঁ, জীবনের বেশিটাই কেটে গেল, একবারও সমুদ্দুর দেখলাম না, বললেই হল তিন ভাগ সমুদ্দুর! যদি জানতে, ঐ সমুদ্দুর পৌছতে আমার বাবা কাকাকে কত কষ্ট করতে হয়েছিল, তা হলে আর ও কথা বলতে না, দাদা।” রুম বললে, "আচ্ছা, দাদা, তুমি থামো না। হ্যাঁ, ঝগড়, তার পর।"

"তার পর বর্মায় পৌঁছে দ্যাখে সে কি দেশ গো! ছেলেদের ভারি মজা, মেয়েরাই সব কাজ করে দেয়। বাবাদের দেখে দেখে হিংসে হয়-"

"এই-না বললে সুখে থেকে আর সইতে পারছিল না ওরা, তবে আবার হিংসে কেন ?"

"নাঃ, তোমরা বড় বোকা,

কারা হিংসুটে হবে? দুঃখীরা?

তবে আর হিংসে করবে কেন?

সুখী লোকরা হিংসুটে হবে না তো

দুঃখীরা তো সুখ কি তাই জানে না,

এখন গল্পটা শোনো তো।

"বাবাদের পাঠিয়ে দিল একেবারে ঘোর জঙ্গলে, সেগুনগাছের ঘন বনে। সেখানে একটা ছোট্ট ডেরা ছিল। দারুণ বেঘো জঙ্গল, ডেরার চার দিক ঘিরে পনেরো হাত উঁচু করে শক্ত কাঠের দেয়াল করা। তার গায়ে একটা মজবুত দরজা। বাঘ নাকি পনেরো হাত লাফাতে পারে না। ডেরাতে বিশেষ কিছু নেই, ওরা বারোটা লোক সারাদিন কাঠ কাটে, সূর্য ডোবার আগে ডেরায় ফিরে আসে। একটা বড় ঘর, তাতে বারোটা খাটিয়া আর বারোটা পিঁড়ে, পাশে রান্নাঘর, ছোট্ট কুয়ো। আর কিই-বা লাগে? সারারাত দরজা এঁটে ঘুমিয়ে থাকে সকলে, সকালে কাজে বেরোয়।

"একদিন কাকার দারুণ জ্বর এল। জ্বরের হাত থেকে কোথাও নিস্তার নেই, দাদা। সবাই কাজে চলে গেল। কাকা একলা কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপটি করে পড়ে আছে। পায়ের কাছে দরজা খোলা। "এমনি সময় একটা শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখে কিনা একটা এই

বড় বাঘ বেড়া উস্কে ভিতরে এল। কাকা তো কাঠ!

"বাঘটা ঘরে ঢুকে একটু ঘুরঘুর ছোঁছোঁক্ করে বেড়ালো, চার ধারে মানুষের গন্ধ, বোধ হয় তাই কাকাকে অতটা লক্ষ্য করল না। কিন্তু কাকা পষ্ট দেখলেন বাঘ ওঁকে শুঁকে পিঁড়েগুলোকে গুণে গেল। তার পর আবার যেমন এসেছিল লাফ দিয়ে বেড়া উস্কে চলে গেল।

"বিকেলে সবাই ফিরলে পর কাকা বাবাকে ডেকে সব কথা বলল। বলল, সবাইকে বল। বাবা বলল, যাঃ, বাঘ কখনো অত উঁচুতে লাফাতে পারে না। আর এলই যদি, তোকে কিছু বলল না? তুই জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখে থাকবি। কি করে কাকা! সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, কাকা দেখল প্রথম রাত্রে বাঘাটা এসে একটা লোককে তুলে নিয়ে গেল। খানিক বাদে এসে আরেকটাকেও নিয়ে গেল। তখন বাবা সবাইকে বলল, কিন্তু কেউ বেরুতে রাজি হল না, বলল, বাঘ কখনো মানুষ মুখে করে অতটা লাফাতে পারে? ওরা দুজনে আছে কোথাও এইখানে।

"শুধু বাবা কাকাকে বলল, চল্, কোথায় যাবি। "একটু দূরে নদী, তার জলে কাঠ কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেইখানে নৌকো বাঁধা থাকে। কাকা বললে, ঐখানে চল নৌকো করে গাঁয়ে চলে যাই।

"নদীর ধারে গিয়ে ওরা দা দিয়ে কাঠ ছুলে কয়েকটা বল্লম বানিয়ে নিল। তার পর যেই-না নৌকোয় চড়েছে, বাঘও এসে হাজির। ততক্ষণে ওরা মাঝনদীতে। বাবা নৌকোর উপর উঠে দাঁড়িয়ে বাঘের বুক লক্ষ্য করে একটা বল্লম ছুড়ল। দুমকার ছেলের হাত ফস্কায় না, বোগিদাদা, বল্লম গিয়ে বাঘের বুকে বিঁধল। বাঘও অমনি মানুষের মতো চীৎকার করে উঠল। আর বাবা টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ল, কাকা তাকে টেনে নৌকোয় তুলে, দাঁড় বেয়ে, যত তাড়াতাড়ি, পারে সেখান থেকে চলে গেল। নদীর বাঁকে ফিরে চেয়ে দেখেছিল, মনে হল, বুকে বল্লম বিঁধে পড়ে আছে ওটা হয়তো বাঘ নয়, বাঘের ছাল-পরা মানুষ।"

"তার মানে, ঝগড় ?"

"কে জানে, সত্যি কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন কোথায় শুরু হয়। আর যায় নি ওরা ডেরায় ফিরে। গাঁ থেকে পালিয়ে চলে এল দেশে।" বোগি বল্লে, "না, ঝগড়, তোমার বর্মার গল্প ভালো না।"

অমনি রুমুও কান্না ধরল, "মরে গেল কেন? ও বিশ্রী গল্প। দাদা, 'ভুলো কেন আসছে না?"

ঝগড় বললে, "আসবে দিদি, আসবে। সময় হলে সব এসে তোমার হাতের কাছে জড়ো হবে। আজ গুণমণিকে দেখেছ নাকি? লক্লক্ করে ছাদ ছোঁয়-ছোঁয়। কুড়ি ধরেছে গুণমণির। আর তিনটে দিন সবুর কর-না। আচ্ছা, যাবে আজ সন্ধ্যাবেলায় ম্যাজিক দেখতে? খেলার মাঠে এত বড় কানাও পড়েছে। চোখের সামনে যা হয় না তাই হচ্ছে। হাজার লোক অবাক হয়ে যাচ্ছে। চোখ মোছ দিকিনি। দিদিমাকে বলে চল যাই।"



চোদ্দো

বোগি কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল, "আসলে কিন্তু ম্যাজিক হয় না, সব চালাকি। দাদু বলেছে সব হাত-সাফাইয়ের বুজরুকি। লোকেরা সেধে পয়সা দিয়ে বোকা বনতে যায় ।"

ঝগড় রুমুর জুতোর ফিতে বেঁধে দিয়ে বললে, "ম্যাজিক যে একেবারেই হয় না, তা বোলো না, বোগিদাদা। এদের কথা আমি জানি না, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন ব্যাপার ঘটে তাতে ম্যাজিক হয় না এ কথা বলা চলে না। ঐ তো নাথু এসেছে, ও-ই বলবে 'খন।"

"নাথু, যাবে তুমিও ম্যাজিক দেখতে? আমাদের গল্প বলতে হবে কিন্তু।"

নাথু খুব ভালো কাপড়জামা পরে, গোঁফ আঁচড়ে, এসেন্স মেখে, সেজেগুজে এসেছিল। পায়ে চক্চকে পাম্পু, তার গোড়ালির কাছে তুলো গোঁজা। নাথু জুতোজোড়া বোগির খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে ওদের সঙ্গে চলল।

"ম্যাজিকের গল্প বল এবার নাথু।"

নাথু বললে, "সে আর এমন কি কথা। বছর বারো আগে একবার হাটের দিনে একটা লোক এসে নানরকম ম্যাজিক দেখিয়ে, এক- পয়সা দু-পয়সা নিচ্ছিল। লোকেরা সব মজা পেয়ে গেল, ওকে ঘিরে তারাও রগড় করতে লাগল। লোকটাকে একটু বোকা মতন মনে হয়েছিল।

"ক্ষেত্রী বলে একজন দোকানদার ছিল, ভারি পাজি আর কেউ পয়সা রোজগার করছে দেখলে তার গা জ্বলে যেত। লোকটা তার কাছে আট- আনার কি সব জিনিস কিনে যেই তাকে একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি সেও ঢং করে অন্য হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বলেছে, 'ফুস্ মন্তর লাগ্ লাগ্ লাগ্-কই হে, আধুলি দাও নিতো, এ তো একটা পয়সা।'

"লোকটা একটু যেন অবাক হয়ে আবার একটা আধুলি দিয়েছে, অমনি আবার সেটা পয়সা হয়ে গেছে। হাটের লোকেদের হেসে হেসে পেটে ব্যথা ধরে গেল। লোকটা ভারি বোকা বনেছে তো।

"তখন কে একজন বললে, 'আরে, তুমিও কি কিছু কম যাও নাকি হে? দাও-না ওকে ধুলো-পড়া করে উড়িয়ে!'

"বলবামাত্র লোকটা একমুঠো ধুলো তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিল, আর হাটসুদ্ধ সকলের সামনে থেকে ক্ষেত্রী অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন এমনি একটা সোরগোল উঠল যে তার মধ্যে কোন ফাঁকে যে সে লোকটা সরে পড়ল, কেউ টেরও পেল না। ক্ষেত্রীর টিকিটি আর কেউ দ্যাখে নি। "ম্যাজিক যে একেবারেই হয় না, তা বোলো না বোগিদাদা।"

"তার পর ক্ষেত্রীর কি হল?"

"সে আর আমি কি জানি। যেমনি ব্যাটা পাজি ছিল, তার ঠিক সাজাই হল। ওকি রুমুদিদি, আবার কি হল?"

"যদি কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করে দেয়?"

"আহা, ভুলো তো আর দুষ্টু নয়, ভুলো তোমাদের ভালো কুকুর।" "ভুলো যে দাদুর দুব খেয়ে ফেলেছিল? অনিমেষবাবুকে কামড়ে- ছিল? দিদিমার জামা ছিড়ে দিয়েছিল?"

বোগি বললে, "কেউ ভুলোকে ধুলো-পড়া করে নি রুমু, ন্যাকামি কোরো না। একটা রুমালও আনতে পারো না।"

ম্যাজিক দেখে বাড়ি ফেরবার সময় বোগি দ্যাখে রুমু, ফ্রকের কোঁচড়ে করে কি নিয়ে চলেছে।

"আঃ, রুমু, ফ্রক নামাও, আবার পেট দ্যাখা যাচ্ছে।"

রুমু মাথা নাড়ল। ঝগড় বললে, আমার হাতে, আমি নিয়ে যাই।-ওকি! "কি আছে দিদি? দাও তোমার তো ভারি সাহস হয়েছে দেখছি, অত বড় মাকড়সাকে কোলে তুলেছ!"

বোগি ব্যস্ত হয়ে উঠল। “ছিঃ রুমু, মাকড়সারা বিষাক্ত হয়, কি

বলে ধরলে? ভয়ও করল না? ফেলে দাও, ঝগড়।" রুমু কেঁদে ফেলল, "না, ঝগড়, না, ওর পাঁচটা ঠ্যাং, ওকে ফেলো না।"

ঝগড় একটুক্ষণ কি ভেবে, পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে মাকড়সাটা তার মধ্যে পুরে নিল।

নাথু বললে, "ব্যাপার যেন ঘোরাল বলে মনে হচ্ছে, দিদি।"

রুমু খুশি হয়ে বলল, "এত দিন পরে!" ঝগড় বললে, "ওকে বিরক্ত কোরো না, নাথু। বলবার হলে বলবে, কারো মনের কথা কেড়ে নিতে হয় না।"

রুমু জিজ্ঞাসা করল, "নিদুলী-মন্ত্রটা কি, ঝগড় ?"

"ঘুমিয়ে পড়বার মন্ত্র, দিদি, বদলে যাবার মন্ত্র।"

"ঘুমোলেই কি বদলে যায়, ঝগড় ?"

ওদের কথা শুনে বোগি খানিকটা এগিয়ে এল, "তুমি বেশ বদলে যাও, রুমু। শোবার সময়ে খিছিট্ কর, কথায় কথায় কাঁদ। আর সকালে ওঠ হাসিমুখে। ঝগড় তুমি তো জানো নিদুলী-মন্ত্র ?”

"বলেছি-না দুমকায় সবাই জানে নিদুলী-মন্ত্র, দাদা। দুমকার ঘুম তো আর এখানকার ঘুমের মতো ছিল না। দুমকায় লোকে ঘুমোত এক চোখ আর এক কান খুলে রেখে। সেও একরকম ঘুম, আবার ঘুমোয় না এমন লোকও তো আছে। তাদেরই জন্য নিদুলী-মন্ত্র হয়েছিল। ঘুম পাড়াবার মন্ত্র, বোগিদাদা। তোমার রাতে ঘুম হয় তো ?"

রুমু বললে, "ও ঘুমোয়, আমার কিন্তু ঘুম হয় না। যখনি ঘুম ভেঙে যায়, তখনি দেখি জেগে আছি।"

"আরে, তা হলে তোমারই জন্য তো নিদুলী-মন্ত্র, দিদি।"

রুমুর আর পা চলতে চায় না, পা ব্যথা করে, এমন সময় ওরা বাড়ি এসে পৌছয়। রাত্রে শুলে পর ঝগড় এসে পা টিপে দেয়। রুমুর কি যে আরাম হয়। ঝগড়কে বলে-

"ঝগড়, তুমি কি ঐ কালো ছেলেটাকে ভালোবাস ?"

"তা বাসি বৈকি, দিদি, বউয়ের ভাইয়ের ছেলে, ভালো না বেসে কি আর আমার উপায় আছে?"

"আচ্ছা, ঝগড়, ওকে না দেখলে তোমার কষ্ট হবে?"

"কষ্টকে ভয় করলে তো আর ভালোবাসা যায় না, দিদি। ওর বাবা-মা এসে ওকে নিয়ে গেলে আর দেখতে পাব না। ভুলোকে দেখতে পাচ্ছ না বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে তো দিদি? তবে কি ভুলোকে ভালো না বাসলে ভালো হত?"

রুমু হঠাৎ এক গাল হেসে বলল, "ভুলো তো আবার আসবে। তুমি একটা সোনা-রুপোর মাদুলি খুঁজে পাও-না ঝগড় ?" "কি হবে দিদি?"

"বাঃ, তুমি-না বললে নিদুলী-মন্ত্র দিয়ে যে কুকুররা শেয়ালরা হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে যায়, তাদের আবার জানোয়ার করে দেয়া যায়? কিন্তু সে ভারি শক্ত, পাঁচঠ্যাং মাকড়সা চাই, সোনা-রুপোর মাদুলি চাই। বল নি তুমি?"

বোগি অন্য খাট থেকে মাথা তুলে বললে, "বল নি তুমি? তবে কি ফের বাজে বকছিলে? গাঁজাখুরি কথা বলছিলে ঝগড় ?"

"না, না, বোগিদাদা। রুপোর মাদুলি এনে দেব। তো বললে না?" বিশ্বাস কর, আমি যেমন করে পারি সোনা- কিন্তু কাকে জানোয়ার বানাতে হবে ত!




পনেরো

রুমু বোগি উঠে বসল।

"বল, দাদা, তুমি বল।"

"ঝগড়, ভুলো যেদিন পালিয়ে গিয়ে রাত করে ফিরেছিল, সেদিন

ও কোথা থেকে হলদে পাখি খেয়ে এসেছিল, ওর ঠোঁটের কোনায় হলদে

পালক গুঁজে ছিল।"

"সে কি, বোগিদাদা ?"

"হ্যাঁ, ঝগড়, হ্যাঁ। পরদিন সকালে দেখি ভুলো নেই, কিন্তু তোমার ঘরে একটা কালো ছেলে। তার চোখ পাটকিলে রঙের আর কানের উপর দিকটা খোঁচা মতো। তুমি মুখ ঢাকছ কেন, ঝগড় ?"

"বেজায় আশ্চর্য লাগছে কিনা। কিন্তু ও যে আমার শালার ছেলে।" রুমু ব্যস্ত হয়ে উঠল। "না, ঝগড়, ও-ই ভুলো। সোনা-রুপোর মাদুলিটা জোগাড় কর, অমনি দেখবে ও ভুলো। আচ্ছা ঝগড়, তোমার বউ কিছু বলবে না তো?"

"আরে বউকে কিছু বলে কাজ নেই। তবে নাথুর সাহায্য দরকার হবে। এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তোমরা? আমাদের গাঁয়ের লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল, আর তোমরা এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তো ?"

"পারব, ঝগড়, পারব! ময়ূর-মেয়ের কথা বল।"

"বুঝলে বোগিদাদা, লখনিয়া তোমাদের মতো ছিল, কষ্ট পাবার ভয়ে কাউকে ভালোবাসত না, কোনো মানুষকে না, কোনো জিনিসকে না। মানুষ চলে যায়, ভুলে যায়, মরে যায়, আর জিনিস ভেঙে যায় চুরি যায়, হারিয়ে যায়, মরচে ধরে, পোকায় খায়। কি হবে ভালোবেসে?

"মেলা টাকাপয়সা ছিল লখনিয়ার, দিব্যি খেত-দেত, ফুতি করত। একদিন চাঁদনী রাতে লখনিয়া পাশের গাঁ থেকে বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছে, দ্যাখে মহুয়া গাছতলায় ময়ূর নাচছে।"

“যাঃ, শুধু মেঘলা দিনে ময়ূর নাচে।"

"না বোগিদাদা, চাঁদের আলোতেও ময়ূর নাচে। লখনিয়া তাই দেখে থমকে দাঁড়াল, ময়ূরটা নেচে নেচে একেবারে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, কি জানি কেন লখনিয়ার তাকে ভালো লাগল। যেই ভালো লাগল, চোখের সামনে ময়ূরটা একটি সুন্দর মেয়ে হয়ে গেল। ময়ূরের পেখমের মতো ঝল্মলে তার রূপ। চেয়ে চেয়ে আর লখনিয়ার মন ভরে না, হাত বাড়িয়ে যেই-না তাকে ধরতে গেল, অমনি মেয়েটি বাতাসের মতো মিষ্টি সুরে বললে, 'অত সহজে পাওয়া যায় না, লখনিয়া, অপেক্ষা করতে হয়।' বলেই কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল।

"সবাই বললে, লখনিয়া বিয়েবাড়িতে নেশা করেছিল, কি দেখতে কি দেখেছে। কিন্তু লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল।"

“থামলে কেন, ঝগড়, তার পর সে এসেছিল ?"

"তা আর আসবে না? ততদিনে লখনিয়া বুড়ো হয়ে গেছিল, চোখে ভালো দেখতে পেত না, কিন্তু তবু ময়ূর-মেয়ের রূপটি ঠিক চিনতে পেরেছিল। মরার আগে চোখ জ্বলজ্বল্ করে উঠেছিল, মুখখানি হাসিতে ভরে গেছিল। এটাও বিশ্রী গল্প, দিদি?"

রুম বললে, "না, ঝগড়, খুব ভালো গল্প।” বোগি বললে, "তাই বলে সত্যি করে ময়ূর কখনো মানুষ হয় না!"

ঝগড় একটু হেসে উঠে গেল।

চার দিকের শব্দ যেন ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল। টেবিলের উপর ঘড়ির টিক্টিক্ কখনো এত জোরে মনে হয় যে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আবার তার পরই এত দূরে সরে যায় যে প্রায় শোনাই যায় না। চার দিক চুপ হয়ে যায়, এত চুপচাপ যে কানে তালা লেগে যায়। ঘুমে বোগির চোখ জড়িয়ে আসছে, মনে পড়ল সেজোমামা বলেছে কানের মধ্যে বোঁ বোঁ আওয়াজ হল নিজের রক্ত-চলাচলের শব্দ।

ঠিক তার পরেই যেন সকাল হয়ে গেল। দিদিমা দরজা খুলে, জানলার পরদা সরিয়ে বললেন, "কত ঘুমুবি তোরা? ওঠ, শিল্পির, চেয়ে দ্যাখ্ তোদের আঁস্তাকুড়ের শিমগাছে কি সুন্দর ফুল ধরেছে!"

এক লাফে রুম বোগি রান্নাঘরের সামনে। একটা দুটো ফুল নয়, ছড়া ছড়া ফুল, ফিকে নীল, গাঢ় নীল, বেগনী, গোলাপী, আশ্চর্য তাদের রঙ, প্রজাপতির মতো গড়ন, মিহি একটা সুগন্ধ।

ঝগড় ও এল একটু বাদে, কুয়ো থেকে জল তোলা হলে। নাথুও

এসেছিল কাপড়ের গাঁটরি মাথায় করে।

"আজ আমার বড় ভালো দিন, দিদি, গাধা কিনেছি, আর বোঝা বইতে হবে না। আর এখানে এসে দেখি গুণমণির ফুল ধরেছে। একটা বিড়ি খাইয়ে দাও, ঝগড়, আজ বড় ভালো দিন।"

নাথুকে নিয়ে ঝগড় কুয়োতলায় গেলে পর ঝগড়ুর বউ এল কালো ছেলেটাকে কোলে করে গুণমণিকে দেখতে। ছেলেটার গায়ে লাল ফতুয়া।

"কি রূপ গো, দিদি, বাড়িখানি আলো হয়ে গেছে!"

ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে, বউ ছেলেটার গায়ের ফতুয়া ছাড়িয়ে দিল। তার গলায় একটা সোনা-রুপোর মাদুলি বাঁধা।

"কি দেখছ, দিদি, দাদা কাল রাতে পাঠিয়েছে দুমকা থেকে, জ্বর বন্ধ হবার জন্য।"

"তুমি যে বলেছিলে সোনা-রুপো কেনবার পয়সা নেই ?"

"কি জানি, দিদি, পাঠিয়েছে তো দেখছি।" সেদিন বিকেলবেলায় ভুলো ফিরে এল। নোংরা, ধুলোমাখা গলায় একটা নারকোলের দড়ি বাঁধা, হাঁপাতে হাঁপাতে জিব ঝোলাতে ঝোলাতে এল। রুমু বোগিকে দূর থেকে দেখেই ভুলে। দৌড়তে লাগল। কাছে এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নোংরা পা দিয়ে ওদের কাপড়চোপড় ময়লা করে দিয়ে, ওদের মুখ চোখ চেটে একাকার করল।

দিদিমা এসে বললেন, "স্নান না করিয়ে ছুস নে ছুস নে বলছি!" দাদু বললেন, "দেখেছ বেটার কান্ড। কেউ বেঁধে রেখেছিল নিশ্চয়।" এমন সময় ঝগড় এসে দাঁড়াল।

ভুলোকে ফেলে রুম ঝগড়র গলা জড়িয়ে ধরল। আর ভুলোও সেই সুযোগে দিল ঝগড়ুর পায়ের গুলিতে দাঁত বসিয়ে। পেজোমি একটুও

কমে নি।

অনেক পরে, রাতে, ভুলোকে ঘরে নিয়ে শুয়ে বোগি বলল-

"রুম্ !"

"কি দাদা?"

"ঝগড়র ঘরে কালো ছেলেটা নেই। বউ বলল, ওর বাবা মা ওকে

নিয়ে দুমকায় চলে গেছে।"

"সত্যি, দাদা, সত্যি ?"

"নেই তো দেখলাম।"

"ও-ই তবে ভুলো, না দাদা? সত্যিই তবে ও-ই ভুলো।"

"কি জানি, রুম, ঝগড় বঙ্গে সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে

কোথায় শুরু হয় বলা মুশকিল।"




23
Articles
লীলা মজুমদার রচনাবলী ১
0.0
লীলা মজুমদারের ছোট ছোট কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টি একত্রে আনা হয়েছে রচনাবলী ১ বইটির মধ্যে। এটি এমন একটি উপন্যাস যেখানে গল্পগুলি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে বইটি সব বয়সের মানুষই পড়তে পারেন, এবং এর মজা উপলব্ধি করতে পারেন।
1

পদিপিসীর বর্মিবাক্স

28 November 2023
0
0
0

পাঁচুমামার প্যাকাটির মতন হাত ধরে টেনে ওকে ট্রেনে তুললাম। শূন্যে খানিক হাত-পা ছুড়ে, ও বাবাগো মাগো বলে চেঁচিয়ে-টে চিয়ে শেষে পাঁচুমামা খচ্ করে বেঞ্চিতে উঠে বসল। তার পর পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে কপালের

2

বক-বধ পালা

28 November 2023
0
0
0

পালা শুরু জুড়ির সুর করে আবৃত্তি, মৃদু মুনু তবলা ইত্যাদি সহযোগে পোড়া জতুগৃহ থেকে বাহিরিয়া যবে, পাণ্ডব বঝিলা মনে এ বিশাল ভবে গৃহ বন্ধু কিছু নেই, নিলা বনবাস। দুঃখে কষ্টে বৃক্ষতলে কাটে দিনমাস। কত যে বিপদ

3

এই যা দেখা

29 November 2023
2
0
0

কলকাতা শহরের উত্তর দিকে সরু একটা সদর রাস্তা, তাতে লোকজন গাড়িঘোড়ার ভিড় কত, ভোর থেকে গভীর রাত অবধি হাঁকডাক ঠেলাঠেলি। লোকে বলে পথটা খুব পুরনো, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কালে তৈরি, ঘরবাড়িগুলো এ ওর গায়

4

ছেলেবেলার গল্প

30 November 2023
0
0
0

গণশার চিঠি ভাই সন্দেশ, অনেকদিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে সব ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকাঠক্ হয়ে কড়া পড়

5

হলদে পাখির পালক

1 December 2023
0
0
0

এক কত দেরি হয়ে গেল ভুলো তবু বাড়ি এল না, সন্ধে হয়ে গেল, রাত হয়ে গেল। দাদু তাস খেলতে যাবার আগে বললেন, "খুঁজতে যাবার কিছু দরকার নেই, কেউ তোদের নেড়িকুত্তো চুরি করবে না, খিদে পেলে সুড়সুড় করে নিজেই বাড়ি ফি

6

বহুরূপী

2 December 2023
0
0
0

ছোটবেলাকার কত কথাই যে মনে পড়ে, কত কান্ডই যে তখন হত। একবার গুপের মামাতো ভাই ভোঁদা বলেছিল যে বহুরূপীরা পর পর সাতদিন আসে, একেক দিন এক এক নতুন সাজে। কখনো কখনো সবাই তাকে বহুরূপী বলে চিনে ফেলে, আবার কখনো কখ

7

মহালয়ার উপহার

2 December 2023
0
0
0

শিবু, শিবুর মা আর শিবুর বউ তিন নম্বর হোগলাপট্টি লেনের দোতলার তিনখানি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত। একটা ঘরে শিবুর মা শুত, সেটা সব থেকে বড় ও ভালো, কারণ বুড়ি ভারি খিটখিটে। আরেকটাতে শিবু আর শিবুর বউ, শুত, সেটা মাঝ

8

ভানুমতীর খেল

3 December 2023
0
0
0

গোরুদের ঘরের পিছনের ছোট ফটকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। গোয়ালের কোনায় একটা মাটির ঢিবির উপর ঝোপের আড়ালে বসে-বসে একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছে আর একটু-একটু পা দোলাচ্ছে। সারা গায়ে ধুলো

9

পঞ্চমুখী শাঁখ

3 December 2023
0
0
0

বন্ধুদের দেশের বাড়িতে একটা প্রকাণ্ড পঞ্চমুখী শাঁখ আছে! শুনেছি শাঁখটা নাকি দেড়শো বছর ধরে ওদের বাড়িতে রয়েছে। ওর নানা- রকম গুণটুনও নাকি আছে। আগে রোজ ওর পুজো হত, পুরুতঠাকুর আসত, খাওয়া-দাওয়া হত। তবে সত্তর

10

হুঁশিয়ার

3 December 2023
0
0
0

যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা-খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা,

11

সেকালে

3 December 2023
0
0
0

পঁয়ষট্টি বছর আগে আমার মামাবাড়ির দেশে এক দিকে যেমন সাধু- সজ্জনের ভিড় ছিল এবং তার ফলে পুজোপার্বণ, তিথিপালন, হরির লুট, ব্রাহ্মণ-ভোজন, কাঙালী-বিদায় লেগেই থাকত, আবার তেমনি অন্য দিক দিয়ে ঠগ-ঠ্যাঙাড়ে, জোচ্চো

12

চোর

3 December 2023
0
0
0

ঠিক যেই নিতাইদের বাড়ির পেছনের সেই ঝাঁকড়ান্ডুলো ঝোপটার কাছে এসেছি, পকেট হাতড়ে দেখি যে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! সেই কোনা-মোড়া আধ-ময়লা নোটটা কে যেন বুক-পকেট থেকে তুলে নিয়েছে! ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ের চোটে ক

13

টাইগার

3 December 2023
0
0
0

তাকে উলটে দেখলাম থাবার তলাটা গোলাপী মখমলের মতো, মাঝে- মাঝে কচি-কচি সাদা লোম। পেটের তলাটাও গোলাপী-নরম তুলতুলে এক জায়গায় একটা শিরা না কি যেন ধুন্ধুক্ করছে। মুণ্ডুটাকে তুলে আবার নিজের পেট দেখতে চেষ্টা কর

14

লোমহর্ষণ

3 December 2023
0
0
0

রাজামশাই ব্যস্ত হয়ে দরদালানে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন, খিদেয় পেটের এ-দেয়াল ও-দেয়াল একসঙ্গে লেপটে যাচ্ছে, টেবিল পাতা, সোনার বাসন-কোসন সাজানো, মুক্তো-বসানো গেলাসে কেয়ার গন্ধ-দেওয়া জল, রানী ওদিকে মখমলের গদি

15

ভালোবাসা

3 December 2023
0
0
0

আজকাল সবই অন্যরকম লাগে। দরজার কড়া নাড়বামাত্র ভিতর থেকে একটা ভারী জিনিস দরজার উপর আর আছড়েও পড়ে না। নখ দিয়ে কেউ দরজায় আঁচড়িয়ে, পালিশ উঠিয়ে, বকুনিও খায় না; ঘরে ঢুকবামাত্র নেচেকঁদে গায়ের উপর চড়ে একাকারও ক

16

তেজী বুড়ো

3 December 2023
0
0
0

আয়না দেখে আঁতকে উঠলুম। এ তো আমার সেই চিরকেলে চেহারা নয়! সেই যাকে ছোটবেলা দেখেছিলুম ন্যাড়া মাথা, নাকে সদি, চোখ ফুলো! তার পর দেখেছিলুম চুল খোঁচা, নাক খাঁদা, গালে-টালে কাজল! এই সেদিনও দেখলুম খাকি পেন্টেল

17

দিনের শেষে

5 December 2023
0
0
0

লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তাদ এসেছে। দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়িতে গান শুনতে গেছেন, ফিরতে রাত হবে। ঝগড় বলল, "তা তোমরা যদি সব-কিছুই বিশ্বাস না করে আনন্দ পাও, তা হলে আমার আর কিছু বলবার নেই। তবে সর্বদা মনে

18

আমাদের দেশে

5 December 2023
0
0
0

আমাদের দেশের কথা আর কী বলব, সে কি আর এখন আমাদের আছে? একেবারে পাকিস্তানের পূর্বকোণে ঠুসে দিয়েছে। কিন্তু সেখানকার লাল-লাল গোল-আলু আর সেখানকার পাকা সোনালী আনারস আর আঠাল দুধের ক্ষীর যে একবার খেয়েছে সে সার

19

পালোয়ান

5 December 2023
0
0
0

নিউ মার্কেটের পিছনে বাঁদরের দোকান আছে। ছোট-ছোট খাঁচায় পোরা বাঁদরের ভিড়, এ-ওর গায়ে চিকে রয়েছে। তা ছাড়া সাদা ইঁদুর, বেজি, কাকাতুয়া, কালোমুখো ল্যাজ-প্যাঁচানো শ্যামদেশের বেড়াল, ভালুক বাচ্চা, আরো কত কি যে

20

গুণ-করা

5 December 2023
0
0
0

বুঝলে, আমার মামাবাড়িতে ফান্ড বলে একটা চাকর ছিল। বাঙালি নয়। ঐ গারো পাহাড়ে অঞ্চলে ওর বাড়ি। আশা করি গারো পাহাড় কোথায় সে কথা আর তোমাদের বলে দিতে হবে না। ফান্ড যে বাঙালি নয় সে ওকে দেখলেই বোঝা যেত। বেঁটে, ম

21

কি বুদ্ধি

5 December 2023
0
0
0

জন্তু জানোয়ারদের বিষয়ে কতরকম অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায় তার আরু ঠিক নেই। একবার নাকি একটি ব্যাঙ কেমন করে পাথরের ফোকরের মধ্যে বদ্ধ হয়ে গিয়ে, ঐভাবে কতকাল যে ছিল তার ঠিক নেই। বোধ হয় অনেক শো বছর। তার পর যেই

22

বনের ধারে

5 December 2023
0
0
0

ছোটবেলায় পাহাড়ে দেশে থাকতাম। চার দিকে ছিল সরলগাছের বন। তাদের ছুচের মতো লম্বা পাতা, সারা গায়ে ধুনোর গন্ধ, একটুখানি বাতাস বইলেই শোঁ শোঁ একটা শব্দ উঠত। শুকনো সময় গাছের ডালে ডালে ঘষা লেগে অমনি আগুন লেগে য

23

মেজোমামার প্রতিশোধ

5 December 2023
0
0
0

আমার মেজোমামাকে নিশ্চয় তোমরা কেউ দ্যাখ নি। হাড় জিজিরে রোগা বেঁটে মতন, সরু লিক্লিকে হাত-পা, সারা মুখময় খোঁচা-খোঁচা দাড়ি গোঁফ। কারণ মেজোমামা দু সপ্তাহে একবার দাড়ি চাঁচেন, নাকি দাড়ি কামালেই মুখময় আঁচড়ে য

---