আমার মেজোমামাকে নিশ্চয় তোমরা কেউ দ্যাখ নি। হাড় জিজিরে রোগা বেঁটে মতন, সরু লিক্লিকে হাত-পা, সারা মুখময় খোঁচা-খোঁচা দাড়ি গোঁফ। কারণ মেজোমামা দু সপ্তাহে একবার দাড়ি চাঁচেন, নাকি দাড়ি কামালেই মুখময় আঁচড়ে যায়। খাটো করে ধুতি পরা, আর প্রাণ ভরে নানারকমের ভয়-চোরের ভয়, পুলিশের ভয়, বাঘের ভয়, গাড়ি চাপা পড়ার ভয়, রোগের ভয়, ডাক্তারের ভয়, ভুতের ভয়, আর সব চেয়ে বেশি ভয় নিজের শ্বশুরকে।
মেজোমামার শালার বিয়ে হবে। শ্বশুর লিখে পাঠালেন মেজোমামাকে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে শ্বশুরের ঠাকুরমার আমলের লাখ টাকার গয়না বের করে নিয়ে নৈহাটী পৌছে দিয়ে আসতে হবে। খুব সাবধানে যাওয়া আসা করতে হবে কারণ ও জিনিস একবার গেলে আর হবে না। আর দুষ্টলোকে খবর পেলে ওর জন্য মারপিট খুন-জখম করতে পিছ পাও হবে না। শুনে তো মেজোমামার জিবতালু জড়িয়ে গেল, অথচ না গেলেও নয়, স্বশুর তা হলে আর আস্ত রাখবেন না।
বন্ধুদাদার গাড়িটা চেয়ে নিয়ে একেবারে স্টেশন যাবার পথে গয়নার বাক্স বের করে নিয়ে একটা আধময়লা বাজারের থলিতে পুরে, তার উপর কতকগুলো মুলোটুলো দিয়ে যত্ন করে ঢাকা চাপা দিয়ে তো স্টেশনে নামা গেল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চির একটি কোনা দখল করতেও বেশি সময় লাগল না। এতক্ষণে মেজোমামা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। থলিটাকে বেঞ্চির কোনে গুঁজে তার উপর একরকম চেপে বসে ওফ্ করে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ধুতির খুঁটটা দিয়ে কপালের গলার ঘামটাম মুছে নিলেন। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পাশে বসে পড়ল। উঃ, যেন সাক্ষাৎ বকরাক্ষস, ইয়া হাতি, ইয়া ভুড়ি আর ইয়া বড়-বড় পান-খাওয়া বল্লিশপাটি দাঁত। তাকে দেখেই মেজোমামার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কি অসৎ চেহারা লোকটার সে আর কি বলব। কানের লতি টানা, নাকের ফুটো বড়, চোখ ছোট, জোড়া ভুরু, আঙুলের গিটে গিটে লোম।
মেজোমামা জড়সড় হয়ে বসলেন, ট্রেনটা লাগলে বাঁচা যায়। এমন সময় লোকটা ঝুঁকে পড়ে কানে কানে বলল, "দামোদরের দলের লোক না? মুখটা যেন চেনাচেনা লাগছে।" মেজোমামা কথা বলবেন কি জিব শুকিয়ে সুকতলা। লোকটা একটু কান্ঠ হেসে আবার বলল-"ঘাবড়াচ্ছ কেন? জানো না কুকুরে কুকুরের মাংস খায় না।" মেজোমামা অনেক কষ্টে ঢোক গিলে হঠাৎ সাহস করে উঠতে যাবেন, অমনি লোকটা কনুই ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল, "আহা শোনোই-না। কথা আছে।" মেজোমামা আবার বসে পড়লেন। পেটটা ব্যথা-ব্যথা করতে লাগল। লোকটা বলল-"মাথা না ঘুরিয়ে আড় চোখে চেয়ে দ্যাখ আমাদের বাঁয়ে যে খাকি হাফপ্যান্ট-পরা লোকটা হলদে সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঐ হল ব্যাঙ্কের বড় জমাদার, নৈহাটী যাচ্ছে। নকুলেশ্বরবাবুর ছেলের বিয়েয়, গয়না আছে।" এই অবধি বলে সুড়ৎ করে লোকটা জিবের জল টেনে নিয়ে আরো বলল-"হ্যাঁ, আর বলতে হবে না, অমন ভালোমানুষও সাজতে হবে না। তুমিও আলুমুলো ব্যাগে করে ডেলি প্যাসেঞ্জার সেজে কেন বসে আছ সে আমি বেশ জানি। দ্যাখ, মুখের ভাবখানা বদলাবে কোথেকে, ওতে যে ছাপ মারা রয়েছে।" মেজোমামা একেবারে থ। লোকটা বলে কি?
ঠিক সেই সময়ে গাড়ি ইন করল আর সক্কলে ধড় মড় করে উঠে পড়ল। তারই মধ্যে লোকটা মেজোমামার কানে কানে দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গলায় বলল-"দ্যাখ দামোদরের চ্যালা, আজ আর কোনো চালাকি করতে এসো না, তা হলে পিটে তোমাকে আলুভাতে বানিয়ে দেব, এই দ্যাখ।" বলে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক ঘুষি পাকিয়ে মামার নাকের কাছে নেড়ে দিল। “খবরদার আমাদের পাছু নেবে না। আমি ঐ লোকটার সঙ্গে এক গাড়িতে যাব, নৈহাটী স্টেশনের আগে একটা পোস্টের ধারে বীরেশ্বর, জানোই তো বীরেশ্বরকে, দাঁড়িয়ে আছে। যেই তার কাছে ট্রেন পৌঁছবে হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে লোকটার ঘাড়ে পড়ে, বাঁ হাতে জানালা দিয়ে ব্যাগ মাটিতে ফেলতে নটবর শর্মার বেশি সময় লাগবে না। তুমি বরং ঐ গাড়িতে ওঠো।" বলে মেজোমামাকে একরকম কোলপাঁজা করে ধরে সামনের একটা থার্ড ক্লাসে তুলে দিয়ে, নিজে সেই লোকটার সঙ্গে পাশের গাড়িতে চেপে বসল। মেজোমামা এতক্ষণ টু শব্দটি করে নি। সারা গা দিয়ে দরূদর্ করে তাঁর ঠান্ডা ঘাম ঝরছে। আর পা কাঁপুনি থামতে থামতে নৈহাটী এসে গেল। নৈহাটী পৌছে সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটটা মাটিতে ফেলে দিয়ে সুড়সুড় করে নেমে পড়ে ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে গেটের উলটো দিকে ছুটলেন। গাড়িতে খুব একটা সোরগোল হচ্ছে টের পেলেন।
লাইন পার হয়ে বাজারের থলি হাতে মেজোমামা পা চালিয়ে এগুতে লাগলেন। বেশ খানিকটা পথ, অন্ধকার হয়ে আসছে, এমনি সময় একবার ঘাড় ফিরিয়ে দ্যাখেন একজন মোটা লোক হনহন করে পিছন পিছন আসছে। মেজোমামার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। সেই লোকটাই বটে। কোথাও জনমানুষ নেই, থলে নিয়ে মেজোমামা বাতাসের বেগে ছুটে চললেন। কিন্তু ল্যাব্যাগে হাত-পা নিয়ে কত আর ছুটবেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকটা অনেক এগিয়ে এল। ভয়ে", তো মেজোমামার চক্ষু চড়কগাছ। এখন কি করা যায়? লোকটাকে। পিটলে কেমন হয়? সেও এক মুশকিল। যা জল্লাদের মতো বপুখানি আর উরে বাগ্ রে, কী খুনে প্যাটার্নের চেহারা। ছোটবেলা থেকে মেজোমামার ঠাকুরমা ওঁকে দিনরাত বলে এসেছেন, ন্যাল্লা, শুঁয়োপোকা মাড়াচ্ছিস, দাঁড়া, তোকে আর-জন্মে গুঁয়োপোকা হতে হবে। এ্যাঁ, মাকড়সা ঠ্যাঙাচ্ছিস নাকি? জানিস তুই আর-জন্মে মাকড়সা হবি? ও কিরে, হাতে ঢিল কেনরে? ঢিল ছুড়লে চিল খেয়ে মরতে হয় তা জানিস? কাজে কাজেই কাউকে আর ঠ্যাঙানোই হত না। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? হ্যাঁ, স্টেশনের সেই লোকটাই তো বটে। নিশ্চয় সুটকেস খুলে তার মধ্যে জামা ইজের দেখে রেগে ফোঁস্ ফোঁস্ করতে করতে ছুটে আসছে। ছোটবেলা থেকে কত লোক যে মিছিমিছি পা মাড়িয়ে দিয়েছে, কান মলেছে, ভেংচি কেটেছে, চুল ছিড়েছে, কালি দিয়ে পিঠে গাধা লিখেছে, বিয়ের সময় শ্যালীরা নুন দিয়ে জল আর ন্যাকড়া দিয়ে সন্দেশ খাইয়েছে, অফিসে অন্য বাবুরা এপ্রিল ফুল বানিয়েছে, তার উপর আজ এই। হঠাৎ মেজোমামার মাথায় খুন চেপে গেল। থলেটাকে রাস্তার ধারে নামিয়ে রেখে এক পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। যেই-না সেই লোকটা কাছে এসেছে ঝড়ের মতো ছুটে গিয়ে দিলেন তার নাঃক প্যাচ্ করে এক ঘুষি, তার পর মুখের উপর ধাঁই করে আরেকটা। লোকটা এমনি অবাক হয়ে গেল যে, কিছু করতে পারল না। মেজোমামা তাকে বেদম পিটলেন। উঃ, সে কী পিটুনি, চড়, লাথি, ঘুষি, কানমলা, চুলছেঁড়া, বিকট বিকট ভেংচি কাটা, নেহাত অন্ধকার ছিল বলে সে দেখতে পেল না, নইলে বাছাধনের পিলে চমকে যেত। তার পর সে যখন হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল মেজোমামা থলে তুলে নিয়ে হাওয়া।
শ্বশুরবাড়ি পৌছলেন অনেক রাতে, ঘুরে ফিরে নার্ভাসনেসের চোটে ভুল রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। বাড়ির লোকেরা তো ব্যস্তই হয়ে উঠেছিল। শ্বশুরমশাই ছুটে এসে গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে বললেন, "যাক বাবাজি, নিরাপদে যে এসেছ এই আমাদের ভাগ্যি। চারি দিকে 'মা সব কান্ড হচ্ছে। এইমাত্র বটু খবর দিল বিকেলের ট্রেনে চুরি-ডাকাতি হয়েছে, আবার নলডাঙার মোড়ে হেডমাস্টারমশাইকে তিন-চারটে গুণ্ডা 'বেদয় ঠেঙিয়েছে-বেচারি ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ওকি, ওরকম মুখে হাত দিয়ে খুন্ধুক্ করছ যে? কাশি হয়েছে বুঝি? ওরে মেধো, জামাইবাবুর স্নানের জন্য শিল্পির গরম জল দে, খাবার-টাবার তো রেডিই আছে।"
মেজোমামা এতক্ষণে শ্বশুরমশাইকে ঢিপ্ করে একটা প্রণাম ঠুকে 'বঙ্গলেন, "আমাকে কিন্তু কাল সকালের গাড়িতেই ফিরে যেতে হবে।"