বন্ধুদের দেশের বাড়িতে একটা প্রকাণ্ড পঞ্চমুখী শাঁখ আছে! শুনেছি শাঁখটা নাকি দেড়শো বছর ধরে ওদের বাড়িতে রয়েছে। ওর নানা- রকম গুণটুনও নাকি আছে। আগে রোজ ওর পুজো হত, পুরুতঠাকুর আসত, খাওয়া-দাওয়া হত। তবে সত্তর বছর হল পুজোটুজো সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ওটা বসবার ঘরের তাকের উপর সাজানোই থাকে। দুপাশে দুটো কাচের ফুলদানিতে কাগজের ফুল থাকে, আর মাঝখানে শাঁখটা পাঁচটা শিং তুলে চক্চক্ করে। রঙটা ফিকে কমলালেবুর মতো, দারুণ ভারী, আর সারা গায়ে কেমন একটু ধুপধুনোর গন্ধ।
গত বছর পুজোর সময় কয়েকদিনের জন্য ওদের বাড়িতে গিয়ে- ছিলাম। শাঁখটা দেখে আমি তো অবাক। শাঁখ যে আবার এত প্রকান্ড হয় তা আমার জানা ছিল না। ঘরে কেউ ছিল না, আস্তে আস্তে গিয়ে ওর গায়ে একটু হাত বুলোলাম, কি সুন্দর পিছলা-পিছলা মনে হল। এমন সময় পিছন থেকে বটুর ছোদাদু বললেন, "একটু ধরতে ইচ্ছে হয় তো ধর্। কিন্তু খবরদার যেন আবার বাজিয়ে বসিস না, হাঁ, তা হলেই সাংঘাতিক কান্ড হবে। ওটাকে শেষ বাজিয়েছিলেন আমার ছোট্ঠাকুরদা! তার পর থেকে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, ঠিক ঐখানটিতে তাঁর লাল মখমলের চাপকান, চুড়িদার ইজের আর নাগরা জুতোজোড়া পড়ে ছিল। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে থেকে ছোট্ঠাকুরদা একেবারে বেমালুম নিখোঁজ। সেই থেকে আর ও শাঁখ বাজানো হয় না।"
আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। ছোদাদু বললেন, "না বাজানো অবধি কোনো ভয় নেই। ঐ শাঁখটা কি এ বাড়ির জন্য কম করেছে। এ গুষ্টির যা-কিছু একরকম সবই বলতে গেলে ঐ শাঁখেরই দয়ায়। তার পর কেন যে বিগড়ে গিয়ে ও সর্বনাশটি করল কে জানে। দেখিস আবার ফেলে-টেলে দিস নে যেন। আঙুলও ছেঁচে যাবে, আবার কি হতে গিয়ে শেষটা কি হয়ে যাবে।” এই বলে ছোদাদু ঘরের কোনা থেকে লাঠিগাছি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
পরে বটুর কাছে আরো শুনলাম। সত্যি অদ্ভুত ব্যাপার। দেড়শো বছর আগে ওদের কে একজন পূর্বপুরুষ মেলা ধারধোর করে শেষটা পাওনাদারদের তাগাদার চোটে সন্ন্যাসী হয়ে সটান রামেশ্বর। সেখানে গিয়ে ঐ অত বড় মন্দির, যার বারান্দাটাই শোনা যায় চার হাজার ফুট লম্বা আর তার মধ্যে থাকে থাকে তেত্রিশ কোটি দেবতার মূতি সাজানো, এই-সব দেখে তাঁর মনের একটা ভারি পরিবর্তন হল। গেলেন সমুদ্রের ধারে, স্নান সেরে একবার পুজো দেবেন।
সে কি বিশ্রী সমুদ্রের ধার সে আর কি বলব। একেবারে জলের কাছাকাছি পর্যন্ত এবড়ো-খেবড়ো গাছগাছালি, জলে মোটে ঢেউ নেই, তীর ঘেঁষে শ্যাওলা পড়েছে, আর সে যে কি বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ। কিন্তু মনের বদল হয়েছে, এখন তো আর ও-সব ভাবলে চলে না। বটুর পূর্বপুরুষ একটা গামছা পরে, তার মধ্যেই ঝুঝাপ্ করে নেমে পড়লেন। ওমা, পায়ের আঙুলে আবার কুকুট্ করে কামড়ায় কিসে? পূর্বপুরুষ সেখান থেকে খানিকটা সরে গিয়ে স্নানের চেষ্টা দেখতে লাগলেন। কিন্তু কি জ্বালা! আবার আঙুলে কিসে কুকুট্ করে কামড়ায়! কি আপদ! এরকম করলে তো মন বদলানো মুশকিল! পূর্বপুরুষ বিরক্ত হয়ে জল থেকে উঠে পড়লেন!
বালিটুকু পার হবেন, এমন সময় পিছনে একটা সর্সর শব্দ শুনে 'তাকিয়ে দেখেন এ কি কান্ড! একটা বিরাট পাঁচমুখী শাঁখ কুকুর- বাচ্চার মতো পিছন পিছন আসছে। এখন কি করা যায়! শাঁখটাকে তাড়া দিলেও যায় না। পূর্বপুরুষের শুকনো ধুতির খুঁটে বাঁধা একটু মুড়ি-নারকেল ছিল তাই খানিকটা ছুড়ে দিলেন, অমনি গুড়গুড় করে এগিয়ে এসে শাঁখটা সেটার উপর চেপে বসল।
তার পর তার সাহস আস্তে আস্তে আরো বেড়ে গেল, একেবারে • নাকি কোলে চড়ে বসল! পূর্বপুরুষ তো ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন, কি জানি আবার কামড়াবে-টামড়াবে না তো? ওজনটিও নেহাত কম নয়! যেই-না ও কথা ভাবা, পূর্বপুরুষ একেবারে উঠে দাঁড়ালেন। অমনি শাঁখটাও কোল থেকে গড়িয়ে বালির উপর চিৎ হয়ে পড়ল। পূর্বপুরুষ অবাক হয়ে দেখলেন, ওটার ভিতর পোকা-টোকা কিছু নেই, একদম ফাঁকা, এমন-কি, মাথায় একটা ফুটো অবধি রয়েছে। তুলে নিয়ে কানের কাছে ধরলেন, অমনি মাঝ-সমুদ্রের অগাধ জলের শোঁ শোঁ শব্দ কানে এল, পূর্বপুরুষের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। শাঁখটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। একবার একটু ফুঁ দিয়ে বাজাতেই আকাশ বাতাস জুড়ে গম্পম্ শব্দ উঠল।
মনে ভাবলেন, যদি কিছু টাকা পেতাম শাঁখটা নিয়ে দেশে ফিরে যেতাম। ধারকর্জ শোধ করে দিয়ে, শাঁখটাকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। যেমনি ভাবা, অমনি ঠুক্ করে পায়ের কাছে কি একটা পড়ল! তুলে দ্যাখেন ময়লা একটা ন্যাকড়ার থলি-ভরা' রুপোর টাকা। পূর্বপুরুষ আর সময় নষ্ট না করে, বুকে শাঁখটাকে জাপটে ধরে, হাতে টাকার থলি নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। তার পর ধার-ধোর শোধ করে দিয়ে, এই বাড়িটা তৈরি করলেন। শাঁখের জন্য আলাদা একটা ঘর হল, ভারি ধুমধাম করে রোজ তার পুজো হত। আর তার দৌলতে ওদের আর কোনোরকম দুঃখকষ্ট রইল না, কারণ রোজ রাত্রে পুজোর পর একবারটি বাজিয়ে ওর কাছে যা চাওয়া যেত তাই পাওয়া যেত।
বটু এতদূর বলে একবার আমার দিকে তাকাল, তার পর আরো বলল, "দিনের মধ্যে কিন্তু ঐ একবারই ওর কাছে চাওয়া হত, আর যা চাওয়া যেত ঠিক তাই পাওয়া যেত। কিন্তু খুব সাবধানে চাইতে হত, কারণ ঠিক যেমনটি বলা হত, তেমনটি ফলে যেত। কথার। একটু নড়চড় হত না। তার জন্য মাঝে মাঝে খুব অসুবিধাও হত। বুড়ি ঠাকুমা শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম করে সবেমাত্র উঠেছেন, নাতি- নাতনিরা এমনি জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে যে ওঁর পানের ডিবের সব পান কটি খেয়ে ফেলে, ওঁর হাড় একেবারে ভাজা-ভাজা করে তুলেছে। বিরক্ত হয়ে যেই বলেছেন, 'চুলোয় যাক্ গে!' আর যাবে কোথা। ঝুঝুপ্ সব রান্নাঘরের উনুনে গিয়ে পড়েছে, উনুন-টুনুন নিবে একাকার, এখানে ছ্যাঁকা, ওখানে ছ্যাঁকা! তবে মাঝে মাঝে আবার সুবিধাও হয়ে যেত। বেয়াইবাড়ির লোকরা মহা বাড়াবাড়ি লাগিয়েছিল। কিছুতেই মেয়ে পাঠাবে না। বুড়ো ঠাকুরদা সবে পুজো সেরে শাঁখকে বাজিয়ে প্রণাম করে উঠেছেন, এমন সময় যারা মেয়েকে আনতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে খবর দিল। বুড়োও রেগে বললেন, 'বেয়াই-বেয়ান ফিরিয়ে দিল বুঝি? যাক্ গে, মরুক গে।' বাস্! আর যাবে কোথা। তৎক্ষণাৎ বেয়াই-বেয়ান চোখ তুলে একেবারে অক্কা।"
আমি বটুকে বললাম, "তবে তুই শাঁখকে বলে একটু অঙ্কের নম্বর-
টম্বর বাড়িয়ে নিস-না কেন?"
বটু বলল, "সে হবার জো নেই। সত্তর বছর থেকে আর ওর কাছে কিছু চাওয়া বারণ।" আমি শাঁখটার আরেকটু কাছে এগিয়ে বললাম, "কেন, চাইলে কি হয়?"
"আরে, কি হয় মানে? ঠাকুরদার ঠাকুরদা যে একেবারে কপুরের মতো উড়ে গেলেন, সেটা বুঝি কিছু নয়?"
যদিও ওর ঠাকুরদার ঠাকুরদা উড়ে গেছেন বলে আমার কিছুও হয় না, তবু ওদের বাড়িতে আছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, তাই আরো কিছু না বলাই ভালো মনে হল।
কিন্তু অমন সুন্দর একটা শাঁখ, এতকাল ঘরে রয়েছে, কাউকে কিছু বলে-টলেও না, তাকেই-বা অত ভয় কিসের ভেবে পেলাম না। একটু হাত দিয়ে সরালাম, কিছু হল না। দু হাতে তুলে নিয়ে একটু শুঁকলাম, বেশ গন্ধ। কানের কাছে উঠিয়ে শুনলাম, অগাধ সমুদ্রের জল শোঁ শোঁ করছে। কেমন যেন গায়ের লোমগুলো সর্সর করে সব খাড়া হয়ে উঠল। শাঁখটাকে আবার নামিয়ে রাখলাম। বটু একটু কাষ্ঠ হেসে বলল, "দেখিস, বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললে কিন্তু শেষে কষ্ট পেতে হবে।"
বটুদের পাড়া ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে, বটতলার মাঠে পুজোর সময় র্যাত্রা হয়। কিন্তু বন্ধুদের বাড়ির লোকেরা এমনি যে কিছুতেই ছেলেদের গাঁয়ের লোকদের সঙ্গে যাত্রা দেখতে দেবে না। বলে নাকি আমার বাবা শুনলে রাগ করবেন। বাবা এদিকে নিজে-যাক্ গে সে কথা। বটু বলল, "অত সহজে ঘাবড়ালে চলবে কেন! দ্যাখই-না।" তার পর খাওয়া-দাওয়া সারা হলে, ঘরে গিয়ে খানিক ঘাপটি মেরে থাকলাম। তার পর উঠে পাশবালিশ আর মাথার বালিশ দিয়ে দুই বিছানায় দুই মানুষ বানিয়ে তাদের গায়ে-মাথায় চাদর ঢাকা দিয়ে, মশারি গুঁজে, আলো নিবিয়ে, পা টিপে টিপে সিড়ি দিয়ে নেমে এলাম।۰
আমার বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করছিল, হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। বটু বলল, "এ তো আমরা বহুবার করেছি। চল রান্নাঘরের জানলা দিয়ে।"
দূরে যাত্রার ডুগডুগি শোনা যাচ্ছে। আমরা বসবার ঘর পেরিয়ে যাবার সময়, তাকের উপর চোখ পড়ল, অন্ধকারেও শাঁখটা কিরকম জ্বলজ্বল করছে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, পা চালিয়ে এগোলাম। বাইরে তারার আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। রান্নাঘরে জানলা বাইরে থেকে ঠেসে দিয়ে, মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড় দৌড়, একেবারে বটতলার মাঠের যাত্রায়।
উঃ, কি ভালোই যে লাগল! কুম্ভকর্ণ যে কি মজাটাই, করল! কখন যে রাত কেটে গেল টেরই পেলাম না। ভোরের আগে যাত্রা ভাঙল, বটু আর আমি ঢুলু ঢুলু চোখে বাড়িমুখে রওনা দিলাম।
এই পর্যন্ত কোনো গোলমাল হয় নি। কিন্তু রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ঢুকেই বটু একটা বালতি না কিসে যেন ধাক্কা খেয়ে, একগোছা থালা ঝঝন্ করে ফেলল। তার এমনি আওয়াজ যে, মরা মানুষরাও উঠে বসে।
কোনোরকমে সেখান থেকে ছুটে বসবার ঘর অবধি এসেছি, আর ততক্ষণে চার দিকে হৈ-চৈ। ছোদাদু লাঠি নিয়ে, টর্চ নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। ধরলে আর আস্ত রাখবেন না। একবার টর্চটা আমাদের মুখে পড়লেই আমার ছুটিতে মজা-মারা সারা! অন্ধকারে শাঁখটা তখনো জ্বলজ্বল করছে। এক দৌড়ে সেটাকে বুকে নিয়ে আস্তে একটু ফু দিলাম। অমনি সারা বাড়িময় গম্ গম্ করে উঠল। মনে মনে বললাম, এইবার দেখি তোমার ক্ষমতা। ওমা! ও কথা ভাবামাত্র শাঁখটা আপনি আপনি আমার হাত থেকে সুড়ৎ করে ছুটে গিয়ে একেবারে ছোদাদুর পায়ের উপর! আর কি! ওরে বাবা রে, বোমা ফেলল নাকি রে, মরে গেলাম রে, জল আন রে। দেখতে দেখতে চারি দিকে লোকজন গিজ গিজ করতে লাগল। সেই সুযোগে বটু আর আমি খাবার ঘর থেকে লম্বা!