নিউ মার্কেটের পিছনে বাঁদরের দোকান আছে। ছোট-ছোট খাঁচায় পোরা বাঁদরের ভিড়, এ-ওর গায়ে চিকে রয়েছে। তা ছাড়া সাদা ইঁদুর, বেজি, কাকাতুয়া, কালোমুখো ল্যাজ-প্যাঁচানো শ্যামদেশের বেড়াল, ভালুক বাচ্চা, আরো কত কি যে পাওয়া যায়! চার দিকে একটা সোঁদা-সোঁদা চীনাবাদাম-পাকা-কলা-বাঘ-বাঘ-গন্ধ ।
সেখানে প্রায়ই যেতাম। হাঁ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম। কিনবার তো আর উপায় ছিল না। টিপিনের পয়সা জমিয়ে গোটা-দুই সাদা ইঁদুর যে কিনতে পারতাম না তা নয়। তবে পিসিমা, বড় জ্যেঠিমা, মা, এরা সব তা হলে কি কান্ডটাই যে করবেন সে আমার বেশ জানা ছিল। শেষটা বাবা বাধ্য হয়েই বলবেন-"জগা! যেখান থেকে এনেছিলি সেইখানে দিয়ে আয়।” এই ভয়েই কিছু করতে পারছিলাম না।
ঐখানেই একদিন পালোয়ানটার সঙ্গে দ্যাখা হল। ইয়া বুকের ছাতি। দেখতে যেন একটা বিরাট পিপে। কোথায় যে ঘাড় শেষ হয়েছে, কোথায় যে বুক, কোথায় যে ভুঁড়ি শুরু হয়েছে, কিছুই বাবা বোঝা যায় না। আমাকে দেখে গুম্ গুম্ করে নিজের বুকে কীল মেরে বলল, "কি রে মুরগি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁদর-বাচ্চা দেখছিস? এই আমার মতো আধসের করে দাঁত দিয়ে খোলা ভেঙে বাদাম খাবি, আর পাঁচশো বার ডন-বৈঠক করবি।” এই বলে সে সেখানেই দু-চার বার ওঠ-বোস করে দেখিয়ে দিলে। বাঁদরগুলো তো তার কান্ড দেখে এ-ওর পিঠে মুখ লুকিয়ে হেসেই একাকার!
লোকটি আমার কাছে এসে দুই আঙুল দিয়ে আমার বাইসেপ টিপে হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, "কি খাও হে? গোলাপ জল দিয়ে মাখন তোলা দুধ বুঝি? ছি, ছি, লজ্জা করে না? ঐরকম শরীর দিয়ে দেশ রক্ষা করবি কি করে? জানিস ভীমভবানী দিন্তে-দিন্তে মোটা-মোটা লাল 'আটার রুটি, গাওয়া ঘি আর অড়র ডাল দিয়ে খেয়ে দুটো দু-মণি মুগুর নিয়ে দু-ঘণ্টা ভাঁজতেন।"
ততক্ষণে বেশ একটা ছোটখাটো ভিড় দাঁড়িয়ে গেছে। "আমি কে, 'তা জানিস? আমি ঐ ভীমভবানীর নাতি। জানিস আমার দাদামশাই 'স্যান্ডোর শিষ্য ছিলেন। তাঁর পায়ের গুলিতে মোটা-মোটা লোহার ডান্ডা । মেরে বেঁকিয়ে বিনুনি বানিয়ে ফেলা হত।"
আবার বুক চাপড়ে লোকটা বলল, "আর সেই আমি কিনা তোদের মতো গঙ্গা-ফড়িংদের সঙ্গে সময় নষ্ট করি।" বলে লোকটা চলে গেল। তার পর আরো অনেকবার দ্যাখা হয়েছে। সর্বদা একই ড্রেস। 'খাকি হাতকাটা মিলিটারি শার্ট, খাকি হাফ প্যান্ট, পায়ে ব্রাউন ক্যাম্বিসের জুতো। ছোট্ট-ছোট্ট করে চুল ছাঁটা, খোঁচা-খোঁচা দাঁতের বুরুসের মতো গোঁফ।
কত কি যে বলত তার ঠিক নেই।
"আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁদর দেখছিস? জানিস, আমার বাবা 'বিখ্যাত বাঘ-শিকারী ছিলেন। এমনি তাঁর সাহস ছিল যে, মাচা-ফাচা বাঁধতেন না, কত সময় বন্দুক নিয়ে যেতে পর্যন্ত ভুলে যেতেন। এমনি করে বাঘের ল্যাজ ধরে বাঁই বাঁই করে বার-কুড়িক চার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন ছেড়ে। পঞ্চাশ গজ দূরে ব্যাঘ্রমশাই পড়ে একেবারে ইহলীলা সংবরণ।"
মাঝে-মাঝে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে, চোখ-টোখ পাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করত-
"কি? বিশ্বাস হল না বুঝি? তবে চল্ ব্যাটা আমার পিসেমশাইয়ের কুস্তির আখড়ায় নিয়ে যাই, আমার দু-চার প্যাঁচ শিরমোড়া দাড়িমোড়া না খেলে দেখছি তোদের বিশ্বাস হবে না। কেমন, যাবি কি না?" বলে খপ্ করে কুলোর মতো দুই হাত দিয়ে আমার ঘাড় ধরে টান! ব্যস্ত হয়ে বলি-"আরে না, না। আপনি যা যা বলেন আমি ভীষণ বিশ্বাস করি।" তক্ষুনি খুশি হয়ে গিয়ে আরো বলতে থাকে-
"দেশে আমাদের বাড়ির বাগানে বুনো হাতি ছাড়া থাকে, লোকের বাড়িতে যেমন হরিণ-টরিণ থাকে। সকালে-বিকেলে যখন-তখন আমার ভাইরা এক হাত দিয়ে বুনো হাতির এক হাঁটু ধরে ঠেলতে ঠেলতে তাদের মাটিতে বসিয়ে দেয়।" মাথা নিচু করে একটু লজ্জার সঙ্গে হাসে আর বলে-"বুঝলি, ভগবানের ইচ্ছেয় পয়সাকড়ির আমাদের অভাব নেই। ঠাকুরদার ঠাকুরদার সময় থেকে সোনা-রুপোর পাহাড় জমছে তো জমছেই। এখন আর ওজন-টোজনও করা হয় না, গুদোম ঘরে অমনি পড়ে পড়ে থাকে আর ধুলো জমে। আমাদের বাড়ির মেয়েদের পর্যন্ত কি ভয়ংকর গায়ের জোর! একবার আমার মা আর ঠাকুমা খুন্তির বাড়ি দিয়ে একদল ডাকাতকে স্রেফ ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার সাহেব বড়লাট সেইজন্য তাঁদের হিন্দী ভাষায় চিঠি লিখে ছিলেন। তাঁরা অবিশ্যি মানে বুঝতে না পেরে সে চিঠি ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।"
এই অবধি বলে আমার দিকে ফিরে বললে, "হাসছিস যে? বলি, 'লেখাপড়া শিখে তোর কি সুবিধেটাই হচ্ছে বল-না? দেখতে তো ঐ ভিজেবেড়ালটি, সাত-চড়েও তো মুখে রা নেই, করবি তো কেরানীগিরি কি পোস্টমাস্টারি। আর আমাকে দ্যাখ্ মুক্তাক্ষর পড়তে পারি না, ইচ্ছে করে শিখি নি, আর আমাদের গুদোম ঘরে যে ঢুকবে তাকে মণি- মুক্তো মাড়িয়ে মাড়িয়ে ঢুকতে হবে। যাই, সন্দে হয়ে এল ডন- বৈঠকের সময় হল।"
আরেকদিন অনেক নতুন পাখি এসেছে, লাল, নীল সবুজ সব তোতাপাখি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছি হঠাৎ লোকটা এসে তাই দেখে হেসেই কুটোপাটি-"ওকি রে! তার চেয়ে খাটে শুয়ে-শুয়ে টুনটুনি পাখির ছবি দেখলেই পারিস। আমার বাবার কাকাবাবু হিমালয় থেকে ঈগল পাখি ধরে এনে টিরেটি বাজারে বিক্রি করতেন। ডানা মেললে তাদের এদিক থেকে ওদিক বারো ফুট, তা জানিস? সেগুলোর দুই পা এক হাতে মুঠো করে ধরে আর অন্য হাতে বাঁকানো ঠোঁটদুটো একসঙ্গে চেপে ধরে গঙ্গার ধারে হেঁটে হাওয়া খেতে যেতেন। তোরা আর আমাকে হাসাস নি।"
যেমনি লোকটার গুষ্টিসুদ্ধ সকলের গায়ে জোর, তেমনি তাদের মনে সাহস। একদিন সে বলল, "কি বলাবলি করছিল 'ওরা? দোকানদারের শত্রুরা এসে বাঁদরকে আফিং খাইয়ে দিতে চেষ্টা করছিল? হেসে বাঁচিনে। আরে পুরুষ মানুষের মতো যে পুরুষ মানুষ তার শত্রু থাকবে কেন? আমার বুড়ো ঠাকুরদা হয় স্রেফ পিটুনি দিয়ে সব বন্ধু বানিয়ে ফেলতেন, নয়তো যারা তবু বন্ধু হতে রাজি হত না তারা রাতারাতি কোথায় যে উড়ে যেত তার ঠিক নেই, একদম নিখোঁজ! পুরুষ মানুষের আবার শত্রু কি রে? আমার একজনও শত্রু নেই।" বলে কটমট করে সকলের দিকে তাকাল। আমরা সকলেই হেঁ হেঁ করে হাসতে লাগলাম। আমরা তো তার বন্ধু লোক।
একদিন বিকালে বাঁদরের দোকানে গিয়েছি। বাঁদরওয়ালা বলল, "একটা কুকুর-বাচ্চা দেখবে, খোকাবাবু? একজন দিয়ে গেছে, ভারি সস্তা দাম।" এমন সময় লোকটি এসে বললে-"কি! কুকুর রাখ নাকি তোমরা? এখানকার সব কুকুর দেখলে আমার হাসি পায়। আমাদের বাড়ির উঠোনে ডালকুত্তা ছাড়া থাকে। গলায় একটি কলার পর্যন্ত থাকে না। চোর বাছাধন সোনাদানার লোভে যে কখনো ঢোকেন না তা নয়। কিন্তু পরদিন সকালে এক-আধটা লেংটির সুতো, কি. হাফ প্যান্টের বোতাম ছাড়া কিছু কখনো দ্যাখা যায় নি।"
তার পর দোকানের রোয়াকের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলল-"উঃ ! পা-টাতে একটু ব্যথা হয়েছে। কাল রাতে হেঁটে বর্ধমান ঘুরে এলাম কিনা! তা কিনা বলছিলাম, ও হ্যাঁ, ঐ বর্ধমানে আমার মাসির বাড়িতে এমন সব কুকুর আছে, যা দেখলে শুধু মেসোমশাইকে কেন মাসিমাকে পর্যন্ত পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। সেগুলোকে একবার দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, ওরা শুধু সাধারণ গোরু-ভেড়ার হাড় খেয়ে মানুষ। আরে আমি নিজেই তো একবার একদল বাড়-হাউন্ড-ও কি, ওটা আবার কি নিয়ে এল"-এই বলে তড়াক্ করে লোকটা লাফিয়ে বারান্দা ছেড়ে একেবারে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াল। দোকানদার অত বুঝতে না পেরে, কালো কুকুচে মিষ্টি ভুটে কুকুরের বাচ্চাটাকে তুলে ধরে একেবারে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। দেখলাম লোকটার দুই চোখ ঠিক্সে বেরিয়ে আসছে, তার চুল আর গোঁফ খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে ।
কুকুর-বাচ্চা ক্ষুদে ল্যাজটা নেড়ে লাল ছোট্ট একটা জিব বের করে লোকটার গালে অল্প একটু চেটে দিল। অমনি কিরকম একটা শব্দ করে লোকটা সেখানেই মুচ্ছো গেল! দোকানদার বিরক্ত হয়ে বলল- "মোটর কোম্পানির সব দরওয়ানগুলোই ঐরকম, খালি বসে-বসে খাবে, আর ছু'লেই অজ্ঞান। থাক্ ব্যাটা পড়ে।"
এই দ্যাখ আমি এক টাকা দিয়ে কুকুর-বাচ্চাটাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। যে যাই বলুক, আমি কিছুতেই ওকে ছাড়ব না। পুজোর সময় সবাই সবাইকে জিনিস দেয়, আমিও নিজেকে কুকুর-বাচ্চা দিলাম। জানো, আমার ঠাকুরদাদা একবার-আচ্ছা, আচ্ছা, থাক গে।