shabd-logo

ছেলেবেলার গল্প

30 November 2023

0 Viewed 0

গণশার চিঠি

ভাই সন্দেশ, অনেকদিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে সব ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকাঠক্ হয়ে কড়া পড়ে যেত!

আজকাল আমি মামাবাড়ি থাকি। আমার মনে হয় ওরা কেউ ভালো লোক নন। ওদের মধ্যে মাস্টারমশাই তো আবার ম্যাজিক জানেন। আমি ম্যাজিক করতে দেখি নি, কিন্তু মন্দা বলেছে ওর ইস্কুলে বছরের প্রথম প্রথম মেলাই ছেলেপুলে থাকে, আর শেষের দিকে গুটিকতক টিফ্টিম্ করে। এদিকে মাস্টারমশাইয়ের ছাগলের ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কিন্তু বাবা সুবিধের কথা নয়। ছেলে- গুলো ভাই যায় কোথা? মাস্টারমশাইয়ের চেহারাটাও ভাই কিরকম যেন! সরু-ঠ্যাং পেন্টেলুন উনি কক্ষনো ধোপার বাড়ি দেন না। সাদা কালো চৌকো কাটা কোট পরছেন তো পরছেনই! আবার চুলগুলো সামনের দিকে ক্ষুদে-ক্ষুদে, পিছনের দিকে লম্বা মতন, মধ্যিখানে দাঁড় করানো! মাঝের গোঁফ বেঁটেখাটো, পাশের গোঁফ ঝুলোঝুলো! ওঁর জুতোগুলো কে জানে বাবা কিসের চামড়া, কিসের তেলে চুবিয়ে, কিসের লোম দিয়ে সেলাই করা! ও বাবাগো, মাগো। ইচ্ছে করে ও'র ইস্কুলে কে যাবে! মাকে স্বচক্ষে দেখেছে, প্রথম সপ্তাহে ঘরের ভিতর সাতটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে দুটো ছাগল নটে চিবুচ্ছে। মাস্টারমশাই গা নাচাচ্ছেন। পরের সপ্তাহে মাকে আবার দেখেছে ঘরের ভিতর ছটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে তিনটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে, মাস্টারমশাই জিভ দিয়ে দাঁতের ফোকর থেকে পানের কুচি বের কচ্ছেন। আবার তার পরের সপ্তাহে হয়তো দেখবে ঘরের ভিতর পাঁচটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে চারটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে। মাস্টারমশাই সেফ্টিপিন দিয়ে কান চুলকোচ্ছেন! শেষটা হয়তো ঘরের দরজায় তালা মারা থাকবে, আর ঘরের বাইরে নটা ছাগল নটে চিবিয়ে দিন কাটাবে। মাস্টারমশাই খাঁড়ায় শান দেবেন!

তা ছাড়া সেই যে বিন্তু আরশুল্লা পুযত, একবার গুবরে পোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে-মাস্টারমশাইয়ের বাস্কে হলদেটে তুলট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে। ওঁর লেবুগাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না। পেঁপেগাছে সেই গোল-চোখ চক্চকে জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের রোগা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝাঁটা বেঁধে দিন-রাত ওৎ পেতে থাকেন। কিন্তু কিছু বলা যায় না! মন্দা তো ও-বাড়ি কোনোমতেই যায় না, মেজোও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না, আর ছোট ছেলে ধনা, তার তো ও-বাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি-কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত ও-বাড়ির কুল খায় না, গুড়িয়ার মা সজনে ডাঁটা নেয় না!

মা কিন্তু ওদের কুমড়ো ডাঁটা দিব্যি খান আর বড়মামা তো ওরই দাদা, ঐ একই ধাত! ওরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কি ম্যাজিক, কি মন্তর-পড়া এ-সব একেবারে বিশ্বাস করেন না! কে জানে কোনদিন হয়তো কানে ধরে ঐ ইস্কুলেই আমাকে ভতি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারা জীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবুব? ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড়মামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের উপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি। কেঁউ কেঁউ, ফোঁৎ ফোঁৎ!-কান্না পেয়ে গেল ভাই।

এদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড়মামা যখন তখন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচর্ ফ্যাচর্ হাসেন। বুঝছি গতিক ভালো নয়। দু-একবার তিনতলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না গোটাকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি-বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুঁয়োপোকা ছিল! খোকনকে বলেছি গালায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হল না। এদিকে অভ্যেস না থাকলে কি যে হবে তাও তো জানি না!

এই-সব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিখতে পারি নি বুঝতেই তো পারছ।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। 'কেডস্' পায়ে দিয়ে সুঙ্গুই মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির বেড়া টপ্‌কে, ছাগলদড়ি ডিঙিয়ে, জানলার গরাদ খিচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়িমাছের মতন ডাণ্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভিতর উকি মারলাম।

দেখলাম মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুকো খেতে চেষ্টা করছেন, আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন-কোনোটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন। কোনোটা আধ-খ্যাঁচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বলে সমস্তক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড় ভালো লাগল।

কিন্তু আনন্দের চোটে যেই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চম্স্কে বললেন, 'ওটা কিরে?' ভাবলুম এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন, নখ দিয়ে খিচে দিয়ে গিরগিটির মতন মুখ করে বললেন-"ও বাঁদর!" বললুম, "আক্তে সার, ছাগল বানাবেন না সার!" বললেন, "বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে?" গিন্নিও ফিস্ফিস্ করে যেন বললেন, "ওটিকে রাখো, আমি পুষব।"

ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কি না দেখে বললেন, "তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল।" জিজ্ঞেস করলুম, "তার কি হল?” বললেন, "তার এখন দাড়ি গজিয়েছে।" বলে বড়-বড় বাতাসা খেতে দিলেন। তার পর বাড়ি চলে গেলাম। জিগেস করতে সাহস হল না, দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুরও গজিয়েছিল কি না।

ইস্কুলের কথা এখনো কিছু ঠিক হয় নি, এই ফাঁকে তোমায় লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো না। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে টোয়াড়ে খোঁজ কোরো। ইতি-

তোমাদের গণশা

দিন দুপুরে

দুপুরবেলা বাড়িসুদ্ধ সব্বাই ঘুমোচ্ছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, মা ঘুমোচ্ছেন, মেজোমামা পর্যন্ত খবরের কাগজে মুখ ঢাকা দিয়ে বেজায় ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু টুনুর আর ঘুমই আসে না। তাকিয়ে দেখল হাবুটা অবধি চোখ বুজে মঙ্কা মেরে পড়ে আছে। তাকে ডাকা চলে না, মেজোমামা যদি জেগে যান!

টুনু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার নতুন ঘোড়া খুব সুন্দর হলেও দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালুর কাছে লাগে না। লালু কত কালের পুরনো, সেই কবে মেজোমামা যখন ইস্কুলে যেতেন তখনকার। কিরকম প্রভুভক্ত! ওর গায়ে কি জোর। ভাবতে ভাবতে টুনুর মনে হল-বাদলা দিন বলে বাবা আবার আজ ঘোড়ায় চড়তে বারণ করেছেন। বড়দের যদি কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে। আচ্ছা, আজকের দিনই যদি ঘোড়া না চড়বে, তো চড়বে কবে!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই টুনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, চোখ দুটো গোলমাল হয়ে গেল। দেখল দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালু কেমন যেন মুচকি হাসতে হাসতে উঠোন পার হয়ে বাবার নতুন ঘোড়া রতনের আস্তাবলে ঢুকল। টুনু উঠে এসে জানলার আড়ালে দাঁড়াল। একটু বাদেই রতন লালু দুজনেই আস্তাবলের কোণ ঘুরে কোথায় যেন চলে গেল।

টুনু ডাকল-"ও কেশরী, ও সই-ই-স! লালু রতন যে পালিয়ে গেল!" কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বরই বেরুল না। বাইরে এসে ইদিক- উদিক তাকিয়ে যখন কেশরী সিং কিম্বা সইসের পাত্তা পেল না, টুনু নিজেই চলল আস্তাবলের কোণ ঘুরে রতন লালুর পিছন পিছন।

কি আশ্চর্য! আস্তাবলের পিছনে সেই-সব ধোপাদের কুঁড়ে ঘর, তার সামনে নোংরা মাঠে ধোপাদের গাধা বাঁধা থাকত, আর ময়লা দড়িতে সাহেবদের কোট পেন্টেলুন রোদে শুকুত, সেই-সব গেল কোথায়? টুনু দেখল দুপাশে গা ঘেঁষে ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা আলু- কাবলির, কোনোটা লাল-নীল পেনসিলের, কোনোটা কাচের মার্বেলের। চারি দিকে দোকানে দোকানে বড়-বড় নোটিস ঝোলানো।-

< এগজিবিশন এইদিকে

আর একটা দাড়িমুখো মোটকা বুড়ো একটা ফুটো বালতি পিটোচ্ছে আর ষাঁড়ের মতন গলায় চ্যাঁচাচ্ছে-"পয়সা না ফেলেই ঢুকে যান! পয়সা-টয়সা কিছু চাই না, গেলেই বাঁচি!"

টুনু আরো এগজিবিশন দেখেছিল, কতরকম আশ্চর্য জিনিস থাকে সেখানে দোকান, বাতিওয়ালা থাম, বায়স্কোপ, নাগরদোলা, গোলক- ধাঁধা !

তাই টুনু তাড়াতাড়ি চলল, মাঝপথে একটা ষণ্ডামার্কা লোক পথ আগলে বলল, "এইয়ো!" টুনু তাকে দেখতেই পেল না, পায়ের ফাঁক দিয়ে সুট্ করে গলে এগিয়ে চলল।

হঠাৎ একটা মস্ত খোলা জায়গায় উপস্থিত হল, তার যেদিকে তাকায় কেবল ঘোড়া! বড় ঘোড়া, ছোট ঘোড়া, সাহেবের ঘোড়া, গাড়োয়ানের ঘোড়া, ভালো ঘোড়া, বিশ্রী ঘোড়া। আবার একটা মড়াখেকো হলদে ঘোড়া, ওলটানো টবে চড়ে গ্যাগেঁসে গলায় বক্ততা দিচ্ছে:

"হে ব্যাকুল ঘোড়াভাই-ভগিনী, আজ আপনারা কিসের জন্য এখানে আসিয়াছেন? পুরাকালে আপনারা বন-বাদাড়ে সুখে বিচরণ করিতেন, এই দুষ্ট মানুষগুলাই তো আপনাদের পাকড়াও করিয়া বিশ্রী গাড়িতে জুতিয়াছে। পায়ে নাল বাঁধাইয়া, পিঠে জিন চড়াইয়া, দুই পাশে অভদ্র- ভাবে ঠ্যাং ঝুলাইয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে। ছিঃ! ছিঃ। আপনারা কি করিয়া এই দুপেয়েদের কুৎসিত চেহারা সহ্য করেন ?"

পিছন থেকে গাড়োয়ানদের ছোট-ছোট ঘোড়াগুলো চেঁচিয়ে উঠল, "কক্ষনো সইব না! সইব না! সইব না। মিটিং করে, রেজলিউশন করে, দানা না খেয়ে মানুষদের জব্দ করব!"

হলদে ঘোড়া ঠ্যাং তুলে ওদের চুপ করিয়ে দিল। টুনুর মনে হল সে নিজের ছাড়া আর কারুর গলার আওয়াজ সইতে পারে না।

এক কোণে লালু রতন বলল, "আপনি প্রবীণ ব্যক্তি! দাঁড়িয়েছিল, হলদে ঘোড়া হঠাৎ লালুকে আপনি কিছু বলুন।" বলবামাত্র লালু তড়বড় করে টব থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বিনা ভূমিকায় আরম্ভ করল:

"বহুকাল ধরে আমি চৌধুরীদের বাড়িতে থাকি। তাদের মতন ছোটলোক আর জগতে নেই" টুনুর শুনে ভারি দুঃখ হল। "তার উপর তারা এমন নিরেট মুখ্যু যে বড়বাবু পর্যন্ত সামান্য-যাক আমি কখনো কারো নিন্দে করি না। ওদের বাড়ির ছেলেগুলো আহাম্মকের একশেষ। আমি শিক্ষা দেবার জন্য ইচ্ছে করে ওদের কাপড় রোদে দিলে মাড়িয়ে দিই, জানলা দিয়ে ঘরে মুখ বাড়াই, বোকারা আহাদে আটখানা হয়ে চিনি খেতে দেয়, আর কেউ যখন দেখছে না গিন্নির হিসেবের খাতা চিবিয়ে রাখি। তা ছাড়া নোংরা জিব দিয়ে ওদের সইসের মুখ চেটে দিই, ছোট ছেলে একা পেলেই তেড়ে গিয়ে পা মাড়িয়ে দিই, এইরকম নানা উপায়ে জাতির মান রক্ষা করি।

"সব চেয়ে বিশ্রী ওদের টুনু আর হাবু বলে দুটো পোষা বাঁদর। অমন বদ চেহারার বাঁদর কেউ যে পোষে জানতাম না। ওরা আমাদের ঘুমের সময়ে এসে ঘেমো হাতে উলটো করে আমাদের গায়ে হাত বুলোয়, এমন ঘেন্না করে যে কী বলব! আবার পাতায় করে যত অখাদ্য জিনিস এনে গদগদ হয়ে শুয়োরের মতো ছুঁচলো মুখ করে, চুচুক্ শব্দ করে খাওয়াতে চেষ্টা করে-ইচ্ছে করে দিই ছেঁচে! কিন্তু অমন নিকৃষ্ট জীবকে মারতেও ঘেন্না করে।"

টুনু বিশ্বাসঘাতক লালুর কথায় অবাক হয়ে গেল, এমন অকৃতজ্ঞতা দেখে তার বড্ড কান্না পেল! ছি, লালুর জন্য দাদামশাই ভালো দানা আনান-সে কথা কই লালু তো বলল না! রতনের নতুন জিনের কথাও বোধ করি সে ভুলে গেছে! টুনু প্রতিজ্ঞা করল আর কখনো আস্তাবলের দিকে যাবে না, ঘোড়া চড়তেও সে চাইবে না। লালুকে সে কত ভালোবাসে আর লালুর তাকে নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে। টুনু ভ্যা করে কেঁদে ফেলেই চমকে দেখল, সে কখন জানি মেজোমামার ঘরে এসে শুয়ে রয়েছে আর লালুটাও ইতিমধ্যে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মেজোমামার হাত থেকে চিনি খাচ্ছে!

টুনুর বড্ড রাগ হল, ডেকে বলল, "দিয়ো না ওকে মেজোমামা, ও বলেছে আমরা আহাম্মক ছোটলোক, নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে!" মেজোমামা "আহাঃ!" বলে টুনুকে চুপ করিয়ে দিয়ে একমনে চিনি খাওয়াতে লাগলেন। টুনু হাঁ করে দেখল লালু দিব্যি চিনি সাবাড় করল, কিন্তু যাবার সময় মনে হল চোখ টিপে জিব বের করে বিশ্রী ভেংচে গেল! কিন্তু সে কথা কাকেই-বা বলে!

গুপের বাহাদুরি

আমার মামাতো ভাই গুপে বলল, "জানিস, একবার শুধু আমার জন্য আমাদের বাড়ির দশহাজার টাকার গয়না চোরের হাত থেকে বেঁচে গেছল ।" শুনে আমরা হেসেই কুটোপাটি, কারণ গুপে কুকুরকে ভয় করে, গোরুকে ভয় করে, ভূতকে ভয় করে, মাতালকে ভয় করে। গুপে রেগে বলল, "কি? না বুঝি? তবে শোন- চোরকে ভয় করে, তোদের বিশ্বাস হল

"গত বছর শীতের ছুটিতে আমার মামার বাড়ি গেছি, বড়মামিমার মেয়ের বিয়ে। সে-সব তোরা ভাবতেই পারিস না। সাতদিন আগে থাকতে রসুনচৌকি বসেছে, বড়-বড় কানাৎ ফেলা হয়েছে, ভিয়েন বসেছে, ঘিয়ের আর মিষ্টির গন্ধে রাজ্যের কুকুর এসে জুটেছে। আত্মীয়- স্বজনও যে যেখানে ছিল, ছেলেপুলে-সুদ্ধ এসে সব জমা হয়েছে। মেজদার আবার সবে টেস্ট পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, অঙ্কে বিশেষ সুবিধে করতে পারে নি, তাই নিয়ে ওরই মধ্যে বকাবকি রঙ্গারাগি, চিলেকোঠায় গিয়ে পড়ার ব্যবস্থা।

"বুঝতেই তো পারছিস আমার মামার বাড়ির ওরা ভীষণ বড়লোক। খাওয়ার যা ব্যবস্থা! দুধের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, রুই মাছের পাহাড় জমে যাচ্ছে, আমরা খেয়ে কূল পাচ্ছি না। এমনি সময় মেজোমামা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, 'বউদি, গয়নাগাটি সব তোমরা একটু আগলে রেখো কিন্তু। এ অঞ্চলে ভীষণ চুরি হচ্ছে।' যেখান থেকে যত মাসি-খুড়ি এসেছিলেন সকলের হাতে এই মোটা-মোটা তাগা, গলায় ভারী ভারী বিছে হার, আর বাক্স-বোঝাই রঙবেরঙের পাথর বসানো সব ভুড়ি বালা, কানের ঝুল্কো। সবার তো মুখ প্যাঙাশপানা হয়ে গেল।

যে-যার বাক্সে আরেকটা করে তালা লাগাল।

"রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর পেটে হাত বুলোতে বুলোতে মেজোমামার শালা বন্ধুদা বেশ আসর জমিয়ে বসে রাজ্যের চোরের গল্প বলতে আরম্ভ করল, শুনে সকলের বুক চিপ্‌ ঢিপ্ করছিল। বড়মামা বললেন, 'তা বাপু মন্দ বলিস নি, আজকাল ভালোমানুষের চেয়ে চোর-ছ্যাঁচড়েরই সংখ্যা ঢের বেশি, এমন-কি, ওরা এখন পরস্পরের কাছ থেকে চুরি করতে বাধ্য হচ্ছে তো আর বলিস কেন?' আমরা তো হাঁ, সে আবার কি? বড়মামা হেসে বললেন-'তাও জানিস না? এই তো গেল বছর আমাদের রেলের আপিসের ছোটসাহেব করেছে কি, সব রেজিস্টারি চিঠি-ফিটি থেকে মেলা টাকা সরিয়েছে। এখন রাখে কোথায়, ওদিকে আবার তাই নিয়ে খোঁজখবর ধর-পাকড় চলছে, ব্যাঙ্কেও রাখা যায় না জানাজানির ভয়ে, আবার ঘরেও রাখা যায় না ধরা পড়বার ভয়ে, চোরের ভয়ে। শেষটা করল কি, টাকাগুলোকে একটা ছোট প্যাকিং-কেসে ভরে ম্যারু স্কিগঞ্জে মেমসাহেবের কাছে পার্শেল করে দিল। উপরে লিখে দিল, 'সাধারণ লোহার পেরেক।' যখন সেখানে পৌঁছল তখন মেমসায়েব খুলে দেখে, ওমা কি সর্বনাশ! সত্যি-সত্যি পেরেক ভর্তি, টাকা-কড়ি হাওয়া! কি ফ্যাসাদ বল দিকিনি, না পারে পুলিসে খবর দিতে, না পারে কাগজে ছাপতে!'

"বন্ধুদাটাকে আমরা দুচক্ষে দেখতে পারি না, সারাক্ষণ শুধু চাল মারে, যেন কোথাকার খাঞ্জাখাঁ এলেন। এদিকে ট্যাঁক তো গড়ের মাঠ, কোথায় কোন ফিকিরে কার কাছ থেকে কি হাতানো যায়, সর্বদা সেই তালেই আছে। আার আমাদের পেছনে সারাক্ষণ লাগবে। বড়মামা একটা গোটা গল্প বলে দেবেন, সে ওর সইবে কেন? অমনি বলে বসল-'ও আর এমন কি? কথায় বলে পুকুর-চুরি, তা-আমাদের ওতরপাড়ার কাছে পুকুর-চুরি ঠিক না হলেও গোটা একটা বাড়ি যে চুরি হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বুঝলেন বড়দা, ওতরপাড়ার ব্যাপারই আলাদা। এই যুদ্ধের সময় একেবারে গঙ্গার ধারে বাঁশবনের জমিদারের তিন পুরুষের পুরনো বাড়িটা, দশবছর খালি থাকবার পর ভাড়া হয়ে গেল। চমৎকার লোক গোপেনবাবু, ব্যবসা করে মেলা টাকা করেছেন। বাগবাজারে জমিদারবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনবছরের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে, দেখতে দেখতে রঙ-টঙ করে, জঙ্গল সাফ করিয়ে তার ভোল বদলে দিলেন। লোকটিও ভারি অমায়িক, দেখতে দেখতে পাড়ার একটি মাতব্বর হয়ে উঠলেন। স্পোর্টিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, দুর্গা-পুজো কমিটির পান্ডা, কথায় কথায় পাঁচ টাকা চাঁদা ফেলে দেন, দশ টাকার সন্দেশ রসগোল্লা খাইয়ে দেন। গিন্নিও খাসা লোক, সকলের মুখে তাঁদের প্রশংসা ধরে না।"

গুপে এই অবধি বলতেই আমরা বললাম, "আরে তুই কি করে গয়না বাঁচালি তাই বল-না।" রাগে গর্ গর্ করতে করতে গুপে বলল, "আরে গোড়া থেকেই শোন-না। বুঝলি তার পর বন্ধুদা বলতে লাগল- 'মাসকাবারে গোপেনবাবু নিজে বাগবাজারে গিয়ে ভাড়া দিয়ে আসেন। সেখানেও তাঁর ভারি খাতির। শেষে একদিন পাড়ার ক্লাবে বললেন, 'বাড়িটা কিনেই ফেললাম হে, একেবারে সের দরে ইঁট কাঠ বেচে, নতুন করে বাড়ি ফাঁদব, কি বলেন? সবাই মহা খুশি। দেখতে দেখতে কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গেল। দশহাজার টাকা দিয়ে গোপেনবাবু পোড়োবাড়ি বেচে দিলেন, চমৎকার সব পুরনো কাঠের কড়ি বর্গা, দরজা জানলা, সম্ভাই হল। কন্ট্রাক্টর পাড়ারই লোক, তার সঙ্গে বন্দোবস্ত হল দুমাসের মধ্যে বাড়ি ভেঙে লোহালক্কড় ইঁটকাঠ সরিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ইতিমধ্যে উনি নিজে গিন্নিকে নিয়ে বদ্যিনাথে হাওয়া বদলাতে যাবেন। ফিরে এসে যা লেখাপড়া দরকার সব হবে।'

"দশহাজার টাকা নিয়ে গোপেনবাবুরা বদ্যিনাথ গেলেন। ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টর বাড়ি চেঁছেপুছে নিয়ে গেল। এমনি সময় একদিন স্বয়ং জমিদারবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। কি সর্বনাশ, বাড়ি কোথায় গেল? আর বাড়ি কোত্থেকে আসবে? গোপেনবাবুও একেবারে নিখোঁজ।

"বন্ধুদা গল্প শেষ করে একটিপ নস্যি নিল। এমন সময় মামাদের সরকারমশাই বড় একটা লাল শালুর পুটলি এনে বড়মামার কোলে ফেলে দিয়ে বললেন, 'ধরুন, সিন্দুকে তুলুন, এর মধ্যে দশহাজার টাকার গয়না আছে।' বড়মামা ব্যস্ত হয়ে বললেন, 'ওমা, তাই তো। এই গুপে, যা তো বাবা, এই পুটলিটা তোর এখনই সিন্দুকে তুলে ফেলুক।' গেলাম ছুটে। ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই অর্ধেক ঘুমুচ্ছেন। বড়মামিমাকে দিয়ে আয় বড়মামিমা ছোটখুকিকে সিন্দুকের চাবি আমাকে দিয়ে বললেন, 'তুমি তো বাবা সিন্দুক খুলতে জানো, তুলেই রাখো না, লক্ষ্মীসোনা।'

"পরদিন সকালে মহা হৈ-চৈ! ঐ অত বড় লোহার সিন্দুক, রাতা- রাতি তাকে কে খুলে ফেলেছে, দরজা হাঁ হয়ে রয়েছে, ভিতরে খালি! কান্নাকাটি, রাগারাগি লেগে গেল। বড়মামা পুলিসে খবর দিতে যাবেন বলে চটি পায়ে দিচ্ছেন, বন্ধুদা, ছোটমামা সবাই চেঁচামেচি করছেন। এমনি সময় আমি গুটিগুটি গিয়ে বড়মামার হাতে লাল সালুর পুল্লি ও সিন্দুকের চাবিগাছি দিলাম।

"'এ্যা, এ কোথায় পেলি?'

" 'ইয়ে-ওটাকে আমার লেপের মধ্যে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা।' বড়মামিমা দরজার কাছ থেকে বললেন, 'সেকি রে, সিন্দুকে তুলিস নি নাকি?...

"আমি কিছু বলবার আগেই, বড়খুকিটা এমনি পাজি, বলে উঠল- 'হ্যাঁ, ও একা-একা গিয়ে সিন্দুকে তুলল আর কি! ভূতের ভয় নেই?' বড়মামা-টামা সবাই হো হো করে হাসতে লাগলেন। শুধু বন্ধুদা চাপা গলায় বলল-'ইডিয়ট! কোনো কিছুর জন্য যদি নির্ভর করা যায়। স্টুপিড্ কোথাকার!'"

নতুন ছেলে নটবর

সেই ছেলেটা প্রথম যেদিন মাস্টারমশাইয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকল, গায়ে নীল ডোরাকাটা গলাবন্ধ কোট আর খাকি হাফপ্যান্ট, চুলগুলো লম্বা হয়ে নোটানোটা কানের উপর ঝুলে পড়েছে, তেল-চুচুকে আহাদে-আহাদে বোকা মতন ভাবখানা-দেখেই আমার গায়ে জ্বর এল! আবার আমোদও লাগল, একে নিয়ে বেশ একটু রগড় করা যাবে মনে করে।

ছেলেটার পায়ে ফিতে দেওয়া কালো জুতো একটু কিঙ্কিচ্ করছিল, তাইতে নগা তাকে শুনিয়ে বলল, "জুতোর দামটা বুঝি আসছে মাসে দেওয়া হবে?"

ছেলেটা কিন্তু কিছু না বলে খাতা পেনসিল নিয়ে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসল। মাস্টারমশাই বললেন, "ওহে নটবরচন্দ্র, বছরের মাঝখানে এয়েচো, ভালো করে পড়াশোনা কোরো।" নাম শুনে আমরা তো হেসেই কুটোপাটি, নগা তক্ষুনি তার নাম দিয়ে ফেলল-'লটবহর'। সত্যি নগার মতন রসিক ছেলে খুঁজে পাওয়া দায়!

টিফিনের সময় নটবরচন্দ্র একটা ছোট্ট বইয়ের মতন টিনের বাক্স খুলে লুচি আলুর দম খেয়ে, হাত চাটতে চাটতে বার বার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাই-না দেখে নগা বললে, “কি রে ছোঁড়া, মানুষ দেখে বুঝি অভ্যেস নেই?"

আমরা তাগ করেছিলাম, চটেমটে ছেলেটা কী করে দেখব। ছেলেটা কিন্তু খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎ মুখে হাত দিয়ে বিশ্রীরকম ফ্যাচফ্যাচ্ করে হাসতে লাগল। নগা রেগে বলল-"অত হাসির কথা কি হল শুনতে পারি?"

ছেলেটা অমনি নরম সুরে বলল-"কিছু মনে কোরো না ভাই, সত্যি আমার হাসা উচিত হয় নি, কিন্তু তোমাদের দেখে আমার হঠাৎ মেজোমামার পোষা বাঁদরগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কেবল ঐ ওকে ছাড়া"-বলে আমাকে দেখিয়ে দিল ।

নগারা রেগে ফোঁস্ ফোঁস্ করতে লাগল, আমি কিন্তু একটু খুশি না হয়ে পারলাম না, অল্প হেসে জিগ্গেস করলাম-"আর আমাকে দেখে কিসের কথা মনে হচ্ছে?"

সে অম্লানবদনে বললে-"মুলতানী গোরুর কথা।" ভীষণ রাগ হল। ভাবলাম ছোটবেলা থেকে এই যে শ্যামবাবুর কাছে স্যান্ডো শিখেছি সে কি মিছিমিছি। তেড়ে গিয়ে এইসা এক প্যাঁচ কষে দেবার চেষ্টা করলাম যে কি বলব! সে কিন্তু কি একটা ছোটলোকি কায়দা করে এক সেকেন্ডে আমাকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক তক্ষুনি ক্লাসের ঘটা পড়ল, নইলে বিষম সাজা দিতাম।

ক্লাসের পর বাড়ি যাবার পথে তার জন্য ওৎ পেতে রইলাম, আমি আর একটা ছেলে। দেখা হতেই সে হাসিমুখে বলল, "কি হে, চীনাবাদাম খেতে আপত্তি আছে?" আমরা আর কি করি, একেবারে তো আর অভদ্র হতে পারি না, তাই চীনাবাদাম নিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললাম-“দ্যাখ, নতুন ছেলে এসেছিস, নতুন ছেলের মতো থাকবি, আজ দয়া করে তোর চীনাবাদাম খেলুম বলে মনে করিস না যে দুপুরের কথা ভুলে গেছি।"

সে বললে, "রাগ কোরো না ভাই। আমি যদি জানতাম অমন হোঁতকা শরীর নিয়েও তুমি এমন ল্যাদাড়ে তবে কি আর কষ্ট করে জনসোনিয়ান প্যাঁচ লাগাতাম, এই এমনি দুআঙুলে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতাম।" এই বলে আমাকে কি একটা কায়দা করে চিৎপাত করে দিয়ে নিমেষের মধ্যে সে তো হাওয়া! এর থেকেই বোঝা গেল সে কী ভীষণ ছেলে! সারারাত মাথা ঘামিয়েও তাকে জব্দ করার উপায় দেখলুম না। পরদিন সকালে ছোটমামা বললে, "কিরে ভোঁদা মুখ শুকনো কেন? পেট কামড়াচ্ছে বুঝি? রোজ বলি অত খাস নি।" যা বুদ্ধি এদের! বলতে এসো না।" বললুম-"যে বিষয়ে কিছু বোঝ না, সে বিষয়ে কিছু

নটবরকে না পারতে পারি, তাই বলে যে অন্যদেরও এক কথায় চুপ করিয়ে দিতে পারি না, এ কথা যেন কেউ মনে না করে। হাবুটার কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না। নিজের বেলা তো খুব বুদ্ধি খোলে, কিন্তু আমি যখন সব খুলে 'বলে পরামর্শ চাইলাম সে উলটে বললে, "তুই আর তোর নগা না বগা, দুটি মানিকজোড়! আমার কাছে যে বড় পরামর্শ চাইতে এসেছিস! ওরে ছোঁড়া, আগে পরামর্শ নেবার মতন একটু বুদ্ধি গজা!"

নাক সিঁটকে চলে এলুম। হ্যাঁ! পরামর্শ আবার কি! মেয়েদের সঙ্গে আবার পরামর্শ! জানো কেবল হি হি করে হাসতে আর কালো গায়ে লাল জামা চড়িয়ে সঙ সাজতে। সাধে কি মুনি-ঋষিরা ওদের বিষয় ঐ-সব লিখে গেছেন!

ইস্কুলে গিয়ে দেখি ছেলেটা আজ ফার্স্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। একদিনেই দেখি মাস্টারদের বেশ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল! বোকার মতন মুখ করে থাকলে সবাই অমন পারে। আর বুঝি আন্দাজে আন্দাজে কতকগুলো সোজা সোজা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। পড়ত ওর ঘাড়ে আমাদের সব শক্ত শক্ত প্রশ্নগুলো, তবে দেখা যেত! যাই হোক, একদিনেই নাম করবার তার এমন কিছু তাড়াহুড়ো ছিল না। নগা বলল-"ব্যাটা খোশামুদে!"

ছেলেটা শুনে বলল, "ছিঃ, হিংসে করতে নেই, পরে কষ্ট পাবে।"

রাগে নগা হাতের মুঠো খুব তাড়াতাড়ি খুলতে ও বন্ধ করতে লাগল। গেল বছর যদি ওর টাইফয়েড না হত নিশ্চয় সেদিন একটা কিছু হয়ে যেত।

এমনি করে কদ্দিন যেতে পারে! শেষটা একদিন গবুই এক বিষম ফন্দি বার করল। গবুটা দেখতে রোগা পটকা, আর প্রত্যেক পরীক্ষায়, প্রত্যেক বিষয়ে লাস্ট হলে কি হবে, ছেলেটার খুব বুদ্ধি আছে। সেদিন ক্লাসে এসেই সে নগাকে কানে কানে কি বলল! তাই-না শুনে উৎসাহের চোটে নগা অঙ্কটঙ্ক ভুল করে কোপে দাঁড়িয়ে একাকার! তাতে বরং একদিক দিয়ে সুবিধেই হল, নগা কোণে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে মতলবটা দিব্যি পাকিয়ে নিল।

সেইদিনই টিফিনের সময় নটবরকে ডেকে নগা বলল, "ভাই নটবর,

যা হবার তা হয়ে গেছে, একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, হেডমাস্টারকে তাই একটু সাহায্য করা চাই! তুমি ক্লাসের ভালো ছেলে, তুমি বললে দেখাবেও ভালো, তা ছাড়া তোমার মতন গুছিয়ে কেই-বা বলতে পারবে?" নটবর খুশি হয়ে বলল-"তা তো বটেই। ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তোতলা, আর বাকিগুলো একেবারে গবুচন্দ্র।"

নগা আশ্চর্যরকম ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা হয়ে বলল- "তা, তুমি গিয়ে তাঁকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে যে তাঁর বাবার শ্রাদ্ধে তুমি কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে সাহায্য করতে চাও। এই একটু সম্মান দেখাবার জন্য আর কি! বুঝলে তো? ভালো করে বুঝিয়ে বোলো, এই কাল ওর বাবা মারা গেছেন কি না।"

নটবর হাঁ করে শুনে বলল-"আহা, তাই নাকি? তোমরা ভেবো না, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করে থাকলে ফল টের পাবে।" বলে হেডমাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেল। তার ঐ 'টের পাওয়া'র কথাটা আমার ভালো লাগল না। 'টের পাওয়া' বলতে আমরা অন্য মানে বুঝি। সে যাই হোক গে। ক্লাসের ঘণ্টা পড়বামাত্র নটবর ছুটতে ছুটতে এসে বলল-"হেডমাস্টার রাজি হয়েছেন। তোমাদের কজনকে এক্ষুনি ডেকেছেন কি সব কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য। তোমরা কি করে জানলে তাও জিগ্গেস করছিলেন। মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। তোমরা এক্ষুনি যাও।"

আমরা প্রথম তো অবাক! শ্রাদ্ধের কথাটা গবুর সম্পূর্ণ বানানো।

কোথায় নটবর ইয়ার্কি দেবার জন্য মার খাবে, না সত্যি হেডমাস্টারের বাপের শ্রাদ্ধ! এরকম কিন্তু আরো হয়। আমি একবার একটা অচেনা ছেলেকে মজা দেখাবার জন্য বলেছিলাম, "কি হে, চাটগাঁ থেকে কবে এলে?” সে বলল-"কাল এলাম, তুমি কি করে জানলে?" আমি অবিশ্যি আর কিছু ভেঙে বলি নি।

যাই হোক, আমরা তো গেলাম। দেখলাম হেডমাস্টার গোমড়া মুখ করে ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেদের ইংরেজি খাতায় লাল পেনসিলের দাগ কাটছেন। আমাদের খেঁকিয়ে বললেন-"কি ব্যাপার কি তোমাদের? ক্লাস নেই নাকি, এখানে যে বড় দঙ্গল বেঁধে এসেছ?"

নগা গলা পরিষ্কার করে বলল-"আক্তে, আপনার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছি। এই আমরা”-এইটুকু বলতেই হেডমাস্টারের এক ভীষণ পরিবর্তন হল। মুখটা লাল হয়ে বেগুনি হল, হাতের পেনসিলের মোটা সীস মট্ করে ভেঙে গেল, গোঁফ-চুল সব খাড়া হয়ে গেল, জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। তার চোটে শার্টের গলার বোতাম ফট্ করে ছিড়ে মাটিতে পড়ে গেল। করে আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেখছিলাম, এবার হঠাৎ বিকট সন্দেহ হল। কিরকম একটা শব্দ আমরা এতক্ষণ হাঁ করে নটবর আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। হেডমাস্টার ডাকেন নি। সে হয়তো দেখাই করে নি! হেডমাস্টার গর্জন করে উঠলেন, জানলার খড়খড়ি কেঁপে উঠল। আমরা ছিকে বাইরে এসে পড়লাম, তিনি ফেলে দিলেন কি আমরাই পালিয়ে গেলাম, আজও ঠিক জানি না। কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসে ঢুকেই শুনলাম, পণ্ডিতমশাই নটবরকে বলছেন, "সে কি নটবর, হেডমাস্টারের ভাইপো তুমি, সে কথা এদ্দিন বল নি!"

নটবর বলল-"বাবা বলেন ও সম্পর্কটা কিছু ঢাক পেটাবার মতো নয়। তা ছাড়া ইস্কুলটা বাজে। এইমাত্র কাকাকে সেই কথা বলে এলাম। তিনি তো রেগে কাঁই।"

এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, "গবুবাবু আর ভোঁদাবাবুকে বেত খেতে হেডমাস্টারবাবু ডাকছেন!"

তাই শুনে পণ্ডিতমশাইও বললেন-"আর হ্যাঁ, বেত খেয়ে এসে আধ ঘণ্টা বেঞ্চে দাঁড়াবে, লেট করে ক্লাসে এসেছ।" তাই বলি পৃথিবীটাই অসার!

লাল নীল মাছ

ক্যাবলাদের বাড়ির পুকুরে কোথায় এক গোপন জায়গায় সেই লাল নীল মাছটা ডিম দিয়েছিল। জানত শুধু লাল নীল মাছ আর শংকর মালী। ব্যাঙরা তাকে খুঁজে পায় নি। হাঁসরা তাকে খুঁজে পায় নি! ক্যাবলা যেদিন শংকর মালীর কাছে খবর পেল সেইদিনই পুকুরপাড়ে ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু সেও খুঁজে পায় নি। দেখল ব্যাঙরা ডিম খুঁজে খুঁজে পুকুরের নীল জল ঘুঁটে ঘোলাটে করে দিয়েছে, হাঁসরা পদ্মফুলের মধ্যে প্যাতপেতে চামড়াওয়ালা ঠ্যাং চালিয়ে শেকড় বাকল পর্যন্ত তুলে এনেছে, কিন্তু ডিমের কোনো পাত্তাই নেই। বুড়ো হাঁসগুড়ো বলেছিলেন- "চোখ রাখিস, তা দেবার সময়ে ক্যাক্ করে ধরিস।" কিন্তু সকাল সন্ধে লাল নীল মাছটাকে গোমড়া মুখে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল, তা দেবার নামটি করল না। সারা দুপুর মাছটা এখানে এক কামড় শেকড়, ওখানে দুটো কিসের দানা খেয়ে বেড়াল, তা দেবার গরজই নেই!

হাঁসরা তো রেগে কাঁই! "আরে মশাই, আমরা ডিম দিলে ভর- সন্ধে তার ওপর চেপে বসে থাকি! ত্রিসীমানায় কেউ এলে খ্যাঁক্ খ্যাক করে তেড়ে যাই, আর এ দেখি দিব্যি আছে!"

ব্যাঙরা তাগ করে থেকে থেকে শেষটা ঝিমিয়ে এল। হাঁসরা ম্যাদা

মেরে গেল, ক্যাবলাও দু-তিন দিন ঘুরে গেল। শংকর মালীকে অনেক পেড়াপীড়ি করাতে সে বলল-"অ রাম-অ!

সে বলিবাকু বারণ-অ অচ্ছি!"

ক্যাবলা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, লাল নীল মাছটা ছোট-ছোট ডানিওয়ালা পোকা ধরে কপাকপ্ গিলছে দেখল। কি মোল্কা মাছ বাবা। পাঁজরের একটা হাড় গোনা যায় না।

ক্যাবলার একটু দুঃখও হল, পগারের মধ্যিখানে কে জানে কোথায় ডিম ফেলে লোকটা দিব্যি মাকড়গুলো মেরে খাচ্ছে। কাল হোক, পরম্ভ হোক, যেদিনই হোক, মেজোমামার মস্ত ছিপটা এনে এটাকে ধরবেই ধরবে। বামুনদিদিকে দিয়ে দেবে, ঝোল রেঁধে খাবে, কাঁটাগুলো বিল্লিকে খাওয়াবে।

এ তো গেল ক্যাবলার কথা। এদিকে লাল নীল মাছটার ভাব- গতিক দেখে পুকুরের আর সবার গা জ্বলছে। শংকর মালী ভাত দিলেই ও তেড়েমেড়ে আগেভাগে গিয়ে সব সাফাই করে দেয়। হাঁসরা সময় মতো উপস্থিতই হতে পারে না, ব্যাঙরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলল, তবু সে গ্রাহ্যই করে না!

শেষটা একদিন চাঁদনি রাতে লাল নীল মাছের ডিম ফুটে ছোট একটা ছানা বেরুল। শংকর মালী জানত তাই দেখতে পেল কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। আর ক্যাবলা তো ছিপই পায় না, মেজোমামা সেটাকে ডালকুত্তোর মতন পাহারা দেন।

ছোট মাছটার কথা কেউ জানতে পারল না। পদ্মফুলের বোঁটায় ছোট-ছোট দাঁতের দাগ কারো চোখেই পড়ল না। ব্যাঙাচিগুলোকে কে যে একা পেলেই ভয় দেখায়, ব্যাঙাচি বেচারাদের বোল ফোটে নি, তারা বলতে পারল না, তারা কেবল দিন-দিন ভয়ের চোটে আমসির মতন শুকিয়ে যেতে লাগল। তাদের ল্যাজগুলো খসে যাবার অনেক আগেই নারকোল-দড়ি হয়ে গেল।

এমনি করে আরো কদিন গেল। তার পর বিকেলবেলায় ক্যাবলা ছিপ ছাড়াই পুকুরপাড়ে চলল। পথে দেখল ওদের তালগাছ থেকে সর্সর্ করে কি একটা যেন নামছে, তার ঠ্যাং দুটো দড়ি দিয়ে এক- সঙ্গে বাঁধা, পাঁচু ধোপার গাধার মতন, তার কোমরে দুটো হাঁড়ি ঝোলানো! ক্যাবলা ভাবছিল লোকটাকে দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না, সঙ্কান দেবে কি না ভাবছে, এমন সময় লোকটা তাকে ডাকল।

ক্যাবলা দেখল হাঁড়ির ভিতর সাদা ফেনা, তার গন্ধের চোটে ভূত ভাগে। লোকটা ক্যাবলার সঙ্গে অনেক কথা বললে, লাল নীল মাছের কথা শুনে, কেমন যেন ভাবুক ভাবুক হয়ে গেল। বলল ছিপের কি দরকার? ছোটবেলায় তারা নাকি কাপড় দিয়ে কচি কচি মাছ ধরত। এখনো ছুটির দিনে সাঁওতালরা দল বেঁধে কোপাই নদীতে মাছ ধরে।

তাদের ছিপ নেই, মাঝখানে ফুটো ধামার মতন জিনিস দিয়ে গপাক্ গপাক্ চাপা দিয়ে দিয়ে ধরে। কাছাড়ের কাছে কোথায় পাহাড়ী নদীতে রাত্রে নাকি জাল বেঁধে রাখে এপাড় থেকে ওপাড়, সকালে দেখে তাতে কত মাছ, ছোটগুলো ছেড়ে দেয় আর বড়গুলো ধরে নিয়ে যায়।

লোকটা এমনি কত কি বলল। যাবার সময়ে বলে গেল হাঁড়ির

কথা যেন কাউকে না বলে। সে চলে গেলে ক্যাবলা কাপড়ের খুঁট বাগিয়ে ঘটম্যাক্ ঘটম্যাক্

করে জলের দিকে চলল। আজ মাছ ব্যাটাকে কে রক্ষা করে? এমন সময় টুপ্ করে জল থেকে মাছের ছানা মুণ্ডু বের করে বিষম এক ভেংচি কাটল। ওরে--বাবা রে, সে কি মেছো ভেংচি! 'ক্যাবলা তো শাঁই শাঁই ছুট লাগাল, আর হাঁসরা ব্যাঙরা কে যে কোথায় ভাগল তার পাত্তাই নেই!

সন্ধেবেলা শংকর মালী যখন ওদের জন্য ভাত আনল, দেখল কেউ কোথাও নেই, খালি লাল নীল মাছ আর সবুজ ছানা পাশাপাশি বসে ফ্যাচফ্যাচ্ করে হাসছে।

• গুপের গুপ্তধন

ও পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে ফিরতে বড্ড সন্ধে হয়ে গেল। আমি • আর গুপে দুজনে অন্ধকার দিয়ে ফিরছি খেলার গল্প করতে করতে, এমন সময় গুপে বলল-"ঐ বাঁশঝাড়টা দেখেছিস?" বললুম "কই ?" সে বললে, "ঐ যে হোথা। মনে হয় ওখানে কি একটা লোমহর্ষক • ব্যাপার ঘটেছিল, না?"

গুপের দিকে তাকালুম, এমন সময়ে এমন কথা আশা করি নি। আমি বললুম, "গুপে, তুই কিছু খেয়েছিস নাকি?"

গুপে বলল, "চোখ থাকলেই দেখা যায়, কান থাকলেই শোনা "যায়।” আমি বললুম, "নিশ্চয়ই। মাথা না থাকলে মাথা-ব্যথা হবে কি করে?" গুপে বলল, "তুই ঠিক আমার কথা বুঝলি না! দেখবি চল আমার সঙ্গে।"

বুকটা চিড়িপ্‌ করতে লাগল। পেঁচোর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেও সন্ধেবেলা মাছ কিনে ফিরছে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসছে, এমন সময় কানের কাছে শুনতে পেল, "পে-চোঁর মাঁ, মাঁছ দে।" পেঁচোর মা হনহনিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু সেও সঙ্গে চলল- "দে বলছি, মাঁছ দে।"

গুপে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোমহর্ষণ সিরিজের বিকট বই পড়ত! আমায় একটা দিয়েছিল, তার নাম 'তিব্বতী গুহার ভয়ংকর' কি ঐ ধরনের একটা কিছু। আমায় বলেছিল, "দেখ, রাত্রে যখন সবাই ঘুমুবে, একা ঘরে পিদিম জ্বেলে পড়বি। দেয়ালে পিদিমের ছায়া নড়বে, ভারি গা শিরশির্ করবে, খুব মজা লাগবে।" আমি কিন্তু একবার চেষ্টা করেই টের পেয়েছিলুম ওরকম মজা আমার ধাতে সইবে না। আজ আবার এই!

গুপে বলল, "কি ভাবছিস? চল দেখি গিয়ে। বাবার কে এক বন্ধু একবার দিল্লীতে একটা সেকেলে পুরনো বাড়িতে একটা শুকনো মরা বুড়ি আর এক ঘড়া সোনা পেয়েছিলেন। দেখেই আসি-না। হয়তো গুপ্তধন পোঁতা আছে। যক্ষ পাহারা দিচ্ছে।" তারার আলোয় দেখলুম, তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বল্ করছে। তাই দেখেই আমার ভয় করতে লাগল-আবার বাঁশঝাড়ের যক্ষ!

কিন্তু কি করি, গুপেটা আঠালির মতন লেগে রইল। অগত্যা দুজনে অন্ধকার ঘন ঝোপের মাঝ দিয়ে আস্তে আস্তে চললুম। গুপে আবার কি একটা মস্তকহীন খুনীর গল্প করল। কবে নাকি কোন পুরনো ডাকবাংলোয় কেউ রাত কাটাতে চাইত না। লোকে বলত, যারাই থেকেছে রাতারাতি মরে গেছে। কেউ কিছু ধরতে পারে না! বাবুচি বলে, "হাম তো মুরগি পকাকে আউর পরটা সেঁককে সাবকো খিলাকে ঐ হামারা কোঠি চালা গিয়া। রাতমে কভি ইধার আতা নেই, বহুত গা ছম্ম্ করতা, আউর যো সব কান্ড হোতা যো মালুম হোতা আলবত্ শয়তান আতা হ্যায়।"

শেষে কে এক সাহসী, মস্ত এক কুকুর নিয়ে বন্দুকে গুলি ভরে বসে রইল, কি হয় দেখবে। কোথাও কিছু নেই, ঘর-দোর ঝাড়াপোঁছা পরিষ্কার। আশ্চর্য, দেওয়ালে একটা টিকটিকি কি ঘুমন্ত মাছি অবধি নেই! অনেক যখন রাত, লোকটা আর জেগে থাকতে পারছে না, দেশলাই বের করেছে, সিগারেট খাবে, কুকুরটাও ঝিমোচ্ছে, এমন সময় পাশের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও কমে এল...

গল্প বলতে বলতে আমাদের চারি দিকের আলোও কমে এসেছিল, আর গুপের স্বর নিচু হতে হতে একেবারে ফিস্ফিসে দাঁড়িয়েছিল। আর তার চোখ দুটো আমার কপাল ছ্যাঁদা করে ভিতরের মগজগুলোকে ঠান্ডায় জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

আমার গলা শুকিয়ে এল, কান বৌ বোঁ করতে লাগল। নিশ্চয়ই মূর্ছা, যেতাম, তার পর সেখান থেকে টেনে আনো রে, কিন্তু হঠাৎ চেয়ে দেখি সামনেই বাঁশঝাড়। দেখে থমকে দাঁড়ালুম, অন্য একটা ভয় এসে কাঁধে চাপল। বাঁশঝাড়ের মধ্যে স্পষ্ট শুনলুম, খস্থ শব্দ- যেন বুড়ো সাপ নিবিষ্ট মনে একটার পর একটা কোলাব্যাঙ গিলে খাচ্ছে।

গুপের দিকে তাকালুম, জায়গাটার থমথমে ভাব নিশ্চয়ই সেও লক্ষ্য করেছে। তার মুখটা অন্ধকারে সাদা মড়ার মতন দেখাচ্ছিল। জায়গাটাতে হাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঝিঝি পোকার ডাক ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না।

আমার মনে হতে লাগল-আর কখনো কি বাড়ি যাব না? পিসিমা আজ মালপো ভেজেছেন। সে কি দাদা একা খাবে? মাস্টার- মশাইও এতক্ষণে এসে বসে রয়েছেন, হয়তো শক্ত শক্ত অঙ্ক ভেবে রাখছেন। গুপেটা কেন জন্মেছিল?

গুপে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে বলল, "চল্ কাছে যাই।" বাঁশঝাড়- গুলা ঘেঁষাঘেঁষি করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল তারার আলোয় মধ্যিখানটা একেবারে ফাঁকা। আশেপাশে ঘন বিছুটি পাতা, সে জায়গাটা শুকনো ঘাসে ঢাকা। থেকে থেকে দু-একটা বুনো কচুগাছ, বিষম ভুতুড়ে গাছ।

তার পর চোখ তুলে আর যা দেখলাম, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মনে হল ছেলেবেলায় একবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি ঘরের আলো নিবে গেছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর তার মধ্যে খস্থস্ শব্দ, যেন কিসে বসে বসে শুকনো কিসের ছাল ছাড়াচ্ছে। এত কথা মনে করবার তখন সময় ছিল না, কারণ আবার ভালো করে দেখলাম দুটো সাদা জিনিস, মানুষের মতন, কিন্তু মানুষ তারা হতেই পারে না। জায়গাটা যে শাঁকচুন্নির আস্তানা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। স্পষ্ট একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধও নাকে এল। অন্ধকারে দেখলাম দুটো খুব লম্বা আর খুব রোগা কি, আপাদমস্তক সাদা কাপড় জড়ানো, মাথায় অবধি ঘোমটা দেওয়া, নড়ছে চড়ছে। দেখলাম তাদের মধ্যে একজন ছোট্ট কোদাল দিয়ে নরম মাটি অতি সাবধানে খুঁড়ছে, অন্যজন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ল জ্যাঠামশাই একবার কলকাতায় পুরনো চক-মেলানো বাড়িতে ছিলেন, সেখানে একদিন দুপুর রাতে দিদিরা ভূত দেখেছিল-কলতলায় গোছা গোছা বাসন মাজছে। তার পর থেকেই তো ছোড়দির ফিটের রোগ। কিছুই না, ভূতের কুদৃষ্টি!

আবার তাকিয়ে দেখি খোঁড়া শেষ হয়েছে, গভীর গর্ত মনে হল! এতক্ষণ অত্যন্ত অস্বোয়াস্তি বোধ হচ্ছিল। ঘাড়ে মশা কামড়াচ্ছিল, চুলের মধ্যে কাঠপিঁপড়ে হাঁটছিল, আর পা বেয়ে কি একটা প্রাণপণে উঠতে চেষ্টা করছিল। গুপের পাশে তো অনেকক্ষণ থেকে একটা গো-সাপের বাচ্চা ওৎ পেতে বসেছিল। গুপে দেখছিল না, আমি কিছু বলছিলাম না। ওকে কামড়াক, আমার ভালোই লাগবে।

সেই সাদা দুটো এবার উঠে দাঁড়িয়ে কি একটা ভারী জিনিস অন্ধকার থেকে টেনে বের করল। হল, ছালায় বাঁধা-মাগো কি! গর্তের পাশে একবার নামাল, মনে

একটা নতুন কথা মনে করে ভয়ে কাদা হয়ে গেলাম! এরা হয়তো ভূত নয়, খুনী ডাকাত, কাকে যেন মেরে ছালায় বেঁধে গভীর অন্ধকারে বাঁশঝাড়ে নিরিবিলি পুঁতে বাড়ি চলে যাবে। কেউ টের পাবে না।

ভাবলাম নিঃশ্বাস অবধি বন্ধ করে থাকি। তারা এদিকে কালো জিনিসটাকে পুঁতে এ ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী 'ফ্যাচফ্যাচ্ করে হাসতে লাগল, কালো মুখে সাদা লম্বা-লম্বা দাঁতগুলো ঝক্কক্ করে উঠল। তার পর তারা অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল।

সে সন্ধের কথা কাউকে বলতে সাহস হয় নি, বিশেষত গুপে যখন বাড়ির দরজার কাছে এসে আস্তে আস্তে বলল, "কাউকে বলিস না, বুঝলি? কাল আবার যাব, এর মধ্যে নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার জড়িত আছে।"

আমি কথা না বলে মাথা নাড়লাম। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না জ্যান্ত বাড়ি। ফরছি!

পরদিন মনে করলাম আজ কিছুতেই গুপের কাছে যাব না। এ তো ভারি আহাদ! উনি সখ করে আগাড়ে বাগাড়ে ভূত তাড়িয়ে বেড়াবেন আর আমায় ওঁর সঙ্গে ঘুরে মরতে হবে! শাঁকচুন্নি যদি অতই ভালো লাগে-একাই যা-না। কেন রে বাপু! আমায় কেন? অনেক করে মন শক্ত করে রাখলুম, আজ কোনো মতেই যাব না। এমন-কি, মেজদাদামশায়ের বাড়ি চণ্ডীপাঠ শুনতে যাব, তবু বাঁশঝাড়ে যাব না।

সারাদিন গুপের ত্রিসীমানায় গেলুম না। ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসলুম। টিফিনের সময় পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ব্যাকরণ বুঝতে গেলুম। এমনি করে কোনোমতে দিনটা কাটল। কিন্তু বাড়ি ফেরবার পথে কে যেন পিছন থেকে এসে কাঁধে হাত দিল! আঁতকে উঠে ফিরে দেখি গুপে! সে বলল-"মনে থাকে যেন সন্ধেবেলা!"

হঠাৎ বলে ফেললুম, "গুপে, আমি যাব না।"

সে একটু চুপ করে থেকে বলল, "ও বুঝেছি, ভয় পেয়েছিস। তা তুই বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প শোন গে, আমি, কেলোকে নিয়ে যাব। তোর চেয়ে ছোট হলেও তার খুব সাহস!"

বড় রাগ হল, বললুম, "ওরে গুপে, সত্যিই কি ভয় পেয়েছি, ঝোপ- জঙ্গলে সাপখোপের বাসা তাই ভাবছিলুম। আচ্ছা, নাহয় যাওয়াই যাবে।"

গুপে বলল, "তাই বল্ !"

আবার চার দিক ঝাপসা করে সন্ধে এল। মাঠ থেকে ফিরতে গুপে ইচ্ছে করে দেরি করল। সূর্য ডুবে গেল, আমরাও বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা হলুম। আজ আমি প্রাণ হাতে নিয়ে এসেছি, মারা যাব তবু শব্দটি করব না। বাঁশঝাড়ের কাছে এসেই গা কেমন করতে লাগল। সত্যিই জায়গাটাতে ভূতে আনাগোনা করে। এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে এই মশাওয়ালা বাঁশঝাড়ে আড্ডা গাড়বার আমি কোনো কারণ ভেবে পেলাম না।

আজ তারার আলো একটু বেশি ছিল, সেই আলোতে দেখতে পেলাম, তারা আবার এসেছে। ঠিক মানুষের মতন দেখতে, তবে পা উলটো কি না বুঝতে পারলাম না। মনে হল এদের উলটো হয়ে গাছে ঝোলা কিছুই আশ্চর্য নয়।

তারা এ ওর দিকে তাকিয়ে শকুনের মতন হাসতে লাগল। তার পর কোদাল বের করে ঠিক সেই জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। দম আটকে আসছিল। কে জানে কি বীভৎস ভোজের আশায় ওরা এসেছে। খুঁড়ে সেই কালো জিনিসটা টেনে তুলল, দেখলুম ছালা নয়, চিত্তির আঁকা কলসী! ভাবলুম গুপ্তধন।

তারা কলসীর মুখ খুলতেই আবার সেই দুর্গন্ধ। নিশ্চিত কিছু বিশ্রী জিনিস আছে ওর মধ্যে! কিন্তু তারা খাবার কোনো আয়োজন করল না।

একজন আর-একজনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট খুদির মায়ের গলায় বলল, "হ্যালো বাগ্ঙ্গীবউ, পদীপিসি ঠিকই বলেছিল, দেখ্-না বাঁশঝাড়ে পুঁতে সুঁটকিগুলো কেমন মজেছে!"

গুপে একটা প্রচন্ড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শিউরে উঠল। বলল, "চল্, পৃথিবীতে দেখছি অ্যাভেনচার বলে কিছু নেই!" আমি তৎক্ষণাৎ বাড়িমুখো রওনা দিলাম।

গুপে বাড়ির কাছে এসে বলল, "কোথায় মড়া, কোথায় গুপ্তধন

আর সুটকিমাছ! আর কারু কাছে কিছু আশা করব না।"

আমি কিন্তু ব্যাপারটাতে খুশি হলাম!

কিছু বললাম না, কেবল মনে মনে সংকল্প করলাম, 'খোক্কসের হাতে বরং পড়ব, তবু গুপের হাতে কখনো নয়।'

বদ্যিনাথের বড়ি

কোন সকালে কলু কদ্দিন দেখেছে রাস্তার মধ্যিখানে লোহার গোল ঢাকনি খুলে খ্যাংরাকাঠির মতন গোঁফওয়ালা লোক, ছোট বালতি হাতে দড়িবাঁধা কালো ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওৎ পেতে বসে থাকে। লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কাদার ছিটে-অমুদা যখন দাড়ি কামাত না তখন তাকে যেমন দেখাত সেইরকম দেখায়। ছোট ছেলেটা হয়তো ওর ভাইপো হবেও-বা। ওর নাম হয়তো ছক্কু, ওর গায়ে মোটে কাপড় নেই, কিন্তু কানে সোনালি রঙের মাকড়ি, গলায় মাদুলি বাঁধা। বুবু বলে নাকি সত্যি সোনার নয়: ওরা গরিব কিনা, খেতেই পায় না, ও পেতলের হবে। কলু আর বুবু ছাড়া ওদের কেউ দেখেই না। সামনে দিয়ে দেবরঞ্জনমামা, অমুদা, ননিগোপালরা সবাই চলে যায়, তাড়াতাড়ি কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি-ওদের চোখেই পড়ে না। কিন্তু কলু দেখেছে লোকটা মাঝে মাঝে বালতি টেনেটুনে ওপরে তোলে, সেটা থাকে কাদায়-ভরা; সেই নোংরা কাদা রাস্তার পরিষ্কার ডাস্টবিনে ঢেলে আবার বালতি নামিয়ে দেয়। কাদা ছাড়া কখনো কিছু ওঠে না। কত কি তো হারিয়ে যায়, কিন্তু কিছু কক্ষনো বেরোয় না। দাদা বলেছিল বিদ্যাধরী ওর ভেতর থেকে নদীর সঙ্গে ওর সোজাসুজি যোগ আছে, ওর ভিতর কুদো কুমির ছেলেপুলে নিয়ে হুমো দিয়ে থাকে, কই বালতিতে তার ডিমটিম তো কক্ষনো পাওয়া যায় না।

দাদার ফাউন্টেন পেন হারিয়ে গেল; চিনুদার কবিতার খাতা হারিয়ে গেল। বদ্যিনাথের নতুন চটি হারিয়ে গেল গোরামামার বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে সেইদিনই আবার পাল-সাহেবের ছাতাও কোথায় হারিয়ে গেল; ছোড়দির চুড়ি ড্রেনের ভিতর তলিয়ে গেল, এত সব গেল কোথায়? তার কিছু মোটে কোথাও পাওয়াই গেল না। অথচ সেই লোক দুটো কত কাদা ওঠাল!

রাত্রে মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন, বুবু পড়ে না, কলু পড়ে।- রোজ রাত্রে, রবিবার ছাড়া। কলু কত সময়ে সেই দুজনের কথা ভাবে, সন্ধি-সমাস গোল হয়ে যায়, মাস্টারমশাই রেগে কাঁই! বলেন, "ওরে আহাম্মক! আমার ছেলে বিধুশেখর তোর অর্ধেক বয়েসে তোর তিনগুণ পড়া শিখত।”

ছেলে বটে ঐ বিধুশেখর। তার কথা শুনে শুনে কলু তো হেদিয়ে গেল। সে কক্ষনো হাই তুলত না, কক্ষনো চেয়ারে ম্যুচ্ শব্দ করত না, কক্ষনো চটি নাচাত না। প্রথম প্রথম কলু ভাবত তা হলে সে বোধ হয় এত দিনে নিশ্চয় মরে গিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাই বলেছেন সে নাকি বিয়ে করে কোথায় পোস্টমাস্টারি করে।

একদির বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনেছিল। বলেছিল ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি, কোন কবিরাজের কাছ থেকে এনেছে। নাকি অনেকদিন আগে মানুষদের পূর্বপুরুষরা বাঁদর ছিল, সেই বাঁদুরে রক্ত মানুষের গায়ে আছেই আছে, ঐ আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে-ঐ একরকম ধাত কিনা! কলু তার দুটো বড়ি চেয়ে রাখল, কাজে লাগতে পারে।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বহুদূরে, উনি তবু রোজ ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হতেন। কী সখ বাবা পড়াবার! মাঝে মাঝে দাদারা এসে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ত, কলুকে শব্দররূপ মুখস্থ করতে হত। কলুর চোখ বুজে আসত, মাথা ঝিঝিম্ করত, আর দাদারা শুধু কথাই বলত। কলু দড়িবাঁধা ছেলেটার কথা ভাবত, আর শুনতে পেত পাশের বাড়ির ছোট ছেলেরা খেতে বসে হল্লা করছে। আর ভাবত,, এমন অবস্থায় পড়লে মাস্টারমশাইয়ের ছেলে সেই বিধুশেখর কী করত।

এক-একদিন যেই পড়া শেষ হয়ে আসত, বাইরে ঝঝম্ করে বৃষ্টি নামত। মাস্টারমশাই হয়তো বাড়িতে, ছাতা ফেলে আসতেন, 'আটকা পড়তেন ।

কলু ব্যস্তভাবে বলত, "ছাতা এনে দিই, ভালো ছাতা ?"

মাস্টারমশাই বলতেন, "না না, থাক, থাক্। একটু বসে যাই।" কলু আবার সেই ম্যুচে চেয়ারটাতে বসত।

মাস্টারমশাই তাঁর ছোটবেলাকার অনেক গল্প বলতেন। তখন বাবাও নাকি ছোট ছিলেন, একসঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন, পুজোর সময় কাদের বাড়ি যাত্রাগান হত, পালিয়ে গিয়ে শুনতেন। কলুর চোখ জড়িয়ে আসত, হাই তুলতে সাহস হত না। ভাবত এতক্ষণে সেই দড়িবাঁধাটা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। হাইগুলো মাথায় গিয়ে জমাট বাঁধত, চমকে জেগে যেত, শুনত মাস্টারমশাই বলছেন, "দে বাবা, ছাতাই দে। এ আর আজ থামবে না।"

কলু ছুটে ছাতা এনে দিত, মাস্টারমশাই চলে যেতেন আর কলুর ঘুমও ছুটে যেত।

এমনি করে দিন যায়। একদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, মাস্টারমশাই বিধুশেখরের কথা বলছেন। সে শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে কক্ষনো বায়স্কোপ দেখে নি, থিয়েটারে যায় নি, বিড়ি টানে নি, গল্পের বই খোলে নি। বলতে বলতে মাস্টারমশাই বললেন, "ওরে, চুপিচুপি দুটো পান সেজে নিয়ে আয় তো দেখি।"

কলু দৌড়ে গেল, পান দিল, চুন দিল, দুটো করে এলাচ-দানা দিল, বড়ো-বড়ো সুপুরির কুচি দিল, আর সব শেষে কি মনে করে বদ্যিনাথের সেই আশ্চর্য বড়িও একটা করে গুঁজে দিল।

মাস্টারমশাই একটা পান তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন, একটা বইয়ের মতন দেখতে টিনের কৌটোতে ভরলেন। কলু তাক করে রইল। প্রথমটা কিছু মনে হল না-তার পর ভালো করে দেখল, মনে হল মাস্টারমশাইয়ের কপালের দিকটা কিরকম যেন লম্বাটে দেখাচ্ছে, থতনিটা যেন ঢুকে পড়েছে, চোখ দুটোও কিরকম পিপিট করতে লাগল।

কলুর বুকের ভিতর কেমন চিল্লি করতে লাগল। মাস্টারমশাই বাড়ি যান না কেন? যদি হঠাৎ ল্যাজ দুলিয়ে হুপ্ করেন? এমন সময়ে বৃষ্টি থেমে গেল, মাস্টারমশাই ধুতির খুঁটটা কাদা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে গেলেন। কলু ভাবতে লাগল, কদিন আর ধুতির খুঁট? অন্য পানটা বিধুশেখর বোধ হয় আজ রাত্রে চেয়ে নেবে, তার পর সেই-বা ধুতি নিয়ে করবে কি!

পরদিন বিকেলে বই নিয়ে কলু অনেকক্ষণ বসে রইল, কিন্তু মাস্টার- মশাই এলেন না। সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, "ওরে তোর মাস্টারমশাই যে হেডমাস্টার হয়ে বিষ্ণুপুর চলে গেলেন।"

কলু ভাবল, বিষ্ণুপুর কেন, কিঙ্কিন্ধে হলেও বুঝতাম!

তার পর বহুদিন চলে গেছে। কলুর নতুন মাস্টার এসেছেন, তাঁর ছেলের নাম বিধুশেখর নয়, তাঁর ছেলেই নেই। তিনি কলুকে রোজ ফুটবলের, ক্রিকেটের গল্প বলেন-কিন্তু কলুর থেকে থেকে মনে হয়, অন্ধকারে ও বাড়ির পাঁচিলে দুটো কি ল্যাজঝোলা বসে আছে। একটার মুখ কেমন চেনাচেনা, অন্যটা বোধ হয় বিধুশেখর।



ভূতের ছানা

রাত যখন ভোর হয়ে আসে তখন ঐ তিন-বাঁকা নিমগাছটায় হুতুম প্যাঁচাটারও ঘুম পায়। নেড় দেখেছে ওর কান লোমে ঢাকা, ওর চোখে চশমা, ওর মুখ হাঁড়ি। হুতুমটা কেন যে চিল-ছাদের ছোট খুপরিতে পায়রাদের সঙ্গে বাসা করে না, নেড় ভেবেই পায় না। বোধ হয় ভূতদের জন্যে। নিমগাছতলায় ভূত আছে। একদিন ভোরবেলায়, মই বগলে ছাগলদাড়ি লোকটা রাস্তার আলো নিবিয়ে নিবিয়ে চলে গেলে পর, নেড় দেখেছিল কোমরে রুপোর ঘুন্সি-ওয়ালা, মাথায় গুটিকতক কোঁকড়া চুল, ভূতদের ছোট কালো ছেলে নিমগাছতলায় কাঁসার বাটিতে নিমফুল কুড়চ্ছে। নেড়কে দেখেই ছেলেটা এক চোখ বুজে বগ দেখাল। ভাবল ভূত কিনা তাই ভদ্রলোক নয়। নেড়

তার পর অনেকদিন নেড় অনেক বেলা পর্যন্ত গাঁক্ গাঁক্ করে ঘুম লাগিয়েছে, শেষটা এমন-কি, ডজুদা এসে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়েছে। নেড় কিন্তু একটুও রেগেমেগে যায় নি। ও তো আর সুকুমারদা নয় যে মুখ দেখলে বালতির দুধ দই হয়ে যাবে! ছানাটাকে আর দেখা হয় নি। কিন্তু সেই

শেষটা হঠাৎ একদিন নেড় স্বপ্ন দেখল কালো ছেলেটা ওকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে নাকের ফুটোয় কাগের নোংরা পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাগের চোটে নেড়র ঘুম ছুটে গেল। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথায় সুপুরি বসিয়ে লাগায় খড়ম! খানিক চোখ রগড়ে, জিব দিয়ে তালুতে চুচুক্ করে চুলকে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল মই বগলে সেই লোকটা। তার পর নিমতলার তাকিয়ে দেখল, ভূতের ছানাটা একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে বেজায় হাসছে, যেন কালো ভাল্লুক মুলো চিবোচ্ছে। সে কি বিশ্রী হাসি। গোটাকতক সুট লাগালে হয়।

ছেলেটা নেড়ুকে দেখে আজ আর বগ দেখাল না, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভূতের ছেলে বাবা! বিশ্বাস নেই! নেড়র একটু ভয় করছিল, ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক একবার তাকাল। দেখে কিনা কুঁজোর পিছন থেকে একটা এয়া বড়া টিকটিকি মুণ্ডু বাড়িয়ে, ঘোলাটে চোখ পিট পিট করে ঘুরিয়ে আহাদে আহাদে ভাব করে টিক্-টিক্-টিক্ করে আবার মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে নিল, কেমন যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব। নেড়র ভারি রাগ হল। কি, ভয় পাই নাকি! নেড় আস্তে আস্তে নীচে গেল। দাঁত মাজল না। চোখ ধুল না। তাতে কি হয়েছে! সেই ছেলেটার তো নাকে সদি! নিমতলায় যাবার পথে দেখে দুই দিকে দেয়ালে খুঁটে দেওয়া। কতকগুলো গোলগোল মতন, সেগুলো ধোপার মা দিয়েছে; আর কতকগুলো ঠ্যাংওয়ালা, সেগুলো ধোপার মায়ের মেয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিমতলায় গিয়ে দেখে ছেলেটা কোথায় যেন সটকে পড়েছে। কি জানি তোর হয়ে এসেছে, আলোটালো দেখে উবে গেল না তো!

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় নেড়র দাঁত ব্যথা করছিল, তাই লবঙ্গজল দিয়ে মুখ ধুয়ে জানলার উপর বসে ভাবছিল, আচ্ছা নেপাল খুড়োর কেনই- বা অমন সিন্ধুঘোটকের গোঁফ, আর বিধুদাই-বা কেন দিনরাত টিক- টিক, করেন!

এদিকে ওদের বাড়ির দারোয়ান কি যেন গাইছিল, মনে হচ্ছিল-

"নিমতলাতে আর যাব না, কে-লো-ভূতে-র-কা-লো-ছা-না!"

হঠাৎ শুনল, "এইয়ো!" চমকে আর-একটু হলে ধুপুস্ করে পড়েই যাচ্ছিল! আবার শুনল, "এইয়ো।"

চেয়ে দেখে নিমতলার আবছায়াতে সেই ভূতের ছানাটা। নেড় গল। নামিয়ে হিন্দীতে ফিস্ফিস্ করে বললে, 'হাম শুনতে পাতা।' ছানাটা আবার বাংলায় বললে-“সকালে কি পায় শেকড় গজিয়েছিল ?"

নেড় বললে, "আমি তো গেলুম, তুমিই আলো দেখে চলে গেছিলে।" ছেলেটা বললে, "দুৎ, আলো নয়, বাবাকে দেখে।" নেড় ভাবল-কেন, বাবাকে দেখে চলে যাবে কেন? নেড় শুধু একবার বাবাকে দেখে চলে গিয়েছিল-সেই যেবার দারোয়ানের হুঁকো টেনেছিল। তাই জিগগেস করল-"হুকো টেনেছিলে ?"

ছেলেটা মাথা নেড়ে বললে, "দুৎ। তার থেকে বিড়ি ভালো।" "তোমার বাবা কি গাছে থাকেন?"

"পুৎ! থাকেন না, চড়েন। আমি অনেক তাগ করে থাকি, কিন্তু

কক্ষনো পড়েন না।"

"তিনি কি প্যাঁচা ?"

"দ্যুৎ-!" তার পর ছেলেটা একটা কথা বললে যেটা মা একদম বলতে বারণ করেছেন। নেড় বললে, "ছি!-আচ্ছা, তাঁর পা কি উলটোবাগে লাগানো ?"

এবার ছেলেটা বেদম রেগে গেল। ভুরু কুঁচকে, ফোঁসফোঁস্ করতে লাগল, আর হাতটাকে ঘুঁষি পাকাতে আর খুলতে লাগল, যেন এই পেলেই সাবড়ে দেয়! তার পর কি ভেবে ঠান্ডা হয়ে বললে-"ঐ যে মিস্ত্রীগুলো সারাদিন বাঁশের টং-এ চড়ে তোমাদের বাড়ির বিশ্রী জানলাগুলোতে তোমার গায়ের রঙের মতন বদ সবুজ রঙ লাগায়, ওদের একটা দড়ি- বাঁধা রঙের টিন, আর-একটা বড় চ্যাপটা রঙ লাগাবার জিনিস যদি আমাকে এক্ষুনি না এনে দাও তা হলে তোমাকে, তোমার বাবাকে, তোমার দাদাকে, আর তোমার মাকে কচুকাটা করব। তোমাদের ছোট- খুকিকে পানের মসলা বানিয়ে কঙ্কচিয়ে চিবিয়ে খাব। তোমাদের মাসি-পিসি যে যেখানে আছে তাদের থেঁতলো করব। তোমাদের রুটি- ওয়ালা, ঘিওয়ালা, আর যা যা তোমরা রাখো সবকটাকে লম্বা-লম্বা ফালি করে ছিঁড়ে কাপড় শুকুবার দড়িতে ঝুলিয়ে সুঁটকিমাছ বানাব। আর তোমার যত বন্ধু আছে সবগুলোকে নুনজল দিয়ে কাঁচা কাঁচা গিলে খাব।" বাপ রে, কি হিংস্র খোকা!

নেড় তাড়াতাড়ি একটা টিন আর দু-তিনটে বুরুশ তাকে দিয়ে এল। ছেলেটা ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে হাসতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। রাতে নেড় শুনতে গেল ফিস্ফিস্ করে কারা কথা বলছে। কানে আঙুল দিয়ে শুনল, তবু মনে হল কে যেন বলছে-

'আছে-আছে নিম গাছে।'

নেড় ভাবলে, ওরে বাবা, কি আছে রে?-পান্তভূত? কবন্ধ? পিশাচ? স্কন্ধকাটা? গন্ধবেনে? শাঁকচুন্নি? পেতনি? প্যাস্তাখেঁচী? নেড় তো নাক-মুখ ঢেকে রাম ঘুম লাগাল। 

পরদিন সকালে নীচে যাবার সময় সিড়ির জানলা দিয়ে দেখে, রাস্তায় ও-বাড়ির কর্তা, এ-বাড়ির দারোয়ান, দাদা, বাবা, মন্টুর বাবা, দিন্দা, আরো কত কে। সবাই ঠ্যাং হাত ছুড়ে বেজায় চ্যাঁচাচ্ছে!

নেড় আরো দেখল রাস্তার সব বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সবুজ রঙ দিয়ে নানানরকম চিত্তির করা, পাশের বাড়ির সাদা গেটটা ডোরা কাটা।

হঠাৎ নেড়র চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড় করল- সেই হিংস্র ছানাটা পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে রঙের বুরুশ আর-এক হাতে রঙের টিন, এক কান ও-বাড়ির দারোয়ান ধরেছে, আর-এক কান এ-বাড়ির লছমনসিং। আর ছেলেটা জোরসে চেল্লাচ্ছে। তার পর ভক্ ভক্ করে একটা মোটর ডাকল, আর পথ ছেড়ে

সকলে চলে এলেন। লছমনসিংও কানে শেষ একটা প্যাঁচ দিয়ে খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিল। তার পর ওদের বাড়ির দারোয়ান ওর হাত থেকে খাচা মেরে রঙের টিন আর বুরুশ নিয়ে গেল, হিন্দীতে আর বাঙলাতে বিড় বিড় করে কী সব বলতে বলতে, সুই মারতে মারতে ওদের বাড়ি দিয়ে গেল!

নেড় পাড়াসুদ্ধ সক্কলের সাহস দেখে এমন হাঁ হয়ে গেল যে দেখতেই ভুলে গেল ছেলেটার পা উলটোবাগে লাগানো কি না!




সর্বনেশে মাদুলি

পুজোর ছুটির পর যখন স্কুল খুলল, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম গুপে ডান হাতে মাদুলি বেঁধে এসেছে। কনুইয়ের একটু উপরে ময়লা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা চক্চকে এক মাদুলি। বুঝি, কিন্তু গুপে পরে বলল নাকি পেতলের। মতো হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম সোনার ঘাম লেগে লেগে সোনার

টিফিনের সময় জিগগেস করলাম, "কেন রে?" তাতে সে এক আশ্চর্য কথা বলল।

তার দাদামশাইয়ের নাকি যখন অল্প বয়স, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের তলায় চক্চকে এক কুকুচে কাগের পালক। প্রথমটা খুব খুশি হলেন। ভাবলেন দিব্যি এক খাগের কলম বানিয়ে বন্ধুদের লম্বা-লম্বা চিঠি লেখা যাবে। পরে শিউরে উঠলেন। কি সর্বনাশ! কাগ যে ছুতে নেই, ইয়ে-টিয়ে খায়, তার পালক বালিশের তলায় এল কোত্থেকে? আর কেউ দেখবার আগেই সেটাকে জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে উঠোনে ফেলে দিলেন।

কিন্তু কি আশ্চর্য, তার পরদিনও ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের নীচে আবার আরেকটা কাগের পালক! এবার আর কোনো সন্দেহই নেই, দস্তুরমতো কাগ কাগ গন্ধ পর্যন্ত পেলেন। দাদামশাই সেইদিনই মাছ-মাংস খাওয়াই ছেড়ে দিলেন, চুল ন্যাড়া করলেন, পাশের বাড়ির লোকদের তাদের গাছ-ছাঁটা কাঁচিটা ছমাস বাদে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন, গঙ্গাস্নান করলেন।

স্নান করে উঠে, ঘাটের উপর দেখেন দিব্যি ফোঁটা কাটা, তিলক আঁকা, জটাওয়ালা, গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসী-বাবা হাসি-হাসি মুখ করে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছেন। দাদামশাই তাঁকে ঢিপ্‌ করে প্রণাম করলেন। অমনি সন্ন্যাসী তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের উপর ঐ লাল সুতো দিয়ে মাদুলিটা বেঁধে দিয়ে দাদামশাইয়ের ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, "কুচ্ ডর্ নেই বেটা। শাঁপখোঁপ সব কেটিয়ে যাবেন!" দাদামশাইয়ের ঘাড়ে খুব সুড়সুড়ি লাগা সত্ত্বেও তিনি শুধু একটু

কিবিল্ করে বললেন, "ঠিক বলছ তো ঠাকুর?"

গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সন্ন্যাসী-ঠাকুর ঝুলির মধ্যে থেকে সুতো বাঁধা এক চশমা বের করে নাকে পরেই আঁৎকে উঠে বললেন, "য়্যা! এ কি আছে রে? আরে হামি তো তোমাকে চিনতে পারে নি, উ মাদুলি পল্টু জমাদার কো আস্তে বনায়া, দে দেও রে বেটা, উ তোমারা নেহি!"

কিন্তু কে শোনে? দৈবাৎ অমন মাদুলি মানুষের জীবনে এক- আধবার ঘটে যায়। তাকে কি অমনি অমনি দিয়ে দেওয়া যায়? দাদামশাই ছপাত করে মালকোঁচা মেরে দে দৌড়!

বাড়ি এসে অবাক হয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির আমগাছের যে ডাল পাকা পাকা আমসুদ্ধ তাঁদের উঠোনের উপর ঝুলছিল, অথচ পাছে নেপালবাবু পুঁতে ফেলেন সেই ভয়ে কিছু করা যাচ্ছিল না, সে-সব আম আপনি আপনি দাদামশাইয়ের উঠোনে পড়ে গেছে। আরো দেখা গেল নতুন কুয়োতেও ভোর থেকে ঠান্ডা মিষ্টি জল আসছে! রাত্রে ফেলাদা পুকুরে যে ছিপ ফেলে রেখেছিল তাতে মস্ত এক কাতলা মাছ পড়েছে! বেলা না হতেই দাদামশাইয়ের শালা, গত নিয়েছিল, নিজে থেকে ফেরত দিয়ে গেল! বছর যে পাঁচ টাকা ধার উপরন্ত রবিবার দুপুরে নেমন্তন্ন করে গেল! বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখলেন এমন-কি, দিদিমার পর্যন্ত হাসিমুখ।

মাদুলির গুণ দেখে দাদামশাই অবাক। মনে মনে সন্ন্যাসী-বাবার ময়লা পায়ে শত শত প্রণাম করলেন।

সেই থেকে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরে গেল। টাকাপয়সা হল, গোরু- ভেড়া হল, ছেলেরা বড়-বড় চাকরি পেল, মেয়েদের ভালো ভালো বিয়ে হল। এমন-কি, মামার বাড়ির গোরুর দুধের ক্ষীর, গাছের আম, আর পুকুরের মাছের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনার চোটে গুপে 'লোম- হর্ষণ সিরিজ'-এর বিশ নম্বর বইয়ের পাঁচ ছটা পাতার কোনা কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলল।

আরো বলল, "এই সেই মাদুলি। একচল্লিশ বছর এক মাস দাদা- মশাইয়ের হাতে বাঁধা ছিল, একদিনের জন্যও খোলা হয় নি, দাদামশাইয়ের হাতে সুতো বাঁধা মাদুলির সাদা দাগ পড়ে গেছে, গায়ে লেগে শেষটা এমন হয়েছিল যে মাঝেমাঝে নাকি মাদুলিটার উপরও চুলকত!"

সেই মাদুলি দাদামশাই এক কথায় গুপের হাতে বেঁধে দিয়েছেন কারণ গুপে বায়না ধরেছিল যে মাদুলি না দিলে নাকি সে তেলও মাখবে না, চানও করবে না, ভাতও খাবে না! আর যদি খায়ও তা হলে এত কম খাবে যে কিছুদিন বাদে পেট না ভরে ভরে হাত-পা ঝিঝিম্ করবে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, চোখ উলটে যাবে-এই অবধি শুনেই দাদামশাই কানে হাত দিলেন ও তখুনি পট্ করে মাদুলির সুতো ছিড়ে সেটাকে গুপের হাতে বেঁধে দিলেন।

গুপে দেখল মাদুলির গুণ একটুও কমে নি। আধ ঘণ্টার ভিতর 'ছোটমামার ফাউন্টেন পেনের নিব খারাপ হয়ে গেল, ছোটমামা সেটা ভপেকে দিয়ে দিল। পরে অবিশ্যি আবার চেয়েছিল, তাইতেই তো গুপে 'ছুটির দুদিন বাকি থাকতেই মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিল।

বাড়ি এসেই শোনে মাস্টারমশাইয়ের মাম্পস হয়েছে, গাল ফুলে চাল- কুমড়ো, সেরে যদি-বা ওঠেন তবু একটি মাসের ধাক্কা।

এর পর গুপে যা তা বলতে আরম্ভ করল। নাকি মাদুলি হাতে পরা থাকলে গুপে যখন যা বলবে তাই ঘটতে বাধ্য। এ কথা শুনে আমরা সবাই ভীষণ আপত্তি করলাম, তা কি কখনো হয়?

নগা বলল, "এক যীশু ছাড়া আর কেউ-"

গুপে ভীষণ রেগে সরু লম্বা ময়লা নখওয়ালা একটা আঙুল নগার দিকে বাগিয়ে বলল, "আজ বলে দিলাম তুই ভূগোল ক্লাসে দাঁড় খাবি।" ওমা! সত্যি সত্যি ভূগোল ক্লাসে নগা দাঁড় তো খেলই, তার উপর কান মলাও খেল! এর পর আর কারুর কিছু বলবার জো নেই। গুপে একবার মাদুলির দিকে তাকালেই হল, সে যখন যা বলে সবাই তা. মেনে নেয়। যখন যা চায় সবাই তাই দিয়ে ফেলে।

তিন সপ্তাহ ক্লাসসুদ্ধ সবাই গুপের দৌরাত্ম্যে খাবি খেলাম। সে যা খুশি তাই করতে আরম্ভ করল। এমন-কি, কালীপদর চুল ছাঁটা পছন্দ হচ্ছিল না বলে সে বেচারাকে ন্যাড়া করিয়ে ছাড়ল।

সবাই দিন দিন রোগা হয়ে যেতে লাগলাম। নগার তো পেন্টেলুন এমন ঢিলে হয়ে গেল যে শেষে তার দাদা তাই নিয়ে টানাটানি। বলে কিনা-"দেখছিস না, ও আমার, তোর গায়ে বড় হচ্ছে। হয় আমার, নয় বাবার।"

এদিকে যার যা ভালো জিনিস গুপে সব গাপ্ করতে লাগল। পেনসিল, রবার, পেনসিলকাটা, রঙিন খড়ির বোঝায় গুপের পকেট ঝুলে ঝুলে ছেঁড়ে আর কি! শেষে কিনা সে-সব রাখবার জন্যে আমার নতুন টিফিনের বাক্সটা একদিন চেয়ে বসল। তখন আমি বেজায় চটে গেলাম। একটু তোতলামি এসে গেল। মাথাটাথা নেড়ে বললাম- "দ্যা-দ্যাখ গুপে, দিন-দিন তোর বাড় বাড়ছে। কাল তোর সব অঙ্ক কষে দিয়েছি। আমার টিফিনের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছিস। ইংরেজি ক্লাসে ছুরি ফট্ ফট্ করেছিস আর তার জন্য বকুনি খেয়েছি আমি। বেশি বাড়াবাড়ি করিস নে বলে দিলাম!"

এক নিঃশ্বাসে রাগের মাথায় এতগুলো কথা বলে দেখি গুপে আমাকে শাপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছোট হয়ে আলপিনের ডগার মতো হয়ে গেল, ঢোক গিলে, গলা হাঁকড়ে, আঙুল বাগিয়ে, খন্থনে গলায় বলল-"আজ তোর জীবনের শেষদিন। দিনটা কাটলেও রাত কাটবে না।" ক্লাসময় একটা থমথমে চুপচাপ। তার মধ্যে নরেনবাবু এসে গেলেন, আর কিছু হল না।

একটু পরেই আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগল, নিঃশ্বাসটা কিরকম জোরে জোরে পড়তে লাগল, চুলের গোড়াগুলো শির- শির্ করতে লাগল, পেটের ভিতর কেমন ফাঁকাফাঁকা মনে হতে লাগল। বুঝলাম মাদুলির শাপ আমার লেগেছে! কিছু পড়া-টড়া শুনলাম না, হোমটাস্ক টুকলাম না, ড্রইং ক্লাসে বেয়াদপি করলাম। যার দিন কাটলেও রাত কাটবে না, তার আবার ভাবনা কি? টিফিন বাক্সটা ক্লাসের মধ্যেই নগার হাতে ঠুসে দিলাম, আমি মরি আর গুপে সেটা ভোগ করুক আর কি! ছুটির ঘণ্টা পড়লে পর মনে হল, আমি তো গেলাম, যাবার আগে ঐ সর্বনেশে মাদুলিটাকে শেষ করে তবে যাব।

দেখি গুপেদের পুরনো চাকর ভদ্দু গুপের বই গুছিয়ে নিচ্ছে, আর গুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। হঠাৎ খুন চড়ে গেল, ছুটে গিয়ে এক সেকেন্ডে মাদুলিটা কেড়ে মাড়িয়ে ভেঙে একাকার! তার থেকে অন্তত ধোঁয়াও বেরুনো উচিত ছিল, কিন্তু কিছু হল না। গুপে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওদের চাকরটা হাঁই হাঁই করে ছুটে এসে হাত-পা ছুড়ে বললে-"য়্যাঁ, কি করলে! আমার পেট-ব্যথার অব্যর্থ মাদুলি, আমি কালীঘাট থেকে দুপয়সা দিয়ে কিনে এনেছি। আগেই জানি গুপিদাদাকে যা দেওয়া যাবে তাই আর কিছু থাকবে না!"

আমরা সবাই হাঁ করে গুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার নিশ্চয় কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু সে অমানবদনে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভদ্দুকে ছুড়ে দিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বাড়ি চলে গেল।


সিঁড়ির মোড়ে বিপদ

নন্দর আজ বেজায় মন খারাপ। সেই সকাল থেকে সব জিনিসকে কিসে যেন পেয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই ভোঁদাকে ঠ্যাঙাতে গিয়ে অত ভালো হকি স্টিক্টার হ্যান্ডেলের সুতো কতখানি এল খুলে! তায় আবার ভোঁদা হতভাগা এমনি চেঁচাল যে বড়মামা এসে নন্দর কান পেঁচিয়ে মাথায় খটাং খটাং করে দুই গাঁট্টা বসিয়ে দিলেন।

তার পর, সেই দেয়ালে কাজলকালি দিয়ে কুকুর তাড়া করছে, মোটা লোকটার ছবি আঁকবার জন্যে বাবা মন্টুর সঙ্গে সেই চমৎকার জায়গায় সেই মজার জিনিস দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। নন্দ আর কি বলে! ছি, মন্টুই-বা কি ভাবল বল তো? নাঃ। বুড়োরা যে কেন পৃথিবীতে জন্মায় বোঝা যায় না!

আচ্ছা, অন্যদের বাড়ির লোকেরাও কি এমন হাঁদা? এরা কিছু-বোঝে না। এই তো কালই দিদির নাগরাইয়ের শুঁড় পাকিয়ে দেবর জন্য দিদি চাঁটাল। আচ্ছা, গুঁড় পাকিয়ে কী এমন খারাপটা দেখাচ্ছিল? ভারি তো নাগরাই! এর চেয়ে আর কোথাও চলে যাওয়া ভালো-ইজিপ্টে যেখানে নীল নদীর ধারে ফ্লেমিঙ্গো পাখিরা মাছ ধরে খায়, আর মস্ত-মস্ত কুমিররা বালির উপর রোদ পোহায়। নয় তো মানস সরোবরে যেখানে একশো বছরে একটা নীল পদ্মফুল ফোটে। সেজদা বলেছে, কাগজে আছে কারা নাকি ছোট-ছোট ঘোড়ার পিঠে বোঁচকা বেঁধে, টিনের দুধ, বিস্কুট কম্বল-টম্বল নিয়ে সেখানে যাচ্ছে।

কিম্বা তাদের ছেড়ে নন্দ আরো উপরে যাবে, যেখানে লোমওয়ালা মানুষরা কিসের জানি রস খায়, সে খেলেই গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিম্বা-যাবার তো কত জায়গাই আছে!

খিদিরপুরের ডকেই যদি কাজ নেয় কে খুঁজে পাবে! সেই যে একবার নন্দ দেখেছিল, একটা পুলের তলায় ইট দিয়ে উনুন বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে কি রেঁধে খাচ্ছিল কারা সব, ডকের কুলি হবেও-বা। সেইরকম করে থাকবে। কিম্বা যারা গান করে করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের সঙ্গেও তো জুটে যাওয়া যায়। গোরুর গাড়ি নিয়ে মেলাতে মেলাতে বেড়ানো যাবে। কিন্তু তার আবার একটা অসুবিধে আছে। দিদিকে গান শেখাতে এসে গোপেশ্বরবাবু বলে গেছেন, কোকিলের ডিম ভেঙে খেলেও এ ছেলের কিছু হবে না।

গান করতে না পারুক, গোরুর গাড়ি তো চালাতে পারবে! হঠাৎ একটা ভীষণ সংকল্প করে নন্দ সটান উঠে একেবারে ঘোরানো সিঁড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

মা বলেছেন, 'খবরদার ও দরজা খুলবি নি। বিপদে পড়বি।' কি বিপদ অনেক ভেবে নন্দ মাসিমাকে জিগেস করেছিল। মাসিমা বলেছিলেন, 'ওরে বাবা। সে ভীষণ বিপদ!'

'কি ভীষণ?' জিগেস করাতে আবার বললেন, 'সিঁড়ির মোড়ে মোড়ে বেজায় হিংস্র লোকেরা নাকি বাঁকা ছুরি হাতে চক্চকে চোখ করে ওৎ পেতে আছে সারা রাত, ভোরবেলা গঙ্গায় জাহাজের বাঁশিগুলো যেই বেজে ওঠে ওরাও কোথায় আবছায়াতে চলে যায়।' নন্দ জানতে চাইল তারা কোত্থেকে এসেছে। মাসিমা বললেন, 'কেউ এসেছে জাভা থেকে, কেউ সানফ্রানসিস্কো, কেউ কাম্বোডিয়া থেকে। আউটরাম ঘাটের কাছে তাদের জাহাজ নোঙর দেওয়া আছে, জাহাজের পাশের রেলিং-না- দেওয়া সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে রাত দুপুরে নেমে এসেছে, ভোর না হতেই আবার ফিরে গিয়ে জাহাজের নীচে অন্ধকার ঘরে প্রকান্ড উনুনে কয়লা পুরবে।"

একবার অনেক রাতে নন্দ কোথা থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ঘরে ফিরছিল। তখন নিজের চোখে দেখেছিল ছোট-ছোট টিমটিমে আলো নিয়ে কারা যেন ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করছে। তাই দরজার সামনে এসে নন্দ একবার থামল। বেশ রাত হয়েছে, বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে, কেমন অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে। হাওয়া তো রোজই দেয় আজকাল, কিন্তু এরকম তো কখনো মনে হয় না।

নন্দ দরজা খুলল, চামচিকের খোকার কান্নার মতন একটা শব্দ হল। একটা বড় সাইজের ঠ্যাঙে লোমওয়ালা মাকড়সা সড় সড়, করে নন্দর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।

প্রথম সিঁড়িতে পা দেবার আগে নন্দ উপর দিকে তাকাল। যতদূর দেখা যায়, সিঁড়ি ঘুরে পাঁচতলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, আর নীচের দিকে যতদূর দেখা যায় ঘুরে ঘুরে একতলার শানবাঁধানো গলি পর্যন্ত নেমেছে। সিড়ির রেলিংটা ক্যাঁ-কোঁ করে নড়ে উঠল, কার জুতো জানি চাপাগলায় ম্যুচ্ করে উপর থেকে নেমে আসতে লাগল। নন্দর হাত-পা হিম হয়ে গেল, অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে চ্যাপটা হয়ে টিক্টিকির মতন লেগে রইল।

তার পর দেখল বুড়ো-আঙুল-বার-করা, জিব-কাটা ছেঁড়া হলদে বুট পায়ে, তালি-দেওয়া সুতো-ঝোলা লম্বা পেন্টেলুন পরা দুটো ঠ্যাঙ সিঁড়ির বাঁক ঘুরে নামতে লাগল। তার পর দেখল, পিঠে তার মস্ত ঝুলি, থুতনিতে খোঁচা দাড়ি, নাকের উপর আঁচিল, তার উপর তিনটে লোম, ন্যাড়া মাথায় নোংরা টুপি-বোধ হয় সেই হিংস্র লোকদের কেউ একজন! ভয়ের চোটে নন্দর একপাটি চটি ছিটকে খুলে, সংঠং করে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে চলল, আর সেই হলদে বুট পরা হিংস্র লোকটা থতমত খেয়ে বোঁচকা ফেলে দে ছুট।

নন্দর কিন্তু আর কিছু মনে নেই। কেমন ভেড় বানিয়ে গিয়েছিল! লোকটা কিন্তু নিজেই টেনে কোথায় দৌড় লাগাল! এদিকে পাঁচতলার লোকেরা আজও গল্প করে নন্দ নামে একটি ছোট

ছেলে চোর ভাগিয়ে জিনিস বাঁচিয়েছিল।

শুনে শুনে নন্দ মনে ভাবে-বুড়োরা কি হাঁদা! কিন্তু বাইরে কিচ্ছু বলে না, চালাক কিনা!





ঘোতন কোথায়

সকালে খুব দেরি করে উঠলাম। উঠেই গায়ের চাদরটা এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারই উপর দাঁড়ালাম। চটি খুঁজে পেলাম না। খালি পায়ে স্নানের ঘরে গেলাম। দাঁত মাজলাম না, তাতে যে সময়টুকু বাঁচল সে সময়টা কলের মুখ টিপে ধরে পিচকিরির মতন দেয়ালে-টেয়ালে জল ছিটোলাম। খানিকটা আবার বাবার তোয়ালের উপরও পড়ল দেখলাম। তার পর চোখেমুখে জল দিয়ে, মুখহাত মুছে সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ঘরের কোনায় ছুড়ে মারলাম।, তার পর একমুখ জল ভরে নিয়ে, শোবার ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে নীচে রাস্তায় একজন বুড়ো লোকের গায়ে পুচ্ করে ফেলেই তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চুলটাকে খুব যত্ন করে আঁচড়াতে লাগলাম।

ততক্ষণে নীচের তলায় মহা সোরগোল লেগে গেছে। পিসিমা দুধের বাটি নিয়ে বলছেন, "ঘোতন কোথায়?" মা আমার চটিজোড়া নিয়ে বলছেন, "ঘোতন কোথায়?" আর সব থেকে বিরক্ত লাগল শুনে যে মাস্টারমশাই সেইসঙ্গে ম্যাও ধরেছেন, "প্রশান্তকুমার কি আজ পড়বে না ?” ভীষণ রাগ হল। জীবনে কি আমার কোনো শান্তি নেই? এই সক্কালবেলা থেকে সবাই পেছু নিয়েছে।

পিসিমাকে সিঁড়ির উপর থেকে ডেকে বললাম, "দুধ খাব না।" সিড়ির নীচে নেমে এসে মাকে বললাম, "চটি পরা ছেড়ে দিয়েছি।" বসবার ঘরে গিয়ে গলা নিচু করে মাস্টারমশাইকে বললাম, "মা বলে দিয়েছেন, আজ আমার পেট-ব্যথা হয়েছে, আজ আমি পড়ব না।" তার পর একেবারে তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সারাটা সকাল রোয়াকে রোদ্দুরে বসে বসে পা দোলালাম, আর রাস্তা দিয়ে যত ছ্যাকড়া গাড়ি গেল তার গাড়োয়ানদের ভ্যাংচালাম।

দশটা বাজতেই উঠে গিয়ে বই-টই কতক-কতক গুছিয়ে, আর কতক-কতক খুঁজেই পাওয়া গেল না বলে ফেলে রেখে, ঝুঝুপ্ করে একটু স্নান করে নিয়ে, খুব যত্ন করে চুলটা ফের আঁচড়ে নিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।

মা জলের গেলাস দিতে-দিতে বললেন, "হ্যাঁ রে, মাস্টারমশাই কখন গেলেন? শুনতে পেলাম না তো ?"

আমি সত্যি করেই বললাম, "সে কখন চলে গেছেন কে-বা তার খবর রাখে।"

ভাত কতক খেলাম, কতক চার পাশে ছড়ালাম, কতক পুসিকে দিলাম, আর কতক পাতে পড়ে রইল। মাছটা খেলাম, ডাল খেলাম, আর ঝিঙে, বেগুন ইত্যাদি রাবিশগুলো সব ফেলে দিলাম। মা রান্নাঘর থেকে দেখতেও পেলেন না। ট্রামভাড়াটা পকেটে নিয়ে মাকে বললাম, "মা, যাচ্ছি।" এই পর্যন্ত প্রায় রোজই যেমন হয় তেমনই হল। অবিশ্যি মাস্টারমশাইয়ের ব্যাপারটা রোজ হয় না, তাই যদি হত তা হলে বাবা- টাবাকে বলে মাস্টারমশাই এক মহা কান্ড বাধাতেন সন্দেহ নেই।

কিন্তু এর পর থেকে সেদিন সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল।

মনে আছে ট্রামে উঠে ডানদিকের একটা কোনা দেখে আরাম করে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর খালি মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে দেখছে। একবার ট্রামসুদ্ধ সবাইকে দেখে নিলাম- বুঝতে পারলাম না কে। তার পর আবার যেই বাইরে চোখ ফিরিয়েছি আবার মনে হল কে আমাকে এমন করে দেখছে যে আমার খুলি ভেদ করে ব্রেন পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তাইতে আমার ভারি ভাবনা হল। এমনিতেই নানান আপদ তার উপর আবার ব্রেনের ভিতরকার কথাগুলো জেনে ফেললে তো আর রক্ষে নেই।

কিছুতেই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা ঘুরিয়ে ট্রামের প্রত্যেকটি লোককে ভালো করে দেখলাম।

এবার লক্ষ্য করলাম ঠিক আমার সামনে কালো পোশাক-পরা একটি অদ্ভুত লোক। তার মুখটা তিনকোনা মতন, মাথায় গাধার টুপির মতন কালো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে লাল নীল হলদে সবুজ চক্রা- বক্সা তারা-চাঁদ আঁকা, পায়ে শুঁড়ওয়ালা কালো জুতো, দুই হাঁটুর মাঝে হাতে ঝুলছে একটা সন্দেহজনক কালো থলে।

এরকম লোক সচরাচর দেখা যায় না। তাকিয়ে থাকতেই ভীষণ চমকে উঠলাম। অবাক হয়ে একটুক্ষণ দেখলাম, মাথায় টুপি নয়, চুলটাই কিরকম উঁচু হয়ে বাগিয়ে আছে। গায়ে সাধারণ ধুতির উপর কালো আলোয়ান, তাতে ট্রামের হাতের কাছের রঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে রঙবেরঙ হয়ে আলো পড়েছে। আর পায়ে নাকতোলা বিদ্যাসাগরী চটি। খালি হাতের থলেটা সেইরকমই আছে। কিরকম একটু ভয়- 'ভয় করতে লাগল।

লোকটা খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল। তার পর স্পষ্ট গলায় বলল, "অতই যদি খারাপ লাগে ইস্কুলে যাও কেন? বড়রা যখন এতই অবুঝ তাদের কথা মেনে নাও কেন?"

আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তবে কী করব?"

লোকটি বলল, "কী করবে? ছোট সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। রঙের রোদ মেখে বসে আছে। তাকিয়ে দ্যাখ নীল আকাশে ছোট- গাছেরা সব ভিজে পাতায় সোনালি গড়ের মাঠের ধার ঘেঁষে পুকুরটাকে দ্যাখ, ঘোর সবুজ জলে টলমল করছে। আর, টের পাচ্ছ দখিন হাওয়া দিচ্ছে?"

তার পর লোকটা তার বড়-বড়-ফুটোওয়ালা নাকটা তুলে বাতাসে কি যেন শুঁকে বলল, "হু", পেঙ্গুইনের গন্ধ পাচ্ছি। গড়ের মাঠের ওপারে, গঙ্গার ওপারে, বঙ্গোপসাগরের ওপারে, ভারত মহাসাগরের ওপারে, কোনো একটা বরফ-জমা দ্বীপের উপর সারি সারি পেঙ্গুইন চলাফেরা করছে, তাদের মুখেচোখে রোদ এসে পড়েছে। ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে, দু-একটা সাদা নরম পালক উড়ে গিয়ে এখানে-ওখানে পড়ছে- দেখতে পাচ্ছ না?"

কী আর বলব, তখন আমি যেন স্পষ্ট ঐ-সব দেখতে পেলাম, আর আমার সমস্ত মনটা আনচান করে উঠল। মনে হল, এমন দিনে কি কেউ ইস্কুলে যায়? এমন পৃথিবীতে কোনোদিনও কেউ ইস্কুলে যায়? আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে আরেকটু আস্তে আস্তে বলল, "জানো, ভোর রাতে বড়-বড় চিংড়িমাছ ধরতে হয়, তার এক-একটার ওজন একসেরের বেশি। দুদিন ধরে সমুদ্রের নীচে দড়ি-বাঁধা সব হাঁড়ার মতন জিনিস ডুবিয়ে রাখতে হয়। আর ভোরবেলা গিয়ে ঐ দড়ি ধরে টেনে হাঁড়াসুদ্ধ চিংড়ি তুলতে হয়। তার পর বাড়ি ফেরবার সময় আস্তে আস্তে সকাল হয়। তুমি তো জানো যে পুব দিকে সূর্য ওঠে, কিন্তু এ কথা জানো কি যে পশ্চিম দিকের আকাশটা আগে লাল হয়, তার পর পুব দিকে সূর্য ওঠে! তারও পর পশ্চিম দিকের লাল রঙ মিলিয়ে যায়, আর সমস্ত আকাশটা ফিকে পোড়া ছাইয়ের মতন হয়ে যায়। তারাগুলোকে নিবে যেতে কখনো দেখেছ কি?"

• আমার মনে হল আমার নিশ্চয় এখানে কিছু বলা উচিত কিন্তু আমার জিব দেখলাম শুকনো কাঠের মতন হয়ে গেছে। কিছু আর বলা হল না। খালি মনটা হু-হু করতে লাগল। সে লোকটা আমার দিকে আরো ঝুঁকে পড়ে বলল, "কী জন্য কলকাতায় পড়ে থাকো আর ইস্কুলে যাও? জানো রবি ঠাকুর ইস্কুল পালিয়ে-পালিয়ে অত বড় কবি হয়েছিলেন! আর জানো সাঁওতাল পরগনায় যখন মহুয়া ফল পাকে, তার গন্ধে জঙ্গলসুদ্ধ সব জিনিসে নেশা লেগে যায়। আর বনের ভালুক- গুলো মহুয়া খেয়ে খেয়ে নেশায় বেহুশ হয়ে গাছতলায় পড়ে থাকে।

পরদিন সকালে কাঠুরেরা তাদের ঐরকম ভাবে দেখতে পায়। তুমি জানতে যে মহুয়া ফল খেলে নেশায় ধরে?"

আমার তখন মনে হল দিনের পর দিন ইস্কুলে গিয়ে আমি বৃথাই জীবন নষ্ট করেছি। ঐ লোকটা নিশ্চয় কখনো ইস্কুলেই যায় নি।

হঠাৎ দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে অম্লান-বদনে বলল, "এসো!" এমন করে বলল যেন বহুক্ষণ থেকে ঐরকমই কথা ছিল। ও-ও নামবে আর সেই সঙ্গে আমিও নামব।

আমি নামলাম। যদিও আমি জানতাম অচেনা লোক ডাকলে সঙ্গে যেতে নেই। যদিও দিনের পর দিন পিসিমা বলেছেন, "দুষ্টু লোকেরা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে হয় আসামের চা-বাগানে চালান দেয়, নয় ঘোর জঙ্গলে মা-কালীর কাছে ঘ্যাঁচ্ করে বলি দেয়।

তবুও আমি নামলাম। কারণ রোজ ঐ ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পড়া তৈরি করা, স্নান করে ভাত খাওয়া, ইস্কুলে যাওয়া, ইস্কুল থেকে সারাটা দিনমান নষ্ট করে বিকেলে আবার বাড়ি ফেরা, সেই খাওয়া, সেই শোয়া-ঐরকম দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর-যতদিন না অনিশ্চিত ভবিষ্যতে, কবে আমি বড় হয়ে ভালো চাকরি করে এই-সব জিনিসের ভালো ফল দেখাব-ও আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।

বইগুলো ট্রামের কোনায় আমার জায়গায় পড়ে রইল। আমি সেই লোকটার সঙ্গে গেলাম।

তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছে।

সে আমাকে একটা চায়ের দোকানের ভিতর দিয়ে পিছন দিকের ছোট একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল, সঙ্গে একটা একচোখো লোক, অন্য চোখটার গায়ে একটা সবুজ তাপি মারা। একটা পা আছে, আরেকটা পা কাঠের তৈরি।

এই লোকটা আমার দিকে এক চোখ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, "কি হে ছোকরা, পড়াশুনোর উপর নাকি এমনই ঘেন্না ধরে গেছে যে একেবারে সে-সব ত্যাগ করে এসেছ?" তার গলাটা এমন কর্কশ আর চেহারাটাও এমন বিশ্রী যে আমি সত্যি ভারি ভড়কে গেলাম।

কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকাতেই সে গ্রামোফোনের. কাকতির মতো বলে যেতে লাগল, "পড়াশুনো করে কী হবে? জানো, 'আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যে-সব বিরাট বিরাট নদী আছে তার ধারে ধারে কুমিরেরা আর হিপোপটেমাসরা শুয়ে-শুয়ে দিন কাটায় আর লম্বা লাল ঠ্যান্ডে ভর দিয়ে গোলাপি রঙের ফ্লেমিঙ্গো পাখিরা রোদ পোহায়। আর ঐ-সব জঙ্গলের মধ্যে এমন বিশাল বিশাল অরকিড জাতীয় ফুল ফোটে যে তার মধ্যে একটা মানুষ দিব্যি আরামে শুয়ে থাকতে পারে!"

বুঝতে পারছিলাম এ-লোকটা জাদু জানে। কারণ তক্ষুনি আমার ভয়-টয় কোথায় উড়ে গেল-অন্য লোকটাকে জোর গলায় বললাম, "হ্যাঁ, সে-সব চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এসেছি।"

লোকটা হাসল, বলল, " 'চিরদিন' বড় দীর্ঘকাল হে ছোকরা। চিরদিনের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু তোমার সাহস আছে, উৎসাহ আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। স্বাস্থ্যটাও তো ভালো দেখছি। আশা করি বাড়ির জন্য মনের টান ইত্যাদি কোনো দুর্বলতা নেই?"

হঠাৎ মনে হল মা এতক্ষণে স্নানের জোগাড় করছেন, বাবা আপিস গেছেন, এবং দুজনেই মনে ভাবছেন আমি বুঝি ইস্কুলে গেছি। গলার কাছটা সবে একটু ব্যথা করতে শুরু করেছিল এমন সময় কালো কাপড় পরা লোকটা বলল, "ইস্কুলের বাইরে, কলকাতা থেকে বহু দূরে নরওয়ের উত্তরে চাঁদনি রাতে হারপুন দিয়ে তিমি শিকার হয়। তিমির গায়ে হারপুন বিধলে তিমি এমন ল্যাজ আছড়ায় যে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে যায়। কত নৌকো ডুবে যায়। আবার তিমি মরে গিয়ে যখন উলটে গিয়ে ভেসে ওঠে, দেখবে তার বুকের রঙটা পিঠের চেয়ে ফিকে।

"আর জানো, ইংল্যান্ডে শীতকালে সোয়ালো গাখিরা থাকে না। তারা দলে-দলে উড়ে স্পেনে চলে যায়, আর যেই শীত কমে আসে আবার তারা দলে-দলে সমুদ্রের উপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে ফিরে আসে। এসে দেখে তাদের আগেই শীতের বাতাসকে তুচ্ছ করে ড্যাফোডিল ফুলরা ফুটে গেছে।"

আমার মন পাখির মতো উড়ে যেতে চাচ্ছিল!

একচোখো বলল, "কিন্তু শুধু তিমি মারলে হবে না। তার বহু অসুবিধাও আছে, বহু দূরও। এই কাছাকাছি মানুষ-টানুষ মারতে পারবে? পরে যাবে আফ্রিকা, নরওয়ে, আলাস্কা-আপাতত অন্ধকার রাত্রে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা ছুরি হাতে নিয়ে ঘচ্ করে সেটাকে লোকের বুকে আমূল বসিয়ে দিতে পারবে? যেমন রক্তের নদী ছুটবে তুমিও হো হো করে রাত কাঁপিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠবে ?"

আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেই কালো কাপড় পরা লোকটা বলল, "উত্তর-মেরুতে সীল মাছেরা বরফের মধ্যে বাসা করে-"

আমি বললাম, "কুড়ি বছর পরে উত্তর-মেরুর কথা শুনব, এখন আমি ইস্কুলেই বরং যাই, মাথায় আমি লাল রুমাল কিছুতেই বাঁধতে পারব না।"

লোকটা বলল, "কে জানে ভুল করছ কি না?"

আমি ততক্ষণে চায়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে ট্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। প্রথম যে ট্রাম এল তাতেই উঠে পড়লাম।

উঠেই ভীষণ চমকে গেলাম। দেখলাম ট্রামের কোনায় ডানদিকের সাঁটে আমার বইগুলো পড়ে রয়েছে। কেমন করে হল বুঝতে না- পেরে ফুটপাথের চায়ের দোকানের সামনে কালো-কাপড়-পরা লোকটার দিকে তাকালাম।

আবার মনে হল তার মাথায় গাধার টুপির মতো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে রঙবেরঙের চক্রা-বক্রা আঁকা আর পায়ে গুঁড়তোলা কালো জাদুকরের জুতো।

সে আমাকে হাত তুলে ইশারা করে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আর আমি মোড়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো সাড়ে-দশটাই বেজে রয়েছে!



নটেমামা

আমি জন্মাবার অনেকদিন আগে মেজোমামা যখন ইস্কুলে পড়তেন, একবার পুজোর ছুটিতে কাঁচকলা নিয়ে দেশে গেছেন, আর তার পরের দিনই ভোরে মার নটেমামা তাঁর বিখ্যাত কালো সুটকেস নিয়ে উপস্থিত হলেন। রঙ-ওঠা দেড়হাত লম্বা একটা পুরনো কালো সুটকেস, তাতে ডবল তাল। মারা ।

ঐ সুটকেসই তিরিশ বছর ধরে মামাবাড়ির ইতিহাস তৈরি করল।

নটেমামাকে দেখেই দিদিমা নাকি কোল থেকে দুম্ করে ছোট- মাসিকে নামিয়ে রেখে, "ওরে নটে এদ্দিন তুই কোথায় ছিলি রে, ওরে বাবা রে!" বলে তাঁর গলা ধরে ঝুলে পড়লেন।

নটেমামা বললেন, "আঃ কি যে কর দিদি! সুটকেস পড়ে গেলেই সর্বনাশ হবে। মনে করেছি তোমার ছেলেপুলেদের দিয়ে যাব! আর কারুর কোনো অভাব থাকবে না।"

তাই শুনে দিদিমা তখুনি গলা ছেড়ে দিয়ে, চোখ মুছে এক গাল হেসে বললেন, "ওমা! তুই চিরটা কালই পেজোমি করে কাটালি ! তুই আবার ওতে ভরে কি আনলি?"

নটেমামা বললেন, "সময় হলে সবই জানতে পারবে দিদি! তোমার ছেলেপুলেদের ছাড়া ও আর কাকে দিয়ে যাব!"

দিদিমার পেছন দিক থেকে দরজা দিয়ে জানলা দিয়ে পিল্-পিল্ করে বেরিয়ে এসে মেজোমামা সেজোমামা বড়মাসি বড়মেসো প্যাতাদা ভজাদা রাঙামাসি ঢ্যাঙামাসি টে পিদিদি খেদিদিদি ইত্যাদি আর পাঁচ- সাতজন কারো ঝুঁটি বাঁধা, কারো কোমরে কালো সুতোয় পয়সা বাঁধা, কারো ন্যাড়া মাথা, যে যেমন ছিল, সবাই অবাক হয়ে গুনল।

তার পর নটেমামা বারান্দার কোণে তালি দেওয়া কালো ছাতাটা রেখে মাঝের ঘরের তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে বসলে পরে, সবাই এগিয়ে এসে ওঁর ছেঁড়া নোংরা সাদা ক্যাম্বিশের জুতো-পরা পায়ে ঢিপ্‌ ঢিপ্ করে প্রণাম করল। আর নটেমামা সবাইকে আশীর্বাদ করে বললেন, ছেলেবেলার গল্প "সুটকেসে তোদের সবার ভাগ আছে। কারো কোনো দুঃখু থাকবে না।" তখন দিদিমা সবাইকে তাড়িয়ে দিলেন। বললেন, "আহা মানুষটা রোজগারপাতি করে তেতে-পুড়ে এয়েছে। তোরা যেন কি!" বলে নটেমামার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, "তোকে ওদের বড্ড ভালো লেগেছে রে, রক্তের টান, ফোঁৎ ফোঁৎ!" বলে আবার চোখ মুছে নটেমামাকে স্নান করবার গরম জল, নরম তোয়ালে, সুগন্ধ সাবান, সেন্টেড, নারকোল তেল, দাদামশাইয়ের সব থেকে ভালো চটিজোড়া আর নতুন ধুতি দিলেন।

তার পর রেকাবি করে সরভাজা আর ভালো সন্দেশ আর হলদে পেয়ালাতে গরম চা দিলেন। শেষে রান্নাঘরে গিয়ে মহা চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিলেন। মার নটেমামা এদিকে তক্তপোশে পা মেলে, বালিশে ঠেসান দিয়ে, খবরের কাগজ নিয়ে শুয়ে পড়লেন।

দিদিমা একবার এসে বলে গেলেন, "ওরে নটে, আমি আর কোনো আপত্তি শুনব না। বাকি জীবনটা তোকে এখানেই কাটাতে হবে। অ খেঁদি, অ খেপি, তোদের কি কোনো আক্কেল নেই লা? নটেদাদামণির পা-দুটো একটু টিপেও দিতে পারিস না? সুটকেসের ভাগ নিতে তোদের লজ্জা করবে না?"

খেঁদি খেপি ইয়া বড়-বড় সাদা-সাদা জিভ কেটে তক্ষুনি পা টিপতে লেগে গেল। আর রাঙামাসিও পেছুপাও না হয়ে তামাক সেজে দিল। তার পর দুপুরে মুড়িঘণ্ট, মাছ-ভাজা, নারকোল-চিংড়ি, দই, রাজভোগ ইত্যাদি খেয়ে নটেমামা দাদামশাইয়ের খাটে শুয়ে পড়লেন। বড়মামিমা সারাদিন বসে-বসে বুড়োকে হাওয়া করলেন। আর দাদামশাই বেচারা কিঞ্চিৎ উত্থস্ করে শেষে পুরনো চটি জোড়াই পায়ে দিয়ে নকুড় দাদামশাইদের বাড়ি তাস খেলতে গেলেন।

সেই প্রথমবার এসে মার নটেমামা আটমাস পরম আরামে কাটিয়ে গেলেন! এই আটমাস দাদামশাই মাছের মুড়ো, কি পের্টির বড় চাকলা, কি মাংসের চোঙার হাড়, কি বড় ফলটা মিষ্টিটার মুখ দেখলেন না। দিদিমা আগেই সে-সব নটেমামার পাতে তুলে দেন।

ছুটির শেষে মেজোমামা যেদিন রওনা হবেন সেদিনও দেখলেন নটেমামা মোড়ায় পা উঠিয়ে ঋদামশাইয়ের ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে পান চিবোচ্ছেন আর রাঙামাসি মাছি তাড়াচ্ছে, বড়মাসি পাকাতুল তুলছে।

কলকাতা গিয়েও রেহাই নেই। থেকে থেকেই দিদিমার ফরমাশ আসতে লাগল-নটের জন্য বালাপোশ, নটের জন্য এগারো ইঞ্চি গরম মোজা, নটের জন্য ইত্যাদি।

পরের বছর আবার পুজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মেজোমামা দেখলেন নটেমামা ইতিমধ্যে একদিন বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কাঁদিয়ে শ্বশুরবাড়ি • গেছেন। শুনলেন দিদিমা নাকি অনেক করে বলেছিলেন, "ওরে আমার বুকটাকে একেবারে খাঁ খাঁ করে দিয়ে যাস নেরে। নিতান্তই যদি যাবি, নিদেন তোর সুটকেসখানাও রেখে যা।"

নটেমামা অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, "আঃ কি যে বল দিদি! ঐ সুটকেসেই তো আমার সব! আমি আর কদিন! তোমার ছেলে- পুলেরাই পাবে!" বলে নতুন কালো জুতো, আন্দির পাঞ্জাবি, তসরের চাদর আর সোনাবাঁধানো ছড়ি নিয়ে ছ্যাড়া গাড়ি চেপে চলে গেলেন। নটেমামার চেঞ্জ ছিল না বলে দিদিমা আবার যাবার খরচটা আর আবার ফিরে আসবার খরচটা দিয়ে দিলেন।

• মেজোমামা দেখলেন নটেমামার জন্য মাঝের ঘরটাকে রেডি করে *তালা দিয়ে রাখা রয়েছে। রোজ ধুলো ঝাড়া এবং ধুনো দেওয়া হচ্ছে। সকলেরই প্রায় মন খারাপ। খালি দাদামশাইয়ের মুখে হাসি। দিদিমা তো থেকে-থেকেই বলেন, "আহা যদি সুটকেসটাও রেখে যেত তাতে হাত বুলোতাম। কি জানি বাবা স্বশুরবাড়ির ওরা যদি আবার তুক্তাক্ · করে নেয়।"

সেবার পুজো দেরিতে পড়েছিল, মেজোমামা যখন ফিরে আসলেন - তখন বেশ শীত পড়ে গেছে। শেষদিনেই আবার নটেমামা ছেঁড়া কোট, • ছেঁড়া জুতো আর কালো সুটকেস নিয়ে এসে উপস্থিত। বললেন, দিদিমার দেওয়া সব জিনিস চুরি গেছে। কিন্তু দিদিমার ছেলেপুলেদের জন্য সুটকেসটা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে এনেছেন।

তাই শুনে দিদিমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পরে জিজ্ঞাসা করলেন- "কি হয়েছিল?" নটেমামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “থাক, সে কথা আর মুখেও আনতে বোলো না।" দিদিমা ভাবলেন, সব ঐ মুখপোড়া শ্বশুরবাড়ির কান্ড এবং তখুনি নটেমামার জন্য নতুন জুতো নতুন ছড়ি থেকে আরম্ভ করে নতুন বালাপোশ নতুন কম্বলের ব্যবস্থা করে দিলেন। এই আয়োজনের মধ্যে মেজোমামার ট্রেনের সময় হয়ে যাওয়াতে,মেজোমামা না-খেয়েই রওনা হয়ে গেলেন, কেউ খেয়ালও করল না।

তার পর থেকে পঁচিশ বছর ধরে মার নটেমামা বছরে একবার করে সুটকেস হাতে আসেন, আট-ন মাস থেকে আবার 'স্বশুরবাড়ি যাচ্ছি' বলে কোথায় জানি চলে যান। প্রতি বছর চোররা অনলসভাবে ওঁর সর্বস্ব চুরি করে নেয় আর দিদিমাও তেমনি অনলসভাবে আবার সমস্ত কিনে দেন। দাদামশাইও শেষ অবধি আপত্তি করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

পঁচিশ বছর পরে দিদিমা ও দাদামশাই চোখ বুজলেন। নটেমামা তখন শ্বশুরবাড়িতে, সেই ঠিকানাতে তার করা হল, পেলেন কি না। বোঝা গেল না। মোট কথা এলেন না।

পুজোর সময় আবার যখন কাপড়চোপড় কেনা হচ্ছে, নটেমামা। কালো সুটকেস হাতে উপস্থিত। বললেন, "আর ইয়ে শ্বশুরবাড়ি যাব না। এখন থেকে আমিই তোদের গাজিয়ান হলাম।" বলে সেদিন থেকেই সব-কিছু হুকুম দেওয়ার ভার নিলেন।

বড়মামা মেজোমামা তখন বিদেশে চাকরি করেন আর মাসে মাসে টাকা পাঠান। সেই টাকার বেশির ভাগটা দিয়ে বড়মামি মেজোমামি রেশারেশি করে নটেমামার সেবা করেন। নটেমামা দিব্যি আরামে আছেন। কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে দরজা জানলা বন্ধ করে সুটকেস গোছান। আর যেদিনই গোছান সেদিনই মেজাজটা যেন আরো ভালো থাকে।

সবাইকে বলেন, "দিদিরা গেছেন, আমারই-বা আর কদিন! তোদের অনেক সেবা নিয়েছি, দেখিস আমাকে যেন ঝগড়াঝাঁটির কারণ বানাস না। সুটকেসে যথেষ্ট আছে। সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নেবার জন্য যথেষ্ট আছে! এতদিন রইলাম, কাউকে কিছু ইচ্ছে করেই দিই নি যাতে আমি গেলে তোদের জন্য আরো বেশি থাকে। নিজের জন্যও এক পয়সা খরচ করি নি! তোরা যখন যা দিয়েছিস তাতেই আমার চলে গেছে।"

তাই-না শুনে বড়মামিমা আর মেজোমামিমা ঠিক দিদিমার মতন ফোঁৎ ফোঁৎ করে কেঁদে চোখে আঁচল দিলেন, এ আমার নিজের চোখে দেখা।

আজকাল মার নটেমামা বুড়ো হয়ে গেছেন, শ্বশুরবাড়ি যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। সুতির কাপড় পরলে গা কুকুট্ করে বলে গরদ ছাড়া কিছু পরেন না। এমনি তেল ঘি সহ্য হয় না বলে গাওয়া ঘিতে ওঁর সব রান্না হয়, রাত্রে গাওয়া ঘি দিয়ে লুচি হয়। দুর্বল হয়ে গেছেন বলে রোজই কি বলে-ইয়ে মুরগি হয়। ছাঁচি পান আসে, অম্বুরি তামাক আসে।

থেকে-থেকে নটেমামা সবাইকে ডেকে বলেন, "ওরে আমি গেলে তোরা ঝগড়া করিস না রে, প্রচুর আছে, প্রচুর আছে।"

আমরা হিসেব করে দেখেছি দিদিমা দাদামশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যদি নটেমামা স্বর্গে যেতেন, একদিক দিয়ে ভালোই হত! জ্বালা জুড়োত আর সুটকেসও মোটে একুশ ভাগ হত। আরো সবাই জন্মে-টন্মে একাকার কান্ড করেছে। ভাগ হবে। ওরও সব এই পাঁচ বছর এখন বেয়াল্লিশ

আমরা মনে করে রেখেছি সুটকেসে হীরে-মণি-মুক্তো আছে। মনে করেছি বোধ হয় তোড়া-তোড়া হাজার টাকার নোট ঠাসা, তাই গোপনে সুটকেস নেড়ে দেখেছি ভেতরে কিছু নড়ে না। বেশ হালকাও।

যাই হোক, গত বছরের শেষে একদিন সন্ধেবেলা নটেমামা সত্যি সত্যি পটোল তুললেন। বাইরে ঝমঝম্ বৃষ্টি, ঘরে তেলের বাতির আলোতে নটেমামা মলেন।

মামিমারা হু-হু করে একবার কেঁদে নিয়েই সুটকেসটাকে টেনে বারান্দায় আনলেন। নটেমামার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করলেন। দেশলাইয়ের আলোতে খুললেন।

খুলে দেখলেন অধু খড় ঠাসা। না, শুধু খড় নয়, তার উপর একটা কাগজে লাল পেনসিল দিয়ে লেখা:

"কাউকে কভু লাই দিস নে, করিস নে কো বিশ্বাস। 

বুদ্ধি তোদের দেখে দেখে

নটে ফেলছে নিঃশ্বাস !" 


হারানো জিনিস

ভেবেই পেলাম না আংটিটা গেল কোথায়। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম। অথচ ব্যাপারটা বলাও যায় না কাউকে। মাসি ওটাকে স্নানের ঘরে তাকের উপর ভুলে ফেলে এসেছিল। স্রেফ ওকে একটা শিক্ষা দেবার জন্য আমি ওটাকে নিয়ে পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। তার পর যে কি করলাম সে আর কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। মোট কথা পকেটে এখন আর সেটা নেই। পড়েই গেল কোথাও, নাকি কোনো-একটা ভালো জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলাম সে আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ঐ আমার একটা মুশকিল হয়েছে, কিছু মনে রাখতে পারি না। পড়াশুনো না, কাজের কথা না, আংটির বিষয় না, এক কথায় খেলা ছাড়া আমার কিছু মনে থাকে না। পেয়ারাগাছের তলায়, খেলার মাঠে ভালো করে খুঁজে এসেছিলাম, তা ছাড়া বইয়ের তাকের পিছনে, আমার সেই খালি কোকোর টিনটাতে, ছাদের আলসের ঐ ফাঁকটাতে, কোথাও আর দেখতে বাকি রাখি নি। কিন্তু কিছুতেই কিছু নয়।

খাসা আংটিটা ছিল, সোনার একটা গোল মতো, তার মাঝখানে একটা মস্ত সবুজ পাথর, তার দুপাশে দুটো সাদা পাথর স্বল্‌জ্বল্ করছে। আমার খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু এখন আর সে কথা ভেবে কি হবে? আরেকবার উঠে খুঁজে এলাম, দিদির পড়ার টেবিলে, বাবার রুমালের দেরাজে, ভাঁড়ার ঘরে, যে-সব জায়গায় কখনই আংটি থাকতে পারে না সে-সব জায়গা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে দেখে এলাম। কোথাও নেই।

বাড়ির লোকরা কেউ জানেও না ওটা আমি নিয়েছিলাম। এখন আর বলাও যায় না কাউকে। ওরা চাকরদের সন্দেহ করছে, ঠাকুরকে কিম্বা পাতির মাকে, কিম্বা ধুনিয়াকে। খুব বকাবকিও করছে, বলছে মাইনে কাটবে, পুলিশে ধরিয়ে দেবে, তাড়িয়ে দেবে। চাকররা খুব ভয় পেয়েছে, ধুনিয়া সিঁড়ির নীচে বসে কাঁদছিল। কি যে করি ভেবে পাচ্ছি না, এত খারাপ লাগছে। কিন্তু আসল কথা এতক্ষণে প্রকাশ করলেও আংটি তো আর ফিরে আসবে না। মাঝখান থেকে আমার পিঠের চামড়াও আস্ত থাকবে না, আমি যে নিজে একটু খোঁজখবর করব তারও জো থাকবে না। ইস্ আংটিটাকে সত্যি যদি চোরে নিত, তবে কি ভালোই যে হত। দিদিমার খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে-শুয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, দুপুরে খাবার পর থেকে কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম। ভারি তো একটা ছোট্ট আংটি, আমার ডান হাতের মাঝের আঙুলে ঢুকলই না। তাই নিয়ে এত কান্ড! মা বললেন নাকি ঐ নিয়ে মাসির শ্বশুরবাড়িতে অশান্তি হতে পারে। যেমনি মাসি, ঠিক তেমনি তার শ্বশুরবাড়িটিও। আরে আমার অত বড় কলমটা হারিয়ে গেল তবু কিছু অশান্তি হল না, বরং মেজোকাকা বলল-বেশ হয়েছে! ঠিক হয়েছে। খুব খুশি হয়েছি!-আর ঐ একটা ক্ষুদে আংটি সে আবার স্নানের ঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল, তাই নিয়ে ক্যায়সা হৈ-চৈ লাগিয়েছে দ্যাখ-না!

আচ্ছা ভেবেই দেখা যাক-না, কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম। খেয়ে উঠে পেয়ারাগাছে। সেখানে দেখেছি, নেই। তার পর খেলার মাঠে মাছ ধরার জন্য পিঁপড়ের ডিম আনতে। সেখানেও নেই। তার পর ছিপটিপের জন্য চিল-ছাদের ঘরে, সে জায়গাটাকে তো গোরু-খোঁজা করে ফেলেছি। কি সব পড়ে-টড়ে ভেঙেচুরে, রসের মতো বেরিয়ে, এটাতে-ওটাতে মেখে গিয়ে একাকার কান্ড হয়ে আছে। তাই নিয়ে আবার কাল হবে এক চোট। যাই হোক, সেখানেও নেই। তা হলে বাকি থাকে পুকুরধার। আগাগোড়া খুঁজেছি। এক যদি জলে পড়ে গিয়ে থাকে, মাছ খেয়ে ফেলে থাকে। কিন্তু তাই-বা হবে কি করে? শেষ মূহর্তে তো ছোটমামা আমার হাত থেকে ওদের ছিপটিপ কেড়ে নিয়ে কান মলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ততক্ষণে বাড়িতে আংটি নিয়ে খোঁজখুঁজি লেগে গেছে, ওদের কারো মেজাজেরও ঠিক ছিল না। মাছ ধরাও বন্ধ, কাজেই লাগাও কানমলা।

তার পর সেখান থেকে বটগাছ তলায়। ইস্, কি অদ্ভুত জায়গাটা। চারি দিক থমথমে, চুপচাপ। দিনের বেলায় ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, ঘন পাতার মধ্যে দিয়ে একটু একটু আলো আসছে, বাদুড় চামচিকের সোঁদা গন্ধ। অদ্ভুত জায়গাটা। আর গাছের গোড়ায় সে যে কতকগুলো কি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম সে আর কি বলব। সাদা, হলদে, গোলাপী, ভিজে-ভিজে মতো, কতকগুলো ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া, কতকগুলো ঠিক হাট্টিমাটিমটিমের ডিমের মতো। কতকগুলো অবিকল ছাতা প্যাটার্নের। ওগুলোকে তাই ব্যাঙের ছাতা বলে। সাহেবরা ভেজে খায়। কতকগুলো খেলে আবার মরেও যায়। সাংঘাতিক জিনিস। ভীষণ তাড়াতাড়ি বাড়ে, সামনে একটা টুল নিয়ে বসে থাকলে নাকি দেখা যায় একটু একটু করে চোখের সামনে বাড়ছে তো বাড়ছেই।

তার পর বোধ হয় একটু ঘুমিয়ে পড়ে থাকব। মনে হল সেইখানে গিয়ে সত্যি একটা টুলের উপর বসে আছি, আর সামনে একটা গোল ব্যাঙের ছাতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। আর আমার টুলটাও সঙ্গে সঙ্গে উঁচু হয়ে উঠছে। টুলটা ভিজে স্যাঁতসেঁতে কেন? বুঝলাম ওটা টুল নয়, ওটাও একটা ব্যাঙের ছাতা, তাই আমার কালো পেন্টেলুনটাও ভিজে সপ্ সপ্ করছে। কালো পেন্টেলুন আবার কি? আমার পরনে তো থাকি পেন্টেলুন। ঝট্ করে চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। খাকি পেন্টেলুনই তো বটে।

এক দৌড়ে উপরে মার শোবার ঘরে খাটের তলা থেকে আমার ছাড়া কাপড়গুলো টেনে বের করলাম। ঐ তো ভিজে স্যাঁতসেঁতে ব্যাঙের ছাতার গন্ধওলা আমার সেই কালো প্যান্টটা। ঐখানেই তো ছেড়ে রেখেছিলাম। নাহয় একটু ভুলেই গিয়েছিলাম। বলেইছি তো খেলার কথা ছাড়া কিছু মনে থাকে না। এই তো প্যান্টের পকেটে আংটিটাও রয়েছে। বলি নি পকেটেই রেখেছিলাম, যাবে কোথায় বাছাধন! যাই, মাসিকে দিয়ে আসি। বলি গিয়ে স্নানের ঘরের তাকেই ছিল। ছিলই তো। সকালে তো সেইখান থেকেই তুলে রেখেছিলাম, আবার কোত্থেকে পাব? মাসি স্নান করে অসাবধান হয়ে আংটি ফেলে গেল। আমি তার পরেই স্নান করতে এসে ভালো মনে করে, ওকে একটা শিক্ষা দেবার জন্য, ওটাকে একটুক্ষণের জন্য পকেটে রেখেছিলাম। অথচ এ বিষয়ে কিছু খুলে বলতে গেলে আমাকে এরা আস্ত রাখবে না। যাই, বলি গিয়ে স্নানের ঘরে তাকের উপর পেয়েছি।




গুপ্তধন

আমার বন্ধু জগাই কী ভালো! পড়াশুনো সেরকম একটা ওর আসে না বটে কিন্তু কি চমৎকার মাউথ-অর্গান বাজায়। আর টিফিনের সময় আমাকে কতদিন আলুকাবলি খাওয়ায়। তা ছাড়া দুই কান নাচাতে পারে, জিভ দিয়ে নাকের ডগা ছুতে পারে। তবে পড়া-টড়ায়, সত্যি কথা বলতে কি বেজায় খারাপ। সেদিন ইতিহাস ক্লাসে সাজাহানের বাবার নামও বলতে পারল না, আবার ছেলের নামও বলতে পারল না। অবিনাশবাবু তো চটে কাঁই, ক্লাসসুদ্ধু ছেলের সামনে ওকে যা নয় তাই বললেন, আর ও ফ্যাল ফ্যাল্ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তখনি জানি একটা কিছু হয়েছে।

বাড়ি যাবার পথে আমাকে বললে, "পড়াশুনো ছেড়ে দেব ভাবছি!" আমি বললাম, "তবে কি বড় হয়ে গোরু চরাবি?" জগাই কাঠ হেসে বললে, "তোরও যেমন বুদ্ধি! বুঝলি, গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি!" আমি একেবারে থ। বলে কি! আমার তো ধারণা ছিল যেখানকার যত গুপ্তধন লোকরা এতদিনে খুঁজে বের করেছে।

জগাই বলল, "আমাদের ঐ বাড়িটা কি আজকের মনে করিস নাকি? কম-সে-কম ওর বয়স একশো বছর। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা সিপাহি-বিদ্রোহের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আপিস থেকে বুদ্ধি করে টাকা সরিয়ে ওটাকে আগাগোড়া তৈরি করে ফেলেছিলেন।"

তার পর একটু চুপ করে থেকে জগাই বলল, "কাল চিলে-কোঠার পুরনো বাক্স-প্যাঁটরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে ওঁর ডায়েরি খুঁজে পেয়েছি। তাতে যে-সব কথা লেখা আছে সে-সব শুনলে তোর চুলদাড়ি খাড়া হয়ে উঠবে, দাঁত-কপাটি লেগে যাবে। ওরই মধ্যে গুপ্তধনের কথাটাও আছে। সাধে কি আর কোথায় কোন কালে কে কার ছেলে ছিল কি বাবা ছিল তাই নিয়ে আর মাথা ঘামাই না! আমাকে তো আর আপিসে চাকরি করতে হবে না!"

আরেকটু থেমে জগাই হঠাৎ বলল, "কিন্তু ভাই, তোকে একটু সাহায্য করতে হবে। আমাদের বাড়িটা জানিসই তো। দিনের বেলায় যদি-বা গুপ্তধনটা খুঁজে বেরও করি, ঐ-সব বুড়োগুলোর জ্বালায় তাতে আমার আর হাত দিতে হবে না। অমনি আমাকে পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা ভাগবাঁটরা করে নেবে। দ্যাখ্, রাত্রে কাজ হাসিল করতে হবে। আজ খেলার মাঠের পর আসিস একবার, শনিবার আছে, আজ রাতেই কেল্লা ফতে। কিন্তু ভাই জানিসই তো আমার যা ভূতের ভয়, তোকে সঙ্গে থাকতে হবে।" কি করি বলো, আমার বুজুম ফ্রেন্ড। তা ছাড়া গুপ্তধন পাওয়া গেলে আমাকেও একটু ভাগ দেবে বলল। গেলাম খেলার মাঠের পর। চাকরদের সিঁড়ি দিয়ে চিলের ছাদে উঠে মোমবাতি জ্বেলে ঠাকুরদার ঠাকুরদার ডায়েরি পড়লাম।

সে কি কাণ্ড! হলদে তুলোট কাগজে সবুজ কালি দিয়ে কি সব হিজিবিজি লেখা, না আছে তার বানানের মাথামুণ্ডু, না যায় তার অর্ধেক বোঝা। কিন্তু গুপ্তধনের কথাটা সম্বন্ধে কোনোই সন্দেহ নেই।

পড়ে মনে হল বুড়োর দুটি বাবাজীবন অর্থাৎ ঘরজামাই ছিলেন। দুটিই যেন সাক্ষাৎ রত্ন! সারাদিন খাই-খাই আর মখমলের বিছানায় টেনে ঘুম। ওদের গিলে-করা পিরান আর কিংখাপের জুতো আর অম্বুরি তামাক জুগিয়ে জুগিয়ে বুড়ো নাকাল। 'পরম-রত্ন' অর্থাৎ কিনা ঐ গুপ্তধন না লুকিয়ে না। যে-ই সুবিধে পাবে অমনি সেটি হাতাবে। পণ্ডিত আসে, কিন্তু পড়াশুনা তাকে তোলা। এদেরই হাত থেকে বুড়োর নিস্তার ছিল অথচ বাড়িতে রোজ

ঠাকুরদার ঠাকুরদা লিখছেন, "চন্ধু হইতে নিদ্রা ঘুচিয়াছে। উহারা সৌখিনতায় ডুবিয়া দিনে দিনে রসাতলে যাইতেছে। উহাদের চিত্তে বড় লোভ জাগিয়াছে। সর্বদা পরম-রত্নের উপর দৃষ্টি, যেন উহাকে 'বাগাইতে পারিলে সকল চিন্তা দূর হয়। উহা একবার হস্তগত করিলে নিঃসন্দেহে জুয়া খেলিয়া সর্বস্ব ফুঁকিয়া দিবে।"

তার পরের দুটো পাতায় দুধ না কি যেন পড়ে ধেড়ে গেছে, কিছু পড়া যাচ্ছে না। তার পরের পাতায় স্পষ্ট করে লেখা, "অগত্যা নিরুপায় হইয়া পরম-রত্ন গুম্ করিয়াছি। গৃহিণীরও ওদিকে দুর্বলতা। মহা অশান্তি করিতেছেন। আমারও ভোলা মন, সেই কারণে গুহ্যস্থানের এই নক্শা রাখিতে বাধ্য হইলাম। সুখের বিষয় বাবাজীবনদিগকে মাধব পণ্ডিতের টোলে ভর্তি করিয়া দিতে সন্ধম হইয়াছি।" বাস্ ঐখানেই ডায়েরি শেষ। তার পরেই বোধ হয় আনন্দের চোটে বুড়ো মলো আর গুপ্তধনের কথাও কেউ জানতে পারল না। জগাই বলল, "এ ডায়েরি বুড়ো চিল-ছাদের কানিশের নীচে গুঁজে রেখেছিল, কাল আমি এটাকে খুঁজে বের করেছি, আজই পরম-রত্ন খুঁজে বের করতে হবে। তার পরে পড়াশুনো ছেড়ে দেব। তাই আজ মিছিমিছি হোমটাস্কগুলো টুকি নি।"

নক্শা জলের মতো সহজ। বাবাজীবনদের হাতে পড়লেই সর্বনাশ হয়েছিল। এক নিমেষে পরম-রত্ন খুঁজে বের করে জুয়ো খেলে সব ফুঁকে দিত। নক্সায় আঁকা ওদের পুকুরধারের বুড়ো বটগাছ। তার বরাবর উত্তরে বারো হাত একটা রেখা, তার বরাবর পুবে আবার বারো হাত। সেইখানে একটা ক্রশ আঁকা। অর্থাৎ কিনা ঐখানেই!

জগাই কোত্থেকে একটা শাবল, একটা মাপবার ফিতে আর একটা টর্চ এনে রেখেছিল। গেলাম পুকুরের পাড়ে। সূর্য ডুবলেই জগাইটার এমনি ভূতের ভয় যে, একটু-একটু বিরক্তও লাগছিল। আরে তোরই ঠাকুরদার ঠাকুরদা গুপ্তধন লুকিয়েছে, তোর ভয় করলে চলবে কেন! তা নয়, দূরে শেয়ালের ডাক শুনে ভয় পাচ্ছে, বটগাছের ডাল থেকে শেকড় ঝুলছে দেখে ভয়ে কিচ্ কিচ্ করে উঠছে, আর টর্চের আলোতে বটগাছের ডালের ছায়া দেখে তো আরেকটু হলেই ভিমি যাচ্ছিল।

যাই হোক, অনেক কষ্টে মাপজোক করে জায়গাটা পাওয়া গেল। তার পর আমি টর্চ ধরে ওকে বললাম, "এবার খুঁড়ে দ্যাখ।" ও শাবল দিয়ে ঝুঝুপ্ করে আট-দশ কোপ দিয়েই বিরাট এক গর্ত বানিয়ে ফেলল। তার পর ঠং করে একটা শব্দ হতেই আমার খুব ফুর্তি লাগল। কিন্তু জগাইটা দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, "যদি ডালা খুলতেই ওর মধ্যে থেকে কিছু উঠে বসে!"

শেষটা ওকে ঠেলে সরিয়ে, ওর হাতে টর্চ দিয়ে, আমিই একটা এক হাত লম্বা, আধ হাত চওড়া তামার বাক্স টেনে বের করলাম। তার তালাটালা ভেঙে গেছে। ঢাকনিটা খুলে ফেললাম। ভাবলাম হীরে- মণি-মুক্তোর উপর আলো পড়ে নিশ্চয় চোখ ঝলসে যাবে।

টর্চের আলোতে দেখলাম বাক্সর নীচে এক প্যাকেট পুরনো হাতে- আঁকা তাস পড়ে রয়েছে। তাদের পিঠের উপর বড় করে লেখা-'পরম- রত্ন'। তার নীচে ছোট্ট করে লেখা 'প্লেয়িং কার্ডস'।

জগাই আস্তে আস্তে টর্চ নামিয়ে রেখে বললে, "সোমবারের হোম- টাস্কগুলো লিখে দিতে ভুলিস না।"





টাকাচুরির খেলা

প্রথম যখন গণার সঙ্গে আলাপ হল সে তখন সদ্য-সদ্য নর্থ-বেঙ্গল এক্সপ্রেস থেকে নেমেছে। চেহারাটা বেশ একটু ক্যাবলা প্যাটার্নের, হলদে বুট পরেছে-তার ফিতেয় আবার দু-জায়গায় গিট দেওয়া, খাকি হাফ-প্যান্ট, আর গলাবন্ধ কালো কোট-তার একটাও বোতাম নেই, গোটাতিনেক বড়-বড় মরচে-ধরা সেফ্টিপিন আঁটা। তার উপর মাথায় দিয়েছে সামনে-বারান্দাওয়ালা হলদে-কালো ডোরা-কাটা টুপি। দেখে হেসে আর বাঁচি নে।

ছোটকাকা সঙ্গে ছিল, গন্ধার দাদাকে ডেকে বলল, "ওহে হরিচরণ, এটি আমার ভাইপো। তোমার ছোটভাইয়ের সঙ্গে মিলবে ভালো।" তাই শুনে গন্ধা রেগে কাঁই, "অত ছোটভাই, ছোটভাই করবেন না মশাই। আর, ঐ কুচো-চিংড়িটার সঙ্গে মিলবে ভালো, শুনলেও হাসি পায়।"

ছোটকাকার মুখের রঙটা কিরকম পাটকিলে মতন হয়ে গেল। ঢোক গিলে বললে-"বটে!" সে বললে, "আজে হ্যাঁ!”

অথচ শেষ অবধি ঐ গণাকেই আমি বিষম ভক্তি করলুম।

সে এক মস্ত উপাখ্যান।

ছুটির দিন দুপুরবেলায় নিরিবিলি ছাদের ঘরের মেঝেতে বেশ আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দুটোকে উঁচুবাগে তুলে একটা চেয়ারের পায়াতে লঙ্কে, দিব্যি করে নিজের মনে দাদার টিকিটের এ্যালবামে নতুন নতুন পাঁচ-পয়সার টিকিট সারিসারি মারছি, কারু কোনো অসুবিধে করছি না কিছু না, এমন সময়ে "ওরে গবা, গবা রে।" বলে বাপ্ রে সে কি চিল্লানো! আর এরা আমায় কিনা বলে যে গোলমাল করি! সেই বিকট গোলযোগ শুনে তাড়াতাড়ি টিকিট-এ্যালবামটা লুকিয়ে ফেলে নীচে যেতে যাব, ভুলেই গেছি যে পা দুটো চেয়ারে লকানো, তাড়াতাড়ি পা টেনে নামাতে গিয়ে চেয়ার উলটে গেল, তার উপর দিদিটা হাঁদার মতন দুটো ফুলদানি রেখেছিল, সে তো গেল ভেঙে সব চেয়ে খারাপ হল, আমার আধ-খাওয়া পেয়ারাটা ছিটকে গিয়ে ঘরের কোণে পিসিমার গঙ্গাজলের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল।

এই-সমস্ত ঘটনাতে আমার যে একেবারে কোনো দোষ ছিল না এ কথা যে শুনবে সেই বলবে। অথচ এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে দাদা দিদি পিসিমা এমন হৈ-চৈ লাগাল, যেন তাদের ঘরে চোর সিঁদ কেটেছে! বাবা পর্যন্ত আমার দিকটা বুঝলেন না, বললেন, "দোষ করে আবার কথা !"

এর পরে যখন ছোটকাকা গোলমাল শুনে দাড়ি কামাতে-কামাতে এসে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল-"অনেকদিন থেকেই বলছি ও ঝুড়ি- ভাজা ছেলেকে বিদেয় কর, তা তো কেউ শুনলে না! এখন জেল- খানাতেও ওকে নিতে রাজি হবে না। সময় থাকতে নারানবাবুর ইস্কুলে দিয়ে দাও নইলে নাকের জলে চোখের জলে এক হবে।" মনে মনে বুঝলাম, ছোটকাকার নতুন সাদা জুতোয় সেই যে কলম ঝাড়বার সময়ে সামান্য তিন-চার ফোঁটা কালি পড়েছিল, ছোটকাকা এখনো সে কথা ভোলে নি। দিক গে বোডিংয়ে, এদের চেয়ে খারাপ বোডিংয়ে কেন, নরকেও কেউ হতে পারে না। তাই রেগে, চেঁচিয়ে, হাত-পা ছুড়ে বলতে লাগলাম-"তাই দাও-না, তাই দাও-না, তাই দাও-না! এদিকে নিজে যখন বায়স্কোপ দেখে দেরি করে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে তাড়া খাও, তখন-"

বাবা বললেন-"চোপ্।"

এরই ফলে ছুটির পরে যখন ইস্কুল খুলল, আমি গেলুম নারান- বাবুদের বোর্ডিংয়ে। বেশ জায়গা, বাড়ির থেকে ঢের ভালো। প্রথমটা সকাল বেলা হালুয়া খেতে বিশ্রী লাগত। তার পর দেখলাম ওতে খুব ভালো ঘুড়ি জুড়বার আঠা হয়। এ ছাড়া বোডিংয়ের আর সব ভালো।

গণাও দেখলাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে সে আমাদের ঘরে থাকে না। প্রথম দিন শুতে গিয়ে দেখি আমাদের ঘরে ছজন ছেলে। পাঁচজন ছোট আর একজন বড়। আমাদের ঘরের বড় ছেলেটি ঠিক বড় নয়, বরং মাঝারি সাইজের বললে চলে। কিন্তু তার তেজ কি! তার নাম পানুদা, তার কাজ নাকি আমাদের সামলানো, আর তাই করে-করে নাকি তার ঠান্ডা মেজাজ খ্যান্ধ্যাক্ করার ফলে দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম পানুদা সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। নিয়ম করে ক্লাসের লাস্ট বয়ের ঠিক উপরে হয়। কিন্তু তার মন খুব ভালো, লাস্ট বয়কে খুব সাহায্য করে। আমাদের ঘরের নিলু বলল, সেই সাহায্যের ফলেই নাকি লাস্ট বয় বেচারা চিরটা কাল লাস্টই হচ্ছে।

যাই হোক, আমি এ-সমস্ত কথা বিশ্বাস করি নি, কারণ আমাদের ঘরে দেখতাম তার খুব বুদ্ধি খোলে। নিজে লুকিয়ে ডিটেকটিভ বই পড়তে আর আমরা কোনো অন্যায় করলে ধরে ফেলতে তার মতন ওস্তাদ আর দুটি হয় না। এই পানুদাই সেদিন বিষম বিপদে পড়ল, আমরা তো সবাই থ!

সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার।

পানুদা আর তার গুটি-পাঁচেক ক্লাসের ছেলে প্রায়ই ভোজ মারে। সবাই মিলে টাকা জমিয়ে পানুদার কাছে দেয় আর এক শনিবার বাদে এক শনিবার চপ, কাটলেট, ডিমের ডেভিল আরো কত কি-র ব্যবস্থা হয়! আমায় একবার একটা ঠোঙা ফেলতে দিয়েছিল, আমি সেটা একটু শুঁকে আর-একবার চেটে 'কী পেলুম না, কী পেলুম না' করে আর ঘুমুতে পারি নি।

পানুদার কাছে তো পিঁপড়েটি আদায় করা দায়, তাই আমরা ছোট ছেলেরা নিজেরা একবার পয়সা জমাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে আর- এক কেলেঙ্কারি। জগা আজ চার-আনা দিল, আবার কাল বলে, "দে বলছি আমার চার-আনা, আমি পেনসিল কিনব।" যত বলি "পেনসিল কিনবি কি রে, ও দিয়ে যে আমরা চপ-কাটলেট খাব রে।"- জগা বলে, "ইয়ার্কি করবার জায়গা পাস নি! দে বলছি নইলে এক রদ্দা কষিয়ে দেব!" পারলে বোধ হয় চার-আনার জায়গায় ছ-আনা নেয়। এমনি করে আমাদের সাড়ে তিন-আনার বেশি জমলোই না। তাও জমত না, নেহাত মন্টু জ্বর-টর হয়ে বাড়ি চলে গেল আর পয়সা- গুলো চেয়ে নিতে ভুলে গেল।

যাই হোক পানুদারা এদিকে সাড়ে তিন-টাকা জমিয়েছিল। রাত্রে শুনলাম পাশের খাট থেকে পানুদা বলছে-"আট-আনার বরফি, আট- আনার চিংড়ি মাছের কাটলেট, চার-আনার ছাঁচি পান-" শুনে শুনে আমার গা জ্বলতে লাগল। জিভের জল গিলে গিলে পেটটা ঢাক হয়ে উঠল।

পরদিনই কিন্তু পানুদা বিষম বিপদে পড়ল। লাইব্রেরিতে পানুদা আর সমীরদা আর কে যেন একটা ছেলে পেল্লায় আড্ডা দিচ্ছে, পানুদা চাল মেরে কি একটা কুস্তির প্যাঁচ দেখাতে গেছে আর স্লিপ করে কাচের আলমারির দরজা-টরজা ভেঙে চুরমার! পানুদা উঠে দাঁড়িয়ে কি একটা বলতে যাচ্ছে, এমন সময় হেডমাস্টারমশাই এসে এমনি বকুনি লাগালেন যে পানুদা চমকে গিয়ে নিজের আলজিভ-টিভ গিলে বিষম- টিষম খেয়ে যায় আর কি!

হেডমাস্টারমশাই এমনি রেগে গিয়েছিলেন যে এ-সব কিছু না-দেখে বললেন, "বাঁদুরে ব্যবসা ছেড়ে এখন মানুষের মতন ব্যবহার শেখো। তোমাকে বেশি জরিমানা কোথেকে করি, কিন্তু তোমার বাক্সে যা টাকাকড়ি আছে সমস্ত দিয়ে যতগুলি কাচ হয় কিনে দেবে। তা দিয়েও যে অর্ধেকের বেশি হবে তা তো মনে হয় না।"

সেদিন পানুদার মেজাজ দেখে কে! রাত্রে আমরা ঘরে বসে শুনলাম পানুদার চটির শব্দ-অন্যান্য দিনের মতন চট্ চটাং, চট, চটাং না হয়ে একেবারে চটাং চটাং চটাং! বুঝলাম পানুদা রেগেছে।

যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখলাম আসলে আরো ঢের বেশি রেগেছে। ঘরে ঢুকেই পানুদা আমার আর কেষ্টর মাথা একসঙ্গে ঠুকে দিয়ে বললে, "অত হাসি-হাসি মুখ কেন রে বেয়াড়া ছোঁড়ারা !" আমরা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলাম। তার পর পানুদা জগার দিকে চেয়ে বলল, "ফের ফোঁস্ ফোঁস্ করছিস রাস্কেল ?" বলে তার কানে দিলে এক প্যাঁচ। হিরু বলল, "ওর সদি হয়েছে কিনা-" পানুদা তার গালে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলল, "চুপ কর বেয়াদব, তোর কে মতামত চেয়েছে?” তার পর সময় কাটাবার জন্য শিবুর কানের কাছের খোঁচা-খোঁচা চুলগুলো সব নখ দিয়ে কুকুট্ করে টানতে-টানতে দাঁতে দাঁত ঘষে বললে, "আজ তোদের কাছ থেকে যদি টু শব্দটি শুনি, সব কটাকে কচুকাটা করে ফেলব বলে রাখলাম।"

ঘরের মধ্যে একদম চুপ। পানুদা ঘরে বসে পা দোলাতে লাগল আর বোধ হয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে লাগল। এমন সময়ে সেই গন্ধাটা এসে হাজির। এসেই পানুদার পিঠ থাবড়ে একগাল হেসে বললে, "কি রে পেনো, ফিল্টিটা ভেস্তে গেছে বলে বুঝি মুখখানা হাঁড়ি আর কচি ছেলের উপর উৎপাত? রোজ বলি: ওরে পেনো, একা- একা অত খাস নি!"

পানুদা গুম হয়ে রইল। গন্ধা বললে, "তাই বলে কি টাকাগুলো সত্যি দিবি নাকি?"

পানুদা বলল, "দেব না তো কি তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে?" গন্ধা হেসে বললে, "আরে রামঃ! এমন এক উপায় বাতলাতে এলুম, তোকেও দিতে হবে না আমাকেও দিতে হবে না। আজ রাত্রে দরজা খুলে শুবি, দেখবি একটা ডাকাত এসে সব টাকা নিয়ে যাবে। পরে হয়তো ফিরে পাবি, কিন্তু ডাকাতটাকে খাওয়াতে হবে বলে রাখলুম।"

পানুদা হাঁ করে খানিক তাকিয়ে বলল, "সে দেখা যাবে এখন। এ সময়ে তুমি এ ঘরে যে এসেছ, জানো না রুল থ্রি?" গশা বললে, "সাধে শাস্ত্রে বলে, 'কদাচ কাহারো উপকার করিয়ো

না'?"

মুখে পানুদা যতই তেজ দেখাক-না কেন, শোবার সময়ে দেখলুম দরজাটা ঠিক খুলে শুল। অন্য দিন তো পারলে জানলাও বন্ধ করে, আমাকে দিয়ে খাটের নীচে খোঁজায়, রাত্রে উঠবার দরকার হলে জগাকে আগে একবার পাঠায়, আর সেদিন দেখি বেজায় সাহস! বালিশে মুখ গুঁজে একটু হেসে নিলাম।

উৎসাহের চোটে আমার অনেকক্ষণ ঘুম হয় নি, অনেক রাষ্ট্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি কে যেন টর্চের আলো ফেলছে। পানুদা ভোস্- ভোঁস্ করে ঘুমোচ্ছে আর বাকিরা কেউ যদি জেগেও থাকে ভয়ের চোটে চোখ বুজে পড়ে আছে। আমি দেখলুম কে একটা লোক পা টিপে-টিপে পানুদার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করল, পানুদার বাক্স খুলল, কি যেন নিল, আবার বাক্স বন্ধ করে চাবি বালিশের নীচে রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল।

পরদিন সকালে ইস্কুলময় হৈ-চৈ, পানুদার টাকা চুরি গেছে। হেডমাস্টারমশাই সবাইকে ডেকে যাচ্ছেতাই করে বকলেন, সকলের বাক্স খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। গণশার বাক্সে তো, এত কম জিনিস, এবং তাও এত নোংরা যে তাই নিয়ে গণশা বেজায় বকুনি খেল। সেদিন রাত্রে পানুদার হাসি-হাসি মুখ। আজ কাউকে কিছু তো বললেই না, এমন-কি, যে-পানুদা শার্টের বোতাম ছিড়ে গেলে আমাদের শার্ট থেকে বোতাম কেটে নিজের শার্টে লাগিয়ে নিত, সে নিজের থেকেই জগাকে দুটো আস্ত খড়ি দিয়ে ফেলল।

এমন সময়ে গশা আবার ঘরে ঢুকল।

"কিরে পেনো! শেষটা সত্যি ডাকাত পোলো তোদের ঘরে ?" পানুদা খুব হেসে বলল, "দিস ভাই, তোরও নেমন্তন্ন রইল।" গণা যেন আকাশ থেকে পড়ল, "কী দেব রে পেনো! বলছিস কী?" "কেন, টাকা।"

"কিসের টাকা? টাকা আবার কোথায় পাব রে? দানছত্তর খুলেছি নাকি? আর তা যদি খুলি, তোকে টাকা দেব কেন রে এত যোগ্য লোক থাকতে?"

পানুদা ভয়ংকর চোখে বললে, "দ্যাখ্ গন্ধা, ইয়াকি ভালো লাগে না। দে বলছি!"

গন্ধা বললে, "ইয়ার্কি কি আমারই ভালো লাগে নাকি রে?" তার পর গুনগুন করে গাইতে লাগল-

"নিশুত রাতে চোরের সাথে টাকাচুরির খেলা,

ঐ চোর ব্যাটা নিলে সেটা পেনো বুঝলে ঠ্যালা ।"

সেই অবধি গন্ধাকে আমি ভক্তি করি।





আচার

অমৃতবাজার পত্রিকার টুকরোটা হাতে নিয়ে বাবার প্রকাণ্ড চটি- জোড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘোতন খুব লক্ষ্য করে দেখল, পিসিমা এসে নিবিষ্ট মনে খোকনাকে ঠ্যাঙাচ্ছেন।

প্রথমে ডান কান প্যাঁচালেন, তার পর বললেন, "হতভাগা ছেলে!" তার পর বাঁ গালপট্টিতে চাঁটালেন, তার পর বললেন, "তোকে আজ আমি-" তার পর বাঁ কান প্যাঁচালেন-আদা-লঙ্কা দিয়ে ছেঁচব।" তার পর ডান গালপট্টিতে চাটালেন-"তেল-নুন দিয়ে আমসি বানাব।" তার পরে পিঠে শুশুম্ করে গোটা দশেক কীল কষিয়ে মাথা থেকে চিটি চিটি চুল ছিঁড়ে, জুল্পি ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ঠিক ভাঁড়ার ঘরের দরজার বাইরে। টিপ দেখে ঘোতন তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারল না।

আরেকটু হলে নিজেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল। তবেই হয়েছিল। ভীষণ না রাগলে পিসিমার নাক কখনো ওরকম ফোলে না। অমৃতবাজারের কুচি-টুচি ফেলে ঘোতন তো হাওয়া! খোকনাটারও যা বুদ্ধি! এত করে বলে দেওয়া হল যেখানে হেয়ারপিন সেই পর্যন্ত পিসিমা পড়েছেন, আচারের জন্য তার এদিক থেকে কাগজ ছিঁড়িস! বোকা ভাবলে কি না 'এদিক' মানে পিছন দিক, মনেও গজাল না যে একটু পড়লেই ছেঁড়া পাতা এসে যাবে! মাথায় কি-ছু নেই, এক যদি গোবর থাকে। বেশ হল! আচারও পেল না, ঠ্যাঙাও খেল।

আবার পিসিমার টিপের কথা মনে হল। কি চমৎকার টিপ্‌! সেই যে সেবার ক্রিকেট সিজন-এ পানু নিজের ব্যাট দিয়ে খুঁচিয়ে স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে, জিব কেটে, মাথা চুলকে, তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে বাউন্ডারির দড়িতে ঠ্যাং আটকে খুঁটিসুদ্ধ দড়ি উপড়ে এনেছিল। বড়কাকা ছিলেন ক্যাপ্টেন, তিনি এক হাতে পানুর শার্টের কলার আর-এক হাতে পেন্টেলুন ধরে তাঁবু থেকে তাকে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়া উল্কে ওপারে ফেলে দিয়েছিলেন, আর পিছন পিছন ওর জুতো, প্যাড,গ্লাভস্, ব্যাট ছুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলেন, প্রত্যেকটা ওর গায়ে লেগেছিল! বাজে প্লেয়ার হলে কি হবে কিরকম টিপ্‌। পিসিমারই-বা হবে না কেন, ওরই তো দিদি!

ঘোতন এদিক-ওদিক ঘুরে আচারের কথা ভুলতে চেষ্টা করল।

নাঃ! খোকনাটা আবার কোথায় উধাও মারল, তার যে পাত্তাই নেই! অনেক খুঁজে দেখা গেল, ঐ যে রেগেমেগে ভালো ভালো ব্যবহার না-করা ডাক-টিকিটগুলো টেবিলের ঠ্যাঙে একটার নীচে একটা লাইন করে দিব্যি থুতু দিয়ে সাঁটছে! ছোঁড়ার সাহস আছে!

ঘোতনা কাছে এসে আস্তে আস্তে জিগেস করল- "লেগেছিল ?" থোকনা বললে, "কি লেগেছিল?"

"কি মুশকিল! লাগবে আবার কিসে? আরে ঠ্যাঙানিতে, ঠ্যাঙানিতে!"

"উহু!"

"তবে যে দেখলুম মাথাটা এমনি হয়ে গেল ?"

"ওরকম মাঝে মাঝে হয়।"

"খাবি নাকি আচার ?"

"না!"

"ঘেবড়ে গেছিস ?"

"দুৎ! সত্যি বলছি, না ।-আচ্ছা তুই আন্ তো দেখি।"

ঘোতন এক ছুটে ভাঁড়ার ঘরের দরজার কাছে চলে গেল। দরজার বাইরে সারি সারি বড়ির থালা অন্ধকারে এ ওকে ঠেলাঠেলি করে চোখ টিপছে। সারা সকাল মা ছিনু মিনুকে নিয়ে বড়ি দিয়েছেন। ঘোতন দেখেছিল মেয়েগুলোর কি বুদ্ধি। প্রথমটা বড়ি চ্যাপটা-চ্যাপটা ঘুঁটের মতন হচ্ছিল। যেই মা বললেন যার বড়ি যত উঁচু তার বরের নাক তত উঁচু, অমনি বোকাগুলো টেনে টেনে বড়ির নাক তুলতে লাগল। বুঝবে শেষটা!

যাক, কিন্তু দরজায় যে তালামারা! এ্যাঃ, মিলার-লক! হেয়ারপিন পাকিয়ে ঘোতন তাকে এক মিনিটে শায়েস্তা করে দিল। আজ আর কোনো ভয় নেই। কি করবে পিসি? ঠ্যাঙাবে? ওঃ! ঠ্যাং নেই? তাকে তাকে আচার। বড় বয়ামে, ছোট বয়ামে, মাটির ভাঁড়ে, পাথরের থালায়, শিশিতে, বোতলে। ঘোতনের চোখ দুটো চার দিকে পাইচারি করতে লাগলে। ঠিক সেবারের বাঙালি পল্টনের মতন-একটা এগোনো, একটা পেছনো, একটা লম্বা, একটা বেঁটে! বাঁকা লাইন, দুধের দাঁত পড়ে খোকনার যেমন ত্যাড়াবাঁকা দাঁত উঠেছিল সেইরকম। সত্যি সেপাইয়ের মতন। আনাড়ি সেপাইকে যেমন কাঁচা কাঁচা ধরে এনে এক পায়ে ঘাস বেঁধে মার্চ করায়-'ঘাস বিচালি' 'ঘাস বিচালি'! লেফট রাইট লেফট রাইট তো আর বোঝে না!

আজ কে পিসিমাকে কেয়ার করে!

বয়ামের গায়ে টোকা মেরে মেরে ইচ্ছে করে ভিতরের আচারের ঘুম ভাঙিয়ে দিল।

কিরকম একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে আসছিল। ঘরের আনাচে-কানাচে ছু'চোদের বাবা, মা, দাদা, দিদিরা চুপ মেরে কিসের যেন অপেক্ষা করছে! দেয়ালের গায়ে সুপুরির মতন কেঁদো কেঁদো মাকড়সা খাপ পেতে রয়েছে। ছাদের উপর টিকটিকিরা খচমচ্ করে চলাফেরা করছে। তারা অনেকদিন পায়ের নখ কাটে নি।

বড় বয়ামের পাশে ওটা কি? নিশ্চয় আমতেল, কেটে পড়ার চেষ্টায় আছে। তুলে দেখে-এ মা! আম তো নয়, আরগুলা চ্যাপটা! যেই পেন্টেলুনে হাতটা মুছতে যাবে-এই রে, পিসিমা! ঘোতনের আত্মারাম শুকিয়ে জুতোর সুকতলার মতন হয়ে গেল, হাত-পাগুলো পেটের ভিতর সেঁদিয়ে গেল।

পিসিমা বললেন, "দরজার কাছে হাওয়া আটকে দাঁড়ালে আচার ভেসে উঠবে।” ঘোতন ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, পিসিমা আবার ডেকে বললেন, "আচার নিয়ে যাও।"

পিসিমা যে কি! বকলেও বিপদে ফেলেন, না বকলেও বিপদে ফেলেন। ঠেঙিয়েও হার মানান, আবার না ঠেঙিয়েও হার মানান। অন্য বুড়োদের মতন একটুও না। ঘোতনের ভারি লজ্জা করল।



বাঘের চোখ

অঙ্কের ক্লাসে আমার বন্ধু গুপির সব অঙ্ক ভুল হল। আর সে-সব কি সাংঘাতিক ভুল তা ভাবা যায় না। বাঁশগাছের অঙ্কটার আসল উত্তর হল পঁচিশ মিনিট, গুপির হয়েছিল সাড়ে পাঁচটা বাঁদর। অমলবাবু তাই নিয়ে ওকে যা নয় তাই সব বললেন-টললেন। গুপি শুধু অন্যমনস্ক ভাবে হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

টিফিনের সময় আমাকে বলল, "এই ঝাল-মটর খাবি?” আমি একটু অবাক হচ্ছি দেখে কাঠ হেসে বলল, "দ্যাখ্, আসল জিনিসের সন্ধান পেয়ে গেছি। ও-সব তুচ্ছ কথায় আমার আর কিছু এসে যায় না।"

এই বলে পকেট থেকে কাগজে-মোড়া একটা ছোট্ট জিনিস বের করল। পুরু ময়লা কাগজে মোড়া, রাংতা দিয়ে জড়ানো একটা গুলি মতন। বললে, "কি, দেখছিস কি? কাগজটা একবার পড়ে দ্যাখ্।"

লাল কালি দিয়ে খুব খারাপ হাতের লেখা। অনেক কষ্টে পড়লাম, 'অন্ধকারে চোখে দেখার অব্যর্থ প্রকরণ।' তার পর গিজিগিজি করে আরো কত যে কি লেখা তার মাথামুণ্ডু বুঝে উঠলাম না।

গুপি গুলিটাকে আবার কাগজে মুড়ে যত্ন করে বুক-পকেটে রাখল। বললাম, "কি ওটা ?"

"কি ওটা! চট্ করে কি আর বলা যায়? তবে সম্ভবত বাঘের চোখের মণি।"

"সেকি! তোমার না বেড়াল দেখলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, ওয়াক আসে, বাঘের চোখের মণি দিয়ে তুমি কি করবে ?"

গুপি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললে, "কাকে কি যে বলি! আরে, অন্ধকারে চোখে দেখবার গুণ পাওয়াটা কি যে-সে কথা? পারে সবাই ইচ্ছেমতো জন্তু-জানোয়ার হয়ে যেতে ?”

আমি তো অবাক। "আমার ছোড়দাদু কানের মধ্যে কি সব গান- বাজনা ঝগড়াঝাঁটি শুনতে পেতেন, তার পর অনেক ওষুধ-উষুধ করে তবে সারল। এও সেই নাকি?"

শুপে রেগে গেল। বললে, "শোন্ তবে। বড়দিনের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছলুম জানিস তো? প্রত্যেক বছর শীতকালে মামাবাড়ির সামনের মাঠে তিনদিন ধরে মেলা বসে। সে কী বিরাট মেলা রে বাপ! দেখলে তোর মুণ্ডু ঘুরে যেত। কি থাকে না ঐ মেলায়, সিনেমা, সার্কাস, হিমালয়ের দৃশ্যের সামনে চার-আনা দিয়ে ফটো তোলা, দুমুখো সাপ, যাত্রাগান, কুস্তির আখড়া, বাউল নাচ, দোকানপাট, তেলেভাজা, হাত-দেখানো গণক-ঠাকুর-কিছু বাকি থাকে না।

"পাড়ার লোকে সাতদিন দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। দুদিন আগে থাকতে গোরু-গাড়ির ক্যাচ্কোচ্, গাড়োয়ানদের ঝগড়া, ভিজে খুঁটের ধোঁয়া, আর অষ্টপ্রহর ছাউনি তোলার ঠুষ্ঠুাক্। মেলার তিনদিন তো গান-বাজনা হৈ-হল্লোড়ে কারো ঘুমুতে ইচ্ছেও করে না। তার পর দুদিন ধরে ভাঙা হাটে সস্তা দরে জিনিস কেনার সে কি হট্টগোল।

"তার পর যে যার গোরু-গাড়ি বোঝাই করে চলে যায়। মাঠের মধ্যে পড়ে থাকে কতকগুলো উনুন তৈরির পোড়া পাথর, খুঁটি পোঁতার গর্ত, ভাঙা খুরি আর ছেঁড়া চাটাই। কয়েকটি ময়লা কাগজের টুকরো আর শালপাতার ঠোঙা বাতাসে উড়ে উড়ে পড়তে থাকে। যত রাজ্যের নেড়িকুত্তোরা এসে কি সব খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ যেন শীতটাও কিরকম কেঁপে আসে। সে একবার ওখানে ঐ সময় না থাকলে তুই বুঝবি নে।

"তবে যারা মনে করে, মেলা উঠে গেলেই মাঠে আর কিছু বাকি থাকে না, তারা যে কিছু জানে না এই কাগজে মোড়া জিনিসটাই তার প্রশ্নাণ।"

এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলুম। বললুম, "ও, তুই বুঝি ওটাকে ঐ মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছিলি, তাই বল্। তা এখন ওটাকে নিয়ে কি করতে হবে শুনি?"

গুপি উঠে পড়ে বলল, "ও! টিকিরি হচ্ছে বুঝি? থাক তবে।" বলে সত্যি সত্যি ক্লাসে ফিরে গেল।

পরদিন ছিল শিবরাত্রির হাফ-হলিডে। ধরলাম ওকে চেপে, "না রে গুপি, গুলিটার কথা বলতেই হবে। দুজনে মিলে ওর একটা হিল্লে করে নিতে পারব।"

আসলে গুপিও তাই চায়। বললে, "বলি নি তোকে আমার মামাবাড়ির নাপিত মেঘলার কথা? রোগা সুটকো কুকুচে কালো, মাথায় একটাও চুল পাকে নি, তীরের মতো সোজা, একশো হাত দূরে থেকে গাছের ওপর নাকি শকুনের চোখ দেখতে পায়। একদিনে পনেরো মাইল হেঁটে ওর গাঁয়ে গিয়ে আবার সেইদিনই ফিরে আসাকে কিছু মনে করে না। ওদিকে ও আবার দাদামশাইয়ের বাবারও দাড়ি কামাত। বয়সটা তা হলে ভেবে দ্যাখ।

"তাঁর সঙ্গে নাকি শ্যামদেশে গেছল, সেখানে গভীর বনের মধ্যে কে এক ফুঙ্গি ওকে জল-পড়া করে দিয়েছিল, সেই থেকে নাকি ওর শরীর একটুও টস্কায় না। গুম্-গুম্ করে নিজের বুকে কীল মেরে বলে, 'তোরাই বল, কোন জোয়ানের শরীরে এর চেয়ে বেশি জোর।' ঐ মেঘলাই এই বড়িটাকে কুড়িয়ে পেয়ে আমাকে দিয়েছে।"

আমি বললাম, "কেন, তোকে দিল কেন? তুই কিছু করবি ভেবেছে নাকি মেঘলা ?"

গুপি খানিক চুপ করে বলল, "আসল কথা কি জানিস, মেঘলা লিখতে পড়তে জানে না। বড়িটা আসলে কি ব্যাপার বুঝেই ওঠে নি। নইলে কি আর অমনি অমনি দিয়ে দিত ভেবেছিস নাকি। ভীষণ চালাক ঐ মেঘলা, বললে, দুমুখো সাপের ঘরের সামনেটাতে কুড়িয়ে পেয়েছে। বোধ হয় ফেলেই দিচ্ছিল আমি কাগজটার ওপর একটু চোখ বুলিয়ে, আর কি ওকে হাতছাড়া করি। তখন ব্যাটা আমার কাছ থেকে পঁচিশ নয়া পয়সা নিয়ে, তবে না আমাকে দিল।"

সত্যি বলতে কি, অন্ধকারে দেখতে পাবার আমারও যথেষ্ট ইচ্ছে ছিল। গুপির কাছ থেকে কাগজটি নিয়ে আরেকবার পড়লাম। একটু অদ্ভুত যে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। বললাম, "আচ্ছা, অন্ধকারে দেখতে পাওয়া মানেই তো অন্ধকারে আমাদের চোখও জ্বলজ্বল্ করবে? তার কিন্তু মেলা অসুবিধেও আছে।"

আছেই তো। তাই জন্যে যদি ভয় পেয়ে যাস তা হলে আর তোর এর মধ্যে এসে কাজ নেই। ভীতুদের কম্ম এ নয়। মেঘলার কাছে শুনেছি, ওর দাদামশাই মেলা মন্ত্রতন্ত্র জানত। যেমন, মানুষকে ছাগল করা, ছাগলকে মানুষ করা, এমনি ধারা কত কি। শুধু বড়িটা গিলে ফেললেই হল না, অত সহজে হলেই হয়েছিল আর কি। নীচে যে-সব লেখা আছে তার কোনো মানে বুঝতে পারলি নাকি?"

মনে হল হয় তো সঙ্কেত লেখা হবেও-বা। কি সব সংখ্যা-টংখ্যা দেওয়া, গোড়াটা এই ধরনের-৩ উ ১ জোসো ১ সো ২ উ মাঝে মাঝে তারা-চিহ্ন দেয়া। শুনেছি লন্ডনের বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এই-সব গোপন সঙ্কেত পড়বার জন্য মাইনে-করা লোক থাকে। তবু একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি। তা বড়িটা গুপে কিছুতেই দেবে না। শেষপর্যন্ত বড়ি রইল ওর কাছে, কাগজ থেকে লেখাটুকু টুকে নিলাম।

গুপি বার বার আমাকে সাবধান করে দিতে লাগল। "যা তা একটা কিছু করে বসিস নে যেন। মেঘলার কাছে শুনেছি, ওরই এক মামা এক সাধুর সঙ্গে ভাব করে অন্ধকারে দেখার ওষুধ নিয়েছিল, কিন্তু পয়সা না দিয়েই পালিয়েছিল। তার পর থেকে মামা নিখোঁজ কিন্তু ওদের বাড়ির চার পাশে রোজ রাতে একটা বিরাট প্যাঁচাকে উড়ে বেড়াতে দেখা যেত। বড়িটা তাই আমার কাছেই রাখলাম।"

অনেক মাথা ঘামালাম লেখাটা নিয়ে। আমার পিসতুত ভাই মাকুদা কবিতা-টবিতা লেখে, তাই নিয়ে প্রায়ই বকুনি-টকুনিও খায়, ওর কাছে বুদ্ধি নিতে গেলাম। অবিশ্যি বড়ি ইত্যাদির কথা একেবারে চেপে গেলাম। বললাম, এগুলি একটা ওষুধের অনুপান, কিন্তু সঙ্কেতে লেখা ।

মাকুদা খুব মাথাটাথা নেড়ে খানিক ভেবে বলল, "এ তো খুব সোজা, দে তো একটু কাগজ পেনসিল।" তার পর কাগজে লিখল, তিনটে উট, এক জোড়া সোনার চেন, একটা সোডাওয়াটার, দুটো উল্লুক এই-সব লাগবে আর কি। তার পর পেনসিলটা পকেটে পুরে মাকুদা উঠে পড়ে বলল, ঐ পেনসিলটা নাকি ওর। অনেকদিন থেকে পাচ্ছে না। অথচ আমি দস্তুরমতো বসবার ঘর থেকে ওটাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। থাক গে। যখন অন্ধকারে চোখে দেখতে পাব, তখন তো আর কোনো দুঃখ থাকবে না।

ঐ লেখা নিয়ে গুপির সঙ্গে খুব একচোট তর্কাতকিও হয়ে গেল। ওর এক বন্ধু আছে, ন্যাপলা, মাথাভরা তেল চুচুকে কোঁকড়া চুল, এমনি একটা গায়ে-পড়া ভাব যে দেখলেই পিত্তি জ্বলে যায়। আর গুপির তো সে দিনরাত দস্তুরমতো খোসামুদিই করে। তাই দেখে গুপি আবার ওকে একেবারে মাথায় তোলে। ওকে নিয়ে এর আগেও গুপির সঙ্গে আমার অনেকবার হয়ে গেছে। সেদিনও একচোট হল।

গুপি আর লোক পায় নি, তাকে দিয়ে লেখাটা পড়িয়েছে। তার নাকি ভারি বুদ্ধি, নাকি পাশা খেলায় বড়দের হারিয়ে দেয়। সে লেখা দেখে বলেছে, ওর মানে তিন ফোঁটা উদক মানে জল, এক জোড়া শোনপাপড়ি, একদানা সোহাগা, আরো দু ফোঁটা উদক দিয়ে গুলে খেয়ে ফেলতে হবে। বুদ্ধিখানা দেখলে একবার। অথচ গুপি গলে জল। ওরকম বুদ্ধি নাকি কারা হয় না। বেশ একটা রাগারাগির পরে ঠিক হল এখন কিছু করা নয়, এক্ষুনি সার্ এসে যাবেন বরং সন্ধেবেলা গুপিদের পেয়ারাতলায় যা হবার হবে।

সন্ধেবেলায় গিয়ে দেখি পেয়ারাতলা ভোঁ ভোঁ! জায়গাটা দস্তুরমতো নির্জন, পুরনো কালের বাগান, ঝোপঝাপে ভর্তি। দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘনিয়ে এল, দূর থেকে রাস্তার শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম, আবার কাছ থেকে বাগানের মধ্যেও নানারকম অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল। কে যেন সাবধানে হেঁটে বেড়াচ্ছে, লুকিয়ে থেকে কিসে যেন নিঃশ্বাস চাপতে চেষ্টা কচ্ছে। বুক ঢিপ্‌ ছিপ্‌ করতে লাগল।

ভয়ে ভয়ে ইদিক-উদিক তাকাতে লাগলাম। গুপির কিছু হয়-টয় নি তো? গুপিই কিছু হয় নি তো? ওর কাছে তো লেখাটাও ছিল, বড়িও ছিল। যদি ঐ ন্যাপলাটার বুদ্ধি নিয়ে বড়ি গিলে বসে থাকে।

হঠাৎ আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। চেয়ে দেখি দূরে রঙন ঝোপের মধ্যে থেকে এক জোড়া সবুজ চোখ আমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। মাটি থেকে দু হাত উঁচুতে হবে। কি আর বলব, হাত-পা পেটে সেঁদিয়ে গেল। যাই হোক, গুপির যতই দোষ থাকুক, পুরনো বন্ধু তো বটে! কিন্তু সবুজ চোখ দুটোতে মনে হল কেমন একটা খিদে খিদে ভাব! গুপিই হয় তো ঝোপের মধ্যে থাবা গেড়ে বসে আছে, আমি একটু নড়লেই হালুম করে-

আর দাঁড়ালাম না। যা থাকে কপালে, লাগালাম। একেবারে বাড়িতে এসে থামলাম। পড়িমরি করে ছুট্ সেখানেও কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়? এ বাড়ি তো ওর চেনা, শুঁকতে শুঁকতে যদি এসে হাজির হয়? জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে হয়তো-বা স্বচ্ছন্দে গলে যাবে।

আস্তে আস্তে জানলাটা বন্ধ করে দিলাম। সবে একটু বসেছি, দরজার বাইরে কিসের শব্দ! ছুটে গিয়ে দরজাটাকে ঠুসে ধরলাম।

বাবা জোর করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বললেন, "সন্ধেবেলা তোরা লাগিয়েছিস কি? ওদিকে গুপিদের ওখানে এক কান্ড।" ভয়ে ভয়ে বললাম, "বেঁধে রেখেছে ?"

বাবা তো অবাক! "বেঁধে রেখেছে কি! সে বিরাট এক বাদশাহী জোলাপের বড়ি কি সব দিয়ে খেয়ে একেবারে কুপোকাৎ! এখন আর নড়বার চড়বার জো নেই। ওটা নাকি ওর মামাবাড়ির কে এক নাপিত মজা করবার জন্য দিয়েছিল। যে কাগজে মুড়ে দিয়েছিল, তাতে কি একটা উল বোনার প্যাটার্ন লেখা ছিল। কাকে দিয়ে পড়িয়েছে সেটাকে, কি বলতে কি বলেছে সে, সোহাগ-টোহাগা দিয়ে বড়ি খেয়ে বাছাধন কুপোকাৎ! এখন ডাক্তার এসে ঘুমপাড়ানি ওষুধ দিয়েছে। কি, শুয়ে পড়ছিস যে? তোরও কি শরীর খারাপ নাকি!"

কিন্তু গুপিদের পেছনের বাগানে তবে ও কার চোখ?





হরিনারায়ণ

ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম নতুন ছেলেটির চেহারার সঙ্গে গিরগিটির চেহারার একেবারে কোনো তফাত নেই। সেই রোগা কাঁকলাশ শরীর সেই লিক্লিকে হাত-পা, সেই বিল্কিলে চোখ, সেই হঠাৎ-হঠাৎ ইদিক- উদিক তাকানো। এসে বসল ঠিক আমারই পাশে। নগা-বন্ধুরা তাই দেখে খুব হাসাহাসি করতে লাগল আর রাগে আমার গা জ্বলে গেল। ঠিক করলাম ছেলেটিকে এইসা কষে দাবড়ে দেব যে আর জন্মে কখনো আমার দিকে এগুবে না।

এমন সময় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ছেলেটি বলল, "ভুবন- ডাঙা, ঠ্যাঙাড়ের মাঠ-এই-সব নাম শুনেছিস কখনো? সেখানে শ্যাওড়া- গাছের ধারে ধারে কেয়া বনের আড়ালে আড়ালে মাটি খুঁড়লে কত যে হাড়গোড় পাওয়া যায় তার ঠিক নেই। বুঝলি, সেইখানে আমার বাড়ি।"

তখন ইতিহাস ক্লাস, অবনীবাবু দেখতে ঐরকম ভালোমানুষ হলে কি হবে, আসলে উনি হলেন একটি কেউটে সাপ। বই থেকে চোখ তুলবার আমার সাহস হচ্ছে না, অথচ ছেলেটি কানের কাছে অনর্গল বকে যেতে লাগল, আর সঙ্গড্ করে আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠতে লাগল। খুব ঘেঁষে এসে আমার বইয়ের মধ্যে প্রায় মুখ গুজে ফেলে বলতে লাগল-

"তুই বন্ধু লোক, তোর কাছে বলতে লজ্জা নেই, আমার পূর্ব- পুরুষদের মধ্যে সারা গুষ্টি খুঁজে দেখলে একটাও ভালো লোক পাওয়া যাবে না। সব খুনে, ডাকাত, ঠগ, জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ। কি ভীষণ মিথ্যাবাদী আর কি দারুণ অসৎ যে আমার বাপ-ঠাকুরদারা সে না দেখলে বিশ্বাস করবি না।"

ঘণ্টা পড়ে গেল, অবনীবাবু চলে গেলেন, অঙ্কের বই হাতে করে অনঙ্গবাবু' এলেন। উনি হলেন ঐ আরেকজন-অবনীবাবুর মতো, কিন্তু তাঁর চেয়েও সাংঘাতিক। নতুন ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আর খচ খচ করে সব অঙ্ক টুকে নিতে লাগল। তখন আর বিশেষ কথা হল না। সেই-সব তেলচিটে-বাঁশবেয়ে-বাঁদর- ওঠার অঙ্ক, ও আমার কখনই ঠিক হয় না, আজও হল না। কিন্তু ও ব্যাটা দেখলাম সব ঠিক করে কষে রাখল। যাই হোক, তার পর রতন মাস্টারের বাংলা ক্লাস। ঢিলে-হাতার লম্বা পাঞ্জাবি পরে কোঁচা দুলিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখ করে কোনো দিকে না তাকিয়ে উনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে লাগলেন, আর ছেলেটা আবার আমার বইয়ে মুখ গুঁজে বলতে আরম্ভ করল-

"বুঝলি, সারা জীবনে ওরা কেউ একটা ভালো কাজ করেন নি, লোক ঠেঙিয়ে, লোক ঠকিয়ে, ডাকাতি করে, মদ খেয়ে, জুয়ো খেলে শেষটা প্রত্যেকে বুড়ো বয়সে হরিনাম শুনতে শুনতে নিজেদের বিছানায়: শুয়ে শান্তিতে মারা গেছেন। আর জানিসই তো যারা হরিনাম শুনতে শুনতে মারা যায়, তারা সব্বাই স্বর্গে যায়।"

রতন মাস্টার একটা কবিতা শেষ করে, অন্যমনস্কভাবে চার দিকে একবার তাকিয়ে, আবার আরেকটা সুর করে পড়তে শুরু করলেন। ছেলেটা বলল, "কি সুখেই যে সব ছিলেন সেকালে সে আর তোকে কি বলব! বাড়িতে গোরু বালতি বালতি দুধ দিচ্ছে, দই হচ্ছে, ক্ষীর হচ্ছে, ছানা হচ্ছে, সন্দেশ হচ্ছে, ঘি হচ্ছে। গাছ ভরা আম কাঁঠাল, বাগানভরা তরিতরকারি। একবার সাহস করে যদি ভুবনডাঙা যাস তো এখনো কিছু কিছু দেখবি। সবার হাতে মোটা-মোটা সোনার তাগা, গলায় সোনা দিয়ে বাঁধানো রুদ্রাক্ষের মালা। সবাই নিরামিষ খেতেন, ত্রিসন্ধে জপতপ করতেন। আর ঘরে ঘড়া-ঘড়া মোহর, সে রাখবার জায়গা হয় না, আদাড়ে-বাদাড়ে কলসিতে পুরে পুতে রাখা হত। কতক মনে থাকত, কতক আবার ভুলেও যেতেন। এখন তো যে-কেউ জায়গা বুঝে মাটি খুঁড়ে সে-সব বের করে আনতে পারে, না বলবার একটা লোকও নেই।"

আমি একবার আড়চোখে ছেলেটার দিকে তাকাতেই একটা দীর্ঘ- নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "আমিই হলাম শেষ বংশধর, আর সব মরে-ঝরে চাঁছাপোঁছা হয়ে গেছে।"

তার পর পকেট থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার চেহারা দেওয়া এত বড় একটা টাকা বের করে বলল-"ধরে দ্যাখ, কিরকম ভারী, একেবারে খাঁটি রুপো। আজকাল চেয়ে-চেয়ে লোকে পায় না। আর ওরা এ- সব যেখানে-সেখানে ফেলে দিতেন। এটা আমি আমাদের পৈতৃক বাড়িতে কুড়িয়ে পেয়েছি। যাস একবার-এমনি কত পড়ে আছে।"

ঘণ্টা পড়ল, রতন মাস্টার পড়েই যাচ্ছেন। নগা-বটুরা মহা হট্টগোল লাগিয়ে দিল, "সার, ঘণ্টা পড়ে গেছে সার।" রতন মাস্টারও অন্যমনস্কভাবে বই বন্ধ করে কি যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন। জ্ঞানবাবু এলেন।

জ্ঞানবাবুর ইংরিজি ক্লাসেও যে কেউ সাহস করে কথা বলে এই প্রথম দেখলাম। নতুন ছেলেটা আমার বই দিয়ে একটুখানি মুখ আড়াল করে অম্লান বদনে বকে যেতে লাগল। “দ্যাখ, এই যে-সব লোকেরা জেল খাটে, জরিমানা দেয়, তাদের আমি ভারি ঘৃণা করি। অন্যায় করলে আমার একটুও রাগ হয় না, কিন্তু ধরা পড়লে আর আমি তাকে ক্ষমা করি না। বুঝলি, আমার বাবার ঠাকুরদা রাতে খাওয়া- দাওয়ার পর মুখে একটা পান পুরে লম্বা-লম্বা বাঁশের রণ-পা চড়ে অনায়াসে পঞ্চান্ন মাইল দূরে বর্ধমানে গিয়ে এর-ওর-তার বাড়ি থেকে ঠেঙিয়ে পিটিয়ে পুঁটলি ভরে সোনাদানা নিয়ে আবার রণ-পা চেপে ভোরের আগে বাড়ি ফিরে, রণ-পা দুটোকে পুকুরের জলে ডুবিয়ে রেখে, পুঁটলি তালগাছের আগায় বেঁধে রেখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তেন। ভোর বেলা পুলিশের লোকে সন্দেহ করে এসে হাজির হত। ঠাকুরদাদা অঘোরে ঘুমুচ্ছেন, পায়ে এতটুকু কাদা পর্যন্ত লেগে নেই। তারা বার বার মাপ চেয়ে চলে যেত। কিন্তু ঠাকুরদাদা ভারি ভদ্রলোক ছিলেন, না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়তেন না। ভেবে দ্যাখ, সেই শীতের সকালে মাঠঘাট থেকে ধোঁয়া-ধোঁয়া কুয়াশা উঠছে, আমলকীগাছের পাতায় একটু রোদ লেগেছে, আর লাল লাল চোখ করে ঠাকুরদা পুলিশদের ক্ষীর দিয়ে কলা দিয়ে খ্যাসরাপাতি ধানের খই খাওয়াচ্ছেন।"

তার পর টিফিনের ছুটি হল, আমি ঘণ্টা পড়ামাত্র মেজদাদের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করলাম। মেজদা বোধ হয় খুব খুশি হল না। কিন্তু ঐ নগা-বন্ধুদের কাছে গেলেই নতুন ছেলেটার সম্বন্ধে সাত-সতেরো জিজ্ঞাসা করবে, আমার আর সে-সব বলতে ইচ্ছে করছিল না।

টিফিনের পর পণ্ডিতমশাইয়ের সংস্কৃত ক্লাস, তখন সবাই গল্প করে। ছেলেটা তো আবার আমার পাশে বসেছে, কাছে এসে বলতে আরম্ভ করল-

"দ্যাখ্, আমার পূর্বপুরুষরা যেরকম পাষণ্ড ছিলেন, আবার তেমনি দয়ালুও ছিলেন। এদিকে এক কোপে শত্রুর মুণ্ডু উড়িয়ে দিচ্ছেন, আবার ওদিকে লোকের দুঃখের কথা শুনলে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। মহৎ লোকেরা ঐরকমই হন। বুঝলি, একবার ওরা সিউড়ির ওদিকে কোথাকার এক মহা অহংকারী জমিদারকে উচিত শিক্ষা দিতে গেছেন। সব-কিছু তছনছ করে দিয়ে, তাল তাল, লুটে নিয়ে ফিরছেন, এমন সময় ঐ জমিদার আর তার সাত ছেলে কেঁদে এসে পায়ে পড়ল, তারা কাজকর্ম কখনো করতে শেখে নি, এখন খাবে কি? তাই গুনে আমার পিতৃপুরুষরা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে, লুটের জিনিস তো ফিরিয়ে দিলেনই, নিজেদের হাত থেকে সোনার তাগা খুলে তাও দিয়ে দিলেন, ঘোড়া চড়ে যাচ্ছিলেন, সে-সব ঘোড়া দিয়ে দিলেন। পায়ে হেঁটে' বারো মাইল পথ পার হতে বিকেল হয়ে গেল।"

তার পর দুই ঘণ্টা ড্রইং ক্লাস। এবার সকলের যা ফতি! জায়গা- টায়গা বদল করে যার যেখানে খুশি বসছে, পেনসিল কাটবার ছুতো করে এদিক-ওদিক ঘুরছে, ভীষণ গল্প করছে। নগা-বটুও অন্য দিনের মতো আমার আশে-পাশে ঘুরতে লাগল। আমি যেন দেখতেই পাই নি, এমনি করে ছবি আঁকার তোড়জোড় করতে লাগলাম। ছেলেটাও চুপ করে বসে রইল, ছবি-টবি তো মোটে আঁকতে পারে না দেখলাম।

ক্লাসটা একটু ঠান্ডা হয়ে এলে বলল, কবে বড়লোক হয়েছে তুই-ই বল-না? "দ্যাখ, ভালো হয়ে আর কে আমার দশা দ্যাখ, কি একটা মোটা জামা-কাপড় পরে তোদের সঙ্গে পড়াশুনো করতে এসেছি। ভালো হওয়ার উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। কি করি বল, রক্তের মধ্যে আমার ডাকাতি রয়েছে। ভাবছি গরমের ছুটির পর আর স্কুলে আসব না। ভুবনডাঙায় পুরনো বাড়িটা রয়েছে, মাটি খুঁড়লেই তাল তাল মোহর রয়েছে, খাওয়া-পরার ভাবনা নেই। ভাবছি আস্তে আস্তে পুরনো ব্যবসাটা আবার জোড়াতালি দিয়ে নিই। আসবি নাকি আমার সঙ্গে? যা অঙ্ক কমলি দেখলাম, তোর ভবিষ্যতটা তো একেবারে অন্ধকার।""

কি যে বলব ভেবে পাচ্ছি না। পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে ভুবনডাঙার ঠ্যাঙাড়ের মাঠে ঘুরে বেড়াব, দইক্ষীর খাব, মুস্কিল হল মা-বাবা আরু আমার ছোট বোন ফুল্কি যে আবার দুষ্ট লোককে দেখতে পারে না। এখন কী করা যায়? ঠিক এমনি সময় হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে হেডকেরানীবাবু এসে আমাদের ডেস্কের সামনে দাঁড়ালেন।

কেরানীবাবু একটু লজ্জিত হয়ে বলতে লাগলেন-"হ্যাঁ সার্, এইটিই আমার বড় ছেলে হরিনারায়ণ, এর ছোট আরো তিনটি আছে। নিজের ছেলে বলে বলছি না, কিন্তু এমন সত্যবাদী সৎ ছেলে আজকাল বড়- একটা দেখা যায় না।

"আর গুরুজনের প্রতি কি ভক্তি! আমার বৃদ্ধ পিতৃদেবকে তো একরকম পুজো করে। একে সার্, এই ক্লাসে না নিলে হবে না।" ছেলেটা ফ্যাল্-ফ্যাল্ করে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না।

ভাবছি কাল কোথায় বসা যায়।







23
Articles
লীলা মজুমদার রচনাবলী ১
0.0
লীলা মজুমদারের ছোট ছোট কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টি একত্রে আনা হয়েছে রচনাবলী ১ বইটির মধ্যে। এটি এমন একটি উপন্যাস যেখানে গল্পগুলি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে বইটি সব বয়সের মানুষই পড়তে পারেন, এবং এর মজা উপলব্ধি করতে পারেন।
1

পদিপিসীর বর্মিবাক্স

28 November 2023
0
0
0

পাঁচুমামার প্যাকাটির মতন হাত ধরে টেনে ওকে ট্রেনে তুললাম। শূন্যে খানিক হাত-পা ছুড়ে, ও বাবাগো মাগো বলে চেঁচিয়ে-টে চিয়ে শেষে পাঁচুমামা খচ্ করে বেঞ্চিতে উঠে বসল। তার পর পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে কপালের

2

বক-বধ পালা

28 November 2023
0
0
0

পালা শুরু জুড়ির সুর করে আবৃত্তি, মৃদু মুনু তবলা ইত্যাদি সহযোগে পোড়া জতুগৃহ থেকে বাহিরিয়া যবে, পাণ্ডব বঝিলা মনে এ বিশাল ভবে গৃহ বন্ধু কিছু নেই, নিলা বনবাস। দুঃখে কষ্টে বৃক্ষতলে কাটে দিনমাস। কত যে বিপদ

3

এই যা দেখা

29 November 2023
2
0
0

কলকাতা শহরের উত্তর দিকে সরু একটা সদর রাস্তা, তাতে লোকজন গাড়িঘোড়ার ভিড় কত, ভোর থেকে গভীর রাত অবধি হাঁকডাক ঠেলাঠেলি। লোকে বলে পথটা খুব পুরনো, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কালে তৈরি, ঘরবাড়িগুলো এ ওর গায়

4

ছেলেবেলার গল্প

30 November 2023
0
0
0

গণশার চিঠি ভাই সন্দেশ, অনেকদিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে সব ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকাঠক্ হয়ে কড়া পড়

5

হলদে পাখির পালক

1 December 2023
0
0
0

এক কত দেরি হয়ে গেল ভুলো তবু বাড়ি এল না, সন্ধে হয়ে গেল, রাত হয়ে গেল। দাদু তাস খেলতে যাবার আগে বললেন, "খুঁজতে যাবার কিছু দরকার নেই, কেউ তোদের নেড়িকুত্তো চুরি করবে না, খিদে পেলে সুড়সুড় করে নিজেই বাড়ি ফি

6

বহুরূপী

2 December 2023
0
0
0

ছোটবেলাকার কত কথাই যে মনে পড়ে, কত কান্ডই যে তখন হত। একবার গুপের মামাতো ভাই ভোঁদা বলেছিল যে বহুরূপীরা পর পর সাতদিন আসে, একেক দিন এক এক নতুন সাজে। কখনো কখনো সবাই তাকে বহুরূপী বলে চিনে ফেলে, আবার কখনো কখ

7

মহালয়ার উপহার

2 December 2023
0
0
0

শিবু, শিবুর মা আর শিবুর বউ তিন নম্বর হোগলাপট্টি লেনের দোতলার তিনখানি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত। একটা ঘরে শিবুর মা শুত, সেটা সব থেকে বড় ও ভালো, কারণ বুড়ি ভারি খিটখিটে। আরেকটাতে শিবু আর শিবুর বউ, শুত, সেটা মাঝ

8

ভানুমতীর খেল

3 December 2023
0
0
0

গোরুদের ঘরের পিছনের ছোট ফটকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। গোয়ালের কোনায় একটা মাটির ঢিবির উপর ঝোপের আড়ালে বসে-বসে একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছে আর একটু-একটু পা দোলাচ্ছে। সারা গায়ে ধুলো

9

পঞ্চমুখী শাঁখ

3 December 2023
0
0
0

বন্ধুদের দেশের বাড়িতে একটা প্রকাণ্ড পঞ্চমুখী শাঁখ আছে! শুনেছি শাঁখটা নাকি দেড়শো বছর ধরে ওদের বাড়িতে রয়েছে। ওর নানা- রকম গুণটুনও নাকি আছে। আগে রোজ ওর পুজো হত, পুরুতঠাকুর আসত, খাওয়া-দাওয়া হত। তবে সত্তর

10

হুঁশিয়ার

3 December 2023
0
0
0

যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা-খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা,

11

সেকালে

3 December 2023
0
0
0

পঁয়ষট্টি বছর আগে আমার মামাবাড়ির দেশে এক দিকে যেমন সাধু- সজ্জনের ভিড় ছিল এবং তার ফলে পুজোপার্বণ, তিথিপালন, হরির লুট, ব্রাহ্মণ-ভোজন, কাঙালী-বিদায় লেগেই থাকত, আবার তেমনি অন্য দিক দিয়ে ঠগ-ঠ্যাঙাড়ে, জোচ্চো

12

চোর

3 December 2023
0
0
0

ঠিক যেই নিতাইদের বাড়ির পেছনের সেই ঝাঁকড়ান্ডুলো ঝোপটার কাছে এসেছি, পকেট হাতড়ে দেখি যে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! সেই কোনা-মোড়া আধ-ময়লা নোটটা কে যেন বুক-পকেট থেকে তুলে নিয়েছে! ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ের চোটে ক

13

টাইগার

3 December 2023
0
0
0

তাকে উলটে দেখলাম থাবার তলাটা গোলাপী মখমলের মতো, মাঝে- মাঝে কচি-কচি সাদা লোম। পেটের তলাটাও গোলাপী-নরম তুলতুলে এক জায়গায় একটা শিরা না কি যেন ধুন্ধুক্ করছে। মুণ্ডুটাকে তুলে আবার নিজের পেট দেখতে চেষ্টা কর

14

লোমহর্ষণ

3 December 2023
0
0
0

রাজামশাই ব্যস্ত হয়ে দরদালানে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন, খিদেয় পেটের এ-দেয়াল ও-দেয়াল একসঙ্গে লেপটে যাচ্ছে, টেবিল পাতা, সোনার বাসন-কোসন সাজানো, মুক্তো-বসানো গেলাসে কেয়ার গন্ধ-দেওয়া জল, রানী ওদিকে মখমলের গদি

15

ভালোবাসা

3 December 2023
0
0
0

আজকাল সবই অন্যরকম লাগে। দরজার কড়া নাড়বামাত্র ভিতর থেকে একটা ভারী জিনিস দরজার উপর আর আছড়েও পড়ে না। নখ দিয়ে কেউ দরজায় আঁচড়িয়ে, পালিশ উঠিয়ে, বকুনিও খায় না; ঘরে ঢুকবামাত্র নেচেকঁদে গায়ের উপর চড়ে একাকারও ক

16

তেজী বুড়ো

3 December 2023
0
0
0

আয়না দেখে আঁতকে উঠলুম। এ তো আমার সেই চিরকেলে চেহারা নয়! সেই যাকে ছোটবেলা দেখেছিলুম ন্যাড়া মাথা, নাকে সদি, চোখ ফুলো! তার পর দেখেছিলুম চুল খোঁচা, নাক খাঁদা, গালে-টালে কাজল! এই সেদিনও দেখলুম খাকি পেন্টেল

17

দিনের শেষে

5 December 2023
0
0
0

লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তাদ এসেছে। দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়িতে গান শুনতে গেছেন, ফিরতে রাত হবে। ঝগড় বলল, "তা তোমরা যদি সব-কিছুই বিশ্বাস না করে আনন্দ পাও, তা হলে আমার আর কিছু বলবার নেই। তবে সর্বদা মনে

18

আমাদের দেশে

5 December 2023
0
0
0

আমাদের দেশের কথা আর কী বলব, সে কি আর এখন আমাদের আছে? একেবারে পাকিস্তানের পূর্বকোণে ঠুসে দিয়েছে। কিন্তু সেখানকার লাল-লাল গোল-আলু আর সেখানকার পাকা সোনালী আনারস আর আঠাল দুধের ক্ষীর যে একবার খেয়েছে সে সার

19

পালোয়ান

5 December 2023
0
0
0

নিউ মার্কেটের পিছনে বাঁদরের দোকান আছে। ছোট-ছোট খাঁচায় পোরা বাঁদরের ভিড়, এ-ওর গায়ে চিকে রয়েছে। তা ছাড়া সাদা ইঁদুর, বেজি, কাকাতুয়া, কালোমুখো ল্যাজ-প্যাঁচানো শ্যামদেশের বেড়াল, ভালুক বাচ্চা, আরো কত কি যে

20

গুণ-করা

5 December 2023
0
0
0

বুঝলে, আমার মামাবাড়িতে ফান্ড বলে একটা চাকর ছিল। বাঙালি নয়। ঐ গারো পাহাড়ে অঞ্চলে ওর বাড়ি। আশা করি গারো পাহাড় কোথায় সে কথা আর তোমাদের বলে দিতে হবে না। ফান্ড যে বাঙালি নয় সে ওকে দেখলেই বোঝা যেত। বেঁটে, ম

21

কি বুদ্ধি

5 December 2023
0
0
0

জন্তু জানোয়ারদের বিষয়ে কতরকম অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায় তার আরু ঠিক নেই। একবার নাকি একটি ব্যাঙ কেমন করে পাথরের ফোকরের মধ্যে বদ্ধ হয়ে গিয়ে, ঐভাবে কতকাল যে ছিল তার ঠিক নেই। বোধ হয় অনেক শো বছর। তার পর যেই

22

বনের ধারে

5 December 2023
0
0
0

ছোটবেলায় পাহাড়ে দেশে থাকতাম। চার দিকে ছিল সরলগাছের বন। তাদের ছুচের মতো লম্বা পাতা, সারা গায়ে ধুনোর গন্ধ, একটুখানি বাতাস বইলেই শোঁ শোঁ একটা শব্দ উঠত। শুকনো সময় গাছের ডালে ডালে ঘষা লেগে অমনি আগুন লেগে য

23

মেজোমামার প্রতিশোধ

5 December 2023
0
0
0

আমার মেজোমামাকে নিশ্চয় তোমরা কেউ দ্যাখ নি। হাড় জিজিরে রোগা বেঁটে মতন, সরু লিক্লিকে হাত-পা, সারা মুখময় খোঁচা-খোঁচা দাড়ি গোঁফ। কারণ মেজোমামা দু সপ্তাহে একবার দাড়ি চাঁচেন, নাকি দাড়ি কামালেই মুখময় আঁচড়ে য

---