এই পরিপ্রেক্ষিতে রাম ও লক্ষ্মণের এবং তাঁহাদের সহযোগীদের চরিত্র বিচার করিতে হইবে। 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র রাম ও লক্ষ্মণ মাইকেলের প্রতিভার অপূর্ণতার পরিচায়ক এইরূপ মত বহু লোকে প্রকাশ করিয়াছেন এবং এই মন্তের আংশিক সত্যতা মানিতেই হইবে। তবে পূর্বেই বলা হইয়াছে যে রাম ও লক্ষ্মণ এই কাব্যে অবতাররূপে কল্পিত না হইলেও তাঁহারা ধর্মেক অমোঘ নিয়মের বাহন মাত্র। হুতরাং তাঁহাদের ব্যক্তিগত শৌর্য তাহাদের পক্ষে শেষ কথা নহে, তাঁহারা সেই গার্হস্থ্য ধর্ম ও চরাচরব্যাপী নীতির প্রতিনিধি যাহা রাবণ লঙ্ঘন করিয়াছেন। লক্ষ্মণ ব্রহ্মচারী, তিনি সকল প্রলোভন জয় করিতে পাবেন, এমন কি দিব্যাঙ্গনারা তাঁহার চিত্তবিভ্রম ঘটাইতে পারেন নাই। সম্মগ যুদ্ধে তিনি কাতর নহেন, স্বয়ং শূলী মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেও তিনি প্রস্তুত, এবং রাবণ যখন তাঁহাকে বধ করিতে অগ্রসর হইলেন তখন তিনি সদর্পে অথচ সংযতভাবে উত্তর করিলেন:
ক্ষত্রবুলে জন্ম মম রগঃবুলপতি
নাহি ভরি যমে আমি, কেন ভরাইব
তোমায়? আকুল তুমি পুত্রশোকে আজি
যথাসাধ্য কর রখি; আশু নিবারিব
শোক তব, প্রেরি তোমা পুভ্রর যথ।।
লক্ষ্মণ বীরশ্রেষ্ঠ হইলেও মেঘনাদকে অল্লায় সমরে নিধন কবিয়াছেন এবং এই
সম্পর্কে তিনি সচেতন বলিয়াও মনে হয় ন।। তাঁহার যুক্তি বীরের যুক্তি নহে:
আনায় মাকারে বামে পাইলে কি কভু
ছাড়ে রে কিরাত তারে?
মারি অরি, পারি যে কৌশলে।
মাইকেল মধুঈদন যে চিত্র আঁকিয়াছেন তাহার স্বপক্ষে ইহা বলা যাইতে পারে যে বাগ্মীকি-অঙ্কিত রাম কর্তৃক বালিবদের চিত্র ইহা অপেক্ষা মহত্তর নহে। কিন্তু লক্ষ্মণের পক্ষে প্রধান বক্তব্য এই যে তিনি দৈবশক্তির বাহন হিসাবে অন্তায় সমরে ব্রতী হইয়াছিলেন। ইন্দ্রজিৎবধের পরে রাম যে অভিনন্দন জানাইয়াছেন তাহার মধ্যে মাইকেলের চরিত্রাঙ্গনের উপযুক্ততর সমর্থন পাওয়া যাইবে। রাম লক্ষ্মণকে এই বলিয়া সম্ভাষণ করিলেন:
লভিন্ন সীতায় আজি তব বাহুবলে,
হে বাহুবলেন্দ্র।
পূজ কিন্তু বলদাতা দেবে,
প্রিয়তম! নিজবলে দুর্বল সতত
মানব! দু-ফল ফলে দেবের প্রসাদে।