শুধু মৌলিক পরিকল্পনায় নহে, চরিত্রস্বষ্টিতেও 'মেঘনাদবধ কাব্য' মহাকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। প্রথমেই দেবদেবীদের কথা ধরা যাইতে পারে। ইলিয়াডে দেবদেবীগণ মানব-মানবীর স্থায়। মানব-মানবীর সব দোষগুণই তাঁহাদের আছে, শুধু তাঁহাদের শৌর্য ও শক্তি মানবাতিরিক্ত। তাঁহারা গ্রীকৃ ও ট্রোজানদের যুদ্ধে অংশ-গ্রহণ করিয়াছেন এবং অনেক সময় আহত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছেন। নিজেদের রাজ্যে তাঁহারা মানবোচিত আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হইয়াছেন, দেবরাজ জিউস্কে দেবমহিষী হিরা মর্ত্যবাসিনী নায়িকার মতই মুগ্ধ করিয়াছেন। মাইকেল মধু্যূদনের দেবদেবীরা হোমারের আদর্শে পরিকল্পিত হইয়াছেন। সেখানেও পার্বতী মোহিনী মূর্তিতেই মহাদেবকে মুগ্ধ করিতে চাহিয়াছেন। এখানে কুমারসম্ভবের উমা-মহেশ্বর-সংবাদের কথঞ্চিৎ প্রভাব থাকিলেও কুমারসম্ভবে যে যতিশ্রেষ্ঠ মহাদেব ও পূজারতা পার্বতীর পরিচয় পাই 'মেঘনাদবধ কাব্যে' তাঁহাদের পরিবর্তন হইয়াছে। তাঁহার। বরং জিউস্ ও হিরারই অন্তরূপ। কিন্তু তাহা হইলেও মহাদেব যে অমোঘ নীতি-ধর্মে অন্তরক্তি দেখাইয়াছেন জুপিটারে তাহার স্পর্শমাত্র নাই। অন্তান্ত দেবদেবীগণ হোমারের দেবদেবী অপেক্ষা নিকৃষ্ট, কারণ তাঁহারা সবাই মেঘনাদের ভয়ে ত্রস্ত এবং মেঘনাদের মৃত্যুর পর তাহারা যখন যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছেন তখন তাহাদের শক্তি অপহৃত হইয়াছে। সুতরাং পার্থিব বীর অপেক্ষা যে শ্রেষ্ঠত্ব হোমারের দেবদেবীর মধ্যে দেখা যায় এখানে তাহা প্রত্যাশা করা যায় না। তাহা হইলেও মাইকেল স্বর্গবাসী দেবদেবী ও অশরীরী মায়া প্রভৃতির যে প্রত্যক্ষগোচর মৃত্তি আঁকিয়াছেন তাহা তাঁহার প্রতিভার স্বকীয়তাই প্রমাণিত করে। তাঁহার সৃষ্টির আর একটি উল্লেপ- যোগ্য গুণ-পরিকল্পনার ঐশ্বর্য। শুধু বাহিরের দিক্ দিয়া নহে, 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র ইন্দ্র, শচী, মরন, রতি, পার্বতী, সরলা প্রভৃতি দেবদেবীগণ অন্ত- ভূতির ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান। তাঁহাদের সুখ-দুঃখের অন্তভূতি, রায়ান্ডায়বোধ, ভক্তবাৎসল্য তাঁহাদিগকে সাধারণ নর-নারী অপেক্ষা উচ্চস্তরে উন্নীত করিয়াছে এবং তাঁহারা হইতেছেন সেই নৈতিক শক্তির প্রতীক যাহা পাপাচারী রাধাকে সবংশে নিধন করিবে।