আমাদের দেশের অলঙ্কারশাস্ত্র মানবহৃদয়ের প্রবৃত্তিগুলিকে প্রধানতঃ আট বা নয়টি স্থায়ীভাবে বিভক্ত করিযা আট বা নয়টি রসের পরিকল্পনা করিয়াছে। এইরূপ সাহিত্যবিচারের কতকগুলি অসুবিধা আছে। যদি স্থায়ী ভাবগুলিকে বাঁড়াইয়া দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয় তাহা হইলে বলা যাইতে পারে যে আমাদের হৃদয়ের অন্যতম স্থায়ী ভাব হইতেছে বিস্তৃতিবোধ। অল্পবিস্তর সমস্ত কাব্যেই বিস্ময়ের ভাব সঞ্চারিত হইয়া থাকে, ওয়াল্টার পেটার ইহাকে রোমান্টিক কাব্যের মূল উৎস বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এই বিস্ময়বোধ যখন বিরাট্ কিছুর দ্বারা উদ্বোধিত হয তখন তাহা একটা বিশিষ্ট রসের সঞ্চার করে যাহার নাম দেওয়া যাইতে পারে বিশালরস। এই জাতীয় কাব্যে উন্মুক্ততা থাকিতে পারে, ইহার মধ্য দিয়া একটা জাতি বা সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করিতে পারে, ইহা অলঙ্কারশাস্ত্রের কৃত্রিম নিয়মানুসারে লিখিত হইতে পারে, কিন্তু ইহার মূল লক্ষণ হইবে বিস্তৃতি। বিশ্বনাথ বলিয়াছেন যে বীর, শৃঙ্গার অথবা শান্ত রস মহাকাব্যের অঙ্গী রস হইয়া থাকে। কিন্তু পূর্বেই বলা হইয়াছে আনন্দবর্ধন মনে করেন যে রামায়ণের অঙ্গী রস হইল করুণ। বাস্তবিক পক্ষে মহাকাব্যে যে-কোন রসের সমাবেশ হইতে পারে, অলঙ্কারবর্ণিত নয়টি রসের যে কোন একটি অঙ্গী হইতে পারে যদি তাহা বিশালতার অনুভব জাগাইতে পারে। ইহাই সমস্ত মহাকাব্যের প্রধান লক্ষণ।
প্রাচীনযুগের যে চারিখানি মহাকাব্য শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে এই গুণটি বর্তমান আছে। অ্যাকিলিস, মুলিসিস, স্বাম অর্জুন-ইহারা সবাই বিরাট্ ব্যক্তি, ইহাদের কার্যকলাপে দেবদেবীরা প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ গ্রহণ করিতেছেন। রামচন্দ্র অবতার-শ্রেষ্ঠ, শ্রীকৃষ্ণও পার্থসারথি এবং ট্রয়ের যুদ্ধে দেবদেবীদের উৎসাহ এত বেশী যে অনেক সময় তাঁহারা নিজেরা যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছেন, ভক্ত বা প্রেয় মানবকে রক্ষা করিয়াছেন, নিজেরাও আহত হইয়াছেন। দেবদেবীরা এত প্রত্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দেবাতিরিক্ত নায়কদের ক্ষমতার লাঘব হয় নাই। অ্যাকিলিস্, হেক্টর, ডাযমিডিস; পাণ্ডব ও কৌরব বীরগণ লক্ষ্মণ, হনুমান, রাবণ ও মেঘনাদের শ্রেষ্ঠত্বের হানি হয় নাই। এতদ্ব্যতীত আবও দুইটি লক্ষণ লক্ষ্য করা যাইতে পারে। হোমারের উপমাগৌরব সুপ্রসিদ্ধ। যে সমস্ত উপমায় তাঁহার প্রতিভার স্বকীয়তা সূচিত হইয়াছে সেই সকল উপমা খুব দীর্ঘ, তাহাদের মধ্যে বিশালত। ও বিস্তৃতির অনুভব বিশেষভাবে পরিস্ফুট হইয়াছে। রামায়ণ- মহাভারতের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে তন্মধ্যে দেব-মানব-রাক্ষসের সংঘর্ষের মধ্য দিয়া একটি নৈতিক ভাব প্রকাশিত হইয়াছে। রামায়ণের সবচেয়ে বড় কথা বামের বাহুবল নহে, সীতার দুঃখ নহে রাম যে পিতৃসত্য রক্ষা করিবার জন্য বনে গিয়াছিলেন, ধর্মপত্নীকে উদ্ধার করিবার জন্য যুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং রাজধর্ম রক্ষা করিবার জন্য সেই পত্নীকে বনবাসে দিয়াছিলেন ইহাই রামায়ণের প্রধান বক্তব্য। মহাভারতে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ একটি বিরাট্ সংগ্রাম, উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের মধ্যে অতিমানবীয় বীরত্বের অভাব নাই। কিন্তু এই বীরত্ব ও সংগ্রামের বিশালতাকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে মহাভারতের নৈতিক তত্ত্ব। আনন্দবন্ধন বলিয়াছেন যে এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য হইতেছে সংসারের নিঃসারতা প্রতিপাদন করা এবং ইহার নায়ক হইতেছেন শ্রীকৃষ্ণ-ভীষ্ম বা অর্জুন নহেন।