নমি আমি, কবি-গুরু, তব পদাম্বুজে, বাল্মীকি! হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি, তব অনুগামী দাস, রাজেন্দ্র-সঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থ-দরশনে তব পদ-চিহ্ন ধ্যান করি দিবা নিশি, পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে, দমনিয়া ভব-দম দুরন্ত শমনে-' অমর! শ্রীভর্তৃহরি; সূরী ভবভূতি শ্রীকণ্ঠ; ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি ভারতীর, কালিদাস-সুমধুর-ভাষী; ইন্দ্রজিং ফ্রারি-মুরলী-ধ্বনি-সদৃশ মুরারি মনোহর; কীর্তিবাস, কীতিবাস কবি,
এ বঙ্গের অলঙ্কার!-হে পিতঃ, কেমনে, কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি! পুনঃ সে গাঁথিব নূতন মালা, তুলি সযতনে তব কাব্যোখ্যানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে বিবিধ ভূষণে ভাসা; কিন্তু কোথা পাব (দীন আমি!) রত্নরাজী, তুমি নাহি দিলে, রত্নাকর? রুপা, প্রভু, কর অকিঞ্চনে।
ভাসিছে কনক-লঙ্কা আনন্দের নীরে, সুবর্ণ-দীপ-মালিনী, রাজেন্দ্রাণী যথা রত্নহারা! ঘরে ঘরে বাজিছে বাজনা; নাচিছে নর্তকী-বৃন্দ, গাইছে সুতানে গায়ক; নায়কে লয়ে কেলিছে নায়কী, খল খল খল হাসি মধুর অধরে! কেহ বা সুরতে রত, কেহ শীধু-পানে।
দ্বারে দ্বারে ঝোলে মালা গাঁথা ফল-ফুলে; গৃহাগ্রে উড়িছে ধ্বজ; বাতায়নে বাতি; জনস্রোতঃ রাজ-পথে বহিছে কল্লোলে, ৩০ যথা মহোৎসবে, যবে মাতে পুরবাসী। রাশি রাশি পুষ্প-বৃষ্টি হইছে চৌদিকে- সৌরভে পুরিয়া পুরী। জাগে লঙ্কা আজি নিশীথে, ফিরেন নিদ্রা দুয়ারে দুয়ারে, কেহ নাহি সাধে তাঁরে পশিতে আলয়ে, বিরাম-বর প্রার্থনে!- "মারিবে বীরেন্দ্র কালি রামে; মারিবে লক্ষ্মণে; সিংহনাদে খেদাইবে শৃগাল-সদৃশ বৈরি-দলে সিন্ধু-পারে; আনিবে বাঁধিয়া বিভীষণে; পলাইবে ছাড়িয়া চাঁদেরে ৪০ রাহু; জগতের আঁখি জুড়াবে দেখিয়া সুধাংশু-ধনে"; আশা মায়াবিনী পথে, ঘাটে, ঘরে, দ্বারে, দেউলে, কাননে, গাইছে গো এই গীত আজি রক্ষঃপুরে- কেন না ভাসিবে রক্ষ: আলাদ-সলিলে?
একাকিনী শোকাকুলা, অশোক-কাননে, কাঁদেন নীরবে! রাঘব-বাঞ্ছা আঁধার কুটীরে দুরন্ত চেড়ী, সতীরে ছাড়িয়া, মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে- হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী ফেরে দূরে হীন-প্রাণা নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে! মলিন-বদনা দেবী, হায় রে, যেমতি খনির তিমির-গর্ভে (না পারে পশিতে সৌর-কর-রাশি যথা) সূর্যকান্ত মণি, কিম্বা বিস্বাধরা রমা অম্বুরাশি-তলে! স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া উচ্ছ্বাসে বিলাপী যথা! লড়িছে বিষাদে মর্মরিয়া পাতাকুল! বসেছে অরবে শাখে পাখী! রাশি রাশি কুসুম পড়েছে তকমূলে, যেন তরু, তাপি মনস্তাপে, ফেলিয়াছে খুলি সাজ! দূরে প্রবাহিণী, উচ্চ বীচি-রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে, কহিতে বারীশে যেন এ দুঃখ-কাহিনী! না পশে সুধাংশু-অংশু সে ঘোর বিপিনে। ফোটে কি কমল কছু সমল সলিলে? তবুও উজ্জল বন ও অপূর্ব রূপে!
একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী তমোময় ধামে যেন! হেনকালে তথা সরমা সুন্দরী আসি বসিলা কাঁদিয়া সতীর চরণ তলে, সরমা সুন্দরী- রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী রক্ষোবধূ-বেশে!
কত ক্ষণে চক্ষুঃ-জল মুছি স্থলোচনা কহিলা মধুর স্বরে; "দুরন্ত চেড়ীরা, তোমারে ছাড়িয়া, দেবি, ফিরিছে নগরে, মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা-কালে; এই কথা শুনি আমি আইমু পূজিতে পা দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা, সুন্দব ললাটে দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে এ বেশ? নিষ্ঠুর, হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি! কে ছেড়ে পদ্মের পর্ণ? কেমনে হরিল ও বরাঙ্গ-অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি!" কৌটা খুলি, রক্ষোবধূ যত্নে দিলা ফোটা সীমস্তে; সিন্দুর-বিন্দু শোভিল ললাটে, গোধূলি-ললাটে, আহা! তারা-রত্ব যথা!
দিয়া ফোঁটা, পদ-ধূলি লইলা সরমা। "ক্ষম, লক্ষ্মি, ছু'ইন্ড ও দেব-আকাঙ্ক্ষিত তন্ম; কিন্তু চির-দাসী দাসী ও চরণে।" এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী পদতলে। আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটি তুলসীর মূলে যেন জলিল, উজলি দশ দিশ! মৃদু স্বরে কহিলা মৈথিলী,-
"বৃথা গঞ্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখি! আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইন্স দূরে আভরণ, যবে পাপী আমারে ধরিল বনাশ্রমে। ছড়াইন্ড পথে সে সকলে, চিহ্ন-হেতু। সেই হেতু আনিয়াছে হেথা- এ কনক-লঙ্কাপুরে-ধীর রঘুনাথে! মণি, মুক্তা রতন, কি আছে লো জগতে যাহে নাহি অবহেলি লভিতে এ ধনে?
কহিলা সরমা; "দেবি, শুনিয়াছে, দৃসিী তব স্বয়ম্বর-কথা তব সুধা-মুখে; কেন বা আইলা বনে রঘু কুল-মণি। কহ এবে দয়া করি, কেমনে হরিল তোমারে রক্ষেন্দ্র, সতি? এই ভিক্ষা করি,- দাসীর এ তৃষা তোষ সুধা-বরিষণে! দূরে দুষ্ট চেড়ীদল; এই অবসরে কহ মোরে বিবরিয়া, শুনি সে কাহিনী। কি ছলে ছলিল রামে, ঠাকুর লক্ষ্মণে এ চোর?
কি মায়া-বলে রাঘবের ঘরে প্রবেশি, করিল চুরি এ হেন রতনে?" যথা গোমুখীর মুখ হইতে হুম্বনে ঝরে পূত বারি-ধারা, কহিলা জানকী, মধুরভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি সরমারে,-"হিতৈষিণী সীতার পরমা তুমি, সখি! পূর্ব-কথা শুনিবারে যদি ইচ্ছা তব, কহি আমি, শুন মনঃ দিয়া।
("ছিন্ন মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে বাধি নীড়, থাকে স্বপে; ছিন্ন ঘোর বনে, নাম পঞ্চবটী, মর্ত্যে সুর-বন-সম। সদা করিতেন সেবা লক্ষ্মণ সুমতি। দণ্ডক ভাণ্ডার যার, ভাবি দেখ মনে, কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি নিত্য ফল মূল বীর সৌমিত্রি; মৃগয়া করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীবনাশে সতত বিরত, সখি, রাঘবেন্দ্র বলী,- দয়ার সাগর নাথ, বিদিত জগতে!
("ভুলিনু পূর্বের সুখ। রাজার নন্দিনী, রঘু কুল-বধূ আমি; কিন্তু এ কাননে, পাইমু, সরমা সই, পরম পিরীতি! কুটীরের চারি দিকে কত যে ফুটিত ফুলকুল নিত্য নিত্য, কহিব কেমনে? পঞ্চবটী-বন-চর মধু নিরবধি; জাগাত প্রভাতে মোরে কুহরি সুস্বরে পিক-রাজ! কোন্ রাণী, রুহ, শশিমুখি,
হেন চিত্ত-বিনোদন বৈতালিক-গীতে খোলে আথি? শিখী সহ, শিখিনী মুখিনী নাচিত দুয়ারে মোর! নর্তক, নর্তকী, এ দোহার সম, রামা, আছে কি জগতের অতিথি আসিত নিত্য করড, করভী,
মৃগ-শিশু, বিহঙ্গম, স্বর্ণ-অঙ্গ কেহ, কেহ শুভ্র, কেহ কাল, কেহ বা চিত্রিত, যথা বাসবের ধন্তঃ ঘন-বর-শিরে; অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে, মহাদরে; পালিতাম পরম যতনে, মরুভূমে স্রোতস্বতী তৃণাতুরে যথা, আপনি সুজলবর্তী বারিদ-প্রসাদে।- সরসী আরসি মোর! তুলি কুবলযে, (অমূল রতন-সম) পরিতাম কেশে; সাজিতাম ফুল-সাজে; হাসিতেন প্রভু, বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে! হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে? আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে দেখিবে সে পা ছগানি-আশার সরসে রাজীব; নয়নমণি? হে দারুণ বিধি,
কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে?" এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে। কাঁদিলা সরমা সতী তিতি অশ্রু-নীরে।
কত ক্ষণে চক্ষুঃ-জল: মুছি রক্ষোবধূ সরমা কহিলা সতী সীতার চরণে;- "স্মরিলে পূর্বের কথা ব্যথা মনে যদি পাও, দেবি, থাক্ তবে; কি কাজ স্মরিয়া?- হেরি তব অশ্রু-বারি ইচ্ছি মরিবারে!"
উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা (কাদয়া যেমতি মধু-স্বরা!): "এ অভাগী, হায়, লো স্বভগে, যদি না কাঁদিবে তবে কে আর কাঁদিবে এ জগতে? কহি, শুন পূর্বের কাহিনী। বরিষার কালে, সপি, প্লাবন:পীড়নে কাতর প্রবাহ, ঢালে, তীর অতিক্রমি, বারি-রাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ দুঃখিত, দুঃখের কথা কহে সে অপরে। তেই আমি কহি, তুমি শুন, লো সরমে। কে আছে সীতার আর এ অবরু-পুরে?
"পঞ্চবটী-বনে মোরা গোদাবরী-তটে ছিন্ন সুখে। হায়, সপি, কেমনে বর্ণিব সে কাস্তার-কাস্তি আমি? সতত স্বপনে শুনিতাম বন-বীণা বন-দেবী-করে; সরসীর তীরে বসি, দেখিতাম কহু সৌর-কর-রাশি-বেশে সুর-বালা কেলি পদ্মবনে; কভু সাধ্বী ঋষি-বংশ-বধূ সুহাসিনী আসিতেন দাসীর কুটীরে, সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে! অজিন (রঞ্জিত, আহা, কত শত রঙে!) পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরু-মূলে, সখী-ভাবে সন্তাসিয়া ছায়ায়, কভু বা
কুরঙ্গিণী-সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে,
গাইতাম গীত শুনি কোকিলের ধ্বনি!
নব-লতিকার, সতি, দিতাম বিবাহ
তরু-সহ, চুম্বিতাম, মঞ্জরিত যবে
দম্পতী, মঞ্জরীবৃন্দে, আনন্দে সম্ভাষি
নাতিনী বলিয়া সবে। গুঞ্জরিলে অলি,
নাতিনী জামাই বলি বরিতাম তারে!
কহু বা প্রভুর সহ ভ্রমিতাম সুখে
নদী-তটে; দেখিতাম তরল সলিলে
নূতন গগন যেন, নব তারাবলী, নব নিশাকান্ত-কাস্তি! কভু বা উঠিয়া পর্বত-উপরে, সখি, বসিতাম আমি নাথের চরণ-তলে, ব্রততী যেমতি বিশাল রসাল-মূলে; কত যে আদরে' তুষিতেন প্রভু মোবে, বরধি বচন- সুধা, হায়, কব কারে? কব বা কেমনে?
শুনেছি কৈলাস-পুরে কৈলাস-নিবাসী ব্যোমকেশ, স্বর্ণাসনে বসি গৌরী-সনে, আগম, পুরাণ, বেদ, পকৃতম্ব কথা পঞ্চ মুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে: শুনিতাম সেইরূপে আমিও, রূপসি, নানা কথা! এখনও, এ বিজন বনে, ভাবি আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী!- সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি,
সে সঙ্গীত?"-নীরবিলা আয়ত-লোচনা
বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী;- "শুনিলে তোমার কথা, রাঘব-রমণি, ঘৃণা জন্মে রাজ-ভোগে! ইচ্ছা করে ত্যজি রাজ্য-সুখ, যাই চলি হেন বন-বাসে! কিন্তু ভেবে দেখি যদি, ভয় হয় মনে। রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে.. তমোময়, নিজ গুণে আলো করে বনে সে কিরণ! নিশি যবে যায় কোন দেশে, মলিন-বদন সবে তার সমাগমে। যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি, কেন না হইবে সুখী সর্ব জন তথা? জগত-আনন্দ তুমি, ভুবন-মোহিনী! কহ, দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা-ধ্বনি দাসী,
পিকবর-রব নব পল্লব-মাঝারে সরস মধুর মাসে; কিন্তু নাহি শুনি ছেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে!'
দেখ চেয়ে, নীলাম্বরে শশী, যাঁর আভা মলিন তোমার রূপে, পিইছেন হাসি তব বাক্য-মৃধা, দেবি, দেব সুধানিধি! নীরব কোকিল এবে আর পাখী যত, শুনিবারে ও কাহিনী, কহিমু তোমারে। এ সবার সাধ, সাব্বি, মিটাও কহিয়া।"
কহিলা রাঘব-প্রিয়া; "এইরূপে, সখি, কাটাইনু কত কাল পঞ্চবটী-বনে সুখে। ননদিনী তব, দুষ্টা সূর্পণখা, বিষম জয়াল আসি ঘটাইল শেষে!
শরমে, সরমা সই, মরি লো স্মরিলে তার কথা! ধিক্ তারে! নারী-কুল-কালি। চাহিল মারিয়া মোরে বরিতে বাঘিনী রঘুবরে! ঘোর রোষে সৌমিত্রি কেশরী খেদাইলা দূরে তারে। আইলা ধাইয়া রাক্ষস, তুমুল রণ বাজিল কাননে।
সভয়ে পশিশু আমি কুটীর মাঝারে। কোস্লপ্ত-টংকারে, সখি, কত যে কাঁদিমু, কব কারে? মুদি আখি, ক্বতাঞ্জলি-পুটে ডাকিমু দেবতা-কুলে রক্ষিতে রাঘবে! আর্তনাদ, সিংহনাদ উঠিল গগনে।
অজ্ঞান হইয়া আমি পড়িমু ভূতলে।
"কত ক্ষণ এ দশায় ছিন্ন যে, স্বজনি,
নাহি জানি; জাগাইলা পরশি দাসীরে রঘুশ্রেষ্ঠ। মৃদু স্বরে, (হায় লো, যেমতি স্বনে মন্দ সমীরণ কুসুম-কাননে বসন্তে!) কহিল কান্ত; 'উঠ, প্রাণেশ্বরি, রঘুনন্দনের ধন! রঘু-রাজ-গৃহ-
"সহসা শুনিম্ন, সখি, আর্তনাদ দূরে- 'কোথা রে লক্ষ্মণ ভাই, এ বিপত্তি-কালে? মরি আমি!' চমকিলা সৌমিত্রি কেশরী! চমকি ধরিয়া হাত, করিছু মিনতি;- আনন্দ। এই কি শষ্যা সাজে-হে তোমারে, 'যাও বীর বায়ু-গতি পশ এ কাননে;
হেমাঙ্গি?'-সরমা সখি, আর কি শুনিব সে মধুর ধ্বনি আমি?"-সহসা পড়িলা মূর্ছিত হইয়া সতী; ধরিল সরমা! যেথা যবে ঘোর বনে নিম্নাদ, শুনিয়া পাখীর ললিত গীত বৃক্ষ-শাথে, হানে স্বর লক্ষ্য করি শর, রিয়ম-আঘাতে ছটফটি পড়ে ভূমে বিহঙ্গী, তেমতি সহসা পড়িলা সতী সরমার কোলে!
কত ক্ষণে চেতন পাইলা সুলোচনা। কহিলা সরমা কাঁদি; "ক্ষম দোষ মম, মৈথিলি! এ ক্লেশ আজি দিমু অকারণে, হায়, জ্ঞানহীন আমি!" উত্তর করিলা মৃদু স্বরে সুকেশিনী রাঘব-বাসনা; "কি দোষ তোমার, সখি? শুন মনঃ দিয়া, কহি পুনঃ পূর্ব-কথা। মারীচ কি ছলে (মরুভূমে মরীচিকা, ছলয়ে যেমতি!) ছলিল, শুনেছ তুমি স্বর্পণখা-মুখে। হায় লো, কুলগ্নে, সখি, মগ্ন লোভ-মদে, মাগিনু কুরঙ্গে আমি! ধনুর্বাণ ধরি, বাহিরিলা রঘুপতি, দেবর লক্ষ্মণে রক্ষা-হেতু রাখি ঘরে। বিদ্যুৎ-আকৃতি পলাইল মায়া-যুগ, কানন উজলি, বারণারি-গতি নাথ ধাইলা পশ্চাতে হারানু নয়ন-তারা আমি অভাগিনী!
দেখ, কে ডাকিছে তোমা? কাঁদিয়া উঠিল। শুনি এ নিনাদ, প্রাণ! যাও ত্বরা করি- বুঝি রঘুনাথ তোমা ডাকিছেন, রথি!'
কহিলা সৌমিত্রি; 'দেবি, কেমনে পালিব
আজ্ঞা তব? একাকিনী কেমনে রহিবে
এ বিজন বনে তুমি?
কত যে মায়াবী রাক্ষস ভ্রমিছে হেথা, কে পারে কহিতে? কাহারে ডরাও তুমি? কে পারে হিংসিতে রঘুবংশ-অবতংসে এ তিন ভুবনে, ভৃগুরাম-গুরু-বলে?'-আবার শুনিম্ন আর্তনাদ; 'মরি আমি! এ বিপত্তি-কালে, কোথা রে লক্ষ্মণ ভাই? কোথায় জানকি?' ধৈর্য ধরিতে আর নারিন্ত, স্বজনি! ছাড়ি লক্ষ্মণের হাত, কহিনু কুক্ষণে; 'সুমিত্রা শাশুড়ী মোর বড় দয়াবতী; কে বলে ধরিয়াছিলা গর্ভে তিনি তোরে, নিষ্ঠুর? পাষাণ দিয়া গড়িলা বিধাতা হিয়া তোর! ঘোর বনে নির্দয় বাঘিনী জন্ম দিয়া পালে তোরে, বুঝিন্তু, দুর্মতি! রে ভীরু, রে বীর-কুল-গ্লানি, যাব আমি, দেখিব করুণ স্বরে কে স্মরে আমারে দূর বনে!' ক্রোধ-ভরে, আরক্ত-নয়নে
বীরমণি, ধরি ধনুঃ, বাঁধিয়া নিমিষে পৃষ্ঠে তুণ, মোর পানে চাহিয়া কহিলা; 'মাতৃ-সম মানি তোমা, জনক-নন্দিনি, মাতৃ-সম! তেঁই সহি এ বৃথা গঞ্জনা! যাই আমি। গৃহমধ্যে থাক সাবধানে। কে জানে কি ঘটে আজি! নহে দোষ মম; তোমার আদেশে আমি-ছাড়িমু তোমারে।'এতেক কহিয়া শূর পশিলা কাননে।
"কত যে ভাবিহু আমি বসিয়া বিরলে, প্রিয়দখি, কহিব তা কি আর তোমারে? বাড়িতে লাগিল বেলা, আহলাদে নিনাদি, কুরঙ্গ, বিহঙ্গ-আদি যুগ-শিশু যত, সদাব্রত-ফলাহারী, করভ, করভী আসি উত্তরিল সবে। তা সবার মাঝে চমকি দেখিমু যোগী, বৈশ্বানর-সম তেজস্বী, বিভূতি অঙ্গে, কমণ্ডলু করে, শিরে জটা। হায়, সখি, জানিতাম যদি ফুল-রাশি মাঝে দুষ্ট কাল-বর্ণ-বেলে, বিমল সলিলে বিষ, তা হলে কি কহু ভূমে লুটাইয়া শিরঃ নমিতাম তারে?
"কহিল মায়াবী; 'ভিক্ষা দেহ রঘুবধূ, (অন্নদা এ বনে তুমি!) ক্ষুধার্ত অতিথে।'
"আবরি বদন আমি ঘোমটায়, সখি, কর-পুটে কহিহু, 'অজিনাসনে বসি, বিশ্রাম লতুন প্রভু তরু-মূলে; অতি, ত্বরায় আসিবে ফিরি রাঘবেন্দ্র যিনি, সৌমিত্রি ভ্রাতার সহ।' কহিল দুর্মতি- (প্রতারিত রোষ আমি নারিশু বুঝিতে) 'ক্ষুধার্ত অতিথি আমি, কহিমু তোমারে। দেহ ভিক্ষা; নহে কহ, যাই অন্য স্থলে। অতিথি-সেবায় তুমি বিরত কি আজি, জানকি? রঘুর বংশে চাহ কি ঢালিতে এ কলঙ্ক-কালি, তুমি রঘু-বধূ? কহ, কি গৌরবে অবহেলা কর ব্রহ্ম-শাপে? দেহ ভিক্ষা; শাপ দিয়া নহে যাই চলি।
দুরন্ত-রাক্ষস-এবে-সীতাকাস্ত-অগ্নি-
মোর শাপে।'-লজ্জা ত্যজি,হায় লো স্বজনি, ভিক্ষা দ্রব্য লয়ে আমি বাহিরিন্ত ভয়ে, না বুঝে পা দিশু ফাঁদে; অমনি ধরিল হাসিযা ভাস্বর তব আমায় তখনি।
"একদা, বিশ্ববদনে, রাঘবের সাথে ভ্রমিতেছিন্ন কাননে; দূর গুল্ম-পাশে চরিতেছিল হরিণী! সহসা শুনিন্ত ঘোর নাদ; ভষাকুলা। দেখিন্ড চাহিয়া ইরম্মদাক্বতি বাঘ ধরিল মৃগীরে!
'রক্ষ, নাথ,' বলি আমি পড়িন্ত চরণে। শরানলে শূব-শ্রেষ্ঠ ভম্মিলা শার্দুলে মুহূর্তে। যতনে তুলি বাঁচাইন্ড আমি বন-সুন্দরীরে, সখি। রক্ষঃ-কুল-পতি, সেই শার্দুলের রূপে, ধরিল আমারে! কিন্তু কেহ না আইল বাঁচাইতে, ধনি, এ অভাগা হরিণীরে এ বিপত্তি-কালে। ৩৬০ পরিম্ভ কানন আমি হাহাকার রবে। শুনি ক্রন্দন-ধ্বনি; বনদেবী বুঝি দাসীর দশায় মাতা কাতরা, কাঁদিলা! কিন্তু বৃথা সে ক্রন্দন! হুতাশন-তেজে গলে লৌহ; বারি-ধারা দমে কি তাহারে? অশ্রু-বিন্দু মানে কি লো কঠিন যে হিয়া? "দূরে গেল জটাজ, ট; কমণ্ডলু দূরে! রাজরথি-বেশে মৃঢ়। আমায় তুলিল
স্বর্ণ-রথে। কহিল যে কত দুষ্টমতি, কভু রোষে গঞ্জি, কভু সুমধুর স্বরে, স্মরিলে, শরমে ইচ্ছি মরিতে, সরমা! "চালাইল রথ রথী। কাল-সর্প-মুখে কাঁদে যথা ভেকী, আমি কাদিপু, স্বভগে বৃথা!
স্বর্ণ-রথ-চক্র, ঘর্ঘরি নির্ঘোষে, পূরিল কানন-রাজী, হায়, ডুবাইয়া অভাগীর আর্তনাদ! প্রভঞ্জন-বলে ত্রস্ত তরুকুল যবে নডে মড়মডে, কে পায় শুনিতে যদি কুহবে কপোতী? ফাফর হইযা, সখি, খুলিশু সত্বরে কঙ্কণ, বলয়, হার, সিথি, কণ্ঠমালা, কুণ্ডল, নপুর, কাঞ্চী; ছড়াইন্ড পথে; তেঁই লো এ পোড়া দেহে নাহি, রক্ষোবণ, আভরণ। বৃথা তুমি গঞ্জ দশাননে।"
নীরবিলা শশিমুখী। কহিলা সরমা,- "এখনও তৃষাতুবা এ দাসী, মৈথিলি; দেহ সুধা-দান তারে। সফল করিগা শ্রবণ-কুহর আজি আমার!" সুস্বরে পুনঃ আরম্ভিলা তবে ইন্দু-নিভাননা;- "শুনিতে লালসা যদি, শুন লোললনে।
বৈদেহীর দুঃখ-কথা কে আর শুনিবে?
"আনন্দে নিষাদ যথা ধরি ফাঁদে পাখী
যায় ঘরে, চালাইল রথ লঙ্কাপতি;
হায় লো, সে পাথী যথা কাঁদে ছটফটি
ভাঙিতে শৃঙ্খল তার, কাঁদিমু, সুন্দরি!
'হে আকাশ, শুনিয়াছি তুমি শব্দবহ, (আরাধিষ্ণু মনে মনে) এ দাসীর দশা ঘোর রবে কহ যথা রঘু-চূড়া-মণি, দেবর লক্ষ্মণ মোর, ভুবন-বিজয়ী! হে সমীর, গন্ধবহ তুমি; দূত-পদে বরিমু তোমায় আমি, যাও ত্বরা করি কথায় ভ্রমেন প্রভু! হে বারিদ, তুমি ভীমনাদী, ডাক নাথে গম্ভীর নিনাদে!
হে ভ্রমর মধুলোভি, ছাড়ি ফুল-কুলে গুঞ্জর নিকুঞ্জে, যথা রাঘবেন্দ্র বলী, সীতার বারতা তুমি; গাও পঞ্চ স্বরে সীতার দুঃখের গীত, তুমি মধু-সথা কোকিল! শুনিবে প্রভু তুমি হে গাইলে!' এইরূপে বিলাপিন্ন, কেহ না শুনিল।
"চলিল কনক-রথ; এড়াইয়া দ্রুতে অভ্রভেদী গিরি-চূড়া, বন, নদ, নদী, নানা দেশ। স্বনয়নে দেখেছ, সরমা, পুষ্পকের গতি তুমি; কি কাজ বনিয়া?-
"কত ক্ষণে সিংহনাদ শুনিন্ত সম্মুখে ভয়ঙ্কর! থরথরি আতঙ্কে কাঁপিল বাজি-রাজী, স্বর্ণরথ চলিল অস্থিরে। দেখিনু মেলিয়া আঁখি, ভৈরব-মূরতি গিরি-পৃষ্ঠে বীর, যেন প্রলয়ের কালে কালমেঘ! 'চিনি তোরে', কহিলা গম্ভীরে বীর-বর, 'চোর তুই, লঙ্কার রাবণ।
কোন্ কুলবধূ আজি হরিলি, দুর্মতি? কার ঘর আঁধারিলি, নিবাইয়া এবে প্রেম-দীপ? এই তোর নিত্য কর্ম, জানি। অগ্নি-দল-অপবাদ ঘুচাইব আজি বধি তোরে তীক্ষ্ণ শরে! আয় মৃঢ়মতি!
ধিক্ তোরে রক্ষোরাজ! নির্লজ্জ পামর আছে কি রে তোর সম এ ব্রহ্ম-মণ্ডলে?' "এতেক কহিয়া, সখি, গর্জিলা শুরেন্দ্র! দ্র! অচেতন হয়ে আমি পড়িমু শান্দনে!
"পাইয়া চেতন পুনঃ দেখিমু রয়েছি ভূতলে। গগন-মার্গে রথে রক্ষোরথী যুঝিছে সে ধীর-সঙ্গে, হুহুঙ্কার-নাদে।
অবলা-রসনা, ধনি, পারে কি বণিতে সে রণে? সভয়ে আমি মুদিয় নয়ন! সাধিশু দেবতা-কুলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া, সে বীরের পক্ষ হয়ে নাশিতে রাক্ষসে, অরি'মোর, উদ্ধারিতে বিষম সঙ্কটে দাসীরে! উঠিন্ন ভাবি পশিব বিপিনে, পলাইব দূর দেশে। হায় লো, পড়িমু, আছাড় খাইয়া, যেন ঘোয় ভূকম্পনে! আরাদিন বহুধারে- 'এ বিজন দেশে, মা আমার, হয়ে দ্বিনা, তব বক্ষঃস্থলে লহ অভাগীরে, সাব্বি! কেমনে সহিছ দুঃখিনী মেয়ের জালা? এস শীঘ্র করি! ফিরিয়া আসিবে দুষ্ট; হায়, মা, যেমতি তম্বর আইসে ফিরি, ঘোর নিশাকালে, পুঁতি যথা রত্ন-রাশি রাখে সে গোপনে- পর-ধন! আসি মোরে তরাও, জননি!'
"বাজিল তুমুল যুদ্ধ গগনে, সুন্দরি; কাঁপিল বহুধা; দেশ পূরিল আরাবে!, অচেতন হৈহু পুনঃ। শুন, লো ললনে, মনঃ দিয়া শুন, সই, অপূর্ব কাহিনী। দেখিনু স্বপনে আমি বহুন্ধরা সতী মা আমার! দাসী-পাশে আসি দয়াময়ী কহিলা, লইয়া কোলে, সুমধুর বাণী; 'বিধির ইচ্ছায়, বাছা, হরিছে গো তোরে রক্ষোরাজ; তোর হেতু সবংশে মজিবে অধম! এ ভার আমি সহিতে না পারি, ধরিশু গো গর্ভে তোরে লঙ্কা বিনাশিতে! যে কুক্ষণে তোর তনু ছু'ইল দুর্মতি রাবণ, জানিমু আমি, সুপ্রসন্ন বিধি এত দিনে মোর প্রতি; আশীযিশু তোরে!! জননীর জালা দূর করিলি, মৈথিলি!- 'ভবিতব্য-দ্বার আমি খুলি, দেখ চেয়ে
"দেখিশু সম্মুখে, সখি, অভ্রভেদী গিরি; পঞ্চ জন বীর তথা নিমগ্ন সকলে দুঃখের সলিলে যেন! হেন কালে আসি উতরিলা রঘুপতি লক্ষ্মণের সাথে। বিরস-বদন নাথে হেরি, লো স্বজনি, উতলা হইনু কত, কত যে কাঁদিন্ত, কি আর কহিব তার? বীর পঞ্চ জনে পূজিল রাঘব-রাজে, পূজিল অনুজে। একত্রে পশিলা সবে সুন্দর নগরে।
"মারি সে দেশের রাজা তুমুল সংগ্রামে দেখিন্ন রঘুবীর, বসাইলা রাজ-সিংহাসনে শ্রেষ্ঠ যে পুরুষ-বর পঞ্চ জন মাঝে। ধাইলা চৌদিকে দূত; আইলা ধাইয়া লক্ষ লক্ষ বীর-সিংহ ঘোর কোলাহলে। কাঁপিল বহুধা, সখি, বীর-পদ-ভরে! সভয়ে মুদিম্ন আঁখি! কহিলা হাসিয়া মা আমার, 'কারে ভয় করিস্, জানকি?সাজিছে সুগ্রীব রাজা উদ্ধারিতে তোরে, মিত্রবর! বধিল যে শূরে তোর স্বামী, বালি নাম ধরে রাজা বিখ্যাত জগতে। কিষ্কিন্ধ্যা নগর ওই। ইন্দ্র-তুল্য বলি- বৃন্দ চেয়ে দেখ, সাজে।' দেখিমু চাহিয়া চলিছে বীরেন্দ্র-দল জল-স্রোতঃ যথা বরিষায়, হুহুঙ্কারি! ঘোর মড়মড়ে ভাঙিল নিবিড় বন; শুধাইল নদী;
ভয়াকুল বন-জীব পলাইল দূরে;
পুরিল জগৎ, সখি, গম্ভীর নির্ঘোষে।
"উতরিলা সৈন্য-দল সাগরের তীরে। দেখিশু, সরমা সখি, ভাসিল সলিলে শিলা! শৃঙ্গধরে ধরি, ভীম পরাক্রমে উপাড়ি, ফেলিল জলে বীর শত শত। বাঁধিল অপূর্ব সেতু শিল্পিকুল মিলি। আপনি বারীশ পাশী, প্রভুর আদেশে, পরিলা শৃঙ্খল পায়ে! অলঙ্ঘ্য সাগরে লঙ্ঘি, বীর-মদে পার হইল কটক। টলিল এ স্বর্ণ-পুরী বৈরি-পদ চাপে,- 'জয়, রঘুপতি, জয়!' ধ্বনিল সকলে! কাঁদিমু হরষে, সখি! সুবর্ণ-মন্দিরে
সুবর্ণাসনে রক্ষঃ-কুল-পতি। আছিল সে সভাতলে ধীর ধর্মসম বীর এক; কহিল সে, 'পূজ রঘুবরে, বৈদেহীরে দেহ ফিরি; নতুবা মরিবে সবংশে!' সংসার-মদে মত্ত রাঘবারি, পদাঘাত করি তারে কহিল কুবাণী! অভিমানে গেলা চলি সে বীর-কুঞ্জর যথা প্রাণনাথ মোর।"-কহিলা সরমা, "হে দেবি, তোমার দুঃখে কত যে দুঃখিত রক্ষোরাজামুজ বলী, কি আর কহিব? দুজনে আমরা, সতি, কত যে কেঁদেছি ভাবিয়া তোমার কথা, কে পারে কহিতে?" "জানি আমি," উত্তরিলা মৈখিলী রূপসী, - "জানি আমি বিভীষণ উপকারী মম পরম! সরমা সখি, তুমিও তেমনি! আছে যে বাঁচিয়া হেথা অভাগিনী সীতা, সে কেবল, দয়াবতি, তব দয়া-গুণে!
কিন্তু কহি, শুন মোর অপূর্ব স্বপন!-
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য; উঠিল গগনে নিনাদ। কাঁপিন্ন, সখি, দেখি বীর-দলে, তেজে হুতাশন-সম, বিক্রমে কেশরী। কত যে হইল রণ, কহিব কেমনে? বহিল শোণিত-নদী! পর্বত-আকারে দেখিনু শবের রাশি, মহাভয়ঙ্কর। আইল কবন্ধ, ভূত, পিশাচ, দানব, শকুনি, গৃধিনী আদি যত মাংসাহারী বিহঙ্গম; পালে পালে শৃগাল; আইল অসংখ্য কুক্কর। লঙ্কা পূরিল ভৈরবে।
"দেখিন্ড কর্তৃর-নাথে পুনঃ সভাতলে, মলিন বদন এবে, অশ্রুময় আঁখি, শোকাকুল! ঘোর রণে রাঘব-বিক্রমে লাঘব-গরব, সই! কহিল বিষাদে রঙ্গোরাজ, 'হায়, বিধি, এই কি রে ছিল তোর মনে? যাও সবে, জাগাও যতনে শূলী শম্ভু-সম ভাই কুম্ভকর্ণে মম। 'কে রাখিবে রক্ষঃ-কুলে সে যদি না পারে?' ধাইল রাক্ষস-দল; বাজিল বাজনা
"কহিন্ত, সরমা সখি, করপুটে আমি; 'কি কাজ, হে সুরবালা, এ বেশ-ভূষণে দাদীর? যাইব আমি যথা কান্ত মম, এ দশায, দেহ আজ্ঞা; কাঙ্গালিনী সীতা, ঘোর রোলে; নারী-দল দিল হুলাহুলি ।কাঙ্গালিনী বেশে তারে দেখুন নৃমণি!' "উত্তরিলা সুরবালা; 'শুন লো মৈথিলি! (সমল খনির গর্ভে মণি; কিন্তু তারে
বিরাট্-মূরতি-ধর পশিল কটকে রক্ষোরথী। প্রভু মোর, তীক্ষ্ণতর শরে (হেন বিচক্ষণ শিক্ষা কার লো জগতে?) কাটিলা তাহার শিরঃ! মরিল অকালে জাগি সে দুরন্ত শূর। 'জয় রাম' ধ্বনি শুনিম্ন হরষে, সই! কাঁদিল রাবণ! কাঁদিল কনক-লঙ্কা হাহাকার রবে!
"চঞ্চল হইমু, সখি, শুনিয়া চৌদিকে "সাজিল রাক্ষস-বৃন্দ যুঝিবার আশে; ক্রন্দন! কহিমু মায়ে, ধরি পা দুখানি, ('রক্ষঃ-কুল-দুঃখে বুক ফাটে, মা, আমার ! পরেরে কাতর দেখি সতত কাতরা এ দাসী; ক্ষম, মা, মোরে!' হাসিয়া কহিলা বহুধা; 'লো রঘুবধূ, সত্য যা দেখিলি! লণ্ডভণ্ড করি লঙ্কা দণ্ডিবে রাবণে
পতি তোর। দেখ পুনঃ নয়ন মেলিয়া।' "দেখিয়, সরমা সখি, স্থর-বালা-দলে,
নানা আভরণ হাতে, মন্দারের মালা, পট্টবস্ত্র। হাসি তারা বেড়িল আমারে। কেহ কহে, 'উঠ, সতি, হত এত দিনে দুরন্ত রাবণ রণে!' কেহ কহে, 'উঠ, রঘুনন্দনের ধন, উঠ, ত্বরা করি, অবগাহ দেহ, দেবি, সুবাসিত জলে, পর নানা আভরণ। দেবেন্দ্রাণী শচী দিবেন সীতায় দান আজি সীতানাথে!'
পরিষ্কারি রাজ-হস্তে দান করে দাতা!' "কাঁদিয়া, হাসিয়া, সই, সাজিমু সত্বরে। হেরিনু অদূরে নাথে, হায় লো, যেমতি কনক-উদয়াচলে দেব অংশুমালী! পাগলিনী প্রায় আমি ধাইমু ধরিতে পদযুগ, ঈবদনে!-জাগিহু অমনি!-
সহসা, স্বজনি, যথা নিবিলে দেউটি, ঘোর অন্ধকার ঘর; ঘটিল সে দশা আমার, আঁধার বিশ্ব দেখিনু চৌদিকে! হে বিধি, কেন না আমি মরিন্ত তখনি? কি সাধে এ পোড়া প্রাণ বহিল এ দেহে?" নীরবিলা বিধুমুখী, নীরবে যেমতি বীণা, ছিড়ে তার যদি! কাঁদিয়া সরমা (রক্ষঃ-কুল-রাজ-লক্ষ্মী রক্ষোবধূ-রূপে) কহিলা; "পাইবে নাথে, জনক-নন্দিনি! সত্য এ স্বপন তব, কহিমু তোমারে! ভাসিছে সলিলে শিলা, পড়েছে সংগ্রামে দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস কুম্ভকর্ণ বলী; সেবিছেন বিভীষণ জিষ্ণু রঘুনাথে লক্ষ লক্ষ বীর সহ। মরিবে পৌলস্ত্য যথোচিত শাস্তি পাই; মজিবে দুর্মতি সবংশে। এখন কহ, কি ঘটিল পরে? অসীম লালসা মোর শুনিতে কাহিনী।" আরম্ভিলা পুনঃ সতী সুমধুর স্বরে;-
"মিলি আঁখি, শশিমুখি, দেখিনু সম্মুখে
রাবণে; ভূতলে, হায়, সে বীর-কেশরী,
তুঙ্গ শৈল-শৃঙ্গ যেন চূর্ণ বজ্রাঘাতে!
"কহিল রাঘব-রিপু; 'ইন্দীবর আধি উন্মীলি, দেখ লো চেয়ে, ইন্দু-নিভাননে, রাবণের পরাক্রম! জগত-বিখ্যাত জটায়ু হীনায়ু আজি মোর ভুজ-বলে! নিজ দোষে মরে মূঢ় গরুড়-নন্দন! কে কহিল মোর সাথে যুঝিতে বর্বরে?"
'ধর্ম-কর্ম সাধিবারে মরিশু সংগ্রামে,
রাবণ';-কহিলা শুর অতি মৃদু স্বরে-
'সম্মুখ সমরে পড়ি যাই দেবালয়ে।
কি দশা ঘটিবে তোর, দেখ রে ভাবিয়া? শৃগাল হইয়া, লোভি, লোভিলি সিংহীরে! কে তোরে রক্ষিবে, রক্ষ? পড়িলি সঙ্কটে, লঙ্কানাথ, করি চুরি এ নারী-রতনে!' "এতেক কহিয়া বীর নীরব হইলা! তুলিল আমায় পুনঃ রথে লঙ্কাপতি। ক্বতাঞ্জলি-পুটে কাদি কহিমু, স্বজনি, বীরবরে; 'সাঁতা নাম, জনক-দুহিতা,, রঘুবধূ দাসী, দেব! শূন্য ঘরে পেয়ে আমায়, হরিছে পাপী; কহিও এ কথা দেখা যদি হয়, প্রভু, রাঘবের সাথে!'
"উঠিল গগনে রথ গম্ভীর নির্ঘোষে। শুনিম্ন ভৈরব রব; দেখিনু সম্মুখে সাগর নীলোমিময়! বহিছে কল্লোলে অতল, অকূল জল, অবিরাম-গতি। ঝাঁপ দিয়া জলে, সখি, চাহিহু ডুবিতে; নিবারিল দুষ্ট মোরে! ডাকিমু বারীশে, জলচরে মনে মনে, কেহ না শুনিল, অবহেলি অভাগীরে! অনম্বর-পথে চলিল কনক-রথ মনোরথ-গতি।
"অবিলম্বে লঙ্কাপুরী শোভিল সম্মুখে। সাগরের ভালে, সখি, এ কনক-পুরী রঞ্জনের রেখা! কিন্তু কারাগার যদি সুবর্ণ-গঠিত, তবু বন্দীর নয়নে কমনীয় কভু কি লো শোভে তার আভা ? সুবর্ণ-পিঞ্জর বলি হয় কি লো সুধী সে পিঞ্জরে বন্ধ পাখী? দুঃখিনী সতত যে পিঞ্জরে রাখ তুমি কুঞ্জ-বিহারিণী! কুক্ষণে জনম মম, সরমা সুন্দরি! কে কবে শুনেছে, সখি, কহ হেন কথা? রাজার নন্দিনী আমি, রাজ-কুল-বধূ, তবু বন্ধ কারাগারে!"-কাঁদিলা রূপসী, সরমার গলা ধরি; কাঁদিলা সরমা। ৬৪০ কত ক্ষণে চক্ষুঃ-জল মুছি সুলোচনা সরমা কহিলা; "দেবি, কে পারে খণ্ডিতে বিধির নির্বন্ধ? কিন্তু সত্য যা কহিলা বহুধা। বিধির ইচ্ছা, তেঁই লঙ্কাপতি আনিয়াছে হরি তোমা; সবংশে মরিবে দুষ্টমতি! বীর আর কে আছে এ পুরে বীরযোনি? কোথা, সতি, ত্রিভুবন-জয়ী যোধ যত? দেখ চেয়ে, সাগরের কূলে, শবাহারী জন্তু-পুরু ভুঞ্জিছে উল্লাসে শব-রাশি! কান দিয়া শুন, ঘরে ঘরে কাঁদিছে বিধবা বন্ধু! আশু পোহাইবে এ দুঃখ-শর্বরী তব! ফলিবে, কহিমু, স্বপ্ন! বিদ্যাধরী-দল মন্দারের দামে ও বরাঙ্গ রঙ্গে আসি আশু সাজাইবে! ভেটিবে রাঘবে তুমি, বহুধা কামিনী সরস বসন্তে যথা ভেটেন মধুরে! ভুলো না দাসীরে, সাব্বি! যত দিন বাঁচি, এ মনোমন্দিরে রাখি, আনন্দে পুঞ্জিব ও প্রতিমা, নিত্য যথা, আইলে রজনী, সরসী হরষে পুজে কৌমুদিনী-ধনে।
বহু ক্লেশ, সুকেশিনি, পাইলে এ দেশে।
কিন্তু নহে দোষী দাসী!" কহিলা সুস্বরে মৈথিলী; "সরমা সখি, মম হিতৈষিণী তোমা সম আর কি লো আছে এ জগতে?- মরুভূমে প্রবাহিণী মোর পক্ষে তুমি, রক্ষোবধূ! সুশীতল ছায়া-রূপ ধরি, তপন-তাপিত আমি, জুড়ালে আমারে। মূর্তিমতী দয়া তুমি এ নির্দয় দেশে! এ পঙ্কিল জলে পদ্ম! ভুজঙ্গিনী-রূপী এ কাল কনক-লঙ্কা-শিরে শিরোমণি ! আর কি কহিব, সখি? কাঙ্গালিনী সীতা, তুমি লো মহাই রত্ন! দরিদ্র, পাইলে রতন, কভু কি তারে অযতনে, ধনি?"
নমিয়া সতীর পদে, কহিলা সরমা; "বিদায় দাসীরে এবে দেহ, দয়াময়ি! না চাহে পরাণ মম ছাড়িতে তোমারে, রঘু-কুল-কমলিনি! কিন্তু প্রাণপতি আমার, রাঘব-দাস; তোমার চরণে আসি কথা কই আমি, এ কথা শুনিলে রুধিবে লঙ্কার নাথ, পড়িব সঙ্কটে!" কহিলা মৈথিলী; "সখি, যাও ত্বরা করি, নিজালয়ে; শুনি আমি দূরে পদ-ধ্বনি; ফিরি বুঝি চেড়ীদল আসিছে এ বনে।"
আতঙ্কে কুরঙ্গী যথা, গেলা দ্রুতগামী সরমা; রহিলা দেবী সে বিজন বনে, একটি কুহুম মাত্র অরণ্যে যেমতি।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধে কাব্যে অশোকবনং নাম
চতুর্থঃ সর্গঃ।