shabd-logo

রতনবাবু আর সেই লোকটা

16 November 2023

0 Viewed 0

ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক দেখে রতনবাবুর মনে একটা খুশির ভাব জেগে উঠল। জায়গাটা তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে। স্টেশনের পিছনে শিরীষ গাছটা কেমন মাথা উচিয়ে রয়েছে, তার ডালে আবার একটা লাল ঘুড়ি আটকে রয়েছে। লোকজনের মধ্যে ব্যস্ততার ভাব নেই, বাতাসে কেমন একটা সোঁদা গন্ধ—সব মিলিয়ে দিব্যি মনোরম পরিবেশ।

সঙ্গে একটা ছোট হোল্ডল আর চামড়ার একটা ছোট সুটকেস। কুলির দরকার নেই; রতনবাবু সেগুলো দু'হাতে তুলে নিয়ে স্টেশনের গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বাইরে সাইকেল-রিকশা পেতে কোনও অসুবিধা হল না। ডোরাকাটা হাফপ্যান্ট পরা ছোকরা চালক জিজ্ঞেস করল, 'কোথায় যাবেন বাবু?”

রতনবাবু বললেন, 'নিউ মহামায়া হোটেল—জানো ?"

ছোকরা ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলল, 'উঠুন।'

ভ্রমণ জিনিসটা রতনবাবুর একটা বাতিক বলেই বলা যেতে পারে। সুযোগ পেলেই তিনি কলকাতার বাইরে কোথাও ঘুরে আসেন। অবিশ্যি সুযোগ যে সবসময় আসে তা নয়, কারণ রতনবাবুর একটা চাকরি আছে। কলকাতার জিয়োলজিকাল সার্ভের আপিসে তিনি একজন কেরানি। আজ চব্বিশ বছর ধরে তিনি এই চাকরি করছেন। তাই বাইরে বেড়িয়ে আসার মতো সুযোগ তাঁর বছরে একবারই আসে। পুজোর ছুটির সঙ্গে তাঁর বাৎসরিক পাওনা ছুটি জুড়ে নিয়ে তিনি প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও ভ্রমণ করে আসেন।

এই বেড়ানোর ব্যাপারে রতনবাবু সঙ্গে আর কাউকে নেন না, বা নেবার ইচ্ছেটাও তাঁর মনে জাগে না। প্রথম প্রথম যে সঙ্গীর অভাব বোধ করতেন না তা নয়; তাঁর পাশের টেবিলের কেশববাবুর সঙ্গে এককালে তাঁর এই নিয়ে কথা হয়েছিল, মহালয়ার কয়েকদিন আগে। রতনবাবু তখন সবে ছুটির প্ল্যান করেছেন; তিনি বলেছিলেন, 'আপনিও তো মশাই একা মানুষ—চলুন না এবার পুজোয় দু'জনে একসঙ্গে কোথাও ঘুরেটুরে আসি।'

কেশববাবু তাঁর কলমটা কানে গুঁজে হাত দুটোকে জড়ো করে তাঁর দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'আপনার পছন্দর সঙ্গে আমার পছন্দ কি মিলবে? আপনি যাবেন সব উদ্ভট নাম-না-জানা জায়গায়। সেখানে না আছে দেখবার কিছু, না আছে থাকা-খাওয়ার সুবিধে। আমায় মাফ করবেন। আমি যাচ্ছি হরিনাভিতে আমার ভায়রাভাইয়ের কাছে।

ক্রমে রতনবাবু বেশ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মনের সঙ্গে মন মিলিয়ে বন্ধু পাওয়া খুবই শক্ত। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ ব্যাপারটা সাধারণ লোকের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। কাজেই বন্ধু পাওয়ার আশাটা পরিত্যাগ করাই ভাল।

সত্যিই রতনবাবুর স্বভাব চরিত্রে বেশ একটা অভিনবত্ব ছিল। যেমন এই চেঞ্জে যাওয়ার ব্যাপারটা। কেশববাবু মোটেই ভুল বলেননি। লোকে সচরাচর যেসব জায়গায় চেঞ্জে যায়, রতনবাবু সেদিকে দৃষ্টিই দিতেন না। তিনি বলতেন, 'আরে মশাই—পুরীতে সমুদ্র আছে, জগন্নাথের মন্দির আছে; দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়; হাজারিবাগে পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, রাঁচির কাছে হুডু ফল্স আছে এসব কথা তো সকলেই জানে। আর লোকমুখে একটা জিনিসের বর্ণনা বারবার শোনা মানে তো সে জিনিস প্রায় দেখাই হয়ে গেল।'

রতনবাবুর যেটা দরকার সেটা হল রেলের স্টেশনের ধারে একটি ছোট্ট শহর। ব্যস আর কিচ্ছু না! প্রতি বছরই ছুটির আগে টাইম টেবল খুলে, খুব বেশি দূরে নয় এমন একটি জায়গার নাম বের করে তিনি দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়েন। কোথায় গেলেন কী দেখলেন, তা কেউ জিজ্ঞেস করে না, বা কাউকে তিনি বলেনও না। এমন অনেকবার হয়েছে যে, যেখানে গেছেন সে জায়গার নাম তিনি আগে শোনেনইনি। আর যেখানেই গেছেন, সেখানেই এমন একটা কিছু খুঁজে পেয়েছেন যার ফলে তাঁর মন খুশিতে ভরে উঠেছে। অন্যদের চোখে হয়তো এসব জিনিস খুবই সামান্য— যেমন রাজাভাতখাওয়ায় একটা বুড়ো অশ্বত্থ গাছ—যেটা একটা কুলগাছ আর একটা নারকেল গাছকে পাকিয়ে উঠেছে, মহেশগঞ্জে একটা নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ, ময়নাতে একটা মিষ্টির দোকানের ডালের বরফি ....

এবারে রতনবাবু যেখানে এসেছেন সে জায়গাটার নাম সিনি। টাটানগর থেকে পনেরো মাইল দূরে এই শহর। এ জায়গাটা অবশ্য টাইম টেবল থেকে বার করেননি তিনি। আপিসের অনুকূল মিত্তির বলেন জায়গাটার কথা। নিউ মহামায়া হোটেলের নামটাও তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া।

রতনবাবুর চোখে হোটেলটাকে বেশ ভালই বলে মনে হল। ঘরটা ছোট—তবে তাতে কিছু এসে যায় না। পুব দক্ষিণ দু'দিকে দুটো জানলা রয়েছে—তাই দিয়ে বেশ চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। পঞ্চা চাকরটিকেও বেশ অমায়িক বলে মনে হল। রতনবাবু শীত-গ্রীষ্ম দু'বেলা গরম জলে স্নান করেন, পঞ্চা তাঁকে আশ্বাস দিল তার জন্য কোনও চিন্তা করতে হবে না। হোটেলের রান্নাটা মোটামুটি চলনসই, এবং সেটাই যথেষ্ট, কারণ খাওয়ার ব্যাপারেও রতনবাবু মোটেই খুঁতখুঁতে নন। শুধু একটি বায়না তাঁর কাছে—ভাত আর হাতের রুটি—এ দুটোই একসঙ্গে না হলে তাঁর খাওয়া হয় না। মাছের ঝোলের সঙ্গে ভাত, আর ডাল তরকারির সঙ্গে রুটি—এটাই তাঁর রেওয়াজ। হোটেলে এসেই পঞ্চাকে তিনি কথাটা জানিয়ে দিয়েছেন, এবং পঞ্চাও সে খবর ম্যানেজারকে পৌঁছে দিয়েছে।

নতুন জায়গায় এলে প্রথম দিনই বিকেলে হেঁটে না বেরোনো পর্যন্ত রতনবাবু সোয়াস্তি বোধ করেন না।

সিনিতেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম হল না। চারটের সময় পঞ্চার এনে দেওয়া চা খেয়েই রতনবাবু বেরিয়ে পড়লেন।

শহর থেকে বেরোলেই খোলা অসমতল প্রান্তর। তার মধ্যে দিয়ে আবার এদিক ওদিক হাঁটা পথ চলে গেছে। এই পথের একটা দিয়ে মাইলখানেক গিয়ে রতনবাবু একটা ভারী মনোরম জিনিস আবিষ্কার করলেন। একটা ছোট্ট ডোবা পুকুর, তার মধ্যে কিছু শালুক ফুটে আছে, আর তার চারিদিকে অজস্র পাখির জটলা। বক, ডাহুক, কাদাখোঁচা, মাছরাঙা—এগুলো রতনবাবুর চেনা; বাকিগুলো এই প্রথম তিনি দেখলেন।

প্রতিদিন বিকেলবেলাটা এই ডোবার ধারে বসেই হয়তো রতনবাবু বাকি ছুটিটা কাটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু দ্বিতীয় দিন আরও কিছু আবিষ্কারের আশায় রতনবাবু অন্য আরেকটা পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।

মাইলখানেক যাবার পর পথে একপাল ছাগল পড়ার দরুন তাঁর হাঁটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখতে হল। রাস্তা খালি হবার পর আরও মিনিটপাঁচেক হাঁটতেই দেখলেন সামনে একটা কাঠের পুল দেখা যাচ্ছে। আরও এগিয়ে গিয়ে বুঝলেন সেটা একটা ওভারব্রিজ। তার নীচ দিয়ে চলে গেছে রেলের লাইন। পুবদিকে দূরে স্টেশনটা দেখা যাচ্ছে, আর পশ্চিমদিকে যতদূর চোখ যায় সোজা চলে গেছে সমান্তরাল দুটো লোহার পাত। এখন যদি হঠাৎ একটা ট্রেন এসে পড়ে, আর ব্রিজের তলা দিয়ে সেটা

যদি যায় তা হলে কী অদ্ভুত ব্যাপার হবে, সেটা ভাবতেই রতনবাবুর গায়ে কাঁটা দিল । একদৃষ্টে রেললাইনের দিকে দেখছিলেন বলেই বোধহয় কখন যে আরেকটি লোক এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা রতনবাবু খেয়াল করেননি, তাই পাশে তাকাতেই তাঁকে চমকে উঠতে হল। লোকটির পরনে ধুতি শার্ট, কাঁধে একটা নস্যি রঙের র‍্যাপার, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, চোখে

বাইফোক্যাল চশমা। রতনবাবুর কেমন জানি খটকা লাগল। এঁকে কি আগে দেখেছেন কোথাও? চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? মাঝারি হাইট, গায়ের রঙও মাঝারি, চোখের দৃষ্টিতে কেমন উদাস ভাবুক ভাবুক ভাব। বয়স কত হবে? পঞ্চাশের বেশি নয় নিশ্চয়ই। চুলে বিশেষ পাক ধরেনি। অন্তত সন্ধ্যার আলোতে তো তাই মনে হয়।

আগন্তুক একটা ঠাণ্ডা হাসি হেসে রতনবাবুকে নমস্কার করলেন। রতনবাবু হাত জোড় করে প্রতিনমস্কার করতে গিয়ে হঠাৎ বুঝেঝ ফেললেন কেন তাঁর খটকা লাগছিল। লোকটিকে চেনা চেনা মনে হবার কারণ আর কিছুই না—এই ধাঁচের একটি চেহারা রতনবাবু বহুবার দেখেছেন—এবং সেটা তাঁর আয়নায়। ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে তাঁর নিজের চেহারার আশ্চর্য মিল। মুখের চৌকোনা ভাব, চুলের টেরি, গোঁফের ধাঁচ, থুতনির মাঝখানে খাঁজ, কানের লতি—এসবই প্রায় হুবহু এক। তবে গায়ের রঙ আগন্তুকের যেন একটু বেশি ময়লা, ভুরু একটু বেশি ঘন, আর মাথার পিছনের চুল যেন একটু বেশি

লম্বা।

এবার আগন্তুকের গলার স্বর শুনেও রতনবাবু চমকে উঠলেন। একবার তাঁর পাড়ার ছেলে সুশান্ত একটা টেপ রেকর্ডারে রতনবাবুর গলা রেকর্ড করে শুনিয়েছিল। সে গলা আর এই লোকটির গলায় কোনও তফাত নেই বললেই চলে।

ভদ্রলোক বললেন, 'আমার নাম মণিলাল মজুমদার। আপনি তো বোধহয় নিউ মহামায়া হোটেলে উঠেছেন, তাই না?'

রতনলাল — মণিলাল। নামেও কেমন আশ্চর্য মিল। রতনবাবু কোনওরকমে অবাক ভাবটা কাটিয়ে তাঁর নিজের পরিচয়টা দিলেন।

আগন্তুক বললেন, 'আপনার বোধহয় আমাকে মনে পড়বে না- আমি কিন্তু এর আগেও আপনাকে দেখেছি।'

*কোথায় বলুন তো?'

'আপনি গত পুজোয় ধুলিয়ান যাননি?'

রতনবাবুর ভুরু কপালে তুলে বললেন, 'আপনিও সেখানে গেসলেন নাকি ?'

'আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি প্রতিবারই পুজোয় কোথাও না কোথাও যাই। একা মানুষ, বন্ধুবান্ধবও বিশেষ নেই। আর নতুন নতুন জায়গায় একা একা বেড়াতে দিব্যি লাগে। সিনির কথাটা আমার আপিসের এক সহকর্মী আমাকে বলেন। বেশ জায়গা—কী বলেন? '

রতনবাবু ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। কেমন যেন অবিশ্বাস আর অসোয়াস্তি মেশানো একটা ভাব বোধ করছেন তিনি।

‘ওদিকের পুকুরটা দেখেছেন — যার পাশে পাখির জটলা হয় বিকেলবেলার দিকটা?' মণিলালবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

রতনবাবু বললেন, হ্যাঁ, দেখেছেন।

'মনে হল কিছু ভিনদেশের পাখিও জড়ো হয়েছে ওখানে। কিছু পাখি দেখলাম যা বাংলাদেশে আগে

দেখিনি। আপনার কী মনে হল ?' এতক্ষণে রতনবাবু খানিকটা স্বাভাবিক বোধ করছেন। বললেন, 'আমারও তাই ধারণা। আমিও কতগুলো পাখি দেখে চিনতে পারিনি।'

দূর থেকে একটা গুম্ গুম্ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেন আসছে। পুব দিকে চেয়ে দেখলেন দূরে সার্চলাইট দেখা যাচ্ছে। আলোটা ক্রমশ বড় হয়ে এগিয়ে আসছে। রতনবাবু আর মণিলালবাবু দু'জনেই ব্রিজের রেলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিরাট শব্দ করে ব্রিজটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে ট্রেনটা উলটো দিকে চলে গেল। দু'জন ভদ্রলোকই হেঁটে ব্রিজটার উলটোদিকে গিয়ে যতক্ষণ না ট্রেনটা অদৃশ্য হয় ততক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলেন। রতনবাবুর মনে ছেলেমানুষি রোমাঞ্চের ভাব জেগে উঠেছে। মণিলালবাবু বললেন, 'আশ্চর্য! এত বয়স হল, তবু ট্রেন দেখার আনন্দটা গেল না।'

বাড়ি ফেরার পথে রতনবাবু জানালেন যে, মণিলালবাবু তিনদিন হল সিনিতে এসেছেন, আর কালিকা হোটেলে উঠেছেন। কলকাতাতেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি, কাজও করেন তিনি কলকাতার এক সওদাগরি আপিসে। মাইনের কথাটা কেউ কাউকে সাধারণত জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু রতনবাবু একটা অদম্য ইচ্ছের ফলে লজ্জার মাথা খেয়ে সেটা জিজ্ঞেস করে ফেললেন। উত্তর যা পেলেন তাতে তাঁর কপালে ঘাম ছুটে গেল। এমনও কি সম্ভব? মণিলালবাবু আর রতনবাবুর মাইনে এক—দু'জনেই পান চারশো সাঁইত্রিশ টাকা, দু'জনেই ঠিক একই বোনাস পেয়েছেন পুজোয়

লোকটা যে তাঁর নাড়িনক্ষত্র কোনও ফিকিরে আগে থেকেই জেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে একটা ধাপ্পাবাজির খেলা খেলছে, এ কথাটা রতনবাবু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। প্রথমত, তাঁর রোজকার জীবনে কী ঘটনা না ঘটছে তা নিয়ে কেউ কোনওদিন মাথা ঘামায়নি। তিনি নিজের তালে নিজেই ঘোরেন। আপিসের বাইরে বাড়ির চাকর ছাড়া কারুর সঙ্গে কথা বলেন না, কারুর বাড়িতে গিয়ে কখনও আড্ডা মারেন না। মাইনের ব্যাপারটা না হয় বাইরে জানাজানি হতে পারে, কিন্তু তিনি রাত্রে কখন ঘুমোন, কী খেতে ভালবাসেন, কোন খবরের কাগজটা পড়েন, কোন থিয়েটার বা কোন বাংলা সিনেমা তিনি ইদানীং দেখেছেন—এসব তো তিনি নিজে ছাড়া আর কেউই জানে না। অথচ এর সবকিছুই যে ভদ্রলোকের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে!

রতনবাবু কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে মণিলালবাবুকে বলতে পারলেন না। সারা রাস্তা তিনি শুধু মণিলালবাবুর কথাই শুনলেন, আর নিজের সঙ্গে মিল দেখে বারবার অবাক হলেন, চমকে উঠলেন। নিজের সম্বন্ধে তিনি এগিয়ে গিয়ে কিছুই বললেন না।

রতনবাবুর হোটেলটাই আগে পড়ে। হোটেলের সামনে এসে মণিলালবাবু বললেন, 'আপনার এখানে খাওয়া-দাওয়া কেমন ?”

রতনবাবু বললেন, 'মাছের ঝোলটা মন্দ করে না। বাকি সব চলনসই।'

'আমার হোটেলে রান্নাটা আবার তেমন সুবিধের নয়। শুনেছি এখানে জগন্নাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নাকি। ভাল লুচি আর ছোলার ডাল করে। আজ রাতের খাওয়াটা সেখানে সারলে কেমন হয়?”

রতনবাবু বললেন, 'বেশ তো, আমার আপত্তি নেই। ধরুন এই আটটা নাগাদ ?'

"ঠিক আছে। আমি ওয়েট করব আপনার জন্য। তারপর একসঙ্গে যাওয়া যাবে।' মণিলালবাবু চলে যাবার পর রতনবাবু হোটেলে না ঢুকে কিছুক্ষণ বাইরে রাস্তায় পায়চারি করলেন। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছে। আকাশ পরিষ্কার—এতই পরিষ্কার যে, তারার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া ছায়াপথটাকে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য! এতকাল রতনবাবুর আফসোস ছিল যে তাঁর সঙ্গে মনের আর মতের মিল হয় এমন কোনও বন্ধু তিনি খুঁজে পাননি; অথচ এই সিনিতে এসে হঠাৎ এমন একজন লোকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন যাকে তাঁরই একটি ডুপ্লিকেট সংস্করণ বলা যেতে পারে। চেহারায় খানিকটা তফাত থাকলেও, স্বভাবে আর রুচিতে এমন মিল যমজ ভাইদের মধ্যেও দেখা যায় কিনা সন্দেহ।

তার মানে কি এতদিনে তাঁর বন্ধুর অভাব মিটল ?

রতনবাবু এ প্রশ্নের উত্তর চট করে খুঁজে পেলেন না। হয়তো মণিলালবাবুর সঙ্গে আরেকটু মিশলে তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। একটা জিনিস তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁর একা ভাবটা যেন কেটে গেছে। এ পৃথিবীতে ঠিক তাঁরই মতো আরেকটি লোক এতদিন ছিল, আর তিনি আকস্মিকভাবে তার সাক্ষাৎ পেয়ে গেছেন।

জগন্নাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে টেবিলের দু'দিকে মুখোমুখি বসে খেতে খেতে রতনবাবু লক্ষ করলেন যে, তাঁরই মতো মণিলালবাবুও বেশ পরিষ্কার করে চেটেপুটে খেতে ভালবাসেন, তাঁরই মতো খাবার মাঝখানে জল খান না, তাঁরই মতো ডালের মধ্যে পাতিলেবু কচলে নেন। সব খাবার পরে দই না খেলে রতনবাবুর চলে না, মণিলালবাবুরও না।

খাবার সময় রতনবাবুর একটু অসোয়ান্তি লাগছিল এই কারণে যে, তাঁর সবসময়ই মনে হচ্ছিল যে, অন্য টেবিলের লোকেরা তাঁদের দিকে ফিরে ফিরে দেখছে। এরা কি তাঁদের দু'জনের মধ্যে মিলটা লক্ষ করেছে? এই মিলটা কি এতই স্পষ্ট যে, বাইরের লোকের চোখেও ধরা পড়ে ?

খাবার পরে রতনবাবু আর মণিলালবাবু চাঁদনি রাতে রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। একটা প্রশ্ন রতনবাবুর মাথায় অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছিল, এক ফাঁকে সেটা বেরিয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার কি পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে?'

মণিলালবাবু হেসে বললেন, 'এই পেরোলো বলে। এগারোই পৌষে পঞ্চাশ কমপ্লিট করব।' রতনবাবুর মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। দু'জনের জন্মও একই দিনে – ১৩২৩ সালের এগারোই পৌষ।

আধঘণ্টাখানেক পায়চারি করার পর বিদায় নেবার সময় মণিলালবাবু হেসে বললেন, 'আপনার সঙ্গে আলাপ করে বড় আনন্দ পেলুম। আমার সঙ্গে সহজে কারুর একটা বনে না কিন্তু আপনার বেলা সে-কথাটা খাটে না। বাকি ছুটিটা বেশ আনন্দে কাটবে বলে মনে হচ্ছে।'

অন্যান্য দিন রতনবাবু দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। সঙ্গে দু-একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা নিয়ে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পাতা ওলটানোর পর আপনা থেকেই ঘুমে চোখ বুজে আসে। শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে বাতির সুইচটা পাওয়া যায়, সেটা নেভানোর মিনিটখানেকের মধ্যেই রতনবাবুর নাক ডাকতে শুরু করে। আজ কিন্তু তিনি দেখলেন যে, তাঁর ঘুম আসতে চাইছে না। পড়বারও ইচ্ছে নেই।

পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে আবার পাশের টেবিলে রেখে দিলেন। মণিলাল মজুমদার.... রতনবাবু কোথায় যেন পড়েছিলেন যে, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কোথাও এমন কোনও

দু'জনকে পাওয়া যাবে না যাদের চেহারা হুবহু একরকম। অথচ চোখ কান নাক হাত পা ইত্যাদির সংখ্যা সকলেরই এক। চেহারার হুবহু মিল না হয় অসম্ভব, কিন্তু দু'জনের মনের এই আশ্চর্য মিল কি সম্ভব? শুধু মন কেন বয়স, পেশা, গলার স্বর, হাঁটা ও বসার ভঙ্গি, চোখের চশমার পাওয়ার ইত্যাদি আরও অনেক কিছু হুবহু মিলে যাচ্ছে। ভাবলে মনে হয় অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু সেটাও যে সম্ভব হয়েছে তার প্রমাণ তো গত চার ঘণ্টায় রতনবাবু অনেকবার পেয়েছেন।

রাত বারোটা নাগাদ রতনবাবু বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের কুঁজো কাত করে আঁজলা করে খানিকটা জল নিয়ে নিজের মাথায় দিলেন। তাঁর মাথা গরম হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ঘুম আসবে না। ভিজে মাথায় আলতো করে গামছাটা একবার বুলিয়ে নিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুলেন। বালিশটা ভিজে গেল। ভালই। যতক্ষণ না শুকোয় ততক্ষণ মাথা ঠাণ্ডা থাকবে।

পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। একটা প্যাঁচা বিকট স্বরে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে হোটেলের পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। কখন জানি আপনা থেকেই রতনবাবুর মন থেকে ভাবনা মুছে গিয়ে তাঁর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল।

রাত্রে ঘুমোতে দেরি হবার ফলে রতনবাবুর সকালে ঘুম ভাঙতে প্রায় আটটা হয়ে গেল। ন'টায় মণিলালবাবুর আসার কথা। আজ মঙ্গলবার। মাইলখানেক দূরে একটা জায়গায় আজ হাট বসবে। গতকাল খেতে খেতে দুজনে প্রায় একসঙ্গেই হাটে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কেনার বিশেষ কিছু নেই, খালি ঘুরে দেখা আর কি।

চা খেতে খেতেই প্রায় ন'টা বাজল। সামনে প্লেটে রাখা মৌরির খানিকটা মুখে পুরে হোটেল থেকে বাইরে বেরোতেই রতনবাবু দেখলেন মণিলালবাবু হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন।

কাছে এসে মণিলালবাবুর প্রথম কথা এল, 'আপনার সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল সে-কথা ভাবতে ভাবতে কাল ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গেল। উঠে দেখি আটটা বাজতে পাঁচ। এমনিতে ঠিক ছ'টায় উঠি।'

রতনবাবু এ-কথার কোনও জবাব দিলেন না। দু'জনে হাটের দিকে রওনা দিলেন। পাড়ার কতগুলো ছোকরা জটলা করছিল; রতনবাবুরা তাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাদের মধ্যে একজন টিটকিরির সুরে বলে উঠল, 'মানিকজোড়!' রতনবাবু যথাসম্ভব কথাটাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চললেন। মিনিট কুড়ির মধ্যে দু'জনে হাটে পৌঁছে গেলেন।

বেশ গমগমে হাট। ফলমূল শাকসবজি তরিতরকারি থেকে বাসনকোসন হাঁড়িকুঁড়ি জামাকাপড় মুরগিছাগল ইত্যাদি সবকিছুরই দোকান বসেছে। ভিড়ও হয়েছে বেশ। সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এ-দোকান সে-দোকান দেখতে দেখতে রতনবাবু আর মণিলালবাবু এগিয়ে চললেন।

ওটা কে ? পঞ্চা না? রতনবাবু কেন জানি তাঁর হোটেলের চাকরটাকে সামনে ভিড়ের মধ্যে দেখে তাঁর দৃষ্টি নামিয়ে মুখটাকে আড়াল করে দিলেন। ছোকরাদের 'মানিকজোড়' কথাটা কানে যাওয়া অবধি তাঁর ধারণা হয়েছে তাঁদের দু'জনকে একসঙ্গে দেখে লোকেরা মনে মনে হাসে।

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আচমকা রতনবাবুর মনে একটা চিন্তার উদয় হল। হঠাৎ কেন জানি মনে হল যে, তিনি একাই ছিলেন ভাল। বন্ধুর তাঁর কোনও দরকার নেই। আর বন্ধু হলেও, সে লোক যেন মণিলালবাবুর মতো না হলেই ভাল। মণিলালবাবুর সঙ্গে তিনি যতবারই কথা বলেছেন, ততবারই তাঁর মনে হয়েছে তিনি যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। প্রশ্ন করলে কী উত্তর পাওয়া যাবে সেটা যেন আগে থেকেই জানা, তর্ক করার কোনও সুযোগ নেই, আলোচনার প্রয়োজন নেই, ঝগড়াঝাঁটির কোনও সম্ভাবনাই নেই। এটা কি বন্ধুত্বের লক্ষণ। তাঁর অফিসের কার্তিক রায়ের সঙ্গে মুকুন্দ চক্কোত্তির তো গলায় গলায় ভাব; কিন্তু তা বলে কি দু'জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় না? আলবত হয়। কিন্তু তবু তো তারা বন্ধু, সত্যি করেই বন্ধু।

সবকিছু মিলিয়ে তাঁর বারবার মনে হতে লাগল যে মণিলাল মজুমদার লোকটি তাঁর জীবনে না এলেই যেন ভাল ছিল। ঠিক একই রকম দু'জন লোক যদি জগতে থাকেও, তাদের পরস্পরের কাছাকাছি আসাটা কোনও কাজের কথা নয়। সিনি থেকে কলকাতা ফিরে গিয়েও মণিলালবাবুর সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে এ কথা ভাবতেই রতনবাবু শিউরে উঠলেন।

একটা দোকানে বাঁশের লাঠি বিক্রি হচ্ছিল। রতনবাবুর অনেকদিনের শখ একটা লাঠি কেনার, কিন্তু মণিলালবাবু দর করছেন দেখে রতনবাবু অনেক কষ্টে তাঁর লোভ সংবরণ করলেন। শেষটায় দেখেন কি মণিলালবাবু নিজেই একটার জায়গায় দুটো লাঠি কিনে তার একটি তাঁকে উপহার দিলেন। দেবার সময় আবার বললেন, 'এই সামান্য লাঠিটা বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসাবে নিতে আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি হবে

না।'

হাটের পর হোটেলের দিকে ফেরার পথে মণিলালবাবু অনেক কথা বললেন। তাঁর ছেলেবেলার কথা, তাঁর মা-বাবার কথা, তাঁর ইস্কুল কলেজের কথা। রতনবাবুর শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে, তাঁর নিজের জীবনকথাই যেন কেউ তাঁকে গড়গড় করে শুনিয়ে যাচ্ছে।

বিকেলবেলা চা খেয়ে দু'জনে মাঠের মাঝখানের পথ দিয়ে ব্রিজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রতনবাবুর মাথায় ফন্দিটা এল। কথা তাঁকে বেশি বলতে হচ্ছে না, তাই মাথাটা কাজ করছিল ভাল। দুপুর থেকেই মনে হচ্ছে এই লোকটাকে হটাতে পারলে ভাল হয়, কিন্তু উপায়টা মাথায় আসছিল না। ঠিক এই মুহূর্তে পশ্চিমের আকাশে কালো মেঘটা চোখে পড়তেই রতনবাবু উপায়টা যে তাঁর চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত দৃশ্য হিসাবে দেখতে পেলেন।

তিনি দেখলেন যে, তাঁরা দু'জন যেন ওভারব্রিজের রেলিং-এর ধারটায় দাঁড়িয়ে আছেন। দুরে পশ্চিম দিক থেকে ছ'টার মেল ট্রেনটা ঝড়ের মতো এগিয়ে আসছে। এঞ্জিনটা যখন বিশ গজের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন তিনি মণিলালবাবুর কাঁধে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে

রতনবাবু হাঁটা অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করলেন। তারপর চোখ খুলে আড়চোখে একবার মণিলালবাবুর দিকে দেখে নিলেন। মণিলালবাবুকে কিছুমাত্র চিন্তিত বলে মনে হল না। কিন্তু দু'জনের মধ্যে যদি এতই

মিল হয়, তা হলে মণিলালবাবুও হয়তো মনে মনে তাঁকে হটাবার কোনও ফন্দি আঁটছেন! কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে তা মনে হল না। সত্যি বলতে কি, ভদ্রলোক দিব্যি মনের আনন্দে গুনগুন করে গান গাইছেন। হিন্দি সিনেমার এই গানের সুরটা রতনবাবুও মাঝে মাঝে গুনগুন করে থাকেন।

পশ্চিমের কালো মেঘটা এগিয়ে এসেছে, সূর্য মেঘের পিছনে ঢাকা। বোধহয় আর কয়েক মিনিটেই অস্ত যাবে। রতনবাবু চারিদিকে চেয়ে ত্রিসীমানায় আর অন্য কোনও মানুষের চিহ্ন দেখতে পেলেন না। ভালই হয়েছে। কাছাকাছির মধ্যে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে তাঁর প্ল্যান ভেস্তে যেত।

আশ্চর্য—একটা মানুষকে খুন করার কথা ভেবেও রতনবাবু নিজেকে দোষী মনে করতে পারলেন না। মণিলালবাবুর যদি কোনও বিশেষত্ব থাকত—এমনকী তাঁর স্বভাবচরিত্র যদি রতনবাবুর চেয়ে সামান্য অন্যরকমও হত—তা হলে রতনবাবু তাঁকে মারবার কথা কল্পনাই করতে পারতেন না। রতনবাবুর বিশ্বাস হয়েছে যে, একই রকম দু'জন লোকের একসঙ্গে বেঁচে থাকার কোনও সার্থকতা নেই। তিনি নিজে আছেন, নিজে থাকবেন এটাই যথেষ্ট। মণিলালবাবু থেকেও যদি তাঁর থেকে দূরে থাকতে পারতেন—যেমন এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন—তাতে তাঁর আপত্তি করার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন এই আলাপের পর সেটা সম্ভব নয়, তাই তাঁকে সরিয়ে ফেলা নেহাতই দরকার।

দুই ভদ্রলোক এসে ওভারব্রিজটায় পৌঁছলেন।

'বেশ গুমোট করেছে', মণিলালবাবু বললেন। 'রাত্রের দিকে বৃষ্টিও হতে পারে। আর তার মানেই কাল থেকে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়বে।

রতনবাবু এই ফাঁকে একবার ঘড়িটা দেখে নিলেন। ছ'টা বাজতে বারো মিনিট। ট্রেনটা নাকি খুব টাইমে যাতায়াত করে। আর বেশিক্ষণ নেই। রতনবাবু তাঁর জড় ভাবটা ঢাকবার জন্য একটা হাই তুলে বললেন, 'বৃষ্টি হলেও ঘণ্টা চার-পাঁচের আগে কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।'

'সুপুরি খাবেন?'

মণিলালবাবু পকেট থেকে একটা গোল টিনের কৌটো বার করে ঢাকনা খুলে রতনবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন। রতনবাবুর পকেটেও একটা কৌটোতে সুপুরি ছিল। তিনি সেটা আর বার না করে, সেটার কথা উল্লেখও না করে মণিলালবাবুর কৌটো থেকে একটা সুপুরি নিয়ে মুখে পুরে দিলেন। আর প্রায় সেই মুহূর্তেই ট্রেনের আওয়াজটা শোনা গেল ।

আজ ট্রেনটা ছ'টার একটু আগেই চলে এসেছে। মণিলালবাবু রেলিং-এর দিকে এগিয়ে গিয়ে ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, 'সাত মিনিট বিফোর টাইম।'

পশ্চিমে মেঘ থাকার জন্য আজ অন্যদিনের চেয়ে চারিদিক একটু বেশি অন্ধকার, তাই হেডলাইটের আলোটা আরও বেশি উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। এখনও অনেক দূরে ট্রেন, তবে আলোটা দ্রুত বেড়ে চলেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে চোখে জল এসে যায়।

'ক্রিং ক্রিং।'

সাইকেল চেপে একটা লোক রাস্তা দিয়ে ব্রিজের দিকে এসেছে। সর্বনাশ। লোকটা থামবে নাকি ? না, রতনবাবুর আশঙ্কা ভুল। লোকটা তাঁদের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে উলটোদিকের রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ট্রেনটা প্রচণ্ড দাপটে এগিয়ে এসেছে। চোখ ঝলসানো হেডলাইটে দূরত্ব আন্দাজ করা কঠিন। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওভারব্রিজ কাঁপতে শুরু করবে। ট্রেনের শব্দে কান পাতা যায় না।

মণিলালবাবু রেলিংধারে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে চেয়ে আছেন। একটা বিদ্যুতের চমক—আর সেই সঙ্গে সঙ্গে রতনবাবু তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দু' হাত দিয়ে মণিলালবাবুর পিঠে মারলেন ধাক্কা। তার ফলে মণিলালবাবুর দেহটা দু' হাত উঁচু কাঠের রেলিং-এর উপর দিয়ে উলটে সটান চলে গেল নীচে একেবারে রেললাইনের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই রতনবাবু বুঝতে পারলেন যে, ওভারব্রিজটা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

রতনবাবু আজ আর ট্রেন চলে যাবার দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করলেন না। কাঠের ব্রিজটার মতোই তাঁর মধ্যেও একটা কাঁপুনি শুরু হয়েছে। পশ্চিমের মেঘটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে—আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক।

রতনবাবু র‍্যাপারটা বেশ ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলেন। বৃষ্টির প্রথম পশলাটা এড়াবার ব্যর্থ চেষ্টায় শেষের রাস্তাটুকু প্রায় দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রতনবাবু হোটেলে ঢুকলেন।

ঢুকেই তাঁর কেমন যেন খটকা লাগল । এটা কোথায় এলেন তিনি? মহামায়া হোটেলের সামনে ঘরটা তো এরকম নয়। এরকম টেবিল, এরকমভাবে চেয়ার সাজানো, দেয়ালে এরকম ছবি....!

এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ দেয়ালে একটা কাঠের বোর্ড তাঁর চোখে পড়ল। কী বিদঘুটে ভুল রে বাবা! এ যে কালিকা হোটেলে এসে ঢুকেছেন তিনি। এইখানেই তো মণিলালবাবু ছিলেন না? 'বৃষ্টিতে ভিজলেন নাকি?'

কে একজন প্রশ্ন করল তাঁকে। রতনবাবু ঘুরে দেখলেন মাথায় কোঁকড়া চুল সবুজ র‍্যাপার গায়ে দেওয়া একজন লোক—বোধহয় এই হোটেলেরই বাসিন্দা —তাঁর দিকে মুখ করে হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে আছে। রতনবাবুর মুখ দেখে ভদ্রলোক যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, 'সরি—ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে দেখে হঠাৎ মণিলালবাবু বলে মনে হয়েছিল।'

এই প্রশ্নটা শুনে এই প্রথম রতনবাবুর মনে একটা সন্দেহ জাগল— তিনি যে খুনটা করলেন— সেটা সবদিক বিচার করে আটঘাট বেঁধে করেছেন কি? তাঁরা দু'জন যে একসঙ্গে বেরিয়েছেন সেটা হয়তো অনেকেই দেখেছে; কিন্তু দেখা মানেই কি লক্ষ করা? যারা দেখেছে তাদের কি কথাটা মনে থাকবে? আর যদি থাকেও, তার মানেই কি সন্দেহটা তাঁর উপরেই পড়বে? হাট থেকে বেরিয়ে খোলা রাস্তায় পড়বার পর আর তাঁদের কেউ দেখেনি – এ কথা রতনবাবু খুব ভালভাবেই জানেন। আর ওভারব্রিজে পৌঁছনোর পর—ও হ্যাঁ — সেই সাইকেলওয়ালা তো তাঁদের দুজনকে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু তখন রীতিমতো অন্ধকার হয়ে এসেছে। ওইভাবে দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে যাবার

সময় কি সে লোক তাঁদের মুখ চিনে মনে করে রেখে দিয়েছে? অসম্ভব ! রতনবাবু যতই ভাবলেন, ততই তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগলেন। মণিলালবাবুর মৃতদেহ আবিষ্কার হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তার ফলে রতনবাবুর উপর সন্দেহ পড়বে, তাঁর বিচার হবে, শাস্তি হবে, তাঁকে

খুনি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে—এসব কথা রতনবাবুর কিছুতেই বিশ্বাস হল না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে দেখে রতনবাবু কালিকা হোটেলে বসে এক পেয়ালা চা খেলেন। সাড়ে সাতটা নাগাদ বৃষ্টি থামল। রতনবাবু সটান নিউ মহামায়ায় চলে এলেন। কী অদ্ভুতভাবে ভুল করে তিনি ভুল হোটেলে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন সেটা ভাবতেও তাঁর হাসি পাচ্ছিল। রাত্রে পেটভরে খেয়ে বিছানায় শুয়ে 'দেশ' পত্রিকা খুলে অস্ট্রেলিয়ার বুনো জাতিদের সম্বন্ধে একটা

প্রবন্ধ পড়ে রতনবাবু ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে পরম নিশ্চিত্তে চোখ বুজলেন। আবার তিনি একা এবং অদ্বিতীয়। তাঁর সঙ্গী নেই, সঙ্গীর কোনও প্রয়োজনও নেই। তিনি এতকাল যেমনভাবে কাটিয়েছেন, আবার ঠিক তেমনিভাবেই কাটাবেন। এর চেয়ে আরাম আর কী হতে পারে?

বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর তার সঙ্গে বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ রতনবাবুর নাক ডাকতে শুরু করেছে।

পরদিন সকালে চা দেবার সময় পঞ্চা বলল, 'ওই লাঠিটা কাল হাটে কিনলেন নাকি বাবু ?? রতনবাবু বলেন, 'হ্যাঁ।'

"কত নিল?"

রতনবাবু দাম বললেন। তারপর গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, 'তুমি গিয়েছিলে

হাটে ?'

পঞ্চা একগাল হেসে বলল, 'হ্যাঁ বাবু। দ্যাখলাম তো আপনাকে। আপনি আমায় দেখতে পাননি?”

'কই, না তো!'

এর পরে পঞ্চার সঙ্গে তাঁর আর কোনও কথা হয়নি।

চা খাওয়া শেষ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি কালিকা হোটেলের সামনে এসে

পৌঁছলেন। কালকের সেই কোঁকড়া চুলওয়ালা ভদ্রলোকটি আরও কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে চিন্তিতভাবে কথাবার্তা বলছেন। মণিলালবাবুর নাম, আর 'সুইসাইড' কথাটা

রতনবাবুর কানে এল। তিনি ভাল করে শোনার জন্য আরেকটু এগিয়ে গেলেন। শুধু তাই না—একটা প্রশ্নও করে বসলেন।

"কে আত্মহত্যা করল মশাই?'

গতকালের ভদ্রলোক বললেন, 'কাল আপনাকে দেখে যে লোক বলে ভুল করেছিলুম, তিনি।'

'সুইসাইড?'

“সেইরকমই তো মনে হচ্ছে। রেললাইনের ধারে লাশ পাওয়া গেছে। একটা ওভারব্রিজ আছে, তারই

ঠিক নীচে। মনে হয় উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন। ভদ্রলোক এমনিতেই একটু অদ্ভুত গোছের ছিলেন। কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলতেন না। আমরা ওঁকে নিয়ে বলাবলি করতুম।' 'ডেডবডি—–?'

‘পুলিশের জিম্মায়। চেঞ্জে এসেছিলেন ভদ্রলোক। চেনাশুনা কেউ নেই এখানে। কলকাতা থেকে এসেছিলেন। এর বেশি আর কিছুই নাকি জানা যায়নি।'

রতনবাবু সহানুভূতির ভঙ্গিতে বার দুয়েক মাথা নেড়ে চুক চুক করে শব্দ করে আবার হাঁটতে শুরু করলেন।

সুইসাইড। তা হলে খুনের কথাটা কারুর মাথাতেই আসেনি। কী আশ্চর্য সৌভাগ্য তাঁর। খুন জিনিসটা তো তা হলে ভারী সহজ। লোকে এত ভয় পায় কেন?

রতনবাবু মনে মনে ভারী হালকা বোধ করলেন। দু'দিন পরে আজ তিনি আবার একা বেড়াতে পারবেন। ভাবতেও আনন্দ লাগে।

গতকাল মণিলালবাবুকে ঠেলা দেবার সময়ই বোধহয় রতনবাবুর শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে গিয়েছিল। একটা দরজির দোকান খুঁজে বার করে তিনি বোতামটা লাগিয়ে নিলেন। তারপর একটা মনিহারি দোকান থেকে একটা নিম টুথপেস্ট কিনলেন——নাহলে কাল সকালে দাঁত মাজা হবে না। যেটা রয়েছে সেটা টিপে টিপে একেবারে চ্যাপটার শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কিছুদূর যেতেই একটা বাড়ির ভিতর থেকে কীর্তনের আওয়াজ এল রতনবাবুর কানে। রতনবাবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কীর্তন শুনলেন। তারপর শহরের বাইরে একটা নতুন রাস্তা দিয়ে মাইলখানেক হেঁটে এগারোটা নাগাদ হোটেলে ফিরে এসে স্নান খাওয়া সেরে দিবানিদ্রার উদ্যোগ করলেন।

যথারীতি তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল, আর ভাঙামাত্র রতনবাবু বুঝতে পারলেন যে তাঁর মন চাইছে আজ সন্ধ্যায় আরেকবার ওভারব্রিজটায় যেতে। গতকাল খুব স্বাভাবিক কারণেই রতনবাবু ট্রেনের দৃশ্যটা উপভোগ করতে পারেননি। আকাশে মেঘ অবিশ্যি কাটেনি, কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। আজ তিনি ট্রেন আসা থেকে শুরু করে চলে যাবার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আরাম করে দেখবেন।

পাঁচটার সময় চা খেয়ে রতনবাবু নীচে নামলেন। সামনেই ম্যানেজার শম্ভুবাবু বসে আছেন। রতনবাবুকে দেখে বললেন, 'যে ভদ্রলোকটি কাল মারা গেছেন তাঁর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল নাকি মশাই?'

রতনবাবু প্রথমটা কিছু না বলে অবাক হবার ভান করে শম্ভুবাবুর দিকে চাইলেন। তারপর বলেন, “কেন বলুন তো?”

'না—ইয়ে—মানে, পঞ্চা বলছিল হাটে আপনাদের দু'জনকে একসঙ্গে দেখেছে।

রতনবাবু অল্প হেসে শান্তভাবে বললেন, 'আলাপ আমার এখানে কারুর সঙ্গেই হয়নি। হাটে এক-আধজনের সঙ্গে কথা হয়েছে বটে, তবে কি জানেন কোন লোকটি যে মারা গেছেন সেটাই তো আমি জানি না।'

ও হো।' শম্ভুবাবু হাসলেন। ভদ্রলোক বেশ আমুদে। উনিও আপনারই মতো হাওয়া বদলাতে এসেছিলেন। কালিকা হোটেলে উঠেছিলেন।' 'ও, তাই বুঝি!

রতনবাবু আর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে পড়লেন। প্রায় দু' মাইল পথ, আর বেশি দেরি করলে ট্রেন দেখা যাবে না।

রাস্তায় তাঁর দিকে আর কেউ সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিল না। গতকাল যে ছেলেগুলো জটলা করছিল, তাদের কাউকেই আজ আর দেখা গেল না। ওই 'মানিকজোড়' কথাটা রতনবাবুর ভাল লাগেনি। ছেলেগুলো কোথায় গেল? একটা ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন রতনবাবু। পাড়ায় পুজো আছে। ছেলেগুলো নির্ঘাত সেখানেই গেছে। রতনবাবু নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চললেন। খোলা প্রান্তরের মাঝখানের পথে আজ তিনি একা। মণিলালবাবুর সঙ্গে আলাপ হবার আগেও তিনি

নিশ্চিত্ত মানুষ ছিলেন, কিন্তু আজ তাঁর নিজেকে যেমন হালকা মনে হচ্ছে, তেমন হালকা এর আগে কখনও মনে হয়নি।

ওই যে বাবলা গাছ। ওটা পেরিয়ে মিনিটখানেক হাঁটলেই ওভারব্রিজ। আকাশ মেঘে ভরা, তবে ঘন কালো মেঘ নয়, ছাইয়ের মতো ফিকে মেঘ। বাতাস নেই, তাই সমস্ত মেঘ যেন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওভারব্রিজটা দেখতে পেয়ে রতনবাবুর মন আনন্দে নেচে উঠল। তিনি পা চালিয়ে এগিয়ে গেলেন। বলা যায় না—ট্রেন যদি কালকের চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি এসে পড়ে। মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক বক উড়ে গেল। ভিনদেশের বক কিনা কে জানে।

ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাটা রতনবাবু বেশ ভাল করে বুঝতে পারলেন। খুব মন দিয়ে কান পাতলে ক্ষীণ ঢাকের শব্দ শহরের দিক থেকে শোনা যায়। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

রতনবাবু রেলিঙের পাশটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ওই যে দূরে সিগন্যাল, আর ওই যে আরও দূরে স্টেশন। রেলিং-এর নীচের দিকের কাঠের ফাটলে কী যেন একটা জিনিস চকচক করছে। রতনবাবু উপুড় হয়ে হাত বাড়িয়ে জিনিসটাকে বার করে আনলেন। সেটা একটা গোল টিনের কৌটো, তার ভিতরে এলাচ আর সুপুরি। রতনবাবু একটু হেসে সেটাকে ব্রিজের উপর থেকে নীচের লাইনে ফেলে দিলেন। ঠুং করে একটা মৃদু শব্দও পেলেন তিনি। কদ্দিন ওইখানে পড়ে থাকবে ওই সুপুরির কৌটো কে জানে !

কীসের আলো ওটা?

ট্রেন আসছে। এখনও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আলো এগিয়ে আসছে।

রতনবাবু অবাক হয়ে আলোটা দেখতে লাগলেন। হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে তাঁর কাঁধ থেকে র‍্যাপারটা খসে পড়ল। রতনবাবু সেটাকে আবার বেশ ভাল করে জড়িয়ে নিলেন।

এবারে শব্দ পাচ্ছেন তিনি। গুড় গুড় গুড় গুম গুম গুম গুম গুম যেন একটা ঝড় এগিয়ে আসছে, আর সঙ্গে ক্রমাগত একটা মেঘের গর্জন।

রতনবাবুর হঠাৎ মনে হল তাঁর পিছনে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। এ সময় ট্রেনের দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল—কিন্তু তাও তিনি একবার চারিদিক চট করে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলেন। কেউ কোথাও নেই। আজ কালকের চেয়ে অন্ধকার কম, তাই দেখতে অসুবিধে নেই। শুধু তিনি আর ওই দ্রুত ধাবমান জাঁদরেল ট্রেনটা ছাড়া মাইলখানেকের মধ্যে আর কেউ আছে বলে মনে হয় না।

ট্রেন এখন একশো গজের মধ্যে। রতনবাবু রেলিঙের দিকে আরও এগিয়ে গেলেন। আগেকার দিনের স্টিম এঞ্জিন হলে এতটা এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ হত না; চোখে মুখে কয়লার ধোঁয়া ঢুকে যাবার বিপদ ছিল। এ ট্রেন ডিজেল ট্রেন, তাই ধোঁয়া নেই। শুধু বুক কাঁপানো গুরুগম্ভীর শব্দ আর চোখ

ঝলসানো হেডলাইটের আলো। ওই এসে পড়ল ট্রেন ব্রিজটার নীচে।

রতনবাবু তাঁর দু' কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে দুটো হাত এসে তাঁর পিঠে মারল এক প্রচণ্ড ধাক্কা। রতনবাবু টাল সামলাতে পারলেন না, কারণ রেলিংটা ছিল মাত্র দু'হাত উঁচু।

মেল ট্রেনটা সশব্দে ব্রিজ কাঁপিয়ে চলে গেল পশ্চিম দিকে, যেদিকের আকাশে রক্তের রঙ এখন বেগুনি হয়ে এসেছে।

রতনবাবু এখন আর ব্রিজের উপরে নেই, তবে তাঁর চিহ্নস্বরূপ একটি জিনিস এখনও রেলিং-এর কাঠের একটা ফাটলে আটকে রয়েছে। সেটা সুপুরি আর এলাচে ভরা একটি অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো।

99
Articles
গল্প ১০১
0.0
ফেলুদা এবং শঙ্কু বাদে সত্যজিৎ রায়ের যাবতীয় লেখা নিয়ে তৈরি একটি সংকলন।
1

বঙ্কুবাবুর বন্ধু

14 November 2023
0
0
0

বঙ্কুবাবুকে কেউ কোনওদিন রাগতে দেখেনি। সত্যি বলতে কি, তিনি রাগলে যে কীরকম ব্যাপারটা হবে, কী যে বলবেন বা করবেন তিনি, সেটা আন্দাজ করা ভারী শক্ত। অথচ রাগবার যে কারণ ঘটে না তা মোটেই নয়। আজ বাইশ বছর তিনি

2

টেরোড্যাকটিলের ডিম

14 November 2023
0
0
0

বদনবাবু আপিসের পর আর কার্জন পার্কে আসেন না। আগে ছিল ভাল। সুরেন বাঁড়ুজ্যের স্ট্যাচুর পাশটায় ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে বিশ্রাম করে তারপর ট্রামের ভিড়টা একটু কমলে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় শিবঠাকুর লেনে বাড়ি ফ

3

সেপ্টোপাসের খিদে

14 November 2023
0
0
0

কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে আপনা থেকেই মুখ থেকে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। বিকেল থেকে এই নিয়ে চারবার হল; মানুষে কাজ করে কী করে? কার্তিকটাও সেই যে বাজারে গেছে আর ফেরার নামটি নেই। লেখাটা বন্ধ ক

4

সদানন্দের খুদে জগৎ

14 November 2023
0
0
0

আজ আমার মনটা বেশ খুশি-খুশি, তাই ভাবছি এইবেলা তোমাদের সব ব্যাপারটা বলে ফেলি। আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে। তোমরা তো আর এদের মতো নও। এরা বিশ্বাস করে না। এরা ভাবে আমার সব কথাই বুঝি মিথ্যে আর বানানো। আমি ত

5

অনাথবাবুর ভয়

14 November 2023
0
0
0

অনাথবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ ট্রেনের কামরায়। আমি যাচ্ছিলাম রঘুনাথপুর, হাওয়াবদলের জন্য। কলকাতায় খবরের কাগজের আপিসে চাকরি করি। গত ক'মাস ধরে কাজের চাপে দমবন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। তা ছাড়া আমার লেখার শখ,

6

দুই ম্যাজিশিয়ান

14 November 2023
0
0
0

'পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো।' সুরপতি ট্রাঙ্কগুলো শুনে নিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট অনিলের দিকে ফিরে বলল, ঠিক আছে। দাও, গাড়ি পাঠিয়ে দাও সব ব্রেকভ্যানে। আর মাত্র পঁচিশ মিনিট। ' অনিল বলল, 'আপনার গাড

7

শিবু আর রাক্ষসের কথা

16 November 2023
0
0
0

'অ্যাই শিবু—এদিকে শোন। ' শিবুর ইস্কুল যাবার পথে ফটিকদা তাকে প্রায়ই এইভাবে ডাকে। ফটিকদা মানে পাগলা ফটিক। জয়নারায়ণ বাবুদের বাড়ি ছাড়িয়ে চৌমাথার কাছটায় যেখানে একটা পুরনো মরচে-ধরা স্টিম রোলার আজ

8

পটলবাবু ফিল্মস্টার

16 November 2023
1
0
0

পটলবাবু সবে বাজারের থলিটা কাঁধে ঝুলিয়েছেন এমন সময় বাইরে থেকে নিশিকান্তবাবু হাঁক দিলেন, 'পটল আছ নাকি হে?' “আজ্ঞে হ্যাঁ। দাঁড়ান, আসছি।' নিশিকান্ত ঘোষ মশাই নেপাল ভট্টচাজ্যি লেনে পটলবাবুর তিনখানা বাড

9

বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম

16 November 2023
0
0
0

নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন বিপিন চৌধুরী। যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প। একসঙ্গে অন্তত খান পাঁচেক বই না কিনলে তাঁর এক সপ্তাহের খোর

10

বাদুড় বিভীষিকা

16 November 2023
0
0
0

বাদুড় জিনিসটা আমার মোটেই ধাতে সয় না। আমার ভবানীপুরের ফ্ল্যাটের ঘরে মাঝে মাঝে যখন সন্ধের দিকে জানলার গরাদ দিয়ে নিঃশব্দে এক-একটা চামচিকে ঢুকে পড়ে, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। বিশেষত

11

নীল আতঙ্ক

16 November 2023
0
0
0

আমার নাম অনিরুদ্ধ বোস। আমার বয়স ঊনত্রিশ। এখনও বিয়ে করিনি। আজ আট বছর হল আমি কলকাতার একটা সদাগরি আপিসে চাকরি করছি। মাইনে যা পাই তাতে একা মানুষের দিব্যি চলে যায়। সর্দার শঙ্কর রোডে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া ন

12

রতনবাবু আর সেই লোকটা

16 November 2023
0
0
0

ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক দেখে রতনবাবুর মনে একটা খুশির ভাব জেগে উঠল। জায়গাটা তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে। স্টেশনের পিছনে শিরীষ গাছটা কেমন মাথা উচিয়ে রয়েছে, তার ডালে আবার একটা লাল ঘুড়ি আটকে

13

ফ্রিৎস

17 November 2023
0
0
0

জয়ন্তর দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে তাকে প্রশ্নটা না করে পারলাম না। 'তোকে আজ যেন কেমন মনমরা মনে হচ্ছে? শরীর-টরীর খারাপ নয় তো?' জয়ন্ত তার অন্যমনস্ক ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে একটা ছেলেমানুষি হাসি হেসে বল

14

ব্রাউন সাহেবের বাড়ি

17 November 2023
0
0
0

ব্রাউন সাহেবের ডায়রিটি হাতে আসার পর থেকেই ব্যাঙ্গালোর যাবার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। সেটা এল বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবে। আমাদের বালিগঞ্জ স্কুলের বাৎসরিক রি-ইউনিয়নে দেখা হয়ে গেল আমার পুরনো সহপাঠী অনীকেন্দ্র

15

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ্

17 November 2023
0
0
0

আমার ঘটনাটা কেউ বিশ্বাস করবে বলে বিশ্বাস হয় না। না করুক—তাতে কিছু এসে যায় না। নিজে চোখে না দেখা অবধি অনেকেই অনেক কিছু বিশ্বাস করে না। যেমন ভূত। আমি অবিশ্যি ভূতের কথা লিখতে বসিনি। সত্যি বলতে কি, এটাক

16

বাতিকবাবু

17 November 2023
0
0
0

বাতিকবাবুর আসল নামটা জিজ্ঞেস করাই হয়নি। পদবি মুখার্জি। চেহারা একবার দেখলে ভোলা কঠিন। প্রায় ছ' ফুট লম্বা, শরীরে চর্বির লেশমাত্র নেই, পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা, হাতে পায়ে গলায় কপালে অজস্র শিরা উপশিরা চ

17

খগম

17 November 2023
0
0
0

পেট্রোম্যাক্সের আলোতে বসে ডিনার খাচ্ছি, সবেমাত্র ডালনার ডিমে একটা কামড় দিয়েছি, এমন সময় চৌকিদার লছমন জিজ্ঞেস করল, আপলোগ ইমলি-বাবাকো দর্শন নেহি করেঙ্গে ? বলতে বাধ্য হলাম যে, ইমলিবাবার নামটা আমাদের ক

18

বারীন ভৌমিকের ব্যারাম

17 November 2023
0
0
0

কন্‌ডাকটরের নির্দেশমতো 'ডি' কামরায় ঢুকে বারীন ভৌমিক তাঁর সুটকেসটা সিটের নীচে ঢুকিয়ে দিলেন। ওটা পথে খোলার দরকার হবে না। ছোট ব্যাগটা হাতের কাছে রাখা দরকার। চিরুনি, বুরুশ, টুথ-ব্রাশ, দাড়ি কামানোর সরঞ্

19

ভক্ত

17 November 2023
0
0
0

অরূপবাবু—অরূপরতন সরকার—পুরী এসেছেন এগারো বছর পরে। শহরে কিছু কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে—কিছু নতুন বাড়ি, নতুন করে বাঁধানো কয়েকটা রাস্তা, দু-চারটে ছোট-বড় নতুন হোটেল—কিন্তু সমুদ্রের ধারটায় এসে বুঝতে পা

20

ফটিকচাঁদ

18 November 2023
0
0
0

ও যে কখন চোখ খুলেছে, ও জানে না। চোখে কিছু দেখার আগে ও বুঝেছে ওর শীত করছে, ওর গা ভিজে, ওর পিঠের তলায় ঘাস, ওর মাথার নীচে একটা শক্ত জিনিস। আর তার পরেই বুঝেছে ওর গায়ে অনেক জায়গায় ব্যথা। তবু ডান হাতটাক

21

বিষফুল

18 November 2023
0
0
0

*ওদিকে যাবেন না বাবু । জগন্ময়বাবু চমকে উঠলেন। কাছাকাছির মধ্যে যে আর কোনও লোক আছে সেটা উনি টের পাননি; তার ফলেই এই চমকানি। এবার দেখলেন তাঁর ডাইনে হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছেল

22

অসমঞ্জবাবুর কুকুর

18 November 2023
0
0
0

হাসিমারায় বন্ধুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে অসমঞ্জবাবুর একটা অনেকদিনের শখ মিটল। ভবানীপুরের মোহিনীমোহন রোডে দেড়খানা ঘর নিয়ে থাকেন অসমঞ্জবাবু। লাজপত রায় পোস্টঅফিসের রেজিস্ট্রি বিভাগে কাজ করেন তিনি; কা

23

লোড শেডিং

18 November 2023
0
0
0

ফণীবাবু তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে থেকেই আঁচ করলেন যে তাঁর পাড়ায় লোড শেডিং হয়ে গেছে। আজ আপিসে ওভারটাইম করে বেরুতে বেরুতে হয়ে গেছে সোয়া আটটা। ডালহৌসি থেকে বাসে তাঁর পাড়ায় পৌঁছাতে লা

24

ক্লাস ফ্রেন্ড

19 November 2023
0
0
0

সকাল সোয়া নটা। মোহিত সরকার সবেমাত্র টাইয়ে ফাঁসটা পরিয়েছেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী অরুণা ঘরে ঢুকে বললেন, 'তোমার ফোন। *এই সময় আবার কে ? কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ন'টায় অফিসে পৌঁছানোর অভ্যাস মোহিত সরকা

25

সহদেববাবুর পোট্রেট

19 November 2023
0
0
0

যেটার আগে নাম ছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, সেই মিরজা গালিব স্ট্রিটে ল্যাজারাসের নিলামের দোকানে প্রতি রবিবার সকালে সহদেববাবুকে দেখা যেতে শুরু করেছে মাস তিনেক হল। প্রথম অবস্থায় লোকাল ট্রেনে হেঁয়ালির বই, গো

26

মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি

19 November 2023
0
0
0

শাসমল আরাম কেদারাটায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন । মোক্ষম জায়গা বেছেছেন তিনি—উত্তর বিহারের এই ফরেস্ট বাংলো। এর চেয়ে নিরিবিলি মিঃ নিরাপদ নিরুপদ্রব জায়গা আর হয় না। ঘরটিও দিব্যি। স

27

পিন্টুর দাদু

19 November 2023
0
0
0

পিন্টুর আপসোস এইখানেই। তার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই দাদু আছে, কিন্তু কই, তাদের কেউই তো তার নিজের দাদুর মতো নয়। রাজুর দাদুকে সে দেখেছে নিজে হাতে লাল আর বেগুনি কাগজের ফিতে পর পর জুড়ে রাজুর ঘুড়ির জন্য ল

28

বৃহচ্চঞ্চু

19 November 2023
0
0
0

ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে তাঁর আপিসের যেখানে বসে তুলসীবাবু কাজ করেন, তার পাশেই জানালা দিয়ে পশ্চিম আকাশে অনেকখানি দেখা যায়। সেই আকাশে এক বর্ষাকালের সকালে যখন জোড়া রামধনু দেখা দিল, ঠিক তখনই তুলসীবাবুর

29

চিলেকোঠা

19 November 2023
0
0
0

ন্যাশনাল হাইওয়ে নাম্বার ফর্টি থেকে ডাইনে রাস্তা ধরে দশ কিলোমিটার গেলেই ব্রহ্মপুর। মোড়টা আসার কিছু আগেই আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী রে, তোর জন্মস্থানটা একবার ঢুঁ মেরে যাবি নাকি ? সেই যে ছেড়েচিস, তার

30

ভূতো

19 November 2023
0
0
0

নবীনকে দ্বিতীয়বার হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হল। অক্রূরবাবুর মন ভেজানো গেল না। উত্তরপাড়ার একটা ফাংশনে নবীন পেয়েছিল অজুর চৌধুরীর আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয়। ভেনট্রিলোকুইজ্‌জ্ম। খেলার নামটা নবীনের জানা ছিল না।

31

অতিথি

19 November 2023
0
0
0

মন্টু ক'দিন থেকেই শুনেছে তার মা-বাবার মধ্যে কথা হচ্ছে দাদুকে নিয়ে। মন্টুর ছোটদাদু, মা-র ছোটমামা । দাদুর চিঠিটা যখন আসে তখন মন্টু বাড়ি ছিল। মা চিঠি পড়ে প্রথমে আপন মনে বললেন, 'বোঝো ব্যাপার।' তারপর ব

32

ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট

19 November 2023
0
0
0

ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বাগানে আশ্চর্য গাছটা আবিষ্কার করলেন নিশিকান্তবাবু। সাহেব যে গাছপালা ভালবাসতেন সেটা করিমগঞ্জে এসেই শুনেছিলেন নিশিকান্তবাবু। ভারত স্বাধীন হবার বছর সাতেকের মধ্যেই সাহেব অস্ট্রেলিয়ায়

33

ফার্স্ট ক্লাস কামরা

20 November 2023
0
0
0

আগের আমলের ফার্স্ট ক্লাস কামরা-বাথরুম সমেত ফোর বার্থ বা সিক্স বার্থ কম্পার্টমেন্ট-আজকাল উঠেই গেছে। এটা যে সময়ের গল্প, অর্থাৎ নাইনটিন সেভেনটি-তখনও মাঝে মাঝে এক-আধটা এই ধরনের কামরা কী করে জানি ট্রেনের ম

34

ডুমনিগড়ের মানুষখেকো

20 November 2023
0
0
0

'আমি তখন ছিলাম ডুমনিগড় নেটিভ স্টেটের ম্যানেজার', বললেন তারিণীখুড়ো। 'ডুমনিগড় ম্যাপে আছে?' জিজ্ঞেস করল ন্যাপলা। ন্যাপলার মুখে কিছু আটকায় না। 'তোর কি ধারণা ম্যাপে যা আছে তার বাইরে আর কিছু নেই?' চোখ-কান

35

ধাপ্পা

20 November 2023
0
0
0

'চার্লস ওয়েকম্যানের 'হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক' আপনার ক' ভল্যুম ছিল?' সমরেশ ব্রহ্ম ইন্টারন্যাশনাল ম্যাজিক সার্কেলের চিঠির উত্তরে সইটা করে মুখ তুলে চাইল মহিমের দিকে। তার বন্ধু অধ্যাপক রণেন সেনগুপ্তর ছেলে মহ

36

কনওয়ে কাস্লের প্রেতাত্মা

20 November 2023
0
0
0

তারিণীখুড়ো তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়িতে দুটো টান দিয়ে বললেন, 'ভূতের গল্প অনেকে বলতে পারে, তবে পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলা গল্পের জাতই আলাদা। সেটা আর কজন পারে বলো।' 'আপনি পারেন?' প্রশ্ন করল ন্য

37

অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু

20 November 2023
0
0
0

টিপু ভূগোলের বইটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে দেখল। সাতচল্লিশ মিনিট পড়া হয়ে গেছে একটানা। এখন তিনটে বেজে তেরো মিনিট। এবার যদি ও একটু ঘুরে আসে তা হলে ক্ষতি কী? ঠিক এমনি সময় তো সেদিন লোকটা এসেছিল। সে তো বলেছিল

38

শেঠ গঙ্গারামের ধনদৌলত

20 November 2023
0
0
0

'আমার এখন যে চেহারা দেখছিস,' বললেন তারিণীখুড়ো, 'তা থেকে আমার ইয়াং বয়সের চেহারা তোরা কল্পনাই করতে পারবি না।' 'কীরকম চেহারা ছিল আপনার, খুড়ো?' জিজ্ঞেস করল ন্যাপলা, 'ধর্মেন্দরের মতো?' 'য্যা য্যাঃ!' বললে

39

স্পটলাইট

20 November 2023
0
0
0

ছোটনাগপুরের এই ছোট্ট শহরটায় পুজোর ছুটি কাটাতে আমরা আগেও অনেকবার এসেছি। আরও বাঙালিরা আসে; কেউ কেউ নিজেদের বাড়িতে থাকে, কেউ কেউ বাড়ি-বাংলো-হোটেল ভাড়া করে থাকে, দিন দশেকে অন্তত মাস ছয়েক আয়ু বাড়িয়ে নিয়ে

40

তারিণীখুড়ো ও বেতাল

20 November 2023
0
0
0

শ্রাবণ মাস, দিনটা ঘোলাটে, সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তারই মধ্যে সন্ধের দিকে তারিণীখুড়ো এসে হাজির। হাতের ভিজে জাপানি ছাতাটা সড়াত করে বন্ধ করে দরজার পাশটায় দাঁড় করিয়ে রেখে তক্তপোশে তাঁর জায়গাটায়

41

বহুরূপী

21 November 2023
0
0
0

নিউ মহামায়া কেবিনের একটি চেয়ার দখল করে হাফ কাপ চা আর আলুর চপ অর্ডার দিয়ে নিকুঞ্জ সাহা একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তার চেনা-পরিচিতের কেউ এসেছে কি? হ্যাঁ, এসেছে বইকী। ওই তো রসিকবাবু, আর ওই যে শ্রীধর।

42

মানপত্র

21 November 2023
0
0
0

শতদল সংস্থার সেক্রেটারি প্রণবেশ দত্ত বিস্ফোরক সংবাদটি ঘোষণা করবার পর উপস্থিত সদস্যদের মুখ দিয়ে প্রায় এক মিনিট কোনও কথা বেরোল না। ক্লাবঘরে জরুরি মিটিং বসেছে নববর্ষের পাঁচদিন আগে। মিটিং-এর উদ্দেশ্য প্রণ

43

অপদার্থ

21 November 2023
0
0
0

অপদার্থ কথাটা অনেক লোক সম্বন্ধে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আমাদের চাকর নবকেষ্ট। 'নব, তুই একটা অপদার্থ'-এই কথাটা ছেলেবেলায় মার মুখে অনেকবার শুনেছি। নব কিন্তু কাজ ভালই করত; দোষের মধ্যে সে ছিল

44

সাধনবাবুর সন্দেহ

21 November 2023
0
0
0

সাধনবাবু একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে ফিরে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখলেন মেঝেতে একটা বিঘতখানেক লম্বা সরু গাছের ডাল পড়ে আছে। সাধনবাবু পিটপিটে স্বভাবের মানুষ। ঘরে যা সামান্য আসবাব আছে-খাট, আলমারি, আলনা, জলের কুঁজো

45

গগন চৌধুরীর স্টুডিও

21 November 2023
0
0
0

একটা ফ্ল্যাট দিনের বেলা দেখে পছন্দ হলেও, সেখানে গিয়ে থাকা না অবধি তার সুবিধে-অসুবিধেগুলো ঠিক বোঝা যায় না। সুধীন সরকার এইটেই উপলব্ধি করল ভবানীপুরের এই ফ্ল্যাটে বসবাস আরম্ভ করে। এই একটা ব্যাপারেই ভাগ্যল

46

লখনৌর ডুয়েল

21 November 2023
0
0
0

'ডুয়েল মানে জানিস?' জিজ্ঞেস করলেন তারিণীখুড়ো। 'বাঃ, ডুয়েল মানে জানব না?' বলল ন্যাপলা। 'ডুয়েল রোল, মানে দ্বৈত ভূমিকা। সন্তোষ দত্ত গুপী গাইনে ডুয়েল রোল করেছিলেন-হাল্লার রাজা, শুণ্ডীর রাজা।' 'সে ডুয়েলে

47

ধুমলগড়ের হান্টিং লজ

21 November 2023
0
0
0

'মাথায় অনেকরকম উদ্ভট শখ চাপে মানুষের', বললেন তারিণীখুড়ো, 'কিন্তু আমার যেমন চেপেছে, তেমন কজনের চাপে জানি না।' আমরা পাঁচজন ঘিরে বসেছি খুড়োকে। বাইরে এক পশলা বেশ ভাল বৃষ্টি হয়ে গিয়ে এখন সেটা অবিরাম ঝিরঝি

48

লাখপতি

21 November 2023
0
0
0

ত্রিদিব চৌধুরী আর থাকতে না পেরে বিরক্তভাবে বেয়ারাকে ডাকার বোতামটা টিপলেন। কিছুক্ষণ থেকেই তিনি অনুভব করছেন যে, কামরাটা যত ঠাণ্ডা থাকার কথা মোটেই তত ঠাণ্ডা নয়। অথচ তাঁর তিন সহযাত্রীই দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘ

49

খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো

21 November 2023
0
0
0

ডিসেম্বরের ঊনত্রিশে, শীতটা পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। সন্ধেবেলা তারিণীখুড়ো এলেন গলায় আর মাথায় মাফলার জড়িয়ে। 'তোরা মাঠে যাচ্ছিস না খেলা দেখতে?' তক্তপোষে বসেই প্রশ্ন করলেন খুড়ো, 'নাকি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার ত

50

টলিউডে তারিণীখুড়ো

21 November 2023
0
0
0

তাকিয়াটাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে আরও জমিয়ে বসে ঝুঁকে পড়ে তারিণীখুড়ো তাঁর গল্প আরম্ভ করলেন। - আমার তখন তেইশ বছর বয়স, তবে একটা তেকোনা ফ্রেঞ্চকাট গোছের দাড়ি রেখেছিলাম বলে মনে হত তেত্রিশ। বেয়াল্লিশ সালের ক

51

আমি ভূত

22 November 2023
1
0
0

আমি ভূত। আজ থেকে ঠিক সাড়ে তিন বছর আগে আমি জ্যান্ত ছিলাম। সেই সময় এই দেওঘরের এই বাড়িতেই আগুনে পুড়ে আমার জ্যান্ত অবস্থার শেষ হয়। এই বাড়ির নাম লিলি ভিলা। আমি এখানে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছুটি কাটা

52

বামধনের বাঁশি

22 November 2023
0
0
0

রামধনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগায় আরেকটু কাছে গিয়ে একটা গাছের আড়াল থেকে দেখে তার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল। দশ বছর পেরিয়ে গেলেও চিনতে কোনও অসুবিধা নেই। এই সেই খগেশবাবু। খগেশ খাস্তগির, পুরনো ইটপাথর নিয়ে ঘ

53

জুটি

22 November 2023
0
0
0

'আজ আমি একজন ফিল্মস্টারের কথা বলতে যাচ্ছি,' চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন তারিণীখুড়ো। 'কে তিনি? তাঁর নাম কী?' আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। 'তাঁর নাম তোরা শুনিসনি,' বললেন তারিণীখুড়ো। 'তিনি যখন রিটায়ার করেন তখন

54

মাস্টার অংশুমান

22 November 2023
0
0
0

সেই সকালটার কথা আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। সেদিন ছিল রবিবার। তিনদিন ধরে সমানে বাদলা করে সেদিনই প্রথম ঝলমলে রোদ বেরিয়েছে। আমি একটা অঙ্ক কষে আমার খাতাটা বন্ধ করেছি এমন সময় বিশুদা এল। বিশুদা, বিশ্বনাথ গা

55

নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ

22 November 2023
0
0
0

কোনও মানুষই তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে ষোলো আনা সন্তুষ্ট বোধ করে না। কোনও-না-কোনও ব্যাপারে একটা খুঁতখুঁতেমির ভাব প্রায় সবার মধ্যেই থাকে। রাম ভাবে তার শরীরে আরও মাংস হল না কেন-হাড়গুলো বড্ড বেশি বেরিয়ে থ

56

কানাইয়ের কথা

22 November 2023
0
0
0

নসু কবরেজ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে বলরামের নাড়ি ধরে বসে রইলেন। শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে বলরামের সতেরো বছরের ছেলে কানাই কবরেজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। আজ দশদিন হল তার বাপের অসুখ। কোনও কিছু খাবারে তার রুচি নেই;

57

রতন আর লক্ষ্মী

23 November 2023
0
0
0

ঠিক কখন থেকে রতনের মনটা খুশিতে ভরে আছে সেটা রতন জানে। দশদিন আগে ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। রতন থাকে শিমুলিতে। সেখান থেকে চার ক্রোশ দূরে উজলপুরে সংক্রান্তির খুব বড় মেলা হয়। রতন গিয়েছিল সেই মেলা দেখতে। শুধু

58

গঙ্গারামের কপাল

23 November 2023
0
0
0

নদীর ধারে খোলামকুচি দিয়ে ব্যাঙবাজি খেলতে খেলতে হঠাৎ গঙ্গারামের চোখে পড়ল পাথরটা। এ নদীতে জল নেই বেশি; যেখানে সবচেয়ে গভীর সেখানেও হাঁটু ডোবে না। জলটা কাচের মতো স্বচ্ছ, তাই তার নীচে লাল নীল সবুজ হলদে খয়ে

59

সুজন হরবোলা

23 November 2023
0
0
0

সুজনের বাড়ির পিছনেই ছিল একটা সজনে গাছ। তাতে থাকত একটা দোয়েল। সুজনের যখন আট বছর বয়স তখন একদিন দোয়েলের ডাক শুনে সে ভাবল-আহা, এ পাখির ডাক কেমন মিষ্টি। মানুষে কি কখনও এমন ডাক ডাকতে পারে? সুজন সেইদিন থেকে

60

নিতাই ও মহাপুরুষ

23 November 2023
0
0
0

কোনও এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলে গেছেন যে মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই মাঝারি দলে পড়ে। কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু নিতাইকে মাঝারিও বলা চলে না। অনেক ব্যাপারেই সে অত্যন্ত খাটো। দেহের দিক দিয়ে যেমন, মনের দিক দিয়েও ছেল

61

মহারাজা তারিণীখুড়ো

23 November 2023
0
0
0

'আজ আপনার কপালে ভ্রুকুটি কেন খুড়ো?' জিজ্ঞেস করল ন্যাপলা। এটা অবিশ্যি আমিও লক্ষ করেছিলাম। খুড়ো তক্তপোশের উপর বাবু হয়ে বসে ডান হাতটা পায়ের পাতায় রেখে অল্প অল্প দুলছেন, তাঁর কপালে ভাঁজ। খুড়ো বললেন, 'এই

62

হাউই

23 November 2023
0
0
0

জয়ন্ত নন্দী : ছোটদের পত্রিকা 'হাউই'-এর সম্পাদক তরুণ সান্যাল : জয়ন্তর বন্ধু তিনকড়ি ধাড়া: 'হাউই'-এর দপ্তরের কর্মচারী। কাজ-বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা তন্ময় সেনগুপ্ত: লেখক মুকুল : দপ্তরের কর্মচারী ধনঞ্জয়/

63

প্রতিকৃতি

23 November 2023
0
0
0

রঞ্জন পুরকায়স্থ কলকাতার একজন নামকরা চিত্রকর। শুধু কলকাতা কেন, তাঁর খ্যাতি পশ্চিমবাংলার বাইরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছে-বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়ে

64

তারিণীখুড়ো ও ঐন্দ্রজালিক

23 November 2023
0
0
0

'কই, আর সব কই?' বললেন তারিণীখুড়ো। 'সব্বাইকে খবর দে, নইলে গল্প জমবে কী করে?' আমি বললাম, 'খবর পাঠানো হয়ে গেছে খুড়ো। এই এসে পড়ল বলে!' 'তা হলে এই ফাঁকে চা-টা বলে দে।' বললাম, 'তাও বলা হয়ে গেছে-দুধ চিনি ছা

65

অনুকূল

23 November 2023
0
0
0

'এর একটা নাম আছে তো?' নিকুঞ্জবাবু জিজ্ঞেস করলেন। 'আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে বইকী।' 'কী বলে ডাকব?' 'অনুকূল।' চৌরঙ্গিতে রোবট সাপ্লাই এজেন্সির দোকানটা খুলেছে মাস ছয়েক হল। নিকুঞ্জবাবুর অনেকদিনের শখ একটা যান্ত্

66

কাকতাড়ুয়া

24 November 2023
0
0
0

মৃগাঙ্কবাবুর সন্দেহটা যে অমূলক নয় সেটা প্রমাণ হল পানাগড়ের কাছাকাছি এসে। গাড়ির পেট্রল ফুরিয়ে গেল। পেট্রলের ইনডিকেটরটা কিছুকাল থেকেই গোলমাল করছে, সে-কথা আজও বেরোবার মুখে ড্রাইভার সুধীরকে বলেছেন, কিন্তু

67

নরিস সাহেবের বাংলো

24 November 2023
0
0
0

তারিণীখুড়োকে ঘিরে আমরা পাঁচ বন্ধু বসেছি, বাদলা দিন, সন্ধে হব-হব, খুড়োর চা খাওয়া হয়ে গেছে। এবার বিড়ি ধরিয়ে হয়তো গল্প শুরু করবেন। খুড়ো এলে সন্ধেতেই আসেন, আর এলেই একটি করে গল্প লাভ হয় আমাদের। সবই খুড়োর জ

68

কুটুম-কাটাম

24 November 2023
0
0
0

'কোথায় পেলি এটা?' 'আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল,' বলল দিলীপ। 'একটা জমি পড়ে আছে কাঠা তিনেক, তাতে কয়েকটা গাছ আর ঝোপঝাড়। একটা গাছের নীচে এটা পড়ে ছিল। অলোকের বাড়িতে সেদিন দেখছিলাম একটা গাছের গুঁড়িকে কেটে তার উপ

69

টেলিফোন

24 November 2023
0
0
0

ক্রিং-ক্রিং... ক্রিং-ক্রিং... ক্রিং-ক্রিং... বীরেশবাবু বিরক্ত হয়ে খাটের পাশের টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনটার দিকে দেখলেন। টেলিফোনের পাশেই ঘড়ি, তাতে বারোটা বাজে। রাত বারোটা। বীরেশবাবু সবে হাতের বইটা বন্ধ

70

গণেশ মুৎসুদ্দির পোট্রেট

24 November 2023
0
0
0

সুখময় সেনের বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সেই সে চিত্রকর হিসাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। পোর্ট্রেটেই তার দক্ষতা বেশি। সমঝদারেরা বলে সুখময় সেনের আঁকা কোনও মানুষের প্রতিকৃতি দেখলে সেই মানুষের জ্যান্ত রূপ দেখতে পাওয়

71

মৃগাঙ্কবাবুর ঘটনা

24 November 2023
0
0
0

মৃগাঙ্কবাবু তাঁর সহকর্মী সলিল বসাকের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারলেন যে বাঁদর থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে। এ খবর আজকের দিনে শিক্ষিত লোকমাত্রই জানে, কিন্তু ঘটনাচক্রে খবরটা মৃগাঙ্কবাবুর গোচরে আসেনি। আসলে তাঁর

72

নতুন বন্ধু

24 November 2023
0
0
0

বর্ধমান স্টেশনের রেস্টোর‍্যান্টে ভদ্রলোক নিজেই যেচে এসে আলাপ করলেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর গোঁফ, মোটামুটি আমারই বয়সী-অর্থাৎ বছর চল্লিশ-বেয়াল্লিশ-বেশ হাসিখুশি অমায়িক হাবভাব। বারোটা বাজে, তাই লাঞ্চটা সেরে ন

73

শিশু সাহিত্যিক

24 November 2023
0
0
0

ছোটদের মাসিক পত্রিকা 'বহুরূপী' এক বছর হল বেরোচ্ছে। সম্পাদক সুপ্রকাশ সেনগুপ্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেন কাগজটাকে ভাল করতে। টাকার জোর নেই, তাই কাজটা সহজ নয়। গ্রাহক সংখ্যা দেড় হাজারের মতো; বিজ্ঞাপন যা আসে তার থ

74

মহিম সান্যালের ঘটনা

24 November 2023
0
0
0

তারিণীখুড়ো তাকিয়াটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, 'চমকলালের কথা তো তোদের বলেছি, তাই না?' 'হ্যাঁ হ্যাঁ,' বলল ন্যাপলা। 'সেই ম্যাজিশিয়ান তো? যাঁর আপনি ম্যানেজার ছিলেন?' 'হ্যাঁ। কিন্তু আরেকজন জাদুকর আছেন

75

গণৎকার তারিণীখুড়ো

24 November 2023
0
0
0

তারিণীখুড়োর এক ভাইপো এক চা কোম্পানিতে ভাল কাজ করে, সে খুড়োকে এক টিন স্পেশাল কোয়ালিটির চা দিয়েছে। খুড়ো টিনটা আমার হাতে চালান দিয়ে বললেন, 'এটা খোলাবার ব্যবস্থা কর; আজ তোদের চা না খেয়ে এইটে খাব।' বৈশাখ

76

গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো

24 November 2023
0
0
0

'তোরা তো আমাকে গল্পবলিয়ে বলেই জানিস', বললেন তারিণীখুড়ো, 'কিন্তু এই গল্প বলে যে আমি এককালে রোজগার করেছি সেটা কি জানিস?' 'না বললে জানব কী করে?' বলল ন্যাপলা। 'সে আজ থেকে বাইশ বছর আগের কথা,' বললেন তারিণ

77

নিতাইবাবুর ময়না

24 November 2023
0
0
0

নিতাইবাবুর অনেকদিনের শখ একটা ময়না কেনার। তাঁর বন্ধু শশাঙ্ক সেনের বাড়িতে একটা ময়না আছে। সেটা হেন বাংলা কথা নেই যে বলে না। তার কথা শুনতেই নিতাইবাবু মাসে অন্তত তিনবার করে শশাঙ্কবাবুর বাড়িতে যান। সেদিন তো

78

রন্টুর দাদু

24 November 2023
0
0
0

রন্টুর বয়স পনেরো, কিন্তু এর মধ্যেই তার গানের গলা হয়েছে চমৎকার। সে সকালে ওস্তাদের কাছে একঘণ্টা গান শেখে। যে তার গান শোনে সেই বলে, 'এ ছেলে আর কয়েক বছরের মধ্যেই আসরে গান গাইবে।' এ গুণটা যে সে কোথা থেকে প

79

সহযাত্রী

24 November 2023
0
0
0

ত্রিদিববাবুর সাধারণত একটা হালকা বই পড়েই সময়টা কেটে যায়। কলকাতা থেকে দিল্লি ট্রেনে যাওয়া। কাজের জন্যই যেতে হয় দু মাসে অন্তত একবার। একটা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মচারী তিনি, হেড আপিস দিল্লিত

80

ব্রজবুড়ো

25 November 2023
0
0
0

শঙ্কর চৌধুরী আধখানা হাতের রুটি ছিঁড়ে ডালে চুবিয়ে মুখে পুরে একবার পাশে বসা ছেলের দিকে চেয়ে নিলেন। তারপর চিবোতে চিবোতে বললেন, 'তোকে একটা কথা বলব-বলব করেও বলা হয়নি। আমাদের ডাইনে একটা বাড়ির পরে একটা দোতলা

81

দুই বন্ধু

25 November 2023
0
0
0

মহিম বাঁ হাতের কবজি ঘুরিয়ে হাতের ঘড়িটার দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিল। বারোটা বাজতে সাত। কোয়ার্টজ ঘড়ি-সময় ভুল হবে না। সে কিছুক্ষণ থেকেই তার বুকের মধ্যে একটা স্পন্দন অনুভব করছে, যেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিশ বছ

82

শিল্পী

25 November 2023
0
0
0

অবনীশ ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অয়েল পেন্টিং। একজন মাঝবয়সি সুপুরুষ ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট। অবনীশের স্টুডিওর এক কোনায় আরও আট-দশটা ছবির পিছনে দাঁড় করানো ছিল। অবনীশের আঁকা প্রথম অয়েল পোর্ট্রেট। গভর্নমে

83

অক্ষয়বাবুর শিক্ষা

25 November 2023
0
0
0

অক্ষয়বাবু ছেলের হাত থেকে লেখাটা ফেরত নিলেন। 'কী রে-এটাও চলবে না?' ছেলে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল-না, চলবে না। এটা অক্ষয়বাবুর পাঁচ নম্বর গল্প যেটা ছেলে নাকচ করে দিল। অক্ষয়বাবুর ছেলের নাম অঞ্জন। তার বয়স চ

84

প্রসন্ন স্যার

25 November 2023
0
0
0

অর্ধেন্দু সেনগুপ্ত সাতদিনের ছুটি নিয়ে শিমুলতলায় এসেছে। সে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ভাল চাকরি করে, যদিও মাত্র পঁচিশ বছর বয়স। চেহারা সুশ্রী, চলনে বলনে রীতিমতো স্মার্ট। ব্যাচেলার হিসেবে তার এই শেষ ছুটি ভ

85

অভিরাম

25 November 2023
0
0
0

'তোমার নাম কী?' 'অভিরাম সাউ, বাবু।' 'তোমার বাড়ি কোথায়?' 'উলুইপুর গাঁয়ে বাবু। উড়িষ্যা।' 'বাড়িতে আছে কে?' 'আমার দাদা আছে, বউদি আছে, দুই ভাইপো আছে।' 'তোমার বাড়ি যেতে হয় না?' 'কালে ভদ্রে বাবু। আমি

86

ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা (অনুবাদ)

25 November 2023
0
0
0

    ১৯০৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাউথ কেনসিংটনের ৩৬ নং আপার কভেন্ট্রি ফ্ল্যাটে যক্ষ্মা রোগে ডাঃ জেমস হার্ডকালের মৃত্যুর পর, তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত কাহিনীটি পাওয়া যায়। যাঁরা হার্ডকাফ্লকে ঘনিষ্ঠভাব

87

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প (অনুবাদ)

25 November 2023
0
0
0

☆☆☆ নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা একদিন তাকে বললে, 'চলো, আজ রাত্রে আমরা তোমার বাড়িতে খাব।' 'বেশ, এসো আমার সঙ্গে', বললে নাসিরুদ্দিন। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে বললে, 'তোমরা একটু সবুর করো, আমি আগে গিন্নিকে বলে আ

88

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (অনুবাদ)

25 November 2023
0
0
0

একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে। কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, 'আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলে

89

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (অনুবাদ)

26 November 2023
0
0
0

রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির। একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, 'বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?' 'বেগুনের জবাব নেই,' বললে নাসিরুদ্দিন। রাজ

90

আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন (অনুবাদ)

26 November 2023
0
0
0

রাজামশাই একদিন নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, 'বনে গিয়ে ভাল্লুক মেরে আনো।' নাসিরুদ্দিন রাজার আদেশ অমান্য করে কী করে? অগত্যা তাকে যেতেই হল। বন থেকে ফেরার পর একজন তাকে জিজ্ঞেস করলে, 'কেমন হল শিকার, মোল্লাসাহ

91

আর এক দফা মোল্লা নাসিরুদ্দিন (অনুবাদ)

26 November 2023
1
0
0

☆☆☆ নাসিরুদ্দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, পাশে ফুলে ফলে ভরা বাগিচা দেখে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। প্রকৃতির শোভাও উপভোগ করা হবে, শর্টকাটও হবে। কিছুদূর যেতে না যেতেই নাসিরুদ্দিন এক গর্তের মধ্যে পড়ল, আর পড়তেই তার

92

ব্রেজিলের কালো বাঘ (অনুবাদ)

26 November 2023
0
0
0

মেজাজটা বনেদি, প্রত্যাশা অসীম, অভিজাত বংশের রক্ত বইছে ধমনীতে, অথচ পকেটে পয়সা নেই, রোজগারের কোনও রাস্তা নেই-একজন যুবকের পক্ষে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? আমার বাবা ছিলেন সহজ, সরল মানুষ। তাঁর দাদা

93

মঙ্গলই স্বর্গ (অনুবাদ)

26 November 2023
0
0
0

মহাকাশ থেকে রকেটটা নেমে আসছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। এতদিন সেটা ছিল তারায় ভরা নিঃশব্দ নিকষ কালো মহাশূন্যে একটি বেগবান ধাতব উজ্জ্বলতা। অগ্নিগর্ভ রকেটটা নতুন। এর দেহ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে উত্তাপ। এর কক্ষের

94

ঈশ্বরের ন' লক্ষ কোটি নাম (অনুবাদ)

27 November 2023
0
0
0

'আপনাদের অর্ডারটা একটু অস্বাভাবিক ধরনের', বিস্ময়ের মাত্রাটা যথাসম্ভব কমিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার- 'আমি যতদূর জানি, এর আগে কোনও তিব্বতি গুম্ফা থেকে অটোমেটিক সিকুয়েন্স কম্পিউটারের জন্য অর্ডার আসেনি। আপনাদের

95

ইহুদির কবচ (অনুবাদ)

27 November 2023
0
0
0

প্রাচ্যের পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আমার বিশিষ্ট বন্ধু ওয়র্ড মর্টিমারের জ্ঞান ছিল অসামান্য। সে এ বিষয়ে বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছিল, মিশরের ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এ খননকার্য তদারকের সময় একটানা দু' বছর থিবিসের একটি সম

96

ময়ূরকণ্ঠি জেলি (অনুবাদ)

27 November 2023
0
0
0

শশাঙ্ক টেবিলের উপর থেকে খাতাটা তুলে নিল। নীল মলাটের ছোট সাইজের সাধারণ নোটবুক! দাম বোধহয় আজকের দিনে আনা আষ্টেক। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে শশাঙ্ক এরকম নোটবুক ব্যবহার করেছে, তখন দাম ছিল দু'আনা। মনে আছে

97

সবুজ মানুষ (অনুবাদ)

27 November 2023
0
0
0

আমি যার কথা লিখতে যাচ্ছি তার সঙ্গে সবুজ মানুষের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, তা আমার সঠিক জানা নেই। সে নিজে পৃথিবীরই মানুষ, এবং আমারই একজন বিশিষ্ট বন্ধু-স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক-প্রফেসর নারা

98

আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু (অনুবাদ)

27 November 2023
1
0
0

অনেকের মতে আর্যশেখর ছিলেন যাকে ইংরাজিতে বলে চাইল্ড প্রডিজি। তাঁর যখন দশ বছর বয়স তখন একদিন স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম পাতায় নীচের দিকে এক লাইন লেখা তাঁর চোখে পড়ল-সান রাইজেজ টুডে অ্যাট সিক্স থার্টিন এ এ

99

পিকুর ডায়রি (অনুবাদ)

27 November 2023
0
0
0

আমি ডাইরি লিখছি। আমি আমার নীল নতুন নীল খাতায় ডাইরি লিখছি। আমি আমার বিছানার উপর বসে লিখছি। দাদুও ডাইরি রোজ লেখে কিন্তু এখন না এখন অসুক করেছিল তাই। সেই অসুকটার নাম আমি জানি আর নামটা করোনানি থমবোসি। বাবা

---