একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, 'আপনাকে যিনি হাঁস
দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু।' নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়ালে। এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, 'আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর
বন্ধু।' নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়ালে।
তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালে।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। 'আপনি কে?' দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে নাসিরুদ্দিন। 'আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
'ভেতরে আসুন,' বললে নাসিরুদ্দিন, 'খাবার তৈরিই আছে।'
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্রাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?'
'হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর', বললে নাসিরুদ্দিন।
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখে সারি সারি খাঁচায় ময়না বিক্রি হচ্ছে, সেগুলির দাম একেকটা পঞ্চাশ টাকা। পরদিন সে তার ধাড়ি মুরগিটাকে নিয়ে বাজারে হাজির, ভাবছে সেটাকে বিক্রি করে মোটা টাকা পাবে।
যখন দেখল যে পাঁচ টাকার বেশি দাম দিতে চায় না কেউ, তখন সে তম্বি শুরু করলে। তাই দেখে একজন লোক এসে তাকে বললে, 'মোল্লাসাহেব, কালকের পাখিগুলো যে কথা বলতে পারে, তাই এত দাম। তোমার মুরগি কথা বলে কি?'
নাসিরুদ্দিন চোখ রাঙিয়ে বললে, 'পুঁচকে পাখি বকবক করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলে তার হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকা দাম, আর আমার এতবড় মুরগি নিজের ভাবনা নিয়ে চুপচাপ থাকে বলে তার কদর নেই? যতসব ইয়ে।'
নাসিরুদ্দিন বাজার থেকে খাবার আনে, আর তার গিন্নি সেগুলো লুকিয়ে এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়। 'ব্যাপার কী বলো তো?' একদিন মোল্লা বললে-'খাবারগুলো যায় কোথায়?'
'বেড়ালে চুরি করে', বললেন গিন্নি।'
কথাটা শুনেই নাসিরুদ্দিন তার সাধের কুতুলটা এনে আলমারির ভিতর লুকিয়ে ফেললে।
'ওটা কী হল?' জিজ্ঞেস করলেন গিন্নি। 'বেড়াল যদি দশ পয়সার খাবার চুরি করতে পারে' বললে নাসিরুদ্দিন, 'তা হলে দশ টাকার কুড়ুলটা বাইরে ফেলে রাখি কোন ভরসায়?'
ॐ
এক সন্ধ্যায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নাসিরুদ্দিন কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গুনলে। নির্ঘাত এরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শাহেন শা-র ফৌজে ভর্তি
করে দেবে। রাস্তার পাশেই গোরস্থান; নাসিরুদ্দিন এক দৌড়ে তাতে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইল। ঘোড়সওয়াররা কৌতূহলী হয়ে গোরস্থানে ঢুকে দেখে নাসিরুদ্দিন একটা কবরের ধারে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। 'এখানে কী হচ্ছে মোল্লাসাহেব?' তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে। নাসিরুদ্দিন বুঝলে তার আঁচে গলতি হয়েছে। সে বললে, 'সব প্রশ্নের তো আর সহজ উত্তর হয় না। যদি বলি যে তোমাদের জন্যই আমার এখানে আসা, আর আমার জন্যই তোমাদের এখানে আসা, তা হলে কিছু বুঝবে?'
নাসিরুদ্দিন তার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, 'বন্ধু, চলো পাড়া বেড়িয়ে আসি।'
'লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না', বললে জামাল সাহেব। নাসিরুদ্দিন তাকে একটি বাহারের পোশাক ধার দিলে। প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন গৃহকর্তাকে বললে, 'ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব।
এঁর পোশাকটা আসলে আমার।'
দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, 'তোমার কেমনতরো আক্কেল
হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?' পরের বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, 'জামাল সাহেব আমার পুরনো বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা
পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।' জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, 'মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল
তোমায়?' 'কেন?' বললে নাসিরুদ্দিন, 'তুমি যেমন চাইলে তেমনই তো বললাম।'
'না', বললেন জামালসাহেব, 'পোশাকের কথাটা না বললেই ভাল।'
তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, 'আমার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভাল।' SRAY
নাসিরুদ্দিন নাকি বলে বেড়াচ্ছে যারা নিজেদের বিজ্ঞ বলে তারা আসলে কিছু জানে না। এই খবর শুনে সাতজন সেরা বিজ্ঞ নাসিরুদ্দিনকে রাজার কাছে ধরে এনে বললে, 'শাহেন শা, এই ব্যক্তি অতি দুর্জন। ইনি আমাদের বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। এর শাস্তির ব্যবস্থা হোক।'
রাজা নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার কিছু বলার আছে?'
'আগে কাগজ-কলম আনা হোক, জাঁহাপনা,' বললে নাসিরুদ্দিন।
কাগজ-কলম এল।
'এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।'
তাও হল।
'এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল-রুটির অর্থ কী?' সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে
গেলেন।
পয়লা নম্বর লিখেছেন-রুটি একপ্রকার খাদ্য।
দুই নম্বর-ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।
তিন নম্বর-রুটি ঈশ্বরের দান। চার নম্বর-একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।
পাঁচ নম্বর-রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।
ছয় নম্বর-রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে। সাত নম্বর-রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর শুনে নাসিরুদ্দিন বললে, 'জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনও চোখেই দেখেননি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।'
রাজা নাসিরুদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিলেন। নাসিরুদ্দিনের দজ্জাল গিন্নি ফুটন্ত সুরুয়া এনে কর্তার সামনে রাখল তার জিভ পুড়িয়ে তাকে জব্দ করবে বলে, কিন্তু ভুলে সে নিজেই দিয়ে ফেলেছে তাতে চুমুক। ফলে তার চোখে জল এসে গেছে। নাসিরুদ্দিন তাই দেখে বলে, 'হল কী? কাঁদছ নাকি?'
গিন্নি বললেন, 'মা মারা যাবার ঠিক আগে সুরুয়া খেয়েছিলেন, আহা! সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।' এবার নাসিরুদ্দিনও সুরুয়ায় চুমুক দিয়েছে, আর তার ফলে তারও চোখ ফেটে জল। 'সে কী, তুমিও কাঁদছ নাকি?' শুধোলেন গিন্নি।
নাসিরুদ্দিন বললে, 'তোমায় জ্যান্ত রেখে তোমার মা মারা গেলেন, এটা কি খুব সুখের কথা?'