শঙ্কর চৌধুরী আধখানা হাতের রুটি ছিঁড়ে ডালে চুবিয়ে মুখে পুরে একবার পাশে বসা ছেলের দিকে চেয়ে নিলেন। তারপর চিবোতে চিবোতে বললেন, 'তোকে একটা কথা বলব-বলব করেও বলা হয়নি। আমাদের ডাইনে একটা বাড়ির পরে একটা দোতলা বাড়িতে এক বুড়ো থাকে দেখেছিস?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ', বলল সুবু। 'রোজ ইস্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি। একতলার বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে থাকেন। আমার দিকে চেয়ে হাসেন।'
'হাসিটা কি বেশ খোশ মেজাজের হাসি?' সুবু একটু ভেবে বলল, 'একটু দুষ্টু দুষ্টুও হতে পারে।'
'ওই বুড়ো সম্বন্ধে এখানে এসে অবধি অনেক কথা শুনছি', বললেন শঙ্করবাবু। 'উনি নাকি তন্ত্রটক্স জানেন; তুকতাক করে যাদের পছন্দ নয় তাদের অনিষ্ট করতে পারেন। মোট কথা, উনি ডাকলেও ওঁর কাছে যাস-টাস না।'
সুবুর ভাল নাম সুবীর। বয়স বারো। তিন মাস হল সুবীরেরা কলকাতা থেকে এই শহরে এসেছে। এখানকারই এক কলেজে শঙ্কর চৌধুরী ইংরিজির প্রোফেসরের চাকরি পেয়েছেন। সুবীর কলকাতার স্কুল ছেড়ে এখানে সেন্ট টমাসে ভর্তি হয়েছে। সবাই বলে এই জায়গাটা স্বাস্থ্যকর। শীতকালে যে বেশ শীত পড়ে সেটা এই নভেম্বরের গোড়াতেই সকাল-সন্ধ্যায় টের পাওয়া যাচ্ছে। সুবীরের মা-র জায়গাটা খুব পছন্দ। বলেন, 'এখানকার বাতাসই আলাদা। প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।'
এই ক'মাসেই ইস্কুলে সুবীরের দু-একজন বন্ধু হয়েছে; তার মধ্যে দিব্যেন্দুকেই ওর সবচেয়ে ভাল লাগে। সুবু-দিবু ক্লাসে পাশাপাশি বসে, দুজনেই পড়াশুনায় ভাল, খেলাধুলোয় দু'জনেরই খুব উৎসাহ। দিবু একদিন কথায় কথায় সুবীরকে বলল, 'ব্রজবুড়ো তো তোদের একটা বাড়ি পরেই থাকে।'
'ব্রজবুড়ো?' সুবীর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। 'সে আবার কে?' 'দেখিসনি? মাথায় টাক, ফরসা রঙ, দাড়ি, গোঁফ কামানো-গলাবন্ধ কোট আর ধুতি পরে বারান্দায় বসে থাকে?'
সুবীর বলল, 'ওঁকে বুঝি লোকে ব্রজবুড়ো বলে? ওঁকে তো রোজ দেখি।'
'সাবধান!' বলল দিব্যেন্দু। 'ওকে চটাসনি। ও হাসলে তুইও হাসিস।' 'তা তো হাসিই।'
'তা হলে ঠিক আছে। ও যদি তোর ওপর খেপে যায়, তা হলে ওর বাড়িতে বসেই স্রেফ মন্ত্র পড়ে তোর সর্বনাশ করে ছাড়বে।'
'বাবাও আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন,' বলল সুবীর।
'একদিন পঞ্চাকে ডেকে একটা ঘুড়ি দিয়েছিল। কোথায় পেল কে জানে! খুব রহস্যজনক ব্যাপার।'
'ওঁর পুরো নাম কী?'
'তা জানি না।'
এর কিছুদিন পরে সুবীরদের প্রতিবেশী অনুকূল সাহা সন্ধ্যায় এলেন সুবীরের বাবার সঙ্গে আলাপ করতে। আগে আসেননি কখনও-এই প্রথম। বয়সে সুবীরের বাবার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়।
বসবার ঘরে সোফার একপাশে বসে বললেন, 'ডিসটার্ব করলুম না তো?'
'না না,' বললেন শঙ্করবাবু। 'আমিই ভাবছিলাম একদিন আপনার ওখানে টু মারব। আপনি অ্যালাহাবাদ ব্যাঙ্কে আছেন না?' 'আজ্ঞে হ্যাঁ। -আমি সংসার করিনি। এখানে আমার বাড়িতে আমি একা। কলকাতায় এক ভাই আছে, লোহালক্কড়ের ব্যবসা করে। আপিস থেকে ফিরে পাড়ার কারুর না কারুর বাড়িতে গিয়ে গল্পসল্প করি। অবিশ্যি একজন বাদে।'
'কে?'
'ব্রজকিশোর বাঁডুজ্যে। নাম শুনেছেন?'
'যাকে ব্রজবুড়ো বলে? আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরে থাকে?'
'আজ্ঞে হ্যাঁ।'
'ভদ্রলোকের তো অনেক গোলমাল শুনেছি।'
'বিস্তর। বুড়ো এখানে আসে বছর পনেরো আগে। আমি তখনও আসিনি, কিন্তু বুড়োর দক্ষিণের লাগোয়া বাড়ির নরেশ মল্লিক ছিলেন। তিনি ত্রিশ বছর হল এখানে আছেন-সদানন্দ রোডে গয়নার দোকান আছে। তিনি বলেন সুটকেস হোল্ডল ছাড়াও বুড়োর সঙ্গে নাকি একটা সবুজ রঙের বাক্স ছিল, সে এক আলিসান ব্যাপার। সঙ্গে একজন লোকও ছিল, সে পরের দিন চলে যায়। ওই সবুজ বাক্সের কথা এখন শহরের সকলেই জানে। আমাদের তো বিশ্বাস, ওতেই বুড়োর তন্ত্রমন্ত্রের সব সরঞ্জাম রয়েছে। উনি আসার আগে নাকি বাড়িটা খালিই পড়ে থাকত।' 'তন্ত্রের ব্যাপারটা কি সত্যি বলে মনে হয়?'
'আমি বলতে পারব না, তবে নরেশবাবুর কাছেই শুনেছি, বুড়োর দোতলার ঘর থেকে মাঝরাত্তিরে নানারকম সব শব্দ শুনেছেন। করতালের আওয়াজ, ডুগি পেটানোর আওয়াজ, বিড়বিড় করে বলা সব মন্ত্র, মাঝে মাঝে হাসির শব্দ। ...এটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ বলছি-বুড়োর উত্তরের বাড়িতে যিনি থাকেন-ভদ্রলোকের নাম বোধহয় জানেন?'
'বাড়ির দরজায় কাঠের ফলকে দেখেছি-এন. কে. মজুমদার।' 'হ্যাঁ। নিশিকান্ত মজুমদার। ইনসিওরেন্স আপিসে চাকরি করেন। ইনিও মাঝরাত্তিরে ওইসব শোনেন-এমনকী একদিন জানলায় একটা বীভৎস মুখ দেখেন। মজুমদার মশাই সোজা গিয়ে বুড়োকে বলেন যে এইভাবে প্রতিবেশীর শান্তিভঙ্গ করলে তিনি পুলিশে খবর দেবেন। এটা বিকেলবেলা। বুড়ো
তখন বারান্দায় বসে।' 'শাসানোর ফল কী হল?'
'সেই তো বলছি। গোলমাল তো বন্ধ হলই না, মাঝখান থেকে নিশিকান্তবাবু ব্যারাম বাধিয়ে বসলেন। হাই ফিভার-১০৬ ডিগ্রি অবধি উঠেছিল। ডাক্তার বললেন ভাইরাস ইনফেকশন। সাতদিনে জ্বর ছাড়ল। নিশিকান্তবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস, বুড়ো তুক করেছিলেন। নীলোৎপলবাবুর একটি ছেলে আছে, বছর পনেরো বয়স, নাম রতন। আমাদের বাড়ির কাছেই কাগমারার মোড়টাতে থাকে। বুড়ো নাকি তার সঙ্গে ভাব করার জন্য খুবই ব্যগ্র। হাসিমুখ করে হাতছানি দিয়ে ডাকে। রতন ওর ব্যাপার জানে, তাই কোনও আমল দেয় না।'
সুবীরকে তার বাবা বারণ করেছেন, কিন্তু দিব্যেন্দুকে কেউ বারণ করেনি। দিব্যেন্দুর বাবা এইসব তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক বিশ্বাস করেন না। বলেন, 'একটা নিরীহ বুড়োকে উদ্দেশ করে মিথ্যে গালমন্দ করা হচ্ছে। ওঁকে দেখলেই বোঝা যায় ওঁর মধ্যে কোনও গণ্ডগোল নেই।'
দিব্যেন্দু যদিও সুবুকে বুড়ো সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিল, কিন্তু বাপের কাছ থেকে সে যে একটা বেপরোয়া ভাব পেয়েছে সেটা যাবে কোথায়? সে একদিন সুবুকে বলল, 'আজ তোর সঙ্গে ফিরব। তোর বাড়িও যাওয়া হবে, আর বুড়ো কী করে তাও দেখা যাবে।'
সুবু ভুরু কুঁচকে বলল, 'কিন্তু তুই নিজেই তো সেদিন বললি বুড়োর কাছ থেকে দূরে থাকতে।'
'তা বলেছিলাম,' বলল দিবু, 'কিন্তু বাবা বলেন বুড়োর মধ্যে কোনও দোষ নেই। তাই একবার গিয়ে দেখি না কী হয়। এও একরকম অ্যাডভেঞ্চার তো।' সুবু তার বাবার নিষেধ উড়িয়ে দিতে পারে না; সে বলল, 'কাছে যেতে পারি, এমনকী কথাও বলতে
পারি, কিন্তু ওঁর বাড়ির ভেতরে ডাকলে যাব না।'
'ঠিক আছে। তাই হবে।'
ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ব্রজবুড়োর বাড়ি দেখা যেতেই সুবুর বুকের ভিতর একটা ধুকপুকুনি শুরু
হয়ে গেল। কিন্তু সে যে ভয় পেয়েছে সেটা তো দিবুকে কিছুতেই জানতে দেওয়া চলে না, তাই সে মনে সাহস এনে এগিয়ে চলল দিবুর সঙ্গে।
হ্যাঁ-কোনও সন্দেহ নেই। রোজকার মতো আজও বুড়ো বসে আছে বারান্দায়।
সুবু-দিবু এগিয়ে আসতে ঠিক অন্যদিনের মতোই ব্রজবুড়ো হাসি মুখে তাদের দিকে চাইলেন। আজ সুবু বুড়োর হাসির মধ্যে সত্যিই একটা শয়তানি ভাব লক্ষ করল।
'হাসছেন কেন? কিছু বলবেন?' দিবু বুড়োর সামনে থেমে পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞেস করল।
'হ্যাঁ, বলব,' বললেন ব্রজবুড়ো। 'আমি ডাকলে আসো না কেন?' দিবু বলল, 'আমাকে কোনওদিন ডাকেননি। আর ডাকলেই বা যাব কেন? ওরকম যার-তার ডাকে আমি যাই না।'
সুবু মনে মনে ভাবল-বারে, দিবুর কী সাহস। আবার দিবুই কথা বলল। 'আপনার সবুজ বাক্সে কী আছে?'
'কেন বলব?' বুড়ো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মিচকে হেসে বলল। 'আমার সঙ্গে আমার বাড়ির দোতলায় গেলেই জানতে পারবে।'
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে দেখে সুবু এক নিশ্বাসে বলে দিল, 'আরেকদিন যাৰ। আজ বাড়িতে কাজ আছে।'
দু'জনে চলে এল পিছন দিকে না তাকিয়ে।
দিবু সুবুর বাড়িতেই বিকেলের খাওয়া সারল। খেতে-খেতেই সুবুর বাবা কলেজ থেকে এসে গেলেন। সুবু কোনও কিছু না লুকিয়ে ব্রজবুড়োর সঙ্গে যা হয়েছে পুরো ব্যাপারটা বাবাকে বলে দিল। শঙ্করবাবু কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, 'একবার করেছ এ জিনিস-আর কোরো না। দিব্যেন্দু, তোমাকেও বলছি, এসব ব্যাপারে সাহস দেখানো কোনও কাজের কথা নয়। বুড়োর মধ্যে অনেক গোলমাল। ওঁর প্রতিবেশীদের কথা অবিশ্বাস করা যায় না। কালই নিশিকান্তবাবু আমার বাড়ি এসেছিলেন। ব্রজ ব্যানার্জির ঘর থেকে মাঝরাত্তিরে নাকি পিস্তলের আওয়াজ পেয়ে বুড়োর বাড়িতে গিয়ে দরজা ধাক্কা দেন। কেউ দরজা খোলে না।'
এর সপ্তাহখানেক পরে এক রবিবার সকালে সুবুদের বাড়ির সামনের দরজায় টোকা পড়ল। সুবুর
বাবা খবরের কাগজ পড়ছিলেন, ছেলেকে বললেন, 'দ্যাখ তো কে এল।' সুবু দরজা খুলে দেখে খয়েরি সুট পরা একজন বেশ ভাল দেখতে ভদ্রলোক, বয়স ত্রিশের খুব বেশি
না। তাঁর পিছনে রাস্তায় একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে-এটাও সুবুর চোখে পড়েছে। 'ব্রজকিশোর ব্যানার্জির বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?'
ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন সুবুর বাবাকে। 'চুয়াত্তর নম্বর সেটা জানি, কিন্তু এখানে তো দেখছি কোনও
বাড়িতেই নম্বর লেখা নেই।'
শঙ্করবাবু দাঁড়িয়ে উঠে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন, 'এইদিকে আমার বাড়ির পরের বাড়িটা।'
'থ্যাঙ্কস।'
ভদ্রলোক যাবার জন্য ঘুরেছিলেন, কিন্তু শঙ্করবাবুর একটা প্রশ্নে থেমে গেলেন।
'আপনি কি ওঁর আত্মীয়?'
'হ্যাঁ। আমি ওঁর ভাইপো। ছোট ভাইয়ের ছেলে। আসি।' ভদ্রলোক চলে গেলেন। শঙ্করবাবু আবার সোফায় বসে বললেন, 'হাইলি ইন্টারেস্টিং। আমার ধারণা
ছিল ব্রজবুড়োর তিন কুলে কেউ নেই।' বিকেলে সুবুরা চা খাচ্ছে, এমন সময় দরজায় আবার টোকা পড়ল। সুবু খুলে দেখে আবার সেই
সকালের ভদ্রলোক।
'একটু আসতে পারি কি?'
শঙ্করবাবুও উঠে এসেছেন, বললেন, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আসুন আসুন।'
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এলেন।
'বসুন। চা খাবেন?'
'নো, থ্যাঙ্কস। এইমাত্র খেয়ে আসছি।'
'ব্রজবাবুকে কেমন দেখলেন?'
'সেইটে নিয়েই একটু কথা বলতে এলাম,' বললেন ভদ্রলোক। 'আগে আমার পরিচয়টা দিই। আমার নাম অমিতাভ ব্যানার্জি। আমার পেশা হচ্ছে মনের ব্যারামের চিকিৎসা করা। সাইকায়াট্রি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই শখটা হয়েছিল; বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আমি বিলেত গিয়ে পাশ করে ওখানে তিন বছর প্র্যাকটিস করছিলাম-কিছুদিন হল কলকাতায় এসেছি। বাবার কাছ থেকেই জ্যাঠার কথাটা শুনেছিলাম। বাবা লখনৌয়ে ওকালতি করতেন, আমার জন্ম, পড়াশুনা সবই ওখানে। আমি ব্রজ জ্যাঠাকে কোনওদিন দেখিনি। যখন কলকাতায় গিয়েছি, ততদিনে ব্রজ জ্যাঠা আপনাদের এখানে চলে এসেছেন। এটা শুনেছিলাম যে কলকাতায় থাকতে জ্যাঠা চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতেন, কারুর সঙ্গে মিশতেন না। ডাক্তার দেখে বলেছিলেন শরীরে কোনও ব্যারাম নেই।'
'যে বাড়িতে রয়েছেন, সেটা কার?' 'ওটা আমার ঠাকুরদা তৈরি করেছিলেন। উনি ব্যবসা করতেন, অনেক পয়সা করেছিলেন। মারা যাবার আগে তিন ছেলেকে উইল করে টাকা সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে যান। কাজেই ব্রজ জ্যাঠার টাকার অভাব নেই।'
- 'উনি কি তন্ত্র-টন্ত্র চর্চা করেছেন নাকি?'
'কী যে করেছেন তা কেউ সঠিক বলতে পারবে না। আমরা থাকতাম লখনৌয়ে, মেজো জ্যাঠার কাজ ছিল ব্যাঙ্গালোরে। ব্রজ জ্যাঠা কলকাতাতেই থাকতেন, তবে গোটা তিনেক চাকর ছাড়া দেখবার আর কেউ ছিল না। তন্ত্রের ব্যাপার জানি না, তবে ওঁর যে মানসিক ব্যারাম রয়েছে তাতে অন্তত আমার কোনও সন্দেহ নেই। কথা হচ্ছে-কী ব্যারাম?'
'সেটা এখনও ধরতে পারেননি?'
'ধরব কী করে? আমার সঙ্গে তো কথাই বলছেন না।...তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।' 'কী?'
'ওঁর চাকর বলছিল উনি নাকি ছোটদের উপর কখনও রাগ করেন না। তাই ভাবছিলাম, যদি আপনার ছেলেকে একবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি, তা হলে হয়তো উনি মুখ খুলতে পারেন।' সুবু বলল, 'ওঁর একটা সবুজ বাক্স আছে কি?'
অমিতাভবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, 'বাক্স মানে কী-সে তো এক বিশাল ট্রাঙ্ক। আমি ওঁকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম ওতে কী আছে। উনি কোনও জবাবই দিলেন না।'
শঙ্করবাবু বললেন, 'ঠিক আছে। আমার ছেলে যাবে; কিন্তু তার সঙ্গে তার বাবাও যাবে।'
'নিশ্চয়ই। সে তো খুব ভাল কথা। আমি খানিকটা জোর পাব।' পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনজনে বেরিয়ে পড়ল। ব্রজবুড়োর বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতেই একটা বুড়ো চাকর এসে দরজা খুলে দিল। 'বাবু কোথায়?' জিজ্ঞেস করলেন অমিতাভবাবু।
'দোতলায় শোবার ঘরে', বলল চাকর।
'আজ বাইরে বসবেন না?'
'আজ্ঞে, আপনি আসার পর থেকেই উনি কেমন যেন হয়ে গেছেন। আজ বিকেলে চাও খেলেন
না।'
'ঠিক আছে। আমরা ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করব। আসুন মিস্টার-'
'চৌধুরী।' তিনজনে দোতলায় গিয়ে হাজির হল। ডান দিকে একটা দরজা, সেটাই ব্রজবুড়োর শোবার ঘর।
ডাঃ ব্যানার্জির পিছন পিছন শঙ্করবাবু আর সুবুও ঘরে ঢুকল।
ব্রজবুড়ো বালিশে পিঠ দিয়ে খাটে আধশোয়া। সুবুকে দেখেই তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই
মিলিয়ে গেল।
'তোমার সঙ্গে আবার এঁরা কেন?' অভিমানের সুরে বললেন ব্রজবুড়ো। সুবু বলল, 'আপনি সবুজ বাক্সটার কথা বলেছিলেন-সেটা দেখতে এলাম।'
প্রকাণ্ড সবুজ ট্রাঙ্কটা সুবু ঘরে ঢুকেই দেখেছিল। খাটের উলটোদিকে দেয়ালের সামনে রাখা
হয়েছে। বোঝাই যায় আদ্যিকালের ট্রাঙ্ক।
'নিশ্চয়ই দেখাব', বললেন ব্রজবুড়ো। 'কিন্তু এখন না। এঁরা ঘর থেকে বেরোলে দেখাব।' ডাঃ ব্যানার্জি শঙ্করবাবুকে বললেন, 'চলুন মিস্টার চৌধুরী-আমরা পাশের ঘরে যাই।' দুজন বেরিয়ে যেতে বুড়োর মুখে আবার হাসি ফুটল। সুবুর বুকের ভিতর আবার ধুকপুকুনি। ব্রজবুড়ো খাট থেকে নেমে ট্যাঁক থেকে একটা চাবি বার করে ট্রাঙ্কটা খুলে ডালাটা উপরে তুলে দিলেন।
'দ্যাখো!'
এ কী! এ যে খেলনায় ভর্তি! রেলগাড়ি, বন্দুক, রাক্ষসের মুখোশ, বিল্ডিং ব্লক্স, মেকানো, লুডো, লটো, করতাল-বাজানো সং, খেলার ড্রাম, খেলার গ্রামোফোন, তা ছাড়া আরও কত খেলা যেসব সুবু কোনওদিন চোখেই দেখেনি-নাম শোনা তো দূরের কথা।
'এগুলো কার?' সুবু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল। ব্রজবুড়ো দু'হাত মাথার উপর তুলে তুড়ি বাজিয়ে দুলিয়ে গান করছিলেন-'আমি রামখেল তিলক সিং, তাই নাচি তিড়িং তিড়িং'-এবার গান বন্ধ করে নিজের বুকে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন-'আমার!'
সুবু বুঝল এই খেলার বন্দুকের আওয়াজ শুনেই পাশের বাড়ির লোক ভেবেছে পিস্তল, ওই মুখোশ
পরে বুড়ো জানলায় দাঁড়াতেই ভেবেছে রাক্ষস, আর এই সব খেলনার নানারকম আওয়াজ শুনেই
ভেবেছে বুড়ো তুকতাক করছে।
সুবু বলল, 'বাবা আর ডাক্তারবাবুকে ডাকি?' 'ওরা যদি আমার খেলনা নিয়ে নেয়?' বুড়ো কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল। 'মোটেই নেবে না। ওরা খুব ভাল লোক। আপনার কোনও অনিষ্ট করবে না।' 'তবে ডাকো।'
দু'জনে এলেন। ট্রাঙ্কের ডালা এখনও খোলা।
অমিতাভ ব্যানার্জি ভিতরের জিনিসগুলো দেখে চাপা গলায় বললেন, 'সব ব্রিটিশ আমলের বিলিতি খেলনা। ওঁর নিজের ছেলেবেলার জিনিস। এর জুড়ি আজকাল আর এদেশে পাওয়া যাবে না।' তারপর ব্রজবুড়োর দিকে চেয়ে বললেন, 'আপনি বসুন জ্যাঠা, বসুন। আমরা আপনার ভাল করতেই এসেছি।'
'যে ভাল রয়েছে, তাকে আবার ভাল করবে কী?' কড়া সুরে জিজ্ঞেস করলেন ব্রজ বুড়ো। 'ঠিক বলেছেন,' বললেন ডাঃ ব্যানার্জি। 'আমি ভুল বলেছিলাম। আপনার কোনও চিন্তা নেই। আমি কালকেই ঢলে যাব।' 'যাবে বইকী, নিশ্চয়ই যাবে।'
অমিতাভ ব্যানার্জির সঙ্গে সুবু আর শঙ্করবাবু নীচে নেমে এলেন। 'এও একরকম মনের ব্যারাম, জানেন তো?' বললেন ডাঃ ব্যানার্জি। 'শরীরে বার্ধক্যের পুরো ছাপ, কিন্তু মন সেই বালক অবস্থার পরে আর বাড়েনি। বড়দের তাই সহ্য করতে পারেন না; নিজের বয়সের সাথী খোঁজেন। অথচ কোনও ছেলে ওঁর কাছে যাবে না। কী করুণ অবস্থা ভেবে দেখুন তো।'
'আপনি সত্যিই কাল চলে যাবেন?' শঙ্করবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
'হ্যাঁ। আমি গেলে উনি ভাল থাকবেন। তা ছাড়া এই ব্যারামের চিকিৎসা বলে তো কিছু নেই।'
শঙ্করবাবু ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, 'তুই মাঝে মাঝে ব্রজবুড়োকে সঙ্গ দিস। তোর বন্ধুদেরও বলিস।'
সুবুরা অমিতাভবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করল। দোতলার ঘর থেকে তখন করতালের সঙ্গে সঙ্গে শোনা যাচ্ছে-
'বাদুড় বলে ওরে ও ভাই শজারু আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু- আজকে রাতে চামচিকে আর প্যাঁচারা...'