☆☆☆
নাসিরুদ্দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, পাশে ফুলে ফলে ভরা বাগিচা দেখে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। প্রকৃতির শোভাও উপভোগ করা হবে, শর্টকাটও হবে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই নাসিরুদ্দিন এক গর্তের মধ্যে পড়ল, আর পড়তেই তার মনে এক চিন্তার উদয় হল।
'ভাগ্যে পথ ছেড়ে বনে ঢুকেছিলাম,' ভাবলে নাসিরুদ্দিন। 'এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেই যদি এমন বিপদ লুকিয়ে থাকে, তা হলে না-জানি ধুলো-কাদায় ভরা রাস্তায় কত নাজেহাল হতে হত।'
মোল্লাগিন্নি একটা শব্দ পেয়ে ছুটে গেছে তার স্বামীর ঘরে। 'কী হল? কীসের শব্দ?' 'আমার জোব্বাটা মাটিতে পড়ে গেস্ল', বললে মোল্লাসাহেব। 'তাতেই এত শব্দ?' 'আমি ছিলাম জোব্বার ভেতর।'
নাসিরুদ্দিন একদিন রাজসভায় হাজির হল মাথায় এক বিশাল বাহারের পাগড়ি নিয়ে। তার মতলব সে রাজাকে পাগড়িটা বিক্রি করবে।
'তোমার ওই আশ্চর্য পাগড়িটা কত মূল্যে খরিদ করলে মোল্লাসাহেব?' রাজা প্রশ্ন করলেন। 'সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, শাহেন শা!' এক উজির মোল্লার মতলব আঁচ করে রাজার কানে ফিসফিস করে বললে, 'মূর্খ না হলে কেউ ওই পাগড়ির জন্য অত দাম দিতে পারে না, জাঁহাপনা।'
রাজা মোল্লাকে বললেন, 'অত দাম কেন? একটা পাগড়ির জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা যে অবিশ্বাস্য।' 'মূল্যের কারণ আর কিছুই না, জাঁহাপনা', বললে নাসিরুদ্দিন, 'আমি জানি দুনিয়ায় কেবল একজন
বাদশাই আছেন যিনি এই পাগড়ি খরিদ করতে পারেন।' তোষামোদে খুশি হয়ে রাজা তৎক্ষণাৎ মোল্লাকে দু'হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবার ব্যবস্থা করে নিজে
পাগড়িটা কিনে নিলেন।
মোল্লা পরে সেই উজিরকে বললে, 'আপনি পাগড়ির মূল্য জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি রাজাদের দুর্বলতা কোথায়।'
বোগদাদের খালিফের প্রাসাদে ভোজ হবে, তিন হাজার হোমরা-চোমরার নেমন্তন্ন হয়েছে। ঘটনাচক্রে
নাসিরুদ্দিনও সেই দলে পড়ে গেছে।
☆☆
☆☆
☆☆
খালিফের বাড়িতে ভোজ, চাট্টিখানি কথা নয়! অতিথি সৎকারে খালিফের জুড়ি দুনিয়ায় নেই। তেমনি তাঁর বাবুর্চিটিও একটি প্রবাদপুরুষ। তার রান্নার যেমনি স্বাদ, তেমনি গন্ধ, তেমনি চেহারা। সব খাদ্যের শেষে বিরাট পাত্রে এল একেকটি আস্ত ময়ূর। দেখে মনে হবে ময়ূর বুঝি জ্যান্ত, যদিও আসলে সেগুলো রোস্ট করা। ডানা, ঠোঁট, পুচ্ছ সবই আছে, আর সবকিছুই তৈরি রঙবেরঙের উপাদেয়
খাদ্যদ্রব্য দিয়ে। নিমন্ত্রিতেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছে রন্ধনশিল্পের এই অপূব নিদর্শনের দিকে, কেউই যেন আর খাবার কথা ভাবছে না।
নাসিরুদ্দিনের খিদে এখনও মেটেনি। সে কিছুক্ষণ ব্যাপার-স্যাপার দেখে আর থাকতে না পেরে
বলে উঠল, 'এই বিচিত্র প্রাণীটি আমাদের ভক্ষণ করার আগে আমাদেরই এটিকে ভক্ষণ করা বুদ্ধিমানের
কাজ হবে না কি?'
নাসিরুদ্দিন একটি সরাইখানার তত্ত্বাবধায়কের কাজে বহাল হয়েছে। একদিন সেখানে স্বয়ং সম্রাট সদলবলে এসে বললেন, তিনি ডিমভাজা খাবেন।
খাওয়া শেষ করে শাহেন শা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, 'এবার শিকারে যাব। বলো কত দিতে হবে তোমাদের?'
'জাঁহাপনা', বললে নাসিরুদ্দিন, 'ডিমভাজার জন্য লাগবে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা।' সম্রাটের চোখ কপালে উঠল। 'ডিম কি এখানে এতই দুষ্প্রাপ্য?' তিনি প্রশ্ন করলেন।
'আজ্ঞে না জাঁহাপনা', বললে নাসিরুদ্দিন। 'ডিম দুষ্প্রাপ্য নয়। দুষ্প্রাপ্য সম্রাটের মতো খদ্দের।'
সন্দেশ, আষাঢ় ১৩৮৯
'মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প' গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ভূমিকা-
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের নামে অনেক গল্প প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানান দেশে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের মতে এইসব গল্পের জন্ম তুরস্কদেশে, কারণ সেখানে এখনো প্রতি বছর মোল্লা নাসিরুদ্দিনের জন্মোৎসব পালন করা হয়।
মোল্লা নাসিরুদ্দিন যে ঠিক কেমন লোক ছিলেন সেটা তার গল্প পড়ে বোঝা মুশকিল। এক এক সময় তাকে মনে হয় বোকা, আবার এক এক সময় মনে হয় ভারী বিজ্ঞ। তোমাদের কী মনে হয় সেটা তোমরাই বুঝে নিও।