রাজামশাই একদিন নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, 'বনে গিয়ে ভাল্লুক মেরে আনো।' নাসিরুদ্দিন রাজার আদেশ অমান্য করে কী করে? অগত্যা তাকে যেতেই হল। বন থেকে ফেরার পর একজন তাকে জিজ্ঞেস করলে, 'কেমন হল শিকার, মোল্লাসাহেব?' 'চমৎকার', বললে নাসিরুদ্দিন।
'ক'টা ভাল্লুক মারলেন?'
'একটিও না।'
'বটে? ক'টাকে ধাওয়া করলেন?'
'একটিও না।'
'সে কী। ক'টা দেখলেন?' 'তা হলে চমৎকারটা হল কী করে?'
'একটিও না।'
'ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে সে জানোয়ারের দেখা না পাওয়ার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে
পারে?
এক পড়শি এসেছে নাসিরুদ্দিনের কাছে এক আর্জি নিয়ে। 'মোল্লাসাহেব, আপনার গাধাটা যদি কিছুদিনের জন্য ধার দেন তো বড় উপকার হয়।' 'মাফ করবেন', বললে নাসিরুদ্দিন, 'ওটা আরেকজনকে ধার দিয়েছি।' কথাটা বলামাত্র বাড়ির পিছন থেকে গাধা ডেকে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে দিল। 'সে কী মোল্লাসাহেব, ওটা আপনারই গাধার ডাক শুনলাম না?'
নাসিরুদ্দিন মহারাগে লোকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সময় বললে, 'আমার কথার চেয়ে আমার গাধার ডাককে যে বেশি বিশ্বাস করে, তাকে কোনওমতেই গাধা ধার দেওয়া চলে না।'
এক বেকুবের শখ হয়েছে সে পণ্ডিত হবে। সে মনে মনে ভাবলে মোল্লার তো নামডাক আছে পণ্ডিত
হিসেবে, তার কাছেই যাওয়া যাক, যদি কিছু শেখা যায়। অনেকখানি পথ পাহাড় ভেঙে উঠে সে খুঁজে পেলে নাসিরুদ্দিনের বাসস্থান। ঢোকবার আগে জানলা
দিয়ে দেখলে মোল্লাসাহেব ঘরের এককোণে ধুনুচির সামনে বসে নিজের দু' হাতের তেলো মুখের সামনে ধরে তাতে ফুঁ দিচ্ছে।
ঘরে ঢুকে বেকুব প্রথমেই হাতে ফুঁ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে। 'ফুঁ দিয়ে হাত গরম করছিলাম',
বলে নাসিরুদ্দিন চুপ করলে। বেকুব ভাবলে, একটা জিনিস তো জানা গেল। আর কিছু জানা যাবে কি? কিছুক্ষণ পরে নাসিরুদ্দিনের গিন্নি দু'বাটি গরম দুধ এনে কর্তা আর অতিথির সামনে রাখলেন।
নাসিরুদ্দিন তক্ষুনি দুধে ফুঁ দিতে শুরু করলে।
এবার বেকুব সম্ভ্রমের সঙ্গে শুধোলে, 'হে গুরু, এবারে ফুঁ দেবার কারণটা কী?' 'দুধ ঠাণ্ডা করা', বললে নাসিরুদ্দিন।
বেকুব বিদায় নিলেন। যে লোক বলে ফুঁ দিয়ে জিনিস গরম হয়, আবার ঠাণ্ডাও হয়, তার কাছ থেকে জ্ঞানলাভের কোনও আশা আছে কি?
মোল্লা এখন কাজি, সে আদালতে বসে। একদিন এক বুড়ি তার কাছে এসে বললে, 'আমি বড়ই গরিব। আমার ছেলেকে নিয়ে বড় ফ্যাসাদে পড়েছি কাজিসাহেব। সে মুঠো মুঠো চিনি খায়, তাকে আর চিনি জুগিয়ে কূল পাচ্ছি না। আপনি হুকুম দিয়ে তার চিনি খাওয়া বন্ধ করুন। সে আমার কথা শোনে না।'
মোল্লা একটু ভেবে বললে, 'ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এক হপ্তা পরে এসো, আমি একটু বিবেচনা করে তারপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।'
বুড়ি হুকুমমতো এক হপ্তা পরে আবার এসে হাজির! মোল্লা তাকে দেখে মাথা নাড়লে।-'এ বড় জটিল মামলা। আরও এক হপ্তা সময় দিতে হবে আমাকে।'
আরও সাতদিন পরেও সেই একই কথা। অবশেষে ঠিক এক মাস পরে মোল্লা বুড়িকে বললে, 'কই, ডাকো তোমার ছেলেকে।' ছেলেটি আসতেই মোল্লা তাকে হুঙ্কার দিয়ে বললে, 'দিনে আধ ছটাকের বেশি চিনি খাওয়া চলবে
না। যাও।' বুড়ি মোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললে, 'একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, কাজিসাহেব।'
'বলো।'
'এই নিয়ে চারবার ডাকলেন কেন আমাকে? এর অনেক আগেই তো আপনি এ হুকুম দিতে
পারতেন।'
'তোমার ছেলেকে হুকুম দেবার আগে আমার নিজের চিনি খাওয়ার অভ্যেস কমাতে হবে তো!' বললে নাসিরুদ্দিন।
রাস্তার কয়েকটি ছোকরা ফন্দি করেছে তারা মোল্লাসাহেবের জুতোজোড়া হাত করবে। একটা লম্বা গাছের দিকে দেখিয়ে তারা মোল্লাসাহেবকে বললে, 'ওই যে গাছ দেখছেন, ওটায় চড়ার সাধ্যি কারুর নেই।'
'আমার আছে', বলে মোল্লাসাহেব জুতোজোড়া পা থেকে না খুলেই গাছটায় চড়তে শুরু করলেন। বেগতিক দেখে ছেলেরা চেঁচিয়ে বলল, 'ও মোল্লাসাহেব, ওই গাছে আপনার জুতো কোনও কাজে লাগবে কি?'
মোল্লাসাহেব গাছের উপর থেকে জবাব দিলেন, 'গাছের মাথায় যে রাস্তা নেই তা কে বলতে পারে?'
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে এক নিলামদারের হাতে তার গাধাটিকে তুলে দিলে। সেটাকে দিয়ে আর
কাজ চলে না, তাই একটা নতুন গাধা কেনা দরকার। আর পাঁচরকম জিনিস পাচার হয়ে যাবার পর গাধা যখন নিলামে উঠল, নাসিরুদ্দিন তখন কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে। নিলামদার হাঁক দিলে, 'এবার দেখুন এই অসামান্য, অতুলনীয় গাধা। পাঁচ
স্বর্ণমুদ্রা কে দেবেন এর জন্য? মাত্র পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা!'
এক চাষা হাত তুললে। দর এত কম দেখে মোল্লাসাহেব নিজেই হেঁকে বসলেন, 'ছয় স্বর্ণমুদ্রা।'
ওদিকে অন্য লোকেও ডাকতে শুরু করেছে, আর নিলামদারও গাধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দর যত
বাড়ে ততই বাড়ে গুণের ফিরিস্তি।
চাষা ও মোল্লাসাহেবের মধ্যে ডাকাডাকিতে গাধার দাম চড়ে চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রায় পৌঁছে শেষটায় মোল্লাসাহেবেরই জিত হল। গাধার আসল দাম ছিল বিশ স্বর্ণমুদ্রা, অর্থাৎ লোকসান হল দ্বিগুণ। কিন্তু তাতে কী এসে গেল? 'যে গাধার এত গুণ', বললে মোল্লাসাহেব, 'তার জন্য চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রা তো জলের দর।'
নাসিরুদ্দিন মওকা বুঝে একজনের সবজির বাগানে গিয়ে হাতের সামনে যা পায় থলেতে ভরতে শুরু করেছে। এদিকে মালিক এসে পড়েছেন। কাণ্ড দেখে তিনি হস্তদন্ত নাসিরুদ্দিনের দিকে ছুটে এসে বললেন,
'ব্যাপারটা কী?' নাসিরুদ্দিন বললে, 'ঝড়ে উড়িয়ে এনে ফেলেছে আমায় এখানে।'
'আর খেতের সবজিগুলোকে উপড়ে ফেলল কে?'
'ওড়ার পথে ওগুলিকে খামচে ধরে তবে তো রক্ষা পেলাম।' 'আর সবজিগুলো থলের মধ্যে গেল কী করে?'
'সেই প্রশ্নই তো আমাকেও চিন্তায় ফেলেছিল, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।'
মোল্লাগিন্নি মাঝরাত্তিরে নাসিরুদ্দিনের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, 'ব্যাপার কী? চশমা পরে ঘুমোচ্ছ কেন?' মোল্লা নতুন চশমা নিয়েছে। খাল্লা হয়ে বললে, 'চোখে চালশে পড়েছে, চশমা ছাড়া স্বপ্ন দেখব কী করে?'
থলেতে একঝুড়ি ডিম লুকিয়ে নিয়ে নাসিরুদ্দিন চলেছে ভিনদেশে। সীমানায় পৌঁছতে শুল্ক বিভাগের লোক তাকে ধরলে। নাসিরুদ্দিন জানে ডিম চালান নিষিদ্ধ। 'মিথ্যে বললে মৃত্যুদণ্ড' বললে শুল্ক বিভাগের লোক। 'তোমার থলেতে কী আছে বলো।'
'প্রথম অবস্থার কিছু মুরগি', বললে মোল্লাসাহেব।
'হুম-সমস্যার কথা। মুরগি চালান নিষিদ্ধ কিনা খোঁজ নিতে হবে, তারপর ব্যাপারটার মীমাংসা হবে। ততদিন এ থলি রইল আমাদের জিম্মায়। ভয় নেই, তোমার মুরগিকে উপোস রাখব না আমরা।' 'কিন্তু আমার মুরগির জাত যে একটু আলাদা', বললে নাসিরুদ্দিন।
'কীরকম।' 'আপনারা তো শুনেছেন অবহেলার দরুন মুরগির অকাল বার্ধক্য আসে।'
'তা শুনেছি বটে!'
'আমার মুরগিকে ফেলে রাখলে সেগুলো অকালে শিশু হয়ে যায়!'
'শিশু মানে?' 'একেবারে শিশু', বললে নাসিরুদ্দিন, 'যাকে বলে ডিম।'
মোল্লা মসজিদে গিয়ে বসেছে, তার জোব্বাটা কিঞ্চিৎ খাটো দেখে তার পিছনের লোক সেটাকে টেনে খানিকটা নামিয়ে দিলে। মোল্লা তৎক্ষণাৎ তার সামনের লোকের জোব্বাটা ধরে নীচের দিকে দিলে এক টান। তাতে লোকটি পিছন ফিরে চোখ রাঙিয়ে বললে, 'এটা কী হচ্ছে?' মোল্লা বললে, 'এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আমার পিছনের লোক।'
কারও মৃত্যু হলে শোক জানানোর জন্য কালো পোশাক পরে মোল্লার দেশের লোকেরা। মোল্লাকে সেই পোশাকে হাঁটতে দেখে একজন জিজ্ঞেস করলে, 'কেউ মরল নাকি, মোল্লাসাহেব?' 'সাবধানের মার নেই', বললে মোল্লাসাহেব, 'কোথায় কখন কে মরছে তা কি কেউ বলতে পারে?'
নাসিরুদ্দিন রাজাকে একটা সুখবর দেবে, তাই অনেক কসরৎ করে রাজসভায় গিয়ে হাজির হয়েছে। রাজা খবর শুনে খুশি হয়ে বললেন, 'কী বকশিশ চাও বলো।'
'পঞ্চাশ ঘা চাবুক', বললে নাসিরুদ্দিন। রাজা অবাক! তবে নাসিরুদ্দিন যে মশকরা করছে না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। হুকুম হল পঞ্চাশ ঘা চাবুকের।
পঁচিশ ঘায়ের পর নাসিরুদ্দিন বললে, 'থামো!'
চাবুক থামল। 'বাকি পঁচিশ ঘা পাবে আমার অংশীদার', বললে নাসিরুদ্দিন। 'রাজপেয়াদা আমার সঙ্গে কড়ার করেছিল সুখবর পেয়ে রাজা বকশিশ দিলে তার অর্ধেক তাকে দিতে হবে।'