shabd-logo

তারপর?

23 December 2023

3 Viewed 3

কাণকালি গাঁয়ের খালে একবার একটা কুমির এসেছিল। মানুষখেকো মস্ত কুমির। পরপর তিনটি বউকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল গাঁয়ের। একজন মাঝবয়সি, দুজন তরুণী। একজন রোগা ন্যাংলা, একজন বেশ মোটাসোটা, আরেকজন ছিপছিপে দোহারা গোছের লম্বাটে। মোটা বউটি কুমিরের পেটে গিয়েছিল একাই। অন্য বউ দুটির একজনের গর্ভ ছিল সাত আট মাস, অন্যজনের কাঁথে ছিল ছোটো একটি শিশু। তার পেটেও একটা কিছু ছিল কয়েক মাসের। তাকে যখন কুমির ধরল, বাচ্চাটাকে বাঁচাবার জন্য তাকে সে যত জোরে যত দূরে পারে ছুঁড়ে দিয়েছিল। মায়ের প্রাণ তো। কাস্তি দাসের বিধবা বোন সনকা বাচ্চাকে তুলে আনে।

সেই শিশুর বয়স এখন পনেরো বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। টেরা বাঁকা আধ শুকনো বাঁ হাতটা একেবারেই অকেজো, আঙুলগুলি শক্ত হয়ে গেছে, বাঁকে না। ডান হাতে বেশ জোর আছে, বিশেষ কর্মতৎপর নয় বটে, কারণ কোনো কাজেই পটুতা অর্জন করার ধৈর্য তার নেই, কিন্তু হাতটি যেন সব সময়েই কাজের জন্য অস্থির ও চঞ্চল হয়ে থাকে, অথবা অকাজের জন্য। তার বাবা গিরিশ আবার বিয়ে করেছিল এগারো মাসের মধ্যেই, কিন্তু প্রথম পক্ষের একমাত্র খুঁতে ছেলেটাকে মানুষ করার চেষ্টার জুটি সে করেনি-স্কুলে পর্যন্ত দিয়েছে। স্কুলে গজেন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত উঠেছিল। ফেল করে করেই সে ক্লাসে উঠেছিল বরাবর কিন্তু একবার, ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠেছিল ফার্স্ট হয়ে। চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল এই চমকপ্রদ ঘটনায়। কিন্তু শুধু ওই একবার। তার আগে বা পরে আর কখনও সে পরীক্ষায় পাশ করেনি একমাত্র ড্রয়িং-এর পরীক্ষা ছাড়া। ড্রয়িং-এ হাতটা ছিল পাকা। এক হাতে এত সহজে এত ভালো ড্রয়িং সে করতে পারত যে অন্য ছেলেরা হাঁ করে চেয়ে থাকত। ড্রয়িং মাস্টারের চেয়ে তার আঁকা পাখি ও গাছ জীবস্ত হত বেশি। তবে ছেলেবেলাতেই কেমন বখাটে হয়ে গেল ছেলেটা। ক্লাস সেভেনে একবার ফেল করার পর আর তাকে পড়ানোই গেল না। পরপর কয়েকটি কেলেঙ্কারির পর গিরিশ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাড়িয়ে দেবার পরেও সে অবশ্য গিরিশের বাড়িতেই থাকে। তাড়ানো ছেলের মতো থাকে।

এই বয়সেই দড়ির মতো পাকিয়ে দেহের মাংসপেশিগুলি তার শক্ত হয়ে গেছে, রোগা শরীরটাতে শক্তি আর সহিষ্ণুতা আশ্চর্যরকম। মুখে স্থায়ী চাপ পড়েছে একটা শ্রান্ত সকরুণ জিজ্ঞাসার, ভাঙা বাঁকা নাকটা যেন জিজ্ঞাসার ভারেই নুয়ে গেছে। আর কী ভীরু তার দুটি চোখ! সবাই যেন যখন তখন তাকে মারে, আপন পর ছোটো বড়ো দেবতা মানুষ নারী পুরুষ যে যেখানে আছে। নিরুপায় সহনশীলতায় সে যেন চুপচাপ সয়ে যায়। অসহ্য হলে অন্তরালে কাঁদে।

মাঝে মাঝে দু চার দিনের জন্য সে গাঁ ছেড়ে উধাও হয়ে যেত। এবার প্রায় ছ মাস কোথায় গিয়ে কাটিয়ে এল কেউ জানে না। সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছে যে আরও অনেকের মতো সেও দুর্ভিক্ষের কবলে গেছে চিরদিনের মতো তখন সে একদিন ফিরে এল। সাজপোশাকের তার উন্নতি দেখা গেল অদ্ভুত রকমেব-সিল্কের পাঞ্জাবি, ফাইন ধুতি, চকচকে বার্নিশ করা জুতো। গাঁয়ে থাকবার তার ঝোঁক দেখা গেল না, যদিও গিরিশ আর বাড়ির লোকের কাছে খাতিরের এবার আর সীমা রইল না তার। দু একদিন থাকে, ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে আলাপ জমায়, বড়োই তাকে মিশুক বলে মনে হয় এবার। ক্ষণে ক্ষণে পাঞ্জাবির পকেট থেকে উদ্ভট চেহারার একটা কেস বার করে তা থেকে খাঁটি মার্কিন মিলিটারি সিগারেট নিয়ে টানে-আগে সে তামাক আর বিড়ি খেত, মাঝে মাঝে পয়সায় দুটোওলা সিগারেট। লালু আর মবুবকেও সিগারেট দেয়। ওদের সঙ্গে এবার তার বড়ো ভাব হয়েছে। লালুর বয়স এগারো বছর, মবুবের বারো। সমবয়সি বয়স্ক লোকের মতোই তারা তাদের মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাবসার কথা বলে, অশ্লীল হাসিতামাশাগুলি পর্যন্ত তাদের হয় বয়স্কদের মাতো।

গজেন বাল, মদনের বোনটা পিছায় কেন রে?

লালু বলে, ডরায়। লালমুখো গোরাদের যদি ধরিয়ে দি?

লালমুখো গোরা কীসের? গজেন বলে বেজার হয়ে। মোদের বিবিসাব কী কয়? মেহের বিবিসাব ?

মবুব বলে, কয় কি, তোরা পোলাপান, তোদের কথায় গিয়ে মরব? পোলাপান ঠাউরেছে, না? একটা কুৎসিত ইঙ্গিতে তারা যে পাকাপোক্ত পুরুষের চেয়ে বেশি কিছু সেটা প্রমাণ করে তিনজনে হাসে। মানুষ বুড়ো হয়ে মরে গিয়ে যত বুড়ো হয় গজেন তার চেয়ে পাকা। হাসাহাসির পর সে বলে, তা কথা বেঠিক না। মাগি ছাড়া মাগিরা ভরসা পায় না।

চপলার জন্যে এ মুশকিল।

চপলার খারাপ রোগ হয়েছে, সর্বাঙ্গে ক্ষত। দামি কাপড় পরে হাসিমুখে সে আর গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে কটিবাজারে কাজ করতে যাবার জন্য মেয়েদের ভবসা দিতে পারে না।

কথাটা ভাববার মতো। ভাবতে ভাবতে গজেন বাড়ি যায়। বাড়ি পৌঁছেই ভাত বাড়বার হুকুম দেয়, এখুনি তাকে কটিবাজার রওনা হতে হবে। রোজগেরে ছেলেকে বাড়ির মেয়েরাই সাগ্রহে ভাত বেড়ে দিত কিন্তু তারা কেউ নড়বার চড়বার আগেই ওবাড়ির হাবো যেন উড়তে উড়তে পিঁড়ি পেতে তার ভাত বেড়ে এনে দেয়। গজেনের নতুন মা, মাসি আর পিসিরা অসন্তুষ্ট হয়ে আড়চোখে তাকায়। ছুঁড়ি যে গজেনেরই দেওয়া নতুন রঙিন শাড়ি পরে এ বাড়িতে এসে ফরফর করে উড়ছে, এতে তাদের চোখ জ্বালা করে আরও বেশি।

ফিরবে কবে? সভয় ভক্তিতে হাবে! জিজ্ঞেস করে। গলা তার প্রায় বৃজে আসে আবেগে।

পরশু তরশু ফিরব।

হাবোকে মন্দ দেখাচ্ছে না রঙিন কাপড়ে, গজনে ভাবে। একটু আশ্চর্য হয়েই সে মেয়েটার সারা গায়ে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয়-মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে এদিক ওদিক আর তার একান্ত অনুগত এই যে একটা মেয়ে আছে এর কথা তার খেয়ালও হয়নি একবার। একটু হাবাগোবা মেয়েটা, চোখ একটু ট্যারা, হাড়গিলের মতো রোগা শরীর। কিন্তু বয়েস তো কম! তাছাড়া, এ রকম হাবা গোছের মেয়েই ভালো, সহজে বাগানো যায়, ভয় দেখিয়ে সহজে কাবু করা চলে।

হাবো, সঙ্গে যাবি? কাজ করে খাবি? কাপড় গয়না পাবি।

যাব!

হাবোর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।

চিরদিন এই মেয়েটা কেন যে তার এত অনুগত গজেন জানে না-পৃথিবীতে এই একজন! কোনোদিন ভাবেও না। হাবো তার কাছে অতি সস্তা, তাকে অন্ধ আবেগের সঙ্গে ভক্তি করে বলে। তার পঙ্গু, বিকারগ্রস্ত জীবনেরই একটা অঙ্গ হিসাবে মেয়েটা তার জীবনে মিশে ছিল বরাবর। আছে তো আছে, এইভাবে। তার নতুন ব্যবসায়ের কাঁচা মাল হিসাবে আজ মনে মনে ওকে যাচাই করতে গিয়ে মেয়েটার সম্বন্ধে বিশেষভাবে সচেতন হয়ে উঠে তার এলোমেলো ভাবনা জাগে। কেমন আঁকুপাঁকু করে মনটা নানা বিরুদ্ধ চিন্তায়। বিধবা ভাগ্নি রাসিকে হারাধনের আস্তানায় পৌঁছে দিতে পারলে কী রকম হয়। রাসি খুব রূপসি, ওকে দেখলে কথাটা সে না ভেবে থাকতে পারে না। ভাবতে গেলে আবার কেমন জ্বালাপোড়া আর অস্থির ভাব শুরু হয়। সে কি আর সত্যি নিজের ভাগ্নিকে হারাধনের কবলে দিয়ে আসবে। কিন্তু তবু ভাগ্নিটার জন্য সে জ্বালাতন হয়ে উঠেছে। ওকে দেখলেই মন তার দাম কষা শুরু করে। হাবো তার সঙ্গেই বার হয়। অনেকক্ষণ হাঁ করে থাকায় লালা গড়িয়ে পড়েছিল, সসপ করে একবার লালা টেনে সে মুখটা বন্ধ করে দেয়। কয়েকটা বাড়ি পরেই হাবোর বাবা দয়ালের খড়ের ঘর। গজেনের সঙ্গে মেয়েকে আসতে দেখে দয়াল ভুকুটি করে তাকায়, কিন্তু গজেন কাছাকাছি এলে তার মুখখানা বেশ অমায়িক মনে হয়।

তেল এক টিন দিলি না বাবা?

দেব দেব। পরশু কি তরশু নিয়ে আসব সঙ্গে।

কোটের বাঁ হাতটা ঝুলছিল লড়বড় করে, ডগাটা পকেটে গুঁজে সে খাল ধারে এগিয়ে যায়। মিলিটারি, সরকারি, আধা-সরকারি আর লাইসেনি নৌকা চলছিল খাল দিয়ে। একটা নৌকাকে সে হাঁক দেয়, জানায় তার পাশ আছে। নৌকা ধারে এসে তাকে তুলে নেয়।

কটিবাজারে সমারোহ ব্যাপার। চারিদিকে অস্থায়ী চালাঘরের অরণ্য, মাছির মতো মানুষের ভিড়, নতুন রাস্তা কাঁপিয়ে হরদম লরিব আনাগোনা। ফাঁকায় পাহাড় সমান স্তূপাকার চালের পচা গন্ধে চারিদিক মশগুল।

হারাধনকে গজেন ক্ষেন্তির ঘরে খুঁজে বার করে। হারাধন লোকটা বেঁটে ও বলিষ্ঠ, ঘাড়ে- গর্দানে এক করা, বয়স প্রায় পঞ্চাশ, মাথার চুলে পাক ধরেছে। এই অবেলায় মদ গেয়ে চোখ লাল করে

ফেলেছে।

মাগি চাই একটা।

গজেন তাকে খবরাখবর দেবার পর হারাধন বলে এক ঢোঁক মদ গিলে। ছোটো ছেলে দিয়ে একদিকে যেমন সুবিধা আছে, অন্যদিকে তেমনি অসুবিধাও অনেক। ছোটো ছেলে যে কোনো বাড়ি গিয়ে যে কোনো মেয়ের সঙ্গো কথা কইতে পারে, কেউ কিছু সন্দেহ করে না। মেয়েলোক কেউ আনাগোনা করলে বরং খটকা লাগতে পারে লোকের মনে কিন্তু এগারো বছবের ছেলে যে মেয়ে ভজানোর কাজে লেগেছে লোকের এ ধারণা সহজে হয় না। কিন্তু অতটুকু ছেলেব কথাতে আবাব ভরসা করতে মেয়েরা সাহস পায় না, এই মুশকিল। খাঁটি গেরস্ত ঘরের দু তিনটি মেয়ে প্রায় তৈরি আছে, চপলার মতো চালাকচতুর হাসিখুশি নাদুসনুদুস একজন মাগির এখন একবার গাঁয়ে ঘুরে আসা দরকার। শাড়ি গয়না পরে গিয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ দেখিয়ে আসবে ওদের যে ওদের জন্যও কেমন পেটভরা খাওয়া, ভালো ভালো কাপড় আর দামি দামি শাড়ি গয়না রয়েছে তৈরি হয়ে, কটিবাজারে এসে খেটে উপার্জন করে নিলেই হয়।

বেশি গয়না না কিন্তু।

গজেন তা জানে। বেশি গয়না দেখলে খটকা লাগে মনুষের মনে। গবিব মানুষের মনে। না, বেশি গয়না না।

দু দিন পরে ফুল, একটিন কেরোসিন এবং আরও নানারকম জিনিসপত্র নিয়ে গজেন নৌকায় কাণকালি আসে। ফুল দেখতে বিশেষ সুন্দরী নয় কিন্তু তার চেহারায় একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য আছে ঘরোয়া ভাবের। মা শিশুকে আদর করতে করতে একেবারে গদগদ হয়ে পড়লে তখন তার যে রকম মুখের ভঙ্গি হয় তারই স্থায়ী ছাঁচে ঢেলে যেন মুখখানা গড়া হয়েছে ফুলের। তার কথা মিষ্টি, হাসি মোলায়েম। তবু তাকে যারা চেনে তারা তাকে ভয় করে। এই শান্ত নম্র গেরস্ত বউটির মতো চেহারার ভিতরে যে বুদ্ধি আছে তার ধারে অনেকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।

কাণকালি পৌঁছে একটা দুঃসংবাদ শোনা যায়। কোনো এক নারীসংঘ থেকে দু জন মহিলা কর্মী গাঁয়ে এসেছে আগের দিন সকালে। বৈরাগী দাসের সেই বউটাকে তারা সঙ্গে এনেছে কটিবাজারের বাজার থেকে সংগ্রহ করে, ওদের কথায় জীর্ণ শীর্ণ জ্বরগ্রস্ত বউটাকে বৈরাগী ক্ষমা করেছে, গ্রহণ করেছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়ে দু জন সকলাকে সাবধান করে দিচ্ছে লোকের কথায় ভুলে মেয়েরা যেন কোথাও না যায়। লোভে পড়ে গিয়ে দু দিনে মেয়েদের কী অবস্থা হয়, রোগে ব্যারামে শরীর একটু ভাঙলেই কী ভাবে পথে এসে দাঁড়াতে হয়, বাগে পেলে কী ভাবে দূরে দূরে চালান করে দেওয়া হয় সব কথা ফাঁস করে দিচ্ছে। বৈরাগী দাসের বউটাকে সামনে ধরছে প্রমাণ হিসাবে।

সঙ্গে দু জন বাবু আছে তাদের। লালু আর মবুবকে তারা কত উপদেশই যে দিয়েছে। স্কুলের ছেলে তারা, এই বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে খারাপ কাজে লাগা কি উচিত?-এমনি সব বড়ো বড়ো কত কথা।

সিগারেট চাইতে ছোকরা বাবুটা রেগে টং!

লালু আর মবুব খিলখিলিয়ে হাসে।

গজেন চিন্তিত হয় ফুলকে নৌকায় রেখে একাই নেমে যায়। অবস্থাটা ভালো করে না বুঝে মাগিটাকে সঙ্গে করে গাঁয়ের মধ্যে যেতে তার ভরসা হয় না। কেরোসিন তেলের টিনটা সে সঙ্গে নিয়ে দয়ালের বাড়ি পৌঁছে দেয়।

তখন শেষ দুপুর। বাকি বেলাটা সারা গাঁয়ে ঘুরে গজেন ভড়কে যায়, চটেও যায়। যারা তাকে দেখতে পারত না কোনোদিন তাদের কথা বাদ যাক, জিনিসপত্র দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে যে সব দুর্বল অসহায় মানুষের কাছে তার বেশ খাতির জমেছিল তারাও যেন অনেকে কেমন দূরে সরে গিয়েছে, তাকে ভালো করে আমল দিতে চায় না। ঘোষপাড়ায় ঢুকবার পথে পাড়ার পাঁচটা ছেলে তার পথ আটকাল, স্পষ্ট বলে দিল পাড়ায়ও ঢুকালে তার একটি মাত্র আস্ত হাতটা মুচড়ে ভেঙে দেবে। হাত কার ভাঙে আর কার আস্ত থাকে গড়েন তা দেখে নেবে, কিন্তু অবস্থা তো সুবিধাজনক নয়। মদন আমতা আমতা করে আবোল-তাবোল কী যেন বকল। তার বোনটা কথাই বলল না তাদেব সঙ্গে। মেহের দরজা খুলল না।

সন্ধ্যার সময় মন খারাপ করে গজেন নৌকায় ফিরে যায়। দু চোখে তার ঘনিয়ে আসে গভীর বিষাদ। নৌকার গলুইয়ে বসে জালের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে এক অজানা দুর্বোধ্য বেদনার রহস্যময় সঞ্চারে তার মন উদাস অবসন্ন হয়ে আসে। বিকৃত উত্তেজনার অবসান ঘটলেই চিরদিন তার এ রকম মন কেমন করে।

ফুল বলে, কী গো, ভাব লাগল?

ভাবছি। আজ নামা হয় না, নায়ে থাকব।

ও বাবা, ডর লাগবে।

আমি থাকব।

তাতে বুঝি ভর কম?

ফুলের পিপাসা পেয়েছিল। আজ আর নামতে হবে না স্থির হওয়ায় সে বোতল বার করে তৃষ্ণা মেটাবার আয়োজন কারে। গজেনকে ডেকে নেয় ছইয়ের মধ্যে। সেখানে কড়া মিলিটারি চোরাই মদ আর ফুলের সাহচর্যে রুমে ক্রমে গজেনের উত্তেজনা ফিরে আসায় কাব্যিক বিষাদ কেটে যায়।

আরও কিছু পরে বেশ মেতেই ওঠে তারা দু জনে।

দুইয়ের বাইরে হাবোকে প্রথম দেখতে পায় ফুল। গজেনকে একটু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে বলে, তুমি কে গো ?

গজেন মুখ ফিরিয়ে বলে, কাঁরে হাবো? কী করছিস হেথা? হাবো পা গুটিয়ে হাতে ভর দিয়ে বসে হাঁ করে দেখছিল। মুখ দিয়ে তার লালা গড়িয়ে গড়িয়ে নৌকার পাটাতনে জমেছে। সসপ্ করে লালা টেনে মুখ বন্ধ করে সে উঠে দাঁড়ায়, এক লাফে ডাঙায় পড়ে, ছুট দেয় গাঁয়ের দিকে।

দূরে থানার পেটা ঘড়িতে দশটা বাজবার খানিক পরে দয়ালের বাড়িতে 'আগুন। আগুন চিৎকার ওঠে। পাড়ার লোক হইহই করে ছুটে যায়। পুরো একটিন কেরোসিন গায়ে বিছানায় ঢেলে হাবো আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঘরে পর্যন্ত আগুন ধরে গেছে দয়ালের।

খবর শুনে বৈরাগী দাসের বউ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, এক টিন তেল: কুপি জ্বালার তেল মেলে না এক ফোঁটা, ছুঁড়ি এক টিন তেল ঢেলেছে।

অনেকেই আপশোশ করে।

16
Articles
আজ কাল পোরশুর
0.0
এটি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা একটি ছোটগল্প
1

আজ কাল পরশুর গল্প

19 December 2023
1
0
0

মানসুকিয়ার আকাশ বেয়ে সূর্য উঠেছে মাঝামাঝি। নিজের রাঁধা ভাত আর শোল মাছের ঝাল খেতে বসেছে রামপদ ভাঙা ঘরের দাওয়ায়। চালার খড় পুরোনো পচাটে আর দেয়াল শুধু মাটির। চালা আর দেয়াল তাই টিকে আছে, ছ মাসের সুযোগেও কে

2

দুঃশাসনীয়

20 December 2023
1
0
0

আগে, কিছুকাল আগে, বেশিদিনের কথা নয়, গভীর রাতেও হাতিপুর গ্রামে এলে লোকালয়ের বাস্তব অনুভূতিতে স্বস্তি মিলত। মানুষের দেখা না মিলুক, মাঠ, খেত, ডোবাপুকুর, ঝোপঝাড়, জলা অপরিসীম রহস্যে ভরাট হয়ে থাক, হুতোম প্য

3

নমুনা

21 December 2023
1
0
0

কেবল কেশবের নয়, এ রকম অবস্থা আরও অনেকের হয়েছে। অন্ন নেই কিন্তু অন্ন পাওয়ার একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে মেয়ের বিনিময়ে। কয়েক বস্তা অন্ন, মেয়েটির দেহের ওজনের দু-তিন গুণ। সেই সঙ্গে কিছু নগদ টাকাও, যা দিয়ে দানক

4

বুড়ি

22 December 2023
0
0
0

বুড়ির বড়ো পুতি আজ যাবে বিয়ে করতে। ছেলের ছেলে তার ছেলে, বড়ো সহজ কথা নয়। বুড়িকে বাদ দিয়েই বাড়িতে চলেছে আপনজনে-ভরাট বাড়ির ছেলে বিয়ে করতে গেলে যত কিছু কাণ্ডকারখানা হয়-রোজ সংসারের সাধারণ হইচইও যেন ওকে বাদ

5

গোপাল শাসমল

22 December 2023
0
0
0

সাতপাকিয়ার গগন শাসমলের ছেলে গোপাল গিয়েছিল জেলে। একদিন ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরল। জেলে যাওয়ার সময় তার বাড়িতে ছিল মন পঁচিশেক ধান, দুটো বলদ, একটা গোবু, পুঁইমাচা লাউ- মাচা আর তিনটে সজনে গাছ। বাড়ি ফিরে দেখল, ধান

6

মঙ্গলা

22 December 2023
1
0
0

শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মঙ্গলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডোবা থেকে উঠে আসে। পুলিশ হঠাৎ গাঁয়ে হানা দিয়েছিল মাঝরাতে। সেই থেকে এই সকাল পর্যন্ত সে ডোবার জলকাদায় আগাছার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে কাটিয়েছে। হাঙ্গামার পর

7

নেশা

23 December 2023
1
0
0

পুলকেশের সিনেমা দেখার নেশা একেবারে ছিল না। যতীনেরও তাই। সত্যিকারের কোনো ভালো ছবির খবর পেলে, রুচি, রসবোধ আর বিচারশক্তি আছে বলে তারা বিশ্বাস করে এমন কোনো বিশ্বাসী লোকের কাছে খবর পেলে হয়তো কখনও নিজেরা শখ

8

বেড়া

23 December 2023
1
0
0

বাড়ির ঠিক মাঝখানে উঁচু চাঁচের বেড়া। খুব লম্বা মানুষের মাথা ছাড়িয়েও হাতখানেক উঁচু হবে। বেড়া ডিঙিয়ে কারও নজর চলবে না, অবশ্য যদি উঁচু কিছুর উপর দাঁড়িয়ে নজর চালানো না হয়। নজর দেধার অন্য উপায় আছে ফুটোতে চো

9

তারপর?

23 December 2023
1
0
0

কাণকালি গাঁয়ের খালে একবার একটা কুমির এসেছিল। মানুষখেকো মস্ত কুমির। পরপর তিনটি বউকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল গাঁয়ের। একজন মাঝবয়সি, দুজন তরুণী। একজন রোগা ন্যাংলা, একজন বেশ মোটাসোটা, আরেকজন ছিপছিপে দোহারা গোছের

10

স্বার্থপর ও ভীরুর লড়াই

26 December 2023
1
0
0

কৈলাস বসুকে সকলে স্বার্থপর আর সংকীর্ণচেতা বলে জানে। মানুষটার চালচলন আচার বাবহার তো বটেই, চেহারাও সকলের এই ধারণাকে অনেকটা সমর্থন করে। বেঁাঁটি, আঁটোসাঁটো ধরনের মোটা, প্রায় গোলাকার মাথায় বুরুশের মতো শক্ত

11

শত্রুমিত্র

26 December 2023
1
0
0

আদালতের বাইরে আবার দেখা হয় দু জনের, পানবিড়ি চা মুড়ি মুড়কি আর উকিল মোক্তারের দোকানগুলির সামনে। দু জনে তারা পরস্পরের দিকে তাকায়। তীব্র বিদ্বেষের আগুনে যেন পুড়ে যায় দু জোড়া চোখ। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায়

12

রাঘব মালাকর

26 December 2023
1
0
0

[ পুরাণে বঙ্গে একদা নররূপী ভগবান স্নানরতা গোপিনীদের বস্ত্র অপহরণ করে নিয়ে তাদের অন্তর পরীক্ষা করেছিলেন-বহুকাল পরে আবার তিনি....এবার অদৃশ্য থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের দিয়ে, সমগ্র বাংলাদেশের নরনারীর বস্তু অ

13

যাকে ঘুষ দিতে হয়

27 December 2023
1
0
0

মোটর চলে, আস্তে। ড্রাইভার ঘনশ্যাম মনে মনে বিরক্ত হয়, স্পিড দেবার জন্য অভ্যাস নিশপিশ করে ওঠে প্রত্যঙ্গে, কিন্তু উপায় নেই। বাবুর আস্তে চালাবার হুকুম। কাজে যাবার সময় গাড়ি জোরে চললে তার কোনো আপত্তি হয় না

14

কৃপাময় সামন্ত

27 December 2023
1
0
0

রঘুনাথ বিশ্বাসের আমবাগানের পাশ দিয়ে আসার সময় কৃপাময় সামন্তের সামনে একটা সাপ পড়ল। সংকীর্ণ মেটে পথ, পাশের কচুবন থেকে লেজটুকু ছাড়া সবটাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে সাপটার, হাত দুই সামনে। পথ পার হয়ে ডাইনে আগাছার

15

নেড়ী

27 December 2023
1
0
0

দুর্ভিক্ষের প্রথম চোটটা লাগল তারার মাথায়। তারার ছিল চুলের বাহার, মাথা ভরা চিকন কালো একরাশি চুল। মাঝে মাঝে কোনো কোনো মেয়ের এ রকম হয়-চাষাভুসোর ঘরেও। গোড়ায় তেল জুটত, বাপের বাড়িতে থাকবার সময় আর শ্বশুরবাড়ি

16

সামঞ্জস্য

27 December 2023
1
0
0

ভিতরে এবং বাইরে শান্ত গম্ভীর হয়ে প্রমথ সেদিন বাড়ি ফেরে। অনেকদিন পরে মাজ গভীর শাস্তি অনুভব করেছে, পরম মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। ভেবেচিন্তে মন স্থির করে ফেলবার পরেই এ রকম আশ্চর্যভাবে শান্ত হয়ে গেছে মনটা। স

---