রঘুনাথ বিশ্বাসের আমবাগানের পাশ দিয়ে আসার সময় কৃপাময় সামন্তের সামনে একটা সাপ পড়ল। সংকীর্ণ মেটে পথ, পাশের কচুবন থেকে লেজটুকু ছাড়া সবটাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে সাপটার, হাত দুই সামনে। পথ পার হয়ে ডাইনে আগাছার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকবে। বেশ বড়ো সাপ, কৃপাময়ের পদক্ষেপের স্পন্দন অনুভব করে ত্রস্ত হয়ে উঠেছে, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তবে সেই পলকের মধ্যেই লাঠির ঘায়ে ওটাকে মেরে ফেলা যায়। লাঠি উঁচু করে কৃপাময় থেমে গেল। কেন, তা না জেনেই। নাতিকে মারবার জন্যে হাত তুলবার পর আপনা থেকে হাতটা যেমন তার শূন্যে আটকে যায়।
ভোরে সামনে দিয়ে, এত কাছ দিয়ে, সাপ চলে গেলে বোধ হয় কিছু হয়। মঙ্গল অথবা অমঙ্গল। কৃপাময় ঠিক জানে না। চলতে আরম্ভ করে সে ভাবে, চুলোয় যাক। মঙ্গল অমঙ্গলের এ সব ইঙ্গিত, সংকেত, নির্দেশ যে পাঠায় সেও চুলোয় যাক। সাপটাকে না মারবার জন্যে কৃপাময় মনে মনে আপশোশ করতে থাকে। বাগান পেরিয়ে পুরপাড়ার বাড়িগুলি, কয়েকটা কাছাকাছি কয়েকটা তফাতে তফাতে, এলোমেলোভাবে সাজানো। পাকা বাড়ি চোখে পড়ে মোটে একখানা। চারিদিকে বর্ষার পরিপুষ্ট জঙ্গল বাড়ির বেড়া ঘেঁষে, ঘরের ভিটা ছুঁয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
পাকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে নিমের দাঁতন চিবোতে চিবোতে ভূধর সরকার গুনে নিচ্ছিল মাচার লাউ।
ছেলের চিঠি পেয়েছ নাকি হে সামন্ত?
রোজ সে এ প্রশ্ন করে। রোজ কৃপাময়ের পিত্তি জ্বলে যায়।
আজ্ঞে না। চিঠি পাইনি।
এত বিলম্ব করে কেন চিঠি দিতে? চিঠিপত্তর লিখতে তো দেয় জেল থেকে। না স্বদেশি বলে
কড়াকড়ি বেশি?
কী জানি।
ভূধরের বুক লোমবহুল, ভুবু ঘন লোমের মোটা আঁটি। সহানুভূতির সকাতর ধীর উচ্চারণে সে বলে, দ্যাকো দিকি ব্যাপার। বলি, তুই এক ছেলে বাপের, তোর কি স্বদেশি করা পোষায়? কেন রে বাপু, বিয়ে থা করেছিস, ছেলে হয়েছে একটা, কাঁচা বয়েস বউটার-আঁ, কী বললে?
কৃপাময় কিছু বলেনি, ভূধরের নিজের মন কথা কয়েছে কৃপাময়ের হয়ে। এ সব কথায় কৃপাময় মুখ ফুটে সায় দেয় না, দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথাটা শুধু একটু নাড়ে। ভূধর বোধ করে অস্বস্তি আর অপমান। একটু ক্ষোভ জাগে, রাগ হয়। তার যে মনে পড়েছে তার ছেলে একটা নয়, জোয়ান- মদ্দ পাঁচ পাঁচটা ছেলে, এটা যেন কৃপাময়েরই ব্যঙ্গ করা তাকে। সে যাবে কৃপাময়ের একমাত্র ছেলের জেলে যাওয়া নিয়ে আন্তরিক সহানুভূতি জানাতে আর তার মনে পড়বে তার পাঁচ ছেলের কথা? এসব লোকের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। কতদিন সে ভেবেছে কৃপাময়ের সঙ্গে কথা বলার, গায়ে পড়ে যেচে কথা বলার স্বভাবটা ত্যাগ করবে, তবু যে কেন দেখা হলেই ওর সঙ্গে সে কথা কয়। মামলাটার কী হল সরকারমশায় ?
এ প্রশ্ন তো করবেই কৃপাময়। বড়ো ছেলে তার ঘুষের মামলায় পড়েছে, এখন সে মামলার কথা না তুললে বাঙ্গ সম্পূর্ণ হবে কেন। কড়া কথা ঠেলে আসে ভূধরের মুখে, বলতে ইচ্ছে হয়, তোমার বাহাদুরি রাখো সামন্ত-কিন্তু মুখে আটকে যায় কথাগুলি। কেন কে জানে।
চলছে। মামলা চলছে। সাজানো মামলা, ফেঁসে যাবে।
কৈফিয়তের মতো শোনায়, আবেদনের মতো। তার ছেলে লোক খারাপ নয়, মামলা সাজানো। কৃপাময় বিশ্বাস করুক, মামলা সাজানো। থুতু ফেলার বদলে ভূধর ঢোঁক গিলে ফেলে। নিমের দাঁতনের জন্যেই নিজের থুতুটা বড়ো তেতো লাগে সন্দেহ নেই।
ওরা খুব খুশি হয়েছে, না সামস্ত? গাঁয়ের লোক? খুব ঢাক পিটিয়ে বেড়াচ্ছে?
এ কথা ওকে আমি কেন জিজ্ঞেস করলাম, ভূধর ভাবে। কৃপাময়ও তো গাঁয়ের লোক। ওরা খুশি হয়ে থাকলে কৃপাময়ও তো খুশি হয়েছে নিশ্চয়। এক মুহূর্তের জন্যে বড়ো অসহায়, বড়ো করুণ দৃষ্টিতে ভূধর তাকায় কৃপাময়ের দিকে, সে যেন সারা গাঁয়ে বিরোধী মতের, শত্রু ভাবের, ঘৃণা ও হিংসার প্রতিনিধি হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। কৃপাময় জবাব দেবার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে ধাতস্থ হয়। সে ভাবটা কেটে গেলে তখন তার মনে হয় ক্ষণিকের জন্যে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠেছে। রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি, পেট গরম হয়েছিল। কেন যে বাড়ির সবাই খাও খাও করে তাকে এত বেশি খাওয়ায়। আজ সাবধানে খাওয়া দাওয়া করতে হবে। দাঁত মেজেই স্বর্ণসিন্দুর খাওয়া চাই।
।বরক্তি চেপে ভেবেচিত্তে কৃপাময় জবাব দেয়, ঢাক পিটে বেড়াবে কে?
শুনে ভূধরের মনে হয়, কৃপাময় যেন বলতে চায়, তোমার ছেলের কীর্তির কথা ঢাক পিটে রটাবার দরকার হয় না, সবাই জানে। কী আস্পর্ধা লোকটার, এমনভাবে তার সঙ্গে কথা কয়, এমন ভাসাভাসা উদাসীনভাবে, অবজ্ঞার সঙ্গে। আর নয়। আর একটি কথা সে বলবে না ওর সঙ্গে। নাই পেলে এরা বেড়ে যায়। কৃপাময়ের দিকে প্রায় পিছন ফিরে ভূধর এবার মাটিতে থুতু ফেলে।
কৃপাময় একটু ইতস্তত করে। তার কি উচিত লোকটাকে একটু সাবধান করা? ফল হয়তো কিছুই হবে না, তবু বলতে বোধ হয় দোষ নেই। দালানের ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মারছে এক জোড়া বুভুক্ষু চোখ, ভূধরের, সেজো ছোলে সুরেশ। তাকিয়ে সে আছে দালানের দক্ষিণে বাপের বাঁধানো পুকুরঘাটে, যেখানে ছেঁড়া ন্যাকড়ায় কোনো মতে, কিংবা শুধু খানিকটা লজ্জা ঢেকে এসেছে গাঁয়ের কজন মেয়ে, না এসে যাদের উপায় নেই, নিরুপায় হয়েও কদিন পরে হয়তো যারা আসতেই পারবে না।
একটা কথা আপনাকে বলি সরকারমশায়।
হুম। ভূধর ফিরেও তাকায় না।
আপনার ছেলেকে একটু সাবধান করে দেবেন, ঘোষপাড়ায় যেন না যায়। সবাই খেপে আছে
ওরা, কী করে বসে ঠিক নেই। বউ-ঝি নিয়ে টানাটানি ওরা সইবে না, এবার পাড়ায় গেলে হয়তো- কোন ছেলে? আমার কোন ছেলে বউ-ঝি নিয়ে টানাটানি করে? গর্জন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কৃপাময়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাটে বউ-ঝিদের নাইতে ও জল নিতে এবং উপরের ধাপে বসে সুরেশকে সিগারেট ফুঁকতে দেখে ভূধর আবার নির্জীব হয়ে যায়।
আপনি যদি কথা দেন ছেলেকে সামলাবেন, আমি ওদের বলতে পারি। নয় তো আমি যদ্দুর জানি ছেলে আপনার খুন হয়ে যাবে।
ছেলেটা গোল্লায় গেছে, সামন্ত।
কৃপাময়ের হাতের চাপে নরম মাটিতে লাঠির ডগায় টোল পড়ে কয়েকটা। গোল্লায় যাক, চুলোয় যাক। খুন হয়ে ছেলেটার নরকে যাওয়া বন্ধ করার জন্যে কৃপাময় মনে মনে আপশোশ করে। ওকে শহরে পাঠিয়ে দেব আজকালের মধ্যে মেজো ছেলের ওখানে।
সেই ভালো।
পরামর্শ দিচ্ছে, উপদেশ। যেন, মহাজন, যেন গুরুঠাকুর, যেন মাস্টার। ভয় দেখাচ্ছে, যেন পুলিশের দারোগা।
কৃপাময়কে সে কি ভয় করে। কোনো কারণ তো নেই ওকে তার ভয় করার। তার সম্পদ আছে, লোকজন আছে কৃপাময় গরিব একা। ছেলের বউ আর ছেলেমানুষ নাতিটা ছাড়া ওর কেউ নেই। ওর অর্ধেক জমি তার কাছে বাঁধা। ইচ্ছা করলে ওকে সে-চললে নাকি সামন্ত? একটা লাউ চেয়েছিলে, নেবে তো নিয়েই যাও আজ।
আজ্ঞে ঠিক চাইনি, তবে দ্যান যদি- দশজনকে দিয়েই তো খাব হে। নইলে এত লাউ দিয়ে করব কী? ওটা নাও, বড়োও হবে, কচিও আছে।
প্রথম সোনালি রোদ এসে পড়েছে মাটির পথে, মাঝে মাঝে গাছের ছায়া। বর্ষায় পরিপুষ্ট সবুজ গ্রাম। শ্যাম মাইতি আর গোকুল দাসের পোড়া বাড়ির কালো কাঠ-বাঁশ-ছাই আজও স্তূপ হয়ে পড়ে আছে, বর্ষাও ধুয়ে নিয়ে যায়নি, নতুন কুটিরও ওঠেনি। কোথায় চলে গেছে ওরা, ফিরে এসে নিশ্চয় আবার ঘর তুলবে।
কৃপাময়ের বাড়ির কাছাকাছি সোনা জেলের বউ কাতু এইটুকু মোটা কাপড়ে তার যৌবন- উথলানো তাজা দেহটা কতটা ঢাকল কেয়ার না করে মাথায় মাছের চুপড়ি বসিয়ে তার নিজস্ব কোমরদোলানো ছন্দে হনহন করে চলে, কৃপাময়কে পেরিয়ে গিয়ে থামে। ফিরে এসে আবার তার নাগাল ধরে।
বলে, খাসা লাউটি বাঃ। কত নিলে গা?
সরকারমশায় দিলেন, কাতু।
ওমা, হাঁ নাকি? দুটি চিংড়ি দি তবে তোমাকে।
চুপড়ি নামিয়ে একটা কচু পাতা ছিঁড়ে কাতু এক খাবলা চিংড়ি তুলে দেয়।
কৃপাময় বলে, পয়সা নেই কাতু।
কাতু বলে, পয়সা কীসের? তুমি মোর বাপ। তোমার ছেলে মোকে বাঁচালে মিলিটাবি থেকে।
তোমায় দুটি চিংড়ি দিয়ে পয়সা নোব? ধম্মে সইবে মোর ? কাতু আরও কিছু চিংড়ি কচুপাতায় তুলে দেয়।
ছেলে ছাড়া পাবে কবে গো সামস্তমশাই?
কতবার শুধোবি কাতু? দেরি আছে, এখনও দেরি আছে।
মোকে বলবে, ছেলে কবে আসবে মোকে বলবে। ছেলেকে তোমার বুই খাওয়াব, পাকা বুই, গোটা বুই আদমুনি। তোমার ছেলে যদি না মোকে বাঁচাত গো সামস্তমশাই-কাতুর ওখলানো যৌবনের অশ্লীলতা পর্যন্ত যেন ঢেকে যায় তার চোখ ছলছলানো মুখের মেঘে। এতক্ষণে কৃপাময় একদণ্ড তার দিকে তাকাতে পারে।
আয় তো কাতু, খানিকটা লাউ কেটে দি তোকে। দুটি প্রাণী, এ লাউয়ের আধখানাও খেতে পারব না।
লাউয়ের ফালি নিয়ে চলে গেলে কৃপাময় বলে ছেলের বউকে, লাউ চিংড়ি তো রাঁধবে বাছা, তেল কি আছে?
আছে একটুখানি, বলে কৃপাময়ের ছেলের ছেঁড়া সেলাই করা গেঞ্জি গায়ে আর কোমরে ভাঁজ খোলা কাঁথার লুঙ্গি-জড়ানো বউ।
তাই রাঁধো গে তবে।
বউ নড়ে না। চোখ তুলে একবার চায়, চোখ নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কৃপাময়ের সামনে, গেঞ্জিপরা লুঙ্গি জড়ানো রোগা প্রতিমার মতো। জলভরা চোখ দেখে কৃপাময়কে একটু ভাবতে হয়। লাউচিংড়ি রাঁধতে বলায় তার ছেলের বউয়ের চোখে জল আসে কেন? তার ছেলের কথা ভেবে ? ছেলে তার বিশেষ করে লাউচিংড়ি খেতে ভালোবাসত বলে তো মনে পড়ে না। তাছাড়া তার সামনে এ ভাবে দাঁড়িয়ে তার ছেলের কথা ভেবে বউ চোখে জল আনত না, আড়ালে যেত। শেষে বুঝতে পেরে কৃপাময় বলে, চাল বাড়ন্ত বুঝি মা? তাই তো!