আগে, কিছুকাল আগে, বেশিদিনের কথা নয়, গভীর রাতেও হাতিপুর গ্রামে এলে লোকালয়ের বাস্তব অনুভূতিতে স্বস্তি মিলত। মানুষের দেখা না মিলুক, মাঠ, খেত, ডোবাপুকুর, ঝোপঝাড়, জলা অপরিসীম রহস্যে ভরাট হয়ে থাক, হুতোম প্যাঁচা ডেকে উঠুক হঠাৎ, জঙ্গলের আড়ালে শুকনো পাতা মচমচিয়ে হাঁটুক রাত্রিচর পশু, বটপুকুরের পূর্বোত্তর কোণের তালবন থেকে খোনা কান্না ভেসে আসুক আবদেরে শকুন ছানার, দীপচিহ্নহীন ছায়ান্ধকারে নিঝুম হয়ে ঘুমিয়ে থাক সারাটি গ্রাম- এ সবই জোগাত ভরসা, রাতদুপুরে ঘুমন্ত গ্রামের এই সংগত লাগসই পরিবেশ ও পরিচয়। গ্রাম তো এই রকমই বাংলার, রাত্রে সব গ্রাম। গা ছমছম করত ভয়ের সংস্কারে, ভয় পাবার ভয়ে, সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে নয়।
আজ তারা হাতিপুরে এলে ভয় পাবে, সন্ধ্যার পর বাংলার গাঁগুলির স্বাভাবিক পরিবেশ আজ কী দাঁড়িয়েছে যারা জানে না। বাংলার গাঁয়ের কথা ভেবে শহরে বসে যেসব ভদ্রলোকের মাথা চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে তাদের কথাই ধরা যাক। বাংলার গাঁয়ে গাঁয়ে যে অভূতপূর্ব ভৌতিক কাণ্ডকারখানা চলছে সে বিষয়ে একান্ত অভিজ্ঞ এই রকম কোনো ভদ্রলোক আজকাল একটু বাত করে হাতিপুরে এলে ভয়ে দাঁতকপাটি লেগে মূর্ছা যাবে। এরা বড়োই সংস্কার বশ, মন প্রায় অবশ। অতএব, দুর্ভিক্ষে গাঁয়ের অধিকাংশের অপমৃত্যু-নিরুদ্ধার, এ জ্ঞান জন্মেই আছে। তারপর সেই গাঁয়ে চারিদিকে ছায়ামূর্তির সঞ্চরণ চোখে দেখে এবং মর্মে অনুভব করে তাদের কী সন্দেহ থাকতে পারে যে জীবিতের জগৎ পার হয়ে তারা ছায়ামূর্তির জগতে এসে পৌঁছে গেছে।
গাছপালার আড়ালে একটা ছনের বাড়ি। বাড়ির সামনে ভাঙা বেড়া কাত হয়েও দাঁড়িয়ে আছে। বেড়ার ওপাশ থেকে নিঃশব্দে ছায়া বেরিয়ে এসে হনহন করে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে জমকালো কতগুলো গাছের ছায়ার গাঢ় অন্ধকারে, নয়তো কাছাকাছি এসে পড়ে থমকে দাঁড়াবে, চোখের পলকে একটা চাপা উলঙ্গিনি বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ফিরে যাবে বেড়ার ওপাশে। ডোবাপুকুরে বাসন মাজবে ছায়া, ঘাট থেকে কলসি কাঁখে উঠে আসবে ছায়া। ছায়া কথা কইবে ছায়ার সঙ্গে, দিদি, মাসি, খুড়ি বলে পরস্পরকে ডেকে হাসবে কাঁদবে অভিশাপ দেবে অদেষ্টকে, আর কথা শেষ না করেই ফিরে যাবে এদিকে ওদিকে এ-কুঁড়ে ও-কুঁড়ের পানে বিড়বিড় করে বকতে বকতে। বিদেশির সামনে পড়ে গেলে চকিতে ঝোপের আড়ালে অন্তরাল খুঁজে নিয়ে ভীত করুণ প্রতিবাদের সুরে ছায়া বলবে, কে? কে গো ওখানে?
কোনো ছায়ার গায়ে লটকানো একফালি ন্যাকড়া, কোনো ছায়ার কোমরে জড়ানো থাকে গাছের পাতার সেলাই করা ঘাঘরা, কোনো ছায়াকে ঘিরে থাকে শুধু সীমাহীন রাত্রির আবস্থা আঁধার, কুরুসভায় দ্রৌপদীর অন্তহীন অবর্ণনীয় রূপক বন্ত্রের মতো।
সারাটা দিন, সূর্যের আলো যতক্ষণ উলঙ্গিনি করে রাখে, ছায়াগুলি বাড়ির ভিতরে বা ঘরের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকে। কোনো কোনো ছায়া থাকে একেবারে অন্ধকার ঘরের মধ্যে লুকিয়ে, বাপ ভাই স্বামী শ্বশুরের সামনে বার হতে পারে না-স্ত্রীলোকসুলভ লজ্জায়। কোনো বাড়িতে কয়েকটি ছায়া থাকে এক সঙ্গে, মা, মাসি, খুড়ি, পিসি, মেয়ে, বোন, শাশুড়ি বউ ইত্যাদি বিবিধ সম্পর্ক সে ছায়াগুলির মধ্যে-এক একজন তারা পালা করে বাইরে বেরোয় কারণ, বাইরে বেরোবার মতো আবরণ একখানিই তাদের আছে। ভোলা নন্দী কোমরের ঘুনসির সঙ্গে দু আঙুল চওড়া পট্টি এঁটে তার পাঁচহাতি ধুতিখানা বাড়ির মেয়েদের দান করেছে। কাপড়খানা যে কোনো সাধারণ গতরের স্ত্রীলোকের কোমবে একপাক ঘুরে বুক ঢেকে কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে-কাঁধে সর্বক্ষণ অবশ্য ধরে রাখতে হয় হাত দিয়ে, নইলে বিপদ। ভোলাব বউ ঘাটে যায়। ঘাট থেকে ঘুরে এসে ভিজে কাপড়টি খুলে দেয়। ভোলার মেজো ছেলে পটলের বউ পাঁটী বা ভোলার মেয়ে শিউলি কাপড়টি পরে ঘাটে যায়।
কৎকাল এমনি কয়েদ হয়ে থাকবো মা?
পাঁচী হু হু করে কেঁদে ওঠে।
আর সয় না।
বলে শাল কাঠের মোটা খুঁটিতে মাথাটা ঠকাশ করে ঠুকে দেয়। আর সয় না, আর সয় না গে। বলতে বলতে মাথা ঠুকতে থাকে খুঁটিতে খুঁটিতে, গড়াগড়ি দেয় আগের গোবর-লেপা গুঁড়ো গুঁড়ো মাটিতে, ধূলায় ধূসর হয়ে যায় তার অপুষ্ট দেহ ও পরিপুষ্ট স্তন। হায়, গুলো মাটি ছাই কাদা মেখেও যদি আড়াল করা যেত মেয়েমানুষেব লজ্জাজনক পোড়া দেহের লজ্জা!
বৈকৃষ্ট মাফিক মাঠে মাঠে ভীষণ পাল্টে, নিজেকে আর বউটাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে। সন্ন্যাসীবাবুর দালানের পর আমবাগান, তাব এ পাশে রাস্তা এবং ও পাশে ঘুপচিমারা পথের ইয়ার্কি, তার কাছে দু বিষে বিচ্ছিন্ন ধান-জমির লাগাও বৈকুন্ঠের মেন্ট আড়াইগানা কড়ে নিয়ে তিন পরদেব বস্তবাটী। আডাইখানা কুঁড়ের মধ্যে ঘর বলা যায় একটাকে, তার ঝাঁপের দরঙণ, বাঁশেষ দেয়াগ, বাঁশের দুয়ার, বাঁশের খিল। ঝাঁপে থপথপ থাপড় মেরে বৈকুণ্ঠ প্রায় পিত্তি-ফাটা তেতো গলায় বলে, বাড়াবাড়ি করছিস ছোটো বউ, বাড়াবাড়ি কবছিস বড়ো। মোর কাছে তোর লজ্জাড়া কী ?
তাব বউ মানদা ভেতর থেকে বলে, মুখপোড়া বঙতি! বোনকে কাপড় দিয়ে বউয়ের সঙ্গো মশকরা? যমের অরুচি, লক্ষ্মীছাড়া।
সুন্দর সকল, সুন্দব সন্ধণ কচুর পাতায় শিশির ফেন্টায় মুক্তা হীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা তন্ড ঝাঁপের দু পাশে এমনি গালাগালি চলে দুজনের মধ্যে। বাড়ির তিনদিকে মাঠ ভাবে শণ উচু হয়ে আছে আড়াই থেকে তিন হাত। ছুটে গিয়ে ডুব দিলে লজ্জাশবম সব ঢাকা পড়ে সাথ আকাশের দিকে চেয়ে প্রাণভরে কাঁদা যায় নির্ভয় নিশ্চিন্ত মনে। এই শণের বনের মাঝখানের পায়ে ইটি! পথ ধবে বেনারসি শাড়ি পরা গোকুলের বোন মালতী বিপিন সামন্তের পিছু পিছু ২কুনের ছাউনির দিকে চলতে থাকে গর্বে ফাটতে ফাটতে, তাই তাকিয়ে দ্যাগে মানদা ঘরের বেড়ার ফোকর-জানালায় চোখ রেখে। দাস কামারের মেয়েটা আজ ওদের সঙ্গে যাচ্ছে। ওও তো রাতের ছায়া ছিল কাল রাত্রি তক, সারাদিন ঘরে লুকিয়ে থেকে চুপি চুপি ঘাটে আসত দুটো চারাটি বাসন আর কলসি নিয়ে। ধোপদুরস্ত সাদা থান কাপড়টা কোপা পেল ও সধবা মাগি ?
শণ খেতের বঙ্গমঞ্চে রঘু একটু মশকবা করে বেনারসি পরা মালতীর সঙ্গে, তা দেখে যেন যাত্রাদলের মেয়ে সাহল ছেলে সঙ্গীর মতো ভড়কে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় রাণুর হাপুসকাঁদা যোলো বছরের কাঁচা মেয়ে। এদিক ওদিক চায়। হঠাৎ পিছু ফিরে হাঁটতে থাকে হনহনিয়ে, ফাঁদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হরিণী যেন পালাচ্ছে যেদিকে পালানো চলে। ইস। কী সাদা ওর পরনের ধুতিটা।
অ বিন্দু দাঁড়া। রঘু ডাকে। বিন্দা দাঁড়ায়। ফাঁদছাড়া হরিণী তো নয় আসলে, মানুষের মেয়ে। দাঁড়িয়ে মুখ ফেরায়। বলে, কাল-কাল যাব সামস্ত মশায়। বড়ো ভর লাগছে আজ।
বেনারসি পরা মালতী বলে, ইহিরে, খুকি মোর ডর লাগছে। দে তবে, দে কাপড় পুলে। খোল কাপড়। যাবি তো ৮. নয় কাপড় খুলে দিয়ে ঘরে যা। বৈকুণ্ঠ বলে, ঝাঁপ ভাঙব ছোটো বউ। মানদা বলে ভাঙো-মাথা ভাঙব তোমার আমি।
সন্ধ্যার পর মানদা বাপ গোলে। সন্ধ্যার পর সোয়ামির কাছে মেয়েমানুষের লজ্জা কাঁ?
ভূতির ছেলে কানুর বয়স বছর বাবো। ভূতির স্বার্মা গদাধর কাজ আর কাপড়ের খোঁজে বেরিয়েছে আজ এগারো দিন খিদের কাতর হয়ে কালু ডুতির করেদম্পানার বাইরে থেকে কেঁদে বলে, মা, ওমা। খিদে পায় যে?
ভৃতি বলে ভেতর থেকে, শিকেয় হাঁড়িতে পাস্তো আছে, গে-গে যা নিয়ে। পাড়তে পারি না যে। তুই দে ভূতি দিশেহারা হয়ে ভাবে, যাবো? ছেলে মাকে ন্যাংটো দেখলে কী আসে যায়। মা কালীও তো ন্যাংটো। ওমা কালী, তুইই বল মা, যাবো বল মা, মোর হিদায় থেকে একটা কিছু বল।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ তাকে উলঙ্গ দেখে কান যেমন হি হি করে হেসেছিল, আজও সদি তেমনি করে হাসে? চোখ ফোটে চাল আসতে চায় ভূতির, জল পড়ে না, জল শুকিয়ে গেছে চোখের। চোখ শুকনো, জ্বালা করে আজকাল কাঁদতে চাইলে।
হঠাৎ ছেঁড়া মাদুবটা চোখে পড়ে।
দাঁড়া জাকড়।
মাদুরটা সে নিজের গায়ে জড়গ্ন। একহাতে শক্ত করে ধরে থাকে গগায়ে জড়ায়েনা মাদুরটা, আর এক হাতে দুয়ার খুলে রসুই ঘবে গিয়ে শিকে থেকে নামাতে যায় পাস্তার হাঁড়িটা। পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে যায় হাঁড়িটা, পাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। তখন মাদুরটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে ভৃতি এঁটো ৬৭৩ আর ভাত ভেজানো এঁটো জলের মধ্যেই দপ করে বসে দু হাতে মুখ ঢেকে শুরু করে কান্না। আব এমনি আশ্চর্য কান্ড, এবার তার শুকনো চোখ থেকে গুল বেরিয়ে আঙুলের গাঁক দিয়ে গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা মিশতে থাকে মেঝেয় ভাত ভেজানো ঢালে।
রাবেয়া বলে আনোয়ারকে, গ্রাজ শেষ। আজ যদি না কাপড় আনবে তো তোমার আমায খদ্রম। পুরুবে ডুবব, খোদার কসম।
রাবেয়া কদিন থেকেই এ ভগ দেখাচ্ছে, তবু তার বিবর্ণ মুখ, রুক্ষ চুল আব উদভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে আনোয়াবের বুক কেঁপে যায়। চাষির সবেব বউ দুর্ভিক্ষের দিনগুলি না খেয়ে ধুকতে ধুকতে কাটিয়ে দিয়েছে, কথা বলেনি, শাক পাতা কুড়িয়ে এনে খুদ কুঁড়োর সাশ্রয় করে তাকে বাঁচিয়ে লড়াই করেছে নিজে বাঁচবার জন্য। আজ কাপড়ের জন্য সে কামনা করছে মরণ। খেতে দিতে না পাবাব দোষ ও গ্রাহ্য করেনি, পরতে দিতে না পাবার দোষ ও সইতে নারাজ, দিনভর ফুঁসে ফুঁসে গঞ্জনা দিচ্ছে। বিবিকে যে পরনের কাপড় দিতে পাবে না সে কেমন মবদ, তাৎ আধার সাদি করা কেন অনুনয় করে আনোয়ার বলে, আজিজ সাব খপর আনাতে গেছেন। হাতিপূবের কাপড়ের ভা মিলবে আজকালের মধ্যে। একটা দিন সবুর কর আরা সবুর। আর কত সবুর করব? কবরে যেয়ে সবুর করব একব। শেমিজ না পরলে দু ফেবা শাড়ি পরা রাবেয়ার অভ্যাস। এক ফেরতা কাপড় জড়িয়ে মানুষের সামনে সে বার হযনি কোনো দিন। পায়খানার চটের পর্দাটা গায়ে জড়িয়ে নিজেকে তার বিবসনা মনে হচ্ছে। কাপড় যদি নেই, ঘোষবাবুর বাড়ির মেয়েরা এবেলা ওবেলা রঙিন শাড়ি বদলে নিয়ে পরে কী করে, আজিজ সায়েবের বাড়ির মেয়েরা চুমকি বসানো হালকা শাড়ির তলার মোটা আবরণ পায় কোথায়? সবাই পায়, পায় না শুধু তার স্বামী। আল্লা, এ কোন মরদের হাতে সে পড়েছিল।
রাত্রের ছায়ামূর্তি হয়ে রাবেয়া গিয়ে দেখে আমিনা জুরে শয্যাগত হয়ে পড়ে আছে, তার গায়ে দুটো বস্তা চাপানো, চুনের বস্তা। বস্তার নীচেই আমিনার গায়ের চামড়া জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে। দেবে মোকে।
আমিনা বলে ফিসফিসিয়ে, গা জ্বলছে-পুড়ে যাচ্ছে! আজ ঠিক মরব। এ বস্তা মুড়ে কবর আবদুল আজিজ আর সুরেন ঘোষ হাতিপুরের একুশ শো চাষি ও কামার কুমার জেলে জোলা তাঁতি আর আড়াই শো ভদ্র স্ত্রীপুরুষের কাপড় জোগাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। মাস দেড়েক আগে উলঙ্গ হাতিপুর সোজাসুজি সদরে গিয়ে মহকুমা হাকিম গোবর্ধন চাকলাদারকে লজ্জিত করেছিল। এ ভাবে সিধে আক্রমণের উসকানি যুগিয়েছিল শরৎ হালদারের মেজো ছেলে বন্ধু আর তার সতেরো জন সাঙ্গোপাঙ্গ। সতেরো মাইল দূরে স্বদেশসেবক তপনবাবুর কাপড়ের কল কয়লার অভাবে অচল হয়েও সাড়ে তিনশো তাঁত কী করে সচল আছে আর খালি গুদামে কেন অনেক শো গাঁট ধুতি শাড়ি জমে আছে, এ সব তথ্য আবিষ্কার করায় বন্ধু আর তার সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামার দায়ে হাজতে আছে সওয়া মাস। মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা তারা না করে থাকলে অবশ্য বিচারে খালাস পাবে, মিথ্যা হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণের পালটা নালিশও বুজু করতে পারবে আইন অনুসারে কিন্তু গুরুতর নালিশ যখন হয়েছে ওদের নামে, হাজতে ওদের থাকতে হবে। জামিন দেওয়ার অনেক বাধা। গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে জামিনের কথা।
ঘোষ আর আজিজ সভা ডেকে ঘোষণা করেছে হাতিপুরের জন্য কাপড়ের 'কোটা' তারা যা আদায় করেছে, এবার কাপড়ের ভাবনা কারও ভাবতে হবে না। মনোহর শার প্রস্তাবে নিজেদের তারা হাতিপুরের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে। বিশ্বাস না করেও হাতিপুরের লোক ভেবেছে, দেখা যাক। আশা ছেড়ে দিয়েও হাতিপুরের নরনারী ভেবেছে, উপায় কী।
দুজনে আজ সদরে গিয়েছিল, কবে হাতিপুরে এসে পৌঁছবে হাতিপুরের জন্য নির্দিষ্ট করা কাপড়ের ভাগ তারই খবর জানতে। গাঁয়ের লোক উন্মুখ হয়ে পথ চেয়ে আছে তাদের। ছায়ারা ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও আগ্রহ ও উত্তেজনার শেষ নেই। বিকালে ছোটোখাটো একটি জনতা জমে উঠল গ্রামের পূর্ব প্রান্তে কাঁথি সড়কের বাস-থামা মোড়ে। ঘোষকে একা বাস থেকে নামতে দেখে জনতা একটু ঝিমিয়ে গেল। ভিড় দেখে ঘোষও গেল একটু ভড়কে।
গোলমাল হয়েছে একটু।
কী হল ঘোষমশায়, কাপড়ের কী হল? বন্ধুর সাঙ্গোপাঙ্গদের একজন, সরকারদের অবিনাশ, সে সময়টা কলেরায় মরোমরো হয়ে গোলমাল ? কীসের গোলমাল? কলকাতা থেকে মাল আসেনি। ভাইসব, আমরা জীবনপাত করে-
থাকায় মারপিটের নালিশে হাজতে যেতে পারেনি। সে বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে, শনিবার ক্ষেত্র সামস্তের চালান এসেছে সাত ওয়াগন। আমি দেখেছি, পুলিশ দাঁড়িয়ে গাঁট নামিয়ে গুনে পুনে চালান দিল। ও সদরের জন্যে। হাতিপুরের কোটা আসেনি।
কবে আসবে?
আসবে। আসবে। ছুটোছুটি করে মরছি দেখতে পাচ্ছ তো ভাই তোমাদের জন্যে?
হতাশ ম্রিয়মান জনতা গাঁয়ে ফিরে যাবার উপক্রম করছে, কাপড়ের গাঁট বোঝাই প্রকাণ্ড এক লরি রাস্তা কাঁপিয়ে এসে থামবার উপক্রম করে তাদের সামনে রাস্তার সেই মোড়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছে আজিজ, তার পাশে সুরেন ঘোষের ভাই নরেন ঘোষ। সুরেন ঘোষ মরিয়া হয়ে পাগলের মতো হাত নেড়ে ইশারা করে, আজিজ জনতার দিকে তাকিয়ে তার ইশারা দ্যাখে, ড্রাইভারকে কী যেন বলে, থামতে থামতে আবার গর্জন করে লরিটা জোরে এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অল্প দূরে পথের বাঁকের আড়ালে। লাল খুলায় সৃষ্টি হয় মেঘারণ্য।
জনতা ঘুরে দাঁড়ায়, একপা দুপা এগিয়ে এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাস তখনও ছাড়েনি। বাস থেকে নেমে এসেছে খাকি পোশাক পরা সুদেব, কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্টটা তার কী চকচকে। লাল পাগড়ি আঁটা একজন চা আনতে যায় সুবলের দোকান থেকে চা এবং একটা কীসের যেন চ্যাপটা শিশি আর সোডার বোতল। ঘোষের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে সুদেব ধরায়, টান মেরে ধোঁয়া ছাড়ে যেন ভেতরে কাঁচা কয়লায় আগুন ধরেছে মানুষের ভিড় দেখার উত্তেজিত রাগে।
কীসের ভিড়?
কাপড় চায়।
হাঃ হাঃ। পরশু পচেটপুরে সার্চে গেছলাম নন্দ জানার বাড়ি। বাড়ির সামনে যেতেই হাত জোড় করে বলল, কী করে ভেতরে যাবেন হুজুর, মেয়েরা সব ন্যাংটো। ওরা বসুই ঘরে যাক, সারা বাড়ি তল্লাশ করুন। আমায় যেন বোকা পেয়েছে। রসুই ঘরে ফেরারি ছোঁড়াটাকে সরিয়ে সারা বাড়ি সার্চ করাবে। আমি বললাম, বেশ। তারপর সোজা রসুই ঘরের দরজা ভেঙে একদম ভেতরে। আরে বাপরে বাপ, সে যেন লাখ শালিকের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেল মশায়। সব কটাই প্রায় বুড়ি, কিন্তু একটা যা ছিল মিঃ ঘোষ, কী বলব আপনাকে। পাতলা একটা উড়নি পরেছে, একদম জালের মতো, গায়ের রং দেখে তো আমি মিস্টার-হাতিপুরের মানুষ হাতিপুরে ফিরে যায় ধীরে ধীরে। এদিকের আশা ফুরিয়ে যাওয়ায় হতাশার চেয়ে চিন্তা সকলের বেশি। এ ভাবে যখন হল না তখন এবার কী করা যায়। কেউ যদি উপায় বাতলে দিত। জান নয় দিলাম রে আব্বাস, আনোয়ার বলে ভুরু কুঁচকে, কী জন্যি জানটা দিব তা বল? ভোলা বলে, লুট করে তো আনতে পারি দু-এক জোড়া, কিন্তু তারপর ?
তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশে ছোটো চাঁদটি উঠেই আছে, দিন দিন একটু একটু বড়ো হবে। কদিন পরে জ্যোৎস্নার তেজ বাড়লে বন্দিনী ছায়াগুলির কী উপায় হবে কে জানে। চাঁদ ডুবলে তবে যদি বাড়ির বাইরে যাওয়া চলে, রোজ পিছিয়ে যেতে থাকবে শেষরাত্রির দিকে চাঁদ ডুববার সময়। বিলের ধারের বাঁধানো সড়কে নানারঙা শাড়ি পরা মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বাবুরা কজন হাওয়া খাচ্ছেন। কাপড় তৈরির কলেই যে হাতিপুরের লোক কাজ করে ওই তার প্রমাণ। কিন্তু আরও কত লোকেও তো কাজ করে সতেরো মাইল দূরে কাপড় তৈরির কলে, তবে কেন ও অবস্থা তাদের ?
সবাই ভাববার চেষ্টা করে।
হাতিপুরের ঘরে ঘরে খবর রটে যায়, কাপড় পাওয়া যাবে না। তবে যে চেঁচরা দিয়ে গেল কাপড় পাওয়া যাবে ? সকলে প্রশ্ন করল সন্ত্রস্ত হয়ে।
রসুল মিয়ার দালানের সামনের রোয়াকে একঘণ্টা ধল্লা দিয়ে পড়ে থেকে আনোয়ার বাড়ি গেল সন্ধ্যার পরে। শাড়ি না পাক, কথা সে আদায় করেছে। বাড়তি শাড়ি ঘরে ছিল কিন্তু বসুল মিয়াও একটু ভয় পেয়ে গেছেন। অবস্থাটা একটু ভালো করে বুঝতে চান আগে। কদিন পরে তিনি একখানা শাড়ি অন্তত আনোয়ারকে দেবেন, আজ হবে না। তাই হোক, তাও মন্দের ভালো। রসুল
মিয়ার কথার খেলাপ হবে না আশা করা যায়। রাবেয়াকে এই কথাটা অন্তত বলা যাবে। রাবেয়া খানিক পরে ঘাট থেকে ফিরে আসে। অদ্ভুত রকম শান্ত মনে হয় আজ তাকে। আনোয়ার গোড়ায় তাকে দুঃসংবাদটা দেয়।
রাবেয়া বলে, জানি। তারপর আনোয়ার রসুল মিয়ার কাছে দু-চারদিনের মধ্যে শাড়ি পাবার ভরসার খবরটা জানায়।
এবারও রাবেয়া বলে, জানি।
দাওয়ায় এসে রাবেয়া তার কাছেই বসে। তেল নেই, দীপহীন অন্ধকার বাড়ি। অন্ধকার বলেই বুঝি পায়খানার ছেঁড়া চটের পর্দা জড়িয়ে নিজের কাছে রাবেয়া লজ্জা কম পায়। তাই বোধ হয় সে শান্ত হয়ে বসে কথা বলে আনোয়ারের সঙ্গে, ফুঁসে না, শাসায় না, খোঁচায় না। মনে মনে গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আনোয়ার অনেকদিন পরে সাহস করে হাত বাড়িয়ে রাবেয়ার হাত ধরে।
রাবেয়া বলে, বাবেনি। চলো।
চলো।
দাওয়ার গাঢ় অন্ধকার থেকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় উঠানের আবছা অন্ধকারে নেমে রাবেয়া একটু দাঁড়ায়। তারপর আনোয়ারকে অবাক করে গায়ে জড়ানো চটটা খুলে ছুঁড়ে দেয় উঠানের
ঘিন্না লাগে বড়ো। গা কুটকুট করছে। আনোয়ারের একটু ধাঁধা লাগে, একটু ভয় করে।
ফের নেয়ে নি।
ঘর থেকে ভরা কলসি এনে রাবেয়া মাথায় উপুড় করে ঢেলে দেয়। গায়ের ছেঁড়া কুর্তিটা খুলে চিপে নিয়ে চুল ঝেড়ে গা মোছে।
পানি ঢেলে দিলি সব?
ফের আনব।
আনোয়ারকে খাইয়ে নিজে খেয়ে সানকি আর কলসি নিয়ে রাবেয়া খাটে গেল, আর ফিরল না। কাপড় যে দিতে পারে না এমন মরদের পাশে আর শোবে না বলে রাবেয়া একটা বস্তায় কতকগুলি ইট-পাথর ভরে মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে গলায় বস্তার মুখটা দড়ি জড়িয়ে এঁটে বেঁধে পুকুরের জলের নীচে, পাঁকে গিয়ে শুয়ে রইল।