বাড়ির ঠিক মাঝখানে উঁচু চাঁচের বেড়া। খুব লম্বা মানুষের মাথা ছাড়িয়েও হাতখানেক উঁচু হবে। বেড়া ডিঙিয়ে কারও নজর চলবে না, অবশ্য যদি উঁচু কিছুর উপর দাঁড়িয়ে নজর চালানো না হয়। নজর দেধার অন্য উপায় আছে ফুটোতে চোখ পাতা।
বাড়িটাকে সমান দু ভাগ করেছে বেড়টিা, পশ্চিমের ভিটার লম্বা দাওয়া ভাগ করে, উঠান ভাগ করে সদরের বেড়ার চার হাত ফাঁকের ঠিক মাঝখান দিয়ে খানিক এগিয়ে বাড়িতে ঢুকবার এই ফাঁক আড়াল করতে দাঁড় করানো সামনের পর্দা বেড়াটার ঠিক মাঝখানে গিয়ে ঠেকেছে।
আগে, প্রায় সাত বছর আগে, গোবর্ধন ও জনার্দনের বাপ অনস্ত হার্তা যখন বেঁচে ছিল, তখন বাড়িতে ঢুকবার পথ ছিল একটা দক্ষিণ-পূব কোণে। এই পথের সামনেও বসগনা ছিল একটা আড়াল করা পর্দা-বেড়া। ভাগের সময় পথটা পড়েছিল জনার্দনের ভাগে। সদরের বেড়ার আরেক প্রান্তে, অর্থাৎ উত্তর-পুর কোণে বেড়া কেটে নতুন একটা প্রবেশ পথ করে নিতে অতান্ত অসুবিধা থাকায় গোল বেধেছিল। ঢুকবার-বেরোবার পথই যদি না থাকল, বাড়ির এমন ভাগ দিয়ে সে কী করবে- গোবর্ধন প্রতিবাদ জানিয়েছিল। মালিকদের মানতে হয়েছিল যে তার আপত্তি সঙ্গত। অনেক মাথা ঘামিয়ে তারপর সালিশরা, যাদের প্রধান ছিলেন সদরের সেরেস্তাদারের বাবা প্রাণধন চক্রবর্তী জ্যোতির্বিদ্যাভূষণ, ব্যবস্থা দিয়েছিলেন ভাগের বেড়ার দুপাশে সদর বেড়া দুহাত করে কেটে দুই অংশের ঢুকবার-বেরোবার পথ করা হোক, আর পুরানো পর্দা-বেড়া তুলে এনে স্থাপন করা হোক এই বিভক্ত পথের সামনে। কারণ ওবেড়াটাও সুভায়ের বাপের সম্পত্তি। অতএব দুজনের ওতে সমান অধিকার।
জনার্দন আপত্তি করে বলেছিল আড়াল-করা বেড়া সরালে সদর বেড়ার কোণের পুরানো পথের ফাঁকে রাস্তার লোক যে তার বাড়ির বউ-ঝিদের দেখতে পাবে, তার কী হবে? সে এমন কী অপরাধ করেছে যে, গাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে বন্ধ করতে হবে বেড়ার ফাঁক! রীতিমতো সমস্যার কথা। সালিশরা যখন মীমাংসা খুঁজতে মাথা ঘামাচ্ছেন, গোবর্ধন উদার ও উদাসভাবে বলেছিল, তিন হাত বেড়ার ফাঁক বন্ধ করার পয়সা খরচ করতে যদি জনার্দনের আপত্তি থাকে, সে এদিকের অংশ নিক। সদর বেড়ার ফাঁকের অসুবিধা ভোগ করতে গোবর্ধন রাজি আছে।
অনেক তর্কবিতর্কের পর সালিশরা হঠাৎ সমস্যাটার চমৎকার মীমাংসা আবিষ্কার করেন। কেন, দু পাশে দু হাত করে পথ করতে সদর বেড়ার মাঝখানে চার হাত অংশ তো কাটতেই হবে, তাই দিয়ে অনায়াসে বন্ধ করা যাবে জনার্দনের অংশের সদর ।বড়ার পুরানো ফাঁক।
এমনি দুর্যোধনি জেদি হিংসার চুলচেরা ভাগাভাগির প্রতীক হয়ে ভাগের বেড়াটি দাঁড়িয়ে আছে, সাত বছর। অনস্ত হাতীর শ্রাদ্ধের দশ দিন পরে বেড়াটা উঠেছিল। আদালত কুরুক্ষেত্রে তারপর যত লড়াই হয়ে গেছে দু ভায়ের মধ্যে জমিজমা নিয়ে, যত হাতাহাতি গালাগালি হয়ে গেছে বাগানের ফল, পুকুরের ঘাট, গাছের মরা ডালের ভাগ নিয়ে তারও যেন প্রতীক হয়ে আছে এই বেড়ার্টিই। জীর্ণ হয়ে এসেছে বেড়াটা, এখানে ওখানে মেরামত হয়েছে, আর এখানে পড়েছে মাটির চাবড়া, ওখানে গোঁজা হয়েছে ন্যাকড়া, সেখানে সাঁট! হয়েছে কাগজ।
বেড়ার ফুটোয় চোখ রেখে উঁকি মারা চলত-দু পাশ থেকেই। হঠাৎ গোবরগোলা জল বেড়া ডিঙিয়ে এসে পড়ত গায়ে। গোবর্ধনের মেয়ে পরীবালা একদিন চোখ পেতে আছে বেড়ার ফুটোয়, জনার্দনের মেয়ে তাকে তাকে থেকে একটা কঞ্চি সেই ফুটো দিয়ে চালান করে দিল তার চোখের মধ্যে। চোখ যায় যায় হল পরীবালার, মাথা ফাটে ফাটে হল গোবর্ধন ও জনার্দন দু ভায়ের, কদিন পাড়ায় কান পাতা গেল না দু বাড়ির মেয়েদের গলাবাজিতে। বেড়ায় কাঁথা-কাপড় শুকতে দিলে অদৃশ্য হয়ে যেত। এঁটোকাঁটা, নোংরা, ছেলেমেয়ের মল বেড়া ডিঙিয়ে পড়ত এক পাশ থেকে অনা পাশে। এ পাশের পুঁই বেড়া বেয়ে উঠে ও পাশের আয়ত্তে একটি ডগা একটু বাড়ালেই টেনে যতটা পারা যায় ছিঁড়ে নেওয়া হত। বেড়া ডিঙিয়ে অহরহ আসা যাওয়া করত সমালোচনা, মন্তব্য, গালাগালি, অভিশাপ। চেরা বাঁশের বেড়াটাকে মাকে রেখে এমন একটানা শত্রুতা চলত দু পাশের দুটি পরিবারের মধ্যে যে সময় সময় মনে হত কবে বুঝি ও পাশের চালা পুড়িয়ে দেবার কোঁক সামলাতে না পেরে এ পাশে নিজের চালাতেই আগুন ধরিয়ে দেয়!
গোলমাল এখনও চলে, বিদ্বেষ এখনও বজায় আছে পুরো মাত্রায়। তবে গোড়ার দিকের মতো খুঁটিনাটি তুচ্ছ ব্যাপাব নিয়ে অহরহ হাঙ্গামা চলে না, গায়ে পড়ে সহজে কেউ ঝগড়া বাধায় না। ঢিলটি মারলে যে পাটকেলটি খেতে হবে দুপাশের মানুষগুলি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে সংযম অভ্যাস করতে বাধ্য হয়েছে। আক্রমণাত্মক হিংসা কমে এসে এখন দাঁড়িয়েছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অবহেলাত্মক মনোভাবে। খোঁচাবার ও গায়ের ঝাল ঝাড়বার প্রক্রিয়াও ক্রমে ক্রমে বেশ কৌশলময় ও মার্জিত হয়ে উঠেছে। এ পাশের ছেলেমানুষ কানাই মাঝের বেড়ার মাহাত্মা ভুলে ও পাশে সমবয়সি বলাইয়ের সঙ্গে খেলতে গেলে, শত্রুপক্ষের ছেলেকে আয়ত্তে পেয়েও ও পাশের কেউ তাকে ধরে পিটিয়ে দেয় না, আচ্ছা করে মার দেওয়া হয় বলাইকে। এ পাশ থেকে হাঁক ওঠে, কানাই! কানাই এলে তাকে চড়চাপড় মেরে উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন করা হয়, ও বাড়ি মরতে গেছিলি কেন রে, বেহায়া পাজি বজ্জাত ও পাশ থেকে জবাব আসে বলাইয়ের প্রতি আরও জোর গলার শাসানোতে, ফের যদি ও বাড়ির কারও সঙ্গে তুই খেলিস হারামজাদা নচ্ছার...
দু পাশেই ছেলেমেয়ে আছে, হাজার বলে তাদের বোঝানোও যায় না যে, বেড়ার ও পাশ যেতে নেই। ছেলেমেয়েরা তাই নিরাপদ থাকে। তবে কুকুর বেড়ালের রেহাই নেই। এ পাশের বেড়াল ও পাশে হাঁড়ি খেতে গেলে তার রক্ষা থাকে না।
দু পাশের হাঁড়িই যখন প্রায় শূন্য থাকছে দুর্ভিক্ষের দিনে, জনার্দনের ছেলে চন্দ্রকুমারের বউ রাণীবালার পোষা বিড়ালটা মেউ মেউ করে বেড়াচ্ছে খিদেয় কাতর হয়ে, গোবর্ধন একদিন কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে এল আধসেরি একটা বুইমাছ। মাছ দেখে খুশি হয়ে হাসি ফুটল সবার মুখে, দু মুঠো চাল সেদিন বেশি নেওয়া হল এই উপলক্ষে। গোবর্ধনের ছেলে সূর্যকান্তের বউ লক্ষ্মীরাণী আঁশর্বটি পেতে কুটতে বসল মাছ।
মাছ কাটা শেষ হয়েছে, কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যকান্ত বউয়ের দিকে গোড়ায় যেমন তাকাত প্রায় সেই
রকম সপ্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাছের দিকে, কোথা থেকে রাণীবালার আদুরে বিড়াল এসে এক
টুকরো মাছ মুখে তুলে নিল। মাছকাটা বঁটিটা ভুলেই সূর্যকান্ত বসিয়ে দিল এক কোপ। রাণীবালার
আদুরে বিড়াল একটা আওয়াজ পর্যন্ত না করে মরে গেল। মাছের টুকরোটা মুখ থেকে খসে পড়ায়
লক্ষ্মীরাণী সেটা তুলে রাখল চুপড়িতে।
পাথর ধার থেকে মরা বিড়ালটা কুড়িয়ে নিয়ে গেল চণ্ডী বসাক। চাল ছিল না কিন্তু ঘরে তার একটু নুন আর একটু হলুদ-লংকা ছিল। ঘুরে ঘুরে হত্যা দিয়ে দুটি খুদকুড়ো চণ্ডী জোগাড় করে নিয়ে এল। ঝাল ঝাল বিড়ালের মাংস দিয়ে সেদিন সে দু বেলা ভোজ খেল সপরিবারে।
হত্যাকাণ্ডের খবরটা রাণীবলা পেল পাঁচুর মার কাছে। ও বাড়িতে পাঁচুর মা দুটি চালের জন্য গিয়েছিল, অনেকক্ষণ ধন্না দিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত পায়নি। নিজের চোখে সে ঘটনাটা দেখেছে আগাগোড়া। এ কী কাণ্ড মা, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করিস, হিংসে করে মা-ষষ্ঠীর বাহনকে মারলি
একাদশীর দিন, এত শত্রুতা?
দুটি চাল াদাব বড়? দে মা, দুটি চাল? বিড়াল ছানা দেব তোকে একটা, তোর পায়ে ধার খুদকুঁড়ো যা হোক দুটি দে।
কোথা পাব গো? চাল বাড়ন্ত। খুদকুঁড়ো শাউড়ি আগলে আছে।
বালে বিড়ালের শোকে রাণীবালা কাঁদতে থাকে, বাড়ির সকলের কাছে নালিশ জানায়। সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, অভিশাপও দিয়ে বসে ও পাশের খুনেদের। ছেলেবেলা থেকে রাণীবালা বিড়াল পুষতে ভালোবাসে, কত পোষা বিড়াল তার মরে আর হারিয়ে গেছে। ও বাড়ির শোক হত্যা না করলে হয়তো বিড়ালটার জন্য এত শোক তার হত না।
কিন্তু এমনি অবাক কাণ্ড, এই নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাধানোর বদলে জনার্দন তাকেই ধমক দিয়ে বলল, আঃ চুপ করো বাছা। বাড়াবাড়ি কোরো না।
চন্দ্রকান্তও প্রায় ধমকের সুরে বলল, তোমার বিড়াল যায় কেন চুরি করে পেতে?
রাণীবালা হকচকিয়ে যায়, ভেবে পায় না ব্যাপারখানা কাঁ। রাগে অভিমানে তার গা জ্বালা করে, ভাবে না খেয়ে শুয়ে থাকবে কিন্তু ভরসা পায় না। কারও পেট কলমিশাক সেদ্ধ দিয়ে দুটি ভাত খেয়ে ভরে না। কেউ যদি তাকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি না করে সে না খেয়ে গোসা করে শুয়ে থাকলেও।
চন্দ্রকান্ত তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় পুলপারের জমিটা না বেচে আর উপায় নেই। গোবর্ধন ও জনার্দন দু জনে মিলে না বেচলে জমিটা বেচবারও উপায় নেই। কাল দু জনে পরামর্শ
করে ঠিক করেছে প্রাণধন চক্রবর্তীকে জমিটা বেচে দেবে। এখন কোনো কারণে গোবর্ধন বিগড়ে গিয়ে বেঁকে বসলে মুশকিল হবে।
ঝগড়াঝাটি কোরো না গবরদার, কদিন মুখ বুজে থাকো।
বিড়াল মারার সময় গেবর্ধন উপস্থিত ছিল না। ফিরে এসে ব্যাপার শুনে সেও অসন্তুষ্ট হয়ে সুর্যকে বলে, একটু কাণ্ডজ্ঞান নেই তোদের ? এমনি করে ফ্যাকড়া বাধাও, ব্যাস, জমি বেচাও খতম। খেয়ো তখন কচুপোড়া সিদ্ধ করে। খবরদার, কেউ ঝগড়া করবে না ওদের সাথে। মুখ বুজে থাকে! কদিন।
সাত বছরের শত্রুতা স্বার্থের খাতিরে একদিনে হঠাৎ স্থগিত হয়ে গেল। দু পারেই কটু কথা যদি বা কিছু বলা হল, হল চুপিচুপি, চাপা গলায়, নিজেদের মধ্যে। এপার কথা বলল না বটে ওপারের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু ওপারকে শোনাবার জন্যই এপার চেঁচাল, ও কানাই, ওদের বেগুন খেতে গরু ঢুকেছেরে। ওপারও চেঁচাল এপারকে শুনিয়ে, ও বলাই, ওদের পুঁটু পুকুরপাড়ে একলা গেছে রে! আমতলায় কানাই বলাইকে খেলতে দেখে কোনো পার কিছু বলল না। এপারের ছেলে ওপারে যাওয়ায় ওপারের ছেলে চড় খেল না। লক্ষ্মীরাণীর বিড়াল প্রায় সারাটা দুপুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল ওপারের দাওয়ার কোণে জড়ো করা ছেঁড়া চটে। হাতটা মনটা বারবার নিশপিশ করে উঠলেও রাণীবালা পর্যন্ত তাকে কিছু বললে না। ওপারের পুঁইগাছের সতেজ ডগাটি লকলক করে বাতাসে দুলতে লাগল এপারের এলাকায়।
কথা যা বলাবলি হল তিন দিনে দু পারের মধ্যে, তা শুধু গোবর্ধন আর জনার্দনের জমি বিক্রি নিয়ে গম্ভীর নৈর্বাক্তিক কথা, তবু এ ভাবেও তো সাত বছর তার কথা বলেনি।
দলিল রেজিস্ট্রি করিয়ে টাকা পাবার দিন সকালে বেড়ার এপার থেকেই গোবর্ধন বলে, কখন রওনা হবে, জনা?
এই খানিক বাদেই, জবাব দিয়ে, একটু থেমে জনার্দন যোগ দেয়, ফেলনার জ্বরটা বেড়েছে। ফেলনা রাণীবালার ছেলে।
একসাথে বেরোয় দু জনে, জনার্দন ডাক দিয়ে নিয়ে যায় গোবর্ধনকে। একসাথে বাড়ি থেকে বেরোবার কোনো দরকার অবশ্য ছিল না। চক্রবর্তীর বাড়ি হয়ে তারা সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে রওনা হবে, একে একে গিয়ে সেখানে জুটলেও চলত। কিন্তু সাত বছর বিবাদ করে আর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কাটাবার পর দু ভাই যখন শান্তভাবে কদিন ধরে কথা বলে, তখন কি আর দরকার আছে অত হিসেব করে সব কাজ করার! দু জনে চলতে থাকে একরকম নির্বাক হয়েই। মাঝে মাঝে এ ওর মুখের দিকে তাকায় আড়চোখে। সাত বছরে দু জনের বয়স যেন বিশ বছর বেড়ে গেছে সংসারের চাপে, দুর্ভিক্ষের গত দু বছরেই যেন বেশি বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও কী আছে ভগবান জানেন।
দরটা সুবিধা হল না।
উপায় কী?
ডবল দরে এমন জমি মিলবে না।
ঠিক। লতিফের সেচা জমির চেয়ে ভালো ফসল দিয়েছে গতবার। গোবর্ধন এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে পড়ে।-শোন <লি, জনা। না বেচলে হয় না জমিটা? এক কাজ করি আয়। না বেচে বাঁধা রাখি, পারি তো ছাড়িয়ে নেব দু জনে মিলে।
চক্কোত্তি মশায় কি রাজি হবে?
রাজি না হয়তো মধু সার কাছে বাঁধা দেব। নয়তো রথতলার নিকুঞ্জকে। বেচে দিলে তো গেল জন্মের মতো। যদি রাখা যায়!
গাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোবর্ধন ও জনার্দন-অনন্ত হাতীর দুই ছেলে, কথাটা বিচার ও বিবেচনা করে দেখতে থাকে। দেখে লোকের মনে হয় যেন আলাপ করছে দুটি স্যাপ্তাত।
এদিকে জ্বর বাড়তে বাড়তে ফেলনার যায় যায় অবস্থা হয় দুপুর বেলা। চাঁচের বেড়া থাকলেও ওপারে সব টের পায় সবাই। সূর্যের মা ইতস্তত করে অনেকক্ষণ, ফিসফিস করে সূর্য আর লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করে কয়েকবার, যাব নাকি? তারপর বেলা পড়ে এলে সতীরাণীর বিনুনি কান্না শুনে হঠাৎ মনস্থির করে সাত বছর পরে সূর্যের মা বেড়ার ওপারে যায়, আস্তে আস্তে গিয়ে বসে ফেলনার শিয়রে চাঁদের মার পাশে। সন্ধ্যার আগে ফেলনা মারা গেলে মড়া কান্না শুনে এপারের বাকি সকলেও হাজির হয় ওপারে। সাত বছরে পাঁচবার মড়া কান্না উঠেছে জনার্দনের অংশে, কিন্তু গোবর্ধনের অংশ থেকে বেড়া পেরিয়ে কেউ কখনও আসেনি। সাত বছর পরে আজ বেড়ার দুদিকের মেয়েরা বেড়ার একদিকে হয়ে একসঙ্গে কাঁদতে আরম্ভ করে। চাঁদ শোকের নেশায় পাগলের মতো কাণ্ড আরম্ভ করলে সূর্য তাকে ধরে রাখে। একটু রাত করে গোবর্ধন ও জনার্দন যখন বাড়ি ফেরে তখনও দেখা যায় ওপারের প্রায় সকলেই রয়েছে এপারে, ওপারের ছেলেমেয়েগুলি ঘুমিয়ে পড়েছে এপারের মাদুরে কাঁথায়, এপারের ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে।
তাই বলে যে খিটিমিটি ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে গেল দু পারের মধ্যে চিরদিনের জন্য, উঠানের মাঝখানে পুরানো চাঁচের বেড়াটা থেকেও রইল না, তা নয়। মানুষ তাহলে দেবতা হয়ে যেত। তবে পরের আশ্বিনের ঝড়ে পচা বেড়া পড়ে গেলে সেটা আবার দাঁড় করাবার তাগিদ কোনো পারেরই দেখা গেল না। বেড়াটা ভেঙে জ্বালানো হতে লাগল দু পারেরই উনানে। দু পারের কাঁটার সঙ্গেও সাফ হয়ে যেতে লাগল বেড়ার টুকরোর আবর্জনা। শেষে একদিন দেখা গেল দাওয়ার বেড়াটি ছাড়া উঠানে বেড়ার চিহ্নও নেই, বাড়ির মেয়েদের ঝাঁটায় দুটির বদলে একটি উঠান তকতক করছে।