পুলকেশের সিনেমা দেখার নেশা একেবারে ছিল না। যতীনেরও তাই। সত্যিকারের কোনো ভালো ছবির খবর পেলে, রুচি, রসবোধ আর বিচারশক্তি আছে বলে তারা বিশ্বাস করে এমন কোনো বিশ্বাসী লোকের কাছে খবর পেলে হয়তো কখনও নিজেরা শখ করে গিয়ে দেখে আসত ছবিটা। তাছাড়া ইচ্ছে করে কখনোই তারা সিনেমায় যেত না। মাঝে মাঝে তবু যে যেতে হত তার কারণ ছিল ভিন্ন। সিনেমা যাবার ভীষণ শখ আছে অথচ কেউ না নিয়ে গেলে যেতে পারে না এমন যার বা যাদের আবদার এড়ানো চলে না, তাকে বা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হত।
ছায়াছবি যে একেবারে তারা দু বন্ধু উপভোগ করে না তা নয়। একটু উলটোভাবে কিছু কিছু উপভোগ করে দর্শকের যেরকম উপভোগের জন্য ছবিটা মোটেই তৈরি হয়নি। বাংলা আর হিন্দি ছবি হলেই পুলকেশ আর যতীনের অভিনব উপভোগটা জমে বেশি। উদ্ভট অবাস্তব সৃষ্টিছাড়া একঘেয়ে কাহিনি, চরিত্রগুলির অমানুষিক খাপছাড়া আর সঙ্গতিহীন কথাবার্তা, চালচলন, ভাবভঙ্গি, যেখানে সেখানে গান, উৎকট হাসি কান্না আর ভাঁড়ামি ইত্যাদি তাদের হাসির অনেক খোরাক জোটায়। অন্য সকলের তন্ময়তার মর্যাদা রাখার জন্য যেখানে সশব্দে হাসা সম্ভব হয় না সেখানে মুখে রুমাল গুঁজে হাসিটা চাপা দেয়। সময়টা তাই একরকম তাদের কেটে যায় হাই না ভুলে, ঘুম না পেয়ে। মৃন্ময়ী একদিন আশ্চর্য হয়ে পুলকেশকে বলেছিল, তুমি কেঁদে ফেললে। দৃশাটা খুব করুণ
সত্যি, কিন্তু-
কোন দৃশ্যটা ?
মেয়েটা যেখানে রাতদুপুরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে-
ও দৃশ্যটা করুণ নাকি? আমার তো ভারী কমিক লাগছিল। এত কাণ্ডের পর অচেন। বাপের সঙ্গে রাতদুপুরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয়? আমরা নয় জানি ও লোকটা মেয়েটার বাপ। কিন্তু মেয়েটাও কি তা জানে? আমি তো ভাবছিলাম মেয়েটা যাতে বাড়িতেই থাকে তার জন্য
প্লট এত ঘোরাল করা হচ্ছে।
মৃন্ময়ী আহত হয়ে বলে, ও, তুমি কাঁদেননি? হাসি চাপছিলে।
দেহমনে স্বাস্থ্য, জীবনে আনন্দ, অসংগতির হাস্যকর দিকটাই চোখে পড়ে আগে। তাই, জীবনের সঙ্গে ছবিগুলির সংযোগের অভাব দেখে, কষ্টকল্পনা দেখে, সস্তা ও হালকা রোমান্সের গ্যাজলা রস থইথই করতে দেখে, এমন কী মানুষের মনে ছবিগুলির প্রভাব যে কিছু কিছু ক্ষতিকর তা ভেবেও, পুলকেশরাও বিদ্বেষমূলক সমালোচনার ঝাঁঝ অনুভব করে না। এই সব ছবি দেখার জন্য যারা পাগল তাদের প্রতি অবজ্ঞার ভাবও পোষণ করে না। কেবল এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে যায় যে ছেলেভুলানো এ জিনিস দিয়ে বয়স্ক মানুষ নিজেকে ভোলায় কী করে! নিজেদের ভোলাবার এত জিনিস রয়েছে জগতে। এ রকম আশ্চর্য হওয়ার মধ্যে নিজেদের বেশ বস্তুতান্ত্রিক ভাবপ্রবণতাহীন মনে হয় বলে খুব তারা গর্ব অনুভব করে।
তারপর জীবন আসে পরবর্তী বাস্তব অধ্যায়ের নিয়ম, অনিয়ম, প্রয়োজন আর ঘাতপ্রতিঘাতের সূচনা নিয়ে। যেভাবে আরম্ভ করবে ভেবেছিল, পুলকেশ বা যতীন কারও আরম্ভটাই সে রকম হয় না। হাসিমুখেই তারা সেই আরস্তকে গ্রহণ করে এবং প্রয়োজন হওয়ায় বৈচিত্র্যময় প্রেমের লীলাখেলায় কত সময় যে তার কোথা দিয়ে কেটে যায়।
শেষের তিন বছর একবারও পুলকেশ কোনো সিনেমায় যায়নি। এই নিয়েই একদিন মৃন্ময়ীর সঙ্গে তার দারুণ কলহ হয়ে গেল। সিনেমায় মৃন্ময়ী হরদম যায়, অন্যের সঙ্গে। কিন্তু কেন তা হবে? কেন তাকে পুলকেশ একদিন সিনেমায় নিয়ে যেতে পারবে না? কোন স্বামী এ রকম ব্যবহার করে স্ত্রীর সঙ্গো ? তার নিজের যেতে ভালো না লাগুক, মৃন্ময়ীর কি শশ্ব থাকতে নেই।
আরেকদিন নিয়ে যাব।
আরেকদিন কেন? আজ নিয়ে চলো।
তাই করতে হল শেষ পর্যন্ত। বহুদিন পরে পুলকেশ সেদিন একটি বাংলা ছবি দেখস। খাপছাড়া অদ্ভুত মনে হল বটে ছবিটা, কিন্তু আজ আর হাস্যকর মনে হল না। এমন কী অজানা নতুন তরুণ ডাক্তার পাড়াগাঁয়ে পা দেওয়া মাত্র কম্পাউন্ডারের বয়স্থা কুমারী মেয়েকে তার সঙ্গে মাঠে গিয়ে নৃত্যচ্ছন্দে লাফাতে লাফাতে ডুয়েট গান করতে দেখেও তার হাসি পেল না, বরং বেশ মিষ্টি আর রসালোই লাগল ব্যাপারটা।
মশগুল হয়েই পুলাকেশ শেষ পর্যন্ত ছবিটা দেখে ও শুনে গেল।
পরের শনিবার অফিসের এক সহকর্মীর সঙ্গে সে আবার সিনেমায় গেল। পরের সপ্তাহে গেল তিনবার। কয়েকমাসের মধ্যে সে নিয়মিত ভাবে সিনেমায় যেতে এবং ভালোমন্দ নির্বিচারে ছবিগুলি তন্ময় হয়ে দেখতে আরম্ভ করল। বন্ধুদের সঙ্গে ছবি আর তারকাদের বিষয় আলোচনা ও তর্ক করে কেটে ফেলতে লাগল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
একদিন ম্যাটিনিতে নাচে গানে প্রেমে বিচ্ছেদে আর শেষ মিনিটের মিলনে জমকালো এক ছবি দেখে পুলকেশ বাইরে এসেছে, দেখা হল যতীনের সঙ্গে। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছিল, যতীন ছাতি মাথায় দিয়ে হাঁটছিল ফুটপাতে। যতীনকে হঠাৎ দেখে পুলকেশ চিনতে পারত কিনা সন্দেহ। তার শরীর ভেঙে পড়েছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে আধময়লা আমাকাপড়। যতীন নিজেই তাকে দেখে কাছে এগিয়ে এল।
এতদিন পরে দেখা, কিন্তু এমনি নির্জীব হয়ে পড়েছে দু জন যে উল্লাসটা তেমন জোরালো হল না। কিছুটা আশ্চর্য আর কিছুটা খুশি হয়ে পুলকেশ বলল, যতীন। কলকাতা এলি কবে? যতীন বলল, মাসখানেক। তোর বাড়ি যাব যাব ভাবছিলাম, হয়ে ওঠেনি।
যতীনের মুখে পুলকেশ মদের গন্ধ পায়। চোখে দেখতে পায় নেশার আবেশ। কথায় একটা অস্বাভাবিক টলোমলো প্রফুল্লতা। দুই বন্ধু কথা বলে ধীরে সুস্থে, খবর নেয় আর দেয় ছাড়া ছাড়া ভাবে এতগুলি বছর ধরে অজস্র কথা জমেছে কিন্তু বলার বা শোনার তাড়া যেন তাদের নেই। যতীন বলে, আয়, বসে কথাবার্তা কই।
কোথায় বসবি?
আয় না। কাছেই।
খানিক এগিয়ে বাঁয়ে গলির মধ্যে একটা দেশি মদের দোকানে যতীন তাকে নিয়ে যায়। শনিবারের বিকাল, ইতিমধ্যেই লোক জামে জায়গাটা গমগম করছে ছেঁড়া কাপড় পরা খালিগায়ের লোক থেকে ফরসা জামাকাপড় পরা পর্যন্ত সব ধরনের বাঙালি ও অবাঙালি লোক। দোকানঘরের বেঞ্চিগুলি সব ভরতি, দাঁড়িয়ে এবং উবু হয়ে বসেও অনেকে মদ খাচ্ছে। পাশের ঘরে একটা বেঞ্চে জায়গা ছিল, পুলকেশকে বসিয়ে যতীন বলে, বোস, একটা পাঁট আনি। একটু সেলিব্রেট করা যাক।
আমি তো ও সব খাই না।
একদিন একটু খাবি, তাতে কী হয়েছে? অ্যাদ্দিন পরে দেখা, একটু ফুর্তি না করলে হয় ? এখানে ঢুকেই যতীনকে আগের চেয়ে বেশি তাজা, বেশি উৎসাহী মনে হচ্ছে। সেলিব্রেট করার একটা ভালো উপলক্ষ পেয়ে সে যে ভারী খুশি হয়েছে বেশ বোঝা যায়, বেশি মদ খাওয়ার জন্য নিজের মনটা আর তাকে কামড়াবে না। পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে যুক্তি পেয়েছে, কৈফিয়ত পেয়েছে, সমর্থন পেয়েছে বেশি মদ খাবার। যতীন মদ আনতে যায়, পুলকেশ বসে বসে ভাবে। যতীনের অধঃপতনে মনটা তার খারাপ হয়ে যায়।
যতীন এসে বসলে সে জিজ্ঞেস করে, কদিন খাচ্ছিস?
বছর দু-তিন?
এটা ধরলি কেন?
প্রশ্ন শুনে যতীন হাসে।-খেলে একটু ভালো লাগে আবার কেন।
গেলাসে মদ ঢেলে ঢেলে খেতে খেতে যতীনের অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে, কথা সে বলতে থাকে তাড়াতাড়ি, বেশি বেশি। একবার চুমুক দিয়েই পুলকেশের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছিল, বমি ঠেলে উঠেছিল। আর খাবার চেষ্টা না করে সে যতীনের কথা শুনে যায়। অদৃষ্ট বাড়ো খারাপ ব্যবহার করেছে যতীনের সঙ্গে, ঘা মেরে মেরে থেঁতলে দিয়েছে জীবনটা, কোনোদিন বিশেষ সুবিধা করতে দেয়নি: চাকরির গোড়ায় বাপ মারা গেল। কিছু টাকা হাতে পেয়ে চাকরি ছোড়ে একটা ব্যাবসা আরম্ভ করেছিল, সুবিধা হল না। বিমার দালালি করেছিল কিছুদিন, সুবিধা হল না। একটা এজেন্সির কারবার ধরেছিল, সেটাতে কিছু হল না। দুটো ছেলে হবার পর বউটা পড়ল অসুখে, সেই থেকে একটানা ভুগছে। বোনের বিয়ে দিয়েছিল, বোনটাকে তার স্বামী নেয় না। বিরক্ত হয়ে সকলকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সে কলকাতায় নতুন একটা ব্যাবসা ফেঁদেছে।
সংসারের হাঙ্গামা নেই, খরাচর টাকা পাঠাই, ব্যাস। এবার ঠিক গুছিয়ে নেব। দু বছরের মধ্যে যদি না মেটির কিনি তো--
জমজমাট নেশা হয়েছে যতীনের। সগর্বে বুক ঠুকে সে পুলকেশকে শোনায় ব্যাবসাতে তার কেমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি, অল্পদিনে কী ভাবে সে ফেঁপে উঠবে, অন্য লোকেরা কী ভুল করে আর সে কী ভুল করবে না, এমনি সব বড়ো বড়ো কথা। জীবনে অসামান্য সাফল্য গাভের অহংকারেই সে যেন সিধে হয়ে বসে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
পুলকেশ তার দিকে চেয়ে, থাকে। ভাবে, নটার শোয়ে প্রিয় ছবিটা তৃতীয়বার দেখতে যাবার সময় ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, না একাই যাবে।