কৈলাস বসুকে সকলে স্বার্থপর আর সংকীর্ণচেতা বলে জানে। মানুষটার চালচলন আচার বাবহার তো বটেই, চেহারাও সকলের এই ধারণাকে অনেকটা সমর্থন করে। বেঁাঁটি, আঁটোসাঁটো ধরনের মোটা, প্রায় গোলাকার মাথায় বুরুশের মতো শক্ত ছোটো ছোটো করে ছাঁটা চুল, লম্বা নাকের দু পাশে মোটা সূর নীচে খুদে খুদে দুটি চোখ। চোখ দুটিকে কটাই বলা চলে। ছোটো এবং কটা, তবু সে চোখের দৃষ্টি বড়ো বড়ো নিকষ কালো চোখের অধিকারীদের কাছে বড়ো বেশি স্পষ্ট সমালোচনা আর তিরস্কারে ভরা মনে হয়। মুখের অটিক নেই এমন অভদ্র মানুষকে এড়ানোর মতো সকলের চোখ তাই কৈলাস বসুর চোখকে এড়িয়ে চলে।
কৈলাস কথা যে কম বলে তা নয়, মৃদু রসিকতা ভরা হাসির সঙ্গে মিস্টিকথাই সাধারণত বলে, তবু লোকের মনে হয় সে যেন বড়ো বেশি গম্ভীর, সব সময় মুখ বুজে কেবল নিজের কথা ভাবছে।
কারণটা সম্ভবত এই যে, অনেনর বক্তব্যের সঙ্গে প্রায়ই তার কথার কোনো যোগ থাকে না। অবিনাশ চক্রবর্তীর সঙ্গে হয়তো তার দেখা হয়ে গেল, তাকে চমকিয়ে দেবার জন্য অবিনাশ হয়তো সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, ঘোষালের কীতিটা শুনেছেন, দাদা-ওপাড়ার কেদার ঘোষালের নতুন কীবৃতি ছি, ছি! ভদ্দরলোকের এমন প্রিবিত্তি হয়, এমন কাজ ভদ্দরলোকে করে।-
কৈলাস হয়তো জিজ্ঞেস করে, ছেলের কোনো খপর পেলেন চকোন্তি মশায়? চিঠিপত্র এল ? অবিনাশ একটু দমে যায়। শহরবাসী রোজগেরে ছেলে তাকে ত্যাগ করেছে সত্য, চিঠিও লেখে না খবরও পাঠায় না, কিন্তু এই কি সে কথা তুলবার সময়। সহানুভূতি জানানোর তো সময় আছে । তবু ধৈর্য ধরে অবিনাশ হয়তো বলে, না, চিঠিপত্তর পাইনি। কী জানেন দাদা, এ যুৎতাই এ রকম, কারও কাণ্ডজ্ঞান নেই। নইলে সোষাল এমন কাণ্ডটা করতে পারে। বামুন মানুষ তুই, গলায় তোল পইতে আছে, সনদেবেলা তুই ঝিনা এক জেলেমাগির ঘরে-
কৈলাস হয়তো আবার বলে, সেই যে পাত্রটির সন্ধান পেয়েছিলেন খুকির জন্যে, কতদূর এগোল প্রস্তাবটা?
অবিনাশের হতে দাঁত সুড়সুড় করে, কৈলাসের গালে এক থা বসিয়ে দিতে, গায়ের কোথাও কামড়ে দিতে।
নবীন সরকারের দাওয়ায় বসে হয়তো পাঁচজনে নানা কথা আলাপ করছে। সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সেক্রেটারি কাঁসে সমস্ত টাকা খরচ করে ফেলল যে সাত টাকা এগারো আনা বিপিন মুদির দোকানে ধার থেকে গেল, সকলে যখন এ সমস্যার কুলকিনারা পাচ্ছে না, কৈলাস হয়তো তখন আপন মনে বকে চলেছে, এ বছর বর্ষা কম হওয়ার ফলটা এ পর্যন্ত কী দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে। গ্রামান্তরে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার সময় ভূষণের বিধবা শালির গর্ভটা ঠিক ক মাসের হয়েছিল, সকলে যখন এই তর্কে মশগুল হয়ে আছে, কৈলাস হয়তো তখন কেবলই সকলকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছে যে, বিপিন মুদির দোকানে দুর্গোৎসবের ধারটা সে এখন ঘরের পয়সা দিয়ে মিটিয়ে দেবে বলেনি, কয়েকজনের কাছে তার যে টাকাটা পাওনা আছে সেটা পেলে তখন মিটিয়ে দেবে।
এ কী কথা বলা? আলাপ করা? এ ভাবে কথা বলার চেয়ে মুখ বুজে থাকা কি ভালো নয়? কৈলাস কখনও কোথাও চার আনার বেশি চাঁদা দেয় না, কোনো উপলক্ষেই নয়। অন্তত পাঁচ টাকায় বিক্রি করা চলে এমন কিছু বাঁধা না দিলে পাঁচটা টাকা ধার পর্যন্ত দেয় না। পাড়ায় যে থাকে, যার ছেলে শহরে একশো টাকা বেতনে চাকরি করে, তাকে পর্যন্ত নয়। হাসি মুখে আবার বলে যে, এ ভাবে টাকা ধার না দিলে শোধ করার কথাটা কারও মনে থাকে না, শোধ করার চেষ্টাও থাকে না। সকলের চোখের উপরে নিজের খুশিমতো সে একটি ছোটো পাকা বাড়ি তুলেছে-ক খানা এবং কতবড়ো ঘর করা উচিত, দরজা জানালা কী রকম হলে ভালো হয়, এ সব বিষয়ে কারও একটা পরামর্শও কানে তোলেনি। পথ সংক্ষেপ করতে সকলে পায়ে পায়ে তার জমির উপর যে পথটি গড়ে ভুলেছিল, বিনা দ্বিধায় তার উপর রান্নাঘর তুলে পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। অনুযোগ অভিযোগের জবাবে হাসিমুখে বলেছে, কয়েক গজ বেশি হাঁটা মানুষের পক্ষে সমান কথা। পঞ্চাশ হাত তফাতের পথটাতেই যখন কাজ চলে সে কেন অন্য জায়গায় রান্নাঘর তুলে অসুবিধা ভোগ করবে?
কেদার ঘোষাল সকলকে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু কেউ সাহস করেনি। অন্য লোকে হয়তো মামলার নামেই একটা মিটমাটের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠত, তার জমির উপর দিয়ে পাড়ার লোকের হাঁটবার অধিকারের বদলে কমপক্ষে পাড়ার লোককে মস্ত একটা ভোজ দিয়ে দিও। কিন্তু কৈলাস হয়তো মামলার নামেই আগে কলকাতা থেকে উকিল ব্যারিস্টার আনাবার ব্যবস্থা করে রাখবে।
কৈলাসের স্ত্রী অভয়ার একটু ঝগড়া করা শখ। কিন্তু সাতটি ছেলেমেয়ে আর স্বার্থপর স্বামীর জন্য বেচারির শখটা ভালো করে মিটতে না মিটতে প্রায় চাপাই পড়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে সে অনুযোগ করে বলে, মানবের সঙ্গে একটু মানিয়ে চলতে পার না?
কৈলাস আশ্চর্য ও আহত হওয়ার ভান করে বলে, কেন, তোমার সঙ্গে মানিয়ে চলি না? মানিয়ে যা চল তা ভগবানই জানেন। আমার কপাল মন্দ তাই তোমার হাতে পড়েছিলাম। লোকের নামে কুৎসা রটিয়ে বেড়াও কেন তুমি? তোমার কী দরকার নিন্দে করে? সকলকে চটিয়ে লাভ কি শুনি?
কৈলাস জবাব দেয় না। এও তার এক ধরনের স্বার্থপরতা, নিজেকে সমর্থন করার জন্যও নিজেব স্ত্রীর সঙ্গে তর্ক করতে চায় না। অভয়ার অনুযোগটাও মিথ্যা নয়। কারও কুৎসা কৈলাস কানে তুলতে চায় না, উৎসাহী প্রচারককে বাজে কথা বলে দমিয়ে দেয়, তবু যে কী করে কুৎসা- প্রচারক হিসাবে তারই নামে কুৎসা রটে যায়। তার কথায় লোকে বিশ্বাস করে বলে হয়তো প্রচারকামীরা ইচ্ছা করে তার নামটা ব্যবহার করে। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে সে এমনভাবে নিজের নিজের অন্যায়গুলি উপলব্ধি করায় যে অন্যের অপবাদ কানে এলে সকলের মনে হয়, সে ছাড়া আর কে চোখে আঙুল দিয়ে পরের অপবাদ দেখিয়ে দেবে ।
কেদার ঘোষালের আধুনিকতম কলঙ্কের সঙ্গে তার নামটা বড়ো বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। অবিনাশ চক্রবর্তী রাধারমণ ভট্টাচার্যকে বলেছিল, কৈলাস বোসের অহংকার আর তো সয় না দাদা। নিজের চোখে যা না দেখবে তাই হেসে উড়িয়ে দেবে, সবাই যেন মিথ্যেবাদী। কেদার ঘোষালের ব্যাপারটা বললাম, শুনে আমার সঙ্গে তামাশা জুড়ে দিল। আমি যেন ওর তামাশার পাত্তর।
আরও অনেক কথা অবিনাশ বলেছিল। পরদিন রটে গিয়েছিল, কৈলাস স্বীকার করেছে যে সে নিজের চোখে কেদার ঘোষালকে জেলেমাগির ঘরে ঢুকতে দেখেছে। রটনাটি আরও খানিকটা বিকৃতভাবে স্বয়ং কেদার ঘোষালের কানে গিয়ে পৌঁচেছে: সুতরাং কেদার ঘোষাল ভয়ানক চটে গেছে। কৈলাস বদনাম রটিয়েছে কলে শুধু নয়, বদনামটা একেবারে মিথ্যা বলে। জেলেপাড়ায় কেদার গিয়েছিল কিন্তু কোনো জেলেমাগির ঘরে ঢোকেনি। কে না জানে যে আজকাল সে কেবল জেলে পাড়া নয়, কুমোরপাড়া, তাঁতিপাড়া, বাগদিপাড়া সব পাড়াতেই যাতায়াত করছে? মিউনিসিপ্যালিটির সে সদস্য, এখানকার সর্বপ্রধান নেতা, সে যদি এ সব পাড়ায় না যায়, কে যাবে? এতদিন প্রয়োজন ছিল না, যায়নি, এখন প্রয়োজন হয়েছে, যাচ্ছে। ও সব গরিব দুর্ভাগাদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য সে যে চেষ্টা আরম্ভ করেছে, সেটা তো সকলে জানে! অন্তত, জানা তো উচিত সকলের? তবু তার নামে এই মিথ্যা বদনাম।
আসলে বদনামটা কিন্তু খুব বেশি ছড়ায়নি। দু-চারদিন একটু ফিসফাস করে চুপ করে গিয়েছিল। কেদারের চরিত্রগত বেশ সুনাম আছে চারিদিকে। সকলে তাকে ভদ্র, সংযত, ভালোমানুষ বলেই অনেকদিন হতে জানে। মানুষটা সে উদার, পরোপকারী। সর্বত্র সে যে অনেকের চেয়ে বেশি টাকা চাঁদা দেয় তা নয়, মাঝে মাঝে নানা প্রতিষ্ঠানে মোটা টাকা দানও করে। তাকে ছাড়া সভাসমিতি হয় না, নতুন পরিকল্পনা দাঁড়ায় না। স্থানীয় হাসপাতাল, স্কুল, লাইব্রেরি প্রভৃতি সমস্ত সাধারণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তার যোগ আছে। বন্ধু ও পরিচিত সকলেই তাকে পছন্দ করে, অনেক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারে তার পরামর্শও জিজ্ঞেস করতে আসে।
একটিমাত্র খাপছাড়া বানানো বদনামে এ রকম জনপ্রিয় মানুষের সুনাম নষ্ট হয় না। তবু, একটু ভয় পেয়ে ছোটোলোকদের পাড়ায় যাওয়া কেদার অনেক কমিয়ে দিল। এক মাসের মধ্যে জেলেপাড়ার ধারেকাছেও ভিড়ল না। কিন্তু একেবারে না গেলেও তো চলে না, নেতৃত্ব বজায় রাখা চাই। তাছাড়া ওদের অবস্থাও সত্যসতাই বড়ো শোচনীয়, ওদের জন্য যতটুকু পারা যায় না করলেই বা চলবে কেন? তাই, সকালের দিকে মাঝে মাঝে কেদার ও সব পাড়ায় যায় এবং কমপক্ষে সাত আটজন অনুগত ও উৎসাহী কর্মীকে সব সময় বডিগার্ডের মতো সঙ্গে সঙ্গে রাখে।
আগেও অবশ্য এ রকম বডিগার্ড দু-একজন কেদারের সঙ্গে থাকত। একা ও সব পাড়ায় যেতে তার চিরদিনই ভয় করে। এখন ছোটোখাটো একটি দল বেঁধে যায়, কেউ যাতে আর কোনোমতেই ভুল করতে না পারে যে তার ভালো ছাড়া মন্দ কোনো উদ্দেশ্য আছে। কৈলাসও মাঝে মাঝে ও সব অঞ্চলে যায় তবে কেদারের মতো কখনও নেতা হিসাবে উপরে উঠবার প্রেরণায়, কখনও গোরু ছাগলের মতো যারা জীবন কাটায় তাদের জন্য কিছু করবার সুখে, কখনও বা নবযুগের নতুন মতাবলম্বী অল্পবয়সি অনুগত কর্মীদের সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় অবশ্য ওদিকে যায় না, নিছক তার নিজের দরকারে। ওখানকার অনেকেই তার কাছে টাকা ধারে। টাকার পরিমাণটা অবশ্য খুবই কম, গরিবকে কৈলাস কখনও দু-পাঁচটাকার বেশি ধার দেয় না এবং সুবিধামতো হয় টাকায়, নয় মাঠের ধানে, বিলের মাছে, গোয়ালের দুধে, তাঁতের কাপড়ে নিজের প্রাপ্য আদায় করে নেয়। কৈলাসের নিজের কিছু জমি আছে, সেই জমিতে খেটে যদি কেউ দেনা শোধ করতে চায় তাতেও কৈলাস আপত্তি করে না। তবে সুদটা কৈলাসকে নগদ দিতে হয়-পাঁচ টাকা পর্যন্ত মাসিক এক পয়সা সুদ।
মফস্বলের ছোটো শহর, কোথায় শহরের শেষ আর গ্রামের আরম্ভ সরকারি কাগজপত্রের নির্দেশ দেখেও সেটা ঠিক করা যায় কিনা সন্দেহ। একদিন তাই নকুড় পালের বাড়ির সামনে কৈলাস আর কেদারের দেখা হয়ে গেল। এগারোজন বডিগার্ড অর্ধচন্দ্রাকারে কেদারকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, হাত তিনেক তফাতে নকুড়ের আশপাশে এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার কুড়ি বাইশজন লোক। কমবয়সি ছেলেমেয়েও জুটেছে অনেক, কাছাকাছি প্রায় সমস্ত বাড়ির বেড়ার ফাঁকে মেয়েদের মুখ উকি দিচ্ছে।
সকলকে জড়ো করে কেদার সবে বলতে আরম্ভ করেছিল, কৈলাস একপাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। কৈলাসের উপর রাগ ছিল, সেই জন্য বোধ হয় তাকে দেখে কেদারের উৎসাহ গেল বেড়ে, অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি আবেগের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে রোগ আর দারিদ্রোর পীড়নে সকলের কী শোচনীয় অবস্থা হয়েছে সকলকে তাই ভালো করে বুঝিয়ে দিল। এ অবস্থার প্রতিকারের জন্য সকলের যে প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত, এই কথাটা বুঝিয়ে দিতেও তার সময় লাগল অনেকটা। কেদারের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র কৈলাস সায় দিয়ে বলল, ঠিক কথা, ঠিক বলেছেন। তারপর মুখে একটা জোরালো আপশোশের আওয়াজ করে বলল, তবে কি জানেন, বেচারিরা করবে কী, করবার যে কিছু নেই।
কেদার রাগ করে বলল, করবার কিছু নেই মানে ?
কী আছে বলুন?
ওই যে বললাম, সকলে মিলে চেষ্টা করতে হবে?
বেশ বোঝা যাচ্ছিল কেদারের বক্তৃতায় কৈলাসের মন রীতিমতো নাড়া খেয়েছে, এ কথায় সেও যেন রেগে গেল, আপনি তো বলে খালাস চেষ্টা করতে হবে বলে। কী চেষ্টা, কীসের চেষ্টা তা বলুন ? তারপর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, যাক যাক, আমার ও সব কথায় কাজ কী। আপনার ছেলের জ্বর কমেছে কেদারবাবু?-আমার সেই টাকাটা নকুড় ? নকুড় কাছে এগিয়ে এল, নিচু গলায় বলল, আজ তো লারব কর্তা।
কৈলাস মাথা নেড়ে বলল, তা কী হয় হে, আজ না পারলে কবে পারবে? পরশ ধান বেচার টাকা পেয়েছ, তিন টাকা তিন পয়সা দিতে পারবে না ?
নকুড় বিড়বিড় করে কী বলতে লাগল কারও কানে গেল না। হঠাৎ কেদার বলল, আপনিই বা এমন নাছোড়বান্দা কেন মশায়? গরিব মানুষ এত করে বলছে, তিনটে টাকার তো মামলা। কদিন পরেই ন' হয় আদায় করবেন?-আচ্ছা, এই নিন, আমি দিচ্ছি আপনার তিন টাকা শোধ করে। তুমি তোমার সুবিধে মতো আমায় টাকাটা দিয়ো নকুড়, আর যদি নেহাত নাই দিতে পার-নকুড় প্রথমটা থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল, কেদারকে মনিব্যাগ হতে টাকা বার করে কৈলাসের দিকে বাড়িয়ে দিতে দেখে তাড়াতাড়ি ঠিক ম্যাজিকওয়ালার মতো কোমরের ভাঁজ হতে ঠিক তিন টাকা তিন পয়সা বার করে ফেলল। টাকাটা কৈলাসের হাতে দিয়ে লজ্জার হাসি হেসে সবিনয়ে কেদারকে বলল, না, বাবুমশায়, না। মোর থেকে মিটমাট হয়ে যাকগা-হাঙ্গামায় কাজ কী?
তারপর কৈলাস বলল, এবার ফিরবেন তো? চলুন এক সঙ্গেই যাই।
কৈলাসের আরও কয়েকটি আদায় বাকি ছিল, কেন্দারও ঠিক করেছিল কিছু তফাতের আরেকটি পাড়া আজ ঘুরে যাবে। নিজের নিজের কাজ বাতিল করে দু জনে একসঙ্গে ফিরে চলল পাশাপাশি, নিঃশব্দে-অনেকটা বন্ধুর মতো। কৈলাস নিজে হতে কথা পড়বে না বুঝে কেদার শেষে বলল, আপনি বড়ো নিষ্ঠুর।
কৈলাস বলল, কী করি বলুন, উপায় কী।
আপনার মন বড়ো ছোটো।
তা বটে। একজনের তিনটে টাকা বলে উদারতা দেখালেন, ও রকম দুশো চারশো হলে করতেন কী? এখনও প্রায় তিনশো লোক আমার কাছে টাকা ধারে।
আমি হলে চাইতে পারতাম না-দান করে দিতাম।
কবার দিতেন? দু দশ টাকা দিলেই যদি চিরকালের জন্যে ওদের অভাব মিটে যেত তবে আর ভাবনা ছিল না। ফাঁকে তালে কিছু লাভ করার সুযোগ পেলে বরং ওদের স্বভাবটাই বিগড়ে যেত। ওদের আপনি জানেন না। নিজের যার রোজগার নেই অন্যে তার কী করবে, কতকাল করবে। দেশে কি গরিবের সংখ্যা আছে।
তাই বলে চুপ করে বসে থাকবেন?
কৈলাস হাসল।-বসে আছি? সারাদিন তো খাটছি, মশায়। অতবড়ো একটা সংসার ঘাড়ে কতকাল ধরে কত খেটেখুটে তবে না আজ অবস্থাটা একটু স্বচ্ছল' করেছি। ক্ষমতা তো তেমন নেই, কী আর হবে! কত লোক বসে বসে লাখপতি হয়, আমি জীবন পাড় করে যা করলাম ছোটো একটা বাড়ি করতেই ফতুর-তাও ঘরে কুলোয় না। ওদের অবস্থা দেখে প্রাণ কি কাঁদে না মশায়? কখনও কি সাধ যায় না এর তিনটে টাকা, ওর পাঁচটা টাকা ছেড়ে দি? তারপর ভাবি তাতে লাভটা কী হবে! মাঝখান থেকে আর দশজনের কাছে আদায় করার সুখ থাকবে না। হঠাৎ কারও বিপদ আপদ ঘটল, পাঁচটা টাকা শোধ দিতে উপোস করার অবস্থা হল-তার কথা আলাদা। তাও খুব হিসেব করে আদায় বন্ধ করতে হয় মশায়। বড়োলোক তো নই, নিজের কটা টাকা ফুরিয়ে গেলে দরকারের সময় দু পাঁচটা টাকাও তো কাউকে দিতে পারব না।
কৈলাসকে উত্তেজিত মনে হয়। জোরে নিশ্বাস গ্রহণ করে। হঠাৎ সুর বদলে বলে, আসল কথা ক্ষমতা নেই, বড়ো বড়ো কথা ভেবে করব কি বলুন? তাতে একূল ওকুল দুকূল নষ্ট- ছেলেমেয়েগুলির দু বেলা পেট ভরে ভাত জুটবে না। তার চেয়ে নিজের যেটুকু শক্তি আছে কারও ক্ষতি না করে-কেদার বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। বক্তৃতায় আপনারা খুব পটু। ক্ষতি করেই বা কত ছাড়েন। কবে আপনি আমায় জেলেমাগির ঘরে যেতে নিজের চোখে দেখেছিলেন মশায়?
অভিযোগটা কৈলাস আগাগোড়াই অঙ্গীকার করল, কিন্তু কেদার বিশ্বাস করল না। মুখ ফুটে অবিশ্বাসটা প্রকাশ করলে কৈলাস হয়তো কথাটা আরও খানিকটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে পারত। কিন্তু মুখের উপর মানুষকে ও ভাবে মিথ্যাবাদী বলাও কেদারের পক্ষে বড়ো কঠিন।
পোস্টাপিসের কাছে ছাড়াছাড়ি হল। কেদারের সঙ্গী একটি ছেলে মন্তব্য করল, চাঁই বটে লোকটা। কেমন আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন, এ রকম স্বার্থপর ছোটোলোক তো মানুষটা তবু নকুড়, শশী এদের কাছে ওর কী খাতির।
কেদার বলল, খাতির করে, না ডরায়?
ছেলেটি বলল, না, ঠিক ডরায় না। ওকে খুব বিশ্বাস করে।
বিশ্বাস কৈলাসকে সকলেই করে। লতাপাতা ফুল আর রঙিন কাগজে সাজানো পাটখড়ির প্রকাণ্ড মঞ্চের চেয়ে ছোটো একটা কাঠের টুলের উপর মানুষের যেমন আস্থা থাকে উচ্ছ্বসিত মমতা আর শুভকামনায় ভরপুর অনেক উদারচেতা মহাপুরুষের চেয়ে স্বার্থপর কৈলাসকে সেইরকম বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়। লটারির টিকিটে লাখ টাকা পাওয়া সম্ভব বটে কিন্তু পাঁচ টাকার নোটে পাঁচটা টাকা পাওয়া যাবেই। কৈলাসের কাছে কেউ কোনোদিন বিশেষ কিছু আশা করে না কিন্তু অমন তো হাজার হাজার লোক আছে যাদের কাছে কেউ কোনোদিন কিছুই আশা করে না। জবরদস্তি আদায় করুক, দরকারের সময় পাঁচটা টাকাও তো সে দেয়। সব সময় নিজের সুখ সুবিধার কথা ভাবুক, অপরকে তার সুখ সুবিধা হতে বঞ্চিত করার চেষ্টা তো সে করে না। আবোল তাবোল কথা তো সে বলে না। মানুষকে সে তো ঠকায় না। নিজের দায়িত্ব আর কর্তব্য তো সে পালন করে। কারও মাথায় হাত বুলিয়ে আদর না করুক কারও পাও তো সে চাটে না।
তবে লোকটা বড়ো স্বার্থপর, এই যা দোষ। একটু অভদ্রও বটে। সেদিন কেদারের বক্তৃতা শূনেই বোধ হয় কৈলাসের মধ্যে পরের ভালো করার জন্য একটু আগ্রহ দেখা গেল। কয়েকদিন পরে সে নিজেই কেদারের বাড়ি গেল, সবিনয়ে বলল, সেদিন ওদের সম্বন্ধে যা বলছিলেন, আমায় একটু বুঝিয়ে বলুন তো ঘোষাল মশায়। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছে সেদিন থেকে। শতরঞ্চি বিছানো চৌকির উপর সে জেঁকে বসল, হেসে বলল, বিবেক মশায়, বিবেক মুখে, যে যাই বলুক, অন্যায় করছে মনে হলে বিবেক খোঁচাবেই খোঁচাবে।
ঘণ্টাখানেক আলাপ আলোচনার পর কেদারের মুখে যখন উগ্র উত্তেজনা আর কৈলাসের মুখে গভীর অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দু জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ঘরে তিনজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক আর পাঁচটি কিশোর বসে ছিল, তারা সকলে একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই কৈলাসের দিকে চাইতে লাগল। কথা সে আবোল তাবোল বলেছে, অতি পরিচিত রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত শব্দের অর্থ পর্যন্ত উলটে দেবার চেষ্টা করেছে, দেশের বৃহৎ ব্যাপারকে রূপ দিতে চেয়েছে ক্ষুদ্র ঘরোয়া ব্যাপারের, তবু তার কথাগুলি কী স্পষ্ট আর সহজবোধ্য। এ সব বিষয়েও যে কৈলাস মাথা ঘামায়, এতক্ষণ এমন তেজের সঙ্গে তর্ক করতে পারে, কেউ তা কখনও কল্পনাও করেনি। তারপর কৈলাস বলল, যাকগে, ও সব বড়ো বড়ো কথা আমার মাথায় ঢুকবে না। একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে। আপনি তো মিউনিসিপ্যালিটিতে আছেন, নিজের চোখে ওদের পাড়ার অবস্থা দেখেওছেন অনেকবার, যেমন ধরুন নকুড়ের বাড়ির সামনের রাস্তাটা কেদার তাড়াতাড়ি বলল, চেষ্টা তো করছি। একা কী করব?
কৈলাসও তাড়াতাড়ি বলল, একা কেন? অন্য সকলকে বোঝাতে পারেন না? ওঁরা সব শিক্ষিত ভদ্রলোক, ওদের যদি না বোঝাতে পারেন- ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট। কেদার অবজ্ঞাভরে 'তামাশার দূরে বলল, আপনি পারেন? দেখুন না একবার চেষ্টা করে।
কৈলাস গম্ভীরভাবে বলল, তাই ভাবছি। তবে ঢুকতেই যা হাঙ্গামা, ভাবতেও ভয় করে! আপনার তো সব ডানাই আছে।
কেদার আশ্চর্য হয়ে বসল, বলেন কি মশায়, আপনি এবার দাঁড়াবেন নাকি?
কৈলাস সায় দিয়ে বলল, দেখি একবার চেষ্টা করে। আপনি এক কাজ করুন না, আপনি নিজে না ঢুকে আমায় ঢুকিয়ে দিন না?
প্রস্তাব শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। কৈলাসের মতো স্বার্থপর মানুষের পক্ষেও কি এমন একটা খাপছাড়া প্রস্তাবকে স্বাভাবিক মনে করা সম্ভব?
সেদিন সন্ধ্যার সময় কৈলাস বাড়িতে বসে আছে, দুটি কিশোর তার সঙ্গে দেখা করতে এল। কৈলাস দেখেই চিনতে পারল, সকালে তারা কেদারের বৈঠকখানায় বসেছিল।
কী মনে করে ভাই?
আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে এলাম!
তখনও নির্বাচনের মাস ছয়েক দেরি ছিল। কিন্তু ধরতে গেলে সেদিন হতেই দু জনে লড়াই শুরু হয়ে গেল। নির্বাচনের মাসখানেক আগে দেখা গেল লড়াইটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রথমটা কৈলাসের বোকামিতে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল লোকটার মাথা বুঝি খারাপ হয়ে গিয়েছে। কেদারের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার মতো লোকের দাঁড়ানোর কোনো মানে হয়? কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে দেখা গেল, কৈলাস খুব বেশি বোকা নয়। তার দিকেও অনেক সমর্থক জুটে গেছে! যতই জনপ্রিয় হোক, কেদারের শত্রুও ছিল অনেক, তারা কৈলাসকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে। কৈলাসের সবচেয়ে বেশি জুটছে কমবয়সি সমর্থকের দল। এতকাল যারা কোরের নামে হইচই করেছে, বডিগার্ডের মতো সঙ্গে থেকেছে, তাদেরও কয়েকজন কৈলাসের দিকে ভিড়েছে। তবে, ফলটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে বলা যায় না। কেদারের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি। এই ঘরোয়া নির্বাচন উপলক্ষে শহর অনেক কাল এ রকম সরগরম হয়ে ওঠেনি। নির্বাচনের অনেকদিন আগে হতেই সকলের মুখে শুধু এই আলোচনা। কৈলাসের দলের ছেলেরা প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, গরিবদের জন্য কৈলাস অনেক কিছু করতে পারবে কিনা এ বিষয়ে অনেকের মনে সন্দেহ থাকলেও, তার উদ্দেশ্যটা যে কিছু করা প্রায় সকলেই তা বিশ্বাস করেছে।
কৈলাসকে সকলে বিশ্বাস করে। কৈলাসের দলের প্রচারকার্যের বিবরণ শুনতে শুনতে এবং দশজনের সঙ্গে আলাপ করতে করতে কেদার স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এবার তার জয়-পরাজয় নির্ভর করছে গরিবের জন্য তার কিছু করবার ক্ষমতায় দশজনের বিশ্বাসের উপর। গরিবদের জন্য সকলের এই অর্থহীন মাথাব্যথায় কেদারের বিরক্তির সীমা থাকে না, রাগে গা জ্বলে গিয়েছে, কিন্তু গরিবদের পাড়ায় যাতায়াতটা সে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।
এমনিভাবে যখন দিন কাটছে, নির্বাচনের আর বাকি আছে মোটে তিনটে দিন, একদিন বিকেলে ওই গরিবদের মধ্যে একটা দাঙ্গা বাধবার উপক্রম দেখা গেল। উপলক্ষটা একটু খাপছাড়া। নকুড়ের বাড়ির কাছে একটা ফাঁকা মাঠ আছে। কেদার আর কৈলাস দু জনের দলের কর্মীরাই গরিবের পাড়ায় পাড়ায় বলে এসেছিল বিকেলে যেন সকলে ওই মাঠে জমা হয়। এই মাঠে এসে কেদার ও কৈলাসের কথা শুনবার জন্য আগেও কয়েকবার তাদের ডাকা হয়েছে কিন্তু একদিন এক সময়ে দু জনের কথা শূনবার জন্য নয়!
নির্বাচন নিয়ে ভদ্রলোকদের পাড়ার উত্তেজনা গরিবদের পাড়াতেও যথেষ্ট পরিমাণে সংক্রামিত হয়েছিল। বহু লোক মাঠে এসে জড়ো হয়েছে। তারপর কী ভাবে যেন অনুপস্থিত কেদার আর কৈলাসকে নিয়ে দাঙ্গা বাধবার উপক্রম হয়েছে।
সভা আহ্বানের ভুলটা প্রায় শেষ মুহূর্তে টের পেয়ে কেদার ও কৈলাস সভায় আসেনি। দু জনেই পরম উদারতার সঙ্গে অপরকে সভায় কথা বলার সুযোগটা দান করেছে। কিন্তু পরস্পরের উদারতার খবর না পাওয়ায় দু জনের একজনও সুযোগটা গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি।
খবরের জন্য উৎসুক হয়ে কৈলাস ঘরে বসেছিল। হস্তদন্ত হয়ে নকুড় ও একটি ছোল এসে দাঙ্গাহাঙ্গামার সম্ভাবনার খবরটা দিল। শুনে জুতা পর্যন্ত পায় না দিয়ে ফতুয়া গায়ে কৈলাস ছুটে গেল কেদারের বাড়ি। ব্যাপারটা কেদারকে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, শিগগির যাই চলুন।
কোথায় যাব মশায়? ওই দাঙ্গার মধ্যে ?
আপনি আর আমি গেলে দাঙ্গা বাঁধবে না। চলুন, চলুন, দেরি করবেন না!
কেদার মাথা নেড়ে বলল, এতক্ষণে বেঁধে গেছে-এখন গিয়ে কী হবে।--মাঝখান থেকে মাথাটা ফাটবে শুধু। পুলিশ সামলে নেবে লাঠির ঘায়ে।
কাজেই কৈলাসও দাঙ্গা থামাতে গেল না।