shabd-logo

রাঘব মালাকর

26 December 2023

3 Viewed 3

[ পুরাণে বঙ্গে একদা নররূপী ভগবান স্নানরতা গোপিনীদের বস্ত্র অপহরণ করে নিয়ে তাদের অন্তর পরীক্ষা করেছিলেন-বহুকাল পরে আবার তিনি....এবার অদৃশ্য থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের দিয়ে, সমগ্র বাংলাদেশের নরনারীর বস্তু অপহরণ করে নিয়ে, কী পরীক্ষা করে দেখছেন, তা তিনিই জানেন.... তবে দুঃশাসনকে জব্দ করে বস্তুহীনা হওয়ার নিদারুণ লজ্জা থেকে দ্রৌপদীকে তিনিই রক্ষা করেছিলেন, হে রাঘব মালাকর, জেলে বসে ফাটা কপালে মলম দিতে দিতে অন্তত সেই কথা স্মরণ করে মনকে সান্ত্বনা দিয়ো-আশা করি এই ছোট্ট কাহিনিটি পড়ার পর আপনিও ঠিক এই কথাই বলবেন...।

রাঘব বাঁচবে কি মরবে ঠিক নেই। লাঠির খায়ে মাথাটা তার ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফুলবাড়ির চৌমাথা থেকে নামমাত্র পথটা মাঠ জলা বনবাদাড়ের ভিতর দিয়ে দুক্রোশ তফাতে মালদিয়া গিয়েছে। এই দুক্রোশের মধ্যে গাঁ বলতে কিছু নেই, এখানে ওখানে কতগুলি কুঁড়ে জড়ো করা বসতি আছে মাত্র। হাটবারের দিন কিছু লোক চলাচল করে পথ দিয়ে, অন্যদিন সন্ধ্যায় পথটা থাকে প্রায় জনহীন।

নির্জন হোক, পথটা নিরাপদ। গত কয়েক বছরের মধ্যে এ পথে কোনো পথিকের বিপদ ঘটেনি। বছর তিনেক আগে দিনদুপুরে একজনকে পাগলা শেয়ালে কামড়েছিল শোনা যায়। কেষ্টরামের পোড়া মাদুলি আর চুম্বকপাথরের চিকিৎসাতেও নাকি বাঁচেনি। সাপটাপ হয়তো কামড়েছে দু-একজনকে ইতিমধ্যে, কুকুর হয়তো তেড়ে গেছে ঘেউঘেউ করে, গোরু শিশু নেড়েছে। কিন্তু বিশেষ কিছু কারও হয়নি, কারণ হলে সেটা মানুষের মনে থাকত। রাহাজানির দু-একটা রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনা যায়, কিন্তু কবে যে সে ঘটনাগুলি ঘটেছিল কেউ বলতে পারে না, একেবারে ঘটেছিল কিনা তারও কোনো প্রমাণ নেই। এ পথের আশেপাশের বস্তি-গাঁগুলিতে যাদের বাস, চুরি ডাকাতি তারা যদি করে, ধারেকাছে কখনও করে না। এ পথের একলা পথিকের গায়ে হাত দেয়া দূরে থাক, তাকে ভয় দেখাবার ভরসা পর্যন্ত ওদের নেই। ও রকম কিছু ঘটলে দায়ি হবে ওরাই। পুলিশও প্রমাণ খুঁজবে না, জমিদার কার্তিক চক্রবর্তীও নয়-দুপক্ষের শাসনে থেঁতো হয়ে যাবে ওরা, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তাদের কুঁড়েগুলি, বাতিল হয়ে যাবে আশেপাশে বাস করার অনুমতি।

একবার সদরে টাকা নিয়ে যাচ্ছিল গোমস্তা রাধাচরণ, সঙ্গে ছিল দুজন পাইক। জন সাতেক লোক তাদের মারধোর করে টাকা কেড়ে নিয়ে যায়। পরে তারা ধরা পড়ে জেলে গিয়েছিল, ফুলবাড়ির পাঁচজন আর মালদিয়ার দুজন-পরে। দুদিকের চাপে রাঘবের আর কাছাকাছি আরও তিনচারটে বস্তি-গাঁয়ের মানুষেরা থেঁতো হয়ে যাবার পরে।

পথ থেকে হাঁক এলে এরা সাড়া দেয়। ভীরু লোক দাবি করলে সঙ্গে পৌঁছেও দিয়ে আসে এদিকে ফুলবাড়ি বা ওদিকে সড়কের মোড় পর্যন্ত। একলা ভীরু পথিকের ভালোমন্দের দায়িক ওরাই কিনা।

শেষ বেলায় ফুলবাড়ি-মালদিয়া নামমাত্র পথ ধরে বোঁচকা মাথায় দুজন লোক চলেছে মালদিয়ার দিকে। বেশভূষা বোঁচকার আকার, বয়স, আর গায়ের রং ছাড়া দুজনের মধ্যে পার্থক্য বেশি নেই-অর্থাৎ লম্বায় চওড়ায় দুজনেই প্রায় সমান হবে। গায়ের জোরে কিনা বলা অসম্ভব, জোরের পরীক্ষা কখনও হয়নি। রাঘব মালাকরের কোমরে একহাত একটি গামছা জড়ানো, জ্যালজেলে পুরানো গামছা। গৌতম দাসের পরনে প্রমাণসাইজ ঘরে কাচা আধপুরানো মিলের ধুতি, গায়ে পুরানো ছিটের শার্ট, ঘাড়ের কাছে একটু ছিঁড়েছে। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। রাঘবের বোঁচকাটা বেশ বড়ো, গৌতমের বোঁচকা তার সিকির চেয়ে ছোটো হবে। রাঘবের আছাটা চুলে পাক ধরেছে, গৌতমের ছাঁটা চুলেও তাই, তবে রাঘব পনেরো বিশ বছরের বড়ো হবে গৌতমের চেয়ে। রাঘব মিশকালো, গৌতম মেটে।

খান দশেক কুঁড়ের নামহীন গাঁয়ের কাছে এসে একটু হাঁপ ধরে রাঘবের। গতবারের চেয়ে এবারের বোঝাটা বেশি ভারী। দু চার মিনিটের জন্য বোঝাটা একটু সে নামিয়ে রাখে। গৌতম বলে, আবার নামালি? আজ তোর হয়েছে কি র‍্যা?

ভবল বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে বলছ? আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম চেঁছে এনে ঝেড়ে ফেলে রাঘব বলে, বাপ্প্স। কাপড়ের এত ওজন হয় জানতাম না বাপু। এত কাপড় জন্মে দেখিনি দোকান ছাড়া।

গৌতম চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে, কাপড়? কাপড় কী রে ব্যাটা? বললাম না বস্তা নিয়ে যাচ্ছি? মধুর সা বস্তা চেয়েছে চাল চালানের জন্যে ?

গতবার টের পেইছি বাবু, কাপড়।

হ্যাঁ, কাপড়। তোকে বলেছে। সদরে খাঁ খাঁ করছে লোকে কাপড়ের জন্যে, বিশ টাকা দিয়ে কাপড় পাচ্ছে না একখানা, আমি নিয়ে চলেছি মালদিয়া। ব্যাটার বুদ্ধি কত!

রাঘবের হাসিটা বড়ো খারাপ লাগে গৌতমের।

সদরেই তো বেচস্থ বাবু। গুদোম করেছ মালদিয়ায়। এপথে মাল আনছ মাসে দুবার চারবার, পাঁচগড়ের পথে রোজ এদিক ওদিক চালান দিচ্ছ খানিক খানিক। মোরা বলি যে ঠাকুরবাবু পাঁচগড়ের পথে বাসে চেপে মালদিয়া যায় না কেনে, ফুলবাড়ি নেমে মজুরি দিয়ে মাল নিয়ে দুকোশ হাঁটে?

পাঁচগড়ের পথে ছোকড়া বাবুরা পাহারা দেয়, তাই তো বিপদ।

কে বলেছে তোকে? কার কাছে শুনলি? সভয় গর্জনে গৌতম জিজ্ঞেস করে।

কে বলবে বাবু? আন্দাজ করিছি। মুখ্যু বলে কি এমন মুখ্য মোরা?

গৌতম চট করে একটা বিড়ি ধরায়। একটু ভাবে। রাঘব যে বলল, মোরা আন্দাজ করিছি, তার মানে কি এই যে জানাজানি হয়ে গেছে? মোরা কারা? রাঘব আর তার আত্মীয়বন্ধু কজন, না

আরও অনেকে?

তোকে চার টাকা মজুরি দি রঘু।

আজ্ঞে বাবু। তোমার দয়া।

তাই বুঝি বলে বেড়াচ্ছিস আমার কারবারের ব্যাপার দশজনকে ? তোকে বিশ্বেস করলাম, তুই শেষে নেমকহারামি করলি রঘু?

দশ কুঁড়ের গাঁ যেন জনহীন-কুকুর পর্যন্ত ডাকে না। পথের পাশে জলায় শালুক ফুটেছে অগুন্তি-দুমাস আগে পর্যন্ত এই শালুকের ফসল তুলে প্রাণ বাঁচিয়েছে এই বস্তি-গাঁগুলির স্ত্রী-পুরুষ-অবশ্য সবাই নয়। বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পিছনে হেলে যায় রাঘব, আবেগের ভারে ভারাক্রান্ত গলায় বলে, নেমকহারামি ঠাকুরবাবু? বলছ নেমকহারামি? হাটে সেদিন সভা করে স্বদেশিবাবুরা বললে, যে যা জানো থানায় বলবে। বলিছি থানায়? থানায় মোরা বলতে যাইনি ঠাকুরবাবু ভালোমন্দ। যা বলি তাতেই গুঁতো। বলাবলি করেছি নিজেদের মধ্যে। তোমার তাতে কী? নে নে, মোট তোল। গৌতম বলে খুশি হয়ে, চটিস কেন? আট আনা বেশি পাবি আজ, যা। রাঘব নিঃশব্দে বোঁচকা মাথায় তুলে নেয়, গৌতমের সাহায্যে। গৌতম তাকে ছেঁদো দর্শনের কথা শোনায়, যে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে মেরে রাখা হয়েছে কোটি গৌতমকে বহুকাল ধরে কী ভাবে ভালো থেকে মরলে লাভ আর কী ভাবে খারাপ হয়ে বাঁচলে লোকসান। তেজি গলায় গৌতম কথা কয়। শুনে গলা বন্ধ হয়ে আসে রাঘবের। মন তার মাথা কুটে বলে, হায় কী করিছি, হায় কী করিছি।

পরের গাঁয়ে রাঘবের ঘর, ফুলবাড়ি আর মালদিয়ার প্রায় মাঝামাঝি। এটাকে মোটামুটি গাঁ বলা যায়। খান ত্রিশেক ঘর আছে, আসল পথের সমান চওড়া পথ আছে গাঁ পর্যন্ত সাত অটি রশি, নামও আছে গাঁয়ের-পল্টু। এইটুকু এসে রাঘব বোঁচকা নামিয়ে রাখে। আঙুল দিয়ে শুধু কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলে ক্ষান্ত হয় না, বোঁচকার ওপর চেপে বসে বেশ আনন্দ অন্তরঙ্গতার সূরে বলে, একটা বিড়ি দেন গো ঠাকুরবাবু।

সাত আট রশি দূরে খান ত্রিশেক ঘরের নামওয়ালা বস্তি-গাঁ, এটাও যেন খানিক আগের দশ-কুঁড়ে গাঁটার মতো নিঃশব্দ, জনহীন, মৃত। উলঙ্গ ছেলেমেয়ে পর্যন্ত ছুটে আসে না পয়সা ভিক্ষা করতে, পথ দিয়ে পথিক কেউ যাচ্ছে কি যাচ্ছে না তাতে যেন কিছু এসে যায় না তাদের। পস্তু গাঁয়ের দক্ষিণে ঘন জঙ্গল, নিচু জমিতে বছরে ছমাস বর্ষার জল জমে থাকলে শোভাহীন বর্ণহীন বীভৎস জলজ জঙ্গল জন্মে। ঝিল্লির ডাকে সন্ধ্যার স্তব্ধতা, অন্ধকার রাত্রির ইঙ্গিত, এখনও সন্ধ্যা নামেনি। বাইরে সন্ধ্যা না নামলেও ঘরগুলির ভিতরে যে গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়েছে রাঘব তা জানে! গৌতমও জানে। এ অঞ্চলেরই মানুষ তো সে। রাঘবকে ধমক দিতে গিয়ে হঠাৎ শিশুর কান্না কানে আসায় গৌতম চমকে উঠে থেমে যায়। কে যেন চাপা দিয়েছে শিশুটির মুখে। গা ছমছম করে গৌতমের। এই জলাজঙ্গল, কুঁড়ে পথ আর এই গামছা-পরা মানুষ এসব পুরানো সবকিছু যেন নতুন নতুন মনে হয়, গাঁয়ের শব্দহীন স্তব্ধতায়, মানুষের সদৃশ্যতায়, শিশুর কান্নার মুখ-চাপায় বোঁচকায় বসবার ভঙ্গিতে।

রাঘবকে সে বিড়ি দেয়। নিজে বিড়ি ধরাবার আগেই রাঘবকে দেয়। বলে, টেনে নিয়ে চটপট ১ল বাবা, পা চালিয়ে বাকি পথটা মেরে দি। খিদেয় পেট চোঁচো কচ্ছে, মাইরি বলছি তোকে রঘু, কালীর দিব্যি। চ যাই চটপট। পৌঁছে দিলে তুইও খালাস। ওখানে গাবি তুই আজ। জানিস, আমার ওখানে খাবি। খেয়ে দেয়ে ফিরিস, নয় শুয়ে থাকবি।

ঘাড় হেট করে রাঘব বসে থাকে বোঁচকায়, করুণ চোখের পক্ষকে তাকিয়েই চোখ নামায়। ধর গলায় বলে, বাবুঠাকুর, এ কাপড় মোদের চাই।

কাপড় চাই? আচ্ছা, আচ্ছা দেবখন তোকে একখানা-গৌতম ঢোক গেলে, একজোড়া কাপড়। নে দিকি নি, চল দিকি নি এবার। ওঠ।

রাঘব উঠে দাঁড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গৌতমের পায়ে, দু হাতে দু পা চেপে ধরে বলে, আজ চলাচলি নাই বাবুঠাকুর। কাপড়গুলো মোদের দিয়ে তুমি যাও গে। দানছত্তর করে যাও বাবুঠাকুর কাপড়গুলো। মোদের ঘরে মেয়ে-বউ ন্যাংটো হয়ে আছে গো।

গৌতমের ভয় করে। কিন্তু এদের সম্বন্ধে তার ভয় খুব অল্প, তাই মন তার ভয়ের সীমা পেরিয়ে যায়। ঝাঁকড়া চুল ধরে রাঘবকে টেনে তুলে গর্জন করে সে বলে, হারামজাদা। গাঁজাখোর। বজ্জাত! ওঠ বলছি। মেন্ট তোল। নন্দবাবুকে বলে তোকে জেল খাটাব ছমাস। ভৈরববাবুকে বলে তোকে চালা কেটে তুলে দেব দেশ থেকে। মোট তোল, পা চালিয়ে চল।

মেয়েগুলো ন্যাংটো বাবুঠাকুর? মা-বুন ন্যাংটো, মেয়ে-বউ ন্যাংটো-

ন্যাংটো তো ধরে ধরে...

বলেই গৌতম অনুতাপ করে। এমন কুৎসিত কথা বলা উচিত হয়নি, রাঘবের মা-বোন মেয়ে-বউকে এমন কদর্য গাল দেওয়া। দুটো মনরাখা কী কী কথা বলে কাটিয়ে দেওয়া যায় এই ভীষণ কথাটা গৌতম তাই মনে মনে স্থির করার চেষ্টা করে। বেশি নরম হলে ব্যাটা পেয়ে বসবে। বেশ লাগসই জুতসই, ওজনসই কথা বলা চাই।

কাপড় তবে রইল বাবুঠাকুর।

বলে রাঘব হাঁক দেয় গলা চড়িয়ে। মৃত পর্তুগাঁ যেন জীবন্ত প্রাণ পেয়ে কলরব করে ওঠে, কিলবিল করে বেরিয়ে আসে উলঙ্গপ্রায় স্ত্রী-পুরুষ। পত্ততে এত লোক থাকে না, অন্য সব বস্তি গাঁয়ের লোকেরাও আজ ওখানে এসে জড়ো হয়েছিল। গৌতম প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর উঠে দাঁড়িয়েই ছুটে পালাবার উপক্রম করে। রাঘব লাফিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে।

'আর হয় না বাবুঠাকুর। বললাম দান করে দিয়ে যাও কাপড়গুনো, তা তো শুনলে না। নে না কাপড়গুনো বাবা। সব কাপড় নে। আমায় ছেড়ে দে।

আর তা হয় না বাবুঠাকুর। দান দিয়ে যেতে সে ছিল ভিন্ন কথা। কাপড় লুট হল এখন, তোমায় ছেড়ে দিয়ে মরব মোরা?

উত্তেজিত মানুষগুলিকে রাঘব সংঘত রাখে। তার ধমকে অন্য সকলের চেঁচামেচি বন্ধ হয়, কিন্তু ভয়াতুর কয়েকজনের আর্ত ও তাঁর প্রতিবাদ সে থামাতে পারে না। বুড়ো নরহরি কপাল চাপড়ে চেঁচায়, মারবি তুই, সবাইকে মারবি তুই রাঘব? পুলিশ আসবে সবাইকে বেঁধে মারবে, ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবে। ওরে বাবা রে, সব্বোনাশ করলে রাখব।

দুটি স্ত্রীলোক চেঁচিয়ে কান্না ধরে।

তিনজন মাঝবয়সি লোক চোখ পাকিয়ে বলে, মোরা এর মধ্যি নাই, রাঘব।

রাঘব বলে, নাই তো ছেঁড়িয়ে রইছ কোনে? কাপড়ের ভাগ নিয়ো না, যাও গা।

কাপড়ের বোঁচকা আর গৌতমকে গাঁয়ের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। রাঘবের ঘরের দাওয়ায় বোঁচকা নামিয়ে বড়োদের মজলিশ বসে, এবার কী করা উচিত আলোচনার জন্য। কী করা হবে না হবে সব ঠিক হয়ে আছে কদিন থেকে, গৌতমকে পুঁতে ফেলার জন্য জঙ্গলে গভীর গর্তও কেটে রাখা হয়েছে একটা, তবু একটু আলোচনা না করে তারা পারে না। কাপড়গুলি তাড়াতাড়ি বিলি করে ফেলা দরকার, বাইরের যারা তারা ফিরে যাবে যে যার গাঁয়ে, এখানকার যারা তারা যাবে যার যার দরে। এত লোক বেশিক্ষণ জমায়েত হয়ে থাকা উচিত নয়, কে যাবে পথ দিয়ে, কার কী চোখে পড়বে কে বলতে পারে। রাঘব থেকে থেকে গর্জন করে ওঠে, ধারালো দা উঁচু করে একদম চুপ হয়ে যেতে বলে সবাইকে গোলমাল শুনে কেউ যদি ব্যাপার দেখতে আসে পথ থেকে। তাকেও তো পুঁততে হবে বাবুঠাকুরের সঙ্গে। একটা লোক নিখোঁজ হওয়া এক কথা। বেশি লোক নিখোঁজ হলে হাঙ্গামা হবে না?

কথা যে কইবে সে কাপড় পাবে না।

রাখবের গর্জনের চেয়ে বলরামের এই ঘোষণায় গল্প হয় বেশি। সবাই চুপ হয়ে যায় একেবারে, যারা প্রতিবাদী ছিল তারা পর্যন্ত। বুড়ি পচার মা শুধু বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকে। গৌতমের কান্না, বিলাপ, অনুনয় বিনয়ের অন্ত ছিল না, রাঘব একবার শ-টা উচিয়ে ধরার পর সেও থেমে গিয়েছিস। এবার সে বিনিয়ে বিনিয়ে বলে, আমণ্য ছেড়ে দে বাবা তোরা। আমায় মেরে কী হবে তোদের? কাপড় পেয়েছিস, বামুনের ছেলেকে মেরে কেন মহাপাপ করবি। ছেড়ে দে আমায়।

বলরাম বলে, কী করে ছাড়ি? ছাড়া পেলে তুমি গিয়ে তো পুলিশ আনবে বাবুঠাকুর। গৌতম পইতে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে, বাপ-মার নামে আর দেব-দেবীর নামে দিব্যি গালে, পুলিশকে সে কিছু বলবে না।

এ কথা কি মনে থাকবে বাবুঠাকুর?

তখন হতাশ হয়ে প্রাণ বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করে গৌতম বলে, শোন বলি, পুলিশকে আমি বলতে পারি না। সাধ থাকলেও পারি না।

পার না?

না। বললে আমারই জেল হবে। এ কাপড় চোরাবাজারের মাল, পুলিশ যখন শুধোবে কাপড় পেলাম কোথেকে, কী জবাব দেব বল? সত্যি বললে যার কাছ থেকে এনেছি তাকে ধরবে, আমাকে ধরবে, কারবার তো ফাঁক হয়ে যাবেই, জেল হয়ে যাবে আমাদের। চোরা মাল না হলে কি এ পথে মাল নিয়ে আসি, তোরাই বুঝে দ্যাখ। পুলিশ কেন, তোরা কাপড় লুটে নিয়েছিস, কারও কাছে বলবার উপায় নেই আমার।

রাঘব বলে, তা বটে। এটা তো খেয়াল করিনি মোরা। সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এতক্ষণে। বাবুঠাকুরকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন না করে ফেলে তাদের উপায় ছিল না, কিন্তু জীবন্ত একটা মানুষকে এভাবে মারতে কী সায় দেয় মানুষের মন। বাবুঠাকুর নিজেই যখন চোর, তার চোরাই মাল কেড়ে নিলেও কী করতে পারবে বাবুঠাকুর? ওকে ছেড়ে দিলে তাদের কোনো ভয় নেই।

রাঘব বলে, তবে তুমি যাও বাবুঠাকুর। অপরাধ নিয়ো না।

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে গৌতম পড়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে গলার আওয়াজ বার হয় না। কাঠের মতো শুকনো গলায় কবার ঢোক গিলবার চেষ্টা করে সে কোনোমতে বলে, জল। জল দে একটু।

মোদের ছোঁয়া জল যে বাবুঠাকুর।

গৌতম মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে বলে, দে। জল খেয়েই সে পালায়।

পরদিন পুলিশ আসে দল বেঁধে, বিকেলের দিকে। দলিলপত্র তৈরি করে আটঘাট বেঁধে সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে এক বেলা সময় লাগে, নইলে সকালেই পুলিশ আসত। নাথগঞ্জের গগন সার প্রকাশ্যে কাপড়ের দোকানও একটা আছে।

তিন দিন আগের তারিখে মালদিয়া গাঁয়ের জন্য কিছু কাপড় বরাদ্দ করিয়ে নিয়ে, গৌতম মুখোপাধ্যায়কে এজেন্ট নিযুক্ত করে, যথাশাস্ত্র খাতাপত্র রসিদ ইত্যাদি ঠিক করে ফেলায় পর্তুগাঁয়ে লুটকরা কাপড়গুলির চোরাই মালত্বের দোষ কেটে যায়।

পর্তুগাঁয়ে গিয়ে পুলিশ দ্যাখে ধড়পাকড় ইত্যাদির চেয়েও ঢের বেশি গুরুতর ও সঙ্গত অনেকটা কারণ উপস্থিত হয়েছে। লুট করা কাপড়ের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে জোরালো একটা দাঙ্গা হয়ে গেছে গতরাত্রে। খুন হয়েছে দুজন, আহত হয়েছে অনেকে। রাঘবের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। রাঘব বাঁচবে কি মরবে ঠিক নেই। 

16
Articles
আজ কাল পোরশুর
0.0
এটি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা একটি ছোটগল্প
1

আজ কাল পরশুর গল্প

19 December 2023
1
0
0

মানসুকিয়ার আকাশ বেয়ে সূর্য উঠেছে মাঝামাঝি। নিজের রাঁধা ভাত আর শোল মাছের ঝাল খেতে বসেছে রামপদ ভাঙা ঘরের দাওয়ায়। চালার খড় পুরোনো পচাটে আর দেয়াল শুধু মাটির। চালা আর দেয়াল তাই টিকে আছে, ছ মাসের সুযোগেও কে

2

দুঃশাসনীয়

20 December 2023
1
0
0

আগে, কিছুকাল আগে, বেশিদিনের কথা নয়, গভীর রাতেও হাতিপুর গ্রামে এলে লোকালয়ের বাস্তব অনুভূতিতে স্বস্তি মিলত। মানুষের দেখা না মিলুক, মাঠ, খেত, ডোবাপুকুর, ঝোপঝাড়, জলা অপরিসীম রহস্যে ভরাট হয়ে থাক, হুতোম প্য

3

নমুনা

21 December 2023
1
0
0

কেবল কেশবের নয়, এ রকম অবস্থা আরও অনেকের হয়েছে। অন্ন নেই কিন্তু অন্ন পাওয়ার একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে মেয়ের বিনিময়ে। কয়েক বস্তা অন্ন, মেয়েটির দেহের ওজনের দু-তিন গুণ। সেই সঙ্গে কিছু নগদ টাকাও, যা দিয়ে দানক

4

বুড়ি

22 December 2023
0
0
0

বুড়ির বড়ো পুতি আজ যাবে বিয়ে করতে। ছেলের ছেলে তার ছেলে, বড়ো সহজ কথা নয়। বুড়িকে বাদ দিয়েই বাড়িতে চলেছে আপনজনে-ভরাট বাড়ির ছেলে বিয়ে করতে গেলে যত কিছু কাণ্ডকারখানা হয়-রোজ সংসারের সাধারণ হইচইও যেন ওকে বাদ

5

গোপাল শাসমল

22 December 2023
0
0
0

সাতপাকিয়ার গগন শাসমলের ছেলে গোপাল গিয়েছিল জেলে। একদিন ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরল। জেলে যাওয়ার সময় তার বাড়িতে ছিল মন পঁচিশেক ধান, দুটো বলদ, একটা গোবু, পুঁইমাচা লাউ- মাচা আর তিনটে সজনে গাছ। বাড়ি ফিরে দেখল, ধান

6

মঙ্গলা

22 December 2023
1
0
0

শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মঙ্গলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডোবা থেকে উঠে আসে। পুলিশ হঠাৎ গাঁয়ে হানা দিয়েছিল মাঝরাতে। সেই থেকে এই সকাল পর্যন্ত সে ডোবার জলকাদায় আগাছার মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে কাটিয়েছে। হাঙ্গামার পর

7

নেশা

23 December 2023
1
0
0

পুলকেশের সিনেমা দেখার নেশা একেবারে ছিল না। যতীনেরও তাই। সত্যিকারের কোনো ভালো ছবির খবর পেলে, রুচি, রসবোধ আর বিচারশক্তি আছে বলে তারা বিশ্বাস করে এমন কোনো বিশ্বাসী লোকের কাছে খবর পেলে হয়তো কখনও নিজেরা শখ

8

বেড়া

23 December 2023
1
0
0

বাড়ির ঠিক মাঝখানে উঁচু চাঁচের বেড়া। খুব লম্বা মানুষের মাথা ছাড়িয়েও হাতখানেক উঁচু হবে। বেড়া ডিঙিয়ে কারও নজর চলবে না, অবশ্য যদি উঁচু কিছুর উপর দাঁড়িয়ে নজর চালানো না হয়। নজর দেধার অন্য উপায় আছে ফুটোতে চো

9

তারপর?

23 December 2023
1
0
0

কাণকালি গাঁয়ের খালে একবার একটা কুমির এসেছিল। মানুষখেকো মস্ত কুমির। পরপর তিনটি বউকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল গাঁয়ের। একজন মাঝবয়সি, দুজন তরুণী। একজন রোগা ন্যাংলা, একজন বেশ মোটাসোটা, আরেকজন ছিপছিপে দোহারা গোছের

10

স্বার্থপর ও ভীরুর লড়াই

26 December 2023
1
0
0

কৈলাস বসুকে সকলে স্বার্থপর আর সংকীর্ণচেতা বলে জানে। মানুষটার চালচলন আচার বাবহার তো বটেই, চেহারাও সকলের এই ধারণাকে অনেকটা সমর্থন করে। বেঁাঁটি, আঁটোসাঁটো ধরনের মোটা, প্রায় গোলাকার মাথায় বুরুশের মতো শক্ত

11

শত্রুমিত্র

26 December 2023
1
0
0

আদালতের বাইরে আবার দেখা হয় দু জনের, পানবিড়ি চা মুড়ি মুড়কি আর উকিল মোক্তারের দোকানগুলির সামনে। দু জনে তারা পরস্পরের দিকে তাকায়। তীব্র বিদ্বেষের আগুনে যেন পুড়ে যায় দু জোড়া চোখ। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায়

12

রাঘব মালাকর

26 December 2023
1
0
0

[ পুরাণে বঙ্গে একদা নররূপী ভগবান স্নানরতা গোপিনীদের বস্ত্র অপহরণ করে নিয়ে তাদের অন্তর পরীক্ষা করেছিলেন-বহুকাল পরে আবার তিনি....এবার অদৃশ্য থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের দিয়ে, সমগ্র বাংলাদেশের নরনারীর বস্তু অ

13

যাকে ঘুষ দিতে হয়

27 December 2023
1
0
0

মোটর চলে, আস্তে। ড্রাইভার ঘনশ্যাম মনে মনে বিরক্ত হয়, স্পিড দেবার জন্য অভ্যাস নিশপিশ করে ওঠে প্রত্যঙ্গে, কিন্তু উপায় নেই। বাবুর আস্তে চালাবার হুকুম। কাজে যাবার সময় গাড়ি জোরে চললে তার কোনো আপত্তি হয় না

14

কৃপাময় সামন্ত

27 December 2023
1
0
0

রঘুনাথ বিশ্বাসের আমবাগানের পাশ দিয়ে আসার সময় কৃপাময় সামন্তের সামনে একটা সাপ পড়ল। সংকীর্ণ মেটে পথ, পাশের কচুবন থেকে লেজটুকু ছাড়া সবটাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে সাপটার, হাত দুই সামনে। পথ পার হয়ে ডাইনে আগাছার

15

নেড়ী

27 December 2023
1
0
0

দুর্ভিক্ষের প্রথম চোটটা লাগল তারার মাথায়। তারার ছিল চুলের বাহার, মাথা ভরা চিকন কালো একরাশি চুল। মাঝে মাঝে কোনো কোনো মেয়ের এ রকম হয়-চাষাভুসোর ঘরেও। গোড়ায় তেল জুটত, বাপের বাড়িতে থাকবার সময় আর শ্বশুরবাড়ি

16

সামঞ্জস্য

27 December 2023
1
0
0

ভিতরে এবং বাইরে শান্ত গম্ভীর হয়ে প্রমথ সেদিন বাড়ি ফেরে। অনেকদিন পরে মাজ গভীর শাস্তি অনুভব করেছে, পরম মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। ভেবেচিন্তে মন স্থির করে ফেলবার পরেই এ রকম আশ্চর্যভাবে শান্ত হয়ে গেছে মনটা। স

---