বাস্তার ধারে একটা লোক মরে পড়ে আছে।
আগের দিন পাড়ায় কেউ তাকে মরাব আযোজন করতে দ্যাখেনি। তীর্থগামিনী পিসিকে হাওড়া স্টেশনে গাড়িতে তুলে দিয়ে প্রায় বাত এগারোটার সময় নরেশ বোধ হয় শেষ বাসেই রাস্তায় প্রায় ওখানটাতেই নেমেছিল।
সে নাকি পাড়ার চেনা ঘেয়ো কুকুরটাকে ঠিক ওইখানে ধাবায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখেছিল। তাকে বাস থেকে নামতে দেখে কুকুরটা অতিকষ্টে উঠে এসে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়েছিল। নরেশের বড়ো ভয় হয়েছিল, কুকুরটা পাছে কামড়ে দেয়।
কাজেই সিদ্ধান্ত করা যায় যে বাত এগারোটার আগে লোকটা ঘেয়ো কুকুরটার জায়গা বেদখল করে চিত হয়ে শুয়ে মরেনি। শেয়াল কুকুর ছাড়া রাত্রিবেলায় কেউ তাকে মরতেও দ্যাখেনি।
ভোরে উঠে দেখা গেল। রাত্রে কোথা থেকে এসে এইখানে শুয়ে মরেছে। কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি একা। জগতে এতটুকু অশান্তি সৃষ্টি না করে।
কোমবে একফালি ন্যাকড়া জড়ানো। মরেও লজ্জা বজায় রেখেছে অথবা বলা যায়, লজ্জা বজায় রেখে মরেছে।
দেহটা অত্যধিক শীর্ণ শুকনো, যাকে বলে কঙ্কালসার। মাথায় একরাশি ধুলোয় মলিন বুক্ষ চুল, মুখে ইঞ্চিখানেক গোঁপ-দাড়ি গজিয়েছে। ভাব দেখে অনুমান করা যায় যে লোকটা এককালে চুলও ছাটত, দাড়ি গোঁপও কামাত, ৮ তিনমাস সেটা বাদ গেছে। গলায় সুতো দিয়ে ঝোলানো আস্ত সুপারির মতো কালো কাঠের সুন্দর বৈষ্ণবী খোলেব মাদুলিরূপী নিদানটি পাঁজরের উপর পড়ে আছে। বা হাতের কনুইয়ে তিনটি মাদুলি, মানুষকে যা রোগ দুঃখ বিপদ-অব্দ থেকে ত্রাণ করে। গবিবকে বড়োলোকও করে।
ভূতনাথ বলে, রোগে মরেছে, মনে হয় না। রোগে এমন চেহারা হলে আর উঠে আসতে হত না,
যেখানে শুয়েছিল সেখানেই মরত। অভয় বলে, রোগে না মরলেও বোগেই মরেছে। যা ভাবছ তা চলবে না। এ দেশে বাবা না
খেয়ে কারও মরা বারণ। আমেরিকার গম আসছে, দু-চাবমন এসেও গেছে। বিমল বলে, না খেয়ে কেউ মরেও না। যে-ই মরুক মরবার আগে হার্টফেল করে মরে। হার্টফেল করে মরা ছাড়া গতি নেই মানুষের, যে 'বা বলবে স্টার্ভেশন।
শচীন বলে, না বলাই উচিত। দেশের একটা মানসম্মান আছে তো? অনা দেশে শুনলে ভাববে কী?
নরেশ ছেলেমানুষ, একটু ভাবপ্রবণ। কেউ মরেছে শুনলেই তার কষ্ট হয়, নিজের চোখে মরণ দেখলে তো কথাই নেই। সে বিরস বিষণ্ণ মুখে বলে, খুন-টুন হয়নি তো?
খুন হয়েছে বইকী। নইলে জোয়ান বয়সে মানুষটা মরে? ছোরা-টোরা মেরে নয়, না? তাহলে রক্ত পড়ত। বিষ-টিষ খাইয়েছে? আরে বোকা, বিষ হোক যাই হোক, কিছু খেতে পেলে কি মরত?
অল্পে অল্পে বেলা বাড়ে।
রেশন আনা বাজার করা ওষুধ কেনা ছাড়াও হাজারটা কাজে মানুষ এদিক ওদিক যায় আসে। রাস্তায় লোক চলাচল বাড়ে, বাস লরি মোটর গাড়ির হর্নের আওয়াজ অবিরাম হয়ে ওঠে, লোকে চোখ তুলে মৃতদেহটার দিকে তাকায়, কেউ একটু দাঁড়ায়, কাছাকাছি কয়েকজন যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রশ্ন করে। কেউ তাকাতে তাকাতেই চলে যায়।
সময় নেই, উপায় নেই, স্পৃহা নেই। একমুহূর্ত দাঁড়ালে হয়তো ফসকে যাবে আজও লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা ধল্লা দিয়ে জরুরি দরকারি জিনিসটা পাওয়া, হয়তো লেট হয়ে যাবে কাজে। অর্ধপুষ্ট অপুষ্ট শরীরে আর টানা যায় না বাঁচাব লড়াই, খিদেয় ক্লান্তিতে ঘোলাটে মনের আকাশে দুর্ভাবনার মেঘে ঢেকে গেছে সব কৌণহল আর শ্মশান-বৈরাগোব ব্যথা বোধ, খেদের অবিরাম বিদ্যুৎ ঝলকানিতে জ্বলে গেছে চাক্ষুষ মরণকেও খাতির করার সাধ।
না, সত্যিকারের মরণকে নয়। সে মরণকে তুচ্ছ করার সাধ থাকলেও সাধ্য কই।
ওরা হল ব্যস্ত বিব্রত কাজের মানুষ, এই দুর্দিনে সংসারের জোয়ালে জুড়ে দেওয়া মানুষ। কাজ নেই বলে বিরত বিপন্ন মানুষও কী কম: ভিও তাই জমে। মুখে আহা বলে খুব কম লোকেই! হৃদয়গুলি উদাসীন হয়ে গেছে বলে নয়। এ রকম মরণ দেখে সহানুভূতি কি আর থাকে অসহানুভূতিই একটা গভীর বিরাগের রূপ নিয়ে ভেতরটা ঘুঁটে দেয়।
রেশনের দোকানে আজ অসম্ভব ভিড়। নতুন হপ্তা আজ শুরু হল। রেশন নিয়ে গেলে তবে অনেকের বাড়িতে আজ হাঁড়ি চড়বে।
নইলে পাঁচ সিকে সের চাল কেনা, নয়তো উপোস দেওয়া। মাসের এই শেষ হপ্তায় রেশন ছাড়া ক-জনেরই গত্যন্তর আছে?
ঘড়ি আর ভিড়ের দিকে তাকালে ভরসা কমে আসে। মড়াটার জন্যই যথাস্থানে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করতে দেরি হয়ে গেছে দীননাথ আর অভয়ের। মানুষটা এসে মরেছে একেবারে বাড়ির সামনে। ভাত খেয়ে আজ আপিস যাওয়া ঘটবে কী অভয়?
দেখা যাক।
লাইন দিতে হয় না, দোকানের টেবিলে কার্ডগুলিই পরপর ঘাড়ে চেপে লাইন দেওয়াব প্রতীক হয়ে স্তূপ হয়েছে। বেশনকার্ডে অদৃশ্য নাড়ির সুতোয় এটে বাঁদা মানুষগুলি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে
দাঁড়িয়ে জটলা করতে পারে।
তবে, নিরুপায় হয়ে শুধু জটলা করাই সার। আশ্বিনের সকালের উজ্জ্বল মধুর আকাশ-বাতাস, প্রাণ কেন শারদোৎসবের ছোঁয়াচ আঁচ করতে পারে না কে জানে!
দেখা যায়, ছেলে কোলে একটি বউ এগিয়ে আসছে ক্লান্ত মন্থর পায়ে। খানিক এগিয়ে থেমে দাঁড়িয়ে কী যেন বলছে পথের ধারের দোকান অথবা বাড়ির মানুষকে। পরনের কাপড়খানা দেখে তফাত থেকে ভিখারিনি মনে হয় না।
রেশনের দোকানের সামনে এলে দেখা যায়, ছেঁড়া আর ময়লা হলেও পরনে তার তাঁতের রঙিন শাড়ি। বিবর্ণ বিশীর্ণ মুখে কোটরে-বসা চোখ, তেলের অভাবে একরাশি ঘন চুল জট বাঁধছে। শুকিয়ে আমসি বনে গেছে কোলের বছর দেড়েকের উলঙ্গ ছেলেটা, যেন নেশার ঘোরে ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে আছে বড়ো মানুষদের ভিড়টার দিকে।
পৃথিবীতে নবাগত শিশু। খিদে পেলেই চেঁচিয়ে চারিদিক মাত করা অধিকার সে যেন ত্যাগ
করেছে-খিদেয় খিদেয় ঝিমিয়ে গিয়ে খিদের নেশায় ফুঁকবার অধিকার পেয়ে। এদিকে একটা মানুষকে দেখেছ বাবুরা? পাগলের মতো দেখতে? কোমরে একটা কানি জড়িয়েছে, খুব চুলদাড়ি হয়েছে? দেখেছ, মোর সোয়ামিকে?
স্বামী আর সিঁদুর কিনা একাকার সবার চেতনায় তাই প্রথমেই স্বামীদের মনে হয় যে বউটার কপালে আর সিঁথিতে যা লেপা আছে তা আসল সিঁদুর নয়, দেখলেই বোকা যায় যে জল দিয়ে শানে পোড়া ইট ঘষে সিদুব বানিয়েছে-এই সিদুর সিথিতে যতটা পারে গাদা করে চাপিয়েছে, কপালের ফোঁটাটা করেছে মস্ত। তাকালেই যেন লোকে বুঝতে পারে যে সে বউ-গেরস্ত ঘরের বউ।
ভূতনাথ ভাবে, হায় রে, শহরে বিজ্ঞানের এত চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপন, শহরে এসে তোকে ইটের গুঁড়ো দিয়ে নিজের গায়ে এই বিজ্ঞাপন আঁটতে হয়!
একজন বলে, কোন দিকে গেছে, স্বামীকে কোথায় খুঁজে বেড়াবে।
এদিকে কাছে কোথা আছে। না খেয়ে খুঁকছে মানুষটা, দূরে কোথা যাবে বাবু? যাবার সাধ্যি
পাবে কোথা?
সে-ও ধুকতে ধুকতেই কথা বলে, প্রাণহীন স্তিমিত চোখে তাকায়।
তোমার ঘর কোথা?
সে অনেক দূর গাঁয়ে। মানুষটারে দ্যাখোনি বাবু কেউ
ভূতনাথ বলে, এগিয়ে দ্যাখো তো, জলের কলটার কাছে, সাদা বাড়ির সামনে। ও বকম একজন শুয়ে আছে দেখলাম যেন।
শুয়ে আছে, না বাবু?
শুয়ে আছে না বসে আছে কী করে বলব বলো।
মরে যায়নি। শুধু শুয়ে আছে? না বাবু?
নরেশের সর্বাঙ্গো কাটা দেয়।
কাঁদো কাঁদো মুখে সে বলে, তুমি আমার সাথে এসো। ও বোধ হয় অন্য লোক।
নরেশদের বাড়িটা পড়বে আগে-মড়ার কাছে পৌঁছবার আগে। পাশের একটা গলির মধ্যে
ঢুকেই তাদের বাড়ি।
নরেশ ভাবে, আগে বাড়িতে নিয়ে একে কিছু খেতে দেবে কী? বাচ্চাটাকে একটু দুধ সে খাওয়াবেই। সে জন্য বাড়ির লোকের সঙ্গে মারামারি করতে হলে মাবমারি করবে।
কোনো প্রশ্ন করে না কেন বউটা? তার স্বামীর মতো একজন স্তার ধবে শুয়ে আছে শুনেও ব্যাকুল হয় না কেন? লোকটা যদি সত্যি এর স্বামী হয়, মরে গেছে দেখে কীভাবে হাহাকার করে কেঁদে উঠবে, কীভাবে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়বে নয় আছড়ে পড়বে-সেই মর্মান্তিক নাটকের কথা ভেবে তাব নিজের বুকটা যে ধড়ফড় করছে।
কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখতে হবে শুনতে হবে সব। পালিয়ে গেলে চলবে না। কাঁদাকাটার পালা চুকালে কী নাম কোথা থেকে এসেছে কীভাবে কী ঘটেছে সব বিবরণ জেনে নিতে হবে।
গলির মোড়ে পৌঁছে নরেশ বসে, বাচ্চাটাকে একটু দুধ খাইয়ে নেবে এসো।
আগে দেখে আসি। শুয়ে আছে, না? ঘুমিয়ে আছে ?
ধীরে ধীরে পা টেনে টেনে সে হাঁটে। তফাত থেকে দেহটার পড়ে থাকার রকম আর খানিক সরে দাঁড়িয়ে ভিড়ের মানুষগুলির জটলা করতে। খও সে একটু জোরে হাঁটে না।
মানুষের শুয়ে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা আর মরে পড়ে থাকা যেন সমান হয়ে গেছে তার কাছে। সিধুর দোকানের সামনে রোয়াকে একজন পুলিশ উবু হয়ে বসে আছে। মৃতদেহটা সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কাছে এসে দাঁড়ায় বউটি। একদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিস্পৃহভাবে বলে, মরে
গেছে, না?
হ্যাঁ। তোমার স্বামী নয় ?
বউটি মাথা হেলিয়ে জানায় মড়াটা তারই স্বামী।
নরেশ থ বনে থাকে। এ কেমন বউ, অ্যাঁ? রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ তো? না, মৃত স্বামীর টানে? পা শিরশির করে নবেশের।
হঠাৎ চোখের সামনে শূনো মিলিয়ে না গিয়ে সকালবেলার তাজা রোদে দেহের ছায়া ফেলে তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নরেশ সবে একটু স্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করেছে, হঠাৎ যেন প্রাণ পায় বউটি। বাচ্চাটার দুপা ধরে শূন্যে তুলে প্রাণপণে রাস্তায় আছাড় মারে। মাথার খুলি চূর্ণ হয়ে যায়। তারপর নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে চলন্ত বাসটার সামনে।
প্রমাণ হয়, কপালে আর সিঁথিতে অত করে ইটের গুড়োর সিঁদুর লাগালেও বউটি সেকালের স্ট্যান্ডার্ডের খাঁটি সতী নয়, তাহলে বাসের সামনে ঝাঁপ দিতে হত না, মৃত স্বামীকে দেখে আপনা হতেই প্রাণপাখি তার বেরিয়ে যেত। না খেয়ে না খেয়ে মরমর অবস্থাতে আপনা থেকে মবে যাওযাব বদলে মরতে কিনা দরকার হল চলন্ত বাসের।