বিলাসময়ের স্ত্রী সুরবালা শুনে বলে, না, আত্মীয়বন্ধুর সলো দেনা পাওনার সম্পর্ক করতে নেই। বড়ো মুশকিল হয়। বাইরের লোকের সঙ্গে সোজাসুজি কারবার, যা বলবার স্পষ্ট বলতে পারবে। আত্মীয় বন্ধুর কাছে চক্ষুলজ্জায় মুখ ফুটবে না, বন্ধুকে ভাড়াটে করে বাড়িতে এনে কাজ নেই।
বড়ো মুশকিলে পড়েছে বেচারা---
পড়ুক অমন কত লাখ লাখ লোক ঢের বেশি মুশকিলে পড়েছে। বন্ধুকে অন্য বাডি খুঁজে দাও. নিজের বাড়িতে ও ঝঞ্ঝাট ঢুকিয়ে কাজ নেই।
বিলাসময়ও যে কথাটা এদিক থেকে বিবেচনা করেনি তা নয়। সুধীব অনেকদিনের বন্ধু গলায় গলায় ভাব। সেলামির কোনো প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু ওকে ঘর দুখানা ভাড়া দিয়ে একপয়সা আগাম নেওয়া যাবে না, সময়মতো ভাড়া না দিলে দাবড়ানি দেওয়া যাবে না, উঠতে বসতে সন বিষয়ে বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখে চলতে হবে। কিন্তু অন্তরঙ্গ বন্ধু বলেই আবার মুশকিল রেহাই পাওয়া যায় কীসে? সুধীর এত কবে বলছে, এখন তাকে না দিয়ে অন্য কাউকে ঘর দুখানা কোন অজুহাতে দেওয়া চলবে সে তাই চিন্তিতভাবে বলে, ও কী সহজে ছাড়বে?
সুরবালা তাকে বুদ্ধি বাতলিয়ে দেয়। বলে, এক কাজ কবো। যা দিনকাল পড়েছে, পক্ষ নলেই তো টাকাপয়সার ব্যাপারে খাতির করা চললে না? খুব চড়া ভাঙা চেয়ে বসো সত্তর বা আশি টাকা। আর আগাম চাও পাঁচশো। বলবে যে একজন আগাম দিয়ে এই ভাড়ান আসতে চায়। বন্ধু নিজেই ছাড়বে ভাবতে হবে না।
এ মন্দ যুক্তি নয়। পাঁচশো টাকা আগাম দেবার সাধ্য যদিই বা হয় যাব করে গয়নাগাটি বন্ধক দিয়ে মাসে দুখানা ঘরের জন্য আশি টাকা ভাড়া দেবার ক্ষমতা সুধীবের নেই। দাম চাহিদাম এই বাজারেও ঘর দুখানার চল্লিশ টাকার বেশি ভাড়া হয় না-সাধ্য থাকলেও সুদীর ডবল ভাড়া দিয়ে রাজি হবে কেন?
ভাগ্যে এখনও 'ভাড়ার কথা কিছু হয়নি সুধীরের সঙ্গে। সে শুধু দাবি জানিয়ে রেখেছে সে. ঘব দুখানা সে-ই ভাড়া নেবে। অন্য কাউকে যেন দেওয়া না হয়। কীভাবে বস্তুর কাছে আগাম আর ভাড়ার কথাটা পাড়বে মনে মনে বিলাসময় তাই আওড়াতে থাকে।
পরদিনই সুদীর কথাটা পাকা করতে আসে। দু-তিনমাস তার মুখে দুশ্চিন্তাব বাড়তি একাটা কালো ছাপ পড়েছিল আজ দেখেই বোঝা যায় মুখ থেকে সে মেঘটা কেটে গেছে।
দেখে, বিলাসময় বড়োই অস্বস্তি বেশ করে।
ঘর দুখানা সে পাবেই এটা নিশ্চিত জেনে বন্ধু একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। তা, তাদের বন্ধুত্বের হিসাব ধরলে সুধীরের নিশ্চিন্ত হওয়া আশ্চর্য নয়। আর নিশ্চিন্ত হয়ে তার মুখে যে অনেকদিন পরে হাসি ফুটবে সেটাও আশ্চর্য নয়। কী অবস্থায় যে তার দিন কাটছে বিলাসময় তা ভালোভাবেই সব কিছু জানে।
কীভাবে এ অবস্থায় এসে পড়েছে সে ইতিহাসও তার অজানা নয়। জন্ম থেকে তার কলকাতায় বসবাস, পাকিস্তান-হিন্দুস্থানের জন্ম সংক্রান্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামার ধাক্কা লেগেছে তারও গায়ে। তার দাদা ভালো চাকরি করে, একখানা বাড়ি করেছে। অবশ্য স্ত্রীর নামে, নইলে সাহস করে ভাইকে একখানা ঘরে থাকতে দেবার মতো উদারভাটা দেখিয়ে ফেলাব ভুলটা করত কী না সন্দেহ। এঠাৎ পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে এসেছে তার শ্বশুরবাড়ির সকলে আর ছেলেপুলে নিয়ে তাব বড়ো মেয়ে ও জামাই।
বাড়ি থেকে সুধীরকে সে এক রকম তাড়িয়ে দিয়েছে। সুধীরের মেয়েটির সন্তান সম্ভাবনা সত্ত্বেও। হয়তো নিরুপায় হয়ে অগত্যাই ভাইকে এ অবস্থায় এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে, নইলে শেষের দিকে ব্যবহার খারাপ হয়ে এলেও একখানা গরে ভাইকে সপরিবাণে নাগা গুঁজে থাকতে দিতে আরও কিছুকাল হয়তো তার আপত্তি হত না।
শ্যামবাজাবে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সুধীব যে কটা দিন নিজের একটা আস্তানা খুঁজে নিতে না পারে। দুখানা দরে বোনের মস্ত সংসার তার মধ্যে আসন্নপ্রসবা মেয়েটি সমেত সুধীর মাথা গুঁজে আছে আজ প্রায় তিন মাস। তার ওপর স্ত্রীবও তার অসুখ।
বোন, ভগিনীপতি আর ভাগনে-ভাগনির মুখ গোমড়া ভালো কবে কেন কেউ এক রকম তাদের সঙ্গে কথাই কয় না। শুধু গজলগজব করে।
সুধীর প্রথম কথাই বলে মারাত্মক। ১৮৩ দুটো যখন ভাড়াই দেবে-কাল-পরশ্ব থেকে দিয়ে দাও। আজ মাসের তেইশে মিছে আব পয়লা পর্যন্ত ভোগাবে কেন! একেবারে পাগল হয়ে যেতে বসেছি।
বিলাসাস চেষ্টা করেও মুখের ভাব বা গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে পারে না। বীতিমতো গম্ভীর হয়ে বলে, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার আমার মধ্যে ঢাকঢাক গুড়গুড় কিছু নেই- আমাদের সে সম্পর্ক নয়।
সুধীণ ভড়কে গিয়ে বলে, এ যে বিষন রকম ভূমিকা করে বসলে ব্যাপার কী ভাই? ব্যাপার কিছু নয়। তোমায় শুধু খোলাখুলি একটা কথা বলছি। ভাঙা-টাড়ার ব্যাপারে আমি কিন্তু কোনো রকম কনসেশন দিতে পারব না। অন্যের কাছে যা পার তোমাকেও তাই দিতে হবে।
সুধীর গপ্তি পেয়ে বলে, তাই বলো। এই কথা? অন্যে যা দেবে আমিও নিশ্চয় তাই দেব। আমি চেয়েছি কনসেশন? আমিও ভাবছিলাম তোমায় স্পষ্ট বলে দেব, এ সব বিষয়ে যেন কোনো রকম সংকোচ কোরো না। লেনদেনের ব্যাপাবে বন্ধুত্ব টানতে নেই সাফ স্পষ্টকথা। ঘর পাচ্ছি তাই ঢের, তোমার আর্থিক ক্ষতি করব কেন ভাই।
বিলাসময় স্ত্রীকে স্মরণ করে আন্তবিক নিশ্বাস ফেলে বলে, দিনকাল বুঝতেই পারছ। তাছাড়া এ শুধু আমার নিজের ব্যাপার নয়-উনিও একজন কর্তাব্যক্তি।
সুধীর ।হসে বলে, আমাকে কর্তা চেনচ্ছে নাকি। আমার বাড়িতে কর্তাব্যক্তি নেই?
সে তখনও ধারণা করতে পারেনি বিলাসময় দুখানা ঘরের জন্যে কী অসম্ভব দাবি করে বসবে। বন্ধুর প্রস্তাব শুনে হাসি মিলিয়ে তার মুখ খানিকটা হাঁ হয়ে যায়। বিস্ময় আর অবিশ্বাস তাকে বলাষ। ঠাট্টা করছ?
না ভাই, ঠাট্টা নয়। এব কমে পারব না। কালবেই একন আমায় টাকাটা হাতে গুঁজে দিযে রসিদপত্র লিখে ফেলবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল।
পাঁচশো টাকা আগাম? আশি টাকা ভাড়া
সুধীরের বিশ্বয় আর অবিশ্বাস যেন কিছুতেই কাটতে চায় না।
বিলাসময় তার মুখের দিকে না তাকিয়ে অনাদিকে চেয়ে বলে, তুমি হয়তো ভাবছ, আমিও দলে ভিড়েছি, চামার হয়ে পড়েছি। কিন্তু কী করি বলো? অনোর কাছে যা পাব, তোমার বেলা কমাতে পারব না। টাকার চিন্তায় পাগল হতে বসেছি। তোমার পোহাবে না জানি, আমি বরং তোমায কম ভাড়ার ঘর খুঁজে দেব। সুধীরের মুখে অদ্ভুত এক ধরনের একটু হাসি ফোটে।
তিন মাসে খুঁজে দিতে পারলে না, আর কবে খুঁজে দেবে?
বিলাসময় কথা কয় না।
সুধীর একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের ভাবের প্রতিফলনে তার মুখে যেন ঘন কালো মেঘ আর চড়া রোদের খেলা চলতে থাকে। সকলের জীবনে চারিদিক থেকে কী ভয়ংকর স্ত্রী বীভৎস সব অন্যায় আর অনিয়মের আবির্ভাব ঘটেছে। দিন দিন যেন ভয়াবহ হয়ে ওঠার রেটটা চড়ছে জীবনযাপনের। যুদ্ধ থেমে গিয়ে ইংরাজ চলে গিয়ে কংগ্রেস রাজা হয়েছে বলে কী এত স্বপ্নাতীত অঘটন অনিয়মও সম্ভব হতে পারে?
সুধীর বলে, ঘর খুঁজে দেবে বলছ, কিন্তু এই যদি ঘরভাড়ার বাজারদর হয়, কম ভাড়ায় ঘর তুমিই বা কোথায় খুঁজে পাবে?
দেখব চেষ্টা করে।
দু-চার-দশবছর লেগে যাবে।
বিলাসময় আবার চুপ করে থাকে।
সুধীর বলে যাক গে, কী আর করা যাবে। এর মধ্যে খবর পেয়ে একজন যখন পাঁচশো টাকা আগাম দিয়ে ওই ভাড়ার ঘর দুটো ভাড়া নিতে পীড়াপীড়ি করছে, ঘরভাড়ার বাজারদরটা এই রকম দাঁড়িয়েছে নিশ্চয়।
বিলাসময় বেশ খানিকটা শঙ্কিত হয়ে বন্ধুর কথা শোনে। সুধীর সতা তার অসম্ভব দাবি মেনে নেবে নাকি!
সুধীর আরও মিনিটখানেক ভেবে বলে, বেশ, আমি রাজি। তুমি যা চাইছ তাই দেব। পারবে?
পারব-কষ্ট হবে। দিনকালটাই দুঃখকষ্টের উপায় কী! আমি কিন্তু পরশুই আসব ভাই। এ ক-দিনের জন্য অর্ধেক মাসের ভাড়া দেব কিন্তু। পুরো মাসের দেব না আগেই বলে রাখছি।
সুরবালা আড়াল থেকে কান পেতে সব কথাই শুনছিল। খানিক পরে সে চা আর শিঙাড়া নিয়ে ঘরে ঢোকে।
এসে বাইরের ঘরেই বসে রইলেন? অন্তত একটা খবর তো দিতে হয়।
খবর পেয়েছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছি-বাবার এসে গেছে। দুদিন বাদে স্থায়ীভাবে ভেতরে ঢুকছি, সবাইকে নিয়ে। জ্বালাতনের একশেষ হবেন।
জ্বালাতন হতেই তো চাই!
বিলাসময় মুখের দিকে চেয়ে-সুরবালা যেন আড়াল থেকে কিছুই শোনেনি কিছুই জানে না এইভাবে বলে, কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেল?
হ্যাঁ। ও রাজি হয়েছে। পরশু দিন আসবে বলছে।
সুরবালা বলে, বেশ তো ভালোই। কাল সন্ধ্যায় তাহলে লেখাপড়াটা করে ফেলুন? না পরশু সকালে আসবেন?
সুধীর শিঙাড়া চিবোতে চিবোতে বলে, কাল সন্ধ্যাবেলাই আসব। পরশু আসব সবাইকে নিয়ে। সুধীর আর বড়োঙ্গেলে বিষ্ণুর গায়ের জোরের উপর নির্ভর করে গাড়ি থেকে নেমে টলতে টলাতে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার সময় অলকাকে দেখেই টের পাওয়া যায় গত সন্ধ্যায় সুধীর কোথা থেকে কীভাবে সংগ্রহ করে এনে পাঁচশো টাকা আগাম দিয়ে ঘরভাড়ার চুক্তিপত্র সই করেছিল। অলকার গা খালি। সুরবালার ঠিকা ঝির নাকে কানে আর হাতে যেটুকু সোনা আছে, অলকার গায়ে সেটুকুও নেই। সোনা-বাঁধানো একটি লোহা পর্যন্ত নয়। শুধু কপালে সিঁদুর আর হাতে শাখা।
পাঁচশো টাকা আগাম দিয়ে আশি টাকা মাসিক ভাড়ায় যে মানুষটা ঘরভাড়া করে তার বউ যখন স্বর্ণচিহ্ন-লেশহীনা হয়ে ভাড়াকরা ঘরে ঢোকে তখন কী আব অনুমান করতে কষ্ট হয় যে মেয়ের বিয়ে দিয়ে গয়নাগাটি যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে ঘরভাড়া আগামের টাকাটা সংগ্রহ করা হসেছে।
পুষ্প নিজেই গাড়ি থেকে নামে খুব সাবধানে। আজকেই কোনো একসময় তার প্রসববেদনা শুরু হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সুববালার মেয়ে বিনতা পুষ্পব সমবয়সি বিয়ের আগে দুজনের গলায় পলায় ভাব ছিল।
বিয়ের পর দুজনের দেখা হয়েছে কদাচিৎ-বছরে দু-একবার। তবু কুমারী জীবনের সখিত্ব কী শেষ হয় বিয়েব পর কয়েক বছরের অদর্শনে? বিনতার ছেলেপিলে হয়নি এখনও, সে শুধু বেড়াতে এসেছে বাপের বাড়ি, উৎসুক আগ্রহে সে এগিয়ে যায়, পুষ্পকে রান্ন, " বেশ, বিয়ে তো সবারই হয়, এর মধ্যে এমন কাণ্ড করেছিস?
পুষ্প ভারী মুখে নিস্পৃহভাবে সংক্ষেপে বলে, কাণ্ড আবার কী? তুই নিশ্চয ঠেকিয়েছিস? হায়, সখিত্ব শেষ হয়ে গেছে তাদের। কোনো স্বার্থেব কোনো টানাটানি থাকে না বলে যে ছেলেমানুষি সখিত্ব জনায়েত থাকে আজীবন একযুগ পরে ঘটনাচক্রে কয়েক ঘন্টার জন্যে দেখা হলে দুটি ধর্ষিতা নিপীড়িতা মনেও আবার ছেলেমানুষি রূপকরসের আমেজ লাগে-সেই সবিত্ব তাদের তিতো হয়ে গেছে।
কেন হয়েছে সে তো জানা কথাই।
প্রথম কাজ বিছানা পেতে অলকাকে শুইয়ে দেওয়া, তারপর ঘবসংসার গুছানো। সুববালা অলকার কাছে গিয়ে দাড়ায়।
রোজ জ্বর আসে নাকি?
রোজ।
অলকা খুকখুক করে কাশে। শঙ্কিত চিন্তিত দৃষ্টিতে সুববালা চেয়ে থাকে। কে জানে এ কী রোগ বাড়িতে ঢোকানো হল? বেশি মেলামেশা ঘেঁষাঘেঁষি চলবে না।
ছেলেমেয়েদের সুরবালা সাবধান করে দেয়।
এক বাড়িতে সপরিবারে দুটি বন্ধু-বাড়িওলা ও ভাড়াটে সম্পক। ক-দিন আগেও বাস্তায় দেখা হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে কখন ঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে টের পাওয়া যায়নি, আজ এত কাছাকাছি এসেও দু-চারমিনিটের বেশি আলাপ হয় না-তাও আবার ছাড়াছাড়া 'ভাসাভাসা আলাপ। সময় আছে ঢের-হঠাৎ যেন বক্তব্য যুবিয়ে গেছে উভয় পক্ষের! দূরে দূরে দুটি ভিন্ন বাড়িতে থাকার সময় যেমন নিজের নিজের ভাবনা নিয়ে তারা মশগুল থাকত, সেই দূরত্বই যেন এসেছে এক বাড়িতে পার্টিশনের দু-পাশের মধ্যে। পার্টিশন শুধু ঘর দুখানার জন্য। সদর দরজা এক, কল বাথরুম এক, বারান্দার একটু অংশ ঘিরে তৈরি নতুন রান্নাঘর ও সুরবালার রান্নাঘরে যাওয়া-আসা একই বারান্দা দিয়ে। দুরত্বটা তাই স্পষ্ট অনুভব করা যায়-প্রত্যেকে অনুভব করে কাছে আসার বাস্তবতাটা বাতিল করার কৃত্রিম বিশ্রী দূরত্ব।
মাসকাবারে সুধীর অর্ধেক মাসের ভাড়া দিতে গেলে বিলাসময় বলে, থাকগে, এ ক-টা দিনের ভাড়া দিতে হবে না। একেবারে সামনের মাস থেকে দিয়ো।
তা কী হয়। কথা যা হয়েছে সেটা শুনতে হবে বইকী।
মাসের মাঝামাঝি পুষ্প তিন দিন দারুণ কষ্ট পেয়ে একটি ছেলে বিয়োয়, বাচ্চাটা মারা যায় পরদিন। বাচ্চাটা মারা যাওয়ায় কেউ বিশেষ দুঃখিত হয়েছে মনে হয় না, বরং আরও একটা দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য একটু স্বস্তিই যেন সকলে বোধ করে-পুষ্প পর্যন্ত।
ছেলেপিলে হয়ে মারা গেলে শুধু চুকেবুকে যায় হাঙ্গামা, মায়েব পর্যন্ত আপশোশ হয় না, অবস্থার ফের এমনও করে দিতে পারে এই সব স্নেহাতুরাদের ? পেটের দায়ে ছেলেমেয়ে বেচে দেবার কাহিনি আজও এই দুর্ভিক্ষের দেশে শোনা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাপ-মা ব তো এই হিসাবটাও থাকে যে অন্যের হয়ে যাক, ছেলেমেয়ে তো উপোস দিয়ে মরার বদলে বাঁচবে।
কোনো হাসপাতালে বেড খালি পাওয়া যায়নি। অন্য প্রসবাগারে দেওয়া যেত-কিন্তু সেডের ভাড়া আর আনুষঙ্গিক খরচ বড়ো বেশি। বাড়িতে ভালো ডাক্তার আনা যেত। কিন্তু ভালো ডাক্তারের ভাড়া বড়ো চড়া। সাধারণ যে ডাক্তার সুধীর এনেছিল সে-ও পুষ্পব কষ্টভোগ কমাতে পাবত, বাচ্চাটাকে হয়তো বাঁচাতে পারত কিন্তু... এখানেও সেই একক কিন্তু-সে জন্য যে চিকিৎসা দরকার ছিল তার জন্য খরচ দরকার ছিল অত্যধিক।
জামাইকে টাকা পাঠাতে জরুরি তার করেছিল। ছাঁটাই বেকার জামাই এসেছিল খালি হাতে- সব চুকেবুকে যাওয়ার পর জামাইকে তার ফিরে যাবার গাড়িভাড়া দিতে হয়েছে।
সকলেই প্রায় নির্বিকারভাবে হিসাব-কবা স্বস্তির সঙ্গে বাচ্চাটার মবণকে স্বীকার করেছে, সুধাব পারেনি। এই তার প্রথম নাতি বলে নয়, ও সব শখ আর সুখ্যে হিসাব তার চুকে গেছে। সে ছাড়া বাড়ির কেউ জানে না যে চেষ্টা করলে টাকা খরচ করলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেত। সেই শুধু জানে। সেই শুধু জানে যে, মেয়েটার তিনটি দিনরাত্রি ঘরে অমন বীভৎস যন্ত্রণাভোগও প্রয়োজন ছিল না।
মেয়েটার জন্যই এক রকম মরিয়া হয়ে দুটি ঘরের জন্য সে পাঁচশো টাকা জোগাড় করেছে, দেড়শো-দুশো টাকার জন্যে সেই মেয়েটাকে ঠিকমতো প্রসব করানো গেল না।
সুধীরের বুকটা তাই জ্বলে যায়-আপশোশে ক্রোধে ক্ষোভে ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় !
তবু শান্ত নির্বিকারভাবেই সে মাসকাবারে দুশো টাকা বেতন থেকে আশি টাকা বিলাসময়ের হাতে গুনে দেয়, স্ট্যাম্প আঁটা রসিদ গ্রহণ করে।
তারপর একদিন হঠাৎ স্তম্ভিত বিস্ময়ের সঙ্গে বিলাসময় ও সুরবালা টের পায় সুধীর তাদের কিছু না জানিয়েই ঘর দুখানার ন্যায্য ভাড়া ঠিক করে দেবার জন্যে রেন্ট- কনট্রোলারের কাছে দরখাস্ত করেছে।
ভাড়া নির্দিষ্ট হয় চল্লিশ টাকা। যে আশি টাকা সুধীর দিয়েছে তার অর্ধেক টাকা পরবর্তী মাসের অগ্রিম ভাড়া হিসেবে ধরা হয়।
সব চুকেবুকে যাবার পর সদর দরজায় খিল লাগিয়ে ভেতরে এসে বিলাসময় আকাশে গলা তুলে চিৎকার করে বলে এত বড়ো বজ্জাত তুমি। বন্ধু সেজে বন্ধুর সঙ্গে এই ব্যবহার। এই মতলব ঠিক করে তুমি ঘরভাড়া নিয়েছিলে? বেরোও তুমি আমার বাড়ি থেকে তোমার আগাম টাকা, ভাড়ার টাকা পাই পয়সাটি পর্যন্ত ফিরিয়ে দিচ্ছি, বেরিয়ে গিয়ে রেহাই দাও আমায়।
সুরবালা তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচায় বন্ধুর বেশে এ কোন সর্বনেশে শনি ঘরে ঢুকেছে গো! ঘন দুখানা থেকে কোনো জবার আসে না। শুদ শোনা যায় সুধীব বিন্নকে ধমকাচ্ছে চুপ কবে থাক। কথাটি বলবি না।
বিলাসময় সের্য হাবিনে গাল দিয়ে বলে, হারামজাদা, জুযাচোব বজ্জাত। বেবো তুই আমার বাড়ি থেকে। তোদের আমি ঘাড়ে ধবে লাগি নেবে বাড়ি থেকে তাভাব।
বিষ্ণু কালজে পড়ে। তাব আঃও তীরকণ্ঠ শোনা যায় চুপচাপ গালাগালি শুনবে বাবা
কবাবে সুধীবের দৃঢ়কণ্ঠ শোনা যায় দিক না গালাগালি। ছোটোলোক মানুষ আব কুরুব ঘেউ ঘেউ কবে। আমাদের কী বয়ে গেল পুলিশ ডেকেও তো আনাদেব তুলতে পারবে না। তুই চুপ কবে বসে থাক।
চপ্যাপ গাল শুনব।
বিষ্ণুর কথা প্রাস আর্তনাদের মতো শোনায়।
বিলাসময় গর্জন করে বলে, এই শূযার বেবোলি ঘর থেকে তীররেগে বিষ্ণু সব থেকে বেরিয়ে যায়। বিনাসময়ের সামনে বুখে দাঁড়িয়ে বলে, শূযার বলছেন কাকে?
সুরবাল আতকে উঠে স্বামীর গায়েব গেঞ্জি টেনে ধরে বলে, থাক থাক, চুপ কবো। পবে বিহিত হবে।
বিললাম, নম্বর গালে একটা চাপড় বসিয়ে দেয়। বলে, শূযাব বলছি তোর বজ্জাত জুখাচোব বাপকে।
সেটা উভয়পক্ষের কমন বারান্দা। বাবান্দার এ প্রান্তে সুধীবদের জন্য সংক্ষেপে ঘেবা রান্নাঘর পুষ্প সেখানে চালকুমড়ার এবকাবি বেঁধে কুচি করে কাটা ঢোকলা দিয়ে ছেঁচকি বাঁধতে বাঁধতে পৃস্তি হাতে বেরিয়ে এসে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়েছিল।
বিষ্ণু তার হাতের সেই সস্তা চিলতে যুস্তিটা কেডে নিয়ে বিলাসময়ের ঘাড়ে বাঁড়ার মতো কোপ খাবে। খুস্তির গায়ে মানুদের গায়ের চামড়ার চলটা পর্যন্ত তোলা যায় না দেখে সে বোধ হয় খেপে সায়।
বারান্দার এদিকে শেষ প্রান্তের দেয়াল ঘেঁতে বিলাসনযেব কয়লা বাথা হয়। এক একখানি আস্ত ইট দিয়ে ঘবোমা কয়লা গুদামটির সীমা প্রার্চার করা হয়েছে। বিষ্ণু অবশ্য অনায়াসে ওই আলগা ইট তুলে নিয়ে বিলাসমনকে মাবতে পাবত।
তাব বদলে সে কয়লাবই একটা সাত আটসেবি চাপড়া তুলে নিয়ে বিলাসময়ের মাথায প্রাণপণে ঠুকে দেয়। আগের দিন বিকালে বিলাসময়ের দুমন কয়লা এসেছিল। দুমন কমলায় তাব তেবো দিন চলে। বিলাসমন কাত হয়ে পড়ে যায়। মনে হয় সে যেন সুবালাব কোলেই ঢলে পড়েছে। তাব ফটা মাথা দিয়ে গলগল করে বস্তু বেরিয়ে আসে।