বলে কিনা, চুলোয় যাক তোমার ঘরসংসার! আমি এত খেটে খেটে মরতে পারব না।
দুজনেই বলে, যখন-তখন-যে যাকে যখন বলার একটা সুযোগ বা অজুহাত পায়। পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চুলোয় পাঠাবার জন্যই যেন এতকাল ধরে গায়ের রক্ত জল করে তারা দুজনে সংসারটা গড়ে তুলেছে, টিকিয়ে রেগেছে।
রেশন হয়তো না আনলেই নয়।
চুষিকেশ বলে, সংসার টানার জন্য খাটব গাধার মতো, আবার রেশন আনতে বাজার করতেও ছুটতে হবে আমাকেই? ছেলেরা যেতে পারে না? কোথাকার নবাব এসেছে?
মোহিনী বলে, আমার হয়েছে সবদিকে জ্বালা। দুদিন বাদে ওদের পরীক্ষা নেই? রাত জেগে জেগে কী চেহারা হয়েছে দেখতে পাওনা? রেশন আনার কথা বলতে গেলে খেঁকিয়ে উঠবে।
হৃষিকেশ বলে, মেয়ে দুটোকে পাঠাও। বাপের ঘাড়ে গিলবে আর মুটোবে, রেশনটা নিয়ে আসুক।
মোহিনী ঝংকার দিয়ে বলে, হ্যাঁ, ওই ধুমসো দুটো মেয়ে ভিড়ের মধ্যে যাবে রেশনের জন্য ধন্না দিতে! কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়েছ নাকি তুমি? চুলোয় যাক তোমার ঘরসংসার, আমি এত খেটে খেটে মরতে পারব না।
বলে গজরগঞ্জর করতে করতে হৃষিকেশ টাকা আর খলি হাতে নিয়ে রেশন আনতে যায়। স্কুল-কলেজ আপিসের তাড়ায় বিব্রত মোহিনী রান্নাঘর থেকে বড়োমেয়েকে ডেকে বলে, শুভা, চট করে মশলাটা বেটে দে আমায়। একহাতে কত করব ?
শুভা মিনতি জানিয়ে বলে, বাবার কাছে পড়াটা একটু বুঝে নিচ্ছি মা। বাবা তো এখুনি আবার বাজারে চলে যাবে। কলেজে দেবে না, মাস্টার রাখবে না, নিজে নিজে পড়ে কেউ প্রাইভোটে পাস করতে পারে? কী রেটে ফেল করছে দেখছ তো?
মোহিনী দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো শিলটা পেতে ধুতে ধুতে ঝংকার দিয়ে বলে, একটা ঠিকে ঝি পর্যন্ত রাখবে না। চুলোয় যাক তোমার ঘরসংসার, এত খেটে খেটে আমি মরতে পারব না।
শুভা উঠে এসে বলে, দাও, বেটে দিচ্ছি। কাজ নেই আমার পরীক্ষা পাস করে। মোহিনী ধমক দিয়ে বলে, তুই পড়বি যা তো হারামজাদি। কলেজে দেয় না, মাস্টার রাখে না, বই কিনতে কত টাকা লেগেছে হিসাব রাখিস?
পুলক পড়া ফেলে লাফিয়ে উঠে আসে। মায়ের কাছে হাত দুটি জোড় করে থিয়েটারি ঢংয়ে বলে, ফেল কী আমরা ইচ্ছা করে হই মা। আমাদের ফেল করাচ্ছে জানো না? বাংলাদেশের ছেলেরা কী হঠাৎ বোকাহীদা হয়ে গেছে? পরীক্ষা দিয়ে সত্তর পঁচাত্তর পার্সেন্ট ফেল করে?
এত বড়ো ছেলের এই অস্বাভাবিক ছেলেমানুষি চংটুকুই কী সয় মা মোহিনীর ? ক্ষোভ বিদ্বেষ রাগ আর নালিশ দিয়ে একটা উগ্র প্রতিবাদের মতোই যে নিজেকে খাড়া রাখে সে ছেলের একটু ছ্যাবলামির আঘাতেই যেন ঝিমিয়ে নেতিয়ে যায়, গা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ বোজে! ভাইবোন দুজনেই ভড়কে যায়।
শুভা বেঁঝে ওঠে পুলকের উপর, তোমায় ডেকেছিলাম মুরুব্বিয়ানা করতে? যাও না নিজের ফেলের পড়া করো না গিয়ে। এই সরু প্যাসেজটুকু দিয়ে সকলের আনাগোনা। শিল-ধোয়া জলে পায়ে পায়ে আনা ধুলোময়লার কাদার মধ্যে বসে পড়ে মা-কে দুহাতে বুকে জড়িয়ে শুভা বলে, অমন কোরো না না! আমরা কী আগের মতো বোকাহাবা স্বার্থপর আছি, তোমার কষ্ট বুঝব না? কী করি বলো-
চোখ মেলে মেয়ের কোল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একটু বিহ্বলের মতন মোহিনী বলে, মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। কী হয়েছিল রে? কাঁ বলছিস তোরা?
পরক্ষণে সে যেন খেপে যায়। গলা ফাটিয়ে বলে, তুই যে হারামজাদি কাচা কাপড়টা পরে জলকাদার মধ্যে বসে পড়লি? কে 'আবার কাচবে তোব কাপড়? সাবান সোডা কে জোগাবে ? বলতে বলতে সে আবার চোখ বুজে সে-ই জলকাদার মধ্যেই গা এলিয়ে দেয়। ডাক্তার আনতেই হয়। সে-ও আবার পেশাদার ডাক্তার।
অভয় দিয়ে বলে, ক-মাস পারফেক্ট বেস্ট দিতে হবে। আমি একটা ভিটামিন টনিক লিখে দিচ্ছি, সেটা খাবেন। রোজ অন্তত আধসের দুধ চাই। তাব বেশি হজম হবে না তাই বিলাতি কোনো পার্সিয়ালি ডাইজেস্টেড মিল্কফুড-পুলক বলে, বাবা দুটো টক্কা দিয়ে ওঁকে যেতে বলো।
মোহিনীর মাথায় ধার করা আইসব্যাগটা চেপে ধরে রেখে শুভা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বায়বাবুদের বাড়ির সামনে মোটরটা দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরের সিটে বসে সিগারেট টানছে ড্রাইভার করালী। সিগারেট টানতে টানতে দু-একবার উৎসুক চোখ তুলে জানলার দিকে তাকাচ্ছে। ঘরের মধ্যে তাকে ভালো দেখতে পাচ্ছে না, আলো বড়ো কম ঢোকে ঘরে, বাতাসের মতোই।
জানালায় গিয়ে যদি সে দাঁড়ায়, করালীব উৎসুক চোখ ক্ষুধাতুর হয়ে উঠবে। শুধু চোখ। এমনিতে মুখে তার সর্বদাই একটা নিশ্চিন্ত নির্লিপ্ত ভাব। রায়বাবুদের বাড়ির মেয়েদের কাছে শূভা শুনেছে করালীর কেউ নেই, যা রোজগার করে সব নিজের জন্য খবচ হয়। আমাদের মতো গন্ধতেল সাবান মাখে, জানিস? প্রথম ভাবতাম চুরি করে বুঝি। তারপর দেখা গেল, না, বাবু নিজের পয়সাতেই কেনে। ঘরভাড়া লাগে না, খাওয়াখরচ লাগে না...
সিগারেট ফেলে দিয়ে করালী চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। বেলা দশটা বাজে, দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে রায়বার এসে গাড়িতে উঠবে, কিন্তু শুভা জানে, তারই মধ্যে করালী একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবে। সে লক্ষ করেছে ফাঁক পেলে যখন ইচ্ছা করালী ঘুমিয়ে। পারে।
ঠিক তাই।
কবালী শুয়ে পড়ার পাঁচ মিনিট পরে রাষবাবু বেরিয়ে অগস, কবালীর ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলতে হয়।
নিজের সিটে বসে গাড়ির স্টার্ট দিয়ে আরেকবার সে উৎসুক চোখে জানালার দিকে তাকায়। শুভা ভাবে, যদি সম্ভব হত সঙ্গত হত তার সঙ্গে করালীর কথা বলা, তাকে তার মনের কামনা জানানো। যদি সম্ভব হত, সঙ্গত হত করালীকে তার জানানো যে তার মনের ইচ্ছায় তারও সায় আছে। অনায়াসে করালী কোনো আত্মীয়কে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারত তার বাবার কাছে, তারপর শুভ হোক অশুভ হোক কোনো একলগ্নে বাবার ঘাড় থেকে তার দায় নামত আর তাদের দুজনেরই সাধ আর সমস্যা মিটে যেত। একার আয় একা ভোগ করার বদলে তার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে কত খুশি আর কৃতার্থ হত করালী।
রায়বাবুদের পেট-মোটা বিড়ালটা অনেকক্ষণ থেকে ঘরের আনাচে-কানাচে শুঁকে বেড়াচ্ছিল। এ বাড়িতে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায় কদাচিৎ, দুধ রাখা হয় নামমাত্র, কে জানে বড়োলোকের বাড়ির পোষ! আদুরে বিড়াল এ বাড়িতে এসেছে কেন। মাছ দুধ এঁটোকাঁটার লোভে পরের বাড়ি যাবার কোনোই দরকার তো ওর নেই!
বিড়ালটা লাফ দিয়ে তাকে উঠে সেখান থেকে পুরানো ভাঙা আলমারিটার উপরে উঠে যেতে দেখে শুভা বুঝতে পারে, বাচ্চা পাড়ার জন্য সে নিরাপদ স্থান খুঁজছে।
গতবার ওর বাচ্চাগুলিকে রায়বাবুরা মেরে ফেলেছিল। কিন্তু একটা বিড়াল কী করে টের পেল যে এত ছ্যাঁকা পোড়া খেয়েও তাদের প্রাণটা কোমল রয়ে গেছে, তার বাচ্চাগুলিকে মারবার মতো
নিষ্ঠুর তারা হতে পারবে না?
বাইরে কড়া নড়তে শুভা জিজ্ঞাসা করে, কে?
বলে, আমি রায়বাবুদের রাঁধুনি। ওদেব বিড়ালটাকে খুঁজছি।
শুভা অবাক হয়ে যায়-রায়বাবুদের নতুন রাঁধুনির এমন চেনা গলা!
উঠে গিয়ে দরজা খুলে সে হাঁ করে চেয়ে থাকে।
সুরমা বলে, তোমাদের বাড়ি নাকি এটা?
শুভার গলায় কথা জড়িয়ে যায়, কোনোমতে সে বলে, ভেতরে আসুন দিদিমণি, বিড়ালটা এসেছে।
কতদিন আর হবে, সুরমার কাছে স্কুলে বাংলা পড়ত। সব দিদিমনির চেয়ে তারই বোধ হয় মেজাজ ছিল কড়া আর ধমক ছিল বেশি। সিঁথিতে সবু করে সিদুর দিয়ে চওড়া পাড় শাড়ি পরে স্কুলে আসত।
আজ তার পরনে থান, সে রাঁধুনিগিরি করছে রায়বাবুদের বাড়ি।
ভিতরে গিয়ে মাখায় আইসব্যাগ বসানো মোহিনীকে দেখে সুরমা বলে, তোমার মা বুঝি? অসুখ?
শুভা বলে, না খেয়ে খাটুনি চিন্তাভাবনা মাখা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দিদিমনি আপনি রান্নার কাজ নিলেন কেন?
এ প্রশ্ন যে উঠবে এবং জবাবও একটা দিতে হবে সে তো জানা কথাই। তবে পাড়ার লোকের রাঁধুনি হিসাবে বাড়ির দরজায় তাকে হাজির হতে দেখে যে বকম থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল তাতে এত শিগগির এমন স্পষ্টভাবে সে প্রশ্নটা করে বসবে, সুরমা সেটা ভাবতেও পারেনি।
সে-ই বরং ভাবছিল কীভাবে কথাটা তুলে এককালের ছাত্রীকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া যায়।
সুরমা ধীরে ধীরে বলে আর বলো কেন, স্কুল থেকে বিদায় কবে দিলে। আরেক জায়গায় কাজ জোটাব তবে তো? কিন্তু ছেলেপুলে নিয়ে খাই কী। বসে থাকলে কাঁ আমাদের চলে? ওদেব রাঁধুনিটা পাড়ায় থাকে, কাজ ছেড়ে দেবে শুনে ভাবলাম আমিই ঢুকে পড়ি। আমার পেটটা তো চলবে, মাস গেলে ক-টা টাকা তো পাব। দুবেলা রাঁধি, দুপুরবেলা কাজের খোঁজে বেরোই। শুভা বারবার তার পরনের ধুতিটার দিকে তাকাচ্ছে খেয়াল করে সুরমা একটু হাসে।
বলে, না, বিধবা হইনি, উনি বেঁচেই আছেন। বসে খাচ্ছেন বলে বাগ করে বিধবার বেশও ধরিনি। রাঁধুনিটা বললে কী এরা সধবা লোক রাখে না, সধবার নাকি অনেক ঝঞ্ঝাট। বিধবারা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়। তাই বিধবা সাজলাম।
শুভা জিজ্ঞাসা করে, মন খুঁতখুঁত করল না?
সুরমা অবজ্ঞার সঙ্গে একটু মুখ বাঁকিয়ে যেন মনের খুঁতখুঁতানি উড়িয়ে দিয়েই বলে, গোড়ায় একটু করেছিল, তারপর ভাবলাম, কী হয় ওতে? একটু সিঁদুর না দিলে আর শাড়ির বদলে ধৃতি পরলেই যদি স্বামীর অকল্যাণ হত-কথা সে শেষ করে না, আলমাসির উপর থেকে বিড়ালটাকে নামিয়ে নিয়ে বলে, নল যাই এবার। উনান কামাই যাচ্ছে। একটা বিডালের জন্য কী মায়া। অনেকক্ষণ দেখা নেই কোথায় গেল এ বাড়ি ও বাড়ি একটু খুঁজে এসো রাঁধুনিকে ওরা একেবারে মানুষ ভাবে না। আগে ভাবতাম বড়োলোক সেক্রেটাবির কাছে টিচাররাই বোধ হয় মানুষ নয়, এখন দেখছি গরিব হলেই মানুষ থাকে না। খানিকক্ষণ বেড়ালের দেখা নেই-অমনি হুকুম, খুঁজে নিয়ে এসো।
স্ত্রী ঝাঁঝ সুরমার কথায়। শুভা টের পায় সুরমাণ গরম মেজাজটা পরিণত হয়েছে সাঁঝে। তার মা-র মেজাজের সঙ্গে খানিকটা যেন মিল ছিল বাড়ির ছেলেপুলে আর স্কুলের মেয়েদের কক্কাটে তার কষে যাওয়া মেজাজের।