ছোটভাই অনাথকে বাধ্য হইয়া প্রাঙ্গণের প্রাচীরে একটা দ্বারা ফুটাইতে হইল। অগ্রজের শ্রাদ্ধ-শান্তি হইয়া গেলে পনর-ষোল দিন পরে একদিন তিনি অফিসে যাইবার মুখে চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বলিলেন, আর না বললে ত নয় বোঠান, বুঝতে তা সবই পার থেকে তোমাকে একবেলা একমুঠো দিতে আমি কাতর নই তা দাদা আমার সঙ্গে যতই কেন না কুব্যাবহার করে যান। কিন্তু এতবড় মেয়ের বিয়ের ভার ত আমি আর সত্যি সত্যি নিতে পারিনে। শুনতেই আমার দেড়শ টাকা মাইনে, কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চা ত কম নয় তা ছাড়া আমার নিজের মেয়েটাও বার বছরে পড়ল, দেখতে পাচ্ছ । তাই আমি বলি কি, মেয়ে নিয়ে এ সময়ে তোমার একবার হরিপালে যাওয়া উচিত।
দুর্গামণী রান্নাঘরের একটা ত্রুটি আশ্রয় করিয়া কোনমতে দাঁড়াইয়া ছিলেন, সভয়ে সসঙ্কোচে কহিলেন, দাদার অবস্থা তুমি ত জান ঠাকুরপো। কিচ্ছু নেই তাঁর। এতবড় বিপদের কথা শুনে একবার দেখা পর্যন্ত দিতে এলেন না। তা ছাড়া, না নিয়ে গেলেই বা যাই কি করে ?
বড়বৌ স্বর্ণমঞ্জরী দেবরের পার্শ্বে পাচারের আড়ালেই দাঁড়াইয়া ছিলেন, একটুখানি গলা বাড়াইয়া কহিলেন, দাদার অবস্থা ভাল নয় জানি, কিন্তু তোমার দেওরটিই কোন্ লাটসাহেব মেজবৌ, আর ঐ শুনতেই দেড়-শ। কিন্তু যা করে আমি সংসার চালাই, তা আমিই ত জানি । আর তাও বলি এত বড় ধুমসো মেয়ে তোমার ঘাড়ে - কে তোমাকে যেচে ঠাঁই দিতে যাবে বল দিকি কিন্তু তা বলে মান-অভিমান করে বসে থাকলে ত চলে না।
দুর্গামণী ধীরে ধীরে বলিলেন, না দিদি, আমার আবার মান-অভিমান কি। স্বর্ণ দেওরকে বাঁ হাত দিয় পিছনে ঠেলিয়া, নিজে অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিলেন, তোমাকে নন্দ কথা ত আমি বলিনি মেজবৌ, যে অমন করে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললে ? তা, রাগই কর, আর ঝালই কর বাপু - তোমার ঐ ডানাকাটা পরীর বিয়ে দিতে আমরা পারব না। মেয়ে ত এ ছোটবৌটাও পেটে ধরেছে। কেউ একবার বাছাদের মুখপানে চেয়ে দেখলে আবার নাকি সে চোখ ফিরিয়ে চলে যাবে। তা সত্যি কথা বলব মেজবৌ যেমন তোমার মেয়ের ছিরি, তেমনি গিয়ে হরিপালে পোড়ে হোড়ে থেকে যা হোক একটা চাষাভূষা ধরে দাও গে ন্যাটা 1 ঢুকে যাক। শুনেছি নাকি সেখানকার লোক সুচ্ছিরি কুচ্ছিরি দেখে না মেয়ে হলেই হ'ল।
দুর্গামণী চুপ করিয়া রহিলেন। যে বিষের জ্বালায় একদিন তাঁহারা পৃথক হইয়াছিলেন, সেই বিষদও পুনরায় উদ্যত দেখিয়া তিনি ভয়ে কাঠ হইয়া পেলেন। স্বর্ণ কহিলেন, যার যেমন তোমাকে কেউ ত নিন্দে করতে পারবে না। হাঁ, পারে বটে বলতে আমাকে। তিনটে পাশের কম যদি জানাই ঘরে আনি, দেশশুদ্ধ একটা চিটি পড়ে যাবে। সবাই বলবে- এটা করলে কি! এতবড় একটা জ্যাঠাই ঘরে থাকতে কিনা দূর্গাপ্রতিমে জলে ভাসিয়ে দিলে। সত্যি কিনা বল ঠাকুরপো। বলিয়া স্বর্ণ অনাথের প্রতি কটাক্ষ করিলেন।
তা বৈ কি! বলিয়া অনাব তাহার মহামান্য বড়ভাজের মর্যাদা রাখিয়া অফিসের বেলা হওয়ার অছিলায় প্রস্থান করিল।
স্বর্ণ বলিলেন, তোমার ভাইকে ধরে কয়ে যা হোক একটা ধরে পাকড়ে দাও গে। তাতে তোমার লজ্জা নেই মেজবৌ, কেউ নিলে করতে পারবে না। তিরিশটি টাকা ৩ সবে মাইনে ছিল, কেই বা তাকে জানত, আর কেই বা চিনত। এঁদের ভাই বলে যা লোকে জানে। আমি বলি কি -কাল দিনটে ভাল আছে, কালই চলে যাও।
দুর্গামণী মনে মনে একবার অতুলের কথাটা ভাবিলেন, কিন্তু, ইহার সাক্ষাতে কোন কথা কহিলেন না। কারণ এই বড়জায়ের সম্বন্ধেই অতুলে সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ। স্বর্ণ অতুলের মায়ের মামাত বোন। সেদিন কেমন করিয়া জ্ঞানদা অতুলের পায়ের উপর পড়িয়া কাঁদাকাটা করিয়াছিল, মা
তাহা দেখিয়াছিলেন বটে, কিন্তু বড় বিপদ মাথার উপর লইয়া ইহার বিশেষ কোন অর্থ ভাবিয়া দেখেন নাই। কিন্তু দঃখীর ঘরে ত একান্ত মনে শোক করিবারও অবসর নাই। তাই স্বামীর মৃত্যুর পরের দিন হইতেই এই কথাটা চিন্তা করিতেছিলেন। ঘরে গিয়া দেখিলেন, মেয়ে চুপ করিয়া মেঝের উপর বসিয়া আছে। ধীরে ধীরে তাহার কাছে বসিয়া কহিলেন, দিনি যা বললেন, শুনেছিস ত
মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল। তার পরে যে তিনি কি বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। কিন্তু মেয়ে নিজেই তাহার সুবিধা করিয়া দিল। কহিল, কখন ত বাপের বাড়ি যাওনি মা, এ সময় একবার কেন চল না
মা বলিলেন, মা বেঁচে নেই, দাদা কোনদিন খোঁজ নিলেন না। এতবড় বিপদ শুনেও একটা চিঠি পর্যন্ত লিখলেন না। কেমন করে তাঁদের কাছে সেধে যাই, বহু দেখি মা ? মেয়ে কহিল, দুঃখীর খোঁজ কেউ সেধে কখনো নেয় না মা। তাঁরা নেননি - এঁরাও ত নেন না। এরা বরং যেতেই বলছেন। আমাদের মান-অভিমান বাবার সঙ্গেই চলে গেছে, মা। চল, আমরা সেখানে গিয়েই থাকিলে।
মায়ের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। মেয়ে সয়েহে মুছাইয়া দিয়া কহিল, আমি জানি, শুধু আমার জন্যেই তুমি কোথাও যেতে চাওনা। নইলে, জ্যাঠাইমার কথা শুনে একটা দিনও তুমি এখানে থাকতে না । আমার জন্যে তোমাকে এতটুকু ভাবতে হবে না মা, চল, দিন-কতকের জন্য আমরা আর কোথাও যাই। এখানে থাকলে তুমি মরে যাবে।
মা আর থাকিতে পারিলেন না, মেয়েকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। মেয়ে বাধা দিল না, শান্ত করিবার চেষ্টা করিল না, শুধু নীরবে জননীর বুকের উপর মুখ রাখিয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে দুর্গামণী নিজেই কতকটা শান্ত হইয়া চোখ মুছিয়া বলিলেন, তোকে সত্যি বলটি জ্ঞানদা, তুই না থাকলে আমি যেখানে দু'চক্ষু যায় সেইদিনই চলে। যেতাম যেদিন তিনিও জন্মের মত চলে গেলেন। শুধু তোর জন্যেই পারিনি।
তা আমি জানি না।
আচ্ছা, একটা কথা আমাকে সত্যি করে বল দেখি, বাছা, সেদিন কেন অতুল ও-কথা বললে ? না জ্ঞানদা, অমন করে মুখ ঢেকে থাকিস নে মা, লজ্জা করবার সময় এ নয়। আমি জানি, মিছে কথা বলবার ছেলে সে নয়। তবে, সেই বা কেন তাঁর মরণকালে অমন ভরসা দিলে, আর তুই বা কেন তার পায়ে পড়ে অমন করে কাঁদি
জ্ঞানদা মায়ের বুকের মধ্য হইতে অস্ফুটে কহিল, সে আমি জানিনে, মা।
দুর্গামণী জোর করিয়া মেয়ের মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া একবার দেখিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে জোর করিয়া আঁকড়িয়া ধরিয়া রহিল। বিফলকাম হইয়া তিনি পুনরায় কহিলেন, তোমার বাবা বোঁচে থাকতে আমার কখনো কিছু মনে হয়নি বটে, কিন্তু সেইদিন থেকে ভেবে ভেবে এখন যেন অনেক কথাই বুঝতে পারি। অতুলের মুখের কতদিনের কত ছোটখাট কথাই না আজ আমার মনে হচ্চে। বলিতে বলিতেই তিনি অকস্মাৎ ব্যগ্র হইয়া কন্যার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে মধ্যে লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যি বল মা, আমি যা মনে করেছি, তা মিথ্যে নয়। আমি এ ক'দিন শুধু স্বপন দেখিনি ?
জ্ঞানদা তেমনি মুখ ঢাকিয়া মৃদুস্বরে বলিল, কি জানি মা, তাঁর ধর্ম তাঁর কাছে। দুর্গামণী আনন্দের আবেগে কাঁদিয়া কহিলেন, আমাকে সংশয়ে ফেলে রেখে আর বিধিস নেমা, একবার মুখ ফুটে বল আমি তোর বাপের জন্যে একটিবার প্রাণ খুলে কাঁদি। আমার এ কান্না আজ তিনি শুনতে পাবেন।
মেয়ে চুপি চুপি কহিল, কাঁদো না - আমি ত তোমাকে কাঁদতে বারণ করিনে। বাবাকে জানাতে বলেছিলাম তিনি নিজেই ত জানিয়েছেন। এখন তাঁর ধর্ম তাঁর কাছে।
দুর্গামণী এবার আর বাধা মানিলেন না। জোর করিয়া মেয়ের আরক্ত অশ্রুসিক্ত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া তাহাকে অজস্র চুম্বন করিয়া, পুনরায় বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া, নীরবে বহুক্ষণ অশ্রুপাত করিলেন । পরে চোখ মুছিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, তাই বটে মা, তাই বটে। অতুল আমার দীর্ঘজীবী হোক তার ধর্ম তার কাছেই বটে। কিন্তু এ কথাটা আমাদের কারু একদিনের তরে মনে পড়েনি মা, তুই নিজেই যে তাতে মরা বাঁচিয়েছিলি। সে বছর, লোকে বললে বেরিবেরি রোগ। তা সে যে রোগই হোক ফুলে ফেটে ঘা হয়ে, আগে তার মা, তার পরে অতুল। অতুলের ত কোন আশাই ছিল না। পচা গন্ধে, ভয়ে, কেউ যখন তাদের ওদিক মারাত না, তখন এতটুকু মেয়ে হয়ে তুই যমের সঙ্গে নিবারাত্রি লড়াই করে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলি। সে ধর্ম সে কি না রেখে পারে? সাবিত্রীর মত থাকে
যমের হাত থেকে তুই ফিরিয়ে এনেছিলি, তাকে কি ভগবান আর কারু হাতে তুলে দিতে পারেন ? এ ধর্ম যদি না থাকে, তবে চন্দ্র-সূর্য এখনও উঠচে কেন ?
একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় পুলকিত চিত্তে বলিতে লাগিলেন, এখন যেখানে আমাকে বলিস সেইখানেই যাব। কিন্তু তুই ত তার মত না নিয়ে যেতে পারিস নে বাছা । তাই বটে। তাই বটে। তাই বাবা আমার ফিরে এসেই সকাল হতে না দু'গাছি চুড়ি দেবার ছল করে মাকে আনার দেখতে এসেছিল। ওগো, আর একটা বছর কেন তুমি বেঁচে থেকে চোখে দেখে গেলে না। বলিয়া তিনি উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন ঞ্চল দিয়া রোধ করিলেন ।
বলি মেজবো ?
দুর্গামণী তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুক হইতে ঠেলিয়া দিয়া, চোখটা মুছিয়া সাড়া দিলেন, কেন দিদি
বড়বৌ একবার ঘরের ভিতর দৃষ্টিপাত করিয়া কঠিন-স্বরে বলিলেন, তোমাদের না হয় শোকের শরীরে ক্ষিদে-তেষ্টা নেই, কিন্তু বাড়ির আর সবাই ত উপোস করে থাকতে পারে না। বেড়িয়ে একবার বেলার দিকে চেয়ে দেখ দেখি। দুর্গামণী শশব্যস্তে ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বেলার দিবে চাহিয়া লজ্জিতমুখে মেয়ের নাম করিয়া কি একটুখানি জাবাবদিহি করিতেই স্বর্ণনারী তীক্ষ্ণভাবে বলিলেন, বেশ ত । হেঁসেলটা চুকিয়ে দিয়ে মেয়েকে কাছে বসিয়ে সারাদিন বোঝাও না আমি কথাটিও কর না। কিন্তু আমার ছেলে মেয়েগুলো যে পিত্তি পড়ে মারা যায়। না বাপু, এমনধারা সব অনাছিষ্টি কাও আমি সইতে পারব না। বলিয়া নিঃসন্তান বছরে ছোটবধূর সন্তানদের প্রতি মাতৃস্নেহের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।
অনাথের সংসারে পুনরায় প্রবেশ করা অবধি দুর্গাকেই রান্নাঘরের সমস্ত ভার গ্রহণ করিতে
হইয়াছিল। তাহাতে বড়বো এবং ছোটবৌ উভয়েই সমস্তদিনব্যাপি ছুটি পাইয়া, একজন পাড়া
বেড়াইয়া এবং খরচপত্র অত্যন্ত বেশী হইতেছে বলিয়া কোন্দল করিয়া, এবং আর একজন ঘুমাইয়া, নভেল পড়িয়া, গল্প করিয়া দিন কাটাইতেছিলেন। অনাথ সাড়ে আটটার ডেলি প্যাসেঞ্জার। ভোরে উঠিয়া যথাসময়ে তাহার আহার্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, এ-বাটীতে একটা নিদারুন অশান্তির ব্যাপার ছিল। এই লইয়া বড় এবং ছোট জায়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি এবং মন কষাকষি চলিত। এ কয়দিন এই হাঙ্গামা হইতে নিস্তার
পাইয়া উভয়ের মধ্যে অনেক দিনের পর আবার একটা ভালবাসার গ্রন্থিবন্ধনের সূচনা হইতেছিল। কিন্তু আজ সকালে হঠাৎ সেই বাঁধনটা আর একবার ছিঁড়িয়া যাহবার উপক্রম হইল। তাহার কারণ এই যে, বেলা সাতটা বাজে, এবং ঝি আসিয়া সদ্যনিদ্রোথিত ছোট কে জানাইল যে, কয়লার উনানের আচ উঠিয়া গিয়াছে, একটু তৎপর হইয়া রান্না চাপাইয়া দেওয়া আবশ্যক।
ছোটবৌ বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, মেজদি কি করছে? বেলা সাতটা বাজে - আজ বুঝি তার সে হুঁশ নেই ?
ঝি কহিল, হুঁশ কেন থাকবে না গা ভোরে উঠে মায়ে দিয়ে জিনিসপত্র বা বাছাধা করছে - এই আটটার গাড়িতে হরিপাল না কোথায় যাবে যে।
ছোটবৌর কালকের কথা মনে পড়িল। কিন্তু কিছুমাত্র বিস্মিত না হইয়া চেঁচাইয়া কহিল, যাবে বললেই যাবে নাকি বাবুর হুকুম নিয়েছে ? দিদিকে জানিয়েছে
ঝি কহিল, বাবুর কথা জানিনে ছোটবৌমা, কিন্তু বড়মা ত নিজেই তাদের আজ যেতে
বলেছিল। তবে, তাকেই বলগে সারে- আটটার ভাত দিতে আমি জানিনে, বলিয়া ছোটবৌ ক্রোধে
অগ্নিমূৰ্তি হইয়া খানিকটা তলতড়ানো ঠোঁটের ভিতর পুরিয়া গামছাটা কাঁধে ফেলিয়া খিরকির দিকে হনহন করিয়া চলিয়া পেল।
ঝি কহিল, থাকলে ত বলব। তিনি গেছে গঙ্গাচান করতে বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল।
ছোটবৌকে ফিরিতে হইল, কারণ অফিসের সাহেব তাহার রাগের মর্যাদা বুঝিবে না। যা হোক দুটা সিদ্ধ করিয়া দিতেই হইবে, না হয় স্বামীকে ঠিক সময়ে অভুক্তই যাইতে হইবে । দুটার একটা অপরিহার্য। ছোটবো ফিরিয়া আসিয়া দুর্গামণীর দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, যাবেই
ত। কিন্তু এমন খেলোমি করে না গেলেই কি হত না মেজদি
এই অভাবনীয় আক্রমনে দুর্গামণী অবাক হইয়া গেলেন।
ছোটবৌ কহিল, আমরা কেউ জানিনে, তোমর সকালেই যাবে। তিনি গেছেন গঙ্গা নাইতে। আমি ত এই উঠটি। টাইমের ভাত কি করে দিই বল দেখি ।
প্রতাপেরম হই মাসীমারা, বলিয়া অতুল বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি হঠাৎ যে অতুল
অতুল কলিকাতার মেসে থাকে। সেখানে চিঠি পাইয়া ছুটাছুটি করিয়া এইমাত্র আসিয়া জুটিয়াছে - এখনও বাড়ি যায় নাহ। কহিল, মেজমাসীমা হরিপালে গঙ্গাযাত্রা করবেন, আর শেষ দেখাটা একবার দেখতে আসব না? হরিপাল। অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার ডিপো। তা এই আশ্বিনের শুরুতেই এমন সুবুদ্ধিটা তোমাকে কে দিলে বল দেখি, মেজমাসীমা : বা: - বাধাছাদা একেবারে কমপিট যে। বলিয়া সে সহাস্যে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেই একপ্রান্ত হইতে একজোড়া জ্বলেভরা আরও চক্ষুর টেলিগ্রাফ পাইয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল।
ছোটবৌ প্রশ্ন করিলেন, তুমি কি করে একা পেলে অতুল আমি : বাঃ, বলিয়া অতুল তাহার কৈফিয়ত শেষ করিল ।
অকস্মাৎ প্রাঙ্গণের কোন একটা অনির্দিষ্ট স্থান হইতে স্বর্ণমঞ্চরীর কণ্ঠস্বর শব্দভেদী বাণের মত আসিয়া প্রত্যেকের কানে বিধিল। অর্থাৎ তিনি গঙ্গাস্নানে শান্ত শুচি হইয়া বাটীতে পা দিয়াই বির মুখে কয়লার উনুনের খবর পাইয়াছিলেন। সুতরাং মেঘজায়ের সদ্য বৈধব্যের যথার্থ হেতুটা মুক্তকণ্ঠে বলিতে বলিতে আসিতেছিলেন চারশো পূর্ণ না হলে কি ভগবান কারু এমন সর্বনাশ - করেন ? করেন না। এ তাঁর ধর্মের সংসার - এখানে অধর্ম হবার জো নেই। সোজা চলিয়া আসিয়া ঘরের চৌকাঠের ভিতরে একটা পা দিয়া কহিলেন, মতলবটা ত তোমার এই, মেজবৌ - না খেয়ে উপোস করে ছোটকর্তা অফিসে যাক, সন্ধ্যেবেলা পিত্তি পড়ে জ্বর হয়ে বাড়ি আসুক। তারপর নিজের যেমন হয়েছে, তেমনি সর্বনাশ আরো একজনের হোক।
দুর্গামণী মনে মনে শিহরিয়া কহিলেন, এ কপাল যার পুরেছে দিদি সে অতিবড় শক জন্যেও অমন কামনা করে না। কিন্তু কি করেছি তোমার যে, এত কটু কথা আমাকে উঠতে বসতে শোনাচ 2
স্বর্ণ হাত নাড়িয়, মুখ অতি বিকৃত করিয়া কহিলেন, কচি খুকী যে। আমাকে বলতে হবে কি করেছ ? সাড়ে সাতটা বাজে টাইমের ভাত রাঁধবে কে ?
অতুল এতক্ষণ অবাক হইয়া শুনিতেছিল। তাহার বড়মাসীকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, এইজন্য কথাবার্তাও বড় একটা কহিত না। কিন্তু এখন আর সহ্য করিতে না পারিয়া নিজেই প্রশ্নের জবাব নিয়া বসিল। কহিল, সত্যি কথা বললে তুমিই রাগ করবে মাসীমা, কিন্তু কপাল নেহাত না পুড়লে, আর কেউ তোমাদের ভাত খেতে আসে না, সে-কথা তোমরাও জান, পাড়ার আর পাঁচজনেও জানে। কিন্তু আজ যাবার দিনটায় হতভাগিনীদের একটুখানি মাপ করলে তোমাদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না, মাসীমা ।
হঠাৎ অতুলের কথার ঝাঁজে দুই জায়েরই বিশ্বয়ের অবধি রহিল না। মিনিট খানেক কাহারও মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না । তাহার পরে স্বর্ণ কহিলেন, কোলকাতা থেকে তুই কি আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এসে হাজির হয়েছিল নাকি রে
ছোটবৌ বলিল, ঝগড়া করতে আসবে কেন দিদি ? ওর মেজমাসীমাকে আমরা হরিপালে গঙ্গাযাত্রা করাচ্চি, ও তাই যে শেষ দেখাটা দেখতে এসেছে।
তাই বটে?
ছোটবৌ কহিল, তাই দিদি, তাই। তাই তখন থেকে ভাবছি, আমরা বাড়ির লোক কেউ জানলাম না, তোমার বোনপোটি কলকাতায় বসে জানলে কি করে তা হলে লোকে যা বলে, তা মিথ্যে নয় দেখচি।
স্বর্ণ কোরে দিগ্বদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া চেঁচাইয়া বিদ্রূপ করিয়া একটা কান্ত করিয়া তুলিলেন। বলিতে লাগিলেন, বেশ ত বাছা, এতই যদি দরদ জন্মে থাকে, তোমার শাশুড়ীমাসীকে পঙ্গাযাত্রা করবে
কেন, ঘরেই নিয়ে যাবনা। গা-সুদ্ধ লোক বাহবা বাহবা করবে
এখন।
তাহার বিষের জ্বালায় অঙুলের মাথাও বেঠিক হইয়া গেল। সেও বলিয়া বসিল, বেশ ত মাসীনা, তোমরা আপনার লোক, কথাটি যদি দু'দিন আগেই জেনে থাক ভালই ত। উনি আমার ঘরে গেলে, আমি মাথায় করে নিয়ে যেতে রাজী আছি। তোমাদের গায়ের লোকগুলো তাতে বাহবা দেবে, কি ছি ছি করবে, আমি ভ্রূক্ষেপও করিনে।
কথাটা বলিয়া ফেলিয়া অতুল নিজেও যেমনি লজ্জায় অভুষ্ট হইয়া উঠিল, তাহার গুরুজনেরাও তেমনি অসহ্য বিস্ময়ে চলিত হইয়া রহিলেন। এ যেন অকস্মাৎ কোথা হইতে একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু ছুটিয়া আসিয়া লজ্জা-শরম আড়াল-আবড়াল সমস্তই চক্ষের পলকে ভাঙ্গিয়া মুচড়াইয়া উড়াইয়া লইয়া মস্ত একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে সবাইকে দাঁড় করাইয়া দিয়া গেল। কাহারও কাছে কাহারও আর গোপন করিবার, রাখিবার ঢাকিবার জায়গা রহিল না।
অতুল নিশব্দে বাহির হইয়া গেল। যদু বাগচী গরুর গাড়ি আনিয়া কহিল, মা, সময় হয়েছে, জিনিসপত্তর কি দেবে দাও। এখন থেকে না বেরুলে ইস্টিশনে গাড়ি ধরতে পারা যাবে না। বলিয়া সে ঘরে ঢুকিয়া নির্দেশমত সুমুখের টিনের তোরঙ্গের উপর বিছানাটা তুলিয়া নিয়া ঘাড়ে করিয়া বাহির হইয়া গেল। বড়বো ছোটবো দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। দুর্গমণী 'দুর্গা দুর্গ বলিয়া ঘরে তালা দিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়া উঠিলেন। মেয়েটা মূর্ছিতের মত মায়ের কোলের উপর চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল ।