মেজমাসীমা, মা মহাপ্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন ধরো। -
কে রে, অতুল ? আয় বাবা, আয়, বলিয়া দুর্গামণি রান্নাঘর হইতে বাহির হইলেন। অতুল প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা গ্রহণ করিল ।
নীরোগ হও বাবা, দীর্ঘজীবী হও। ওরে ও জ্ঞানদা, তোর অতুলদাদা ফিরে এসেছেন যে রে! একখানা আসন পেতে দিয়ে মহাপ্রসাদটা ঘরে তোল মা। কাল রাত্তিরে সাড়ে নটা দশটার সময় সদর রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শুনে ভাবলুম, কে এলো। তখন যদি জানতুম, দিদি এলেন - ছুটে গিয়ে পায়ের ধুলো নিতুম। এমন মানুষ কি আর জগতে হয়। তা দিদি ভাল আছে বাবা ? এখন পুরী থেকে আসা হ'ল বুঝি ? কি কচ্ছিস মা তোর অতুল দাদা যে দাঁড়িয়ে রইলেন।
মায়ের আহ্বানে একটি বার-তের বছরের শ্যামবর্ণ মেয়ে হাতে একখানি আসন লইয়া ঘর হইতে বাহির হইল, এবং যতদূর পারা যায়, ঘাড় হেঁট করিয়া দাওয়ার উপর আসনখানি পাতিয়া দিয়া, অতুলের পায়ের কাছে আসিয়া প্রণাম করিল, কথাও কহিল না, মুখ তুলিয়াও চাহিল না। প্রণাম করিয়া উঠিয়া, মহাপ্রসাদের পাত্রখানি হাত হইতে লইয়া, ধীরে ধীরে ঘরে চলিয়া গেল। কিন্তু একটু ভাল করিয়া দেখিলেই দেখিতে পাওয়া যাইত, যাবার সময়ে মেয়েটির
চোখমুখ দিয়া একটা চাপা হাসি যেন উছলিয়া পড়িতেছিল। আবার শুধু মেয়েটিই নয় । এদিকেও একটুখানি নজর করিলে চোখে পড়িতে পারিত, এই সুশ্রী ছেলেটিরও মুখের উপর দীপ্তি খেলিয়া একটা অদৃশ্য তড়িৎপ্রবাহ মুহূর্তের মধ্যে মিলাইয়া গেল ।
অতুল আসনে বসিয়া তীর্থ-প্রবাসের গল্প বলিতে লাগিল। তাহার বাপ একজন সেকেলে সরদআলা ছিলেন। অনেক টাকাকড়ি এবং বিষয় সম্পত্তি করিয়া পেন্সন লইয়া ঘরে বসিয়াছিলেন, বছর চারেক হইল, ইহলোক ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। বি.এ. একজামিন দিয়া অতুল মাস-দুই পূর্বে মাকে লইয়া তীর্থপর্যটনে বাহির হইয়াছিল। সম্প্রতি রামেশ্বর হইয়া, পুরী
হইয়া কাল ঘরে ফিরিয়াছে। পল্প গুনিয়া দুর্গামণি একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আর এমনি মহাপাতকী আমি যে, আর কিছু না হোক, একবার কাশী গিয়ে বাবা বিশ্বেশ্বরের চরণ দর্শন করে আসব, এ মনে সে সাধটাও কখন পুরল না।
অতুল বলিল, কাশীই কল, আর যাই বল মেজমাসীমা, একবার সব ছেড়েছুড়ে জোর করে বেরিয়ে পড়তে না পারলে আর হয় না। আমি অমন জোর করে না নিয়ে পেলে, আমার মায়েরই কি যাওয়া হ'ত ?
দুর্গামণি আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, জানিস ত বাবা সব। জোর করব কি দিয়ে বল দেখি? তিরিশটি টাকা মাইনের উপর খেয়ে পরে, লোক লৌকতা, কুটুরিতে করে, ডাক্তার-বদ্যির ওষুধের খরচ যুগিয়ে কি থাকে বল দেখি? আর এই মেয়েটা দেখতে দেখতে তেরোয় পা দিলে। তোকে সত্যি বলটি, অতুল, এর পানে চাইলেই যেন আমার বুকের রক্ত হুহু করে শুকিয়ে যায়। উঃ। এতবড় শত্রুকেও পেটে ধরে মাকে লালন পালন করতে হয়। বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু সজল হইয়া উঠিল।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে, অতুল এতবড় দুশ্চিন্তা ও কাতরোফির সম্মুখেও ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল, কহিল, মাসীমার সব বাড়াবাড়ি। আচ্ছা, মেয়ে কি আর কারু হয় না যে, তোমারই শুধু এই একটা হয়েছে - আর রাজ্যের দুর্ভাবনা একা তোমার
দুর্গামণি কহিলেন, আমার এটা ঠিক ভাবনা নয়, অতুল, এ আমাদের মৃত্যু যন্ত্রণা। সমাজ আমি জানি তা মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলেই জাত যাবে, কিন্তু দেব কি করে ? টাকা চাই কিন্তু পাব কোথায় ? এই ভদ্রাসনের একাংশ ছাড়া আপনার বলতে ত আর কিছু নেই বাবা।
আধ ঘণ্টা পূর্বে এই মেয়েটাকেই উপলক্ষ করিয়া স্বামী স্ত্রীতে কলহ হইয়া গিয়াছিল। স্বামী অর্থভুক্ত ভাতের থালা ফেলিয়া রাখিয়া অফিসে চলিয়া গিয়াছিলেন। সেই ব্যথা দুর্গামণির মনে আলোরিত হইয়া উঠিল এবং টপটপ করিয়া দু'ফোটা চোখের জল গাল বাহিয়া কোলের উপর ঝরিয়া পড়িল। হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া বলিলেন, আর জনে কত স্ত্রীহত্যা, ব্ৰহ্মহত্যা করেছিলুম অতুল, যে, এ জন্মে মেয়ে পেটে ধরেছি নাঃ - মেজমাসীমা, আমি উঠলুম, নইলে তুমি থামবে না।
দুর্গামণি আর একবার চোখ মুছিয়া লইয়া কহিলেন, না বাবা, একটু বোস, দু'দন্ড তোমার কাছে কাঁদলেও বুকটা হালকা হয়। তাই বলি, ভগবান। হতভাগীকে আমার কোলেই যদি পাঠালে, রংটা একটু ফর্সা করেই পাঠালে না কেন কালো বলে কেউ যে ওকে আশ্রয় দিতেই চায় না। সবাই যে চায় সুন্দরী মেয়ে। ওরে পোড়া সমাজ, তুই কলি, শীল, স্বভাব, চরিত্র কিছুই যদি দেখবি নে, মেয়ে শুধু কালো বলেই তাকে ঘরে ঠাঁই দিবিনে, তবে সে মেয়ের বিয়ে না হলেই বাপ-মাকে লন্ড দিবি কেন ?
অতুল কহিল, কালো মেয়ের কি বিয়ে হচ্ছে না? তোমরাও কালো, কোকিলও কালো তাদের আদর হয় না। এ-সব ত চিরকালের দৃষ্টান্ত জেমাসীমা।
দুর্গামণি কহিলেন, তাই দৃষ্টান্তই শুধু চিরজীবী হয়ে আছে বাবা, আর কিছু নেই। কিন্তু তাতে আর সান্ত্বনা পাইলে, জোরও পাইনে অতুল। গিরীশ ভটচারি মেয়ের বিয়ে চোখের উপর দেখে হাত পা যেন পেটের ভেতর ঢুকে গেছে। ঠিক আমাদের মতই না ছিল তার টাকার বল, না ছিল মেয়ের রূপ তাই পাত্রের বয়সও গেল ষাটের কাছাকাছি। তার মায়ের কান্নাটা আমি নিজেও যেন কানে শুনতে পাচ্ছি।
অতুল সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, ঘাটের কাছাকাছি বল তা হবে বৈ কি বাবা হরি চকোত্তির নাতজামাই হ'ল ওপাড়ার নিতাই চাটুয়ো। তারই একটা আদ দশ বছরের মেয়ে যে। হিসেব করে দেখ দেখি ।
পর শুনিয়া অতুল কন্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
দুর্গামণি বলিতে লাগিলেন, সে মেয়ে দি মনের ফেনায় বিষ খায়, কি গলায় দড়ি দেয়, কিংবা কুলে কালি দিয়ে চলে যায় মা হয়ে তাকে বুকের ভেতর থেকে অভিশাপ দিই কেমন করে, বল দেখি বাবা ?
অতুল চুপ করিয়া রহিল। দুর্গামণি হঠাৎ তাহার হাতটা চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, বাবা অতুল, আজকাল সবাই বলে, তোদের ছেলেদের মধ্যে দয়া-ধর্ম আছে। দেখিস নে বাবা, তোদের ইস্কুল-কলেজের কোন ছেলে যদি নিতান্ত দয়া করেই মেয়েটাকে তার পায়ে একটুখানি ঠ দেয়। তাহলে তোদের কাছে আমি মরণ পর্যন্ত কেনা হয়ে থাকব।
অতুল শশব্যমে হাত ছাড়াইয়া লইয়া তাঁহার পায়ের ধুলা মাথায় লইয়া আর্দ্রকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, কেন এত ব্যস্ত হচ্চ মেজমাসীমা ? আমি কথা দিচ্ছি
কিন্তু কাটা সে দিতে পারিল না। সহসা লজ্জায় তাহার কর্ণমূল পর্যন্ত রাজা হইয় কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। দুর্গামণি যদি হা লক্ষ্য করিলেন না, কিন্তু আর কেহ তথায় উপস্থিত থাকিলে হয়ত সংশয় করিত, কি এমন কথাটা অতুল ঝোঁকের উপর দিতে গিয়াও এমন করিয়া থামিয়া গেল । অতুল নিজেকে সামলাইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সহজভাবে বলিল, আচ্ছা, খুব চেষ্টা করব। কৈ রে জ্ঞানদা, একটা পান-টান দে না বাড়ি যাই।
দুর্গামণি রাগিয়া চীৎকার করিলেন, তোর অতুলদার একটা পান দে না গেনি। মুখপোড়া মেয়ের না আছে রূপ, না আছে গুণ। বলি, এ-সব কথাও কি শেখাতে হবে? মহাপ্রসাদ নিয়ে সে যে ঘরে ঢুকলি, আর বেরুনি নে। শিল্পির পান নিয়ে আয়।
আচ্ছা, আমি নিজেই গিয়ে পান নিচে কোন ঘরে রে জ্ঞানদা! বলিয়া উচ্চকণ্ঠে সারা দিয়া অতুল শোবার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।
সম্মুখে পানের সজ্জা লইয়া মেয়েটি চুপ করিয়া বসিয়াছিল। অতুল ঘরে ঢুকিয়াই গভীর হইয়া বলিল, মেজমাসীমা কলচেন, মুখপোড়া গেলির না আছে রূপ, না আছে হল। তাকে একটা
ষাট বছরের বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। জ্ঞানদা জবাব দিল না, অবনত মুখে বাটা হইতে গোটা দুই পান লইয়া হাত উঁচু করিয়া ধরিল।
অতুল পিছনে আসিয়া হাত হইতে পান লইয়া কহিল, কিন্তু পান সাজা ভাল হলে এবার মাপ করা হবে, ঘাটকে কমিয়ে না হয় কুড়ি- একুশে দাঁড় করান যাবে। জ্ঞানদা লজ্জায় মাথাটা হুঁকাইয়া প্রায় বাটার সঙ্গে এক করিয়া ফেলিল। অতুল লা খাটো করিয়া বলিল, মাসীমার কাছে আর একটু হলে বলে ফেলেছিলুম আর কি। আচ্ছা, বেলা হ'ল চললুম।
জ্ঞানদা ইহারও প্রত্যুত্তর করিল না। সেই যে জড়সড় হইয়া মাথা হেঁট করিয়া বসিয়াছিল, তেমনি বসিয়া রহিল।
কথা কওয়া হ'ল না ? আচ্ছা বলিয়া অতুল মেয়েটির ভিজা এলোচুলের একগোছা - টানিয়া দিয়া বলিল, কিন্তু আসছে হরি চক্কোত্তির মতন একটা বুড়ো - চললুম, বলিয়া হাসিতে হাসিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু উঠানে পা দিয়াই চেঁচাইয়া উঠিল, মোসীমা, জ্ঞানোর জন্যে বোম্বাই থেকে মা একজোড়া চুড়ি কিনেছিলেন, বাইরে এসে দেখ - কৈ, দেখি বাবা, বলিয়া দুর্গামণি পুনরায় রন্ধনশালা হইতে বাহির হইলেন। অতুল পকেট হইতে দু'গাছি চুড়ি বাহির করিয়া মেলিয়া ধ তাহার রং এবং কারুকার্য দেখিয়া দুর্গামণি অত্যন্ত পুলকিত চিত্তে দাতার ভূয়োঃভূয়োঃ যশোগান করিতে লাগিলেন। চুড়ি দুগাছি কাচের বটে, কিন্তু সেরূপ মূল্যবান বাহারে চুড়ি পাড়াগাঁয়ে কেন, কলিকাতাতেও তখনও আমদানি হয় নাই। বস্তুতঃ তাহার গঠন, চাকচিক্য এবং সৌন্দর্য দেখিয়া মায়ের নাম করিয়া অতুল নিজের টাকাতেই বোম্বাই হইতে ক্রয় করিয়া- আনিয়াছিল।
মায়ের ডাকাডাকিতে জ্ঞানদা বাহির হইয়া আসিল এবং নিঃশব্দ নতমুখে স্নেহের এই প্রথম উপহার হাত পাতিয়া গ্রহণ করিতে পিয়া তাহার আঞ্চলিক হাতদুটি কাঁপিয়া পেল। তার পরে দাতার পায়ের কাছে নমস্কার করিয়া সে ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। সে একটি কথাও করে নাই কিন্তু আজ তাহার অন্তরের কথা অন্তর্যামী জানিলেন। শুধু পিছনে দাঁড়াইয়া এই দুটি ->> মানুষ ক্ষণকালের জন্য সস্নেহ মুগ্ধ নেত্রে এই কিশোরীর অনিন্দ গঠন ও গতিভঙ্গীর প্রতি চাহিয়া রহিলেন।