shabd-logo

চার

27 October 2023

0 Viewed 0

এগার বৎসর পরে দুর্গামণি হরিপালের বাপের ভিটায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন শরতের সন্ধ্যা এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর ঝাপসা ধুয়া লইয়া সমস্ত প্রামখানার উপর হুমড়ি খাইয়া বসিয়াছিল যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ করিবামাত্রই দুর্গামণীর বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল। বাড়িতে বাপ মা নাই - বড়ভাই আছেন। শম্ভু চাটুয়োর সেদিন ছিল বৈকালিক পালাজ্বন্নের দিন। অতএব সূর্যাস্তের পরই তিনি প্রস্তুত হইয়া বিছানা গ্রহণ করিয়াছিলেন। খবর পাইয়া সুপ্রাচীন বালাপোশে মাথা এবং দুইকান ঢাকিয়া খড়ম পায়ে খটখট শব্দে বাহিরে আসিয়া চিনিতে পারিলেন।

কে, এ দুর্গা এলি নাকি ? তা আয় আয়।

দুর্গা কাঁদিতে কাঁদিতে অগ্রসর হইয়া দাদার পদমূলে প্রণাম করিলেন। জ্ঞানদা প্রণাম করিলে, কহিলেন, এটি বুঝি মেয়ে তা বিয়ে দিলি কোথায় ? দুর্গা কুন্ঠিত স্বরে কহিলেন, বিয়ে এখনও দিতে পারিনি দাদা যেখানে হোক শিপপির অ্যাঁ - বিয়ে দিসনি এ যে একটা সোমন্ত মাগী রে দুর্গা ? বহুকাল অদর্শনের পর

ভগিনীর প্রতি তাঁহার ঈষৎ করুন কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তেই জমিয়া একেবারে কাঠ হইয়া পেল, বলিলেন, তাই ত, এখানকার আবার যে-সব বজাত লোক তা জানতে পেলে তা আমি বলি কি, ওকে হেঁসেলে-টেসেলে ঠাকুরঘরদোরে ঢুকতে দিয়ে কাজ নেই জানিস ত এদেশের সমাজ। বিশেষ হরিপাল এমন পাজী জায়গা কি ভূ-ভারতে আছে ? তা আয়, বাড়ির ভিতরে আয়। এতবড় মেয়ে ওর কাকার কাছে রেখে এলে স্বচ্ছন্দে তুই দুদিন জুড়িয়ে যেতে পারতিস। এখানে থাকলে ত আর - বুঝলি নে দুর্গা তা যা, এখন হাত-পা ধুগে ওগো, কৈ পো, বলিতে বলিতে শম্ভু চাটুয়ো পুনরায় খটখট করিয়া অন্দরে প্রবেশ করিলেন। দুর্গা এবং তাঁহার কন্যা যেমন করিয়া তাঁহার অনুসরণ করিয়া বাড়ি ঢুকিল সে শুধু ভগবানই দেখিলেন।

শম্ভুর এটি দ্বিতীয় পক্ষ। প্রথম পক্ষের বৌকে দুর্গা দেখিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাকে দেখেন নাই। উপস্থিত ইনি যেমনই কাল, তেমনই রোপা এবং লম্বা। ম্যালেরিয়া জ্বরে রঙটা যেন পোড়াকাঠের মত। তিনদিনের গোবর উঠানের মাঝখানে জমা করা ছিল, তাহা এইমাত্র নিঃশেষ করিয়া ঘুঁটে দিয়া, হাত-পা ধুইয়া প্রদীপের তো করিতেছিলেন, স্বামীর আহ্বানে সম্মুখে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। শম্ভুর জ্বর আসিতেছিল, আগন্তকদিগের অভ্যর্থনার জন্য স্ত্রীর কাছে সংক্ষেপে ইহাদের পরিচয় দিয়া ঘরে গিয়া চুকিলেন। বৌয়ের নাম ভামিনী । মেদিনীপুর জেলার মেয়ে। কথাগুলো একটু বাকা বাকা । সে হাসিয়া উপরের এবং নীচের সমস্ত মাড়ীটা অনাবৃত করিয়া ননদের হাত ধরিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় লইয়া গিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসাইলেন। তাঁহার হাসি এবং কথার স্ত্রী দেখিয়া দুর্গার বুকের ভিতর পর্যন্ত বাকাইয়া উঠিল । আসিবার সময় দুর্গা এক হাঁড়ি রসগোলা আনহিয়াছিলেন, সেটা নামাইতে না নামাইতে এক পাল ছেলে মেয়ে কোথা হইতে যেন পঙ্গপালের মত ছুটিয়া আসিয়া হেঁকিয়া ধরিল। চেঁচাচেচি ঠ্যালাঠেলি সে যেন একটা হাঁট বসিয়া গেল। তাহাদের মা ইহাকে আধখানি উহাকে সিকিখানি, আর দু'জনকে দু'টুকরা বাঁটিয়া দিয়া হাড়িটা ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়া শোবার ঘরের শিকায় টাঙ্গাইয়া রাখিলেন। ছেলেগুলো যে যাহা পাইয়াছিল, অমৃতং গিলিয়া ফেলিয়া, হাতের রস চাটিতে চাচিতে প্রস্থান করিল।

দুর্গা এখানকার রীতিনীতি কতক জানিতেন, কারন তিনি এই গ্রামের মেয়ে । কিন্তু জ্ঞানদা আট-দশ বছরের ছেলেগুলোকে পর্যন্ত সম্পূর্ণ দিগম্বর দেখিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া রহিল। মেয়েগুলোরও প্রায় ঐ দশা। ইতরবিশেষ যাহা আছে, তাহা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তাহাদের নিজেদের গ্রামটাও শহর নয় বটে, কিন্তু সেখানে রাস্তাঘাট আছে, এমন আম, কাঁঠাল ও বাঁশঝাড়ে মাথার উপর অন্ধকার করিয়া নাই। এরূপ গোবর ও পাট পচা গন্ধ চতুর্দিক হইতে আসিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের ত্রিয়াকে ভারাক্রান্ত, ব্যাকুল করিয়া দেয় না। তখনও অন্ধকার হয় নাই, একটা শৃগাল উঠানের উপর আসিয়া দাঁড়াইতেই বড় ছেলেটা ভাড়া করিয়া গেল। চারিদিকে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা বিকট শব্দ শুরু করিয়া দিল। দেয়ালের গায়ে একটা শুকনা ডালে হঠাৎ অশ্রুতপূর্ব একপ্রকার বিশ্রী শব্দ শুনিয়া জ্ঞানদা সভয়ে চুপি চুপি কহিল, ও কি ডাকে মা ? মামী শুনিতে পাইয়া কহিলেন, ও যে 




তোক্ষোপ ।

জ্ঞানদা শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোক্ষোপ কি ? তক্ষক সাপ

মামী বলিলেন, হাঁ মা, তাই। ঐ যে কোন রাজাকে কামরেছিল বলে। গাছে গাছে একেবারে ভরা।

জবাব শুনিয়া জ্ঞানদা মায়ের মুখের প্রতি একবার চাহিল। ইতিপূর্বে কান্নায় তাহার সমস্ত বক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এইবার সে জননীর কোলের উপর লুটাইয়া পড়িয়া একেবারে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কহিল, এখান থেকে চল মা এখানে আমি একদণ্ডও বাঁচব না । রা যে দেবতা। কখনো কারুর অপকার করে না। আর সংযোগের কামড়ে কটা লোক মরে বাহা বঞ্চ, তয় যা তা ঐ স্যালোয়ারীর একবার ধরলে, আর তাতে বস্তু রেখে ছাড়ে না। এ বছর দিন কুড়ি হ'ল তোমার মামাকে ধরেছে এরই মধ্যে যেন শতজীর্ণ করে ফেলেচে, আর দিনকতক পরে কে কার মুখে হল দেবে মা, এ-পায়ে তার ঠিক থাকবে না।

কানা মনে মনে অতুলের শেষ কথাগুলো মিলাইয়া লইয়া নীরবে পড়িয়া রহিল। ে রাত্রে সে একবারও ঘুমাইতে পারিল না। মায়ের বুকের খাচ্ছ মুখ রাখিয়া বারংবার চমকা হয়। উঠলো। করিয়া প্রভাত হইল ন স্থানে নুতন আলো চোখে পড়ায় বিন্দুমাত্রও তাহার আনন্দের হইল না কর সমস্ত আবহাওয়া, আলো, বাতাস যেন কালকের চেয়েও বেশী করিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল।

এতবড় আইবুড়ো মেয়ে দেখিয়া পাড়ার লোক ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল। আমাদের বাঙ্গালাদেশে মেয়ের বয়স ঠিক করিয়া বলার রীতি নাই। সবাই জানে, বাপ মাকে দু এক বছর রাখিয়া বলিতে হয় । সুতরাং দুর্গা যখন বলিলেন, তের, তখন সবাই বুঝিল পনর। তা ছাড়া একমাত্র সন্তান বলিয়া, নিজের না খাইয়া মেয়েকে খাওয়াহিয়াছিলেন, পরাইয়াছিলেন- সেই নিটোল স্বাস্থ্যই এখন আরও কাল হইল জ্ঞানদার যথার্থ বয়সের বিরুদ্ধে ইহাই বেশী করিয়া সাক্ষ্য দিতে লাগিল

দুই দিন না যাইতেই শম্ভু কথা প্রসঙ্গে ভগিনীকে কহিলেন; মেয়েটার জন্য র পাড়ায় মুখ দেখানো তার হয়েছে। একটি ভারী সুপার হাতে আছে, দিবি ?

দুর্গা বলিলেন, জামাই আমার হির হয়ে আছে আর কোথাও হতে পারে না। শ বলিলেন, তা হলে ত কথাই নেই। কিন্তু যেন সুপাত্র বড় ভাগ্যে মেলে, তা বলে দিচ্ছি। কুড়ি- পঁচিশ বিশ্বে ব্রহ্মন, পুকুর, বাগান, ধানের গোলা লেখাপড়াতেও -

দুর্গা কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন, না দাদা, আর কোথাও হবার জো নেই এই বছরটা বাদে সেইখানেই আমাকে মেয়ে দিতে হবে।

বিবেচনায় এই সামনের নেই মেয়ে উচ্চগু লো কর্তবা হয়েছে। দুর্গা আর নিরর্বক প্রতিবাদ না করিয়া কত আছে, বলিয়া উঠিয়া গেলেন। জামশঃ প্রকাশ পাইল, এই সুপাত্রটি শরই এ পক্ষের বড় শ্যালক। স্ত্রীর মৃত্যু ক্ষার, প্রায় ছয় মাস যাবৎ বেকার অবস্থায় আছে আর বেশীদিন থাকা তেই সঙ্গত মনে করে না। বিশেষতঃ ঘরে অনেকগুলি কাচ্চা বাচ্চা থাকায় একটি ডাগর মেয়ে নিতান্তই আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে ৷ সেইজন্যই বোধ করি, দুর্গার বারংবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও এই সুপাত্রটি একদিন আবির্ভূত খেই অনাকে দেখিতে পাইলেন, এবং বলা বাহুল্য যে, পছন্দ করিয়াই ফিরিয়া গেলেন। অনতিকাল মধ্যেই ভগিনীর প্রতি শম্ভুনাথের স্নেহের অনুরোধ কঠোর নির্যাতনের আকার ধরিয়া দাড়াইল। একদিন তিনি স্পষ্ট জানাইয়া দিলেন যে, প্রিয়নাথের অবর্তমানে তিনিই এখন পিটের বার্থ অভিভাবক। সুতরাং আবশ্যক হইলে এই সামনের অ্যানেই তিনি জোর করিয়া বিবাহ দিবেন।

দাদার সঙ্গে বাদানুবাদ করিয়া দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া মেয়ের পানে চাহিয়াই বুঝিতে পারিলেন, সে সমস্ত শুনিয়াছে। তাহার দুই চক্ষু ফুলিয়া রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, আমি বেঁচে থাকতে ভয় কি না। মুখে অভয় নিলেন বটে, কিন্তু ভয়ে তাঁহার নিজের বুকের অন্তঃকূল পর্যন্ত অনকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল। বুকে মুখ লুকাইয়া চেয়ে উচ্ছ্বসিত হইয়া কালিতে লাগিল। মা তাহার কপালে বুকে হাত দিয়া দেখিলেন, জ্বরে গা ফটিয়া যাইতেছে। চোখ মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কখন জ্বর হল না

কাল রাত্তির থেকে।

আমাকে জানাস নি কেন যে ভয়ানক ম্যালেরিয়ার সময় মেয়ে চুপ করিয়া রহিল জবাব দিল না দাদার বৌয়ের সহিত দুর্গা এ পর্যন্ত কোনপ্রকার ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করেন নাই। শুধু যে তাহার বিকট চেহারা ও ততোধিক বিকট হাসি দেখিলেই তাহার গা জ্বলিয়া যাই তাহা নহে, তা অতি কর্মশ কণ্ঠরাও তিনি হা করিতে পারিতেন না। পাড়াগায়ের মেয়েরা স্বভারত একটু উচ্চকন্ঠে কথা কহে, কিন্তু বৌয়ের কথাবার্তা একটু নূর হইতে শুনিলে খাড়া বলিয়া মনে হইত। তাহার উপর সে যেমন সুংরা, তেমনি যুদ্ধবিশারদ। কিন্তু তাহার একটা গুণ দুর্গা রে পাইয়াছিল সে পায়ে পড়িয়া ঝগড়া করিতে চাহিত না। তার গত পদ্ম ছাড়িয়া দিলে, সে কাহাকেও কিছু বলিব না ছেলে পিলে ঘর সংসার লইয়াই থাকিত, পরের কথায় না।

প্রথমে আসিয়াই দুর্গা একদিন তাহার ভান্নাবান্নার সাহায্য করিতে গিয়াছিল। তাহাতে সে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিল তুমি দু'দিনের জন্যে এসেচ ঠাকুরঝি, তোমাকে কাজ করতে হবে না। আমি রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর কাউকে দিতে পারব না। সেই অবধি দুর্গা এ বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলেন। আজ বেলা দেখিয় বৌ দোর-পোড়ায় স্বাভাবিক চীৎকার শব্দে পশ্ন করিল, আজ খাওয়া- দাওয়া কি হবে না ঠাকুরঝি ? হেঁসেল নিয়ে বসে থাকব দুর্গা মুখ তুলিয়া বলিলেন, মেয়েটার ভারী জ্বর হয়েচে বৌ, তোমরা খাও পে, আমরা আজ আর কেউ খাব না । বৌ কহিল, মেয়ের জ্বর, তা তোমার কি হ'ল গো জ্বর আবার করে না হয় ? নাও উঠে এসো। দুর্গা কবির কণ্ঠে কহিলেন, না বৌ, আমাকে খেতে বল না মেয়ে ফেলে আমি মুখে ভাত তুলতে পারব না।

তোমাদের সব আদিখ্যেতা, বলিয়া বৌ চলিয়া গেল। রান্নাঘর হইতে পুনরায় কহিল, র হয়েছে কবরেজ ডেকে পাঁচন সিদ্ধ করে দাও। ম্যালোয়ারী জ্বরে আবার খায় না কে আমাদের দেশে ওসব উপোস-তিরেসের পাঠ নেই বাপু। বলিয়া সে নিজের কাজে মন দিল।

অপরাহ্নবেলায় সে নিজেই একবাটি পাচন সিদ্ধ করিয়া আনিয়া কহিল, ওলো ও গেনি, উঠে পাঁচন খা। ভাতে জল দিয়ে রেখেছি, চল, খাবি আয় ।

মামীকে সে অত্যন্ত ভয় করিত। বিনাবাক্যে উঠিয়া খানিকটা তিক্ত পাঁচন গিলিয়া বমি করিয়া ফেলিয়া পুল্লায় শুইয়া পড়িল। দুর্গা ঘরে ছিল না, বমির শব্দে ছুটিয়া আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া লিশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মামী রাগ করিয়া উঠানে গিয় সমস্ত পাড়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন, এ-সব বাবুমেয়ে নিয়ে আমাদের গরীব, দুঃখীর ঘরে আসা কেন বাপু ?

সেই হইতে জ্ঞানদার অসুস্থ উত্তরোত্তর বাড়িতেই লাগিল। তাহার জামিনী নানী সেই যে প্রথম দিনই বলিয়াছিল, বাছা। পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক'টা লোক মরে, ম েযা া ম্যালোয়ারীতে। একবার ধরলে আর রক্ষা নেই । তাহার কথাটার সত্যতা সম্প্রমাণ হইতে বেশী বিলম্ব ঘটিল না, অনতিকালমধ্যেই জ্ঞানদাকে একেবারে শয্যাগত করিয়া ফেলিল। সেদিন কার্তিকের সংক্রান্তি, দুর্গা ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন, বো জ্ঞানদার শিয়রে বসিয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে। একে ত সংসারের কাজ ছাড়িয়া এইসব বাজে কাজ করিবার তাহার অকার নাই, তাহাতে পরের মেয়ের প্রতি এই অযাচিত সেবাটা এমনি একটা প্রকৃতি- বিরুদ্ধ বিসদৃশ কাণ্ড বলিয়া দুর্গার মনে হইল যে, তিনি দাদার প্রস্তাবিত সেই বিবাহ-ব্যাপারটা স্মরণ করিয়া আশঙ্কায় ক'টকিত হইয়া উঠিলেন। ভামিনীর এই যত্নটা যে সেই জনাই, তাহাতে আর সংশয়মার রহিল না। কারণ, সে যে নিজের দাদার সহিত জ্ঞানদার বিবাহ ঘটাইবার জন্য স্বামীকে নিয়োজিত করিয়াছে এবং ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত করিতেছে, প্রথম হইতেই এই কথাটা দুর্গা স্বতঃসিন্ধের মত মানিয়া লইয়াছিল। বৌ পলাটা আজ একটু খাটো করিয়াই কহিল,

তারকেশ্বরে পাশ কারা ডাক্তার আছে তোমার দাদাকে আনতে পাঠিয়ে নিয়েছি, ঠাকুরঝি। জ্বর যেন রোজ রোজ বেশীই হচ্চে এতো ভালো না। দুর্গা অব্যাক্তার যাহা বলিলেন, তাহা শোনা গেল না, কারণ এই সুসংবাদ শুনিয়ার তিনি অন্তরের ভিতর হইতে প্রসন্ন হইতে পারিলেন না।

বৌ সংসারের কাজে চলিয়া গেল । জ্ঞানদা বালিশের তলা হইতে একখানা চিঠি বাহির করিয়া কহিল, জবাব দিয়েছেন।

কৈ দেখি, দেখি, বলিয়া মা সেখানি যেন কাড়িয়া লইলেন। কিন্তু পরক্ষনেই অ আগ্রহ দমন করিয়া চিঠিখানি দুই মুঠার মধ্যে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। একবার মনে কহিলেন, খুলিয়া পড়ি। আবার ভাবিলেন, না উচিত নয়। মেয়ে যেন হাতেই দিয়েছে, কিন্তু মা হইয়া তিনি পড়িবেন কি করিয়া। মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি লিখেছে অতুল ?

জ্ঞানদা ইতিমধ্যে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছিল। সংক্ষেপে কহিল, আসা উচিত ছিল না এই সব। পত্রের এই দুটি কথা শুনিয়াহ মায়ের দুই চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। তিনি মনে মনে আবৃত্তি করিলেন, আসা উচিত ছিল না- এই সব। অতুলের মুখখানি স্মরণ করিয়া তাহাকে অসংখ্য আশীর্বাদ করিয়া দুর্গা মাতৃস্নেহে বিগলিত হইয়া মনে মনে বলিলেন, না জানি, বাছার কতই না অভিমান, কতই না মর্মান্তিক ব্যথা, এই দুটি কথার মধ্যে লুকান আছে। এখানে আসিয়া জ্ঞানা জ্বরে পড়িয়াছে তাখতেই ও বাছা সেদিন রাগ করিয়া বলিয়াছিল ইহাদের গঙ্গাযাত্রা দেখিতে কলিকাতা হইতে আসিয়াছি । সত্যই তা আমি নিজে যাই করি এবং 1- যেখানেই যাই, সে আলাদা কথা। কিন্তু মেয়ে লইয়া আমার যে কোনমতেই আসা উচিত ছিল না। যতই কষ্ট হোক, সব সহ্য করিয়াই ও সেখানে আমাদের পড়িয়া থাকা উচিত ছিল। কাগজখানি অপূর্ব মমতার সহিত মুঠোর মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে করিতে কত কথাই আজ তাহার মনে পড়িতে লাগিল। স্বামীর মৃত্যুশয্যায় অতুলের প্রতীজ্ঞা – সেই চুড়ি দু'গাছি দিবার ছলে মহাপ্রসাদ লইয়া আসা, বিশেষ করিয়া আসিবার দিনটায় মাসীর সহিত তাহার কলহ। এ- কথা তাহার মা শুনিয়াছে, পাড়ার লোকে শুনিয়াছে - এতদিনে সবাই জানিয়াছে কেন সে কলিকাতা হইতে ছুটিয়া আসিয়াছিল। আনন্দে পর্বে তাঁহার মাতৃক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিলেন, কালো মেয়ে! আমার কালো মেয়ের গৌরব দেখুক সবাই! ওরে, কোকিলও কালো, ভোমরাও কালো যে ডাকিলেন, জ্ঞানদা এখন কেমন আছিস মা ?

ভাল আছি মা।

হাঁ রে, আমার কথা অতুল কিছু লিখেছে ?

পড়ে দেখ না ।

কৌতুহল আর তিনি সামলাইতে পারিলেন না। জানালার কাছে কাগজখানি মেলিয়া ধরিলেন। অতবড় কাগজের মধ্যে মাত্র দুইদুর লেখা দেখিয়া প্রথমটা তাহার মনে হইল, মেয়ে কি দিতে, হয়ত কি দিয়াছে। পরক্ষণেই শ্রীচরণেষু পাঠ দেখিয়া মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, তাইতেই পড়তে দিয়েছে- এ যে আমারই চিঠি। লেখা আছে " সেই সময়েই বলিয়াছিলাম, ও জায়গা ম্যালেরিয়ার ডিপো আর জ্বর শুনিয়া দুঃখিত হইলাম আশ করি, শীঘ্র আরোপা হইয়া যাইবে। আমরা ভাল আছি। আমার প্রণাম গ্রহণ করিবেন।" ইতি-

দুর্গার কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে একটু বাখিল, কিন্তু মায়ের প্রাণ না জিজ্ঞাসা করিয়াও থাকিতে পারিলেন না, কাছে বসিয়া মেয়ের রুক্ষ চুলগুলি আঙ্গুল দিয়া নাড়িতে নাড়িতে আস্তে আস্তে বলিলেন, হাঁ মা, তোমার চিঠিটার মধ্যে বুঝি অতুল রাগ করেছে জ্ঞানদা বিস্মিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া কহিল, আমার চিঠি আবার কোথায় মা তোমাকেই তো লিখেছেন। দুর্গা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আমি দেখতে চাই না, শুনলেই সুখী। রাগ করেছে, সে ত আমি বুঝতেই পারচি - না না, আমাকে তিনি আলাদা চিঠিপত্র কিছুই লেখেন নি। যা লিখেছেন, তা ওই। বুলিয়া মেয়ে পুনরায় পাশ ফিরিয়া শুইল।

সবে দু'ছত্র ? আর কোন কথা নেই । বলিয়া দুর্গা স্তব্ধ হইয়া গেলেন। তাঁহার যে আব্দুলগুলা এতক্ষণ মেয়ের চুলের মধ্যে নানাপ্রকার বিচিত্র গতিতে বিচরণ করিয়া ফিলিতেছিল, সেগুলাও যেন হাড়ের মত শক্ত হইয়া উঠিল, এইভাবে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া তিনি

উঠিয়া গেলেন।

আবার দিন কাটিতে লাগিল।

10
Articles
অরক্ষণীয়া
0.0
"আরক্ষনিয়া" সত্যবতী নামে এক যুবতীর গল্প বলে, যিনি একটি রক্ষণশীল এবং গোঁড়া বাঙালি পরিবারের অন্তর্গত। সত্যবতীর জীবন তার সমাজে নারীদের প্রতি স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও প্রত্যাশার দ্বারা গঠিত। তিনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি বিকাশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি একজন কঠোর এবং নিপীড়ক ব্যক্তিত্ব। এই বিবাহ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবে প্রমাণিত হয়। সত্যবতীর স্বামী বিকাশকে এমন একটি চরিত্র হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে যিনি সমাজের নিপীড়ক এবং পুরুষতান্ত্রিক দিকগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি সত্যবতীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং তার জীবন তার বৈবাহিক বাড়ির সীমানার মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য একটি অবিরাম সংগ্রামে পরিণত হয়। অসুবিধা সত্ত্বেও, সত্যবতী স্থিতিস্থাপকতা এবং তার জীবন পরিবর্তন করার দৃঢ় সংকল্প প্রদর্শন করে।উপন্যাসটি আত্ম-আবিষ্কারের দিকে সত্যবতীর যাত্রা এবং তার স্বাধীনতার সংগ্রামকে অন্বেষণ করে। তিনি সমাজ কর্তৃক তার উপর আরোপিত নিয়ম ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ঐতিহ্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চান। শরৎচন্দ্র সত্যবতীকে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন।গল্পটি উন্মোচিত হওয়ার সাথে সাথে, সত্যবতীর ক্রিয়াকলাপ বিদ্যমান সামাজিক নিয়মগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে, যা একটি চিন্তা-উদ্দীপক আখ্যানের দিকে পরিচালিত করে যা লিঙ্গ, শ্রেণী এবং সামাজিক প্রত্যাশার সমস্যাগুলিকে সম্বোধন করে। উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত নারীর মুক্তির বৃহত্তর বিষয়বস্তু এবং মর্যাদা ও আত্মসম্মানে জীবনযাপন করার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পড়ে।"অরক্ষনীয়া" সাহিত্যের একটি শক্তিশালী কাজ যা মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এবং একটি ঐতিহ্যবাহী সমাজে নারীদের মুখোমুখি হওয়া সংগ্রামকে চিত্রিত করার জন্য শরৎচন্দ্রের প্রতিভা প্রদর্শন করে। এটি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হিসাবে রয়ে গেছে এবং লিঙ্গ সমতা এবং সামাজিক সংস্কারের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হতে চলেছে।
1

এক

27 October 2023
0
0
0

মেজমাসীমা, মা মহাপ্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন ধরো। - কে রে, অতুল ? আয় বাবা, আয়, বলিয়া দুর্গামণি রান্নাঘর হইতে বাহির হইলেন। অতুল প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা গ্রহণ করিল । নীরোগ হও বাবা, দীর্ঘজীবী হও। ওরে ও জ

2

দুই

27 October 2023
0
0
0

বড়ভাই গোলকনাথ মারা গেলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বর্ণমঞ্জরী নির্বংশ পিতৃকুলের যৎসামা বিষয় আশয় বিক্রয় করিয়া হাতে কিছু নগদ পুঁজি করিয়া কনিষ্ঠ দেবর অনাথনাথকেই আশ্রয় করিয়াছিলেন। তাহারই বিষের অসহ্য জ্ব

3

তিন

27 October 2023
0
0
0

ছোটভাই অনাথকে বাধ্য হইয়া প্রাঙ্গণের প্রাচীরে একটা দ্বারা ফুটাইতে হইল। অগ্রজের শ্রাদ্ধ-শান্তি হইয়া গেলে পনর-ষোল দিন পরে একদিন তিনি অফিসে যাইবার মুখে চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বলিলেন,

4

চার

27 October 2023
0
0
0

এগার বৎসর পরে দুর্গামণি হরিপালের বাপের ভিটায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন শরতের সন্ধ্যা এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর ঝাপসা ধুয়া লইয়া সমস্ত প্রামখানার উপর হুমড়ি খাইয়া বসিয়াছিল যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ করিবা

5

পাঁচ

27 October 2023
1
0
0

প্রথম অগ্রহায়ণের শীতের বাতাস বহিতেছিল। দুর্গার এক ছেলেবেলার সাথী বাপের বাড়ি আসিয়াছিল। আজ দুপুরবেলা মেয়েকে একটু ভাল দেখিয়া দুর্গা তাহার সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়াছিল। পথে ডাক-পিয়নের সাক্ষাৎ পাইয

6

ছয়

28 October 2023
1
0
0

সংবাদ দিবার প্রয়োজন ছিল না বলিয়াই দুর্গা চিঠি না লিখিয়াই আসিয়াছিলেন। জ্ঞানদার চেহারা দেখিয়া জ্যাঠাইমা হাসিয়াই খুনগুলো ওগেনি, গালদুটো তোর চড়িয়ে ভেঙ্গে দিলে কে লো মা কি ঘেন্না। মাথায় টাক পড়ল ক

7

সাত

28 October 2023
0
0
0

আজকাল ধরিয়া না তুলিলে দুর্গা প্রায় উঠিতেই পারিতেন না। মেয়ে ছাড়া তাঁহার কোন উপায়ই ছিল না। তাই সহস্র কর্মের মধ্যেও জ্ঞানদা যখন-তখন ঘরে ঢুকিয়া মায়ের কাছে বসিত। আজিকার সকালেও একটুখানি ফাঁক পাইয়া,

8

আট

28 October 2023
0
0
0

মাধুরী শিশুকাল হইতেই কলিকাতায় মামার বাড়ি থাকে। মহাকালী পাঠশালায় পড়ে । ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত শিখিয়াছে। গাহিতে বাজাইতে, কার্পেট বুনিতেও জানে, আবার শিব গড়িতে, স্তোত্র আওড়াইতেও পারে। দেখিতেও অতিশয়

9

নয়

28 October 2023
0
0
0

চৈত্রের শেষ কয়টা দিন বলিয়া ছোটবৌয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই। মাসটা শেষ হইতেই তাহার ছোটভাই তাহাকে এবং মাধুরীকে লইবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ ভাল দিন খাওয়াদাওয়ার পরেই যাত্রার সময়। অতুল বাড

10

দশ

28 October 2023
0
0
0

দুর্গার এমন অবস্থা যে, কখন কি ঘটে বলা যায় না। তাহার উপর যখন তিনি পাড়ার সর্বশাস্ত্রদশী প্রবীণাদের মুখে শুনিলেন, তাহার প্রাপ্তবয়স্কা অলা কন্যা শুধু যে পিতৃপুরুষদিগেরই দিন দিন অধোপতি করিতেছে তাহা নাহে

---