প্রথম অগ্রহায়ণের শীতের বাতাস বহিতেছিল। দুর্গার এক ছেলেবেলার সাথী বাপের বাড়ি আসিয়াছিল। আজ দুপুরবেলা মেয়েকে একটু ভাল দেখিয়া দুর্গা তাহার সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়াছিল। পথে ডাক-পিয়নের সাক্ষাৎ পাইয়া ভাকিয়া বলিলেন, হাঁ দাশু, আমার নামের চিঠিপত্র পাচ্ছিলে কেন? দাশু হাসিয়া কহিল, চিঠি না এলে কি করে পাবে, দিদিঠাকরুন ?
দুর্গা সন্ধিস্বরে বলিলেন, আমার কিংবা আমার মেয়ে জ্ঞানদা দেবী কারু নামেই কি চিঠি আসে না?
দাত কহিল, এনে ত আমিই দিয়ে যেতাম দিদিঠ দুর্গা বলিলেন, না দাশু তোমার ব্যাগটা একটু ভালো করে দেখো - আসতেও পারে । তিন-তিনখানা চিঠির জবাব দেবে না, আমার অতুল ত তেমন ছেলে ন দাও বৃথা পরিশ্রম না করিয়া কহিল, না দিদি, নেই - এলেই পারে। বলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে, দুর্গা বাধা দিয়া বলিলেন, হাঁ দাল, এমনও ত হতে পারে তোমার পোস্টাফিসেই পড়ে আছে – পোস্টমাস্টার আমাদের নাম জানে না। হয়ত বা টেবিলের তলায় খোঁজে ঘাঁজে: কেযোও পড়ে গেছে, তোমরা কেউ দেখতে পাওনি। আমাকে ত এখানে সবাই জানে, আমি নিজে গিয়ে কি একবার খুঁজতে পারিনে ব্যাকুলতা দেখিয়া দাশু সদয়চিত্তে কহিল, কেন পারবে না দিদিঠাকরুন কিন্তু সে মিছে খোঁজা হবে। আচ্ছা, আমিই গিয়ে আজ একবার খুঁজে দেখব। যদি পাই দিয়ে যাবো। বলিয়া সে আর সময় নষ্ট না করিয়া চলিয়া গেল।
দুর্গা ঠাকুর দেবতার চরণে বিশ্বের ঐশ্বর্য মানত করিতে করিতে চলিলেন- হে মা দুর্গা, হে মা কালী, একখানি চিঠিও যেন খুঁজে পাওয়া যায়। আনদার এত বড় অসুখ শুনিয়াও সে উত্তর লিখবে না- এ কি কোনমতেই বিশ্বাস করা যায়। সে নিশ্চয় লিখিয়াছে, কিন্তু কোথাও গোলমাল হইয়া গেছে। হায় রে মানুষের আশা। শত কোটি সম্ভব-অসম্ভব জল্পনা-কল্পনার মধ্যে এ কথাটা একবারও দুর্গার মনে উদয় হইল না যে, ইতিমধ্যে অতুলের মনের গতি বদলাইয়া যাইতে পারে। একবারও ভাবিলেন না - অতুলের যে কামনা একদিন একান্ত সঙ্গোপনে সম্পূর্ণ আবরণের অন্তরে, শুধু নির্বিবাদেই বাড়িয়া উঠিতে পাইয়াছিল, তাহাকে এমন অসময়ে এতবড় অনাবৃত প্রকাশ্যের মধ্যে টানিয়া আনিলে, সে চক্ষের পলকে শুকাইয়া যাইতে পারে। এখন শত বিরুদ্ধ- শক্তি সজাগ হইয়া তাহাকে মুহূর্তের মধ্যে চাপিয়া মারিতে পারে। মানুষ এমনি অন্ধ- দুর্গা একটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া মেয়ের ঘরে ঢুকিয়া প্রথমেই প্রশ্ন করিলেন, হাঁ সে জ্ঞানদা, দাশু কোন চিঠিপত্র দিয়ে গেছে কি
মেয়ে কুণ্ঠিতম্বরে কহিল, না মা।
আজ দুই মাস হইতে উপর্যুপরি তিনখানি পরের জবাব আসিতেছে না। দুর্গা সংশয় ক্ষুব্ধ হইয়া কহিলেন, তুই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলি। তোর সাড়া না পেয়ে দাও হয়ত ফিরে গেছে । আমি বাড়িতে নেই একদিন একটুখানি কি জেগে থাকতে পারিসনে বাছা বলিয়া দুর্গা মুখ - ভার করিয়া চলিয়া গেলেন । জ্ঞানদা চুপ করিয়া রহিল। সে ঘুমায় নাই, জাগিয়াছিল বলিয়া তর্ক করিল না। মায়ের কাছে প্রত্যহ একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে নিজের লজ্জায় নিজেই মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিল।
দুর্গা তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া দ্বারের বাহির হইতে কহিলেন, কেন দাশু যে আমাকে বললে, সে খুঁজে এনে দিয়ে যাবে আজ কেমন করিয়া যেন তাঁহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইয়াছিল, অতুলের চিঠিপত্র আসিয়াছেই।
মেয়ে কথা কহিল না - একটা মলিন কাঁথার মধ্যে মুখ লুকাইয়া পড়িয়া রহিল । কিন্তু দুর্গা এইখানেই থামিতে পারিলেন না। তিনি ভ্রাতুষ্পুরকে পোষ্টাপিসে পাঠাইয়া করে লইয়া জানিলেন, দাশু আসে নাই ।
পরের তিন-চারি দিন তিনি পত্রের প্রত্যাশায় অহোরাত্র যেন কণ্টকশয্যায় বসিয়া কাটাইলেন তথাপি কিছু আসিল না। অবশেষে হতাশ হইয়া অঙুরের জননীকে চিঠি লিখিলেন। তিনি প্রত্যুত্তরে সংক্ষেপে জানাইলেন, অতুল ভাল আছে এবং কলিকাতার বাসায় থাকিয়া পূর্ববং লেখাপড়া করিতেছে। তাহার চিঠির মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের সুরই যেন দুর্গার কানে বাচ্ছিল। এমনি করিয়া অঘ্রান গেল, পৌষ গেল, কিন্তু অতুলের চিঠি আসিল না। মারে মাঝামাঝি মেয়ে যদিবা একটু সারিয়া উঠিল, মা অসুখে পড়িলেন। এতবড় নিরাশার আঘাত তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তা ছাড়া, বৌয়ের প্রতি তাঁহার বিদ্বেষের আর যেন অন্ত ছিল না। তাহার উল্লেখ করিতে হইলেই, ঘৃণাভরে কখনো বা পোড়া কাঠ' কখনো বা 'তড়কা বলিতেন এবং যত দিন যাইতে লাগিল, ঘৃণা যেন অপরিসীম হইয়া উঠিতে লাগিল। তাহার আরও একটা কারণ এই ছিল পোড়া কাঠ নিজের ধরনে জ্ঞানদাকে তাহার স্বাভাবিক মাধুর্যের জন্যই বোধ করি ভালবাসিয়াছিল, যত্নও করিত। কিন্তু এই যত্নের মধ্যে একটা উৎকট স্বার্থের গন্ধ পাইয়া দুর্গা বিষের জ্বালায় জ্বলিতে লাগিলেন। বড় দুঃখের লেহ, তাই অনেক সহিয়াছিল, কিন্তু আর সহিল না। মাঘের শেষে তিনি শয্যা আশ্রয় করিলেন। মেয়ে কাঁদিয়া বলিল, আর না মা, এইবার বাড়ি চল। যা হবার সেইখানেই হোক।
দুর্গা রাজী হইলেন। তাঁহার সম্মতির এখন আর বিশেষ আর কোন কারণ ছিল না, শুধু “পোড়া কাঠের যত্ন ও আত্মীয়তা হইতে বাহির হইবার জন্যই মন যেন তাহার অহরহ পালাই পালাই করিতে লাগিল।
যাত্রার উদ্যোগ হইতেছে শুনিয়া শম্ভু বাঁকিয়া বসিলেন। তখন সকাল সাতটা-আটটা, শম্ভু সন্ধ্যা আহ্নিক সারিয়া খটখট শব্দে বাহিরে আসিয়া ডাকিলেন, দুর্গা।
দুর্গা দাওয়ার একপ্রান্তে খুঁটি ঠেস দিয়া মুখ ধুইতেছিল। জ্ঞানদা কাছে বসিয়া সাহায্য করিতেছিল। দাদার আহ্বানে দুর্গা সাড়া দিলেন।
শম্ভু কহিলেন, এখন ত তোমার যাওয়া হতে পারে না।
কেন দাদা ?
কেন দাদা। আমি কি তোমার জন্যে কথা দিয়ে মিথ্যাবাদী হব নাকি ? সে জন্ম আমার নয়। কথাটা না জানিয়াও দুর্গার বুকের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল । মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিসের কথা, দাদা
শম্ভু কহিলেন, গেনির বিয়ের। আর ত আমি রাখতে পারি নে - কাজেই আমাদের নবীনের সঙ্গেই সামনের পাচুই ফাল্গুনে কথাবার্তা পাকা করে ফেলতে হ'ল। এদিকে গয়নাগাটির মন্দ দেবে না ব্লচে। দেখতে শুনতে সবদিকেই ভাল হবে, দেখলাম কিনা।
খবর শুনিয়া দুর্গার মাথায় বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কাঁদ-কাঁদ হইয়া কহিলেন, আমাকে লা বলে কেন মিথ্যে কথা দিলে, দাদা এ নিয়ে ত আমি প্রাণ থাকতে দিতে পারব না ।
শম্ভু ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, পারব না বললেই হবে ? আমি মামা আমি যা বলব তাই হবে। তোর জন্যে কথার নড়চড় করব, তেমন বাপে আমাকে জন্ম দেয়নি তা জানিস ? এইবার দুর্গা সত্যি সত্যি কাঁদিয়া ফেলিলেন, কহিলেন, না দাদা, মেয়ের বিয়ে এখানে আমি মরে গেলেও দেব না আমার জন্যে তুমি এতটুকু ভেব না দাদা কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া কথাটা তিনি শেষ করিতেই পারিলেন না।
শম্ভু এই কান্না দেখিয়া মহা বিরক্ত হইয়া দাঁত খিঁচাইয়া কহিলেন, শুভকর্মে মিছে কাঁদিস নে ভ্যানভ্যান করে। যা হবার নয়, যা পারব না - রাজস্থলে 'পোড়া কাঠা দেখা দিলেন। দুই হাত গোবর মাখা বোধ করি, তখনো গোয়ালঘরের ব্যাবস্থাই করিতেছিলেন। উঠানের উপর আসিয়া স্বামীকে উদ্দেশ্য করিয়া অকস্মাৎ ভাঙ্গা কাঁসির মত খানখ্যান করিয়া বাজিয়া উঠিলেন- বলি সুপান্তরটি কে গা ঠাকুর ? একবার শুনতে পাইনে শম্ভু শ্রীর ভাবগতিক দেখিয়া বিচলিত হইলেন। কিন্তু মুখের সাহস বজায় রাখিয়া কহিলেন, যেই হোক, তাতে তোর কি "পোড়া কাঠ' গোবর মাখা হাত দু'খানা নাড়া দিয়া অর্ধেক উঠানটা যেন নাচিয়া আসিল।
তেমনি সুমধুর কন্ঠে সমস্ত পাড়াটা সচকিত করিয়া কহিল, মামা মামাতি ফলাতে এসেছেন। নবীনের সঙ্গে বিয়ে দেব। তা হলে একশ টাকা সুদে-আসলে শোধ যায় না তাই সে সুপান্তর আমার নিজের দাদা, আমি জানিনে ? তাড়ি-গাঁজা খেয়ে পাঁচ ছেলের মা বৌটাকে আট মাস পেটের উপর লাথি মেরে, মেরে ফেললে কিনা, তাই অমন পাত্তর আর নেই ; গলায় দেবার দড়ি জোটে না তোমার ? ধিক ধিক।
শম্ভু ভগিনী ভগিনীর সমক্ষে ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিলেন না। পায়ের খড়ম হাতে লইয়া চীৎকার করিলেন, চুপ কর বলচি, হারামজাদী।
'পোড় কাঠ' এইবার ক্ষেপিয়া উঠিল। সে এমনি ভয়ঙ্কর ভঙ্গী করিয়া চেঁচাইতে লাগিল যে, সে বস্তু চোখে না দেখিলে শুধু লেখাপড়িয়া বোঝা যায় না, কহিল, অ্যাঁ আমাকে হারামজাদী ফের মুখে আনলে পোড়া কাঠ যদি না মুখে গুঁজে দিত, পাঁচু ঘোষালের মেয়ে নই আমি। জোর করে বিয়ে দেবে? কেন, কে তুমি ও এসেছে মেয়ে নিয়ে দু'দিন জুড়োতে, কেন তুমি তকে রাতদিন ভয় দেখাবে ? আঁশ বটিটা আমার দেখে রেখো। শালা-ভগ্নিপোতের একসঙ্গে
নাক-কান কেটে তবে ছাড়ব। আমার নাম ভামিনী, তা মনে রেখো।
সে মূর্তির সামনে শম্ভু আর কথা কহিলেন না ঘরে চলিয়া গেলেন। “পোড়া কাঠ' তখন দুর্গার পানে ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, ও কি সোজা চামার, ঠাকুরঝি। তোমার আসা পর্যন্ত মতলব আটচে কি করে অমন সোনার প্রতীমা বাদরের হাতে দিয়ে ধার করে জমি খালাস করে নেবে। আবার বলে মামা আমি।
একটুখানি দম লইয়া কহিতে লাগিল, বললে তুমি মনে কষ্ট করবে, আমি বলতাম না, ঠাকুরঝি। বললাম, মেয়েটা জ্বরে মরে যায়, একটা ভাল ডাক্তার আনো। বললে, অত পয়সা নেই আমার। মহলের মধ্যে সম্বল, একগাছি রূপার গোটা ছিল আমার, তাই বাধা দিয়ে আমি ডাক্তার ডেকে আনলাম আর ও বলে কিনা যা খুশী করব আমি মামা। মুখপোড়া। আমি - বেঁচে থাকতে ভয় কি ঠাকুরঝি। আমি আজই বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি গিয়ে মেয়ের বিয়ে দাও গে দিয়ে যখন খুশী আবার এসো। -
দুর্গা খুঁটি ঠেস দিয়া তেমনি বসিয়া রহিলেন তাঁহার দুই চক্ষু নিয়া কেবল ঝরঝর করিয়া - জল পড়াইয়া পড়িতে লাগিল ।
'পোড়া কাঠ কণ্ঠস্বর কিঞ্চিত খাটো করিয়া অদৃশ্য স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, অনাথ বলে ওর উপর জুলুম করবে কেন, মাতার উপর ভগবান নেই কি ? আমি বলি, যা তোমার আছে, তাই নিয়ে নাড়ো চাড়ো খাও-দাও। পরের নিয়ে নিজের পেট মোটা করব কি জন্যে ? ভগবান কখনো তার ভাল করেন না।
সেই দিনেই দুপুর বেলা যাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক হইয়া গেল।
গরুর গাড়িতে উঠিতে গিয়া দুর্গা 'পোড়া কাঠের দু'পায়ের উপর মহা পাতিয়া আজ সত্য সত্যই তার অশ্রুজলে ভিজাইয়া ফেলিলেন। কহিলেন, বৌ, বড় ভাল তুমি, তোমাকে ত আশীর্বাদ করতে পারিনে কিন্তু ভগবান তোমাকে যেন দেখেন। আমার জন্যে তুমি তোমার গোটছড়াটি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেললে।
"পোড়া কাঠ আদান্ত মাড়ী বাহির করিয়া হাসিয়া কহিল, ছাই গোটছড়া। এই বল ঠাকুরঝি, হাতে নোয়া নিয়ে স্বামী-পুত্তুরের, গো-ব্রাহ্মণের সেবা করে যেন যেতে পারি। নাও, রোগা শ্রীরে আর দাঁড়িয়ে দেক না গাড়িতে উঠে বসে। গেনি, মামা-মামীর ঘরে অনেক কষ্ট - পেয়ে গেলি মা, কিন্তু আবার আসিস - ভুলিস নে যেন। বলিয়া তাহার হতের মধ্যে জোর করিয়া দুটি টাকা ওঁজিয়া দিল।
গাড়ি ছাড়িয়া দিলে দুৰ্গ চোখ মুছিতে মুছিতে কহিল, না বুঝে অনেক অপরাধ তোমার চরণে করে গেলাম বৌ, সে-সব আমার মাপ করো। 'পোড়া কাঠ' আজ আর সমস্ত মাড়ী বিকশিত করিয়া হাসিল না, বরং চট্ট করিয়া একফোটা চোখের জল মুছিয়া কহিল, পোড়া কপাল! অপরাধ ত সব আমাদেরই হ'ল ঠাকুরঝি। এলো, ও গেনি, মামা মামীর ওপর রাগ টাগ করিস নে যেন। আসছে বছর আম কাঠালের দিনে তোর নেমন্তন্ন রইল - জামাইকে সঙ্গে করে একবার আসিস না। বলিয়া হাতের পিঠ দিয়া আর দু'ফোটা চোখের জল মুছিয়া ফেলিল।