shabd-logo

দশ

28 October 2023

1 Viewed 1

দুর্গার এমন অবস্থা যে, কখন কি ঘটে বলা যায় না। তাহার উপর যখন তিনি পাড়ার সর্বশাস্ত্রদশী প্রবীণাদের মুখে শুনিলেন, তাহার প্রাপ্তবয়স্কা অলা কন্যা শুধু যে পিতৃপুরুষদিগেরই দিন দিন অধোপতি করিতেছে তাহা নাহে, তাহার নিজেরও মরণকালে সে কোন কাজেই - আসিবে না তাহার হাতের জল এবং অভন উভয়ই অস্পৃশ্য তখন শাস্ত্র শুনিয়া এই আসর পরলোকযাত্রীর পাংশু মুখ কিছুক্ষণের জন্য একেবারে কাগজের মত সাদা হইয়া গেল।

বহুদিন ধরিয়া অবিশ্রান্ত যা খাইয়া খাইয়া তাহার স্নেহের স্থানটা কি একপ্রকার যেন অসাড় হইয়া আসিতেছিল। যে মেয়ের প্রতি তাহার ভালবাসার অবধি ছিল না, সেই মেয়েকেই দেখিলে জ্বলিয়া উঠিতেছিলেন। আজ এই সংবাদ শোনার পর, তাঁহার পরলোকের কাঁটা এই মেয়েটার বিরুদ্ধে তাঁহার সমস্ত চিত্ত একেবারে পাষাণের মত কঠিন হইয়া গেল। মায়া-মমতার আর লেশমাত্র তথায় অবশিষ্ট রহিল না।

অনাথকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিলেন, ঠাকুরপো, শুনেচি নাকি ও পাড়ার ঐ যে গোপাল ভটচায্যি, না কে, সে বুঝি আবার বিয়ে করবে। আমার মরবার আগে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে না ঠাকুরপো?

অনাথ কথাটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করিয়া উড়াইয়া দিয়া কহিল, না না, গোপাল ভটচায্যি আবার বিয়ে করবে কি। কে তোমার সঙ্গে তামাশা করেচে, বৌঠান দুর্গা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমার সঙ্গে আর তামাশা করবে কে, ঠাকুরপো? তিনি পুরুষমানুষ ব্যাটাছেলে, তাদের আবার বয়সের খোজ কে করে? না না, ও-বয়সে অনেকে বিয়ে করে ঠাকুরপো! আমি মিনতি করচি, একবার গিয়ে তর সন্ধান নাও। বেঁচে থেকে ৩ কিছুই পেলাম না, মরণের পরে একটু আগুনও কি পাব না এখন ইহাই হইয়াছে তাঁহার সকল আশঙ্কার বড় আশঙ্কা। তাঁহার কেবলই মনে হইতেছে এই যে, মেয়ে পেটে ধরা এত দুঃখে লালন পালন করা, শেষ মুহূর্তে সং একেবারে নিষ্ফল হইয়া যাইবে যাহার হাতের আগুন পাইবার জো নাই, সে মেয়ে কেন জন্মিয়াছিল ? উদ্বেগে প্রায় উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, ঠাকুরপো, যেখানে হোক, যার হাতে হোক আমি বেঁচে থাকতে ওকে সঁপে দাও। আমি কাচি, আমার এই শেষ আশীর্বাদে তুমি রাজা হবে ঠাকুরপো।

ঠাকুরপোর নিজের গরজও এ বিষয়ে কম নয়। সে সেইদিনই গোপাল ভটচায়ির খোঁজ লইতে গেল এবং কথাটা সত্য শুনিয়া খানিকক্ষণ চিত হইয়া রহিল, শুধু সত্য বলিয়াই নয় - ইহারই মধ্যে খবর পাইয়া চারি পাঁচজন কন্যাভারগ্রস্থ পিতা আসিয়া তাহাকে সাধাসাধি করিয়া গিয়াছে বলিয়া ।

এত কষ্টের বিয়ে, তবুও যে নিল গোপালকে কন্যা দান করা হইবে সে-ই ছি ছি করিল। কিন্তু জননীর তাহাতে মন চলিল না। তিনি যে এখন পরলোকের যাত্রী, সে যাবার পাবের শাস্ত্র-নির্দেশমত যেমন করিয়া হোক তাঁহার সংগ্রহ হওয়া যে নিতান্তই চাই।

বাঙ্গালীর মেয়ে - কত জন্ম-জন্যান্তর ধরিয়া যে শাস্ত্রের যূপকাষ্ঠে কন্যা বলি দিয়া আসিয়াছে, আজ পিছাইয়া দাঁড়াইবে সে কি করিয়া " আবার দুঃখের উপর দুঃখ, সেই গোপাল বলিয়া পাঠাইল, সে মেয়ে দেখিয়া বিবাহ করিবে। এ পোড়া দেশে তাহারও শখ আছে এবং পাঁচটি দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ করিবার সুযোগও আছে।

গ্রীষ্মের শুষ্ক তুন একটা মেঘের বারিপাতেই যেমন উজ্জীবিত হইয়া উঠে, এই একটুকুমাত্র আশার ইঙ্গিতে দুর্গার মরা আশা চক্ষের পলকে মাথাঝাড়া দিয়া উি অনাথের হাতটা ধরিয়া মিনতি করিয়া কহিলেন, ঠাকুরপো, এইটুকু ছোটভাইয়ের কাজ কর ভাই - হততা পীর হাতের আগুনটুকু যেন শেষ সময়ে পাই। সামনের পাচুইটা যেন আর কোনমতেই ফসকে না যায়। তুমি বলে এস ভাই, আজকেই যেন মেয়ে দেখে কথাবার্তা পাকা করে যান।

বিয়ে না হইলে মায়ের শেষ কাজটাও তাহাকে দিয়া করান হইবে না শাস্ত্রে নিষেধ আছে এ কথা শুনিয়া জ্ঞানদা নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করিল। সেও ত বাঙ্গালীর মেয়ে তাহারও - বুকের মধ্যে অবিশ্রাম যেন চিতার আগুন জ্বলিতে লাগিল ।

অপরাহ্নবেলায় একাকী রান্নাঘরে বসিয়া সে মায়ের জন্য পণ্য প্রস্তুত করিতেছিল, রূপের পরীক্ষা দিবার জন্য আর একবার তাহার ডাক পড়িল ।

স্বর্ণ নিজে ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, ওলো গেনি, ওটা নামিয়ে রেখে শিগগির আয়, তা দেখতে এসেছে। শুধু একখানা কাপড় পড়ে আয়, তারা এমনি দেখে যাবে। বলিয়া তিনি তেমনি দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন । অনাথ তখনও অফিস হইতে ফিরে নাই, সুতরাং আদর-অন্ত্যর্থনা করিবার ভার তাঁরই উপরে । দেখিতে আসিয়াছিল পাত্র নিজে এবং তাহার এক দূর সম্পর্কীয় ভাগিনেয়। ছেলে- ছোকরাদের পছন্দ আছে বলিয়া গোপাল বৃদ্ধি করিয়া তাহার এই ভাগিনেয়টিকে সঙ্গে আনিয়াছিল। ইহারই পরামর্শমত মেয়ে যেমন আছে তেমনি দেখাইবার আদেশ হইয়াছিল, - কারণ সাজাইয়া দেখানোর মধ্যে ফাঁকি চলিতে পারে।

ছেলেটি ছয়টার ট্রেনে কলিকাতা যাইবে সে তাড়াতাড়ি করিতে লাগিল স্বর্ণ অন্তরালে দাঁড়াইয়া গলা চাপিয়া ডাকাডাকি করিতে লাগিল, কিন্তু জ্ঞানদা আর আসে না। শুধুমাত্র একখানা কাপড় পড়িয়া আসিতে যে সময় লাগে তাহার অনেক বেশী বিলম্ব হইয়েছে দেখিয়া ঝি গিয়া যখন তাহাকে টানিয়া আনিল, তখন তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই জ্যাঠাইমা লোখে আত্মহারা হইয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন, খোল এ-সব, কে বললে, তোকে এমন করে সেজেগুজে আসতে যা শিগগির খুলে আয় - যাঁহারা দেখিতে আসিয়াছিল, হঠাৎ এই চেঁচামেচি শুনিয়া তাহারা আশ্চর্য হইয়া পলা বাড়াইয়া দেখিলেন। ছেলেটি ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়া কহিল, তবে এমনিই নিয়ে আসুন, আমার আর দেরি করবার জো নেই।

ঝি যখন তাহাকে আনিয়া সম্মুখে দাঁড় করাইল, তখন কন্যার অপরূপ সাজসজ্জা দেখিয়া ছেলেটি বহু ক্লেশে হাসি দমন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কাল খবর দেব, বলিয়া মাতুলকে লইয়া প্রস্থান করিল । জলযোগের আয়োজন ছিল, কিন্তু ট্রেন মিস্ করিবার ভয়ে তাহা স্পর্শ করিবারও তাহাদের অবকাশ ঘটল না।

কাল খবর দেবার অর্থ যে কি, তাহা সবাই বুঝিল। জ্যাঠাইমা চেঁচাইয়া, পালি পাড়িয়া, চক্ষের পলকে সমস্ত পাড়াটা মাথায় তুলিয়া ফেলিলেন। মেজবৌয়ের অবস্থা ভাল নয়, আশঙ্কা করিয়া পাশের বাড়ির দুই-চারিন ছুটিয়া আসিয়া পড়িল, এবং ঠিক সময়েই অকস্মাৎ কোথা হইতে অতুল আসিয়া উপস্থিত হইল। সেও ছটার ট্রেনে কলিকাতায় যাইতেছিল এবং পথের মধ্যে চীৎকার শুনিয়া এই আশা করিয়াই বাড়ি ঢুকিয়াছিল।

অতুলকে দেখিতে পাইয়া স্বর্ণের রোষ শতগুণ এবং ক্ষোভ সহস্রগুণ হইয়া উঠিল শ সঙ্কুচিত, ভয়ে মৃতকল্প, দুর্ভাগা মেয়েটার ঘাড়টা জোর করিয়া অতুলের মুখের উপর তুলিয়া পর্শিয়া উঠিলেন, দ্যাখ অতুল, একবার চেয়ে দ্যাখা হতভাগী, শতেকথাকী, বদরীর মুখখানা একবার তাকিয়ে দ্যাখ ! বাস্তবিক তাহার মুখের পানে চাহিলে হাসি সামলানো যায় না। তাহার ঠোঁটের রঙ গালে, পায়ের রঙ দাড়িতে, অন্ধকার কোণে স্বহস্তে টিপ পড়িতে গিয়া সেটা কপালের মাঝখানে লাগিয়াছে রুক্ষ চুল বোধ করি তাড়াতাড়ি এক খাবলা তেল দিয়া বাঁধিতে গিয়াছিল, তখনো দুই রগ গড়াইয়া তেল ঝরিতেছে।

দুই-একটা মেয়ে পাশ হইতে লিখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজনের কোলে ছেলে ছিল, সে কহিল, তিনি পিতি থঙ বেজেছে। পিতি, এমনি কোলে জিব বার কলো। বলিয়া সে হাঁ করিয়া জিভ বাহির করিয়া দেখাইল। আর একবার সবাই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল ।

মুখপোড়া ছেলে। বলিয়া তাহার মা-ও হাসিয়া ছেলের পালে একটা ঠোনা । কিন্তু অতুলের বুকের ভেতরটা কে যেন তপ্ত শেল দিয়া বিধিয়া দিল। অনেকদিন হইয়া গেছে, এমন দিবালোকে এত স্পষ্ট করিয়া সে জ্ঞানলার মুখের পানে চাহে নাই। শুধু পরের মুখে শুনিয়াছিল, রোপে বিশ্রী হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সে বিশ্রী যে এই বিশ্রী, তাহা সে স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। এই সাংঘাতিক রোগে নিজে যখন সে মরণাপন্ন, তখন এই মুখখানাকে সে ভালবাসিয়াছিল। 

চোখের নেশা নয়, কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস নয় অকপটে সমস্ত প্রাণ চালি ভালবাসিয়াছিল। আজ অকস্মাৎ যখন চোখে পড়িল, সেই মুখখানার উপরেই যম তাঁহার ডিক্রিজারি করিয়া শেষ নোটিস আঁটিয়া গেছেন, তখন মুহূর্তের জন্য সে আত্মবিস্মৃত হইল। কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু স্বর্ণের উচ্চকণ্ঠে তাহা চাপা পড়িয়া গেল।

অ্যাঁ, খানকীর বেহদ্দ করলি না? একটা ঘাটের মড়া, তার মন ভুলোবার জন্যে এই সেজে এলি ? কিন্তু পারলি ভুলোতে মুখে লাথি মেরে চলে গেল যে।

কে একজন প্রশ্ন করিল, কে এমন ভূত সাজিয়ে দিলে বড়বৌ ? বুড়োর পছন্দ হ'ল না স্বর্ণ তাহার প্রতি চাহিয়া, তর্জন করিয়া কহিলেন, নিজে সেজেচেন আবার কে সাজাবে ? মা ত অজ্ঞান-অচৈতন্য। বলে দিলাম শুধু একখানি কাপড় পড়ে আয়। তা পছন্দ হ'ল না। ভাবলেন, সেজেগুজে না গেলে যদি বুড়োর মনে না ধরে আর সাজের মধ্যে ত ঐ ছোপানো কাপড়খানি, আর অতুলের দেওয়া এই দু গাছি চুড়ি। তা দিনের মধ্যে দশবার খুলে ভুলে রাখছে, দশবার হাতে পরতে। কালীমুখীর ও-চুড়ি হাতে দিয়ে বার হতে লজ্জাও করে না বেলো সুমুখ থেকে দূর হয়ে যা বেহায়া মেয়েটার এই নির্লজ্জ চরিত্রের সবাই আালোচনা করিয়া ছি ছি করিয়া চলিয়া গেল, শুধু যাঁহার কাছে কিছুই অজ্ঞাত থাকে না, সেই অন্তর্যামীর চোখ দিয়া হয়ত বা একফোঁটা তুলিয়া কথা কহিতেই পারিত না, সে কেমন করিয়া, আজ সকল লজ্জায় পদাঘাত করিয়া নিজের ওই স্বাস্থ্য শ্রীহীন লেংটাকে মহন্তে সাজাইয়া আনিয়া ঐ অতি বৃদ্ধটার পদেই ঠকাইয়া বিক্রি জল গড়াইয়া পড়িল। তিনিই শুধু জানিলেন, – যে মেয়েটা আজকাল লজ্জায় কখনো মুখ করিতে পিয়া ছিল। কিন্তু বিক্রি হইল না ফাঁকি ধরা পড়িল। আজ তাই সবাই ছি ছি করিয়া - হিজার দিয়া গেল - কেহই ক্ষমা করিল না। কিন্তু অন্তরে বসিয়া যিনি সর্বকালের সর্বলোকের বিচারক, তিনি হয়ত দুর্ভাগা বালিকার এই অপরাধের ভার আপনার শীহতেই গ্রহণ করিলেন।

জ্ঞানদা উঠিয়া দাঁড়াইল। কখনো সে পরের সমক্ষে কাঁদে নাই কিন্তু অতুলের সম্মুখে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। অথচ, একটা কথারও কৈফিয়ত দিল না, কাহারো পানে চাহিয়া দেখিল না নীরবে চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল।

কলিকাতা যাইবার আর পাড়ি ছিল না বলিয়া অতুল সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া গেল । পথে সব কথা ছাপাইয়া ছোটমাসীর সেই কথাটাই বারবার মনে পড়িতে লাগিল। সেদিন বাপের বাড়ি যাইবার সময় অতুলকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিয় ছিলেন, অতুল, হীরা ফেলে যে কাঁচ আঁচলে বাধে, তার মনস্তাপের আর অবধি থাকে না বাবা। সেদিন কথাটা ভাল বুঝিতে পারে নাই, কিন্তু আজ তাহার যেন নিঃসংশয়ে মনে হইল, কথাটা তাহাকেই লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছিল। লজ্জাহীনা বলিয়া যাহাতে আজ সবাই লাঞ্ছনা করিয়া বিদায় দিল, তাহারই লজ্জা শরমের সীমারেখাটি যে কোনখানে, আজ সে কথাও তাহার স্মরণ হইল। তখনো ভোর হয় নাই, অনাথ ডাকিতে আসিলেন, মেজবৌকে দাহ করিতে হইবে। চলুন যাই, বলিয়া অতুল বাহির হইয়া পড়িল। গিয়া দেখিল, দেড় বৎসর পূর্বে তুলসীমূলে পিতার পা-দুটি কোলে করিয়া যেমন বসিয়াছিল, আজও তেমনি নিঃশব্দে মায়ের পদ দুটি কোলে লইয়া জ্ঞানদা বসিয়া আছে। শুধু একটিবার ছাড়া জীবনে কেহ কখনো তাহাকে চঞ্চল হইতে দেখে নাই - সেই যখন সে অতুলেরই পায়ের উপর পড়িয়া মাথা খুঁড়িয়া ছিল। সুতরাং, তাহার এই নিবিড় নীরবতায় কেহ কিছুই মনে করিল না। সেদিকে কাহারও দৃষ্টিহ ছিল। না, সৎকারের উদ্যোগ-আয়োজনেই পাড়ার লোক ব্যাস্ত ।

যথাসময়ে তাহারা মৃতদেহ লইয়া শ্মশানে যাত্রা করিল। সকলের পিছনে জ্ঞানদাও গেল। দুঃখীর মেয়ে বলিয়া পাড়ার কোন মেয়েই তাহার সঙ্গে গেল না, যাবার কথাও কাহারো মনে হইল না।

বর্ষায় ভরা গলা শ্মশানের ঠিক নীচে দিয়াই আবেগে বহিতেছিল। মায়ের শেষ কাজ মেয়ে নীরবে সাঙ্গ করিল। চিতা যখন ধুধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে পুরুষের ভীড় হইতে সরিয়া নীচে নামিয়া একেবারে জলের ধারে গিয়া বসিল। কেই নিষেধ করিল না, কারণ, নিষেধ করিবার কিছু ছিল না। বরঞ্চ এই পভীর শোকের দৃশ্যটাকে চোখের আড়াল করিতেই সে যে নামিয়া গেল, তাহা নিশ্চয় অনুভব করিয়া মুহূর্তের সমবেদনায় অনেকেই 'আগ' বলিয়া নিঃশ্বাস ফেলিল।

এই চিরদিন শান্ত পরমসহিষ্ণু মেয়েটি উৎকট কিছু যে করিয়া বসিতে পারে, সে ভয় কাহারও ছিল না। অতুলেরও না। তথাপি তাহাকে খরস্রোতের একান্ত সন্নিকটে গিয়া বসিতে দেখিয়া, তাহার বুকের ভিতরটায় কেমন একরকম করিয়া উঠিল। একবার ভাবিন নিষেধ করে, একবার ভাবিল কাছে গিয়া দাঁড়ায়, কিন্তু লজ্জায়, কুণ্ঠায় কোনটাই পারিল না।

অন্যুত্তাপ বাঁচাইয়া সবাই পিয়া যেখানে বসিয়াছিল, অতুলও গিয়া সেখানে বসিল। সমুখে প্রভুলিত চিতার পানে চাহিয়া সহসা তাহার মনের মধ্যে সেই চিরদিনের পুরানো শুধু আবার নূতন করিয়া জাগিয়া উঠিল কাল যে ছিল, আজ সে নাই, আজও যে ছিল, তাহারও ঐ নশ্বর দেহটা ধীরে ধীরে ভরসা হইতেছে, আর তাহাকে চেনাই যায় না, অথচ, এই দেহটাকেই আশ্রয় করিয়া কত আশ, কত আকাঙ্খা, কত ভয়, কত ভাবনাই না ছিল। কোথায় গেল ? এক নিমিষে কোথায় অন্তর্হিত হইল ? তবে কি তার দাম মরিতেই বা কতক্ষণ লাগে ?

সহসা তাহার নিজেরই বিগত জীবন চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল। বছর তিনেক পূর্বে সে মরিতে বসিয় ছিল, কিন্তু মরে নাই। অজ্ঞাতসারে তাহার চোখের দৃষ্টি চিতার পিঙ্গল ধূসর ধূমের তরঙ্গিত যবনিকা ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। মনে পড়িল, সেদিন যে মরিতে দেয় নাই সে ওই, ওই যে জাহ্নবীর ঘোলা জলে অস্পষ্ট ছায়া ফেলিয়া মূর্তিমতী শোকের মত বসিয়া আছে, শুধু রুক্ষ কেশ ও মলিন অঞ্চল তাহার বাতাসে দুলিতেছে।

তাহার দুই চক্ষু অসম্পূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলল, ছাই রূপ। রূপেরই যদি এত দাম, তবে তিন বৎসর পূর্বে রূপের হাটে সে নিজেই ত দেউলিয়া হইয়া গিয়াছিল। সেদিন পরম নারীয়েরাও ও ঘৃণায় তাহার পানে চাহিতে পারে নাই।

কেমন করিয়া যে সময় কাটিতেছিল, তাহার জ্ঞান ছিল না। কখন যে চিতা নিভিতেছিল, তাহাও সে দেখে নাই। সর্বক্ষণ তাহার সমস্ত দৃষ্টি শুধু এই নিশ্চল মূর্তিটার প্রতি নিবন্ধ হইয়া ছিল।

অনাথ কহিলেন, আর বসে কেন বাবা এসো, শেষ কাজটা শেষ করে দিই। চলুন, বলিয়া অতুল অপরাহ্নবেলায় স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তখন সূর্য ঢলিয়া পড়িতেছিল। সেই শন আলোক দীপ্যমান ঘাটের উপরে নিপতিত দু'পাছি ভাঙ্গা চুড়ির উপর দৃষ্টি পড়ায় সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। এ সেই তাহারই দেওয়া অতি তুচ্ছ মহামূল্য অলঙ্কার। শত লাঞ্ছনা, সহস্র শিকারেও যে দু'গাছির মায়া জ্ঞানদা কাটাইতে পারে নাই, আজ নিজের হাতে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহার কৈফিয়ত দিয়াছে। অতুল দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া আসিয়া সেই দু'গাছি সস্নেহে, সযত্নে কুড়াইয়া লইল। অখণ্ড অবস্থায় যাহার কোন মর্যাদাই সে দেয় নাই, আজ তাহা ভগ্ন তুচ্ছ কাঁচখণ্ড হইয়াও তাহার কাছে একেবারে অমূল্য হইয়া উঠিল।

পিছনে পদধ্বনি শুনিয়া মানদা মুখ ফিরিয়া চাহিল। সে চাহনি অতুল সহ্য করিতে পারিল না। বোধ করি বা একবার সে যেন তাহার হাত ধরিতেও গেল, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, - ভুল সকলেই হয় জ্ঞানদা, কিন্তু বলিয়া সে হাতের মুঠাটা মেলিয়া ধরিতেই সারাহের আরও আভার আর একবার সেই কাঁচখতগুলি ঝকঝক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল কহিল, আজ যাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে এলে, আমি তাকেই আবার শ্মশান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলুম।

কথাটা জ্ঞানদা বুঝিতে পারিল না, তাই সে তাহার নিবিড় শোকাচ্ছন্ন উদাস দৃষ্টি অতুলের মুখের প্রতি তুলিয়া আজ অনেকদিন পরে আবার কথা কহিল, মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কেন জবাব দিতে গিয়া অতুলের দু'চক্ষু সহসা অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু সামলাইয়া লইয়া বলিল, আনো, আজ মেজমাসীমার চিতার আগুনের মধ্যে একটা জিনিস আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, যা ভাঙ্গবার নয়, তাকে কিছুতেই জোর করে ভাগা যায় না। জোর করে কাঁচের চুড়িই ভাঙ্গা যায়, কিন্তু, আমাদের সেই দেওয়া-নেওয়াটা আজও তেমনি আঁক হয়ে আছে তাকে ভেঙ্গে ফেলি, এত জোর তোমার আমার কারও নেই। আমি যা পারিনি, তুমিও তা পারবে না নিশ্চয় জানতে পেরেছি বলেই এই ভাঙা চুড়ি বুকে করে তুলে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। জ্ঞানদা হতচেতনের মত নির্ণশেষ চক্ষে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অতুল অকস্মাৎ দুই হাত বাড়াইয়া তাহার শীর্ণ ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইল, কিন্তু জ্ঞানদা তেমনি পাথরের মূর্তির মত স্থির হইয়াই রহিল। অব্দে থাকিয়া অপরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আমার সমস্ত পাপের গুরুদত্ত আর যেই দিক জ্ঞানো, তুমি দেবার চেষ্টা ক'রো না। আমি যত অরাহ করে থাকি না কেন, আমাকে তোমার ফিরে নিতেই হবে। আমাকে ত্যাগ করে শালি দেবে এ সাধ্য তোমার কিছুতেই নেই।

এতক্ষণে জ্ঞানদা মাথা হেঁট করিল, কিন্তু মুখ দিয়া তাহার কথা ফুটিল না দুর্বল শীর্ণ হাতটি অতুলের হাতের মধ্যে একবার শিহরিয়া কাঁপিয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্ত উভয়েই স্তব্ধ থাকিয়া অতুল হাতখানি ধীরে ধীরে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, বাড়ি চল, তারা সবাই এগিয়ে গেছেন।

1 সমাপ্ত 1

10
Articles
অরক্ষণীয়া
0.0
"আরক্ষনিয়া" সত্যবতী নামে এক যুবতীর গল্প বলে, যিনি একটি রক্ষণশীল এবং গোঁড়া বাঙালি পরিবারের অন্তর্গত। সত্যবতীর জীবন তার সমাজে নারীদের প্রতি স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও প্রত্যাশার দ্বারা গঠিত। তিনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি বিকাশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি একজন কঠোর এবং নিপীড়ক ব্যক্তিত্ব। এই বিবাহ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবে প্রমাণিত হয়। সত্যবতীর স্বামী বিকাশকে এমন একটি চরিত্র হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে যিনি সমাজের নিপীড়ক এবং পুরুষতান্ত্রিক দিকগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি সত্যবতীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং তার জীবন তার বৈবাহিক বাড়ির সীমানার মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য একটি অবিরাম সংগ্রামে পরিণত হয়। অসুবিধা সত্ত্বেও, সত্যবতী স্থিতিস্থাপকতা এবং তার জীবন পরিবর্তন করার দৃঢ় সংকল্প প্রদর্শন করে।উপন্যাসটি আত্ম-আবিষ্কারের দিকে সত্যবতীর যাত্রা এবং তার স্বাধীনতার সংগ্রামকে অন্বেষণ করে। তিনি সমাজ কর্তৃক তার উপর আরোপিত নিয়ম ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ঐতিহ্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চান। শরৎচন্দ্র সত্যবতীকে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন।গল্পটি উন্মোচিত হওয়ার সাথে সাথে, সত্যবতীর ক্রিয়াকলাপ বিদ্যমান সামাজিক নিয়মগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে, যা একটি চিন্তা-উদ্দীপক আখ্যানের দিকে পরিচালিত করে যা লিঙ্গ, শ্রেণী এবং সামাজিক প্রত্যাশার সমস্যাগুলিকে সম্বোধন করে। উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত নারীর মুক্তির বৃহত্তর বিষয়বস্তু এবং মর্যাদা ও আত্মসম্মানে জীবনযাপন করার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পড়ে।"অরক্ষনীয়া" সাহিত্যের একটি শক্তিশালী কাজ যা মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এবং একটি ঐতিহ্যবাহী সমাজে নারীদের মুখোমুখি হওয়া সংগ্রামকে চিত্রিত করার জন্য শরৎচন্দ্রের প্রতিভা প্রদর্শন করে। এটি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হিসাবে রয়ে গেছে এবং লিঙ্গ সমতা এবং সামাজিক সংস্কারের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হতে চলেছে।
1

এক

27 October 2023
0
0
0

মেজমাসীমা, মা মহাপ্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন ধরো। - কে রে, অতুল ? আয় বাবা, আয়, বলিয়া দুর্গামণি রান্নাঘর হইতে বাহির হইলেন। অতুল প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা গ্রহণ করিল । নীরোগ হও বাবা, দীর্ঘজীবী হও। ওরে ও জ

2

দুই

27 October 2023
0
0
0

বড়ভাই গোলকনাথ মারা গেলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বর্ণমঞ্জরী নির্বংশ পিতৃকুলের যৎসামা বিষয় আশয় বিক্রয় করিয়া হাতে কিছু নগদ পুঁজি করিয়া কনিষ্ঠ দেবর অনাথনাথকেই আশ্রয় করিয়াছিলেন। তাহারই বিষের অসহ্য জ্ব

3

তিন

27 October 2023
0
0
0

ছোটভাই অনাথকে বাধ্য হইয়া প্রাঙ্গণের প্রাচীরে একটা দ্বারা ফুটাইতে হইল। অগ্রজের শ্রাদ্ধ-শান্তি হইয়া গেলে পনর-ষোল দিন পরে একদিন তিনি অফিসে যাইবার মুখে চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বলিলেন,

4

চার

27 October 2023
0
0
0

এগার বৎসর পরে দুর্গামণি হরিপালের বাপের ভিটায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন শরতের সন্ধ্যা এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর ঝাপসা ধুয়া লইয়া সমস্ত প্রামখানার উপর হুমড়ি খাইয়া বসিয়াছিল যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ করিবা

5

পাঁচ

27 October 2023
1
0
0

প্রথম অগ্রহায়ণের শীতের বাতাস বহিতেছিল। দুর্গার এক ছেলেবেলার সাথী বাপের বাড়ি আসিয়াছিল। আজ দুপুরবেলা মেয়েকে একটু ভাল দেখিয়া দুর্গা তাহার সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়াছিল। পথে ডাক-পিয়নের সাক্ষাৎ পাইয

6

ছয়

28 October 2023
1
0
0

সংবাদ দিবার প্রয়োজন ছিল না বলিয়াই দুর্গা চিঠি না লিখিয়াই আসিয়াছিলেন। জ্ঞানদার চেহারা দেখিয়া জ্যাঠাইমা হাসিয়াই খুনগুলো ওগেনি, গালদুটো তোর চড়িয়ে ভেঙ্গে দিলে কে লো মা কি ঘেন্না। মাথায় টাক পড়ল ক

7

সাত

28 October 2023
0
0
0

আজকাল ধরিয়া না তুলিলে দুর্গা প্রায় উঠিতেই পারিতেন না। মেয়ে ছাড়া তাঁহার কোন উপায়ই ছিল না। তাই সহস্র কর্মের মধ্যেও জ্ঞানদা যখন-তখন ঘরে ঢুকিয়া মায়ের কাছে বসিত। আজিকার সকালেও একটুখানি ফাঁক পাইয়া,

8

আট

28 October 2023
0
0
0

মাধুরী শিশুকাল হইতেই কলিকাতায় মামার বাড়ি থাকে। মহাকালী পাঠশালায় পড়ে । ইংরাজী, বাংলা, সংস্কৃত শিখিয়াছে। গাহিতে বাজাইতে, কার্পেট বুনিতেও জানে, আবার শিব গড়িতে, স্তোত্র আওড়াইতেও পারে। দেখিতেও অতিশয়

9

নয়

28 October 2023
0
0
0

চৈত্রের শেষ কয়টা দিন বলিয়া ছোটবৌয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই। মাসটা শেষ হইতেই তাহার ছোটভাই তাহাকে এবং মাধুরীকে লইবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ ভাল দিন খাওয়াদাওয়ার পরেই যাত্রার সময়। অতুল বাড

10

দশ

28 October 2023
0
0
0

দুর্গার এমন অবস্থা যে, কখন কি ঘটে বলা যায় না। তাহার উপর যখন তিনি পাড়ার সর্বশাস্ত্রদশী প্রবীণাদের মুখে শুনিলেন, তাহার প্রাপ্তবয়স্কা অলা কন্যা শুধু যে পিতৃপুরুষদিগেরই দিন দিন অধোপতি করিতেছে তাহা নাহে

---