বড়ভাই গোলকনাথ মারা গেলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বর্ণমঞ্জরী নির্বংশ পিতৃকুলের যৎসামা বিষয় আশয় বিক্রয় করিয়া হাতে কিছু নগদ পুঁজি করিয়া কনিষ্ঠ দেবর অনাথনাথকেই আশ্রয় করিয়াছিলেন। তাহারই বিষের অসহ্য জ্বালায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হইয়া মেজভাই প্রিয়নাথ গত বৎসর ঠিক এমনি দিনে ছোটভাই অনাথের সঙ্গে বিবাদ করিয়া উঠানের মাঝখানে একটা প্রাচীর তুলিয়া দিয়া পৃথগন্ন হইয়াছিলেন এবং মাঝখানে একটা কবাট রাখার পর্যন্ত প্রয়োজন অনুভব করেন নাই, তখন রঙ্গ দেখিয়া বিধাতাপুষ নিশ্চয়ই অলক্ষ্যে বসিয়া হাসিতেছিলেন। কারণ, একটা বৎসরও কাটিল না প্রাচীরের সমস্ত উদ্দেশ্য নিষ্ফল করিয়া দিয়া, সেদিন প্রিয়নাথ সাতদিনের জ্বরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করিলেন।
মৃত্যুর আগের দিনটায় মরণ সম্বন্ধে যখন আর কোথাও বিন্দুমাত্র অনিশ্চয়তা ছিল না, এবং তাই দেখিতে সমস্ত গ্রামের লোক পিলপিল করিয়া বাড়ি ঢুকিয়া, ঘরের দরজার সম্মুখে ভিড়ন করিয়া দাঁড়াইয়া অস্ফুট কলকণ্ঠে হা-হুতাশ করিতেছিল, তখনও প্রিয়নাথের একেবারে সংজ্ঞা লোপ হয় নাই। অতুল নামে ছিল না। কলিকাতার মেসে ওই দুঃসংবাদ পাইয়া আজ ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। ভিড় ঠেলিয়া যখন সে রোগীর ঘরে ঢুকিবার চেষ্টা করিতেছিল, কোথা হইদে জ্ঞানদা পাপলের মত আছাড় খাইয়া পড়িয়া তাহার দুই পায়ের উপর মাথা কুটিতে লাগিল। যাহারা তামাশা দেখিতে আসিয়াছিল, তাহারা এই আর একটা অভাবনীয় ফাউ পাইয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া মনে মনে বিতর্ক করিতে লাগিল, কিন্তু অতুল এত লোকের সমক্ষে দুঃখে লজ্জায় হতবুদ্ধি হইয়া গেল।
ক্ষণেক পরে যখন সে কিঞ্চিত প্রকৃতিস্থ হইয়া তাহাকে ধরিয়া তুলিতে গেল, তখন জ্ঞানদা জোর করিয়া পায়ের উপর মুখ চাপিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, বাবার মরণকালে তুমি নিজের মুখে তাঁকে একটা সান্ত্বনা দিয়ে যাও আমার অদৃষ্টে পরে যাই থাক এ সময় আমার মতন আমার ভাবনাটাকেও যেন তিনি এইখানেই ফেলে রেখে যেতে পারেন আর তোমার কাছে আমি কখন কিছু চাইব না। বলিয়া তেমনি করিয়াই মাথা খুঁড়িয়া কাঁদিতে লালি । তাহার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দুর্ভাপা পিতা অত্যন্ত অসময়ে অকালে মরিতেছে- আজ আর তাহার কান্তজ্ঞান ছিল না এত লোকের সম্মুখে কি করিতেছে, কি বলিতেছে, কিছুই ভাবিয়া দেখিল না, - ক্রমাগত একভাবে মাথা খুঁড়িতে লাগিল। কিন্তু অতুল সংখনী লোক। জ্ঞানদার এই ব্যাবহারে অন্তরে সে যত ক্লেশই অনুভব করুক, বাহিরে এতগুলি কৌতূহলী চক্ষের উপর কঠিন হইয়া উঠিল। জোর করিয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া মৃদু তিরষ্কারের স্বরে কহিল, ছি, শান্ত হও, কান্নাকাটি করো না - আমার যা বলবার আমি তা বলব বৈ কি। বলিয়া মুমূর্ষুর শয্যার একাংশে গিয়া উপবেশন করিল। দুর্গামণী স্বামীর শিয়রে বসিয়াছিলেন, অতুলের মুখের পানে চাহিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিলেন।
প্রতিবেশী নীলকণ্ঠ চাটুয়ো দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া ছিলেন, অতুলের বিলম্ব দেখিয়া কহিলেন, প্রিয়নাথের এখনো একটু জ্ঞান আছে বাবা, যা বলবে, এইবেলা বেশ চেঁচিয়ে বল তা হলেই বুঝতে পারবে। বলাবাহুল্য, বৃদ্ধের এই প্রস্তাব আরও দুই একজন তৎক্ষণাৎ অনুমোদন করিল।
জনতা দেখিয়া অতুল প্রথমেই ক্রুদ্ধ হইয়াছিল, তাহার উপর ইহাদের এই নিতান্ত অশোভন কৌতূহলে সে মনে মনে আগুন হইয়া কহিল, আপনারা নিরর্থক ভিড় করে থেকে ত কোন উপকার করতে পারবেন না, একটুখানি বাহিরে গিয়ে বসলেই আমরা যা বলবার বলতে পারি। নীলকণ্ঠ চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, নিরর্থক কি হে? প্রতিবেশীর বিপদে প্রতিবেশীই এসে থাকে। তুমি কোন সার্থক উপকার করতে বিছানায় গিয়ে বসেচ বাপু : অতুল উঠিয়া দাঁড়াইয়া দৃঢ় স্বরে কহিল, আমি উপকার করি না করি, আপনাদের এমন করে বাতাস আটকে অপকার করতে আমি দেব না। সবাই বাইরে যান।
তাহার ভাব দেখিয়া নীলকণ্ঠ দু'পা পিছাইয়া দাড়াইয়া কহিলেন, সেদিনকার ছোকরা - তোমার ত বড় আম্পর্ণ দেখি হে। কে একজন তাহার আড়ালে দাঁড়াইয়া কহিল, এল.এ. বি.এ. পাশ করেছে কিনা। একটা দশ-বার বছরের ছোঁড়া উকি মারিতেছিল। অতুল কাহারও কথার কোন জবাব না দিয়া তাহাকে ঠেলিয়া দিল। সে গিয়া আর একজনের গায়ে পড়িল । যাহার গায়ে পড়িল, সে অস্ফুটস্বরে গাজালার ব্যাটা প্রভৃতি বলিতে বলিতে বাহিরে চলিয়া গেল প্রভৃতি ভদ্রলোক অতুলের কথাটা শুনিবার বিশেষ কোন আশা না দেখিয়া মনে মনে শাসাইয়া প্রস্থান করিলেন।
যখন বাহিরের লোক আর কেহ রহিল না, তখন অতুল মুমূর্ষুর মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া ডাকিল, মেসোমশাই। প্রিয়নাথ রক্তবর্ণ চক্ষু মেলিয়া মৃতের মত চাহিয়া রহিলেন। অতুল পুনরায় উচ্চকণ্ঠে কহিল, আমাকে চিনতে পাচ্ছেন কি? প্রিয়নাথ চক্ষু মুদিয়া অঙ্কুটে বলিলেন,
এখন কেমন আছেন ?
প্রিয়নাথ মাথা নাড়িয়া তেমনি অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, ভাল না ।
অতুলের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া অশ্রদ্ধ কন্ঠ পরিষ্কার করিয়া কহিল, মেসোমশাই, একটা কথা আপনাকে জানাচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত হোন- আজ থেকে জ্ঞানদার ভার আমি নিলুম। প্রিয়নাথ কথাটা বুঝিতে পারিলেন না। এদিকে- ওদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, কৈ, জ্ঞানদা ?
দুর্গামণী স্বামীর মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া অশ্রুবিকৃত রোদনের কণ্ঠে বলিলেন, একবার দেখবে জ্ঞানদাকে ? প্রিয়নাথ প্রথমটা জবাব দিলেন না শেষে বলিলেন, না।
দুর্গামণী কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, অতুল কি বলচে, শুনেছ ? সে তোমার জ্ঞানদার ভার নিতে এসেচে। আর তুমি ভেবো না হতভাগীকে অনেক গালমন্দ করেছ, আজ একবার ডেকে আশীর্বাদ করে যাও।
প্রিয়নাথ চুপ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। দুর্গামণী আবার সেই কথা আবৃত্তি করার পর, তাহার চোখ দিয়া দু'ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল। অক্ষম হাতখানি অনেক কষ্টে তুলিয়া, অতুলের কপালে একবার স্পর্শ করাইয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন। তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথাই বাহির হইল না বটে, কিন্তু এই আপরকালে তাঁহার হৃদয়ের একটা অতি গুরুভার নিঃসংশয়ে ভুলিয়া ফেলিতে পারিয়াছে অনুভব করিয়া অতুল অকস্মাৎ বালকের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিয়া ফেলিন। সাক্ষী রহিলেন শুধু দুর্গামণী আর ভগবান।
পরদিন সায়াহ্নকালে, শতকরা আশীজন ভদ্র বাঙ্গালী যাহা করে, প্রিয়নাথও তাহাই করিলেন। অর্থাৎ, অফিসের ত্রিশ ঢাকা চাকরি মায়া কাটাইয়া, ছাব্বিশ বৎসরের বিধবা ও রে বৎসরের অনুঢ়া কন্যার বোঝা তদপেক্ষা কোন এক দূর্ভাগ আত্মীয়ের মাথায় তুলিয়া দিয়া, ছত্রিশ বৎসর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ছিয়াশী বৎসরের সমতুল্য একটা জীর্ণ কঙ্কালসার দেহ তুলসীবেদীমূলে পরিত্যাগ করিয়া গঙ্গানারায়ণ ব্রাহ্ম নাম শুনিতে শুনিতে বোধ করি বা হিন্দু বিষ্ণুলোকেই গেলেন।