আজকাল ধরিয়া না তুলিলে দুর্গা প্রায় উঠিতেই পারিতেন না। মেয়ে ছাড়া তাঁহার কোন উপায়ই ছিল না। তাই সহস্র কর্মের মধ্যেও জ্ঞানদা যখন-তখন ঘরে ঢুকিয়া মায়ের কাছে বসিত। আজিকার সকালেও একটুখানি ফাঁক পাইয়া, কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে মায়ের পিঠে হাত বুলাইয়া দিতেছিল। সহসা একটা অত্যন্ত সুপরিচিত কণ্ঠস্বরে তাহার বুকের ভেতর ধক করিয়া উঠিল ৷
দোলের দিন। ছুটির বন্ধে অতুল বাড়ি আসিয়াছিল। দুই-তিনজন পাড়ার সঙ্গী লইয়া 8 মাখিয়া পকেটে ভরিয়া আাবীর লইয়া সে 'মাসীমা' বলিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়া বাড়ি ঢুকিল ।
দুর্গা তন্দ্রায় জাগরণে সারাদিন একপ্রকার আচ্ছন্নের মত পড়িয়া থাকিতেন। পাছে কণ্ঠস্বর কানে গেলে না সজাগ হইয়া উঠেন, এই ভয়ে জ্ঞাননা এস্ত হইয়া উঠিল। মনে মনে ইনি যে এই লোকটিরই প্রতীক্ষা করিতেছেন, তাহা সে জানিত। অথচ, তাঁহার সেই স্বাভাবিক ধৈর্য, গাম্ভীর্য, আত্মসম্মান আর যেন ছিল না। বুদ্ধি বিবেচনাও কেমন যেন দ্রুত বিকৃত হইয়া উঠিতেছিল তাহার যে জননী কলহের ছায়া দেখিলেও শঙ্কিত হইতেন, তিনি আকা ইহাতেও যেন বিমুখ নন- সে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। সুতরাং, উভয়ের দেখা হইলেই একটা অত্যন্ত অশোভন কলহ যে অনিবার্য, এ কথা তাহার অন্তর্যামী আজ বলিয়া দিলেন। কি করিলে যে এই বিপদ এড়াইতে পারা যায়, ভাবিয়া সে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। পা-টিপিয়া উঠিয়া সে কম্পটি রুদ্ধ করিতেছিল, মা বলিলেন, জ্ঞানদা ও অতুল কথা কইলে না?
আদা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কি জানি না, তিনি নন বোধ হয়।
হাঁ, সেই বৈ কি। উঠে একবার দেখ দিকি।
তর্ক করিলেই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিবেন তাহা সে জানিত, তাই ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া উকি মারিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু দেখা গেল না। শুধু বারান্দার ওধারে অনেকের মধ্যে তাঁহারও কণ্ঠস্বর তাহার কানে গেল। এইটুকু খবর লইয়াই সে ফিরিতে পারিত, কিন্তু হইতে একবার তাঁহার মুখখানি দেখিয়া লইবার লোভ তাহাকে যেন ঠেলিয়া লইয়া গেল। সে নিঃশব্দে আগাইয়া আসিয়া একটা থামের আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিল, তিনি বড়মাসীর পায়ের উপর মুঠা করিয়া আবীর দিয়া হাসিতেছেন। পাড়ার ছেলেরও দেখাদেখি তাহাই করিতেছে।
ছোটবৌ ছিল না। একটা ব্যথার মত হওয়াতে আজ সে ঘর ছাড়িয়া বাহির হয় নাই। ফিরিবে ফিরিবে করিয়াও নিজের অজ্ঞাতসারে বোধ করি জ্ঞানদার একটু বিলম্ব ঘটিয়াছিল, অকস্মাৎ বদ্ধাহতপায় হইয়া দেখিল, সে যে ভয় করিয়াছিল ঠিক তাই, - মা হেলিয়া দুলিয়া সেইদিকে চলিয়াছেন।
ছুটিয়া পিয়া দুই বাহু দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ব্যাকুল কণ্ঠে কহিল, যেয়ো না মা, ফেরো।
দুর্গা চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, কেন কেন, জানিনে মা, তুমি ফেরো। তার ৩ কোন আশাই নেই মা -আমাকে ছাড় হতভাগী ছেড়ে দে বলিয়া অমানুষিক বলে দুর্গা নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া অগ্রসর হইয়া গেলেন। জ্ঞানদ কলের পুতুলের মত তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া পিছনে গিয়া দাড়াইল। সবাই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া দেখিল- মেজবৌ ।
তাঁহার সেই কঙ্কালসার মুখমণ্ডল ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের দৃষ্টি ছিল। সে দুটা ভুলত চক্ষুর গানে চাহিয়া অতুল সভয়ে দৃষ্টি অবনত করিল।
দুর্গা বলিলেন, অতুল, আমরা তোমার কি করেছিলাম যে, এমন করে আমাদের সর্বনাশ করলে ?
অল জবাব দিবে কি, অপরাধের ভারে ঘাড় তুলিতেই পারি না।
সেই কাজটা করিলেন স্বর্ণ। হৃদয় বলিয়া তাহার ত কোন বালাই ছিল না, তাই অতি সহজেই মুখ তুলিয়া কহিলেন , কেন, কি সর্বনাশ করেছে শুনি দুর্গা বলিলেন, তোমাকে তার কি জবাব দেব, দিদি যাকে কলটি সেই জানে সে কি করেছে।
স্বর্ণ কহিলেন, আমরাও ঘাস খাইনে মেজবৌ, কিন্তু, ও কি তোমার মেয়েকে বিয়ে করবে বলে লেখাপড়া করে দিয়েছিল যে, এত লোকের মাঝখানে তেড়ে এসেচ। যাও, ঘরে যাও - পাল-পার্বণ আমোদ-আহ্লাদের দিনে আমার বাড়িতে বসে অনাছিষ্টি কাও ক'রো না ।
অনাছিষ্টি কাণ্ড আমি করতে আসিনি দিদি। বলিয়া অতুলের পানে চাহিয়া বলিলেন, যে করে আমাদের এই একটা বছর কেটেছে অতুল, সে তুমি জান না কিন্তু ভগবান জানেন । কিন্তু, এই যদি তোমার মনে ছিল, কেন তাঁর কালে আশা দিয়েছিলে ? কেন তুমি তখনি জানালে না স্বর্ণ রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, বাছাকে তুমি ভগবান দেখিয়ো না বলচি, মেজবৌ ভাল হবে। না। আমরা বেঁচে থাকতে কথা দেবার কর্তা ও নয়।
এত লোকের সমক্ষে অতুল নিজেকে অপমানিত বোধ করিতেছিল, মাসীর জোর পাইয়া কহিল, আমি কি নিজে বিয়ে করব বলে কথা দিয়েছিলাম আমার পা ছাড়ে না - পায়ের উপর মাথা খুঁড়তে লাগল বাবাকে নিজের মুখের কথা দাও করি কি অত লোকের সামনে আমি লজ্জায় বাঁচিনে তাই পা ছাড়াবার জন্যে যদি একটা কৌশল করে থাকি, তাকে কি কথা দেওয়া বলে স্বর্ণ খিলখিল করিয়া হাসিয়া কহিলেন, ওমা কি ঘেন্নার কথা অতুল, তুই বলিস কি রে ভুঁড়ি নিজে পায়ে ধরে বলে- আমায় বিয়ে কর ? অ্যা অতুল কহিল, সত্যি কিনা, ওঁকেই জিজ্ঞাসা কর না। মেজমাসীমা নিজেই বলুন না আমার পায়ের উপর মাথা খুঁড়তে দেখেছিল কিনা। নইলে ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করতে যাব আমার কি মরবার দড়ি-কলসী জোটে না ?
অতুলের সঙ্গীরা মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া উঠিল। দুর্গা উন্মাদের মত চেঁচাইয়া উঠিলেন, ওরে নিষ্ঠুর। ওরে কৃতঘ্ন। দড়ি-কলসী আমি কিনে দেব রে, তুই মর পে, তোর মরাই উচিত। যে মেয়েকে তুই এত লোকের সুমুখে এতবড় অপমান করলি, সেই মেয়েই যে তোকে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল সে। সব ভুলে গেলি?
চীৎকার শুনিয়া ছোটবৌ ব্যথা ভুলিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিল, স্বর্ণ লাফাইয়া উঠিয়াছে - তবে লো হতভাগী। বেরো আমার বাড়ি থেকে বেরো বলছি।
জ্ঞানদা দাঁড়াইয়া ছিল। কিন্তু সে অচেতন পাথর হইয়া গিয়াছিল। লজ্জা, ঘৃণা, অভিমান, অপমান, ভালমন্দ কিছুই তাহাকে স্পর্শ করিতেছিল না। এ সমস্তরই যেন সে একান্ত অতীত হইয়াই নীরবে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া দাড়াইয়াছিল। এই অদৃষ্টপূর্ব মূর্তির পতি চাহিয়া ছোটাবী সভয়ে একটা ঠেলা দিয়া ডাকিল, জ্ঞানদা ? সে ঘরের ভিতর হইতেই কলহের কিছু কিছু শুনিতে পাইয়াছিল।
জ্ঞানদা জবাব দিল, কেন খুড়ীমা আর কেন দাড়িয়ে মা, তোর মাকে ঘরে নিয়ে যা মা চল, বলিয়া মায়ের হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে তাঁহাকে ঘরে লইয়া গেল। স্বর্ণ কহিলেন, দেখালি ছোটৰো, আম্পর্ণা। একেই বলে, বামন হয়ে চাঁদে হাত। অতুল হাসিবার মত করিয়া দাঁত বাহির করিয়া কহিল, ওনালেন ছোটমাসীমা কাটা কি 'ভয়ানক লজ্জা।
স্বর্ণ খনখন করিয়া বলিলেন, একফোঁটা মেয়ে, - এ কি ঘোর কলি। ছোটবৌ একটুখানি হাসিয়া কহিল, ঘোর কলি বলেই বাঁচোয়া দিদি। নইলে আর কোন কাল হলে, না বসুন্ধরা এতক্ষণ লজ্জায় দুফাক হয়ে যেতেন অতুল। বলিয়া ঘরে চলিয়া গেল।
স্বর্ণ বিদ্রূপের তাৎপর্য না বুঝিয়া খুশী হইয়া বলিলেন, সেই কথাই ত বলছি ছোটবৌ- কিন্তু অতুলের মুখ কালো হইয়া উঠিল। ছোটবৌয়ের কথার তাৎপর্য স্বর্ণ না বুঝিলেও সে বুঝিয়াছিল। তাই খানিকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিয়া যখন সে উঠিয়া গেল, তখন মনে হইল, এই হোলির দিনে কে যেন তাহার জামার কাপড়ে লাল রঙ এবং মুখে পাঢ় কালি লেপিয়া দিয়াছে।
আসল কথাটা এতদিন অপ্রকাশ ছিল বটে, কিন্তু আর রহিল না। পাড়ার হিতাকাঙ্খিণীদের কথায় অচিরেই দুর্গার কানে গেল যে, এই বড়িতেই অতুল আবদ্ধ হইয়াছে অনাথেরই বড় মেয়ে মাধুরীর সঙ্গেই তাহার বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে। ঘটকালি স্বর্ণা করিয়াছেন এবং মেয়ে দেখিয়া অতুলের ভারী পছন্দ হইয়াছে ।