জন্মেই শুরু করলে ছেলেটি কান্না-উ-এঁ-৩-৩-৩, সে কান্না আর থামে না।
'ও ছেলের মা, দুধ দাও গো ভুখ লেগেছে, ছেলে যে গেল!' দুধ টেনে খায় ছাওয়াল চোঁ-চোঁ, পেট ভরে, তারপর আবার শুরু ৩-৩। মা বলে, 'বুকে যে দুধ নেই বাবা, আর কি খাবা? বলি গাই-দুধ কোথা পাব, বাঘের দুধ আনি খাওয়াব? ও ছাগলির মা, যা তো বনে, দেখ তো বাঘিনী বিয়াল ক'নে!'
মা ছড়া কাটে, ছেলে তো ভালো না। ৩-৬ কেঁদেই চলে, ভুলে না। এ পহর ও পহর কাঁদছে তো কাঁদছেই।
ছেলের কান্নায় পাড়ার লোক অস্থির। 'বলি ও ছেলের মা, তোমার ছেলেকে হয় দানায় পেয়েছে, না তো কিছু রোগে ধরেছে বাপু! নজুম ডাকাও, হকিম আনাও, ঝাড়-ফোঁক করুক, দাবাই পেলাক, ছেলে ঘুমাক, পাড়া জুড়াক।'
নজুম ডাকাতে হকিম আনাতে হাতের খাড় বিকিয়ে যায়। হকিমের হিকমত হয় না, কাঁদুনি থামা দেয় না ছেলে। ঙ-ঙ বলতে বলতে ছেলের বুলি ফুটল।
মা বলে, 'বাবা, বড় হলে, তবু এখনও কাঁদ কেন অমন করে? পাড়ার লোক যে রাগ করে!'
ছেলে বলে, 'কাঁদি কি সাধে। পাড়াপড়শির জন্যেই তো কাঁদি। এরা যে বুঝছে না-গজব পড়ল বলে, তুফান এল বলে। এইবেলা সাবধান হওয়া চাই, সময় থাকতে উপায় ঠাওরাবে রক্ষের, তা না হেসে খেলে বেড়াচ্ছে নির্ভাবনায় সবাই।'
'ওমা, ওগো ও পড়শিরা, ছেলে বলে কি শোন।'
'ও ছেলের মা, তুই শোন।
তুফানের কথা শুনে শুনে আমাদের কান পচে গেছে। এখন ভাল চাও তো ছেলেকে কি আর বলি! হকিমও হয়েছে যেমন নজ্জমও হয়েছে তেমন। তুফানের ভয় ঢুকিয়ে গেছে, ছেলে এখন তুফানই তুলছে, আর থেকে থেকে চিল্লিয়ে পাড়া মাত করছে।'
ছেলে বড় হয়। এখন আর কাঁদে না-রুন্দন করে। আরো বড় হয়ে তখন বিলাপ করে।
পড়শিরা বলে, 'ও ছেলের মা, ছেলের মা, আর দেখ কি, এইবার প্রলাপ শুরু হলেই হল। দিন থাকতে ছেলের বিয়েটি দিয়ে ওকে বউয়ের জিন্মে করে তুমি ভেক নিয়ে বেরিয়ে পড়-না হলে ভোগান্তি আছে কপালে।'
তা করল কি? জুটিয়ে দিলে ছিঁচকাঁদুনি একটা মেয়ে পাড়ার পাঁচজনে, হয়ে গেল বিয়ে। ছেলের মা একচোথে হাসে, একচোথে কাঁদে আর বলে, 'বউ তুমি রইলে, পাড়ার পাঁচজনা তোমরা রইলে, আমি চললুম টুকরি হাতে পাড়া ছেড়ে।
আমার ঘরও রইল দুয়ারও রইল
আমি চললেম থালি হয়ে বরাহনগর কাশীপুর হাবড়া শালকে বালি।' বুড়ি ভেখ নিয়ে বেরোতে চায়, কচি বউ কাঁদে ৩-৩, মনে পড়ে যায় কোলের ছেলের কান্না, যাওয়া হয় না ভেক নিয়ে বেরিয়ে।
'বলি ও ছেলের মা, বসে আছ যে, যাচ্ছ কবে গুনি!
'আর যাওয়া! যে বউ করে দিয়েছ তোমরা, দুয়ারের চৌকাট পাড়াতে গেলেই কান্না ধরে।'
'আহা কাঁদুক গো কাঁদুক, কাঁদবে না, বল কি! কচি মেয়ে গয়ের ঘর করতে। এসেছে-'
'তাই তো ভাবি গো, পড়শিরা, কোন্ চুলোয় যাব আর! বসে থাকি ঘরে বউ আগলে।' 'তোমার বেটা কি করছেন আজকাল?'
'সে গেছে ঐ জঙ্গলে কর্পূর গাছ কেটে আনতে।'
'কেন গো, কর্তৃর কাঠের খোঁটা দিয়ে ঘর তুলবে, না তক্তা চেলে সিন্দুক গড়বে?'
'কি জানি ভাই, অধোলে বলে কর্পূর কাঠে একটা কিস্তি বানাবে। তুফান যেদিন আসবে, সেদিন জরু গরু সবাইকে নিয়ে ভেসে পড়বে, গ্রামখানা ডোবার আগে।'
'তুফান রোগ এখনো ছাড়েনি তাহলে! বল তোমার ছেলেকে ডাঙায় কিস্তি চালাবার মতলব ছাড়ুক। এখন থেকে ঐ পাহাড়ের টু'টিতে একখানা বড় দেখে ঘর বাঁধুক-তুফান এলে আমরা সবাই সেখানে গিয়ে উঠব।'
'তাই বলে দেখব, যদি রাজি হয়!'
'যাই বল ছেলের মা, ঐ তুফানেই দেখবে শেষে তলাবে তোমরা সবাই।'
'তুফানের তো এখনো দেরি আছে-দেখি এর মধ্যে যদি ছেলের সুবুদ্ধি জোগায়।'
'জোগাবে গো জোগাবে, সময় কালে জোগাবে, যেমন জুগিয়ে থাকে অনেকেরই।'
'যদি না জোগায় ভাই-তবে উপায় কি?'
'নিরুপায়ে উপায় রুপায়-রূপোর তাবিজটা বাঁধা দিয়ে নোয়ার বালা একটা কষে দাও ছেলের হাতে,-দেখবে কিস্তিমাতের বেলায় ফল পাবে।'
'আমাদের তেনারই মত।'
এমনি তেনার মত করতে করতে তাবিজ, পঁইচি, হাঁসুলি, মাদুলি সব গেল ছিচকাঁপুনি বউটার। রইল ঘরের চারখানা ফুটো চাল, মেঝের ছেঁড়া মাদুর আর হেঁসেলের চুলোটা হাঁ করে-তার মধ্যে বেঁধেছে উইচিংড়িকটা বাসা। উঠানের কোণে মশলা বাটা শিল বুকে নোড়া চাপিয়ে, আর কুয়োতলায় ফুটো ঘটটি গলায় ফাঁসি দেবার দড়ি আগলে।
সেইকালে অকাল পড়ল দেশে, আকাশ ছিল নীল, হয়ে উঠল ঘোর কালো। শুকতারা সন্ধ্যাতারা মিটি-মিটি করে যেন নিভতে চায় বাতাসে। হাওয়া সুর ফেরায়, ফুল ফোটানোর দিন আর আসে না। ঝড়ে কাত হয়ে পড়ে ফুলের গাছ, মচকে যায় ফুলের ডাল। ছচিমন্ডি হয়ে যায় সারা মালঞ্চ।
রাতের আকাশে চাঁদ উঠে না, বিদ্যুৎ খেলে। দিনের আকাশে পড়ে থেকে থেকে বাজ। শুকনো কুয়ো ঘিরে ব্যাঙগুলো ডাকে গজব বড়-গড় বড়-জড় নাই-জড় নাই। মুশকিল আসান, মুশকিল আসান রব তোলে পাড়া। সুরে ডাকে দিনে দুপুরে শ্যালগুলো। সেইকালে কি হল-বুড়িকে ডাক দিলে স্বপনে এসে তার ছেলে, 'চলে এস, চলে এস।'
শুনল সে কানেকালা বুড়ি, ছানিপড়া দুচোখ মেলে দেখলে স্পষ্ট-কর্পূর কাঠের নৌকো বেয়ে আসছে তার ছেলে, প্রচণ্ড তুফানের উপর দিয়ে আসছে কিস্তি, সাদা পাল তুলে, দুধের ফেনা কেটে কেটে দুলতে দুলতে-দুলতে দুলতে বান এসেছে জলে কত চাঁদ ভেসেছে।
এই দেখতে দেখতে রাতের ঘোর কেটে যেতেই বুড়ি পেলে কপূর-বাস হাওয়ার পরশ, শুনলে একটি কথা, 'মা'!
শরীর বুড়ির শীতল হয়ে গেল-মন ঠাণ্ডা হল।
আরামের নিম্নাস ফেলে বুড়ি বললে, 'এলি বাপ আমার!'
শেষ হল বুড়ির দুঃখ ভাবনা ভয় সব। ভেসে গেল সেইকালে ঠুকরি গ্রাম-বানে।