পুবের পাখি তারা বাসা বেঁধে থাকে মলয় দ্বীপে চন্দন বনে। বঝাঁক বেঁধে ওড়ে পুব আকাশে সোনার আলোয়। ধান-ক্ষেতের কচি সবুজ মেখে নিয়ে সবুজ হল তাদের ডানা, হিঙ্গুল ফলের কম লেগে হল রাঙা তাদের ঠোঁট।
তার একটি পাখি একদিন ধরা পড়ল। সওদাগর তাকে জাহাজে করে নিয়ে গেল, উদয়াচল ঘুরে পশ্চিম সাগর পার হয়ে আজব সহরে। সেখানে সবুজ নেই-কেবল বাড়ি, কেবল বাড়ি! ইট, কাঠ, চুন, সুরকি, কলকারখানা, ধুয়া, ধুলো আর কুয়াসায় দিকবিদিক আকাশ বাতাস পর্যন্ত ঢাকা, দিন রাত্রি সমান অন্ধকার। আলোগুলো যেন সেখানে জ্বলছে না। কুয়াসায় ভিজে কম্বলমুড়ি দিয়ে রাস্তার ধারে বসে সে জ্বরে কাঁপছে। সূর্যের রথ সহরের পাঁচিলে এসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় সহর ছেড়ে। মলয় বাতাস দুয়োরের কপাট ধরে নাড়া দিয়ে দেখে কিন্তু ঘর খোলা পায় না কোনদিন।
সবুজ পাখি সেখানে খাঁচায় রইল--- কালো লোহার শক্ত খাঁচা-কলের কুলুপে চাবি- দেওয়া খাঁচা। খায় দায় পাখি, থেকে-থেকে কুলুপ নাড়া দেয়। কুলুপ নড়ে চড়ে কিন্তু খোলে না। কল-ঘরের এক কোণে পাখির খাঁচা---কলের ধুয়া থেকে ভুষো ছিটিয়ে যায় তার গায়ে, সবুজ পাখনা কালো হয় দিনে দিনে। পাখি সেখানে থাকে মনের দুঃখে, শুনতে শুনতে শেখে সব খটোমটো বুলি, যেন লোহার কলের খটখটাং। তাই শুনতে লোক জড়ো হয়। সেই কলের ছাই-ভস্ম- মাখা পাখনা দেখে অবাক হয়ে যায়-এ কী আশ্চর্য পাখি! নাচতে পারে, গাইতে পারে, বলতে পারে, কইতে পারে, পড়তেও পারে!
পাখি সে থেকে থেকে নিজের কথা চেঁচিয়ে বলে, 'ওরে উড়তে পারিনে রে, উড়তে পারিনে-- বেঁচে আমি মরে আছি!' থেকে-থেকে রাগ করে গা-ঝাড়া দেয়-লোকে তার মনের কথা বোঝে না, তামাসা দেখে হাসে, হাততালি দেয়। আজব সহরের মানুষ তারা, কেউ বোঝে না মলয় দ্বীপের গাখির কী দুঃখ। তার দুঃখটা বোঝে শুধু ভোরের আলো। সে কোনদিন কুয়াসা সরিয়ে কারখানা-ঘরের কোণটিতে এসে দেখা দেয়, সবুজ পাখির গায়ে হাত বোলায়। ভয়ে-ভয়ে আসে আলো, ভয়ে-ওয়ে সরে যায়। পাখি বলে, 'যদি কোনদিন সিন্ধু-পারে যাও হে আলো, তবে ভুলো না, মলয় দ্বীপের সবুজ ঘরে আমার খবর পৌছে দিও। বোলো আমি বেঁচে মরে আছি!'
আলো বলে, 'যেদিন আমি বড় হয়ে উঠব সেদিন নিশ্চয় নিশ্চয় তোমার কথা তোমার আপনার লোকের কাছে জানিয়ে আসব।'
শীত কাটল, পরিষ্কার হল দিনে দিনে আকাশ, আলোর তেজ বেড়েই চলল। আর সে ভয়ে-ভয়ে আসে না। অন্ধকারের ঘরে আসে রানীর মতো চারিদিক আলো করে, কারখানার কলকব্জা ঝকঝক করতে থাকে আলো পেয়ে।
পাখি আলো-মাখা ডানা কাঁপিয়ে বলে, 'আর কেন, এইবার।'
আলো বলে, 'থাকো থাকো, আজ রাতের শেষে খবর পাবে!'
খাঁচার পাখি ছট্ফট্ করে-সকাল কখন হয় তারই আশায়।
সেদিন ভোরের বেলায় কলের খাঁচায় ধরা ক্লান্ত পাখি ঘুমিয়ে গেল---সেই সময় কারখানার বাঁশি ডাক দিল কুলিদের।
পাখির কাছে আলো এসে বললে চুপি চুপি, 'মলয় দ্বীপে গিয়েছিলেম, তাদের তোমার দুঃখের খবর দিলেম।'
পাখি ঘুমন্ত চোখ একটু খুলে শুধোলো, 'তারা কী বলে পাঠালে শুনি?'
আলো খাঁচার মধ্যে এগিয়ে এসে বললে, 'সবাই আহা করলে, কেবল একটি পাখি সে যেমন ছিল তেমনই রইল।'
পাখির ঘাড় তুলে বললে, তারপর?'
আলো তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, 'তারপর সে ঝরা-পাতার মতো গাছের তলায় লুটিয়ে পড়ল ধুলোতে, আর সবাই বললে, 'আহা মরে বাঁচল রে!'
খাঁচার পাখি আর কোন সাড়া দিলে না।
কল-ঘরের কল চলল বেজে-খটখটাং।
যার পাখি সে খাঁচার কাছে এসে দেখলে-পাখি মরে গেছে, আলো তার উপর পড়ে কাঁদছে।