কারিগর যেখানে থেকে কারিগরি করে সে দেশে কাজ হয় আস্তে আস্তে ধীরে সুস্থে। এতটুকু বীজ যেমন হয়ে ওঠে মস্ত গাছ আস্তে আস্তে, গুটিপোকা যেমন আস্তে ধীরে হয়ে ওঠে রঙিন প্রজাপতি, সেইভাবে কাজ চলে কারিগরি-পাড়ায়। হঠাৎ কিছু হবার জো নেই সেখানে। আর বাজিকর-পাড়ায় যেখানে বাজিকর কারসাজি করে সেখানে সবই অদ্ভুত রকমের হঠাৎ হয়ে যায়। হাউইয়ের পাঁকাটি ফোঁস্ করে আকাশে উঠে ঝর-ঝর করে তারা-বৃষ্টি করে পালায়। লাল বাতি হঠাৎ সবুজ আলো দিয়ে দপ্ করে জ্বলেই নেতে-হয়ত কোথাও কিছু নেই একটা বোমা হাওয়াতে ফাউল আর রাতের আকাশ দিনের সমস্ত জানা অজানা পাখির কিচমিচিতে ভরে গেল।
কারিগরকে কেউ বড়-একটা চেনে না, কিন্তু বাজিকরের নাম ছেলে-বুড়ো রাজা-বাদশা- ফকির সবার মুখেই শোনা যায়। পয়সাও করে বাজিকর যথেষ্ট আজগুবি তামাসা দিখিয়ে। এক সময় রাজসভায় কারিগর আর বাজিকর দুজনেরই কাজ দেখাবার হুকুম হল। যেখানে যত কারিগর যত বাজিকর সবাই যে-যার গুণপনা দেখাতে হাজির আপনার আপনার দলের সর্দারকে নিয়ে। দুই দলের মধ্যে এক মাস তের দিন লড়াই চলেছে, কোন দল জেতেও না হারেও না। ভূত-চতুর্দশীর দিন রাজা দিলেন ছুটি দুই সর্দারকে শেষ হার- জিতের জন্য প্রস্তুত হতে।
ভূত-চতুর্দশীর সারা রাত বাজিকরের ঘরে কারো ঘুম নেই। পঁচিশ গণ্ডা চেলা, তারা লোহাচুর করতে বসে গেল, তাই নিয়ে বাজিকর অদ্ভুত সব বাজি করলে যা কেউ কখনো দেখেনি। তার উপর গাছ-চালা নল-চালা থেকে আরম্ভ করে যা কিছু বিষয় তার ছিল সব একল্প করে সে একটা মস্ত সিন্দুক ভতি করে ভোর না-হতে রাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হল, সঙ্গে পঁচিশ গণ্ডা চেলা, তারা তাল ঠুকে ডিগবাজি করে যেন সভা চমকে তুললে।
রাজা সভা করে বসে আছেন, রানীরা আড়াল থেকে উকি দিতে লেগেছেন। বাজি শুরু হয়, কিন্তু কারিগরের দেখা নেই।
রাজা ব্যস্ত হয়ে বলেন, 'গেল
কোথায়? ' বাজিকর হেসে বলে, 'মহারাজ, সে তার একগণ্ডা চেলা নিয়ে বোধহয় রাতারাতি চম্পট দিয়েছে। অনুমতি দেন তো বাজি কাকে বলে দেখাই!'
বলেই বাজিকর একলাফে আকাশে উঠে হাওয়ার উপর তিন-চারটে পাক খেয়ে ঝুপ করে একেবারে রাজার ঠিক সিংহাসনটা বাঁচিয়ে মাটিতে সোজা এসে দাঁড়ালো। সভার চারিদিকে হাততালি আর সাধুবাদ শুরু হয়ে গেল। সেই সময় বাজিকর বিদ্যের সিন্দুক খুললে। অমনি চরকি বাজির মতো বন-বন্ করে, ছু'চো বাজির মতো চড়-চড় করে বাজির ধূম লেগে গেল এমন যে কারু চোখে মুখে দেখবার বলবার অবসর রইল না। রাজা মহা খুশি হয়ে গজমোতির যালা খুলে বাজিকরকে দেন-এমন সময় কারিগর এসে হাজির হল একলা।
রাজা তাকে দেখে বললেন, 'তুমি কোথায় ছিলে, এমন বাজিটা দেখতে পেলে না।'
কারিগর একটু হেসে বললে, 'এইবার তবে আমার পালা মহারাজ?'
বাজিকর তাকে ধমকে বললে, 'তোমার গালা কি রকম? এতক্ষণ এসে পৌছতে পারো নি, বেলা শেষ হয়েছে, যাও!'
রাজা বাজিকরকে থামিয়ে বললেন, 'না, তা হয় না। সময় আছে, এরই মধ্যে যা পারে ও দেখাক কারিগরি।'
একদিকে কারিগর আর একদিকে বাজিকর। কারিগর একটা পাখির পালক বাজিকরের হাতে দিয়ে বললে, 'এইটে ওড়াও।'
বাজিকর পালকটা নিয়ে ফুঁ দিতেই সেটা উড়ে গিয়ে সভা ছাড়িয়ে মাঠে পড়ল। সভাসুদ্ধ কারিগরকে দুয়ো দিয়ে উঠল।
তখন কারিগর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বলছে, 'এইবার আমায় উড়াও তো দেখি কত বড় বাজিকর!'
সভাসুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে দেখতে লাগল, কী হয়! বাজিকর ফুঁ দেয়, কারিগর হেলেও না। খানিক পরে বাজিকর চোখ রাঙিয়ে বললে, 'কই তুমিই আমায় ওড়াও তো দেখি কত বড় কারিগর!'
কারিগর একটু হেসে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই একধার থেকে একটা লোহার পাখি সভার মধ্যিখানে কারিগরের চেলারা এনে হাজির করলে।
কারিগর বাজিকরকে বললে, 'এগিয়ে এস। পাখির পিঠে চড়ে পড়, কেমন না-ওড়ো দেখি।'
কলের পাখির বিকট চেহারা দেখে বাজিকর শুকনো মুখে রাজার দিকে চাইতে রাজা বললেন, 'আচ্ছা হয়েছে, আর পরীক্ষায় কাজ নেই, ছেড়ে দাও।'
বাজিকর তখন বললে, 'সে কি মহারাজ, ও আমায় ওড়াবে কী? লোকটা আগে নিজেই উড়ুক তো দেখি কেমন পারে। আমি মনে করলে এখনি ওর পাখিসুদ্ধ ওকে পালকের মতো এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে পারি। শুধু ছেলেমানুষ বলে এতক্ষণ রেহাই দিয়েছি। আর না, দেখাচ্ছি মজা এবার!'
কারিগর হাসতে হাসতে আপনার হাতে গড়া পাখির উপর সওয়ার হল। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। পাখি রঙিন আলোয় ডানা মেলে কারিগরকে নিয়ে মাটি ছেড়ে খুব আস্তে আস্তে আকাশে উঠতে আরম্ভ করলে।
রাজা সাধুবাদ দিতে যাবেন এমন সময় বাজিকর পাখিটার পেটের তলায় দাঁড়িয়ে একটা মস্তর আউরে চারটে ফুঁ দিয়ে বললে, 'দেখুন মহারাজ। এবার একেবারে উড়ল। যাঃ ফুঁঃ! আর আসিসনে, ভাগ্!'
পাখি সন্ধ্যার অন্ধকারে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনেকক্ষণ আর ফিরল না। রাজা বললেন, 'এ বাজিকরটা যা বললে, তাই তো করলে!'
রাজা বাজিকরকেই বকসিস দিলেন।
কারিগর খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখে সত্তা শূন্য। কা কস্য পরিবেদনা। শুকনো মুখে অন্ধকারে শুধু তার এক গণ্ডা চেলার মধ্যে মোটে একজন গালে হাত দিয়ে বসে আছে তার প্রতীক্ষায়। বাকি চেলারা বাজিকরের কাছে বিদ্যে শিখতে চলে গেছে।