বাদশার আগাগোড়া পাকা দাড়ির মাঝে একটি মাত্র কাঁচা ও বেগমের সব কাঁচা চুলের মধ্যে একটি পাকা চুল দেখা যায়। বেগমের কিছুতেই পছন্দ হয় না বাদশার দাড়ি-তা যতই কেন বাদশা আতর কস্তুরীতে দাড়ি মাজুন। ওদিকে বেগমসাহেবা--তিনিও মাথায় হীরে-মুক্তোর ঝাপটা সিঁথি পরে মাথা ঘষা মেথেও সেই একগাছি পাকা চুল বাদশার চোখ থেকে ঢেকে রাখতে পারেন না। দুজনে দুজনকে দেখে মুখ ফেরান, দুজনেই মনের দুঃখে থাকেন, শেষে এমন হ'ল যে, বাদশার দরবারে কাঁচা-দাড়ি এবং বেগমের দরবারে পাকাচুল যাদের তাদের টেকাই দায় হল।
কবি আসে, কালোয়াত আসে, ছবিওয়ালী আসে, চুড়ীওয়ালী আসে, কেউ খাতির পায় না, উল্টে বরং ধমক খায়, গর্দানি খায়, সরে পড়ে প্রাণ নিয়ে!
উজির ভেবেই অস্থির---কি করা যায়! নাপিত-নাপ্তিনীকে উজির ডেকে বলেন, 'তোরা সাঁড়াশি দিয়ে চুল-দুগাছা উপড়ে দে, আপদ ঢুকুক।' হাজাম-হাজামিন দুজনে ভয়ে শিউরে উঠে বলে, 'দোহাই উজির সাহেব, এমন কাজ আমাদের দ্বারা হবে না---সাঁড়াশি দিয়ে আমাদের দাঁত উপড়ে ফেলতে বলেন তো পারি, বাদশা বেগমের উপর অস্তর চালাই এমন নেমকহারাম আমরা নই!'
উজির নিঃশ্বাস ফেলে গালে হাত দিয়ে বসেন! কি উপায়!
মোল্লা দো-পেঁয়াজা পেঁয়াজ-রসুন খেতে বড়ই ভালবাসেন, কিন্তু হাতে পয়সা নেই মাষকলাই কৈনবারও। ফতোয়া দেন মজিদে দু-বেলা; কোন ফল হয় না। তাঁর বিবি তাঁকে বলেন, 'দেখ, এই সময় বাদশা-বেগমকে খুশি করতে পার তো কিছু হতে পারে।'
মোল্লা দো-পেঁয়াজা বল্লেন, 'তা জানি, পেঁয়াজও হতে পারে পয়জারও হতে পারে।' বিবি বল্লেন, 'দেখ না চেষ্টা করে। কিছু না হওয়ার চেয়ে সে-ও যে ভাল।'
মোল্লা সকালে কোমর বেঁধে মজলিসে হাজির! দেখেন সবাই যে যার দাড়ি মোচড়াচ্ছেন আর চুপ ক'রে বসে আছেন। এমন কি যার দাড়ি-গোঁফ কিছুই নেই সেও হাত বোলাচ্ছে শুধু গালের ওপরটাতেই। নাচ-গান আমোদ-আহলাদ সব বন্ধ।
বাদশা মোল্লার দিকে চাইতেই মোল্লা মস্ত এক সেলাম ঠুকলেন, কিন্তু বাদশার উচ্চবাচ্য নেই। তখন মোল্লা একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে যে ভাবে ফতোয়া দেয় লোকে, 'সেইভাবে সুর করে গান সুরু করলেন দাড়ি নেড়ে, যথা-আবূ দাড়ি চাপ্ দাড়ি, বুলবুল চস্নেদার দাড়ি, কুল্ পাক্কা এক কাঁচ্চা ওহি দাড়ি সবক্সে আচ্ছা।
বাদশা খুশি হয়ে তালে তালে ঘাড় নাড়ছেন দেখে দো-পেঁয়াজা আবার গাইলেন-এক দাড়ি মান মনোহর,
এক দাড়ি ভব্বো। এক দাড়ি খালিফ ফজিহৎ এক দাড়ি উল্লো।
সদর পাক্কা অন্দর কাঁচ্চা ওহি ওহি সর্বসে আচ্ছা!
শুনে-শুনে বাদশা একগাল হেসে ফেল্লেন, সেই সময় অন্দরেও হাসির রোল উঠলো পর্দার আড়ালে!
এক সঙ্গে বাদশা-বেগম আমির-ওমরা এবং শহরের কাঁচা-পাকা যে কেউ খুশি হয়ে গেল। মোল্লার আর প্যাঁজ-রসুন ধরে না ঘরে। শহরের বাড়ি বাড়ি দাড়ির গান উল্টে পাল্টে লোকে গাইতে থাকলো, যার যেমন খুশি সুরে।
(দাড়ির গান)
আবূ দাড়ি চাপ্ দাড়ি, বুলবুল চদোর দাড়ি--
কুল্ পাক্কা এক কাঁচ্চা সবক্সে দাড়ি ওহি আচ্ছা!
এক দাড়ি মান মনোহর, এক দাড়ি ভব্বো, এক দাড়ি খালিফ্ ফজিহৎ, এক দাড়ি উচ্চো!
সদর পাক্কা অন্দর কাঁচ্চা ওহি ওহি সর্বক্সে আচ্ছা!
লম্বে দাড়ি ওহি আচ্ছা। ছোটে ছোটে ওভি আচ্ছা। দাড়িমে সত্তি সচ্চা।
পাক্কে কাচ্চে সত্তি আচ্ছা। 'আচ্ছা আচ্ছা' বোলি সাচ্চা।