সিংহির মামা ভোম্বলদাস নেহাৎ সেকালের জানোয়ার। রাজকার্য চালাবার মতো বুদ্ধিও তাঁর ছিলনা, গায়ের জোর যে খুব ছিল, তাও নয়। খোস-মেজাজে সেজে- গুজে সিংহাসনে বসে আয়েস আর আমোদ-আহলাদ করতেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। রাজকার্য করবার নাম শুনলে তাঁর জ্বর আসত,-লড়াই করা তো দূরের কথা। কিন্তু দেশ-বিদেশের সবাই তাঁকে মস্ত রাজা বলে জানত। সবাই বলত-'সিংহির মামা ভোম্বলদাস, বাঘ মেরেছে গণ্ডা দশ!'
যে ভোম্বলদাস ঘরের কোণে আরসোলা উড়লে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যায়, সে কেমন কোরে দশ গণ্ডা বাঘ মারলো? ভোম্বলদাসের একটি মন্ত্র গুণ ছিল, সেটি হচ্ছে মন্ত্রী বেছে নেবার! দেখে দেখে তিনি শেয়ালপন্ডিতকে আপনার প্রধানমন্ত্রী কোরে নিয়েছিলেন। আর তাঁরই পরামর্শে দশ গণ্ডার চেয়েও ঢের বেশী বাঘ মেরে তিনি পশুদের মধ্যে একচ্ছত্র রাজা হয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু কপাল। বনের যত জোরোয়ার জানোয়ার দেশের চারিদিকে সুখ-শান্তি দেখে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠলো। তারা কোথাও একটা লড়াই বাধিয়ে খানিক হাঁকাহাঁকি দাপাদাপি মাথা ফাটাফাটি করতে ভোম্বলদাসকে ধরে পড়লো।
ভোম্বলদাস শেয়ালের সঙ্গে মুক্তি করে বললেন, 'আমার শত্রু যারা ছিল সব তো যমের বাড়ী পাঠিয়েছি। লড়াই হবে কার সঙ্গে?'
দুষ্টু জানোয়ার, তারা আগে হতেই সড় করে এসেছিল। তারা পিঁপড়েদের ক্ষুদে শহরের উপর চড়াও হয়ে লড়াই দেবার জন্যে অনুরোধ করলে।
শেয়াল পণ্ডিত বললেন, 'এমন কাজ করো না! তারা দেখতে ছোট কিন্তু কামড়ালে আর রক্ষে নেই।
সবাই হেসে শেয়ালের কথা উড়িয়ে দিলে। লড়াই বাধলো। জীবনের মধ্যে ভোম্বলদাস এই এক ভুল করলেন, বুদ্ধিমানের কথা ঠেলে, গায়ের জোরের মান রাখতে গেলেন। তার ফলও ফন্সতে দেরী হলো না। লড়াই তো যেমন হবার হলো, কিন্তু ক্ষুদে শহরের একটি ইটও খসাতে পারলে না। উল্টে সিংহির মামা ভোম্বলদাস বুড়ো বয়সে হাতে-মুখে, মাকে-চোখে, কানে-ল্যাজে, বুকে-পিঠে, পেটে এমন কামড় খেলেন যে সর্বাঙ্গ ফুলে ঢোল! না পারেন চলতে, না পারেন বলতে। খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই, কাজে মন দিতে গেলে মাথা ঘোরে। জানোয়ারদের মুল্লুকে রাজ কার্য অচল হলো। শেয়ালপণ্ডিত মাথায় হাত দিয়ে পড়লেন। বাঘা-কোটাল, ভালুক-মন্ত্রী এমনি সব রাজ্যের বড় বড় আমির-ওমরা গো-বদ্যিকে ডেকে রাজার চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে লাগলেন, কিন্তু ঘুঁটে-ভস্ম, গোবর-প্রলেপ এসবে কিছুই হলো না। তখন বকা-ধামিক এসে ভোম্বলদাস মহারাজকে কৈলাস করবার ব্যবস্থা দিলেন। মহারাজও ভাগ্নে সিংহকে রাজ্যের ভার দিয়ে কিছুদিনের জন্যে কৈলাসের দিকে রওনা হতে প্রস্তুত হয়ে বললেন, 'আমি তো চলৎ-শক্তি-রহিত, আমাকে কেউ যদি রেখে আসে তো কৈলাস যাওয়া ঘটে-নচেৎ উপায় নাস্তি।'
বকা-ধার্মিককে রাজার সঙ্গে যাবার জন্যে নিমন্ত্রণ দেওয়া হলো। কিন্তু কৈলাসে দুরন্ত শীত, তার উপর সেখানে মাছ খাওয়া নিষেধ, কাজেই বকা পিছলেন। তিনি গেলে পশুদের ধর্ম কথা শোনায় কে? বাঘা-কোটালেরও ঐ একই কথা। তিনি না থাকলে গৃহস্থের গরু- জরু সামলায় কে? ভালুক-মন্ত্রী যেতে পারতেন, কিন্তু নতুন রাজা সিংহকে নিয়ে রাজকার্য চালাবার জন্যে সদরে থাকা তাঁর বিশেষ দরকার। কাজেই তাঁরও যাওয়া হয় না। শেয়াল- পণ্ডিতকে রাজা বললেন, 'পণ্ডিত, তুমি কি বল?'
পণ্ডিত কি জানি কি ভেবে বললেন, 'জানোয়ারদের দেশে গায়ের জোরের চর্চাই দেখছি বেশী, বুদ্ধির চাষ কম, সুতরাং এ-রাজ্য থেকে আমি চলে গেলে কোন কাজই আটকাবে না। গর্দভ রইলেন পাঠশালাগুলোর তদারক করতে। আমি মহারাজকে সশরীরে কৈলাসে পৌঁছে দিয়ে আসি।'
রাজা খুশী হয়ে শেয়ালকে কৈলাস-মান্নার আয়োজন করতে তখনি হুকুম দিয়ে সভা ভঙ্গ করলেন।
কৈলাসে শীত বিষম, কাজেই রাজ্যের ভেড়া মেরে শেয়াল তাদের ছাল সংগ্রহ করতে লাগলেন। আর পথে খাবার জন্যে ভেড়ার মাংস, ছাগলের মাথাগুলোও বোঝা বাঁধা হলো। এ ছাড়া নানা সুস্বাদু পাখি, খরগোস, এমন কি রাজার জন্যে কচি কচি বাঘ-ভাল্লুকের গা থেকে ছাল পর্যন্ত ছাড়িয়ে নেওয়া হলো। বকের পালকের বালিশ, লেপ, তোশক, গণ্ডারের ছালের প্যাঁটরা আর জুতো, মোষের শিঙের ছড়ি, গজদন্তের খড়ম-এমনি নানা সামগ্রী শেয়ালের কাছে দিনে দিনে স্তূপাকার হয়ে উঠলো।
এদিকে জানোয়ারদের ঘরে ঘরে কান্না উঠেছে, কিন্তু রাজার প্রয়োজনে এই সব সংগ্রহ করছেন শেয়াল পণ্ডিত-কারো কথাটি বলবার সাধ্য নেই! ভাল্লুক-মন্ত্রী বকা- ধার্মিককে বলে কয়ে যাতে রাজার চটপট যাওয়া হয়, এমন একটা ভালো দিন পাঁজি-পুঁথি দেখে স্থির করতে বলে দিলেন। সামনে অশ্লেষা-মঘা, সেই দিনই উত্তম বলে ঠিক হলো। প্রজারা সবাই রাজাকে বিদায় দিতে এলো। রাজার কৈলাস যাত্রার সাজ-সরঞ্জাম জুগিয়ে প্রজারা কেউ নুন-ছালের জালায়, কেউ দাঁতের বেদনায়, কেউ বা ছেঁড়া-পালকের শোকে চোখ-মুখ ফুলিয়ে এসেছে দেখে, শেয়াল রাজাকে বুঝিয়ে দিলেন যে প্রজারা তাঁরই বিরহে ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন করছে। ভোজলদাস খুশী হয়ে সবাইকে আশীর্বাদ করে রওনা হলেন। পিছনে শেয়াল তার দলবল, রাজ্যের যা কিছু ধন-দৌলত, আসবাব-পত্র নিয়ে রাজার সঙ্গে কৈলাস করতে চললো।
এদিকে গ্রামে-গ্রামে ঘার্টিতে-ঘাটিতে খবর এসেছে ভোম্বলদাস কৈলাস চলেছেন। সবাই রাজা দেখতে পথের দুই ধারে ভিড় লাগিয়েছে। ভোজলদাস রয়েছেন রাম-ছাগলের চামড়ার কম্বলে ঢাকা ডুলির মধ্যে। আর শেয়াল চলেছেন আগে আগে বুক ফুলিয়ে। পাড়াগেঁয়ে জানোয়ার তারা কোনোদিন রাজাকে চোখে দেখে নি। শেয়ালকেই রাজা ভেবে তারা দু'হাতে সেলাম দিতে লাগলো। সঙ্গের ডুলিতে কম্বল মুড়ি দেওয়া ভোম্বলদাসকে দেখে তারা ভাবলে রানী।
সুন্দরবনের সিংহগড় থেকে শেয়াল পণ্ডিতের বাড়ী জম্বুকগড় হলো তিন হতার পথ। আর কৈলাস তিন মাসেরও বেশী রাস্তা। বুড়ো ভোম্বলদাসের সঙ্গে দেশ ছেড়ে এতটা যাওয়া শেয়ালের আদপেই ইচ্ছা ছিল না। সে যত শীঘ্র পরে বুড়ো রাজার সঙ্গে তাঁর ধন-দৌলত নিজের ঘরে এনে ফেলবার মতলবে আছে।
এদিকে কিন্তু ডুলির মধ্যে ঝাঁকানি খেতে খেতে রাজার প্রাণান্ত হবার জোগাড় হয়েছে। তাঁর ইচ্ছা ঘাটিতে ঘাটিতে জিরিয়ে যাওয়া। যেখানে ভালো গ্রাম দেখেন সেইখানেই রাজা বলেন, 'ওহে পণ্ডিত, জায়গাটা তো ভালো বোধ হচ্ছে। দু-এক দিন এখানে থেকে গেলে হয় না?'
শেয়াল অমনি বলে ওঠে, 'না মহারাজ, এখানে থাকা চলবে না, এটা হলো মশা ভন্ডনানির দেশ! রায়ে নিদ্রা মোটেই হবে না-এগিয়ে চলুন!'
আরো কতদূর গিয়ে রাজা বলেন, 'ওহে, এ স্থানটা কেমন?'
'মহারার্ড, এটা, হাড়মড়মড়ি শহর। এক ঘন্টা এখানে কাটালেই বাতে ধরবে।'
'ওহে পণ্ডিত, এ জায়গাটা ?'
'সর্বনাশ! এটা পিপঁড়ে-কাঁদা গ্রাম! এখানে থাকা হতেই পারে না-না খেয়ে প্রাণ যাবে!'
এই ভাবে রাজাকে কখনো ভয় দেখিয়ে, কথনো মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে, শেয়াল দিন- রাত চলে এক হপ্তায় তিন হতার পথ নিজের আড্ডায় এসে হাজির। কিন্তু শেয়ালের গর্তে তো সিংহের মামা প্রবেশ করতে পারেন না, কাজেই বাইরে গাছতলায় তাঁকে শোয়ানো হলো। ধন-দৌলত সমস্তই শেয়ালের গর্তে গিয়ে পৌঁছলো।
রাজা ভুলি থেকে কষ্টে মাটিতে নেমে বলেন, 'ওহে পণ্ডিত, কৈলাস আর কতদূর?" 'কাছে মহারাজ! ঐ যে কৈলাসের চূড়ো দেখা যায়!'
রাজাকে কিছু দূরে একটা উই-ভিপি দেখিয়ে দিলেন।
রাজা খুশী হয়ে বললেন, 'তাহলে এই গাছতলায় দিন কতক আরাম করা যাক! একটু সুস্থ হয়ে পাহাড়ে ওঠা যাবে।'
শেয়াল বললে, 'মহারাজ, এইখানে বসে কিছু দিন তপস্যা করেন। পশুপতির কৃপায় দু-দিনেই রোগের শাস্তি হবে!'
এই বলে মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে শেয়াল নিজের গর্তে গিয়ে প্রবেশ করলেন।