কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কিছুদিন যখন দেবদাস এলাহাবাদে বাস করিতেছিল, তখন হঠাৎ একদিন সে চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখিয়াছিল, বৌ, মনে করেছিলাম, আর
কখনো ভালবাসব না। একে ত ভালবেসে শুধুহাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা, তার পরে আবার নূতন করে ভালবাসতে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা সংসারে আর
নেই।
্রত্যন্তরে চন্দ্রমুখী কি লিখিয়াছিল তাহাতে আবশ্যক নাই; কিন্তু এই সময়টায় দেবদাসের কেবলই মনে হইত, সে একবার এলে হয় না!
পরক্ষণে সভয়ে ভাবিত-_না, না, কাজ নেই,_-কোনদিন পার্বতী যদি জানতে পারে! এমনি করিয়া একবার পার্বতী, একবার চন্দ্রমুখী তাহার হৃদয়রাজ্যে বাস
করিতেছিল। কখনও বা দু'জনের মুখই পাশাপাশি তাহার হৃদয়পটে ভাসিয়া উঠিত-_যেন উভয়ের কত ভাব!
মনের মাঝে দু'জনেই পাশাপাশি বিরাজ করিত । কোনদিন বা অত্যন্ত অকন্মাৎ মনে হইত, তাহারা দু'জনেই যেন ঘৃমাইয়া পড়িয়াছে। এই সময়টায় মনটা
তাহার এমনি অন্তঃসারশূন্য হইয়া পড়িত যে, শুধু একটা নিজীব অতৃপ্তিই তাহার মনের মধ্যে মিথ্যা প্রতিধ্বনির মত ঘুরিয়া বেড়াইত। তার পরে দেবদাস
লাহোরে চলিয়া গেল। এখানে চুনিলাল কাজ করিতেছিল, সন্ধান পাইয়া দেখা করিতে আসিল। বহুদিন পরে দেবদাস সুরা স্পর্শ করিল । চন্দ্রমুখীকে মনে পড়ে,
সে নিষেধ করিয়া দিয়াছিল। মনে হয়, তার কত বুদ্ধি। সে কত শান্ত, ধীর; আর তার কত স্নেহ। পার্বতী এখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল-_শুধু নির্বাণোনুখ
দীপশিখার মত কখনো কখনো জুলিয়া জুলিয়া উঠিত। কিন্তু এখানকার জলবায়ু তাহার সহিল না । মাঝে মাঝে অসুখ হয়, পেটের কাছে আবার যেন ব্যথা বোধ
হয়। ধর্মদাস একদিন কীদ-কীদ হইয়া কহিল, দেবৃতা, তোমার শরীর আবার খারাপ হচ্চে-_আর কোথাও চল।
দেবদাস অন্যমনক্কভাবে জবাব দিল, চল যাই।
দেবদাস প্রায় বাসাতে মদ খায় না। চুনিলাল আসিলে কোনদিন খায়, কোন দিন বাহির হইয়া চলিয়া যায়। রাত্রিশেষে বাটা ফিরিয়া আসে, কোন রাত্রি বা
একেবারেই আসে না । আজ দুইদিন হইতে হঠাৎ তাহার দেখা নাই। কাঁদিয়া ধর্মদাস অনুজল স্পর্শ করিল না। তৃতীয় দিনে দেবদাস জুর লইয়া বাটী ফিরিয়া
আসিল; শয্যা লইল, আর উঠিতে পারিল না। তিন-চারিজন ডাক্তার আসিয়া চিকিৎসা করিতে লাগিল ।
ধর্মদাস কহিল, দেবৃতা, কাশীতে মাকে খবর দিই-_
দেবদাস তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিয়া উঠিল, ছিঃ ছিঃ__মাকে কি এ মুখ দেখাতে পারি?
ধর্মদাস প্রতিবাদ করিল, রোগ-শোক সকলেরই আছে; কিন্তু তাই বলে কি এতবড় বিপদের দিনে মাকে লুকানো যায়ঃ তোমার কোন লজ্জা নাই, দেব্তা,
কাশীতে চল।
দেবদাস মুখ ফিরাইয়া কহিল, না, ধর্মদাস, এ সময়ে তার কাছে যেতে পারব না। ভাল হই, তার পরে।
ধর্মদাস একবার মনে করিল, চন্দ্রমুখীর উল্লেখ করে; কিন্তু নিজে তাহাকে এত ঘৃণা করিত যে, তাহার মুখ মনে পড়িবামাত্রই চুপ করিয়া রহিল।
দেবদাসের নিজেরও অনেকবার এ কথা মনে হইত; কিন্তু কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করিত না। সুতরাং কেহই আসিল না। তার পর অনেক দিনে সে ধীরে
ধীরে আরোগ্য হইতে লাগিল । একদিন সে উঠিয়া বসিয়া বলিল, চল ধর্মদাস, এইবার আর কোথাও যাই।
আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই ভাই, হয় বাড়ি চল, না হয় মায়ের কাছে চল।
জিনিসপত্র বাধিয়া চুনিলালের নিকট বিদায় লইয়া, দেবদাস আবার এলাহাবাদে আসিয়া উপস্থিত হইল-_শরীরটা অনেকটা ভাল । কিছুদিন থাকিবার পর
একদিন দেবদাস কহিল, ধর্ম কোন নূতন জায়গায় গেলে হয় না? কখনো বোম্বাই দেখিনি , যাবে?
আগ্রহ দেখিয়া অনিচ্ছাসত্তেও ধর্মদাস মত দিল । সময়টা জ্যৈষ্ঠ মাস; বোম্বাই শহর তেমন গরম নয়। এখানে আসিয়া দেবদাস অনেকটা সারিয়া উঠিল।
ধর্মদাস জিজ্ঞাসা করিল, এখন বাড়ি গেলে হয় না?
দেবদাস কহিল, না, বেশ আছি। আমি এখানেই আর কিছুদিন থাকব ।
এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। ভাদ্র মাসের সকালবেলায়, একদিন দেবদাস ধর্মদাসের কীধে ভর দিয়া বোম্বাই হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া
গাড়িতে আসিয়া বসিল। ধর্মদাস কহিল, দেব্তা, আমি বলি, মায়ের কাছে যাওয়া ভাল।
দেবদাসের দুশ্চক্ষু জলে ভরিয়া গেল_আজ কয়দিন হইতে মাকে তাহার কেবল মনে পড়িতেছিল। হাসপাতালে পড়িয়া যখন তখন এই কথাই
ভাবিয়াছে,_এ সংসারে তাহার সবই আছে, অথচ কেহই নাই। তাহার মা আছেন, বড় ভাই আছেন, ভগিনীর অধিক পার্বতী আছে- চন্দ্রমুখীও আছে! তাহার
সবাই আছে, কিন্তু সে আর কাহারও নাই। ধর্মদাসও কীদিতেছিল; কহিল, তাহলে দাদা, মায়ের কাছে যাওয়াই স্থিরঃ
দেবদাস মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিল; বলিল, না ধর্মদাস, মাকে এ মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না,__আমার এখনো বোধ করি সে সময় আসেনি ।
বৃদ্ধ ধর্মদাস হাউহাউ করিয়া কীদিয়া কহিল, দাদা, এখনো যে মা বেঁচে আছেন!
কথাটায় কতখানি যে প্রকাশ করিল, তাহা অন্তরে উভয়েই অনুভব করিল । দেবদাসের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ হইয়াছে। সমস্ত পেট গ্রীহা-লিভারে পরিপূর্ণ;
তাহার উপর জুর, কাশি । রঙ গাঢু কৃষ্তবর্ণ, দেহ অস্থিচর্মসার। চোখ একেবারে ঢুকিয়া গিয়াছে, শুধু একটা অস্বাভাবিক উজ্ভ্বলতায় চকচক করিতেছে। মাথায়
চুল রুক্ষ ও খাজু-_চেষ্টা করিলে বোধ হয় গুণিতে পারা যায়। হাতের আঙ্গুলগুলার পানে চাহিলে ঘৃণা বোধ হয়_-একে শীর্ণ, তাহাতে আবার কুৎসিত ব্যাধির
দাগে দুষ্ট । স্টেশনে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথাকার টিকিট কিনব দেব্তা?
দেবদাস ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিল, চল বাড়ি যাই-__-তার পর সব হবে।
গাড়ির সময় হইলে তাহারা হুগলির টিকিট কিনিয়া চাপিয়া বসিল।
ধর্মদাস দেবদাসের নিকটেই রহিল । সন্ধ্যার পূর্বে দেবদাসের চোখ জ্বালা করিয়া আবার জবর আসিল । ধর্মদাসকে ডাকিয়া কহিল,ধর্মদাস, আজ মনে হচ্চে,
বাড়ি পৌছনও হয়ত কঠিন হবে।
ধর্মদাস সভয়ে কহিল, কেন দাদা?
দেবদাস হাসিবার চেষ্টা করিয়া শুধু বলিল, আবার যে জবর হল, ধর্মদাস।
কাশীর পথ যখন পার হইয়া গেল, দেবদাস তখন জুরে অচেতন । পাটনার কাছাকাছি তাহার ইশ হইল, কহিল, তাইত ধর্মদাস, মায়ের কাছে যাওয়া সত্যিই
আর ঘটল না।
ধর্মদাস কহিল, চল দাদা, আমরা পাটনায় নেমে গিয়ে ডাক্তার দেখাই__
উত্তরে দেবদাস বলিল, না থাক, আমরা বাড়ি যাই চল।
গাড়ি যখন পাখুয়া স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন ভোর হইতেছে। সারারাত্রি বৃষ্টি হইয়াছিল, এখন থামিয়াছে। দেবদাস উঠিয়া দীড়াইল। নীচে
ধর্মদাস নিদ্রিত। ধীরে ধীরে একবার তাহার ললাট স্পর্শ করিল, লজ্জায় তাহাকে জাগাইতে পারিল না। তার পর দ্বার খুলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া পড়িল।
গাড়ি সুপ্ত ধর্মদাসকে লইয়া চলিয়া গেল। কীপিতে কীপিতে দেবদাস স্টেশনের বাহিরে আসিল। একজন ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে ডাকিয়া বলিল, বাপু,
হাতীপোতায় নিয়ে যেতে পারবে?
সে একবার মুখপানে চাহিল, একবার এদিক-ওদিক চাহিল, তাহার পর কহিল, না বাবু, রাস্তা ভাল নয়--ঘোড়ার গাড়ি এ বর্ষায় ওখানে যেতে পারবে না।
দেবদাস উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিল, পালকি পাওয়া যায়?
গাড়োয়ান বলিল, না।
আশঙ্কায় দেবদাস বসিয়া পড়িল_-তবে কি যাওয়া হবে নাঃ তাহার মুখের উপরেই তাহার অন্তিম অবস্থা গা মুদ্রিত ছিল, অন্ধেও তাহা পড়িতে পারিত।
গাড়োয়ান আর্্র হইয়া কহিল, বাবু, একটা গরুর গাড়ি ঠিক করে দেব?
দেবদাস জিজ্ঞাসা করিল, কতক্ষণে পৌছবে?
গাড়োয়ান বলিল, পথ ভাল নয় বাবু, বোধ হয় দিন-দুই লেগে যাবে ।
দেবদাস মনে মনে হিসাব করিতে লাগিল, দু'দিন বাচব ত? কিন্তু পাবর্তীর কাছে যাইতেই হইবে । তাহার অনেক দিনের অনেক মিথ্যা কথা, অনেক মিথ্যা
আচরণ ম্মরণ হইল কিন্তু শেষদিনের এ প্রতিশ্রুতি সত্য করিতেই হইবে । যেমন করিয়া হোক, একবার তাহাকে শেষ দেখা দিতেই হইবে! কিন্তু এ জীবনের
মেয়াদ যে আর বেশী বাকী নাই! সেই যে বড় ভয়ের কথা!
দেবদাস গরুর গাড়িতে যখন উঠিয়া বসিল, তখন জননীর কথা মনে করিয়া তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিয়া পড়িল। আর একখানি ন্নেহকোমল মুখ আজ
জীবনের শেষক্ষণে নিরতিশয় পবিত্র হইয়া দেখা দিল-_সে মুখ চন্দ্রমুখীর । যাহাকে পাপিষ্ঠা বলিয়া সে চিরদিন ঘৃণা করিয়াছে, আজ তাহাকেই জননীর পাশে
সগৌরবে ফুটিয়া উঠিতে দেখিয়া তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। এ জীবনে আর দেখা হইবে না, হয়ত বহুদিন পর্যন্ত সে
খবরটাও পাইবে না। তবু পার্বতীর কাছে যাইতে হইবে । দেবদাস শপথ করিয়াছিল, আর একবার দেখা দিবেই। আজ এ প্রতিজ্ঞা তাহাকে পূর্ণ করিতেই
হইবে । পথ ভাল নয়। বর্ধার জল কোথাও পথের মাঝে জমিয়া আছে, কোথাও বা পথ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। কাদায় সমস্ত রাস্তা পরিপূর্ণ। গরুর গাড়ি হটর হটর
করিয়া চলিল। কোথাও নামিয়া চাকা ঠেলিতে হইল, কোথাও গরু-দুটোকে নির্দয়রূপে প্রহার করিতে হইল--যেমন করিয়াই হোক এ ষোল ক্রোশ পথ অতিক্রম
করিতেই হইবে। হুহু করিয়া ঠাগ্ডা বাতাস বহিতেছিল। আজও তাহার সন্ধ্যার পর প্রবল জুর দেখা দিল। সে সভয়ে প্রশ্ন করিল, গাড়োয়ান, আর কত পথ?
গাড়োয়ান জবাব দিল, এখনো আট-দশ কোশ আছে বাবু।
শিগগির নিয়ে চল্ বাপু, তোকে অনেক টাকা বকশিশ দেব । পকেটে একখানা এক শ' টাকার নোট ছিল, তাই দেখাইয়া কহিল, এক শ' টাকা দেব, নিয়ে
চল্।
তাহার পর কেমন করিয়া কোথা দিয়া সমস্ত রাত্রি গেল, দেবদাস জানিতেও পারিল না। অসাড় অচেতন; সকালে সজ্ঞান হইয়া কহিল, ওরে, আর কত পথ?
এ কি ফুরোবে না?
গাড়োয়ান কহিল, আরও ছয় কোশ।
দেবদাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, একটু শিগণির চল্ বাপু, আর যে সময় নেই।
গাড়োয়ান বুঝিতে পারিল না, কিন্তু নৃতন উৎসাহে গরু ঠেঙ্গাইয়া গালিগালাজ করিয়া চলিল। প্রাণপণে গাড়ি চলিতেছে, ভিতরে দেবদাস ছটফট করিতেছে।
কেবল মনে হইতেছে, দেখা হবে ত? পৌছৰ ত? দুপুরবেলা গাড়ি থামাইয়া গাড়োয়ান গরুকে খাবার দিয়া, নিজে আহার করিয়া আবার উঠিয়া বসিল। কহিল,
বাবু, তুমি খাবে না কিছু?
না বাপু, তবে বড় তেষ্টা পেয়েচে, একটু জল দিতে পার?
সে পথিপার্শস্থ পু্করিণী হইতে জল আনিয়া দিল । আজ সন্ধ্যার পর জুরের সঙ্গে দেবদাসের নাকের ভিতর হইতে সড়সড় করিয়া ফৌটা ফৌটা রক্ত পড়িতে
লাগিল । সে প্রাণপণে নাক চাপিয়া ধরিল। তাহার পর বোধ হইল, দাতের পাশ দিয়াও রক্ত বাহির হইতেছে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসেও যেন টান ধরিয়াছে। হাপাইতে
হাপাইতে কহিল, আর কত?
গাড়োয়ান কহিল, কোশ-দুই; রাত্রি দশটা নাগাদ পৌছব।
দেবদাস বহুকষ্টে মুখ তুলিয়া পথের পানে চাহিয়া কহিল, ভগবান!
গাড়োয়ান প্রশ্ন করিল, বাবু, অমন করচেন কেন?
দেবদাস এ কথার জবাব দিতেও পারিল না। গাড়ি চলিতে লাগিল, কিন্তু দশটার সময় না পৌছিয়া প্রায় বারোটায় গাড়ি হাতীপোতার জমিদারবাবুর বাটার
সম্মুখে বাধান অশ্বথতলায় আসিয়া উপস্থিত হইল।
গাড়োয়ান ডাকিয়া কহিল, বাবু, নেমে এসো।
কোন উত্তর নাই । আবার ডাকিল, তবু উত্তর নাই। তখন সে ভয় পাইয়া প্রদীপ মুখের কাছে আনিল, বাবু, ঘুমালে কি?
দেবদাস চাহিয়া আছে; ঠোট নাড়িয়া কি বলিল, কিন্তু শব্দ হইল না । গাড়োয়ান আবার ডাকিল, ও বাবু!
দেবদাস হাত তুলিতে চাহিল, কিন্তু হাত উঠিল না; শুধু তাহার চোখের কোণ বাহিয়া দু'ফৌটা জল গড়াইয়া পড়িল। গাড়োয়ান তখন বুদ্ধি খাটাইয়া
অশ্বথতলার বাধানো বেদীটার উপর খড় পাতিয়া শয্যা রচনা করিল। তাহার পর বহুকষ্টে দেবদাসকে তুলিয়া আনিয়া তাহার উপর শয়ন করাইয়া দিল । বাহিরে
আর কেহ নাই, জমিদারবাটা নিস্তব্ধ, নিত্রিত। দেবদাস বনুর্লেশে পকেট হইতে একশ' টাকার নোটটা বাহির করিয়া দিল। লগ্ঠনের আলোকে গাড়োয়ান দেখিল,
বাবু তাহার পানে চাহিয়া আছে, কিন্তু কথা কহিতে পারিতেছে না। সে অবস্থাটা অনুমান করিয়া নোট লইয়া চাদরে বাঁধিয়া রাখিল। শাল দিয়া দেবদাসের মুখ
পর্যন্ত আবৃত; সম্মুখে লগ্ঘন জবলিতেছে, নূতন বন্ধু পায়ের কাছে বসিয়া ভাবিতেছে।
ভোর হইল সকালবেলা জমিদারবাটী হইতে লোক বাহির হইল,_-এক আশ্চর্য দৃশ্য । গাছতলায় একজন লোক মরিতেছে। ভদ্রলোক । গায়ে শাল, পায়ে
চকচকে জুতো, হাতে আংটি । একে একে অনেক লোক জমা হইল । ক্রমে ভূবনবাবুর কানে এ কথা গেল, তিনি ডাক্তার আনিতে বলিয়া নিজে উপস্থিত
হইলেন। দেবদাস সকলের পানে চাহিয়া দেখিল; কিন্তু তাহার কণ্ঠরোধ হইয়াছিল--একটা কথাও বলিতে পারিল না, শুধু চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে
লাগিল । গাড়োয়ান যতদূর জানে বলিল, কিন্তু তাহাতে সুবিধা হইল না। ডাক্তার আসিয়া কহিল, শ্বাস উঠেছে, এখনই মরবে ।
সকলেই কহিল, আহা!
উপরে বসিয়া পার্বতী এ কাহিনী শুনিয়া বলিল, আহা!
কে একজন দয়া করিয়া মুখে একফৌটা জল দিয়া গেল। দেবদাস তাহার পানে করণদৃষ্টিতে একবার চাহিয়া দেখিল, তাহার পর চক্ষু মুদিল। আরও কিছুক্ষণ
বাচিয়া ছিল, তাহার পরে সব ফুরাইল। এখন কে দাহ করিবে, কে ছুঁইবে, কি জাত ইত্যাদি লইয়া তর্ক উঠিল। ভুবনবাবু নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে সংবাদ
দিলেন। ইন্স্পেক্টর আসিয়া তদন্ত করিতে লাগিল। প্রীহা-লিভারে মৃত্যু । নাকে মুখে রক্তের দাগ। পকেট হইতে দুইখানা পত্র বাহির হইল। একখানা
তালসোনাপুরের দ্বিজদাস মুখৃষ্যে বোম্বায়ের দেবদাসকে লিখিতেছে।-_টাকা পাঠান এখন সম্ভব নয়। আর একটা কাশীর হরিমতী দেবী উক্ত দেবদাস মুখুষ্যেকে
লিখিতেছে_-কেমন আছ?
বা হাতে উলকি দিয়া ইংরাজী অক্ষরে নামের আদ্যক্ষর লেখা আছে। ইনৃস্পেক্টুরবাবু তদন্ত করিয়া কহিলেন, হা, লোকটা দেবদাস বটে ।
হাতে নীলপাথর দেওয়া আংটি-__দাম আন্দাজ দেড়-শ* গায়ে একজোড়া শাল-_দাম আন্দাজ দুই শ'। জামাকাপড় ইত্যাদি সমস্তই লিখিয়া লইলেন।
চৌধুরীমহাশয় ও মহেন্দ্রনাথ উভয়েই উপস্থিত ছিলেন । তালসোনাপুর নাম শুনিয়া মহেন্দ্র কহিল, ছোটমার বাপের বাড়ির লোক, তিনি দেখলে-_
চৌধুরীমহাশয় তাড়া দিলেন, সে কি এখানে মড়া সনাক্ত করতে আসবে নাকি?
দারোগাবাবু সহাস্যে কহিলেন, পাগল আর কি!
ব্রাহ্মণের মৃতদেহ হইলেও পাড়ার্গায়ে কেহ স্পর্শ করিতে চাহিল না; কাজেই চণ্ডাল আসিয়া বাধিয়া লইয়া গেল। তার পর কোন শুষ্ক পুরিণীর তটে অর্ধদগ্ধ
করিয়া ফেলিয়া দিল_কাক-_-শকুন উপরে আসিয়া বসিল, শৃগাল-কুকুর শবদেহ লইয়া কলহ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তবুও যে শুনিল, সেই কহিল, আহা! দাসী
চাকরও বলাবলি করিতে লাগিল, আহা ভদ্দরলোক, বড়লোক! দু শ' টাকা দামের শাল, দেড় শ" টাকা দামের আংটি! সে-সব এখন দারোগার জিম্মায় আছে;
পত্র দু'খানাও তিনি রখিয়াছেন।
খবরটা সকালেই পার্বতীর কানে গিয়াছিল বটে, কিন্তু কোন বিষয়েই আজকাল সে মনোনিবেশ করিতে পারিত না বলিয়া ব্যাপারটা ঠিক বুঝিতে পারে নাই।
কিন্তু সকলের মুখেই যখন এ কথা, তখন পার্বতীও বিশেষ করিয়া শুনিতে পাইয়া সন্ধ্যার পূর্বে একজন দাসীকে ডাকিয়া কহিল, কি হয়েচে লা? কে মরেচে?
দাসী কহিল, আহা, কেউ তা জানে না মা! পূর্বজন্মের মাটি কেনা ছিল, তাই মরতে এসেছিল । শীতে হিমে সেই রাত্রি থেকে পড়ে ছিল, আর বেলা ন'্টার
সময় মরেছে ।
পার্বতী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আহা, কে তা কিছু জানা গেল না।
দাসী বলিল, মহেনবাবু সব জানেন, আমি অত জানিনে মা।
মহেন্দ্রকে ডাকিয়া আনা হইলে সে কহিল, তোমাদের দেশের দেবদাস মুখুষ্যে ৷
পকেটে দু'খানা চিঠি ছিল; একখানা দ্বিজদাস মুখুয্যে লিখচেন__
পার্বতী বাধা দিয়া কহিল, হা, তার বড়দাদা।
আর একখানা কাশীর হরিমতী দেবী লিখেচেন__
হা, তিনি মা।
হাতের উপর উলকি দিয়ে নাম লেখা ছিল-_
পার্বতী কহিল, হা, কলকাতায় প্রথম গিয়ে লিখিয়েছিলেন বটে
একটা নীল রংয়ের আর্টি__
পৈতার সময় জেঠামশাই দিয়েছিলেন । আমি যাই,_বলিতে বলিতে পার্বতী ছুটিয়া নামিয়া পড়িল।
মহেন্দ্র হতবৃদ্ধি হইয়া কহিল, ও মা, কোথা যাও?
দেবদার কাছে।
সে ত আর নেই-_ডোমে নিয়ে গেছে।
ওগো, মা গো। বলিয়া কাদিতে কীদিতে পার্বতী ছুটিল। মহেন্দ্র ুটিয়া সম্মুখে আসিয়া বাধা দিয়া বলিল, তুমি কি পাগল হলে মা? কোথা যাবে?
পার্বতী মহেন্দ্রের পানে তীব্র কটাক্ষ করিয়া কহিল, মহেন, আমাকে কি সত্যি পাগল পেলে? পথ ছাড়।
তাহার চক্ষের পানে চাহিয়া, মহেন্দ্র পথ ছাড়িয়া নিঃশব্দে পিছনে পিছনে চলিল। পার্বতী বাহির হইয়া গেল। বাহিরে তখনও নায়েব গোমস্তা কাজ
করিতেছিল, তাহারা চাহিয়া দেখিল। চৌধুরীমহাশয় চশমার উপর দিয়া চাহিয়া কহিলেন, যায় কে?
মহেন্দ্র বলিল, ছোটমা ।
সে কি? কোথায় যায়ঃ
মহেন্দ্র বলিল, দেবদাসকে দেখতে ।
ভুবন চৌধুরী চীৎকার করিয়া উঠিলেন, তোরা কি সব ক্ষেপে গেলি, ধর--ধর--ধরে আনো ওকে । পাগল হয়েচে! ও মহেন, ও কনেবৌ!
তাহার পর দাসী-চাকর মিলিয়া ধরাধরি করিয়া পার্বতীর মুষ্ছিত দেহ টানিয়া আনিয়া বাটার ভিতরে লইয়া গেল। পরদিন তাহার মৃষ্থাভঙ্গ হইল, কিন্তু সে
কোন কথা কহিল না। একজন দাসীকে ডাকিয়া শুধু জিজ্ঞাসা করিল, রাত্রিতে এসেছিলেন, না? সমস্ত রাত্রি!
তাহার পর পার্বতী চুপ করিয়া রহিল।
এখন এতদিনে পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না। সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না। শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ
কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য
একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে । মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি
ন্নেহকরম্পর্শ তাহার ললাটে পৌছে-_যেন একটিও করুণার্ ন্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফৌটা চোখের
জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।