দুই ভাই দ্বিজদাস ও দেবদাস ও গ্রামের অনেকেই জমিদার নারায়ণ মুখৃয্যের সৎকার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। দ্বিজদাস চীৎকার করিয়া কীদিয়া পাগলের মত হইয়াছে__পাড়ার পাচজন তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। আর দেবদাস শান্তভাবে একটা থামের পার্শ্বে বসিয়া আছে। মুখে শব্দ নাই, চোখে একফৌটা জল নাই । কেহ তাহাকে ধরিতেছে না__ কেহ সান্ত্বনা দিবার প্রয়াস করিতেছে না। মধুসূদন ঘোষ নিকটে গিয়া একবার বলিতে গিয়াছিল,__তা বাবা
কপালে
দেবদাস হাত দিয়া দ্বিজদাসের দিকটা দেখাইয়া বলিল, ওখানে ।
ঘোষজা মহাশয় অপ্রতিভ হইয়া__হা, তা উনি-_কত বড় লোক, ইত্যাদি বলিতে বলিতে চলিয়া গেল। আর কেহ নিকটে আসিল না। দ্বিপ্রহর অতীত হইলে,
দেবদাস অর্ধমুহ্ছিত জননীর পদপ্রান্তে গিয়া উপবেশন করিল। সেখানে অনেকগুলো স্ত্রীলোক তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। পার্বতীর পিতামহীও উপস্থিত
ছিলেন। ভাঙ্গাগলায় সদ্যবিধবা শোকার্ত জননীকে সন্বোধন করিয়া কহিলেন, বউমা, চেয়ে দেখ মা, দেবদাস এসেচে।
দেবদাস ডাকিল, মা।
তিনি একবারমাত্র চাহিয়া বলিলেন, বাবা! তাহার পর নিমীলিত চোখের কোণ হইতে অজজ্্ অশ্রু বহিতে লাগিল । স্ত্রীলোকের দল কলম্বরে রৈ-রাই করিয়া
কীদিয়া উঠিল। দেবদাস জননীর চরণে কিছুক্ষণ মুখ ঢাকিয়া রহিল; তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল। গেল মৃত পিতার শয়নকক্ষে । চোখে জল নাই, গল্ভীর
শান্তমূর্তি। রক্তনেত্র উর্ধে স্থাপিত করিয়া ভূমিতলে বসিয়া পড়িল। যে-কেহ সে মূর্তি দেখিতে পাইলে বোধ করি ভীত হইত । কপালের দুই পার্থ উভয় শিরা
স্ফীত হইয়া রহিয়াছে, বড় বড় রুক্ষ কেশ ফুলিয়া উঠিয়াছে। তগ্তকাঞ্চনের বর্ণ কালিমাখা হইয়াছে--কলিকাতার জঘন্য অত্যাচারের পর এই দীর্ঘ রাত্রিজাগরণ,
তাহার পর পিতার মৃত্যু! এক বৎসর পূর্বে যে-কেহ তাহাকে দেখিয়াছিল__-এখন বোধ হয় তাহাকে হঠাৎ সে চিনিতে পারিত না। কিছুক্ষণের পর পার্বতীর জননী
সন্ধান করিয়া দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে আসিলেন,_-দেবদাস!
কেন খুড়ীমা?
এমন করলে ত চলবে না বাবা!
দেবদাস তাহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, কি করেচি খুড়ীমা?
খুড়ীমা তাহা বুঝিলেন, কিন্তু উত্তর দিতে পারিলেন না। দেবদাসের মাথাটা কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন,_দেব্তা-_বাবা!
কেন খুড়ীমা?
দেব্তা-চরণ-_বাবা-__
বুকের কাছে মুখ রাখিয়া দেবদাস এইবার একফৌটা অশ্রুবিসর্জন করিল ।
শোকার্ত পরিবারেরও দিন কাটে। ক্রমে প্রভাত হইল, কান্নাকাটি অনেক কমিয়া আসিল। দ্বিজদাস একেবারে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। তাহার জননীও উঠিয়া
বসিয়াছেন,_চোখ মুছিতে মুছিতে দিনের কাজ করিতেছেন। দুইদিন পরে দ্বিজদাস দেবদাসকে ডাকিয়া কহিলেন, দেবদাস, পিতার শ্রাদ্ধকার্যে কত ব্যয় করা
উচিত?
দেবদাস অগ্রজের মুখপানে চাহিয়া কহিল, যেমন উচিত বিবেচনা করেন।
না ভাই, এখন শুধু আমার বিবেচনায় চলবে না । তুমি বড় হয়েচ, তোমার মত জানা আবশ্যক ।
দেবদাস জিজ্ঞাসা করিল, কত নগদ টাকা আছে?
বাবার তবিলে দেড় লাখ টাকা জমা আছে। আমার বিবেচনায় হাজার-দশেক টাকা খরচ করলেই যথেষ্ট হবে_-কি বল?
আমি কত পাব?
দ্বিজদাস একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, তা তুমিও অর্ধেক পাবে । দশ হাজার খরচ হলে, তোমার সত্তর হাজার ও আমার সত্তর হাজার থাকবে ।
মা কি পাবেন?
মা নগদ টাকা কি করবেন? তিনি বাটার গিনী-_-আমরা প্রতিপালন করব।
দেবদাস একটু চিন্তা করিয়া বলিল, আমার বিবেচনায়, আপনার ভাগের পাচ হাজার টাকা খরচ হোক এবং আমার ভাগের পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে ।
বাকি পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে আমি পঁচিশ হাজার নেব, বাকী পঁচিশ হাজার টাকা মায়ের নামে জমা থাকবে । আপনার কি বিবেচনা হয়?
প্রথমে দ্বিজদাস যেন লঙ্জিত হইলেন; পরে কহিলেন, উত্তম কথা। কিন্তু আমার, কি জান- স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছে; তাদের বিয়ে, পৈতা দেওয়া,_-অনেক
খরচ । তা এই পরামর্শই ভাল । একটু থামিয়া বলিলেন, তা একটু লিখে দিলেই__
লেখাপড়ার প্রয়োজন হবে কি? কাজটা ভাল দেখাবে না। আমার ইচ্ছা, টাকাকড়ির কথা-_এ সময়ে গোপনেই হয়।
তা ভাল কথা; কিন্তু কি জানো ভাই-
আচ্ছা, আমি লিখেই দিচ্চি। সেইদিনই দেবদাস লেখাপড়া করিয়া দিল।
পরদিন দ্িপ্রহরে দেবদাস নীচে নামিতেছিল, সিঁড়ির পারে পার্বতীকে দেখিতে পাইয়া থমকিয়া দীড়াইল। পার্বতী মুখপানে চাহিয়াছিল-_চিনিতে যেন তাহার
ক্লেশ হইতেছিল। দেবদাস গন্তীর শান্তমুখে কাছে আসিয়া কহিল, কখন এলে পার্বতী?
সেই কণ্ঠস্বর! আজ তিন বৎসর পরে দেখা । অধোমুখে পার্বতী কহিল--সকালবেলা এসেচি।
অনেকদিন দেখা হয়নি । বেশ ভাল ছিলে?
পার্বতী মাথা নাড়িল।
চৌধুরীমশাই ভাল আছেন? ছেলেমেয়েরা সব ভাল?
সব ভাল। পার্বতী একটিবার মুখপানে চাহিয়া দেখিল। কিন্তু একটিবার জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না, তিনি কেমন আছেন-_কি করিতেছেন । এখন যে কোন
প্রশ্নই খাটে না।
দেবদাস কহিল, এখন কিছুদিন আছ ত?
হা।
তবে আর কি-_বলিয়া দেবদাস বাহিরে চলিয়া গেল।
শ্রাদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। সে কথা বলিতে গেলে অনেক লিখিতে হয়, তাই তাহাতে প্রয়োজন নাই। শ্রাদ্ধের পরদিবস পার্বতী ধর্মদাসকে নিভূতে ডাকিয়া
তাহার হাতে একগাছা সোনার হার দিয়া কহিল, ধর্ম, তোমার মেয়েকে পরতে দিয়ো__
ধর্মদাস মুখপানে চাহিয়া আর্্র চক্ষু আরো আর্দ্র করিয়া বলিল, আহা, তোমাকে কতদিন দেখিনি; সব ভাল খবর ত দিদি?
সব ভাল । তোমার ছেলেমেয়ে ভাল আছে?
তা আছে পারু।
তুমি ভাল আছ?
এইবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ধর্মদাস কহিল, কৈ আর ভাল! এইবার যেতে ইচ্ছে করে__কর্তা গেলেন। ধর্মদাস শোকের আবেগে কত কি হয়ত কহিত, কিন্তু
তাহাতে পার্বতী বাধা দিল। এ-সব সংবাদ শুনিবার জন্য সে হার দেয় নাই।
পার্বতী কহিয়া উঠিল, সে কি কথা ধর্ম, তুমি গেলে দেবদাদাকে দেখবে কে?
ধর্মদাস কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, যখন ছেলেমানুষটি ছিল, তখন দেখেচি। এখন না দেখতে হলেই বাঁচি, পারু।
পার্বতী আরও নিকটে সরিয়া আসিয়া কহিল, ধর্ম, একটি কথা সত্য বলবে?
কেন বলব না দিদি!
তবে সত্যি করে বল, দেবদা এখন কি করে?
করে আমার মাথা আর মুগু।
ধর্মদাস, খুলে বল না?
ধর্মদাস পুনরায় কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, খুলে আর কি বলব দিদি! এ কি আর বলবার কথা! এবারে কর্তা নাই, দেব্তার হাতে অগাধ টাকা হল;
এবারে কি আর রক্ষা থাকবে?
পার্বতীর মুখ একেবারে শ্ান হইয়া গেল। সে আভাসে-ইঙ্গিতে কিছু কিছু শুনিয়াছিল। শুষ্ক হইয়া কহিল, বল কি ধর্মদাসঃ সে মনোরমার পত্রে যখন কতক
শুনিয়াছিল, তখন বিশ্বাস করিতে পারে নাই। ধর্মদাস মাথা নাড়িয়া কহিতে লাগিল-_আহার নাই, নিদ্রা নাই, শুধু বোতল বোতল মদ। তিনদিন, চারদিন ধরে
কোথায় পড়ে থাকে-_ ঠিকানা নাই । কত টাকা উড়িয়ে দিলে,_শুনতে পাই, কত হাজার টাকার নাকি তাকে গয়না গড়িয়ে দিয়েচে।
পার্বতীর আপাদমস্তক কীপিয়া উঠিল- ধর্মদাস, এ-সব সত্যিঃ
ধর্মদাস নিজের মনে কহিতে লাগিল,_-তোর কথা হয়ত শুনতে পারে--একবার বারণ করে দে। কি শরীর কি হয়ে গেল--এমনধারা অত্যাচারে কণ্টা দিন বা
বীচবে? কাকেই বা এ কথা বলি? মা, বাপ, ভাই--এদের এ কথা বলা যায় না। ধর্মদাস শিরে পুনঃপুনঃ করাঘাত করিয়া বলিয়া উঠিল, ইচ্ছে করে মাথা খুঁড়ে
মরি পারু, আর বাচতে সাধ নেই।
পার্বতী উঠিয়া গেল। নারাণবাবুর মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া সে ছুটিয়া আসিয়াছিল। ভাবিয়াছিল, এ বিপদের সময় দেবদাসের কাছে যাওয়া একবার উচিত। কিন্তু,
তাহার এত সাধের দেবদাদা এই হইয়াছে! কত কথাই যে মনে পড়িতে লাগিল, তাহার অবধি নাই। যত ধিকার সে দেবদাসকে দিল, তাহার সহগুণ
আপনাকে দিল; সহস্রবার তাহার মনে হইল, সে থাকিলে কি এমন হইতে পারিত! আগেই সে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারিয়াছিল, কিন্তু, সে কুঠার এখন
তাহার মাথায় পড়িল। তাহার দেবদাদা এমন হইয়া যাইতেছে--এমন করিয়া নষ্ট হইতেছে, আর সে পরের সংসার ভাল করিবার জন্য ব্বিত! পরকে আপনার ভাবিয়া সে নিত্য অন্ন বিতরণ করিতেছে, আর তাহার সর্বস্,_-আজ অনাহারে মরিতেছে! পার্বতী প্রতিজ্ঞা করিল, আজ সে দেবদাসের পায়ে মাথা খুঁড়িয়া
মরিবে।
এখনও সন্ধ্যা হইতে কিছু বিলম্ব আছে,__পার্বতী দেবদাসের ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। দেবদাস শয্যায় বসিয়া হিসাব দেখিতেছিল, চাহিয়া দেখিল।
পার্বতী ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিয়া মেঝের উপর বসিল। দেবদাস মুখ তুলিয়া হাসিল। তাহার মুখ বিষণ্ন, কিন্তু শান্ত। হঠাৎ কৌতুক করিয়া কহিল, যদি
অপবাদ দিই?
পার্বতী সলজ্জ নীলোৎপল চক্ষু-দুটি একবার তাহার পানে রাখিয়া, পরক্ষণেই অবনত করিল। মুহূর্তে বুঝাইয়া দিল, এ কথা তাহার বুকের মাঝে চিরদিনের
জন্য শেলের মত বিধিয়া আছে। আর কেন? কত কথা বলিতে আসিয়াছিল, সব ভুলিয়া গেল । দেবদাসের কাছে সে কথা কহিতে পারে না।
আবার দেবদাস হাসিয়া উঠিল; কহিল, বুঝেচি রে, বুঝেচি। লজ্জা হচ্ছে, না?
তবুও পার্বতী কথা কহিতে পারিল না। দেবদাস কহিতে লাগিল, তাতে আর লজ্জা কি? দু'জনে মিলেমিশে একটা ছেলেমানুষী করে ফেলে_-এই দেখ
দেখি_মাঝে থেকে কি গোলমাল হয়ে গেল! রাগ করে তুই যা ইচ্ছে তাই বললি, আমিও কপালের ওপর এ দাগ দিয়ে দিলাম । কেমন হয়েচে!
দেবদাসের কথার ভিতর শ্রেষ বা বিদ্রপের লেশমাত্র ছিল না; প্রসন্ন হাসি-হাসি মুখে অতীতের দুঃখের কাহিনী । পার্বতীর কিন্তু বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
মুখে কাপড় দিয়া, নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া মনে মনে বলিল, দেবদাদা, এ দাগই আমার সান্ত্বনা, এ আমার সম্বল। তুমি আমাকে ভালবাসিতে-_তাই দয়া করে,
আমাদের বাল্য-ইতিহাস ললাটে লিখে দিয়েচ। ও আমার লজ্জা নয়, কলঙ্ক নয়, আমার গৌরবের সামগ্্রী।
পারু!
মুখ হইতে অঞ্চল না খুলিয়া পার্বতী কহিল, কি?
তোর উপর আমার বড় রাগ হয়_
এইবার দেবদাসের কণ্ঠস্বর বিকৃত হইতে লাগিল-_বাবা নাই, আজ আমার কি দুঃখের দিন; কিন্তু তুই থাকলে কি ভাবনা ছিল! বড়বৌকে জানিস ত, দাদার
স্বভাবও কিছু তোর কাছে লুকানো নেই; বল্ দেখি মাকে নিয়ে এ সময়ে কি করি! আর আমারই বা যে কি হবে, কিছুই বুঝে পাই না। তুই থাকলে নিশ্চিত
হয়ে_সব তোর হাতে ফেলে দিয়ে_ও কি রে পারু!
পার্বতী ফুঁপাইয়া কীদিয়া উঠিল।
দেবদাস কহিল, কীদছিস বুঝি? তবে আর বলা হল না।
পার্বতী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বল।
দেবদাস মুহূর্তে কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, পারু, তুই নাকি খুব পাকা গিনী হয়েচিস রে?
ভিতরে ভিতরে পার্বতী চাপিয়া অধর দংশন করিল; মনে মনে বলিল, ছাই গৃহিণী । শিমুলফুল দেবসেবায় লাগে কি?
দেবদাস হাসিয়া উঠিল; হাসিয়া কহিল-_-বড় হাসি পায়! ছিলি তুই এতটুকু--কত বড় হলি। বড় বাড়ি, বড় জমিদারি, বড় বড় ছেলেমেয়ে-আর
চৌধুরীমশাই, সবাই বড়__কি রে পারু!
চৌধুরীমশাই পার্বতীর বড় আমোদের জিনিস; তাকে মনে হইলেই তাহার হাসি পাইত | এত কষ্টেও তাই তার হাসি আসিল ।
দেবদাস কৃত্রিম গাল্টীর্যের সহিত কহিল, একটা উপকার করতে পারিস?
পার্বতী মুখ তুলিয়া কহিল, কি?
তোদের দেশে ভাল মেয়ে পাওয়া যায়?
পার্বতী ঢোক গিলিয়া, কাশিয়া বলিল-_ভাল মেয়ে? কি করবে?
পেলে বিয়ে করি। একবার সংসারী হতে সাধ হয়।
পার্বতী ভাল মানুষটির মত কহিল, খুব সুন্দরী ত?
হা, তোর মত।
আর খুব ভালমানুষ?
না, খুব ভালমানুষে কাজ নেই-_বরং একটু দুষ্ট,_-তোর মত আমার সঙ্গে যে ঝগড়া করতে পারবে।
পার্বতী মনে মনে কহিল, সে ত কেউ পারবে না দেবদাদা; কেননা তাতে আমার মত ভালবাসতে পারা চাই। মুখে কহিল, পোড়া মুখ আমার, আমার মত
কত হাজার তোমার পায়ে আসতে পেলে ধন্য হয়।
দেবদাস কৌতুক করিয়া হাসিয়া বলিল, একটি আপাততঃ দিতে পারিস দিদি?
দেবদাদা, সত্যি বিয়ে করবে?
এই যে বললাম।
শুধু এইটি সে খুলিয়া বলিল না যে, তাকে ভিন্ন এ জীবনে অন্য স্ত্রীলোকে তার প্রবৃত্তি হইবে না।
দেবদাদা, একটি কথা বলব?
কি?
পার্বতী আপনাকে একটু সামলাইয়া লইয়া কহিল, তুমি মদ খেতে শিখলে কেন?
দেবদাস হাসিয়া উঠিল, কহিল, খেতে কি কোন জিনিস শিখতে হয়ঃ
তা নয়, অভ্যাস করলে কেন?
কে বলেচে,ধর্মদাস?
যেই বলুক, কথাটা কি সত্যি? দেবদাস প্রতারণা করিল না; কহিল, কতকটা বটে।
পার্বতী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আর কত হাজার টাকার গয়না গড়িয়ে দিয়েচ, না?
দেবদাস হাসিয়া কহিল, দিইনি, গড়িয়ে রেখেচি। তুই নিবি?
পার্বতী হাত পাতিয়া বলিল, দাও। এই দেখ, আমার একটিও গয়না নেই।
চৌধুরীমশাই তোকে দেননি?
দিয়েছিলেন; আমি সমস্ত তার বড়মেয়েকে দিয়ে দিয়েচি।
তোর বুঝি দরকার নেই?
পার্বতী মাথা নাড়িয়া মুখ নীচু করিল।
এইবার সত্যই দেবদাসের চোখে জল আসিতেছিল। দেবদাস অন্তরে বুঝিতে পারিয়াছিল, কম দুঃখে আর স্ত্রীলোক নিজের গহনা খুলিয়া বিলাইয়া দেয় না।
কিন্তু চোখের জল চাপিয়া ধীরে ধীরে বলিল, মিছে কথা, পারু। কোন স্ত্রীলোককেই আমি ভালবাসিনি, কাউকেই গয়না দিইনি।
পার্বতী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, তাই আমি বিশ্বাস করি।
অনেকক্ষণ দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর পার্বতী কহিল, কিন্তু, প্রতিজ্ঞা কর-_ আর মদ খাবে না!
তা পারিনে । তুমি কি প্রতিজ্ঞা করতে পার, আমাকে আর একটিবারও মনে করবে না?
পার্বতী কথা কহিল না। এই সময়ে বাহিরে সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি হইল। দেবদাস চকিত হইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া কহিল, সন্ধ্যা হল, এখন বাড়ি যা পারু!
আমি যাব না। তুমি প্রতিজ্ঞা কর।
আমি পারিনে।
কেন পার না?
সবাই কি সব কাজ পারে?
ইচ্ছে করলে নিশ্চয় পারে।
তুমি আজ রাত্রে আমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে পার?
পার্বতীর সহসা যেন হৎস্পন্দন রুদ্ধ হইয়া গেল। অজ্ঞাতসারে অস্ফুটে মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, তা কি হয়?
দেবদাস শয্যার উপর একটু সরিয়া বসিয়া কহিল, পার্বতী, দোর খুলে দাও ।
পার্বতী সরিয়া আসিয়া, দ্বারে পিঠ দিয়া ভাল করিয়া বসিয়া বলিল, প্রতিজ্ঞা কর!
দেবদাস উঠিয়া দীড়াইয়া ধীরভাবে কহিতে লাগিল-_-পারু, জোর করিয়ে প্রতিজ্ঞা করানটা কি ভাল, না তাতে বিশেষ লাভ আছে? আজকার প্রতিজ্ঞা কাল
হয়ত থাকবে না_কেন আমাকে আর মিথ্যাবাদী কর্বি?
আবার বহুক্ষণ নিঃশব্দে অতিবাহিত হইল । এমনি সময়ে কোথায় কোন ঘরের ঘড়িতে টং টং করিয়া নয়টা বাজিয়া গেল। দেবদাস ব্যস্ত হইয়া পড়িল;
কহিল, ওরে পারু, দোর খুলে দে__
পার্বতী কথা কহে না।
ও পারু-
আমি কিছুতেই যাব না, বলিয়া পার্বতী অকন্মাৎ রুদ্ব-আবেগে সেইখানেই লুটাইয়া পড়িল-_বহুক্ষণ ধরিয়া বড় কান্না কাদিতে লাগিল ঘরের ভিতর এখন
গাঢ় অন্ধকার-_কিছুই দেখা যায় না। দেবদাস শুধু অনুমান করিয়া বুঝিল, পার্বতী মাটিতে পড়িয়া কাদিতেছে। ধীরে ধীরে ডাকিল-_পারু!
পার্বতী কীদিয়া উত্তর দিল, দেবদা, আমার যে বড় কষ্ট!
দেবদাস কাছে সরিয়া আসিল । তীহার চক্ষেও জল-_কিন্তু, স্বর বিকৃত হইতে পায় নাই । কহিল, তা কি আর জানিনে রে?
দেবদা, আমি যে মরে যাচ্ছি। কখনো তোমার সেবা করতে পেলাম না-_আমার যে আজন্মের সাধ-__
অন্ধকারে চোখ মুছিয়া দেবদাস কহিল__তারও ত সময় আছে।
তবে আমার কাছে চল; এখানে তোমাকে দেখবার যে কেউ নেই!
তোর বাড়ি গেলে খুব যত্ু করবি?
আমার ছেলেবেলার সাধ! স্বর্ণের ঠাকুর! আমার এ সাটি পূর্ণ করে দাও! তারপর মরি_-তাতেও দুঃখ নেই।
এবার দেবদাসের চোখেও জল আসিয়া পড়িল।
পার্বতী পুনরায় কহিল, দেবদা, আমার বাড়ি চল।
দেবদাস চোখ মুছিয়া বলিল, আচ্ছা যাব।
আমাকে ছুঁয়ে বল, যাবে?
দেবদাস অনুমান করিয়া পার্বতীর পদপ্রান্ত স্পর্শ করিয়া বলিল, এ কথা কখনও ভুলব না। আমাকে যত্বু করলে যদি-_-তোমার দুঃখ ঘোচে-_আমি যাব ।
মরবার আগেও আমার এ কথা স্মরণ থাকবে।