shabd-logo

প্রথম পরিচ্ছেদ

7 October 2023

12 Viewed 12

একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না, উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখৃষ্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া

মাদুরের উপর বসিয়া, শ্রেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা ছড়াইয়া, হাই তুলিয়া, অবশেষে হঠাৎ খুব চিন্তাশীল হইয়া উঠিল; এবং নিমিষে স্থির করিয়া

ফেলিল যে, এই পরম রমণীয় সময়টিতে মাঠে মাঠে ঘুড়ি উড়াইয়া বেড়ানোর পরিবর্তে পাঠশালায় আবদ্ধ থাকাটা কিছু নয়। উর্বর মস্তিষ্কে একটা উপায়ও

গজাইয়া উঠিল । সে শ্রেট-হাতে উঠিয়া দীড়াইল।

 

পাঠশালায় এখন টিফিনের ছুটি হইয়াছিল। বালকের দল নানারূপ ভাবভঙ্গী ও শব্দসাড়া করিয়া অনতিদূরের বটবৃক্ষতলে ডাংগুলি খেলিতেছিল। দেবদাস

সেদিকে একবার চাহিল। টিফিনের ছুটি সে পায় না-_কেননা গোবিন্দ পণ্ডিত অনেকবার দেখিয়াছেন যে, একবার পাঠাশালা হইতে বাহির হইয়া পুনরায় প্রবেশ

করাটা দেবদাস নিতান্ত অপছন্দ করে। তাহার পিতারও নিষেধ ছিল। নানা কারণে ইহাই স্থির হইয়াছিল যে এই সময়টিতে সে সর্দার-পোড়ো ভুলোর জিম্মায়

থাকিবে।

 

এখন ঘরের মধ্যে শুধু পপ্তিত মহাশয় দিপ্রাহরিক আলস্যে চক্ষু মুদিয়া শয়ন করিয়াছিলেন এবং সর্দার-পোড়ো ভুলো এক কোণে হাত-পা ভাঙ্গা একখণ্ড

বেঞ্চের উপর ছোটখাটো পন্তিত সাজিয়া বসিয়াছিল এবং মধ্যে মধ্যে নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কখন বা ছেলেদের খেলা দেখিতেছিল, কখন বা দেবদাস এবং

পার্বতীর প্রতি আলস্য-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছিল। পার্বতী এই মাসখানেক হইল পণ্ডিত মহাশয়ের আশ্রয়ে এবং তত্ত্বাবধানে আসিয়াছে। পপ্ডিত মহাশয় সম্ভবতঃ

এই অল্পসময়ের মধ্যেই তাহার একান্ত মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন, তাই সে নিঝিষ্টমনে, নিরতিশয় ধৈর্যের সহিত সুপ্ত পণ্ডিতের প্রতিকৃতি বোধোদয়ের শেষ

পাতাটির উপর কালি দিয়া লিখিতেছিল এবং দক্ষ চিত্রকরের ন্যায় নানাভাবে দেখিতেছিল যে, তাহার বহু-যত্তের চিত্রটি আদর্শের সহিত কতখানি মিলিয়াছে।

বেশী যে মিল ছিল তাহা নয়; কিন্তু পার্বতী ইহাতেই যথেষ্ট আনন্দ ও আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিতেছিল।

 

এই সময় দেবদাস শ্রেট-হাতে উঠিয়া দীড়াইল এবং ভুলোর উদ্দেশে ডাকিয়া বলিল, অঙ্ক হয় না।

 

ভুলো শান্ত গন্ভীরমুখে কহিল, কি আক?

 

মণকষা_

 

শেলেটটা দেখি__

 

ভাবটা এই যে, তাহার নিকট এ-সব কাজে শ্রেটখানি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। দেবদাস তাহার হাতে শ্রেট দিয়া নিকটে দীড়াইল। ভুলো ডাকিয়া

লিখিতে লাগিল যে, এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে এমনি সময়ে একটা ঘটনা ঘটিল। হাত-পা-ভাঙ্গা বেঞ্চখানার উপর সর্দার-পোড়ো তাহার পদমর্যাদার উপযুক্ত আসন নির্বাচন করিয়া যথানিয়মে আজ তিন

বৎসর ধরিয়া প্রতিদিন বসিয়া আসিতেছে। তাহার পশ্চাতে একরাশি চুন গাদা করা ছিল। এটি পণ্ডিত মহাশয় কবে কোন্‌ যুগে নাকি সন্তা দরে কিনিয়া

রাখিয়াছিলেন, মানস ছিল, সময় ভাল হইলে ইহাতে কোঠা-দালান দিবেন। কবে যে সে শুভদিন আসিবে তাহা জানি না। কিন্তু এই শ্বেত-চূর্ণের প্রতি তাহার

সতর্কতা এবং যত্বের অবধি ছিল না। সংসারানভিজ্ঞ, অপরিণামদশশী কোন অলক্ষ্ী-আশ্রিত বালক ইহার রেণুমাত্র নষ্ট না করিতে পারে, এইজন্য প্রিয়পাত্র এবং

অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভোলানাথ এই সযতু-সঞ্চিত বস্তুটি সাবধানে রক্ষা করিবার ভার পাইয়াছিল এবং তাই সে বেঞ্চের উপর বসিয়া ইহাকে আগুলিয়া থাকিত।

 

ভোলানাথ লিখিতেছিল--এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে,_-ওগো বাবা গো-_তাহার পর খুব শব্দ-সাড়া হইল।

পার্বতী ভয়ানক উচ্চকণ্ঠে টেচাইয়া হাততালি দিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল । সদ্যগনিদ্রোথিত গোবিন্দ পপ্তিত রক্তনেত্রে একেবারে উঠিয়া দীড়াইলেন; দেখিলেন,

গাছতলায় ছেলের দল একেবারে সার বীধিয়া হৈহৈ শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে, এবং তখনি চক্ষে পড়িল যে, ভগ্ন বেঞ্চের উপর একজোড়া পা নাচিয়া বেড়াইতেছে এবং চুনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্যুৎপাত হইতেছে। চীৎকার করিলেন, কি_কি-_কি রে!

 

বলিবার মধ্যে শুধু পার্বতী ছিল। কিন্তু সে তখন ভূমিতলে লুটাইতেছে এবং করতালি দিতেছে। পগ্তিত মহাশয়ের বিফল প্রশ্ন ক্ুদ্ধভাবে ফিরিয়া গেল, কি কি_কি রে!

 

তাহার পর শ্বেতমূর্তি ভোলানাথ চুন ঠেলিয়া উঠিয়া দীড়াইল। পণ্ডিত মহাশয় আবার চীৎকার করিলেন, গুয়োটা তুই!-_তুই ওর ভেতর!

 

আা-_আ্টা_ আটা

 

আবার!

 

দেবা শালা-_ঠেলে-ত্যা__ত্যা-__মণকষা__

 

আবার গুয়োটা!

 

কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া, মাদুরের উপর উপবেশন করিয়া প্রশ্ন করিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে দিয়ে পালিয়েচেঃ

 

ভুলো আরো কীদিতে লাগিল-_ত্্যা_ আ্যা_আ্যা_

 

তাহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া চুন ঝাড়াঝাড়ি হইল, কিন্তু সাদা এবং কাল রঙে সর্দার-পোড়োকে কতকটা ভূতের মত দেখাইতে লাগিল এবং তখনও তাহার

ত্রন্দনের নিবৃত্তি হইল না।

 

পণ্তিত বলিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে পালিয়েচে? বটে?

 

ভুলো বলিল- জ্যা-ত্যা-_

 

পণ্তিত বলিলেন, এর শোধ নেব।

 

ভুলো কহিল,_ত্যা__আ্যা-আ্যা_

 

পণ্তিত প্রশ্ন করিলেন, ছৌড়াটা কোথায়__

 

তাহার পর ছেলেদের দল রক্তমুখে হাপাইতে হাপাইতে ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, দেবাকে ধরা গেল না। উঃ_-যে ইট ছৌড়ে-_!

ধরা গেল না?

 

আর একজন বালক পূর্বকথার প্রতিধ্বনি করিল-_উঃ_যে_

 

থাম বেটা__

 

সে ঢোক গিলিয়া একপাশে সরিয়া গেল। নিক্ষল-ক্রোধে পগ্ডিতমশাই প্রথমে পার্বতীকে খুব ধমকাইয়া উঠিলেন; তাহার পর ভোলানাথের হাত ধরিয়া

কহিলেন, চল্‌, একবার কাছাড়িবাড়িতে কর্তাকে বলে আসি।

 

ইহার অর্থ এই যে, জমিদার নারায়ণ মুখৃষ্যের নিকট তাহার পুত্রের আচরণের নালিশ করিবেন।

 

তখন বেলা তিনটা আন্দাজ হইয়াছিল। নারায়ণ মুখুয্েমশায় বাহিরে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক খাইতেছিলেন এবং একজন ভূত্য হাতপাখা লইয়া বাতাস

করিতেছিল। সছাত্র পণ্ডিতের অসময় আগমনে কিছু বিম্মিত হইয়া কহিলেন, গোবিন্দ যে!

 

গোবিন্দ জাতিতে কায়স্থ-_ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া ভুলোকে দেখাইয়া সমস্ত কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। মুখুয্যেমশায় বিরক্ত হইলেন; বলিলেন,

তাইত, দেবদাস যে শাসনের বাইরে গেছে দেখচি!

 

কি করি, আপনি হুকুম করুন।

 

জমিদারবাবু নলটা রাখিয়া দিয়া কহিলেন, কোথা গেল সে?

 

তা কি জানি? যারা ধরতে গিয়েছিল, তাদের ইট মেরে তাড়িয়েচে।

 

তাহারা দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। নারায়ণবাবু বলিলেন, বাড়ি এলে যা হয় করব।

 

গোবিন্দ ছাত্রের হাত ধরিয়া পাঠশালায় ফিরিয়া গিয়া মুখ ও চোখের ভাবভঙ্গীতে সমস্ত পাঠশালা সন্ত্রাসিত করিয়া তুলিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন যে,

দেবদাসের পিতা সে অঞ্চলের জমিদার হইলেও তাহাকে আর পাঠশালে ঢুকিতে দিবেন না। সেদিন পাঠশালার ছুটি কিছু পূর্বেই হইল; যাইবার সময় ছেলেরা

অনেক কথা বলাবলি করিতে লাগিল ।

 

একজন কহিল, উঃ! দেবা কি ষণ্তা দেখেচিস!

 

আর একজন কহিল, ভুলোকে আচ্ছা জব্দ করেচে।

 

উঃ, কি টিল ছোড়ে!

 

আর একজন ভুলোর তরফ হইতে কহিল,_ভুলো শোধ নেবে দেখিস।

 

ইস্-_সে ত আর পাঠশালায় আসবে না যে শোধ নেবে।

 

এই ক্ষুদ্র দলটির একপাশে পার্বতীও বই-শ্রেট লইয়া বাড়ি আসিতেছিল। সে নিকটবর্তী একজন ছেলের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মণি, দেবদাদাকে আর

পাঠশালায় সত্যি আসতে দেবে না?

 

মণি বলিল, না__কিছুতেই না।

 

পার্বতী সরিয়া গেল__কথাটা তার বরাবরই ভাল লাগে নাই। পার্বতীর পিতার নাম নীলকণ্ঠ চক্রবর্তী । চক্রবর্তী মহাশয় জমিদারের প্রতিবেশী অর্থাৎ মুখুয্যে মহাশয়ের খুব বড় বাড়ির পার্থ তাহার ছোট এবং পুরাতন

সেকেলে ইটের বাড়ি। তাহার দু-দশ বিঘা জমিজমা আছে, দু-চার ঘর যজমান আছে, জমিদারবাড়ির আশা-প্রত্যাশাটা আছে,__বেশ স্বচ্ছন্দ পরিবার-_বেশ দিন

কাটে।

 

প্রথমে ধর্মদাসের সহিত পার্বতীর সাক্ষাৎ হইল। সে দেবদাসের বাটার ভূত্য। এক বৎসর বয়স হইতে আজ দ্বাদশবর্ষ বয়স পর্যন্ত তাহাকে লইয়াই

আছে-_পাঠশালায় পৌছিয়া দিয়া আসে এবং ছুটির সময় সঙ্গে করিয়া বাটী ফিরাইয়া আনে । এ কাজটি সে যথানিয়মে প্রত্যহ করিয়াছে এবং আজিও সেইজন্যই

পাঠশালায় যাইতেছিল। পার্বতীকে দেখিয়া কহিল, কৈ পারু, তোর দেবদাদা কোথায়?

 

পালিয়ে গেছে__

 

ধর্মদাস ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া বলিল, পালিয়ে গেছে কি রে?

 

তখন পার্বতী ভোলানাথের দুর্দশার কথা মনে করিয়া আবার নূতন করিয়া হাসিতে শুরু করিল,__-দেখ্‌ ধন্ম, দেবদা-_হি হি হি_-একেবারে চুনের গাদায়_হি

হি-হু হু__একেবারে ধন্ম চিৎ করে__

 

ধর্মদাস সব কথা বুঝিতে না পারিলেও হাসি দেখিয়া খানিকটা হাসিয়া লইল; পরে হাস্য সংবরণ করিয়া জিদ করিয়া কহিল, বল না পারু, কি হয়েচে?

 

দেবদা ঠেলে ফেলে দিয়ে-_ভুলোকে-_চুনের গাদায়__হি হি হি-_

 

ধর্মদাস এবার বাকীটা বুঝিয়া লইল এবং অতিশয় চিন্তিত হইল; বলিল, পারু সে এখন কোথায় আছে জানিস?

 

আমি কি জানি!

 

তুই জানিস-__বলে দে। আহা তার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েচে।

 

তা ত পেয়েচে__আমি কিন্তু বলব না।

 

কেন বলবি নে?

 

বললে আমাকে বড় মারবে । আমি খাবার দিয়ে আসব ।

 

ধর্মদাস কতকটা সন্তুষ্ট হইল--কহিল, তা দিয়ে আসিস, আর সন্ধ্যের আগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি ডেকে আনিস।

 

আনব।

 

বাটীতে আসিয়া পার্বতী দেখিল, তাহার মা এবং দেবদাসের মা উভয়েই সব কথা শুনিয়াছেন। তাহাকেও এ কথা জিজ্ঞাসা করা হইল । হাসিয়া গন্তীর হইয়া

সে যতটা পারিল কহিল। তাহার পর আঁচলে মুড়ি বাধিয়া জমিদারদের একটা আমবাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। বাগানটা তাহাদেরই বাটীর নিকটে, এবং

ইহারই একান্তে একটা বাঁশঝাড় ছিল। সে জানিত, লুকাইয়া তামাক খাইবার জন্য দেবদাস এই বাশঝাড়ের মধ্যে কতকটা স্থান পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিল।

পলাইয়া লুকাইয়া থাকিতে হইলে ইহাই তাহার গরপ্তস্থান। ভিতরে প্রবেশ করিয়া পার্বতী দেখিল, বাশঝোপের মধ্যে দেবদাস ছোট একটা হুকা-হাতে বসিয়া

আছে এবং বিজ্ঞের মত ধূমপান করিতেছে। মুখখানা বড় গন্তীর__যথেষ্ট দুর্তাবনার চিহ্ন তাহাতে প্রকাশ পাইতেছে। পার্বতীকে দেখিতে পাইয়া সে খুব খুশী

হইল, কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করিল না। তামাক টানিতে টানিতে গল্ভীরভাবেই কহিল, আয়।

পার্বতী কাছে আসিয়া বসিল। আঁচলে যাহা বাধা ছিল, তৎক্ষণাৎ দেবদাসের চক্ষে পড়িল। কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সে তাহা খুলিয়া খাইতে আরন্ত

করিয়া কহিল, পারু, পপ্ডিতমশাই কি বললে রে?

 

জ্যঠামশায়ের কাছে বলে দিয়েচে।

 

হা।

 

তারপর?

 

তোমাকে আর পাঠশালায় যেতে দেবে না।

 

আমি পড়তেও চাই না।

 

এই সময়ে তাহার খাদ্যদ্রব্য প্রায় ফুরাইয়া আসিল, দেবদাস পার্বতীর মুখপানে চাহিয়া বলিল, সন্দেশ দে।

 

সন্দেশ তআনিনি।

 

তবে জল দে।

 

জল কোথায় পাব?

 

বিরক্ত হইয়া দেবদাস কহিল, কিছুই নেই, ত এসেচিস কেন? যা, জল নিয়ে আয়।

 

তাহার রুক্ষস্বর পার্বতীর ভাল লাগিল না; কহিল, আমি আবার যেতে পারিনে-_তুমি খেয়ে আসবে চল।

 

আমি কি এখন যেতে পারি?

 

তবে কি এইখানেই থাকবে?

 

এইখানে থাকব, তারপর চলে যাব__

 

পার্বতীর মনটা খারাপ হইয়া গেল। দেবদাসের আপাত-বৈরাগ্য দেখিয়া এবং কথাবার্তা শুনিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছিল,_-কহিল, দেবদা, আমিও

যাব।

 

কোথায়? আমার সঙ্গে? দূর__তা কি হয়?

 

পার্বতী মাথা নাড়িয়া কহিল, যাবই-_

 

না,__যেতে হবে না__তুই আগে জল নিয়ে আয়__

 

পার্বতী আবার মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি যাবই-__

 

আগে জল নিয়ে আয়__

 

আমি যাব না-_তুমি তা হলে পালিয়ে যাবে।

 

না-যাব না।

কিন্তু পার্বতী কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিল না, তাই বসিয়া রহিল। দেবদাস পুনরায় হুকুম করিল, যা বলচি!

 

আমি যেতে পারব না।

 

রাগ করিয়া দেবদাস পার্বতীর চুল ধরিয়া টান দিয়া ধমক দিল-_যা বলচি।

 

পার্বতী চুপ করিয়া রহিল । তারপর তাহার পিঠে একটা কিল পড়িল-_যাবিনে?

 

পার্বতী কীদিয়া ফেলিল__আমি কিছুতেই যাব না।

 

দেবদাস একদিকে চলিয়া গেল। পার্বতীও কীদিতে কীদিতে একেবারে দেবদাসের পিতার সুমুখে আসিয়া উপস্থিত হইল মুখুয্যেমশাই পার্বতীকে বড়

ভালবাসিতেন। বলিলেন, পারু, কীদচিস কেন মা?

 

দেবদা মেরেচে।

 

কোথায় সে?

 

এ বাশবাগানে বসে তামাক খাচ্ছিল।

 

একে পগ্ডিত মহাশয়ের আগমন হইতেই তিনি চটিয়া বসিয়াছিলেন_-এখন এই সংবাদটা তাহাকে একেবারে অগ্নিমূর্তি করিয়া দিল। বলিলেন, দেবা বুঝি

আবার তামাক খায়?

 

হা খায়, রোজ খায়। বাশবাগানে তার ইকো নুকোন আছে__

 

এতদিন আমাকে বলিস নি কেন?

 

দেবদাদা মারবে বলে।

 

কথাটা কিন্তু ঠিক তাই নহে। প্রকাশ করিলে দেবদাস পাছে শান্তি ভোগ করে, এই ভয়ে সেকোন কথা বলে নাই। আজ কথাটা শুধু রাগের মাথায় বলিয়া

 

দিয়াছে। এই তাহার সবে আট বৎসরমাত্র বয়স-_রাগ এখন বড় বেশী; কিন্তু তাই বলিয়া তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা নিতান্ত কম ছিল না। বাড়ি গিয়া বিছানায় শুইয়া

অনেকক্ষণ কীদিয়া-কাটিয়া ঘুমাইয়া পড়িল,-__-সে রাত্রে ভাত পর্যন্ত খাইল না।

 

 

 

 

 

 

 

16
Articles
দেবদাস
0.0
"দেবদাস" প্রখ্যাত বাঙালি লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি কালজয়ী ক্লাসিক। এই মর্মস্পর্শী আখ্যানটি দেবদাসের করুণ কাহিনি, অপ্রত্যাশিত প্রেমের দ্বারা গ্রাস করা এক যুবককে নিয়ে আসে। 20 শতকের গোড়ার দিকে স্থাপিত, গল্পটি ঔপনিবেশিক ভারতে সামাজিক নিয়ম এবং শ্রেণীগত পার্থক্যগুলির জটিলতাগুলি অন্বেষণ করে। বইটি স্পষ্টভাবে মদ্যপান এবং হতাশার মধ্যে দেবদাসের আত্ম-ধ্বংসাত্মক বংশদ্ভুত চিত্রিত করে, পারোর প্রতি তার প্রেম এবং পারিবারিক চাপের কারণে তাকে বিয়ে করতে না পারা থেকে উদ্ভূত। শরৎচন্দ্রের উদ্দীপনামূলক গল্প বলার এবং গভীর চরিত্রের অন্বেষণ "দেবদাস" কে একটি স্থায়ী সাহিত্যিক মাস্টারপিস করে তোলে, প্রেম, ক্ষতি এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতার থিমগুলিকে উস্কে দেয় যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাঠকদের সাথে অনুরণিত হতে থাকে।
1

প্রথম পরিচ্ছেদ

7 October 2023
1
0
0

একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না, উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখৃষ্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া, শ্রেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা

2

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

দেবদাসকে পরদিন খুব মারধর করা হইল-_সমস্তদিন ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইল। তাহার পর, তাহার জননী যখন ভারী কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন, তখন দেবদাসকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পরদিন ভোরবেলায় সে পলাইয়া আসিয়া পার্ব

3

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

দিনের পর দিন যায়__এ দুটি বালক-বালিকার আমোদের সীমা নাই-_সমস্ত দিন ধরিয়া রোদে রোদে ঘুরিয়া বেড়ায়, সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিয়া মারধর খায়, আবার সকালবেলায় ছুটিয়া পলাইয়া যায়__আবার তিরক্কার-প্রহার

4

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

7 October 2023
1
0
0

এমনি করিয়া এক বৎসর কাটিল বটে, কিন্তু আর কাটিতে চাহে না। দেবদাসের জননী বড় গোলযোগ করিতে লাগিলেন । স্বামীকে ডাকিয়া বলিলেন, দেবা যে মুখ্য চাষা হয়ে গেল,__-একটা যা হয় উপায় কর। তিনি ভাবিয়া বলিলেন,

5

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

7 October 2023
0
0
0

পার্বতী এই তের বছরে পা দিয়াছে_-ঠাকুরমাতা এই কথা বলেন। এই বয়সে শারীরিক সৌন্দর্য অকম্মাৎ যেন কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া কিশোরীর সর্বাঙ্গ ছাইয়া ফেলে। আত্মীয়স্বজন হঠাৎ একদিন চমকিত হইয়া দেখিতে পান যে,

6

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

রাত্রি বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছে । তখনও স্লান জ্যোৎস্না আকাশের গায়ে লাগিয়া আছে। পার্বতী বিছানার চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া ধীরপদবিক্ষেপে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া আসিল। চারিদিকে চাহিয়া দেখিল

7

সপ্তম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

পরদিন পিতার সহিত দেবদাসের অল্পক্ষণের জন্য কথাবার্তা হইল। পিতা কহিলেন, তুমি চিরদিন আমাকে জ্বালাতন করিয়াছ, যতদিন বাঁচিব, ততদিনই জ্বালাতন হইতে হইবে । তোমার মুখে এ কথায় আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। দে

8

অষ্টম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

সতর্ক এবং অভিজ্ঞ লোকদিগের স্বভাব এই যে, তাহারা চক্ষুর নিমিষে কোন দ্রব্যের দোষগুণ সম্বন্ধে দৃঢ় মতামত প্রকাশ করে না-_সবটুকুর বিচার না করিয়া, সবটুকুর ধারণা করিয়া লয় না; দুটো দিক দেখিয়া চারিদিকের কথ

9

নবম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

আর দেবদাসঃ সে রাত্রিটা সে কলিকাতা ইডেন গার্ডেনের একটা বেঞ্চের উপর বসিয়া কাটাইয়া দিল। তাহার খুব যে ক্লেশ হইতেছিল, যাতনায় মর্মভেদ হইতেছিল, তাহা নয়। কেমন একটা শিথিল ওঁদাস্য ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে জমা

10

দশম পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

পার্বতী আসিয়া দেখিল, তাহার স্বামীর মস্ত বাড়ি। নৃতন সাহেবী ফ্যাশনের নহে, পুরাতন সেকেলে ধরনের । সদর মহল, অন্দর মহল, পূজার দালান, নাটমন্দির, অতিথিশালা, কাছারি-বাড়ি, তোশাখানা, কত দাসদাসী-_পার্বতী অবাক

11

একাদশ পরিচ্ছেদ

8 October 2023
0
0
0

তাহার পর দুই-তিনদিন দেবদাস মিছিমিছি পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল-_-অনেকটা পাগলের মত । ধর্মদাস কি কহিতে গিয়াছিল, তাহাকে চক্ষু রাঙ্গাইয়া ধমকাইয়া উঠিল। গতিক দেখিয়া চুনিলালও কথা কহিতে সাহস করিল না। ধর্মদা

12

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

দুই ভাই দ্বিজদাস ও দেবদাস ও গ্রামের অনেকেই জমিদার নারায়ণ মুখৃয্যের সৎকার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। দ্বিজদাস চীৎকার করিয়া কীদিয়া পাগলের মত হইয়াছে__পাড়ার পাচজন তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না।

13

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

পিতার মৃত্যুর পর ছয় মাস ধরিয়া ক্রমাগত বাটীতে থাকিয়া, দেবদাস একেবারে জ্বালাতন হইয়া উঠিল। সুখ নাই, শান্তি নাই, একান্ত একঘেয়ে জীবন। তার উপর ক্রমাগত পার্বতীর চিন্তা; আজকাল সব কাজেই তাহাকে মনে পড়ে ।

14

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

বৎসর-দুই হইল পার্বতী মহেন্দ্রের বিবাহ দিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়াছে । জলদবালা বুদ্ধিমতী ও কর্মপটু । পার্বতীর পরিবর্তে সংসারের অনেক কাজ সে-ই করে। পার্বতী এখন অন্যদিকে মন দিয়াছে । আজ পাঁচ বৎসর হইল তা

15

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

আজ দুই বৎসর হইতে অশথঝুরি গ্রামে চন্দরমুখী ঘর বীধিয়াছে। ছোট নদীর তীরে একটা উঁচু জায়গায় তাহার ঝরঝরে দু'খানি মাটির ঘর; পাশে একটা চালা,তাহাতে কাল রংয়ের একটা পরিপুষ্ট গাভী বাধা থাকে । ঘর-দুইটির একটিতে

16

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

10 October 2023
0
0
0

কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কিছুদিন যখন দেবদাস এলাহাবাদে বাস করিতেছিল, তখন হঠাৎ একদিন সে চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখিয়াছিল, বৌ, মনে করেছিলাম, আর কখনো ভালবাসব না। একে ত ভালবেসে শুধুহাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা, তার

---